www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

স্মৃতিচারণ (Reminiscence) শতবর্ষের উজ্জ্বল আলোকে আমাদের বিদ্যালয় হেঁড়িয়া শিবপ্রসাদ ইনস্টিটিউশন

রাশভারী কথাটা ! সেদিন হটাৎই মনে পড়লো …… বছর চল্লিশের আগের কথা। প্রচন্ড শীত ছিল সেদিনও। তখন বামফ্রন্ট সরকার আসেনি, সিদ্ধার্থবাবুর শাসনকালের শেষ সময়। আমাদের চতুর্থ শ্রেণীর সেন্টার পরীক্ষা হচ্ছিল - হেঁড়িয়া হাইস্কুলে। শিশুজীবনে প্রথম দেখা মস্তবড় স্কুল। প্রথমদিন পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি গেলাম। হাড় কাঁপানো প্রচন্ড শীতেও কপালে আমার তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম। যদি আবার সব প্রশ্নের উত্তর ঠিক ঠিক লিখেছি কিনা জিজ্ঞেস করে। অন্যদিনের মতো সন্তোষবাবু সেদিন আর কোনো মারধর করেনি। শ্রী সন্তোষ কুমার জানা ছিলেন আমাদের নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহাশয়। সম্পর্কে মাসির ছেলে দাদা হলেও কোনোদিন বেতের ভয়ে দাদা বলিনি স্কুলে । পড়ালেখা নিয়মিত না করলে বেতের দর্শনে আধ ঘন্টায় সব পড়া হয়ে যেত । এমনই রাশভারী লোক ছিলেন তিনি।

সময়টা ১৯৭৭ সালের জানুয়ারী। পাঠশালায় যাওয়া ইতি করে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তির উদ্দেশ্যে বাবার হাত ধরে চললাম হাইস্কুলে। তখনকার দিনে এডমিশন টেস্ট হতো না। এখনকার মতো এতো ABCD বিভাগ ছিল না।  ছাত্র সংখ্যা ছিল কম। বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে এসে বাবা বললেন এই ইস্কুলের নাম হেঁড়িয়া শিবপ্রসাদ ইনস্টিটিউশন। বিদ্যালয় ভবনের বিশাল বাড়িটা আর একবার দেখলাম। ভয়ে বুকটা দুরু-দুরু করছে। বাবার হাত ধরে প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে প্রবেশ করলাম। দেখলাম; ধবধবে সাদা পোশাক পরা একজন দীর্ঘ, সুঠাম, সৌম্যদর্শন, রাশভারী ভদ্রলোক বসে আছেন চেয়ারে। সামনে কিছু বই ও খাতাপত্রে সুসজ্জিত টেবিল। টেবিলের নিচে ঢুকে টুক করে একটি প্রণাম করলাম। সুন্দর উচ্চারণে পরিষ্কার বাংলায় এক-দুটি প্রশ্ন করলেন। আমি যথাযথ উত্তর দিলাম। উনি বললেন; ভেরি গুড। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে বললেন; রাখাল, সমরেশকে পঞ্চম শ্রেণীতে দিয়ে এসো।  আমি গেলাম সেই লোকের সঙ্গে। বাবা অফিসে বসে অন্যান্ন ফর্মালিটি পুরো করলেন। ক্লাসের শেষে একা বাড়ি ফিরে এসে দাদা দিদিদের সামনে বেশ লাফালাফি করেছিলাম। সেদিনটা আমার জীবনে প্রথম এক আনন্দঘন মুহূর্ত ছিল। যা সবার জীবনে হয়তো একবারই আসে। পরে জেনে ছিলাম সেই রাশভারী ভদ্রলোক ছিলেন প্রধান শিক্ষক শ্রী কার্তিক চন্দ্র মান্না মহাশয়।

নতুন স্কুল, অনেক বন্ধু, অনেক আশা, অনেক কথা, অনেক আচার - সবে মিলে আনন্দে একাকার।  স্কুলের বন্ধুদের কথাবার্তা, মাস্টার মশাইদের আলাপ আলোচনা, আদব-কায়দা, পড়াশোনা শেখানোর পদ্ধতি সবই আমার্ কাছে অবর্ণণীয় এক সুখানুভুতি । ভয় কেটে গিয়ে একটু একটু করে আমার ভীষণ ভালো লাগলো সবাইকে । নতুন একটি জীবন পেলাম - আনন্দ সুখের ঝর্ণাধারায় তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগলাম। ক্লাসের পড়া ঠিকঠাক করে যেতাম। কেননা ঘরে দাদাদিদিদের রুটিন মাফিক রেশনে পাওয়া এলোমেলো অগোছালো গম চালের মতো বেতের আর কানমলা খেয়ে সব ঠিকঠাক চলতো। এক একটি দিন এগোতে লাগলো। আমার মনে হতো প্রত্যেক দিনই আমার কাছে নিত্য নতুন দিন, আনন্দের দিন আর উৎসবের দিন। ইস্কুলের সরস্বতী পূজায় আমার প্রথম অংশগ্রহণ। একাদশ শ্রেণীর দাদাদিদিদের হাত থেকে পুজোর প্রসাদ পাওয়া যেন এক একটি স্বপ্নপূরণ।

আমাদের বিদ্যালয়ে বছরের বিশেষ দিনগুলি খুবই আনন্দ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে উদযাপিত হতো। সেইসব উৎসবমুখর দিনে আনন্দ সহকারে অংশগ্রহণ করতাম। শুধু সরস্বতী পুজো নয় - ২৩শে জানুয়ারী, ২৬শে জানুয়ারী, বাৎসরিক ক্রীড়া ও সাংকৃতিক অনুষ্ঠান,  ২৫শে বৈশাখ, ১৫ই অগাস্ট, ৫ই সেপ্টেম্বর কিংবা ২রা অক্টোবর - এইসব বিশেষ দিনে সকাল সকাল সবাই উপস্থিত হতাম । শিক্ষক মহাশয়গন বক্তব্য রাখতেন এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশন হতো জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পরে । এইসব মহতী দিনে উদযাপনের মাহাত্ম্য আমাদের কাছে অসাধারণ বাগ্মিতায় সহজ ও সরল ভাবে তুলে ধরতেন আমাদের প্রিয় প্রধান শিক্ষক পুণ্যশ্লোক কার্তিক চন্দ্র মান্না। অন্যান্ন শিক্ষক মহাশয়গন তাঁদের বক্তব্যে আমাদের জ্ঞাত করাতেন - এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার কথা। প্রধান শিক্ষকের সভাপতিত্বে সভার প্রথম থেকে শেষ অবধি পিন ড্রপ সাউন্ডে সভা পরিচালিত হতো। গন্ডগোল তো দূরের কথা কেউ টুঁটি শব্দ করতে পারতো না। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী’ র জন্মদিবস পালনে অথবা বিশেষ কোনো “দিবস” উদযাপনের পর আমাদের মিষ্টিমুখ করাতেন কার্তিক বাবু। একসঙ্গে সকলের লুচি মিষ্টি পাওয়াটাও একটা আনন্দের বিষয় ছিল। সবাই এক এক করে লাইনে দাঁড়াতাম । প্রধান শিক্ষক মহাশয় দাঁড়িয়ে তদারকি করতেন, সবাই লাইনে থাকতাম, আগে পাওয়ার অপেক্ষায় কখনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়নি।

প্রতি বছর জানুয়ারী- ফেব্রুয়ারী মাসে শীতের দিনে আমাদের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান হতো।  প্রায় সকল শিক্ষক মহাশয়গন উপস্থিত থেকে পরিচালনা করতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতেন শ্রী নীলরতন বারিক, শ্রী বিভূতি ভূষণ সামন্ত, শ্রী অজিত কুমার পড়িয়া, শ্রী মৃগেন্দ্রনাথ গুড়্যা, শ্রী প্রতাপ চন্দ্র সিনহা, শ্রী নরেন্দ্রনাথ মন্ডল, শ্রী বিমল পড়িয়া, শ্রী বিজন মাইতি, শ্রী কানন প্রামানিক, শ্রী অবনী নন্দ, শ্রী দুর্গাপদ আচার্য মহাশয় প্রমুখ । সহযোগিতা করতেন রাখাল’দা, মনোরঞ্জন’দা, কাঙাল’দা। প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানাধিকারীদের ভিক্টরি স্ট্যান্ডে দাঁড়াতে হতো - সেটা দেখা ও উপভোগ করা ছিল আমাদের কাছে একটা আনন্দঘন মুহূর্ত।  অনুষ্ঠানের বিভিন্ন সময়ে ফটো তুলে রাখতেন স্বয়ং প্রধান শিক্ষক। উনি বলতেন এগুলো চির-স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সরস্বতী পূজায় সবসময়ের জন্য পুরোহিত ছিলেন আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে শ্রী চিরন্তন পণ্ডা মহাশয় । বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংগীত বা নাট্য পরিচালনা করতেন শ্রী অবনী নন্দ মহাশয়। সকল ছাত্রদের নাম মনে রাখা এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রাখা তখনকার দিনের শিক্ষকদের একটি প্রধান গুণ ছিল। অনেক কঠিন অংক খুব সহজ সরল সুন্দর করে মুখে মুখে (মৌখিকভাবে) বুঝিয়ে ও শিখিয়ে দিতেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক প্রতাপবাবু।  এছাড়া শ্রী সত্যেন্দ্রনাথ মাইতি, শ্রী সুধাংশু শেখর ভূঁঞা, শ্রী নিতাইচরণ মন্ডল, শ্রী বিষ্ণুপদ নায়ক, শ্রী জগদীশ গুড়্যা, শ্রী বিধুভূষণ ভট্টাচাৰ্য, শ্রী জগদীশ জানা এবং পরবর্তী সময়ে শ্রী সুবিমল পড়িয়া, শ্রী কালিপদ পড়িয়ালী, ক্রীড়া শিক্ষক শ্রী সুশান্ত বাবু ও শ্রীপৃথ্বীরাজ প্রধান মহাশয়গন স্ব-স্ব বিষয়ে অত্যন্ত পারদর্শিতায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আমাদের সকলের হৃদয়ে আজ ও বিরাজমান।

তখনকার দিনে অতো টিউশনি ছিলোনা। বইও বেশি পাওয়া যেতো না। পাশকরা সিনিয়র দাদাদের বইগুলো নিয়ে পড়তাম। আমাদের শিক্ষকগণ খুব যত্নের সঙ্গে পড়াতেন। ক্লাসের সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনতো।  তাই টিউশনির দরকারই হতো না। হই-হট্টগোল করলেই কানমলা কিংবা বেতের ছড়ির এক-দু ঘা তো পাওনা ছিল পাক্কা । একবার মনে আছে দুষ্টামি করার অপরাধে ধীরস্থির শান্ত শিক্ষক শ্রী ক্ষুদিরাম বাবু আমার কানটা বেশ ভালো করে মলে দিয়েছিলেন। আর একবার ছুটির পর হো:হো: করে সিঁড়ি থেকে নামার অপরাধে বেতের ঘা খেতে হয়েছিল রাশভারী শিক্ষক নীলরতন বাবুর কাছে। শাসন করলেও উনারা খুব স্নেহ করতেন। সেইসব ঘা খেয়েই আমরা মানুষ হয়েছি। তখনকার দিনে পথেঘাটে শিক্ষক মহাশয়দের দেখে সকল ছাত্র পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করত। তাঁরা ছিলেন আদর্শের বার্তাবাহক, আদর্শ গুণীজন - আদর্শ শিক্ষক ।

বর্তমান দিনে সরকার আইন করে ছাত্রশাসন করা বন্ধ করে দিয়েছে। ছাত্ররা অন্যায় করলেও এখন শাসন করা নিষিদ্ধ। পাশফেল প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে আদর্শবান বা ভালো হওয়ার প্রতিযোগিতা আর নেই। খেলাধুলা আর শরীর চর্চা'র সময় নেই। টিউশনি পড়া আর নোটস মুখস্ত করে মার্ক্স্ পাওয়ার যাঁতাকলে ছাত্রদের অবস্থা কাহিল - কলুর বলদের মতো।  ছাত্রদের থেকেও অবিভাবক আর শিক্ষকের মার্কসের চাহিদা এখন অনেক বেশি । মনোবল এখন তলিয়ে যাচ্ছে, ঠাঁই হচ্ছে টাকায়। সত্যিকারে বিদ্বান, আদর্শবান আর শরীরগঠন এখন ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে বিদ্যালয়ের আঙিনা থেকে । রেষারেষী আর পরশ্রীকাতরতায় দেশ ভরে যাচ্ছে - আদর্শহীন, স্বার্থপর, দুর্নীতি আর অসভ্যতায়। শান্তি, প্রীতি, ভালোবাসা আর পরিবেশ-প্রকৃতি’র ধ্বংসের কারণ হচ্ছে - আদর্শ শিক্ষার অভাবে।

আমাদের প্রধান শিক্ষক মহাশয় প্রতিটি অনুষ্ঠানে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন। এই এলাকায় উচ্চ শিক্ষালাভের যখন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিলো না তখন পার্শ্ববর্তী কলিয়াচক গ্রামের মহাপ্রাণ বিশিষ্ট সমাজসেবী পুন্যশ্লোক শিবপ্রসাদ সাউ মহোদয়ের সুযোগ্য পুত্রগণ শিক্ষানুরাগী - বিদ্যোৎসাহী ঈশ্বর চন্দ্র সাউ, বিক্রম কিশোর সাউ, বলরাম সাউ মহোদয়গণের ভূমি ও আর্থিক সহায়তায় ১৯১৭ সালে এই বিদ্যালয়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। তখনকার দিনে ছাত্র পাওয়া মুশকিল হতো। রাস্তাঘাট তেমন একটা ভালো ছিলনা। সবই কাঁচা রাস্তা । বর্ষায় রাস্তার চেহারা হয়ে যেত খালের মতো। লাক্ষী, ধ্বজিভাঙ্গা, তল্লা, ঠাকুরনগর, কৃষ্ণনগর, টিকাশি, মৌহাটি, জুখিয়া, খারড়, কলিয়াচক প্রভৃতি দূর-দূরান্ত গ্রামের বাড়ি থেকে ছাত্রদের ধরে ধরে আনতে হতো। শিক্ষকদের এবং বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী, শিক্ষাপ্রেমীদের আন্তরিক প্রয়াসে ধীরে ধীরে বিভিন্ন শাখা যুক্ত হয়ে আমাদের এই বহুমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বহু গুণীজন এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে দেশ-বিদেশ আলোকিত করেছেন এবং করছেন । বহু কৃতী ছাত্র আজ দেশ-বিদেশে স্ব-স্ব মহিমায় বিভিন্ন পেশায় কৃতিত্বের স্থান অধিকার করেছে, সেই সঙ্গে এই প্রতিঠানকে মহিমান্বিত করেছেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, আইনজ্ঞ, বিচারপতি, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, নার্স, শিক্ষক, অধ্যাপক, প্রশাসক, ক্রীড়াবিদ, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী প্রভৃতি বিভিন্ন গুণীজনের জন্ম দেওয়া এই মাতৃসমা বিদ্যালয়ের ঋণ কেউ কখনও শোধ করতে পারবেনা। এই বিদ্যালয়ে আমরা শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে আমাদের জীবনকে আলোকিত করতে পেরেছি। জীবনযাপনে শিক্ষার নতুন বীজ বপন করে জীবনকে ধন্য করেছি। এখানে শিক্ষালাভ করে নিজেকে গর্বিত বলে মনে করি। ধমনী থেকে ধমনীতে বইতে থাকা প্রাণপ্রিয় এই শতাব্দী প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের মায়ের মতো - এই বিদ্যালয়কে আমরা সবাই ভালোবাসি।

একটা কথা মনে পড়লো, সেটা ছিল ১৯৮২ সালের জানুয়ারী মাস। আমরা দশম শ্রেণীতে পড়ি। তখন আমাদের ক্লাসের বেশির ভাগ ছাত্ররা মিলেমিশে সবাই খেলাধুলা করতাম। ফুটবল, ভলিবল, হাডুডু সবই।  এছাড়া বিদ্যালয়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম। তখনকার দিনে সর্বাধিক পাঁচটি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করা যেত। সেবছর আমরা অর্থাৎ হরিপদ (গিরি), শচীন (মান্না) আর আমি তিনজন মিলে অনেকবার ভিক্টরি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলাম একসঙ্গে। সেকথা কখনো ভোলার নয়।

