www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

স্মরণীয় বরণীয় পূর্ণেন্দুকুমার (২য় খন্ড)

প্রথম খন্ডের পর...

তিনি ছিলেন একজন সমাজকর্মী আর পরিবেশবন্ধু । "গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান" স্লোগানের সমর্থক, প্রচারক ও করে দেখানোর বা উদাহরণ দেওয়ার আদর্শ ব্যক্তি । এই বিষয়ে তাঁর তিনজন সুযোগ্য পুত্রদের মধ্যে অন্যতম শিক্ষক ব্রহ্মানন্দবাবুর কথায়  " পড়াশোনার বাইরে তিনি সমবায় আন্দোলন, ক্লাব, সমিতি, গ্রাম্য বিষয়ে বিভিন্ন সভায় যোগদান করতেন । জুখিয়া কুঙর নারায়ণ বাণী মন্দিরের প্রায় দীর্ঘ দশ বছর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন । এর বাহিরে তিনি ফুল ও ফলের বাগান চাষ করতে ভালবাসতেন । বাড়িতে থাকাকালীন তিনি চুপ করে বসে থাকতেন না ।  কোদাল নিয়ে বাগানে বেরিয়ে যেতেন ।  ... পেয়ারা, পেঁপে, লেবু, কলা, আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, তাল, বেল, খেজুর, কুলের গাছ, দেবদারু, শিরীষ, ব্যাবলা, ইউক্যালিপটাস, আকাশবাণী, বাঁশ, নিম, শিমুল, খয়ের এমনকি পাতাবাহার, হেনা, রজনীগন্ধা, কামিনী, গন্ধরাজ, করমরী, তুলসী (কালো, বাবু, ও বন) সমেত বহু বনৌষধি গাছ গাছড়ার বাগান ও জঙ্গল রয়েছে তা সবই বাবার হাতে তৈরী । নিজেই সমস্ত আগাছা পরিষ্কার করতেন যত্ন করে । ১৪ই নভেম্বর বিকালেও কুমড়ার বাগানে নিজে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাঁদা কাটিয়েছেন ।"

গরিবের ঘরে জন্ম হয়ে তিনি কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করেছেন । তখনকার দিনে এগারো ক্লাস পড়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯৫৯ সালে ৬০ টাকা বেতনে তিনি রাধাপুর মুসলিমপল্লী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন ।  তার দু-বছর পর ঠাকুরনগর নন্দামহিলা বিদ্যাপীঠে সংস্কৃত-শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে ৪০ বছরকাল বিরামহীন শিক্ষকতা করেন । অবসর গ্রহনের পর মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর মহাবিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন । তিনি কখনো কলেজে পড়েননি (বিএডটা কলেজে পড়েছেন)।  সংস্কৃতে অনার্স পড়ার বহুবছর পর ১৯৯৫ সালে (৫৫ বছর বয়সে) তিনি এমএ পাশ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে - সংস্কৃত বিষয়ে । পরে ৬৪ বছর বয়সে তিনি ২০০৪ সালে সংস্কৃতে ডাবল এমএ (ধর্মশাস্ত্র / আচার্য) ডিগ্রী অর্জন করেন কল্যাচক বিক্রমকিশোর আদর্শ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় থেকে ।  তিনি প্রমান করেছেন পড়াশোনার কোনো বযো:সীমা নেই । অব্রাহ্মন হয়েও ব্রাহ্মণের চর্চ্চার ভাষা সংস্কৃত, অনর্গল বলতেন ।  তাই পন্ডিত বলত লোকে ।

