www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

দত্তক

হ্যাঁ মিঃ ওম একটি প্রদীপ রেখে গেছেন বংশে বাতি দেবার জন্য। কিভাবে এটি হল সেটাই বলব আজ। মিঃ ওমের বিয়ে হয়েছে আজ নয় বছর। কিন্তু কোন সন্তান হয় নি এই মাড়োয়ারি দম্পতির। সস্ত্রীক ঘুরে এসেছিলেন ব্যাঙ্গালোরের ডঃ শ্রীবাস্তবের ব্যাক্তিগত চেম্বার থেকে। সমস্ত ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেল অক্ষমতা স্ত্রীর নয়। স্বামীর। সময়টা ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাস। মাড়োয়ারি পরিবারগুলি যখন দীপাবলির আলোর ঝর্ণায় ঝলমলে রাতগুলি নিজেদের মধ্যে বিতরনে ব্যস্ত তখন এই মাড়োয়ারি দম্পতি মনের গহনে এক নিরুত্তাপের বীজ নিশ্চিত করে ঘরে ফিরলেন। বাড়িতে শুধু ওমের ষাটোর্ধ মা ও স্ত্রী অনিলাদেবি। বৃদ্ধা বেশ কয়েকবার ছেলের দ্বিতীয় বিবাহ দেবার কথা মুখে এনেও বলে উঠতে পারেন নি । কারন এই তল্লাটে মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বিবাহের নজির একটিও নেই। আর তাছাড়া তার বউমা নেহাতই নিরীহ গোছের। ঘরসংসারের কাজটিকেই তিনি চরম সুখের কাজ মনে করে নত মস্তকে সম্পাদন করে চলতেন। মিঃ ওমও বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তার পরিবার নিয়ে কিন্তু সম্ভব-অসম্ভবের দোলাচালে যখন অসম্ভবের দিকেই সূচকটি স্থির হয়ে গেল তখন মনে মনে কিছুটা মুষরে পড়লেন। প্রায় দেখা যেত কাজ কর্মের মধ্যে একটা গা-ছাড়া গা-ছাড়া ভাব । বস্ত্রের হোলসেল ব্যবসায়ী মিঃ ওম নিয়মিত দোকান খুলতেন, কর্মচারী আসত, কর্মচাঞ্চল্যে সরগরম হয়ে উঠত দোকান চত্বর; তবু যেন কোন এক ভাবজগতে হারিয়ে থাকতেন তিনি।
মারোয়াড়ীদের অনেকে জাত ব্যবসায়ী বলেন। সম্ভবত যা দেখা যায়, অর্থাগমের সম্ভাব্য প্রায় সবদিকেই তারা হাত বাড়ায়। ওমের মধ্যে সেসব খুব একটা দেখা যেত না। যেন, যা আছে তাকেই তিনি নাড়াচাড়া করে এগোবার পথিক।
২০০০ সাল। সেই যে বড় বন্যার পর দীর্ঘদিন দোকান বন্ধ থাকল, তখন থেকেই যে দোকান বন্ধ হল, আজও হল কালও হল। চেনাজানা মুখগুলো কখন যে হারিয়ে যায় তা আর দ্বিতীয়বার আবির্ভূত না হলে, বা তীব্রতর প্রয়োজন না হলে, তা আমাদের মনকে খুব বেশী নাড়া দেয় না। ওম দম্পতিও এমনই এক ধোঁয়াশার আড়ালে হারিয়ে গেল, প্রতিবেশিরা বেমালুম ভুলে গেল। মাকে রেখে গেল মাসতুতো বোন নয়নার কাছে। পাঞ্জাবে।
কর্মচারী ছাঁটায়। দোকানে তালা। শুধু এক কেয়ার টেকার। জনৈক বিধবা প্রতিবেশী। মুন্নির মা। শুধু নিচেতলার রান্নাঘর আর বৈঠকখানার চাবি তার হেফাজতে।
ওম দম্পতির এহেন অন্তর্ধানের রহস্য যে যেমন করে অর্থ করে নিতে পারল তেমনভাবেই বিষয়টি স্তব্ধ হয়ে গেল।
---------
একদিন সন্ধ্যার দিকে একটি সাদা এম্বাসাডর এসে থামে ওমের বাড়ির সামনে। উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল বাড়ির চৌহদ্দি। খবর নিয়ে এল খিরু ফুচকাওালার বছর বারোর ছেলে নাড়ুগোপাল। ওম ফিরে এসেছে সস্ত্রীক। সাথে মা। আর সবচেয়ে বড় যে খবর তা হল ওমের সন্তান। পুত্র। খুশির রোল উঠল বাড়িতে। মুন্নির মায়ের তত্বাবধানে বরণ করে ঘরে ঢুকল নবজাতক।
কারোর কৌতূহল ধরে না। সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একই প্রশ্ন। “ওমের একেবারে পুত্রসহ পদার্পণ!”
যতবড়ই ঘটনা হোক প্রথমবারে তীব্রতা যতটা হয় ধীরে ধীরে তাতে ভাটা পড়ে। ক্রমে তা গা-সওয়া হয়ে ওঠে। জানবার মত সময়, স্পৃহা, মানসিকতা হারায় সময়ের ধুলো পড়ে পড়ে। এটিও তার ব্যাতিক্রম নয়।
যাই হোক, ওমের বাড়িতে খেলে উঠল খুশির হিল্লোল। যেন ডাঙ্গার মাছ পেয়ে গেল স্রোতস্বিনী জলধারা।
নামকরণ হল ঘটা করে। ভোজবাজির আয়োজন সহ খাওয়া দাওয়া হল শহরের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান বাড়ি ‘সুস্বাগতম’ হলে।  ঠাকুমা নাম দিলেন মেঘ। আদরের আতিশয্যে বড় হয়ে উঠতে থাকল মেঘ। বুকের আকাশে ভেসে বেরাতে বেরাতে মেঘ হয়ে উঠল সাবালক। স্কুলের গণ্ডী পেড়িয়ে সে এখন ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।
তবে খুশিটা যে খুব একটা চরম শিখরে পৌঁছয় নি তা ওমের মুখ দেখে প্রতিবেশীদের কেউ কেউ আঁচ করতে পেরেছিল, বিশেষত যারা ওমের সহপাঠী গোছের মানুষ। যেন কোথায় সুগন্ধিময় ফুলবাগানের মধ্যে দিয়ে চোরাগোপ্তা পথে রক্তের একটা স্রোত বয়ছে ওমের ভাবনা জুড়ে, যেন প্রকাশ করতে পারলে আরাম হয়।
একদিন ভোরের দিকে কান্নার স্রোত ভেসে এল ওমের বাড়ির দিক থেকে। জানা গেল সেরিব্রাল স্ট্রোক বছর বিয়াল্লিশের ওমের। অনিলা দেবী তো বরাবরই শান্ত স্বভাবের। নিজের মধ্যেই যেন নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টায় রত। কাজকাম মিটে গেল বন্ধুবৎসল প্রতিবেশীদের মধ্যস্থতায়।
অনিলাদেবি ভীষণ একা হয়ে গেলেন। তাঁর পিতৃকুলের তেমন ধন সম্পত্তি ছিল না যে তিনি দাপটের সঙ্গে বাপের বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন কাটাতে পারেন। বাবা নেই। আর ভাইগুলোও তেমন আঁটসাঁট সম্পর্কের মধ্যে নেই। তাই তিনি আর গেলেন না কোথাও। সদ্যমৃত স্বামীর স্মৃতি রোমন্থন করে করেই বেশির ভাগ সময় কাটাবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
ছেলের সাথে প্রায় বনিবনা না হওয়া এবং সদ্য স্বামীর মৃত্যু যেন তাঁর মধ্যে গড়ে তুলল এক অদৃশ্য ক্ষত।
তিন মাস পর শোনা গেল তিনিও মারা গেলেন। ইন্টারনাল ব্রেন হেমারেজ।

বাড়িতে রইল দুটি প্রাণী। এক পুরনো ধ্যানধারণার ঠাকুমা, আর এক নিউ জেনারেশনের নাতি। প্রায় মত বিরোধ দেখা দিত দুই প্রজন্মের মাঝে। সাধারনত যা হয়, জেনারেশন গ্যাপ।
ঠাকুমাও শক্ত হাতে হাল ধরবার মত মানুষ ছিলেন না। তাই এই পরিবারটি বইতে শুরু করল সময়ের নিজস্ব স্রোতে।
মেঘের সাথে অনেক ধুলোবালি মিশতে শুরু করল। বাড়িতে আনাগোনা শুরু হল উচ্ছন্নে যাওয়া কিছু ছেলে মেয়ের। বিড়ি, সিগারেট, গাঁজা,  মদের আখড়া হয়ে উঠল ওমের স্বপ্নের কুটির।
বৃদ্ধাও নিজেকে কোণঠাসা করতে শুরু করলেন।
একদিন যখন উপরতলায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে মেঘ উত্তাল নাচ, গান আর সুরা দেবীর আরাধনায় মত্ত, তখন বৃদ্ধা উপরতলা থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যান। হয়ে যান অচৈতন্য। কতক্ষন পড়ে ছিলেন ঠিক নেই। মুন্নির মা দুপুরের আহারাদির বাসন মাজতে যাবার সময় সিঁড়ির নিচ থেকে আসা গোঙানি অনুসরন করে এগিয়ে যান, আর সেই বৃদ্ধাকে উদ্ধার করেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল সকালে খবর আসে, বৃদ্ধা মারা গেছেন।
খুব অল্প সময়ে মারা গেলেন সেই বাড়ির তিন তিনটি জীবন। শুধু পড়ে থাকল মেঘ।
সে মেঘ যে ওমের নিজের ঔরসজাত সন্তান নয় তা এ তল্লাটের কেউ জানে না, এমনকি মেঘও নয়। প্ল্যান মাফিক সব হয়েছে।
২০০০ সালের এর বড় বন্যায় ওমের অন্তর্ধান ছিল একটা খুব সুন্দর পরিকল্পনা, একটি সন্তান দত্তক নেবার। সন্তান সংক্রান্ত ডাক্তারি পরিক্ষার পর ব্যাঙ্গালোর থেকে ফেরার পথে তারা যোগাযোগ করেছিল ঠাকুরপুকুরের এক বেসরকারি নার্সিং হোমের সাথে। কথা হয়েছিল ম্যানেজিং কমিটির সাথে যে খুব ছোট বাচ্চা তারা দত্তক নিতে চান। সেই অনুযায়ী নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা করে মিঃ ওমকে জানিয়েছিলেন। ওম দম্পতি সেখান থেকে বাচ্চাটি নেন। আর চার বছরের জন্য ভিঁটেমাটি ছাড়া? সেই দম্পতি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে  ওটি তাদের নিজস্ব সন্তান। সে জন্য কিছুটা বড় করে দেশে ফিরলে কারোর সন্দেহ হবে না, আর ওম যে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম সেই হীনমন্যতায় তাকে ভুগতে হবে না।
তারা অপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেন যাতে মেঘের জন্মরহস্য সম্পূর্ণ  অজ্ঞাত থাকে সবার কাছে। কেন ওম এটি চেয়েছিলেন? এরও একটি কারন আছে। ওমের এক ব্যবসায়িক পার্টনার ছিল, রিন্টু। সে এই দত্তক সন্তানের ভাগ্যের ব্যাপারে ভুক্তভোগী। দত্তক সন্তান যখন জানতে পারে সে এক পাপিষ্ঠার পাপের ফসল, তখন প্রায় সন্তানই সেটা সহজভাবে মেমে নিতে পারে না। চির ধরে পালিত পিতামাতার সাথে সম্পর্কে। এবং সেই চির বড়সড় ফাটলের আকার শেষে নেমে আসে অস্বস্থ্যিকর পরিবেশ। অবস্থাটা তখন হয় না-ফেলার না-গেলার। তাই ওম চান নি এমন কোন পরিস্থিতি আসুক। তাই এই গোপন সত্য কাওকে জানতে না দেবার জন্য এই চার বছরের অন্তর্ধান এবং সেই সময় বাড়ির বাইরে, নিজের সমাজের বাইরে ছেলেকে মানুষ করা। ডাক্তারি পরীক্ষার নথিপত্র এ জন্যই ফিরতি পথে রেলের ওয়াশ রুমে জ্বালিয়ে দেয় স্ত্রীর সম্মতিক্রমে। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! যাকে আনার জন্য যে দক্ষযজ্ঞের আয়োজন সে থাকল নির্ভাবনায় আর দুই কাণ্ডারি নৌকা বেয়ে রেখে গেল একটি প্রাণকে এক পাড় থেকে অরেক পাড়ে । সন্তানের জন্ম রহস্য বুকে জমা ব্যাথার তলে চাপা রেখে চলে গেল অমরালোকে। ‘আমাদের সন্তানের উপর কোন আঁচ, কারোর দিক থেকেই যেন কোনোদিন না আসে’, এই কথাগুলি ভেবে ভেবেই বুঝি তারা মৃত্যুর গান গায়বার সাহস সঞ্চয় করেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে কোন গুপ্ত কথা নিয়ে শ্বাস চালান যে কতটা কষ্টকর এবং আরও কত কষ্টের সেটা চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা, তা বুঝি অন্তর্যামীই জানেন।  না জানি কি পরিমাণ কষ্টের দোলে ফুলে উঠেছিল সেই মাতৃ পিতৃ হৃদয়!
হায় রে মানব হৃদয়! সন্তানের জন্য এত দরদ? সে ঔরসজাত হোক বা পালিত......
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৫৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/০১/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সাইদুর রহমান ১১/০২/২০১৬
    বেশ লাগলো।
  • গল্পটা দাঁড়ায় নি। প্রথম কারণ বিষয় বস্তুর মৌলিকতার অভাব , আর পরিবেশনা। তারপর আছে স্ববিরোধ আর বানান ভুল।
    • শ্যামেন্দু ৩০/১২/২০১৫
      একটু ডিটেইল দিলে আর একটু ভাল বুঝতে পারতাম।
      স্ববিরোধ কেমন ধরনের?
      • যেহেতু গল্পের নাম দত্তক , তাই সে সংক্রান্ত সাসপেন্স , শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া আজকের দিনে দত্তক নেওয়াটা সামাজিক ভাবে এতবড় কিছু বিষয় নয়।
        ১) অক্ষমতা যখন মি : ওমের , তবে তার দ্বিতীয় বিবাহের কথা আসবে কেন ?
        ২) একবার লেখা হয়েছে , চার বছর পর বাচ্চা বড় করে ফেরার কথা। আবার লেখা হয়েছে নবজাতক নিয়ে দম্পতি বাড়িতে এলেন।
        ৩) স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বিদেশে গিয়ে ধাপে ধাপে মিথ্যেটাকে সাজাতে হোত।
        ৪) বোঝাই যায় পুরো ব্যাপারটি মি :ওমের বুদ্ধিতে ও ইচ্ছেয় হয়েছে। তাহলে তার বিমর্ষ হয়ে মৃত্যু বরণ করার কারণ বোধগম্য নয়।
        ৫) পুরো গল্প পড়ে বোধ হয় পুরো গোপনীয়তার কারণ মি: ওম কে যাতে হীনমন্যতায় ভুগতে না হয়। আবার শেষে বলা হয়েছে , সন্তানের জন্য এত দরদ ?
        • শিমুল শুভ্র ১৮/০১/২০১৬
          অতি সুন্দর মন্তব্য
          এমন পাঠক একটা কবিতা এবং গল্পের জন্য অভিভাবকের মত।অনেক ধন্যবাদ সান্যাল দাদা। এমন মন্তব্য মুগ্ধকর।
 
Quantcast