www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নীল পাহাড়ের ওপারে

আমি যে বাসাটায়  থাকি তার বারান্দা থেকে সিডনির মূল শহরটি দেখা যায়। রাতে তা স্বপ্নের মতো সুন্দর লাগে। হাজারো বাতি আর ল্যাম্পপোস্ট জ্বলজ্বল করে জ্বলে থাকে, যেমনটা জ্বলে থাকে মানুষের স্বপ্ন জীবনকে ঘিরে। অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর মানচিত্র থেকে কিছুটা দূরে, নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগরের স্বপ্ন নীল কোলে। বর্ণবাদের আধিপত্য যেমন আছে তেমনি আছে তেমনি আছে মনুষ্যত্বের বিশালতা। মনুষ্যত্ব ভীষণ সুন্দর। ঠিক যেমন অস্ট্রেলিয়া, মহাসাগর প্রশান্ত কিংবা নীল পাহাড়েরা। এই উন্নত বিশ্বের দেশ অস্ট্রেলিয়ার প্রাণ হলো সিডনি। অনেকে মনে করেন সিডনিই হয়তো অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী। এতে রাজধানী ক্যানবেরা হয়তো মুচকি হেসে কেবল মাথা নাড়ায়। সে যাগ গে...

প্রথম এখানে  এসেই দেখতে গেলাম অপেরা  হউস আর হার্ভার্ড ব্রিজ। আহামরি কিছু মনে হয়নি তবে  অবাক হয়েছিলাম সাদাকালো দাঁড়কাক দেখে! যদিও পরে জানতে পেরেছি ওগুলো দাঁড়কাক নয়। সে যাগ গে, সিডনি শহরে ডলার থাকলে সব আছে! অনন্য এ শহরে দ্রুতগামী না হলে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব কোন সাধারণ শ্রেণীর বহিরাগতের জন্যে; বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ছাত্রদের। ‘টিউশন ফি’ টা একেবারে বখে যাওয়া বেশি বেশি! বাস্তবতার প্রকটে স্বপ্ন দেখার সুযোগ বেশ সীমিত তবু স্বপ্নেরা থেমে থাকেনা। সিডনির দৌড়ে তাল মেলাতে পারলে জীবন এখানে মসৃণ। এমনকি কোন পিছুটান না থাকলে বিলাসী জীবনও সম্ভব কিন্ত পিছুটান যে পিছু ছাড়ে না! এজন্যেই তো আমি বাঙালি, একজন গর্বিত বাংলাদেশি যুবক।

প্রথম দিকের  কথা। প্রথম প্রথম চারপাশে তাকিয়ে নিজেকে খুব ছোট মনে হত, আশ্চর্য! সাদা চামড়ার মানুষ দেখলেই আগে একটা সমীহ হতো যা হয়তো আমার জাতিসত্তাতেই বিদ্যমান। কিন্তু এরই মাঝে উল্টোটাও ঘটে যায়। একদিন সিটি থেকে একটা মোবাইল ফোন কিনলাম; চমৎকার লাল রং। ফেরার সময় টানেলের প্রবেশ মুখে দেখলাম একজন সাদা বৃদ্ধ কিছু কলম হাতে দাড়িয়ে। তার গলায় একটা কাগজ ঝুলছে যাতে লেখা, ‘Help me to survive’। তৎক্ষণাৎ তার চোখের দিকে তাকালাম; সেই চোখে যে বেদনা দেখেছি তা আমার দুঃখকে ভাসিয়ে দিল প্রশান্তের নীল জলে। একটা কলম আমি কিনতে চেয়েছিলাম কিন্তু ডলারের সাথে টাকার অঙ্ক কষে সেটা কেনা হয়নি।  

একটা গির্জার  বিষণ্ণ ঘণ্টার শব্দ শুনলাম, আকাশটাকে বেশ বিষণ্ণ লাগছে। মানুষ নাকি বদলে যায়? সবাই আমায় বলত মাস চারেক যেতে দাও সব ঠিক হয়ে যাবে। পেরিয়ে গেছে বছর চারেক, বদলায়নি কিছুই। সেই বৃদ্ধ আজ কলম হাতে দাড়িয়ে থাকেন যার চোখ আজ আরও বেশি অসহায়। আমি আজও কষি ডলার ও টাকার মাঝে থাকা বিস্তর হিসেবের অঙ্ক। হিসেব যে মেলেনা কিছুতেই! এই বাসাটায় উঠেছি বহুদিন হোল। সুযোগ পাওয়া কঠিন তবু পেলেই হারিয়ে যাই প্রশান্তের বাতাসে কিংবা নীল পাহাড়ের বুকে। মনেহয় ঐ পাহাড় টপকে চলে আসি আমার সীমান্তে কিন্তু এ পাহাড় যে অনেক উঁচু বন্ধু! তাই পাহাড় ডিঙানো আর হয়না। নীল পাহাড়েরা নিস্তব্ধ হয়ে যায় পড়ন্ত বিকেলে।

মানুষ শুধু বলেই গেল, ‘বদলে যায়, বদলে যায়’।  বদলাতে নাচাইলেও যে বদলে যেতে হয় তা কেও বোঝে না কেন? আতাহারের সন্ধ্যাকালীন চাস্টলের ধুব পোড়া গন্ধ থেকে সেই থানাকাউন্সিল কোয়াটার কলোনির পুরনো লোহার গেইট এততুকু বদলায়নি আমার স্মৃতি থেকে! লোহায় জং ধরে কিন্তু আমি তো লোহা নই! প্রতি মুহূর্তে আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় এক হারানো জোনাকির ঝোপ, প্রিয় সেই নোংরা পুকুর, ছেঁড়া ফুটবল, ক্রিকেটের মাঠ, বৃষ্টির গন্ধ, ঝড়ে নোয়ানো আমগাছ। আমি দৌড়ে পালাই। প্রশান্তকে বলেছি সব; সেই বেদনায় সে আছড়ে দেয় প্রকাণ্ড ঢেউ, আমি তাতে ভাসাই একাকীত্বের ভেলা।

অস্ট্রেলিয়া আসার সময় বাবা তাঁর লেখা একটি বই আমায় দিয়েছিলেন, ‘ফিরে যাই  নিজের ধূলায়’। বছর দুই  আগে আমার ছোটবোন পিঙ্কু আমায় একটা কার্ড পাঠিয়েছে, তাতে সে লেখেছে, ‘ভাইয়া, ফিরে এসো  নিজের ধুলায়’। মায়ের  সাথে মাত্র কথা হচ্ছিল টেলিফোনে। বলছিলেন,“ব্যাচেলর-মাস্টারস কইরাই দেশে আইসা পরো আব্বু, ঐখানে থাকা দরকার নাই। আমাদের খুব একা লাগে, খালি খালি মনেহয়। পারলে আর একবার আইসা ঘুইরা যাও...” আমি বললাম, “আসব আম্মু; লাস্ট সেমিস্টারটা শেষ হোক... হ্যালো ... হ্যালো ... আম্মু ... হ্যালো ...” - এভাবে প্রায়ই লাইনটা কেটে যায়।

এখন অনেক রাত দূরের শহরের সব বাতি জ্বলে আছে স্বপ্নের মতো। হাজারো বাতি আর ল্যাম্পপোস্ট জ্বলজ্বল করে যেমনটা জ্বলে  থাকে মানুষের স্বপ্ন জীবনকে ঘিরে; যেভাবে জ্বলে থাকে প্রশান্তের বাতিঘর, যেভাবে জ্বলে থাকে আমার নীল পাহাড় ডিঙানোর স্বপ্ন...।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৯০৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৮/০৬/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast