কমলার শেষ আশা (১ম খন্ড)
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি । একটা সত্যিকারের ঘটনা । বেশিনয় বছর আঠারোর আগের কথা । সুশোভন তখন উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে তিনটে লেটার-মার্কস পেয়ে ফার্স্ট-ডিভিশনে পাশ করেছে কলাগেছিয়া হাইস্কুল থেকে । গ্রামের সকলের কি আনন্দ । বাপমরা ছেলেটা অনেক কষ্টে পড়াশোনা করে । রাত্রি বেলায় কেরোসিনের লন্ঠন জ্বেলে পড়াশোনা করতে হয় । তখন গ্রামে ইলেকট্রিক আলো আসেনি । তার বাবা নেই, সেই ছোট্ট বেলায় বর্ষাকালে চাষ করতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা গেছে । মা অনেক কষ্ট করে লোকের বাড়িতে বাসন মেজে আর ১০ কাঠা স্বামীর পৈত্রিক জমি চাষ করে কোনো রকমে দিন গুজরান করে আর তাকে পড়ায় । ইস্কুলের মাস্টার মশায়েরা বইপত্র দিয়ে সাহায্য করে । সুশোভন বরাবরই ক্লাসে ফার্স্ট হয় । দেখতে খুবই সুন্দর ছিপছিপে আর লম্বা তাই ওকে সবাই ভালবাসে । সব থেকে বড় কথা ও কারুর সাথে ঝগড়া করে না । তার মা একজন বংশজ বাড়ির মেয়ে । সেই ভরা যৌবনে স্বামীহারা হয়েও অনেকের অনুরোধ সত্বেও সে আর বিয়ে করতে রাজি হয়নি । শুধুমাত্র সুশোভন এর দিকে চেয়ে । শুনেছি গ্রামের মাতব্বরদের অনেকে ওর মায়ের প্রতি কু-নজর ছিল । কিন্তু শত বাধা বিপত্তি সত্বেও সুশোভনের মা কমলাদেবীকে টলানো যায়নি । যাক সে অনেক দিনের আগের কথা।
কিছুদিন আগে কমলাদেবী মারা গেছে । সাতদিনের কাঁপুনি জ্বরে । কি একটা কঠিন জ্বর হয়েছিল । ও হাঁ মনে পড়েছে নামটা - সোয়াইন ফ্লু । সুশোভনকে ফোন করে জানিয়ে ছিল তার এক মাস্টার মশাই । কিন্তু কাজের চাপে আসতে পারবে না বলেছিল । অবশ্য রুমেলা ফোনটা ধরে ছিল । সুশোভন অনেক চেষ্টা করেছিল শহরের এক বৃদ্ধাশ্রমে রাখার জন্য কিন্তু তাতে তার মা রাজি হয়নি । গ্রামের এই ছোট্ট ঘরের প্রতি তার খুব মায়া ছিল । এইখানে শ্বশুর শাশুড়িহারা স্বামীকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিল সেই ছোট্ট বয়সে। মাত্র তিন বছর স্বামীর ঘর করার পরই তার স্বামী চলে যায় । সেই থেকে সে বরাবরই এই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে থাকে। মাঝে অবশ্য তার দাদুসোনা শীর্ষেন্দু হওয়ার পরে একবার গিয়ে ছিল মধ্যপ্রদেশে, মাত্র এক মাসের জন্য । তারপর থেকে সে তার দাদুসোনাকে দেখেনি । শীর্ষেন্দু তো প্রায় ১২ বছরের হয়ে গেছে । তার বাবার মত সে খুব বুদ্ধিমান । ইংলিশ, হিন্দি আর বাংলায় খুব ভালো বলতে লিখতে পারে ।
সুশোভন জয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এ সুযোগ পেয়ে গেল উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়ার পর । ভালো রাংক থাকায় কলকাতায় বড় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট এ পড়তে শুরু করে । সরকারী কলেজ হলেও অনেক খরচ । মা পরের বাড়িতে কাজ করে কিছু উপার্জন করত তাতে “নুন আনতে পান্তা ফুরায়” এর মত অবস্থা, সংসার চালাতে কষ্ট হত । হাতে একটা টাকাই বাঁচত না । কি হবে ভেবে ভেবে সুশোভন বন্ধুদের ধরে একটি টিউশনি যোগাড় করে কলকাতায় । সেই থেকে পড়াশোনা করে এবং টিউশনি পড়ায় একটি ছাত্রীকে । মেয়েটি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, নাম তার রুমেলা । দেখতে খুবই সুন্দর তবে পড়াশোনায় ততটা ভালো নয় । তার বাবা কলকাতার মস্তবড় একজন কাপড় ব্যবসায়ী । মা পূর্ববঙ্গের কাপড় ব্যবসায়ীর একমাত্র সুন্দরী কন্যা ছিল । নাম অনুরিমা দেবী । রুমেলার বাবা তার দাদুর দোকানে একাউন্টেন্ট ছিল । অনুরিমাদেবী ই একদিন প্রায় জোর করে তার বাবার সাথে বিয়ে করে । মামাদাদুর মৃত্যুর পর থেকে তার বাবা মস্ত বড়লোক।
কয়েকটি স্বচ্ছল পরিবারে বাসন মেজে একটু বেশি রোজগার করছে এখন সুশোভনের মা । দিন রাত মেহনত করছে । লোকে বললে তার মা বলে; আমার ব্যাটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে অনেক টাকার প্রয়োজন একটু গতরে কাজ করি এখন । আরকি । তার মা গ্রামে লোকের বাড়িতে কাজ করে যা পায় সংসারের খরচ বাঁচিয়ে শহরে ছেলের জন্য পাঠায়।
কয়েকবছর পর, রুমেলা যখন দশম শ্রেণীতে উঠলো তখন সে একবার সুশোভনকে বললো; তোমাদের দেশের বাড়িতে নিয়ে চলোনা । সুশোভন একটু লাজুক গোছের ছেলে। ভাবলো দেশে নিয়ে গেলে পাছে লোকে কিছু বলে, তাই রুমেলাকে বললো; অজপাড়াগাঁয়ে গিয়ে কোনো লাভ নেই। সেখানে ইলেকট্রিক আলো নেই। তোমার কষ্ট হবে । রুমেলা জীদ ধরে বলল আমাকে নিয়ে যেতেই হবে নইলে আমি খাবনা । সত্যি ! তিন দিন না খেয়ে পরে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস পেয়েই ভাত খেল । রুমেলার মায়ের অনুরোধে দেশের বাড়িতে রুমেলাকে ঘোরাতে নিয়ে এলো সুশোভন। রুমেলার মিষ্টি ব্যবহারে সবাই খুশি । প্রথমদিন সুশোভনের মাকে মাসিমা বলে ডেকেছিল । পরেরদিন সকালে ভুলে মা বলে ডাকলো । আর সঙ্গে সঙ্গে সরি বলে বলল; মাফ করবেন, আমি ভুলে আপনাকে মা বলেছি কিছু মনে করলেন না তো । সুশোভনের মা বলল; এতে মাফ চাওয়ার কি আছে । তুমি তো আমার মেয়ের মত মা বলতেই পারো । সেই থেকে প্রতিদিন ২০-২৫ বার মা মা বলে ডাকত । আর কমলাদেবীর রুমেলার মুখে মা ডাক শুনতে খুব ভালো লাগত । রুমেলা যা চাইত সেটা বানিয়ে খাওয়াত । এইভাবে ১০-১২ দিন থেকে পাড়ার সবার মন জয় করে কলকাতায় ফিরল।
তার ঠিক বছরখানেক পরই সুশোভনের ফাইন্যাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলো । খুব ভালোভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে সে । ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ ও হয়ে গিয়েছিল । সিলেক্ট হয়েছে - ডাইরেক্ট মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ফ্যাক্টরি ম্যানেজার, জে কে টায়ার, মধ্যপ্রদেশে । পাশ করা ও চাকরি পাওয়ার খুশিতে বাড়ি যাবে মাকে খবর দিতে তার আগে রুমেলাকে খবরটা দিয়ে আসি এই ভেবে রুমেলাদের বাড়িতে গেল সে । গিয়ে দেখে এক কান্ড ! রুমেলা দরজা বন্ধ করে আছে । কারুর সঙ্গে কথা বলছে না । ও যেতেই তার মা বলল; দেখনা সুশোভন - রুমি কারুর সঙ্গে কথা বলছে না, আমার তো ভয় করছে - কাল থেকে কাউকে কিছু বলছে না আর কোনো কিছু খাচ্ছে না । সুশোভন তখন দরজার কাছে গিয়ে বলল - “রুমেলা দরজা খোল, এসব কি ছেলেমানুষী করছ”। রুমেলা বলল; তুমি কথা দাও আমার কথা শুনবে তাহলে আমি দরজা খুলবো, নাহলে আমি মরে যাব তবুও আমি কোনদিনই এই দরজা খুলবো না । অনুরিমাদেবী হাতজোড় করে সুশোভনকে বলল; বাবা, ওর কথা শোনো, নইলে ওযে মরে যাবে বাবা।
সুশোভন ভাবলো কি এমন কথা না শুনলে ও মরে যাবে বলছে । ঠিক আছে, বল তোমার কি কথা । রুমেলা দরজার ওপার থেকে বলল; কথা দাও আমার কথা শুনবে তবেই আমি দরজা খুলবো নইলে এখানেই মরে যাব । সুশোভন আবেগের বশে বলে ফেলল; ঠিক আছে, কি তোমার কথা বল, আমি শুনব । রুমেলা বলল তোমার মায়ের দিব্যি করে বল আমার কথা রাখবে তবেই না আমি দরজা খুলবো । সুশোভন চিন্তায় পড়ল । কি এমন কথা যে মায়ের দিব্যি দিয়েই শুনতে হবে । একটু সময় নিল । অনুরিমাদেবী হাতজোড় করে সুশোভনকে বলল; বাবা আর দেরী করোনা, রুমির কথা শোনো নইলে ও মরে যাবে বাবা । সুশোভন আর অপেক্ষা না করে বলেই ফেলল; তোমার সব কথা শুনব বলো তোমার কি কথা । বন্ধ দরজার ওপার থেকে রুমেলা বলল; আজই আমায় বিয়ে করতে হবে নইলে আমি মরে যাব । কথাটা শুনে সুশোভনের মাথায় চক্কর এসে গেছে । এ কি কথা ! রুমেলা তার ছাত্রী । এটা কি সম্ভব । না: এ হতে পারে না । এই রকম ভাবছে আর ঠিক তখনি রুমেলা তার পাতলা নাইটি পরা অবস্থায় দরজা খুলে এসে সুশোভনকে জড়িয়ে আনন্দে গালে মুখে কপালে চুমু খেতে শুরু করেছে । সুশোভন কি করবে ভেবেই পেলনা সারাদিন । যতক্ষণে তার সম্বিত ফিরে পেলো, দেখল একেবারে সে বাসর ঘরে বসে আছে । এরইমধ্যে সারাদিনে রুমেলার বিয়ের সমস্ত আয়োজন, লোক ডাকা, লোক খাওয়ানোর মতো ঝামেলার কাজগুলো তার মা একা হাতে সামলে সব ঠিকঠাক করে দিয়েছে।
প্রথমে মনে একটু কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল । বৌকে একেবারে দেশের বাড়িতে কিভাবে নিয়ে যাবে । রুমেলার মা ঠিকঠাক গুছিয়ে সব জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছে । তারপর নিজের হাতে দামী শাড়ি নিয়ে কমলাদেবীকে পরিয়ে রুমেলাকে প্রনাম করিয়ে একেবারে নাতি নাতনির আশির্বাদ পর্যন্ত আদায় করে নিয়েছে । গ্রামে বৌভাতের আয়োজন থেকে আত্মীয় বিদায়ে একজন দক্ষ গৃহিনীর পরিচয় দিয়েছে সকল কাজে সিদ্ধহস্ত অনুরিমাদেবী । গ্রামের গুরুজনদের প্রনামী ধুতি-শাড়ি আর মিষ্টান্ন উপহার দিয়েছে । সবাই এই বিয়েতে খুব খুশি । নতুন বউ ও সুশোভনকে দু-হাত তুলে আশির্বাদ করলো তারা, সবাই বলল অন্নপূর্ণার মত বউমা পেয়েছে আমাদের বৌঠান । তারপর সুশোভন রুমেলাকে নিয়ে মধ্যপ্রদেশ চলে গেল । মাঝে মাঝে তারা চিঠি পাঠায় আর মাস্টার মশায়ের কাছে ফোন করে খবর নেয় - মায়ের, স্কুলের, গ্রামের গুরুজনদের এবং সেইসঙ্গে অন্যদেরও । এইভাবে চলতে লাগলো একবছর । বছরের শেষে খুশির খবর এলো । কমলাদেবী ঠাকুরমা হতে চলেছে । গ্রামে আনন্দের বন্যা । কমলাদেবীর ডাক পড়ল, যেতে হবে মধ্যপ্রদেশে । সবাই বলল ধন্য মেয়ে কমলা, রত্নগর্ভা । এমনি দিনে সুসংবাদ এল, সুশোভনের ছেলে হয়েছে।
দুদিন দু রাত ট্রেন-জার্নির পর একটুও বিশ্রাম করেনি কমলাদেবী । মধ্যপ্রদেশের এরকম পাহাড়ি এলাকা কখনো দেখেনি, কেননা সে গ্রাম ছেড়ে কখনো শহরে যায়নি । তবুও নতুন জায়গা আর নতুন ভাষায় তার কোনো আড়ষ্টতা নেই । এসেই দাদুসোনার সেবায় লেগে গেছে । কাঁথা সেলাই, সেঁক দেওয়া, স্নান করানো, খাওয়ানো, ময়লা কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে ঘর পরিষ্কার আর রান্না করা, এসব কাজ তো তার জল ভাত । তাকে তো দেশে এগুলোই করতে হত । পাড়ায় কারুর ঘরে ছেলে হলে তাকেই তো সবাই ডাকত । তাই জানা কাজে সময় নষ্ট না করে প্রথম থেকেই সব গুছিয়ে গাছিয়ে শেখাতে শুরু করলো রুমেলা বৌমাকে । মাঝে মাঝে রুমেলা তার মায়ের সঙ্গে পরামর্শ ও করে নেয় ফোনে । কত টাকা খরচ করতে হবে। কত টাকার গয়না বানাতে হবে বা কত টাকা জমাতে হবে, সব কিছু। বুদ্ধিমতি বৌমাও খুব তাড়াতাড়ি শিখেনিল ঠিক তার মা অনুরিমাদেবীর মতো। এইটুকু বয়সে সে একজন পাক্কা গৃহিনী হয়ে গেছে।
চলবে ..
কিছুদিন আগে কমলাদেবী মারা গেছে । সাতদিনের কাঁপুনি জ্বরে । কি একটা কঠিন জ্বর হয়েছিল । ও হাঁ মনে পড়েছে নামটা - সোয়াইন ফ্লু । সুশোভনকে ফোন করে জানিয়ে ছিল তার এক মাস্টার মশাই । কিন্তু কাজের চাপে আসতে পারবে না বলেছিল । অবশ্য রুমেলা ফোনটা ধরে ছিল । সুশোভন অনেক চেষ্টা করেছিল শহরের এক বৃদ্ধাশ্রমে রাখার জন্য কিন্তু তাতে তার মা রাজি হয়নি । গ্রামের এই ছোট্ট ঘরের প্রতি তার খুব মায়া ছিল । এইখানে শ্বশুর শাশুড়িহারা স্বামীকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিল সেই ছোট্ট বয়সে। মাত্র তিন বছর স্বামীর ঘর করার পরই তার স্বামী চলে যায় । সেই থেকে সে বরাবরই এই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে থাকে। মাঝে অবশ্য তার দাদুসোনা শীর্ষেন্দু হওয়ার পরে একবার গিয়ে ছিল মধ্যপ্রদেশে, মাত্র এক মাসের জন্য । তারপর থেকে সে তার দাদুসোনাকে দেখেনি । শীর্ষেন্দু তো প্রায় ১২ বছরের হয়ে গেছে । তার বাবার মত সে খুব বুদ্ধিমান । ইংলিশ, হিন্দি আর বাংলায় খুব ভালো বলতে লিখতে পারে ।
সুশোভন জয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এ সুযোগ পেয়ে গেল উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়ার পর । ভালো রাংক থাকায় কলকাতায় বড় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট এ পড়তে শুরু করে । সরকারী কলেজ হলেও অনেক খরচ । মা পরের বাড়িতে কাজ করে কিছু উপার্জন করত তাতে “নুন আনতে পান্তা ফুরায়” এর মত অবস্থা, সংসার চালাতে কষ্ট হত । হাতে একটা টাকাই বাঁচত না । কি হবে ভেবে ভেবে সুশোভন বন্ধুদের ধরে একটি টিউশনি যোগাড় করে কলকাতায় । সেই থেকে পড়াশোনা করে এবং টিউশনি পড়ায় একটি ছাত্রীকে । মেয়েটি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, নাম তার রুমেলা । দেখতে খুবই সুন্দর তবে পড়াশোনায় ততটা ভালো নয় । তার বাবা কলকাতার মস্তবড় একজন কাপড় ব্যবসায়ী । মা পূর্ববঙ্গের কাপড় ব্যবসায়ীর একমাত্র সুন্দরী কন্যা ছিল । নাম অনুরিমা দেবী । রুমেলার বাবা তার দাদুর দোকানে একাউন্টেন্ট ছিল । অনুরিমাদেবী ই একদিন প্রায় জোর করে তার বাবার সাথে বিয়ে করে । মামাদাদুর মৃত্যুর পর থেকে তার বাবা মস্ত বড়লোক।
কয়েকটি স্বচ্ছল পরিবারে বাসন মেজে একটু বেশি রোজগার করছে এখন সুশোভনের মা । দিন রাত মেহনত করছে । লোকে বললে তার মা বলে; আমার ব্যাটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে অনেক টাকার প্রয়োজন একটু গতরে কাজ করি এখন । আরকি । তার মা গ্রামে লোকের বাড়িতে কাজ করে যা পায় সংসারের খরচ বাঁচিয়ে শহরে ছেলের জন্য পাঠায়।
কয়েকবছর পর, রুমেলা যখন দশম শ্রেণীতে উঠলো তখন সে একবার সুশোভনকে বললো; তোমাদের দেশের বাড়িতে নিয়ে চলোনা । সুশোভন একটু লাজুক গোছের ছেলে। ভাবলো দেশে নিয়ে গেলে পাছে লোকে কিছু বলে, তাই রুমেলাকে বললো; অজপাড়াগাঁয়ে গিয়ে কোনো লাভ নেই। সেখানে ইলেকট্রিক আলো নেই। তোমার কষ্ট হবে । রুমেলা জীদ ধরে বলল আমাকে নিয়ে যেতেই হবে নইলে আমি খাবনা । সত্যি ! তিন দিন না খেয়ে পরে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস পেয়েই ভাত খেল । রুমেলার মায়ের অনুরোধে দেশের বাড়িতে রুমেলাকে ঘোরাতে নিয়ে এলো সুশোভন। রুমেলার মিষ্টি ব্যবহারে সবাই খুশি । প্রথমদিন সুশোভনের মাকে মাসিমা বলে ডেকেছিল । পরেরদিন সকালে ভুলে মা বলে ডাকলো । আর সঙ্গে সঙ্গে সরি বলে বলল; মাফ করবেন, আমি ভুলে আপনাকে মা বলেছি কিছু মনে করলেন না তো । সুশোভনের মা বলল; এতে মাফ চাওয়ার কি আছে । তুমি তো আমার মেয়ের মত মা বলতেই পারো । সেই থেকে প্রতিদিন ২০-২৫ বার মা মা বলে ডাকত । আর কমলাদেবীর রুমেলার মুখে মা ডাক শুনতে খুব ভালো লাগত । রুমেলা যা চাইত সেটা বানিয়ে খাওয়াত । এইভাবে ১০-১২ দিন থেকে পাড়ার সবার মন জয় করে কলকাতায় ফিরল।
তার ঠিক বছরখানেক পরই সুশোভনের ফাইন্যাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলো । খুব ভালোভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে সে । ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ ও হয়ে গিয়েছিল । সিলেক্ট হয়েছে - ডাইরেক্ট মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ফ্যাক্টরি ম্যানেজার, জে কে টায়ার, মধ্যপ্রদেশে । পাশ করা ও চাকরি পাওয়ার খুশিতে বাড়ি যাবে মাকে খবর দিতে তার আগে রুমেলাকে খবরটা দিয়ে আসি এই ভেবে রুমেলাদের বাড়িতে গেল সে । গিয়ে দেখে এক কান্ড ! রুমেলা দরজা বন্ধ করে আছে । কারুর সঙ্গে কথা বলছে না । ও যেতেই তার মা বলল; দেখনা সুশোভন - রুমি কারুর সঙ্গে কথা বলছে না, আমার তো ভয় করছে - কাল থেকে কাউকে কিছু বলছে না আর কোনো কিছু খাচ্ছে না । সুশোভন তখন দরজার কাছে গিয়ে বলল - “রুমেলা দরজা খোল, এসব কি ছেলেমানুষী করছ”। রুমেলা বলল; তুমি কথা দাও আমার কথা শুনবে তাহলে আমি দরজা খুলবো, নাহলে আমি মরে যাব তবুও আমি কোনদিনই এই দরজা খুলবো না । অনুরিমাদেবী হাতজোড় করে সুশোভনকে বলল; বাবা, ওর কথা শোনো, নইলে ওযে মরে যাবে বাবা।
সুশোভন ভাবলো কি এমন কথা না শুনলে ও মরে যাবে বলছে । ঠিক আছে, বল তোমার কি কথা । রুমেলা দরজার ওপার থেকে বলল; কথা দাও আমার কথা শুনবে তবেই আমি দরজা খুলবো নইলে এখানেই মরে যাব । সুশোভন আবেগের বশে বলে ফেলল; ঠিক আছে, কি তোমার কথা বল, আমি শুনব । রুমেলা বলল তোমার মায়ের দিব্যি করে বল আমার কথা রাখবে তবেই না আমি দরজা খুলবো । সুশোভন চিন্তায় পড়ল । কি এমন কথা যে মায়ের দিব্যি দিয়েই শুনতে হবে । একটু সময় নিল । অনুরিমাদেবী হাতজোড় করে সুশোভনকে বলল; বাবা আর দেরী করোনা, রুমির কথা শোনো নইলে ও মরে যাবে বাবা । সুশোভন আর অপেক্ষা না করে বলেই ফেলল; তোমার সব কথা শুনব বলো তোমার কি কথা । বন্ধ দরজার ওপার থেকে রুমেলা বলল; আজই আমায় বিয়ে করতে হবে নইলে আমি মরে যাব । কথাটা শুনে সুশোভনের মাথায় চক্কর এসে গেছে । এ কি কথা ! রুমেলা তার ছাত্রী । এটা কি সম্ভব । না: এ হতে পারে না । এই রকম ভাবছে আর ঠিক তখনি রুমেলা তার পাতলা নাইটি পরা অবস্থায় দরজা খুলে এসে সুশোভনকে জড়িয়ে আনন্দে গালে মুখে কপালে চুমু খেতে শুরু করেছে । সুশোভন কি করবে ভেবেই পেলনা সারাদিন । যতক্ষণে তার সম্বিত ফিরে পেলো, দেখল একেবারে সে বাসর ঘরে বসে আছে । এরইমধ্যে সারাদিনে রুমেলার বিয়ের সমস্ত আয়োজন, লোক ডাকা, লোক খাওয়ানোর মতো ঝামেলার কাজগুলো তার মা একা হাতে সামলে সব ঠিকঠাক করে দিয়েছে।
প্রথমে মনে একটু কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল । বৌকে একেবারে দেশের বাড়িতে কিভাবে নিয়ে যাবে । রুমেলার মা ঠিকঠাক গুছিয়ে সব জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছে । তারপর নিজের হাতে দামী শাড়ি নিয়ে কমলাদেবীকে পরিয়ে রুমেলাকে প্রনাম করিয়ে একেবারে নাতি নাতনির আশির্বাদ পর্যন্ত আদায় করে নিয়েছে । গ্রামে বৌভাতের আয়োজন থেকে আত্মীয় বিদায়ে একজন দক্ষ গৃহিনীর পরিচয় দিয়েছে সকল কাজে সিদ্ধহস্ত অনুরিমাদেবী । গ্রামের গুরুজনদের প্রনামী ধুতি-শাড়ি আর মিষ্টান্ন উপহার দিয়েছে । সবাই এই বিয়েতে খুব খুশি । নতুন বউ ও সুশোভনকে দু-হাত তুলে আশির্বাদ করলো তারা, সবাই বলল অন্নপূর্ণার মত বউমা পেয়েছে আমাদের বৌঠান । তারপর সুশোভন রুমেলাকে নিয়ে মধ্যপ্রদেশ চলে গেল । মাঝে মাঝে তারা চিঠি পাঠায় আর মাস্টার মশায়ের কাছে ফোন করে খবর নেয় - মায়ের, স্কুলের, গ্রামের গুরুজনদের এবং সেইসঙ্গে অন্যদেরও । এইভাবে চলতে লাগলো একবছর । বছরের শেষে খুশির খবর এলো । কমলাদেবী ঠাকুরমা হতে চলেছে । গ্রামে আনন্দের বন্যা । কমলাদেবীর ডাক পড়ল, যেতে হবে মধ্যপ্রদেশে । সবাই বলল ধন্য মেয়ে কমলা, রত্নগর্ভা । এমনি দিনে সুসংবাদ এল, সুশোভনের ছেলে হয়েছে।
দুদিন দু রাত ট্রেন-জার্নির পর একটুও বিশ্রাম করেনি কমলাদেবী । মধ্যপ্রদেশের এরকম পাহাড়ি এলাকা কখনো দেখেনি, কেননা সে গ্রাম ছেড়ে কখনো শহরে যায়নি । তবুও নতুন জায়গা আর নতুন ভাষায় তার কোনো আড়ষ্টতা নেই । এসেই দাদুসোনার সেবায় লেগে গেছে । কাঁথা সেলাই, সেঁক দেওয়া, স্নান করানো, খাওয়ানো, ময়লা কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে ঘর পরিষ্কার আর রান্না করা, এসব কাজ তো তার জল ভাত । তাকে তো দেশে এগুলোই করতে হত । পাড়ায় কারুর ঘরে ছেলে হলে তাকেই তো সবাই ডাকত । তাই জানা কাজে সময় নষ্ট না করে প্রথম থেকেই সব গুছিয়ে গাছিয়ে শেখাতে শুরু করলো রুমেলা বৌমাকে । মাঝে মাঝে রুমেলা তার মায়ের সঙ্গে পরামর্শ ও করে নেয় ফোনে । কত টাকা খরচ করতে হবে। কত টাকার গয়না বানাতে হবে বা কত টাকা জমাতে হবে, সব কিছু। বুদ্ধিমতি বৌমাও খুব তাড়াতাড়ি শিখেনিল ঠিক তার মা অনুরিমাদেবীর মতো। এইটুকু বয়সে সে একজন পাক্কা গৃহিনী হয়ে গেছে।
চলবে ..
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোহাম্মদ আব্দুল ওয়ারেশ (কাব্য) ৩০/০৯/২০১৫ভালো হয়েছে
-
শান্তনু ব্যানার্জ্জী ০৯/০৯/২০১৫বাহ !! দারুণ চলছে । খুব ভালো লাগলো ।
-
ইমরান কবির রুপম ০৮/০৯/২০১৫অনেক অনেক ভাল হবে আশা করছি।বাকিটুকুর অপেক্ষায় থাকলাম