তাবিজ
সকালের আলো ফুটতে মাত্র ১ ঘণ্টা বাকী । শেফালি এখনো ঘুমায় নি । সেই সন্ধ্যারাত থেকে এখন অবধি তার তিন মাসের একমাত্র মেয়ের পাশে জেগে আছে । মনে ভীষণ শঙ্কা । কী যে হয়েছে মেয়ের , শেফালি কিছুই বুঝতে পারছে না । পরশু দুপুরের পর থেকে মেয়ে কেমন অস্বাভাবিক হয়ে গেছে । মাঝে মাঝে সমস্ত মুখ কেমন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে; প্রবল শব্দে কেঁদে উঠছে । পরশু অবশ্য গঞ্জে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । ইব্রাহিম স্যার মেয়েকে দেখে কিছু ঔষধ লিখে দিয়েছেন । বলেছেন যে, শেফালি যেন কোন ঠাণ্ডাই স্পর্শ না করে এবং ১ দিন পর অবশ্যই দেখা করে যায় । কিন্তু শেফালির পক্ষে প্রথম নির্দেশটা পালন করা সম্ভব হয় নি । না হওয়ারই কথা; রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে ডাক্তারবাবুর আদেশের চেয়ে যে শাশুড়িমার নির্দেশ মান্য করা অধিক জরুরী – এ কথা কে না জানে ।
ভোরের আলো ফুটেছে । মেয়েকে কোলে নিয়ে শেফালি ভীরু পায়ে শাশুড়িমার সামনে এসে দাঁড়াল । শেফালির বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে শাশুড়ি বললেন, “ মেয়েকে রেখে এ দিকে এসো । অনেক কাজ বাকী পড়ে আছে ।“
শেফালি আস্তে আস্তে বলল, “মণির অসুখ অনেক বেড়ে গেছে । আমাকে এখন একে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে ।“
“ ও আচ্ছা, তাই । ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা তো আজকাল তোমাদের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে । আমার মনে হয় তোমার মেয়ের অন্য সমস্যা । গঞ্জের ডাক্তার ওকে ভালো করতে পারবে না । ওকে জ্বিনে আচর করছে ।“
চমকে উঠল শেফালি ! যদিও সে জ্বীন-ভুতে বিশ্বাস করে, তবুও তিন মাসের বাচ্চার সাথে জ্বীনের সম্পৃক্ততা কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছে ।
বউকে নিশ্চুপ দেখে শাশুড়ির রাগ হল । তার মানে বউ তার মূল্যবান বক্তব্যকে কানে তুলছে না । একটু ধমকের সুরে বললেন, “আমার কথা বিশ্বাস না হলে, শেষ পর্যন্ত তোমাকে পস্তাতে হবে । বয়স তো কম হয় নি, অনেক দেখেছি এসব । একবার আমার ছোট ভাইয়ের ছেলের এই দশা হয়েছিল । বালিপুরের লোকমান হুযুরের তাবিজ লাগাতেই একেবারেই সুস্থ হয়ে গিয়েছিল । এত ডাক্তার পাক্তারের পিছে না ছুটে । মণিরে হুযুরের কাছে নিয়ে যাও । অনেক বড় কবিরাজ লোকমান হুযুর ।“
শাশুড়ির এই কথাগুলো শেফালির একেবারে অবিশ্বাস্য মনে হয় নি । লোকমান হুযুরের খ্যাতি তো এমনি এমনি ছড়ায় নি । নিশ্চয়ই লোকজন উপকার পায় । একবার নিয়ে চেষ্টা করে দেখা যাক না ।
বাশুরের ছেলে মবিনকে সঙ্গে নিয়ে শেফালি বালিপুরে রওনা দিল ।
হুযুর মেয়ের গলায় তিনটি তাবিজ ঝুলিয়ে দিলেন; সঙ্গে এক বোতল পানি পড়া ।
বালিপুর থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেল । এখন শেফালির মেয়ের সেই পূর্বের অবস্থা নেই । কান্নাকাটিও বন্ধ । হুযুরের প্রতি শেফালির মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল । মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে গোসলের জন্য বের হল ।
ফিরে এসে দেখে মেয়ে প্রশান্তিতে ঘুমোচ্ছে । স্তন দিতে শেফালি মেয়েকে জাগাতে চাইল । কিন্তু সে আর জাগবে না । হুযুরের তাবিজ বুকে করে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
Înšigniã Āvî ২৬/০৯/২০১৩
-
ইব্রাহীম রাসেল ২৬/০৯/২০১৩--আপনার গল্প বলার ভংগিমাটা দারুণ।--
আরও গল্প চাই
অধিক শিক্ষিত না হওয়াই কী অন্ধমনস্কতার কারণ?
কিন্তু তথাকথিত 'শিক্ষিত' সমাজ যখন তাবিজ এর জন্য ছোটে....... তখন 'শিক্ষিত' 'অশিক্ষিত'র সংজ্ঞাটাই বদলে যায়।