গুনী মানুষের সাথে যেমনি তাঁর দৈনন্দিন উঠাবসা ছিল তেমনি অতি সাধারণ মানুষের সাথে মিশতেন অনায়াসে। তাঁর জীবন যাত্রা ছিল অনাড়ম্বর । কৃষ্ণানন্দবাবুর কথায়;  মুখে সবসময় নির্মল হাসি আর ধুতিপরা নিপাট- ভদ্রলোক । শিশুদের তিনি খুব  ভালবাসতেন । মহিলাদের তিনি সম্মান করতেন ।  তাঁর বেয়াইমশাই সুবোধবাবু একদিন বলেছিলেন; যে বাড়িতে মহিলারা কাঁদেন (মা, স্ত্রী, বৌমা-মেয়ে,) সে বাড়িতে কখনো সুখের লক্ষী আসেনা । এই কথাগুলো তিনি সবাইকে বলতেন । সুবোধবাবু একদিন বলেছিলেন; “যিনি বাড়িতে ৩৬৫ টি কলাগাছ ও ৩৬৫ টি নারকেল গাছ লাগাবেন তাঁর বাড়িতে কোনদিন অন্নের অভাব হবে না” । তাই তিনি অনেক প্রকারের কলাগাছ  লাগিয়েছিলেন । কলা খেতে ভালবাসতেন । তাঁর বড়বৌমা - শেফালীদেবীর কথায়; "আমার শ্বশুরমহাশয় পান খেতেন, কলা খেতেন আর নারকেলের পুরপিঠা খেতে ভালবাসতেন । রান্না করতেন খুব যত্ন করে ।  আমাকে অনেক রকমের রান্না শিখিয়েছেন " । তাঁর ছোট নাতনি তিথি তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণী থেকে ছড়ালেখা শুরু করেছে । কি ভালো লাগত তাঁর নাতনির লেখা ছড়াগুলো পড়ে । তিথি তার ছড়াতে লিখত; তার দাদু কি কি খেতে ভালবাসত । কি কি কথা বলত ।  সেই সব নানান কথা দিয়ে ছড়া লিখত । তার দাদু ভুল শুধরে দিত ।  তিথির ছড়া গুলো মাননীয় অজিত বাবু (তিথি দের বটতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক শ্রী অজিত কুমার জানা মহোদয়) খুব যত্ন সহকারে ছাপাতেন উনাদের সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকাতে । তাঁর বাড়িতে পড়ালেখা চর্চায় একটা আদর্শ সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে উঠেছিল । তিনি বলতেন; বিদ্যা দদাতি বিনয়ং। বিনয়াদ যাতি পাত্রতাম । পাত্রতাত ধনমাপ্নোতি । ধনাদ ধর্ম তত: সুখম ।  

কোনো সময়েই তাঁর মনোকষ্ট ছিলনা । অম্লান ও অকৃত্রিম হাসি ছিল তাঁর  সম্পদ । সকল সময়ে সুখ অনুভব করতেন ।  বিপদে তিনি ভেঙ্গে পড়েননি কোনদিন ।  বরং নিজের বিপদের দিনেও অন্যকে সু-পরামর্শ দিতেন আর সাহসী পদক্ষেপ করতেন । নিজেকে কখনো দুর্বল মনে করেননি । কখনো ভাগ্যকে দোষারোপ করতেন না বা অদৃষ্টে লিখন বলে ভাগ্যকে পরিহাস করতেন না । সাহস অবলম্বন করে এগিয়ে যেতেন । তিনি কখনো পরাজয় স্বীকার করেননি । লড়তে লড়তে জেতা শিখেছেন । তিনি একজন যুবকের মতো সাহসী ছিলেন । অন্যায় তিনি করতেন না আর অন্যায় বরদাস্ত করেননি কখনো । তাই আজও সমাজের বুকে তিনি এক আদর্শ ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত । বহুদিনের সাথী অর্দ্ধাঙ্গিনী - তাপসীদেবী, পুত্রত্রয় - শিবানন্দ, ব্রহ্মানন্দ ও সচ্চিদানন্দ, সু-পুত্রী - মীনাক্ষী, নাতি-নাতনি - অর্চিষ্মান, শুচিস্মিতা, শতাক্ষী, এনাক্ষী, ত্র্যম্বক ও পুত্রবধুত্রয় – শেফালীদেবী, সুপর্ণাদেবী ও সন্ধ্যাদেবী - তাঁর অনুপস্থিতিতে আজ সবাই দুঃখিত, ব্যথিত - মর্মাহত । আমাকে উনি খুব ভালবাসতেন । এইভাবে উনি চলে যাবেন, কোনদিন ভাবিনি । উনার জীবনটা ছিল অত্যন্ত সাধারণ । এমন উদারচেতা, কর্মবীর, অজাতশত্রু, সরল জীবনযাত্রী, প্রগাঢ় পন্ডিতের অকালে চলে যাওয়াটা আমাদের কাছে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং ব্যথাদায়ক ।

আজ হতে প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে (১৯৪০ সালে, ২রা ফেব্রুয়ারী), এক অজ-পাড়াগাঁ এক্তারপুরে জন্মেছিলেন ননীবালার গর্ভে । তাঁর বাবা ভূতনাথ জানা । ছিলেন একজন প্রাথমিক শিক্ষক । সেইসঙ্গে গ্রামে প্রাকটিস করতেন ডাক্তারি । গ্রামের গরিবের ঘরে যেকোনো অসুখ বিসুখে ছুটতেন তিনি । সবার ডাকে সাড়া দিতেন, যে যখন যা দিতেন কখনো গুনে দেখেননি । কেননা এটা তাঁর পেশা ছিলনা । ছিল নেশা । তেমনি পূর্ণেন্দুবাবু ও বাবার নেশার প্রতি একটু আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন । পড়া-পড়ানোর ফাঁকে একটু ডাক্তারি করতেন, হোমিওপ্যাথি ।  শুনেছি তিনি কখনো ফী’জ নেননি । এখনো লোকে বলে বেড়ায়; আমাদের পন্ডিত ডাক্তার কোথায় যে হারিয়ে গেল আমাদের ছেড়ে, এমন লোক আর আসবেনা এ জগতে । গরিব দুঃখীদের সেবার জন্য, বিনে পয়সার ডাক্তার পাওয়া যে মুস্কিল হয়ে যাচ্ছে আজকাল ।

টাকা ছাড়া আর কিছু হচ্ছেনা । চাকরি পেতে ঘুষ দিতে হচ্ছে । বিদ্যাদাতারা এখন ব্যাপারী হয়ে যাচ্ছে । আজকাল শিক্ষাকে শিল্পরূপে (Education Industry) ব্যবসায় হিসেবে গন্য করা হচ্ছে ।  আজকাল অনেক আদর্শহীন, চরিত্রহীন ধনলোভী এই ব্যবসায় এ বিনিয়োগ করছে ।  মদ ব্যবসায়ী, তামাক ব্যবসায়ী কিংবা অস্ত্র ব্যবসায়ীরা ও এই ব্যবসায়ে আসছে - শুধুমাত্র  ধনলাভের আশায় । সেখানে কি আদর্শ স্থান পাবে ? একশ্রেনীর মানুষ নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে মানুষের মধ্যে হিংসা ছড়াচ্ছে । নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বাড়ছে । "পাশফেল প্রথা" তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে তিনি বলতেন; পাশফেল প্রথায় ছাত্র ছাত্রীদের ছোটবেলা থেকে প্রতিযোগিতায় লড়ার ও জেতার সাহস যোগায় । তাতে ছাত্র-ছাত্রীরা রোদে জলে কষ্ট করে পড়ে খাঁটি সোনার মানুষে পরিনত হয় । আগে কত অন্দোলন হত । দলমত নির্বিশেষে সবাই সাপোর্ট করত ।  সবাই ভাবছে; আমার ছেলে প্রতিষ্ঠিত হোক সমাজে । ব্যাস ! এইটাই চাই, আর কারুরটা দরকার নেই । সেটা হবে কিভাবে ? আদর্শ শিক্ষা আর আদর্শ আচরণই তো পারে সমাজের শিরদাঁড়াটা সোজা রাখতে । প্রতিবন্ধী, দুঃখী ও নিঃস্বদের দয়া করো । দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, সমাজ ভাবনা, গুরুজনে শ্রদ্ধাভক্তি, শিশুদের স্নেহ ভালোবাসা, মায়া, মমতা, সততা, ন্যায়, নিষ্ঠা - এগুলোই সমাজকে করবে রক্ষা আর তাতেই হবে মানুষের মধ্যে আদর্শের প্রাণ-প্রতিষ্ঠা ।

তিনি বলতেন বিবেকানন্দের কথা - "সকল জীবই শিব, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর" - এই বাণী সহস্র-শতাব্দী ধরে সারা পৃথিবীর মানুষকে শিক্ষা দেবে । যারা প্রকৃত শিক্ষালাভ করবে তাঁরাই সুন্দর ভাবে জীবনযাপন করতে পারবে । সুন্দর সমাজ গঠন করবে । আদর্শ শিক্ষাই বাঁচাবে সমাজকে, বছর বছর - সহস্র বছর । দিকে দিকে হিংসা, রেষারেষি, মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বাড়ছে । অলস অকর্মন্য লোভী, চরিত্রহীন - মদ্য মাতাল লোকের সংখ্যা বাড়ছে ।  কি হবে আগামীদিনের ভবিষ্যত ! সুষ্ঠুভাবে  সমাজ চলবে কিভাবে ? দিশা দেখাবে কে - ভাবিয়ে তুলছে আমাদের । আজকে সেই স্মরণীয় বরণীয় পূর্ণেন্দুকুমার নামে চিরবিদ্রোহী যুবকের কথা মনে পড়ছে বেশিবেশি করে । আবার আসিবে ফিরে ....  হে মহাজীবন । তারই অপেক্ষায় ..

সমাপ্ত।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৯৭৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৫/০৯/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast