পরিবর্তনশীল আধুনিকা
গল্পটি শুরু করার আগে বলে রাখা ভালো , কারুর জীবনের ঘটনা এ প্রকার হতেও পারে আর নাও পারে । তবে হলে , লেখকের দায়িত্ব খুবই কম , কারণ এ নিছক এক পুরানো বন্ধুর থেকে শোনা তারই জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । শুনে বিশ্বাস হয় না , সময়ের সাথে সাথে চেহারা এক থাকলেও মানুষ বদলে যায় কীভাবে ? কিভাবে একজন সহজে অস্বীকার করতে পারে কারুর সাহায্য , যা কোন একদিন জীবন মৃত্যুর মাঝে ঝুলে থাকা কাউকে বাঁচিয়েছিলো । আজ সে সম্পূর্ণ সুস্থ , নতুন জীবন শুরু করার মুখে । অথচ সে সুস্থ মস্তিস্ক সম্পূর্ণ এক ব্যক্তি আজ , তবু ভুলে গেছে সেদিনের শুভ কে । আজ্ঞে হ্যা ! আমার বাল্য বন্ধু শুভ দত্ত । দেখতে লম্বা , ছিমছাম চেহারা , কিন্তু ভাগ্য ততটাই ছোট । অপরের সাহায্যে কোন দিন পিছু পা হতে দেখিনি তাকে । আজ হঠাৎ দেখা ধর্মতলার মোড়ে । ব্যাস , সোজা তুলে নিয়ে গেলো আমায় তার বাড়ি , আমতলায় । বললো দু দিন থেকে যেতে হবে । না ! আবদার ফেলতে পারি নি আমি । আর এতো দিন পর কাকিমার হাতের রান্না আমিও চাই নি মিস করতে । সুতরাং থেকেই গেলাম ।
আজ শনিবার । ওদের আবার নিরামিষ । তবে কোলায়ের ডাল আর আলু পোস্ত দিয়ে ভাত ; উফ সে যেন অমৃত । এ যুগেও যে এভাবে খাওয়াতে পারে কেউ , না গেলে সে পুরোনো বাঙালিয়ানা খুঁজেই পেতাম না কোনদিন । যাই হোক , খাওয়া পর্ব শেষ । এবার বিশ্রামের পালা ।।
শীতের দুপুর , বাইরের রোদে বসে বসে দুই বন্ধুর সে এক জমজমাটি আড্ডা । বললাম , ভাই শুভ , কি করছিস এখন । সেই এম সি এ করে কলেজ ছাড়ার পর এই দেখা । অনেক বদলে গেছিস এতো বছরে ।
শুভ এক গাল হাসি মুখ করে বলে উঠল , টি সি এস এ একাউন্টস সামলাই । দারুন চাকরি । কথায় কথায় অনেক কথাই হলো , অনেক কথাই বললাম তাকে । জানলাম , স্কুলের বন্ধুরা এক এক করে বিয়ে করে নিয়েছে , সবাই প্রায় ওয়েল সেটল । রাগ হচ্ছিলো নিজের ওপর । আমরা দুই বন্ধুই বুঝি দুটো পাকা ধ্যারোস । কিছুই পারি না ।
শুভ নিজের জীবনের অনেক অন্তরঙ্গ এপিসোড শোনাচ্ছিলো । হটাৎ ওকে থামিয়ে , আমি বলে উঠলাম , হ্যারে , সেই পাগলির কি খবর । বেশ হত্চকিয়ে উঠে বসলো সে । শুভর মুখ দেখে মনে হচ্ছে , রাগে দাঁত কিরকির করছে ওর । বেশ জোরে বলে উঠলো শুভ , শুভশ্রীর কথা মুখে আনবি না আর । ওর মতো দু নম্বরি আর দুটো দেখি নি । জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম রে ওর , আজ এই পরিণাম দিলো । বেশ অবাক হলাম শুনে , যে শুভ এই শুভশ্রী কে প্রানের থেকে বেশি ভালোবাসত , যাকে ছাড়া শুভর দিন হতো না , রাত হতো না , তার সম্বন্ধে এই মন্তব্য । তাও শুভর মুখ থেকে , ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছিলো না আমার । কি এমন হয়েছিল , ঠিক করলাম এই দু দিনে জেনে ফিরবই ।
বেশ কবার এ বিষয়ে শুভকে জিজ্ঞাসাবাদ চালালাম , তবে ও এতটাই রেগে ছিল শুভশ্রীর নামে যে এক ফোঁটাও বেরোলো না ওর পেট থেকে । সুতরাং , দিবা নিদ্রা হয়ে যাক একবার , রাতে আবার ফেলু মিত্তির হওয়া যাবে ।।
সন্ধ্যে বাতি জ্বলে উঠেছে সারা আকাশ জুড়ে । এতো দিন পর দেখা শুভর সাথে আর হালকা নেশা হবে না , তা হয় নাকি । সন্ধ্যে বেলার আড্ডা তাই কে এফ সি র সাজানো বাগানেই কাটানো যাক । হাতে গোল্ড ফ্লেক বড় একটা । টেবিলে সাজানো গেলাস । অনেক দিন পর টান দিলাম । শুভর মুড দেখলাম এখন বেশ ভালো । মনে মনে গুনগুনিয়ে গান করে চলেছে । বেশ ফাইন গলা তো , আমি বলে উঠলাম । নীরব গলায় আস্তে করে শুভর জবাব , পাগলিটার এই টুকু স্মৃতি আজও রয়ে গেছে রে । বুঝলাম , ভালোবাসার ঝর্ণা এখনো ঝরে পরছে শুভর বুক থেকে , ভালো লাগলো তবে কৌতুহলটা আরো চেপে ধরলো আমাকে । দুপুরের ঘটনাটা কি নিছক কোনো ছলনা , নাকি সত্যি শুভর ঐ রূপ । জেদ চেপে ধরলো এবার , জানতেই হবে কি ব্যাপার ।।
সুরটা বেশ পরিচিত , " দেখা হলে বলে দিও আজও বেঁচে আছি "। একটু ডিসটার্ব করে শুভকে এবার একটু লেগ পুল করে বসলাম । " কিরে প্রেম যে আর ধরে না , তবে দুপুরে যে অভাবে দাঁত খিঁচিয়ে শুভশ্রী র চোদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছিলিস যে " । শান্ত ভাবে শুভ বলে উঠলো , ভালো সে আজও বাসে ওকে , বাট , সপ্তাহ আগে ও যে ভাবে ব্যবহার করেছিল শুভর সাথে , ঠিক বিশ্বাস হয়নি শুভর । এতটা বদলে গেল মেয়েটি ।
আমার ও বিশ্বাস হচ্ছিলো না , শুভর কথায় । শুভ মেয়েটির জন্য যা করেছিল , আমি তো দেখেছি । দিনের পর দিন ওর পাগলামো সামলেছে , বিয়ে না করেও মিথ্যা বরের অভিনয় চালিয়ে গেছিলো শুভ । নিজের ভালোবাসা ভুলে শুধু মেয়েটির জীবনের চিন্তা করে গেছিলো । এটা আজকের দিনে কজন করে , বলতে পারো ।।
রাত এখন দুটো বাজে , ঠিক ঘুম আসছে না । একদিকে নেশার ঘোর অন্যদিকে শুভশ্রীর আর শুভর সেই কলেজ দিনের গপ্প গুলো ভেসে উঠছে চোখের সামনে । কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে শুভশ্রী । ধপধপে ফর্সা , হেভি স্মার্ট । অন্যদিকে শুভ , লাজুক ছেলে , মেয়েদের ছোঁয়া থেকেও লজ্যা , এমন ছেলে জন্মে দেখি নি । তবে শুভশ্রীর প্রতি হেভি টান ওর । বন্ধুত্ব ও হয় , বেশ গভীর । একসাথে ওঠা বসা । দিন রাত তখন কলেজে একটাই চর্চা , শুভ আর শুভশ্রী । ভাবতেও পারছি না এই শুভ আজ ঐ নাম শুনলে রেগে যাচ্ছে । অবাক কান্ড ।।
দিন ঘুরতে লাগলো , সেদিন কলেজ ফাংশান । স্টেজে তখন শুভশ্রী উঠেছে , গান শোনাবে সে । অসাধারণ গলা , বলে বোঝাবো কি করে । আর অন্যদিকে একদম সামনের সারিতে সেই চেনা মুখ , মি.রোমিও , শুভ । ভাবতাম ব্যাটা বোর হয়ে যায় না , একেই বলে ভালোবাসা । ছেলে খেলাধুলায় ভালো , খেলার মাঠে তার চিয়ার লিডার , থাক আর বলছি না নামটা । যেন এরা মেড ফর ইচ আদার । তবে , দিন এগিয়েছে , বন্ধুত্ব আরো ঘন হয়েছে , কিন্তু শুভ আজ অবধি বলতে পারেনি তার মনের কথা শুভশ্রী কে । কে জানে কোনোদিন পারবে কি না বলতে !!
সেদিন সোমবার , কলেজের কমন রুমে শুভ দেখি বসে আছে । দু তিন বার ডাকলাম , শুনতে পেল না । কাছে গিয়ে দেখি মুখ ভার । জিজ্ঞাসা করলাম , কি হয়েছে । বললো গতকাল ও আর শুভশ্রী , সিটি সেন্টার গেছিলো । ভাবলাম এ তো ভালো খবর । শুভ তখন ও বলে চলেছে ওরা কি কি করলো , কেমন এনজয় করলো । ওর মুখ থেকেই শুনলাম , শুভশ্রী ওকে একটা শেরওয়ানি গিফট করেছে । কৌতূহল বসত: প্রশ্ন করলাম , শেরওয়ানি কেন ? এবার বেশ কাঁদো কাঁদো মুখ করে শুভ র জবাব , আগামী মাসে শুভশ্রীর বিয়ে । আমাকে বিয়ে বাড়িতে থাকতেই হবে , তাই ।
ধূস ! এতো তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে গেলো । বলার সময়টাও পেলো না ও । কেঁদে আর কি লাভ । বললাম , ছেলে কী করে ? বললো ছেলের বহরমপুরে বিশাল ব্যবসা আছে । এদিকে শুভর চোখে জল , ওদিকে আমার মনে কৌতুহল , এতো হিট জুটি তাহলে শেষ ! এদিকে আমি ভেবে চলেছি , ওদিকে দুরে বিধাতা আড়াল থেকে হেসে চলেছে ...
রাত অনেক হলো । আজ থাক , ঘুমিয়ে পরা যাক , কাল ,পরশু করে বাকিটা শোনাবো ।।
নতুন ভোর হয়েছে । আমাদের জীবনে আর গল্পের প্রাণে । শুভ দেখলাম রেডি , বললাম কোথাও যাবি নাকি ? সে বেশ ইয়ার্কি মেরে বললো , চল না চড়ে আসি একটু । একদিকে আমার মাথায় তখনও সেই অতীতের ঘোর , টিকটিকিগিরিটা তখনও থামেনি আমার মাথায় ।
শুভ কিন্তু বেশ ফ্রেস মুডে , খালি গলায় গান ধরেছে , "ক্যাইসে মুঝে তুম মিল গ্যায়ী " । ভালো লাগছে ওকে এতটা খুশি দেখে । আমিও তৈরি হয়ে নিলাম ফটাফট । আমাদের সকলের গন্তব্য , মেট্রো সিনেমা । তারপর বিগবাজারে শপিং আর বিকেলে কালকের মতোই কে এফ সি র সাজানো বাগান ।।
শুভ কাম মে দের কৈশি । আমিও তৈরি হয়ে নিলাম । শুভর বাইক তখন দুরন্ত গতিতে ছুটছে । না ! অন্য রাস্তা মনে হচ্ছে । আরে , এ যে দক্ষিণেশ্বর । গাড়িটা হটাৎ রাস্তার ধারে থামিয়ে দিলো শুভ । বেশ ভারি গলায় , শুভ বলে উঠলো , এইখানেই প্রথম শুভশ্রী কে একটা প্রপোজাল দিই । ক্যান আই কিস ইউ ? উত্তর না । আর তারপর সেই মর্মান্তিক সংবাদ শোনালো আমাকে । " আই এম গেটিং ম্যারেড বাই নেক্সট মান্থ , ইউ হ্যাব টু লিভ উইথ ফ্যামিলি । ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড । " আর তার দিন তিনেক পরেই সেই ঘটনা । সুইসাইড । এই প্রথম দেখলাম শুভর গলাটা ভারি আর চোখে জল । কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না । শুধু ওর পিঠে হাত রাখলাম একবার ।।
সারা কলেজ জুড়ে শোরগোল । এম্বুলেন্স , পুলিশ ভোরে আছে কলেজ চত্বরে । রুটিন জানতে ফোন করেছিল শুভ । ওর আবার জ্বর , কলেজে আসতে পারেনি তাই । আমিও বললাম না তাই কিছুই । কিন্তু এ খবর কি আটকে থাকে , না রাখা যায় । দু দিন ধরে শুভশ্রীর কোন খবর পাইনি শুভ , ফোনটাও তুলছে না । জ্বর গায়ে একটা অস্বস্তি ভাব তাই । কিন্তু অন্যদিকে , তখন উৎকণ্ঠা , জীবন মৃত্যুর লড়াই লড়ছে শুভশ্রী । ডাক্তার ৭২ ঘন্টা টাইম দিয়েছে । কিছুই হতে পারে যে কোন মুহূর্তে । হাসপাতাল জুড়ে ভিড়ে ভিড় । ছাত্র , ছাত্রী , গার্জেন , টিচার পুলিশ সবাই অপেক্ষায় , কখন জেগে উঠবে শুভশ্রী । সবাই রয়েছে সেদিন , নেই শুধু শুভ আর দূরে বসে বসে আমার একটাই চিন্তা , কি করলো এটা শুভশ্রী , আর কেনই বা করলো ? কদিন পর বিয়ে আর...ছি: ছি:... এসব কেউ করে ! এক একবার মনে হচ্ছিলো শুভ এর জন্যে দায়ী নয়তো । আবার এই ভেবে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম যে ছেলেটা কদিন আগে স্কুল রিইইউনিয়ণ পার্টি তে মদ্যপ অবস্থায় থাকা শর্মিলাকে সেবা করে যে ভাবে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিলো , সে কিছু করেছে , মানতে পারলাম না ।।
দেখতে দেখতে তিন দিন কাটলো , হোস ফিরলো শুভশ্রীর । সবার মুখে একটা খুশির ভাব দেখা যাচ্ছিল যখন ডাক্তার বেরিয়ে এসে এই খবরটা দিলো । সবাই তখন শুভশ্রী কে একবার দেখা করার জন্য ব্যাকুল , এদিকে বাঁধ সাধলো ডাক্তার । ঘোষণা হলো , শুভশ্রী সবার আগে শুভর সাথে দেখা করতে চায় ।
পরিবারের মুখে একটা অবাক হয়ে চেয়ে থাকার ছাপ , কে এই শুভ ? শুভশ্রীর সাথে ওর কি সম্পর্ক ? আর বাকিদের মুখে একটাই প্রশ্ন , সত্যি তো শুভ কোথায় ? এদিকে আমি তখনও ভাবছি , শুভকে কি একটা খবর দেব ।
এরই মাঝে দূরে একটা চেনা মুখ দেখলাম বলে মনে হলো , একটা চেনা গলা খুঁজছে যেন শুভশ্রীকে । এতো আতঙ্কের মাঝেও সবার নজর তখন সেই মুখটাতে এসে আটকালো , আর আমি অবাক দেখলাম যে শুভ হাজির । তবে, কে বলল ওকে শুভশ্রীর খবর !!
সত্যি সত্যি ওটা শুভ ছিল । আস্তে আস্তে রুমে ঢুকলো সে । শুভশ্রী তখন চোখ বুঝে শুয়ে আছে । শুভর ছোয়ায় চোখ খুললো । চোখ দুটো জলে ভর্তি , ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে । কাঁদতে কাঁদতে শুভর হাত দুটো চেপে ধরলো সে । অনবরত এক কথা , কেন তাকে বাঁচানো হলো , সে ওর কাছে যেতে চায় । শুভর মাথা যেন বন বন করে ঘুরছে । কি বলছে এ সব , কি হচ্ছে এ সব । রুম থেকে বেরিয়ে এলো শুভ । ওর মা কে ডেকে বললো একে বিষ দিতে বলুন আর ওর মৃত্যুর সমস্ত দায়িত্ব আমি নিলাম । সবাই অবাক , এসব আবার কি উল্টো পাল্টা বকছে ছেলেটি ।।
এদিকে তখন শুভশ্রীর মায়ের চোখেও জল । কিছুক্ষন এই ইমোশনাল সিন চললো । তারপর মায়ের মুখ থেকে যা শুনলাম , আমরা সবাই তো অবাক ! কি বলছেন উনি । শুভশ্রীর যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা , সে অলরেডি দেড , তাও চার বছর আগে ।।
দক্ষিনেস্বর ছেড়ে আমরা এখন কফি হাউসে । আড্ডা আর গান , পুরো মেজাজে চলছে । হটাৎ বেশ নস্টালজিক হয়ে শুভ আমাকে বলে উঠলো , জানিস সেই ছেলেটি , আরে বহরমপুরের যার সাথে পাগলির বিয়ে হতো , তার দাদার সাথে সেদিন কথা হচ্ছিল । শুভশ্রী নতুন বিয়ে করেছে , মুম্বাইতে আছে । শুনেও ভালো লাগলো , মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠেছে । তবে এর পুরো কৃত্বিত্ব একা শুভর । মেয়েটি যেদিন সুসাইড করে তার কয়েক দিন আগেই সে ছেলেটির মৃত্যুর ব্যাপারে জানতে পারে । তারপর রাতে হোস্টেলের রুমে বসে লিকুইড মোরটিন খেয়ে নিয়েছিল । ছেলেটিকে খুব ভালোবাসতো নাকি শুভশ্রী । এ সবই সেদিন হাসপাতালে তার মায়ের মুখ থেকে শোনা ।।
এদিকে শুভকে এক কোনায় নিয়ে এসে আমি জানতে চাইলাম যে ওকে এ বিষয়ে কে বলল । জানলাম , ও শুভশ্রী কে ফোনে দুদিন না পেয়ে ওর বান্ধবি তৃষা আগারওয়াল কে ফোন করে । ওই বলে যে শুভশ্রী নে সুসাইড কিই হ্যায় । এই খবর পেয়ে আর থাকতে পারে নি শুভ । ভোরের ট্রেনে চলে আসে সোজা হাসপাতালে আর বাকিটা তো শুনলেনই আগে । তবে শুভর সেদিনের ঐ মৃত্যু দায়িত্ব তুলে নেওয়া আমার একদম ভালো লাগে নি । আর বাড়াবাড়ি যাতে না করতে পারে , তাই ওকে নিজে সোজা বাড়ি চলে এলাম ।।
এদিকে বাড়িতে আরেক কান্ড । এসব ঘটনা শুনে শুভর বাবা তো রেগে আগুন । বলেই বসলেন , এবার কিছু হলে ছেলেকে পুলিশে তুলবে , দেখো ছেলের কান্ড । শুভর মা কিন্তু কিচ্ছু বললো না । ছেলেকে কতটা ভালোবাসে তা আজ রাতের খাওয়ার টেবিলে বুঝে গেলাম । মাংস করেছেন , তবে ছেলে খাসি ভালো বাসে তাই তার জন্য আলাদা রান্না হয়েছে । আমার জন্য নিরামিষ কারণ আমি আবার ওসব খাই না আজকাল ।।
রাত কাটলেই চলে যেতে হবে । তাই ব্যাগ টা গুছিয়ে রাখলাম । রাতে জমিয়ে আড্ডা হলো আজ । নতুন পুরোনো কত কথা , আর এই প্রথম শুভর মুখ থেকে শুনলাম শুভশ্রী কিভাবে তাকে অপমান করেছে । খুব খারাপ লাগলো শুনে । সাথে মনে হলো মানুষ কিভাবে পাল্টে যায় । পয়সা সবাইকে পাল্টে দেয় । সত্যি বড়োই বিচিত্র এ নিয়ম !!
রাত থেকেই জ্বর । কাল যে যাওয়া হচ্ছে না এটা তো সিওর । তবে রাত ভর এই পাগলামটা শুভ যে কি করে সহ্য করেছে তাই ভাবছি । অবশ্য এটাই প্রথম বার নয় । শুভশ্রীকেও ঠিক এই একই ভাবে সামলেছিলো শুভ । তাও দিনের পর দিন । ওর ক্রেডিট আছে বলতে হয় । এমনি অনেক কিছুই ভাবছি , এদিকে চায়ের কাপ হাতে হাজির শুভ । একদম নিজের স্টাইলে বলে উঠলো , টি ব্রেক ।।
চা খেতে খেতে অনেক ভাবনাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো । এবার আর পারলাম না চেপে
রাখতে । জিজ্ঞাসা করেই বসলাম শুভকে , তুই কি সত্যি শুভশ্রী কে লাইক করতিস ? বেশ চাপা গলায় উত্তর এলো হুম । আমি বললাম , তবে এত দিন শুধু অভিনয় করে গেলি কেন ? ওর মায়ের কাছে একবার মন খুলে বলতেই পারতিস !
শুভর গলাটা বেশ নরম মনে হলো । শুভশ্রীর সঙ্গে হবু স্বামীর অভিনয়টা তার কাছেও বেশ কষ্টকর ছিল এটুকু তো বুঝি , বাট , কি করে পারলো সে এই অভিনয় করতে । শুভ বললো , সেদিন ওর মা আর ডাক্তার বাবুর রিকুয়েস্ট ফেলতে পারিনি । শুরু করি শুভশ্রীকে সুস্থ করার অভিনয় । ওর মন থেকে সুইসাইড এর ভূত নামানোর অভিনয় । ওর কত চাহিদা হাসিমুখে পূরণ করেছি কে জানে , শুধু শরীর বাদ দিয়ে ।
জ্বর গায়ে শুনছি আর কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে । দিনে কত বার ফোন করতাম ,হিসাব নেই । যা তা বলে যেতাম , আর এটা কাজও করছিলো । ডাক্তার বললো এতো কুইক রিকভারি কোনোদিন দেখেনি সে , কিন্তু আমি তো জানি , কিছুই উন্নতি হয় নি । নাহলে সেদিন , বিগবাজারে দাঁড়িয়ে শুভশ্রী আবার সুসাইড করবে বলে । বেশ অবাক করার হলেও এটাই সত্যি ।
এর পর কলেজ শেষ হলো ওদের এক মর্মান্তিক ভাবেই । শুভ পাস করলেও শুভশ্রীর পাস করা আর হলো না । আর এর পর শুভশ্রী আর এগোতেও চাইলো না ।। শুভ বেশ হারে হারে টের পাচ্ছিলো যে কেসটা বেশ জন্ডিস । কোন রাস্তাও পাচ্ছিলো না । শুরু হলো কাকিমার কাছে আরেক অভিনয় যে শুভশ্রী সম্পূর্ণ সুস্থ । ওকে বিবিএ ও এম বি এ পড়তে সাউথে পাঠিয়ে দেওয়া হোক । এটাই যেন ওকে সুস্থ করার শেষ উপায় শুভ দেখতে পাচ্ছিলো আর শুভশ্রীকে বোঝানোর দায়িত্ব শুভ নিজে নিলো ।।
না , দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে । আজ মেনু মাছের মাথা , তবে ওই যে বলেছিলাম যে আমি নিরামিশি , তাই আমার জন্য স্পেশাল ধোঁকার ডালনা হয়েছে । খেয়ে উঠে আর শরীর চলছিল না । অতএব , ফেলু মিত্তির কে সরিয়ে রেখে এক ঘুম এই দুপুরে ।।
রাত কেটে ভোর হল ।। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে শুভর গাড়ির পিছনে সোজা ধর্মতলা ।। বাস ছাড়বে ঠিক ৮.২০ ।। বাসের টিকিট কেটে দিলো শুভ নিজে , আমাকে পেমেন্ট করতেও দিলো না ।। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল আজ ও স্বাধীন ।। কারণ আজ ও এ জঙ্গলে এক নতুন পরিবার গড়ার কথা ভাবছে , সঙ্গী হিসাবে পেয়েছে এক বাঘিনী কে , দি রয়েল বেঙ্গল টাইগ্রেস ।। ভয় পাবেন না , এ বাঘিনী শুভর জীবনে নতুন প্রেম , এসেও এখনও ধরা দেয় নি ।।
অনেক কিছুই জানতাম না , আজ জেনে ফিরছি ।। সেদিন তার চিরদিনের ভালোবাসাকে বেঙ্গালুরুর মাটিতে এম বি এ করতে পাঠিয়ে দেয় শুভ নিজে ।। নিজে বসে থেকে শুভশ্রীকে রাজি করায় সে ।। বিমান বন্দরের সেদিন আর এক মাস আগেকার দিনটা মোটেও এক ছিল না ।। সেইদিন শুভশ্রী ছিল শুভর নয়নের মনি আর এই মাস খানেক আগে কলকাতায় যখন ফিরলো তখন তার হাতে অন্য একটি হাত ।। বিয়ে করেছে শুভশ্রী ।
শুভর কিন্তু আগে ভাগেই এয়ারপোর্টে হাজির হয় ।। তবে , তাকে দেখেও না দেখার ভান করে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় শুভশ্রী ।। আমি বসে আছি বাসে , কিন্তু মনে মনে অনুমান করতে পারছি কতটা কষ্ট পেয়েছিল শুভ ।।
বিকেলে ফোন করলে শুভশ্রী তাকে চিনতে অস্বীকার করে এবং সতর্ক করে দেয় যে এর পর ফোন এলে বা ডিস্টার্ব করলে সে এফ আই আর করবে শুভর নামে ।। শুভ কিছু বলেনি সেদিন , কাউকে না ।। হয়তো আমাকেও বলতো না যদি কাল রাতে প্রচন্ড চাপ দিয়ে ঝগড়া না করতাম ।।
আই এম সরি , শুভ ।। ঝগড়া না করে উপায় ছিল না রে ।।
শুধু শুভশ্রীর শেষ কথাগুলো ... না , আজও ভোলেনি শুভ ।। 'সেবা করেছে বলে গায়ে পরার কি আছে , দাম টা নিয়ে নিলেই পারে '?
আমার বাস আসানসোল ঢুকছে ।। একটু পরে নেমে যাবো , রোজকার কাজে ভুলেই যাবো হয়তো এত ঘটনা , তাই লিখে ফেললাম ।। কিছু মনে করিস না ভাই ।। তোর মতন ভালো ছেলের জীবনে ভালোই হবে ।। যে খারাপ তাকে যেতে দে ।।
দূর থেকে মনে মনে শুধু এটুকুই বলে যাচ্ছিলাম ।।
আজ শনিবার । ওদের আবার নিরামিষ । তবে কোলায়ের ডাল আর আলু পোস্ত দিয়ে ভাত ; উফ সে যেন অমৃত । এ যুগেও যে এভাবে খাওয়াতে পারে কেউ , না গেলে সে পুরোনো বাঙালিয়ানা খুঁজেই পেতাম না কোনদিন । যাই হোক , খাওয়া পর্ব শেষ । এবার বিশ্রামের পালা ।।
শীতের দুপুর , বাইরের রোদে বসে বসে দুই বন্ধুর সে এক জমজমাটি আড্ডা । বললাম , ভাই শুভ , কি করছিস এখন । সেই এম সি এ করে কলেজ ছাড়ার পর এই দেখা । অনেক বদলে গেছিস এতো বছরে ।
শুভ এক গাল হাসি মুখ করে বলে উঠল , টি সি এস এ একাউন্টস সামলাই । দারুন চাকরি । কথায় কথায় অনেক কথাই হলো , অনেক কথাই বললাম তাকে । জানলাম , স্কুলের বন্ধুরা এক এক করে বিয়ে করে নিয়েছে , সবাই প্রায় ওয়েল সেটল । রাগ হচ্ছিলো নিজের ওপর । আমরা দুই বন্ধুই বুঝি দুটো পাকা ধ্যারোস । কিছুই পারি না ।
শুভ নিজের জীবনের অনেক অন্তরঙ্গ এপিসোড শোনাচ্ছিলো । হটাৎ ওকে থামিয়ে , আমি বলে উঠলাম , হ্যারে , সেই পাগলির কি খবর । বেশ হত্চকিয়ে উঠে বসলো সে । শুভর মুখ দেখে মনে হচ্ছে , রাগে দাঁত কিরকির করছে ওর । বেশ জোরে বলে উঠলো শুভ , শুভশ্রীর কথা মুখে আনবি না আর । ওর মতো দু নম্বরি আর দুটো দেখি নি । জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম রে ওর , আজ এই পরিণাম দিলো । বেশ অবাক হলাম শুনে , যে শুভ এই শুভশ্রী কে প্রানের থেকে বেশি ভালোবাসত , যাকে ছাড়া শুভর দিন হতো না , রাত হতো না , তার সম্বন্ধে এই মন্তব্য । তাও শুভর মুখ থেকে , ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছিলো না আমার । কি এমন হয়েছিল , ঠিক করলাম এই দু দিনে জেনে ফিরবই ।
বেশ কবার এ বিষয়ে শুভকে জিজ্ঞাসাবাদ চালালাম , তবে ও এতটাই রেগে ছিল শুভশ্রীর নামে যে এক ফোঁটাও বেরোলো না ওর পেট থেকে । সুতরাং , দিবা নিদ্রা হয়ে যাক একবার , রাতে আবার ফেলু মিত্তির হওয়া যাবে ।।
সন্ধ্যে বাতি জ্বলে উঠেছে সারা আকাশ জুড়ে । এতো দিন পর দেখা শুভর সাথে আর হালকা নেশা হবে না , তা হয় নাকি । সন্ধ্যে বেলার আড্ডা তাই কে এফ সি র সাজানো বাগানেই কাটানো যাক । হাতে গোল্ড ফ্লেক বড় একটা । টেবিলে সাজানো গেলাস । অনেক দিন পর টান দিলাম । শুভর মুড দেখলাম এখন বেশ ভালো । মনে মনে গুনগুনিয়ে গান করে চলেছে । বেশ ফাইন গলা তো , আমি বলে উঠলাম । নীরব গলায় আস্তে করে শুভর জবাব , পাগলিটার এই টুকু স্মৃতি আজও রয়ে গেছে রে । বুঝলাম , ভালোবাসার ঝর্ণা এখনো ঝরে পরছে শুভর বুক থেকে , ভালো লাগলো তবে কৌতুহলটা আরো চেপে ধরলো আমাকে । দুপুরের ঘটনাটা কি নিছক কোনো ছলনা , নাকি সত্যি শুভর ঐ রূপ । জেদ চেপে ধরলো এবার , জানতেই হবে কি ব্যাপার ।।
সুরটা বেশ পরিচিত , " দেখা হলে বলে দিও আজও বেঁচে আছি "। একটু ডিসটার্ব করে শুভকে এবার একটু লেগ পুল করে বসলাম । " কিরে প্রেম যে আর ধরে না , তবে দুপুরে যে অভাবে দাঁত খিঁচিয়ে শুভশ্রী র চোদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছিলিস যে " । শান্ত ভাবে শুভ বলে উঠলো , ভালো সে আজও বাসে ওকে , বাট , সপ্তাহ আগে ও যে ভাবে ব্যবহার করেছিল শুভর সাথে , ঠিক বিশ্বাস হয়নি শুভর । এতটা বদলে গেল মেয়েটি ।
আমার ও বিশ্বাস হচ্ছিলো না , শুভর কথায় । শুভ মেয়েটির জন্য যা করেছিল , আমি তো দেখেছি । দিনের পর দিন ওর পাগলামো সামলেছে , বিয়ে না করেও মিথ্যা বরের অভিনয় চালিয়ে গেছিলো শুভ । নিজের ভালোবাসা ভুলে শুধু মেয়েটির জীবনের চিন্তা করে গেছিলো । এটা আজকের দিনে কজন করে , বলতে পারো ।।
রাত এখন দুটো বাজে , ঠিক ঘুম আসছে না । একদিকে নেশার ঘোর অন্যদিকে শুভশ্রীর আর শুভর সেই কলেজ দিনের গপ্প গুলো ভেসে উঠছে চোখের সামনে । কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে শুভশ্রী । ধপধপে ফর্সা , হেভি স্মার্ট । অন্যদিকে শুভ , লাজুক ছেলে , মেয়েদের ছোঁয়া থেকেও লজ্যা , এমন ছেলে জন্মে দেখি নি । তবে শুভশ্রীর প্রতি হেভি টান ওর । বন্ধুত্ব ও হয় , বেশ গভীর । একসাথে ওঠা বসা । দিন রাত তখন কলেজে একটাই চর্চা , শুভ আর শুভশ্রী । ভাবতেও পারছি না এই শুভ আজ ঐ নাম শুনলে রেগে যাচ্ছে । অবাক কান্ড ।।
দিন ঘুরতে লাগলো , সেদিন কলেজ ফাংশান । স্টেজে তখন শুভশ্রী উঠেছে , গান শোনাবে সে । অসাধারণ গলা , বলে বোঝাবো কি করে । আর অন্যদিকে একদম সামনের সারিতে সেই চেনা মুখ , মি.রোমিও , শুভ । ভাবতাম ব্যাটা বোর হয়ে যায় না , একেই বলে ভালোবাসা । ছেলে খেলাধুলায় ভালো , খেলার মাঠে তার চিয়ার লিডার , থাক আর বলছি না নামটা । যেন এরা মেড ফর ইচ আদার । তবে , দিন এগিয়েছে , বন্ধুত্ব আরো ঘন হয়েছে , কিন্তু শুভ আজ অবধি বলতে পারেনি তার মনের কথা শুভশ্রী কে । কে জানে কোনোদিন পারবে কি না বলতে !!
সেদিন সোমবার , কলেজের কমন রুমে শুভ দেখি বসে আছে । দু তিন বার ডাকলাম , শুনতে পেল না । কাছে গিয়ে দেখি মুখ ভার । জিজ্ঞাসা করলাম , কি হয়েছে । বললো গতকাল ও আর শুভশ্রী , সিটি সেন্টার গেছিলো । ভাবলাম এ তো ভালো খবর । শুভ তখন ও বলে চলেছে ওরা কি কি করলো , কেমন এনজয় করলো । ওর মুখ থেকেই শুনলাম , শুভশ্রী ওকে একটা শেরওয়ানি গিফট করেছে । কৌতূহল বসত: প্রশ্ন করলাম , শেরওয়ানি কেন ? এবার বেশ কাঁদো কাঁদো মুখ করে শুভ র জবাব , আগামী মাসে শুভশ্রীর বিয়ে । আমাকে বিয়ে বাড়িতে থাকতেই হবে , তাই ।
ধূস ! এতো তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে গেলো । বলার সময়টাও পেলো না ও । কেঁদে আর কি লাভ । বললাম , ছেলে কী করে ? বললো ছেলের বহরমপুরে বিশাল ব্যবসা আছে । এদিকে শুভর চোখে জল , ওদিকে আমার মনে কৌতুহল , এতো হিট জুটি তাহলে শেষ ! এদিকে আমি ভেবে চলেছি , ওদিকে দুরে বিধাতা আড়াল থেকে হেসে চলেছে ...
রাত অনেক হলো । আজ থাক , ঘুমিয়ে পরা যাক , কাল ,পরশু করে বাকিটা শোনাবো ।।
নতুন ভোর হয়েছে । আমাদের জীবনে আর গল্পের প্রাণে । শুভ দেখলাম রেডি , বললাম কোথাও যাবি নাকি ? সে বেশ ইয়ার্কি মেরে বললো , চল না চড়ে আসি একটু । একদিকে আমার মাথায় তখনও সেই অতীতের ঘোর , টিকটিকিগিরিটা তখনও থামেনি আমার মাথায় ।
শুভ কিন্তু বেশ ফ্রেস মুডে , খালি গলায় গান ধরেছে , "ক্যাইসে মুঝে তুম মিল গ্যায়ী " । ভালো লাগছে ওকে এতটা খুশি দেখে । আমিও তৈরি হয়ে নিলাম ফটাফট । আমাদের সকলের গন্তব্য , মেট্রো সিনেমা । তারপর বিগবাজারে শপিং আর বিকেলে কালকের মতোই কে এফ সি র সাজানো বাগান ।।
শুভ কাম মে দের কৈশি । আমিও তৈরি হয়ে নিলাম । শুভর বাইক তখন দুরন্ত গতিতে ছুটছে । না ! অন্য রাস্তা মনে হচ্ছে । আরে , এ যে দক্ষিণেশ্বর । গাড়িটা হটাৎ রাস্তার ধারে থামিয়ে দিলো শুভ । বেশ ভারি গলায় , শুভ বলে উঠলো , এইখানেই প্রথম শুভশ্রী কে একটা প্রপোজাল দিই । ক্যান আই কিস ইউ ? উত্তর না । আর তারপর সেই মর্মান্তিক সংবাদ শোনালো আমাকে । " আই এম গেটিং ম্যারেড বাই নেক্সট মান্থ , ইউ হ্যাব টু লিভ উইথ ফ্যামিলি । ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড । " আর তার দিন তিনেক পরেই সেই ঘটনা । সুইসাইড । এই প্রথম দেখলাম শুভর গলাটা ভারি আর চোখে জল । কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না । শুধু ওর পিঠে হাত রাখলাম একবার ।।
সারা কলেজ জুড়ে শোরগোল । এম্বুলেন্স , পুলিশ ভোরে আছে কলেজ চত্বরে । রুটিন জানতে ফোন করেছিল শুভ । ওর আবার জ্বর , কলেজে আসতে পারেনি তাই । আমিও বললাম না তাই কিছুই । কিন্তু এ খবর কি আটকে থাকে , না রাখা যায় । দু দিন ধরে শুভশ্রীর কোন খবর পাইনি শুভ , ফোনটাও তুলছে না । জ্বর গায়ে একটা অস্বস্তি ভাব তাই । কিন্তু অন্যদিকে , তখন উৎকণ্ঠা , জীবন মৃত্যুর লড়াই লড়ছে শুভশ্রী । ডাক্তার ৭২ ঘন্টা টাইম দিয়েছে । কিছুই হতে পারে যে কোন মুহূর্তে । হাসপাতাল জুড়ে ভিড়ে ভিড় । ছাত্র , ছাত্রী , গার্জেন , টিচার পুলিশ সবাই অপেক্ষায় , কখন জেগে উঠবে শুভশ্রী । সবাই রয়েছে সেদিন , নেই শুধু শুভ আর দূরে বসে বসে আমার একটাই চিন্তা , কি করলো এটা শুভশ্রী , আর কেনই বা করলো ? কদিন পর বিয়ে আর...ছি: ছি:... এসব কেউ করে ! এক একবার মনে হচ্ছিলো শুভ এর জন্যে দায়ী নয়তো । আবার এই ভেবে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম যে ছেলেটা কদিন আগে স্কুল রিইইউনিয়ণ পার্টি তে মদ্যপ অবস্থায় থাকা শর্মিলাকে সেবা করে যে ভাবে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিলো , সে কিছু করেছে , মানতে পারলাম না ।।
দেখতে দেখতে তিন দিন কাটলো , হোস ফিরলো শুভশ্রীর । সবার মুখে একটা খুশির ভাব দেখা যাচ্ছিল যখন ডাক্তার বেরিয়ে এসে এই খবরটা দিলো । সবাই তখন শুভশ্রী কে একবার দেখা করার জন্য ব্যাকুল , এদিকে বাঁধ সাধলো ডাক্তার । ঘোষণা হলো , শুভশ্রী সবার আগে শুভর সাথে দেখা করতে চায় ।
পরিবারের মুখে একটা অবাক হয়ে চেয়ে থাকার ছাপ , কে এই শুভ ? শুভশ্রীর সাথে ওর কি সম্পর্ক ? আর বাকিদের মুখে একটাই প্রশ্ন , সত্যি তো শুভ কোথায় ? এদিকে আমি তখনও ভাবছি , শুভকে কি একটা খবর দেব ।
এরই মাঝে দূরে একটা চেনা মুখ দেখলাম বলে মনে হলো , একটা চেনা গলা খুঁজছে যেন শুভশ্রীকে । এতো আতঙ্কের মাঝেও সবার নজর তখন সেই মুখটাতে এসে আটকালো , আর আমি অবাক দেখলাম যে শুভ হাজির । তবে, কে বলল ওকে শুভশ্রীর খবর !!
সত্যি সত্যি ওটা শুভ ছিল । আস্তে আস্তে রুমে ঢুকলো সে । শুভশ্রী তখন চোখ বুঝে শুয়ে আছে । শুভর ছোয়ায় চোখ খুললো । চোখ দুটো জলে ভর্তি , ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে । কাঁদতে কাঁদতে শুভর হাত দুটো চেপে ধরলো সে । অনবরত এক কথা , কেন তাকে বাঁচানো হলো , সে ওর কাছে যেতে চায় । শুভর মাথা যেন বন বন করে ঘুরছে । কি বলছে এ সব , কি হচ্ছে এ সব । রুম থেকে বেরিয়ে এলো শুভ । ওর মা কে ডেকে বললো একে বিষ দিতে বলুন আর ওর মৃত্যুর সমস্ত দায়িত্ব আমি নিলাম । সবাই অবাক , এসব আবার কি উল্টো পাল্টা বকছে ছেলেটি ।।
এদিকে তখন শুভশ্রীর মায়ের চোখেও জল । কিছুক্ষন এই ইমোশনাল সিন চললো । তারপর মায়ের মুখ থেকে যা শুনলাম , আমরা সবাই তো অবাক ! কি বলছেন উনি । শুভশ্রীর যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা , সে অলরেডি দেড , তাও চার বছর আগে ।।
দক্ষিনেস্বর ছেড়ে আমরা এখন কফি হাউসে । আড্ডা আর গান , পুরো মেজাজে চলছে । হটাৎ বেশ নস্টালজিক হয়ে শুভ আমাকে বলে উঠলো , জানিস সেই ছেলেটি , আরে বহরমপুরের যার সাথে পাগলির বিয়ে হতো , তার দাদার সাথে সেদিন কথা হচ্ছিল । শুভশ্রী নতুন বিয়ে করেছে , মুম্বাইতে আছে । শুনেও ভালো লাগলো , মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠেছে । তবে এর পুরো কৃত্বিত্ব একা শুভর । মেয়েটি যেদিন সুসাইড করে তার কয়েক দিন আগেই সে ছেলেটির মৃত্যুর ব্যাপারে জানতে পারে । তারপর রাতে হোস্টেলের রুমে বসে লিকুইড মোরটিন খেয়ে নিয়েছিল । ছেলেটিকে খুব ভালোবাসতো নাকি শুভশ্রী । এ সবই সেদিন হাসপাতালে তার মায়ের মুখ থেকে শোনা ।।
এদিকে শুভকে এক কোনায় নিয়ে এসে আমি জানতে চাইলাম যে ওকে এ বিষয়ে কে বলল । জানলাম , ও শুভশ্রী কে ফোনে দুদিন না পেয়ে ওর বান্ধবি তৃষা আগারওয়াল কে ফোন করে । ওই বলে যে শুভশ্রী নে সুসাইড কিই হ্যায় । এই খবর পেয়ে আর থাকতে পারে নি শুভ । ভোরের ট্রেনে চলে আসে সোজা হাসপাতালে আর বাকিটা তো শুনলেনই আগে । তবে শুভর সেদিনের ঐ মৃত্যু দায়িত্ব তুলে নেওয়া আমার একদম ভালো লাগে নি । আর বাড়াবাড়ি যাতে না করতে পারে , তাই ওকে নিজে সোজা বাড়ি চলে এলাম ।।
এদিকে বাড়িতে আরেক কান্ড । এসব ঘটনা শুনে শুভর বাবা তো রেগে আগুন । বলেই বসলেন , এবার কিছু হলে ছেলেকে পুলিশে তুলবে , দেখো ছেলের কান্ড । শুভর মা কিন্তু কিচ্ছু বললো না । ছেলেকে কতটা ভালোবাসে তা আজ রাতের খাওয়ার টেবিলে বুঝে গেলাম । মাংস করেছেন , তবে ছেলে খাসি ভালো বাসে তাই তার জন্য আলাদা রান্না হয়েছে । আমার জন্য নিরামিষ কারণ আমি আবার ওসব খাই না আজকাল ।।
রাত কাটলেই চলে যেতে হবে । তাই ব্যাগ টা গুছিয়ে রাখলাম । রাতে জমিয়ে আড্ডা হলো আজ । নতুন পুরোনো কত কথা , আর এই প্রথম শুভর মুখ থেকে শুনলাম শুভশ্রী কিভাবে তাকে অপমান করেছে । খুব খারাপ লাগলো শুনে । সাথে মনে হলো মানুষ কিভাবে পাল্টে যায় । পয়সা সবাইকে পাল্টে দেয় । সত্যি বড়োই বিচিত্র এ নিয়ম !!
রাত থেকেই জ্বর । কাল যে যাওয়া হচ্ছে না এটা তো সিওর । তবে রাত ভর এই পাগলামটা শুভ যে কি করে সহ্য করেছে তাই ভাবছি । অবশ্য এটাই প্রথম বার নয় । শুভশ্রীকেও ঠিক এই একই ভাবে সামলেছিলো শুভ । তাও দিনের পর দিন । ওর ক্রেডিট আছে বলতে হয় । এমনি অনেক কিছুই ভাবছি , এদিকে চায়ের কাপ হাতে হাজির শুভ । একদম নিজের স্টাইলে বলে উঠলো , টি ব্রেক ।।
চা খেতে খেতে অনেক ভাবনাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো । এবার আর পারলাম না চেপে
রাখতে । জিজ্ঞাসা করেই বসলাম শুভকে , তুই কি সত্যি শুভশ্রী কে লাইক করতিস ? বেশ চাপা গলায় উত্তর এলো হুম । আমি বললাম , তবে এত দিন শুধু অভিনয় করে গেলি কেন ? ওর মায়ের কাছে একবার মন খুলে বলতেই পারতিস !
শুভর গলাটা বেশ নরম মনে হলো । শুভশ্রীর সঙ্গে হবু স্বামীর অভিনয়টা তার কাছেও বেশ কষ্টকর ছিল এটুকু তো বুঝি , বাট , কি করে পারলো সে এই অভিনয় করতে । শুভ বললো , সেদিন ওর মা আর ডাক্তার বাবুর রিকুয়েস্ট ফেলতে পারিনি । শুরু করি শুভশ্রীকে সুস্থ করার অভিনয় । ওর মন থেকে সুইসাইড এর ভূত নামানোর অভিনয় । ওর কত চাহিদা হাসিমুখে পূরণ করেছি কে জানে , শুধু শরীর বাদ দিয়ে ।
জ্বর গায়ে শুনছি আর কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে । দিনে কত বার ফোন করতাম ,হিসাব নেই । যা তা বলে যেতাম , আর এটা কাজও করছিলো । ডাক্তার বললো এতো কুইক রিকভারি কোনোদিন দেখেনি সে , কিন্তু আমি তো জানি , কিছুই উন্নতি হয় নি । নাহলে সেদিন , বিগবাজারে দাঁড়িয়ে শুভশ্রী আবার সুসাইড করবে বলে । বেশ অবাক করার হলেও এটাই সত্যি ।
এর পর কলেজ শেষ হলো ওদের এক মর্মান্তিক ভাবেই । শুভ পাস করলেও শুভশ্রীর পাস করা আর হলো না । আর এর পর শুভশ্রী আর এগোতেও চাইলো না ।। শুভ বেশ হারে হারে টের পাচ্ছিলো যে কেসটা বেশ জন্ডিস । কোন রাস্তাও পাচ্ছিলো না । শুরু হলো কাকিমার কাছে আরেক অভিনয় যে শুভশ্রী সম্পূর্ণ সুস্থ । ওকে বিবিএ ও এম বি এ পড়তে সাউথে পাঠিয়ে দেওয়া হোক । এটাই যেন ওকে সুস্থ করার শেষ উপায় শুভ দেখতে পাচ্ছিলো আর শুভশ্রীকে বোঝানোর দায়িত্ব শুভ নিজে নিলো ।।
না , দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে । আজ মেনু মাছের মাথা , তবে ওই যে বলেছিলাম যে আমি নিরামিশি , তাই আমার জন্য স্পেশাল ধোঁকার ডালনা হয়েছে । খেয়ে উঠে আর শরীর চলছিল না । অতএব , ফেলু মিত্তির কে সরিয়ে রেখে এক ঘুম এই দুপুরে ।।
রাত কেটে ভোর হল ।। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে শুভর গাড়ির পিছনে সোজা ধর্মতলা ।। বাস ছাড়বে ঠিক ৮.২০ ।। বাসের টিকিট কেটে দিলো শুভ নিজে , আমাকে পেমেন্ট করতেও দিলো না ।। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল আজ ও স্বাধীন ।। কারণ আজ ও এ জঙ্গলে এক নতুন পরিবার গড়ার কথা ভাবছে , সঙ্গী হিসাবে পেয়েছে এক বাঘিনী কে , দি রয়েল বেঙ্গল টাইগ্রেস ।। ভয় পাবেন না , এ বাঘিনী শুভর জীবনে নতুন প্রেম , এসেও এখনও ধরা দেয় নি ।।
অনেক কিছুই জানতাম না , আজ জেনে ফিরছি ।। সেদিন তার চিরদিনের ভালোবাসাকে বেঙ্গালুরুর মাটিতে এম বি এ করতে পাঠিয়ে দেয় শুভ নিজে ।। নিজে বসে থেকে শুভশ্রীকে রাজি করায় সে ।। বিমান বন্দরের সেদিন আর এক মাস আগেকার দিনটা মোটেও এক ছিল না ।। সেইদিন শুভশ্রী ছিল শুভর নয়নের মনি আর এই মাস খানেক আগে কলকাতায় যখন ফিরলো তখন তার হাতে অন্য একটি হাত ।। বিয়ে করেছে শুভশ্রী ।
শুভর কিন্তু আগে ভাগেই এয়ারপোর্টে হাজির হয় ।। তবে , তাকে দেখেও না দেখার ভান করে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় শুভশ্রী ।। আমি বসে আছি বাসে , কিন্তু মনে মনে অনুমান করতে পারছি কতটা কষ্ট পেয়েছিল শুভ ।।
বিকেলে ফোন করলে শুভশ্রী তাকে চিনতে অস্বীকার করে এবং সতর্ক করে দেয় যে এর পর ফোন এলে বা ডিস্টার্ব করলে সে এফ আই আর করবে শুভর নামে ।। শুভ কিছু বলেনি সেদিন , কাউকে না ।। হয়তো আমাকেও বলতো না যদি কাল রাতে প্রচন্ড চাপ দিয়ে ঝগড়া না করতাম ।।
আই এম সরি , শুভ ।। ঝগড়া না করে উপায় ছিল না রে ।।
শুধু শুভশ্রীর শেষ কথাগুলো ... না , আজও ভোলেনি শুভ ।। 'সেবা করেছে বলে গায়ে পরার কি আছে , দাম টা নিয়ে নিলেই পারে '?
আমার বাস আসানসোল ঢুকছে ।। একটু পরে নেমে যাবো , রোজকার কাজে ভুলেই যাবো হয়তো এত ঘটনা , তাই লিখে ফেললাম ।। কিছু মনে করিস না ভাই ।। তোর মতন ভালো ছেলের জীবনে ভালোই হবে ।। যে খারাপ তাকে যেতে দে ।।
দূর থেকে মনে মনে শুধু এটুকুই বলে যাচ্ছিলাম ।।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শেলি ২৫/০৪/২০১৭সুন্দর লেখা
-
শুভম গাঙ্গুলী ২৫/০৪/২০১৭অসাধারণ রচনা। বোধয় শুভ রা চিরজীবন এরকম বঞ্চিত হয় শুভশ্রী দের কাছে।।।