সরস্বতী পুজোর দিনে পুস্পাঞ্জলির পর বোর্ডিংয়ে গিয়ে খিচুড়ি খাওয়া যেমন ভোলার নয় তেমনি মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বোর্ডিংয়ে দু-মাস থাকাটা ও ভোলার নয়। ১৯৮২ সালে কার্তিক বাবুর রিটায়ারের পর বিধুবাবু টিচার ইনচার্জ হলেন।  মাধ্যমিক পরীক্ষা ১৯৮৩ সালের মার্চের ৩ তারিখ। বোর্ডিংয়ে এসে প্রতিদিন সন্ধ্যায় খোঁজ নিতেন বিধুবাবু আর সঙ্গে থাকতেন প্রতাপবাবু। প্রথমদিন আমি পরীক্ষা দিয়ে আসার পর ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যা ৭টায় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।  পরে গৌতম, শ্যামল আর অরুপদের কাছ থেকে শুনেছিলাম; মাস্টার মহাশয় এসে বলেছিলেন; সমরেশকে এখন ডাকিসনা ও একটু পরে উঠে পড়বে। ভয় দেখাবি না তোরা। শ্রদ্ধা ভক্তি এমনি এমনি কি করতো লোকে তাঁদের। স্নেহ করতেন আর প্রত্যেকের খেয়াল রাখতেন, দুষ্টামি করলে শাসন ও করতেন। রাশভারী শিক্ষক হলেও এইরকম ছিলেন তাঁরা।

মনে আছে প্রতি বছর একটি দিন বিশেষ ছুটি'র দিন হিসাবে ঘোষণা করতেন আমাদের প্রধান শিক্ষক মহাশয়। সেদিনটি ! অর্থাৎ আমাদের কৃষি বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণীর ফলাফল প্রকাশের পরের দিন।  ইস্কুলে এসে জানতাম আমাদের দ্বাদশ শ্রেণীর দাদা দিদিরা সারা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বিশেষ-বিশেষ স্থান অধিকার করেছেন। ওই দিনটি আমার খুব ভালো লাগতো । কার্তিকবাবু মৃদু হেসে আমাদের কৌতূহলী মুখের দিকে চাইতেন আর ছুটির ঘোষণা করতেন। নোটিশ বোর্ডে লেখা থাকতো - 'এতদ্বারা সকলের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে "..............." ইত্যাদি ইত্যাদি।

আজ ও নোটিশ (চিঠি) পেলাম! আনন্দে শিহরিত হচ্ছি এটা জেনে যে বহু দুর্যোগ, বহু দুর্ভোগ আর বহুকাল অতিক্রম করে আমাদের বিদ্যালয় হেঁড়িয়া শিবপ্রসাদ ইনস্টিটিউশন’ এর - আজ শতবর্ষে পদার্পন । যাঁদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ও সক্রিয় সহযোগিতায় আজ এই বিদ্যালয়; সেইসব পুন্যশ্লোক মহাপুরুষেরা আজ অনেকেই আমাদের কাছে নেই।  নেই - এই বিদ্যালয়ে জন্ম নেওয়া বহু কৃতী ছাত্র ছাত্রী। যাঁরা আমাদেরকে গর্বিত করেছেন আর মহিমামণ্ডিত করেছেন । তাঁরা  চলে গিয়েছেন অনন্তলোকে। তাঁদের সকলের অনন্তলোক যাত্রা শান্তিময় হোক এবং অমর আত্মা শান্তিলাভ করুক - মঙ্গলময়ের কাছে আমার বিনীত প্রার্থনা। তাঁদের সকলকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
"বিদ্যা দদাতি বিনয়ং, বিনয়াদ যাতি পাত্রতাম, পাত্ৰতাত ধনোমাপ্নতি, ধনাদ ধর্ম ততো সুখম" - আমাদের প্রিয় শিক্ষক শ্রী দুর্গাপদ আচার্য মহাশয়ের রচিত ও সম্পাদিত সংকৃত পাঠ্যপুস্তক এর একটি শ্লোক। উনার সৌম্যকান্তি অবয়বে গম্ভীর উচ্চারণে গম-গম করতো বিদ্যালয় গৃহখানি - এখনো দেখতে পাই আমাদের শতাব্দী প্রাচীন বিদ্যালয়ে তাঁর হাতছানি ।
কর্তব্যপরায়ণ হয়ে উঠেন দায়িত্ববান – আদর্শ, নিষ্ঠাবান আর সচ্চরিত্রবান, দেশ-বিদেশে তিনিই পূজ্যবান - সর্বক্ষেত্রে যিনি বিদ্বান । ……….…                ******
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১৬৪৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৬/১১/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast