শৈশবের স্বপ্ন পূরণ
🌿🌿🌹🌹 শৈশবের স্বপ্ন পূরণ 🌹🌹🌿🌿
🌹🏵🏵 বেগম সেলিনা খাতুন🏵🏵🌹
শৈশব থেকে মায়ের মুখে , মায়ের লালিত সপ্নের কথা শুনেছি । কালো গিলাফ ও সবুজ গম্ভুজের কথা শুনেছি । আমার মায়ের নিজের দেখার সৌভাগ্য হয়নি ,কিন্তু তিনি এতো বেশী হজ্জ সম্পর্কিত বই পড়তেন, তাই তার আল্লাহর ঘর এবং পবিত্র ভূমির প্রতি স্থানের কথা তার হৃদয়ে খোদাই করে লেখা হয়ে গিয়েছিল। সে আমাদের কে কাছে বসিয়ে বুঝিয়ে দিতো । মনোযোগ সহকারে তার কথা গুলো শ্রবন করতাম ।তার প্রতিটা কথায় মনের সান্নিধ্য লাভ করতাম ,তার কথায় প্রশান্তি, আবেগ ,তৃপ্তি এবং হৃদয়ে শিহরণ জাগতো। যেন আমি আল্লাহর ঘরের সামনে দাড়িয়ে দেখছি যমযমের ঝর্নাধারা , হারিয়ে গিয়েছি তাওয়াফের তরঙ্গ দোলায় , ছাফা-মারওয়ার আনন্দ বেদনায় শামিল হয়েছি আরাফার মিলন মেলায় , এবং মিনার তাবুর বর্ননা। যুমদালিফার পাথরের উপর ঘুমানো মনোরম সোনার মদিনার বর্ননা । যা এমন আবেগের সাথে শোনাতেন ,চোখের সামনে সব কিছু যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো । মায়ের একটাই সাধনা ছিল , আল্লাহর ঘরখানা নিজ হাতে স্পর্শ করার । তার আশা পূর্ন হয়নি , ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে তাকে বৈধব্য গ্রাস করেছিল । শেষ পর্যন্ত তাকেও অসুস্থ হয়ে বিছানায় থাকতে হয়েছে । মা নেক মানুষ ছিলেন মায়ের আশা পূর্ণ না হতেই এ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন ,না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আল্লাহ মাকে জান্নাতের সর্ব উচ্চু আসন দান করুন আমিন ।
হৃদয়ে শৈশব থেকে লালিত স্বপ্ন পূর্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় , হৃদয়ের উদ্যানে ফুল অংকরিত হলো। আতœার আলো উচ্ছসিত হলো , আমার হৃদয়ের সপ্ন আমাকে আনন্দ সাগরে ভাসাতে লাগলো। সারাদিন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম । কল্পনার স্বপ্ন , স্বপ্নের আবেশে পুলকিত ও শিহরিত হতে লাগলাম , কখনো আল্লাহর ঘর তাওয়াফ , কখনো শয়তানকে পাথর মারা, কখনো আল্লার ধ্যানে মগ্ন হওয়া। আমি আমার স্বামী ও আমার বড় ছেলে, আমরা তিনজন একত্রে আল্লাহর পবিত্র ভূমিতে আল্লাহর ডাকে সারা দিলাম ।
আজ প্রায় সপ্তাহ পার হলো , ভুলতে পারছি না মনের কোনোর আবেগ । আনন্দ আর ভালো লাগার সেই মূহুর্ত গুলো। হয়তো মনের কিছু কিছু আবেগ কাগজে কলমে তুলে ধরা কারো পক্ষে সম্ভব না। জানিনা, হয়তো কেও তুলে ধরতে পারে , আমি পারছিনা । কি লিখব ভাবতে ভাবতেই অনেক সময় পার হয়ে গেল ।
প্লেনে যাতায়াত আমার ভাগ্যে তেমন একটা সুযোগ হয়নি । ১১/০৭/২০১৯ ইং তারিখ বেলা ১১ টা বাজতেই প্লেনে উঠে বসলাম । সৌভাগ্য ক্রমে জানালার পাশে সিটটা পেয়ে গেলাম , সেই মূহুর্তের ভালো লাগা , আবেগ আর উচ্ছসিতে হারিয়ে গেলাম । জানালায় চোখ রাখতেই প্লেন শূন্যে উঠতে শুরু করলো। ছোট ছোট কাপুনি , ঝাকুনি শুরু হলো প্লেনে । সব যাত্রী একই উদ্দেশ্যে চলছে। প্রত্যেকটা লোকই এহরাম পড়া সাদা ধবধবে সেলাই বিহীন কাপড় পরিধান করা । এহরাম পড়া মানে , নিজেকে মৃত্যুর কোলে সপে দেওয়া । দুনিয়ার খেয়াল থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখা । সবার মুখে একই সাথে উচ্চারিত হতে লাগলো , “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শরিকালাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা , ওয়ান্নিায়ামাতা , লাকা ওয়াল মুলক লা শারি কালাক ”। এই কথাগুলো মনের গহীন ছুতে লাগলো, সারা শরীরে শিহরণ জাগলো । হে আল্লাহ তোমার ডাকে তোমার বান্দা হাজির।
প্লেনের গতি উপরের দিকে উঠছে তো উঠছেই । মাঝে মাঝে সতর্ক বাণী শোনা যাচ্ছে, সিট বেল ঠিক মতো সবাই বেধেছেন ? বিমান বালার হুশিয়ারী ,প্লেনের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত বীর দর্পে চলাফেরা । আবার ও শতর্ক বানীতে বলা হচ্ছে, প্লেনটি এখন ৩৮ হাজার ফিট উপরে রান ওয়েতে আছে । আকাশে দুর্যোগ নেমে এসেছে , আপনারা কেউ ভয় পাবেন না । সবাই সৃষ্টি কর্তাকে স্বরণ করেন । প্লেনের সমস্ত যাত্রী হাজী হওয়ার উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা শরীফ যাচ্ছে। প্রত্যেকেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুুত । দুর্যোগ বেশী সময় স্থায়ী করে নাই । আকাশ পরিস্কার হয়ে গেল । সবাই স¦স্তির নিশ্বাস ফেললো । আমি ও আমার অভ্যাস গত কাজ থেকে বিরত না থেকে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ছবি তুলার প্রস্তুতি নিলাম । ছবি আর কী তুলবো , চোখ তো ছানাবড়া , জানালা দিয়ে দৃশ্য গুলো দেখতে দেখতে ভাবনার জগতে চলে গেলাম । সারা জীবন , মেঘ দেখতাম মাথা উচু করে । চোখ দুটি কপালে তুলে , আর প্লেনে বসে মেঘ দেখছি মাথা নিচু করে , চোখ নিচু করে । মেঘের রাজ্যে দুধ রঙা মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। অপূর্ব দৃশ্য , এই দৃশ্্েযর সৌন্দর্যের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। যতটুকু পারি তুলে ধরার চেষ্টা করছি । মেঘের গায়ের রঙ দুধের মতো সাদা আকৃতি! কোথাও পাহাড়ের মতো, কোথাও গাছের মতো, কোথাও নদীর মতো মনে হচ্ছে ,যেন ছোট ছোট ঢেউ কিল বিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে । কোথাও মেঘের উপর মেঘ । মেঘের উপর মেঘ মানে প্লেনে বসে দেখতে পাচ্ছিলাম প্লেনে নিচের দিকে তাকালেও মেঘ উপরের দিকে নীল আকাশে মেঘের আনাগোনা । তুলা তুলা মেঘ গুলো নীলের সঙ্গে মাখা মাখি । দুধের সমুদ্রে দুধের তুফান।
মেঘ রাজ্য ছাড়িয়ে মরুভূমির রাজ্যে পৌছাতেই শুধু মরুভূমি আর মরুভ’মি ,এই মরুভূমির কোন কুল নেই , কিনারা নেই । আছে শুধু জন মানবহীন অথৈই পাথার । পাহাড় পর্বত দেখে মনের মধ্যে যে ভাবের উদয় হলো , যে অনুভব অনুভূতি মনের মধ্যে আন্দোলিত শুরু করলো । আল্লাহর প্রতি মহব্বত , প্রেম-ভালবাসার তরঙ্গ দোলায় ভাসতে লাগলাম ।
বিমানের চাকা ঘুরছে তো ঘুরছে , আরো জোরে ঘুরছে। আমার ভাগ্যের চাকাও মনে হয় ঘুরছে । ভাগ্য আমাকে নিয়ে যাবে তো আমার গন্তব্যে ? জানি না আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না । তবে আমার মন বলছে আমি তো আল্লাহর মেহমান মক্কার মুসাফির,মদিনার পথিক ।তার ইচ্ছাতে সব কিছু হবে। আমার কিসের ভয় ।মাঝে মাঝে বিমান থর থর করে কাঁপছে ।আমার মনের মধ্যে ভাবের তরক্সগ দোলা খাচ্ছে।অজানার উদ্দেশ্যে চলছি।পশ্চিমের অভিমুখে ।সময় যত পার হচ্ছে,মনের উত্তেজনা ততই বেড়ে যাচ্ছে ।মনের মধ্যে পাওয়ার আনন্দে মন বলছে হে কালো গিলাফ হে সবুজ গম্ভুজ আামি আসছি ,আমি আরো কাছে আসছি ।
আমরা মক্কায় বিকেল ৪টা নাগাদ পৌঁছালাম । সবাই এহরাম অবস্থায় , খাওয়া দাওয়া শেষ করে , তাওয়াফের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । আমাদের সফর সঙ্গি -১৬৫ জন । প্রথম যখন কালো গিলাফের দর্শন পাই , তাকে স্পর্শ লাভের অস্থিরতা ব্যাকুলতা যে কি ছিল তা অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা । যে শহর জীবনের প্রথম দেখলাম । দেখেই হৃদয়ের গভীরে নিজের জন্মভূমির চেয়ে বেশি ভালোবেসে ফেললাম । এ যেন প্রতিটি জায়গা আমার চেনা জানা । সেই সময় সেই প্রথম দিনটি বড় প্রিয় ছিল । তাওয়াফ শেষে সায়ী, সাফা-মারওয়া শেষ করে মসজিদুল হারামে তাহাজ্জুদ নামাজ শেষ করে , ফজরের আযানের ধ্বনির অপেক্ষায় বসে জিকিরে মগ্ন হয়ে গেলাম ।
মহাকবি কায়কোবাদের কবিতাটি মনে পড়ে গেলো ।
কে ঐ শোনালো মোরে আযানরে ধ্বনি
র্মমে র্মমে সইে সূর বাজলি কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ নাচলি ধমনী
কে ঐ শোনালো মোরে আযানরে ধ্বন।
ফজরের নামাজ শেষ হতেই , সামনে খেজুর ভর্তি বাটি ধরা হলো , দুটি খেজুর তুলে নিয়ে খেয়ে নিলাম , যমযমের পানি পান করে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । আমাদের গাইড ছিলেন মওলানা খুরশিদ আলম সাহেব তার আন্তরিকতা তুলনা বিহীন । নূরাণী চেহারার মাঝে প্রান খুলে হাসতেন । মাঝে মাঝে সবাইকে সচল রাখার জন্য মজার মজার কথা বলতেন । ওনি যখন “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লাশারিকালাক লাব্বাইক ইন্নাল হামদা , ওয়ান্নিমাতা , লাকা ওয়াল মুলক, লা শারি কালাক বলতেন আমরা সবাই তার সাথে সাথে বলতাম , এই শব্দগুলো মনের সাগরে ঢেউ খেলতো ।
হে আল্লাহ আমি তোমার ডাকে হাজির হয়েছি তোমার পবিত্র ভূমিতে , আমি তোমার মেহমান , আমি তোমার দেওয়া দ্বায়িত্ব হজ্জের আহকাম গুলো যেন ঠিক মতো পালন করতে পারি । তুমি তা সহজ করে দাও ,আসান করে দাও ,কবুল করে নাও ।
তাওয়াফঃ
আজকের তাওয়াফ হজ্জের প্রথম তাওয়াফ মানে ফরজ তাওয়াফ । দিন রাত ২৪ ঘন্টা তাওয়াফ চলছে ।কোন এক সময়ও জন সমুদ্রের কমতি ন্ইে । শুধু বেড়েই চলছে ।
যে দিন প্রথম তাওয়াফ করলাম সে দিনের বর্ণনা কি ভাবে লিখবো ? নাহ পারছিনা তবু লিখতে মন চাইছে । সেই সাতটি ঘূর্নয়নের স্বাদ , অপূর্ব , অতুলনীয়। তাই মাঝ পথে কলম থামিয়ে আপনাদের বলছি জীবনে একবার হলেও আল্লাহর পবিত্র ঘরখানা দর্শন করে যান ।
তাওয়াফের শেষ চক্করে ঐ কালো গিলাফ স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। আহা কী যে প্রশান্তি , শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন এক সাথে বলে উঠলো হায় আল্লাহ আমার মাবুদ , সারা জাহানের মালিক তোমাকে পেয়েছি । তোমার ঘর আমি ছুতে পেরেছি ্ । তুমি আমায় এতো ভালোবাসো , আমি যা তোমার কাছে প্রাপ্য নই , তুমি তার অধিক দিয়েছো , আমি তাহার শোকর করি । হে আল্লাহ আমি তোমার নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যান কামনা করি । মৃত্যুর পর সুখময় জীবন এবং জাহান্নামের আগুন হইতে পানা চাই। তাওয়াফের শেষ প্রদক্ষিনের পর মাকামে ইব্রাহীমের বাইরে তাওয়াফের দুই রাকাত নামাজ আদায় করে , মুনাজাতে চোখের পানি যেন থামতেই চাচ্ছে না । জানিনা সে পানি কিসের ছিল।আটই যিলহজ্জ থেকে পবিত্র হজ্জের কাজ শুরু হয় গেল। আমরা ভোরেই মিনার ্উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । সবার মনের মধ্যেই হজ্জের তরঙ্গমালা দোলা খেতে লাগলো । সামনে পিছনে ডানে বামে , কাফেলার পর কাফেলার মুখে একই সুর ধ্বনীত হতে লাগলো “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লাশারিকালাক লাব্ব্্্্্ইাক, ইন্নাল হামদা , ওয়ান্নিমাতা , লাকা ওয়াল মুলক, লাশারি কালাক । সারা জীবন আমার বুকের মধ্যে যে লালিত স্বপ্ন পুষে রেখেছিলাম , তা যেন পূরন হতে চলছে । হৃদয়ে মধুর স্পন্দন দোল খাচ্ছে। মনের গহীন থেকে বার বার একটাই বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে। হায় আল্লাহ হায় মাবুদ , তুমি আমাকে এতো এতো ভালোবাসো , আমি বুঝিনি । আজ বুঝতে পেরেছি , আমি যতটা প্রাপ্য ,উপযুক্ত,তুমি আমাকে তার অনেক অনেক বেশী দিয়েছো । হায় আল্লাহ আমি তোমার নিয়ামতের শোকর করি,শোকর আলহামদুলিল্লাহ ।
আরাফার ময়দানের কথা কি ভাবে যে লিখবো ! মীনা থেকে আরাফার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম বিকেল ৪টা থেকে ৫ টার মধ্যে। আমাদের বাস নামিয়ে দিল , আমাদের তাবু থেকে বেশ খানিকটা দুরে ওখান থেকে আমরা পায়ে হেঁটে তাবুতে পৌছালাম । অনেক বড় একটা তাবু , পাহাড়ের উপর । পুরুষ মহিলা একই তাবুর মধ্যে এক দিকে পুরুষ , একদিকে মহিলা । মাঝখানে বিছানার চাদর একটার মধ্যে একটা বেধে আড়াল করে দেওয়া,সারারাত সবাই নামাজ জিকির তেলাওয়াত নিয়ে ব্যাস্ত ।
ভোর থেকে তালবিয়ার আওয়াজে মুখরিত আরাফার ময়দান ,“লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক
লাশারিকালাক লাব্বাইক ,ইন্নাল হামদা , ওয়ান্নিমাতা , লাকা ওয়াল মুলক, লা শারি কালাক ।হাজির,হে আল্লাহ আমি হাজির।তোমার গুনাহগার বান্দা তোমার দুয়ারে হাজির। তুমি আমার সব আহকামগুলো সহজ করে দাও আসান করে দাও কবুল করে নাও ।
হে আল্লাহ , তুমি আমায় যে নিয়ামত দান করেছো , আমি তার শোকর করি। হে আল্লাহ আমি যা প্রাপ্য নই তুমি আমায় তার চেয়ে অধিক দিয়েছো ।হায় মাবুদ কি বলে যে তোমায় ধন্যবাদ দিবো, তা আমার জানা নেই। জানা নেই , জানা নেই।
আরাফার আকাশে বাতাসে এক মধুর আওয়াজ , তোমাকে অভিনন্দন , তুমি এসেছো , মারহাবা জানালে রহমতের ভূমিতে তোমাকে মারহাবা ! মারহাবা!
আমি আনন্দে , আবেগে উদ্ভাসিত হলাম , হৃদয়ের সবটুকু কৃতজ্ঞতা নিবেদন করলাম , মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে ।
খুরশিদ আলম সাহেব , অন্যান্য যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তাদের ক্রন্দনের কাছে আমার ক্রন্দন হয়তো আলাদা । মনে হচ্ছে ওনারা যে ভাবে আমার রবকে ডাকছে আমি মনে হয় সে ভাবে পারছি না । তা আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বলছি , হে আল্লাহ তোমার পেয়ারা বান্দার তোমার কাছে যা চাওয়া পাওয়া ,আমাকেও সামিল কর।
মক্কা থেকে যখন মিনার যাত্রা পথে লক্ষ লক্ষ হাজীর ইহরামের সাদা লিবানে নূরানি চেহারার দৃশ্য যে কি অপূর্ব, তা কি ভাবে বর্ণনা করবো, কিসের সাথে তুলনা করব জানিনা । এ দৃশ্য যে তুলনাহীন । শুধু একটি কথাই বলতাম হায় আল্লাহ তুমি আম্য়া কী দেখাচ্ছো । আমি তোম্রা এত প্রিয় বান্দা , তুমি আমার জন্য এত ভালবাসা , এতো নিয়ামত রেখেছো তা আমার বুঝতে এত দেরী হলো কেন? আমি কেন এতো দেরীতে তোমার পবিত্র ভূমিতে তোমার ডাকে সারা দিলাম ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের এতটাই শক্তি দান করলেন , আমরা মক্কা থেকে মীনা পর্যন্ত পায়ে হেঁটেই গন্তব্য স্থানে পৌছালাম । সে যে কী মধুর অনুভূতি আজও শরীরের শিহরন জাগে । “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক,লাব্বাইক লা শারিকালাক লাব্বাইক,ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিমাতা,লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকালাক।
একই সাথে যখন বার বার উচ্চারিত হয়।তখন হৃদয়ের জগতে ঝড় বইতে থাকে।সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উতাল পাতাল ঢেউ জাগতে থাকে।জীবন যেন বদলে গেল,বদলে দিলো।
আমাদের দলনেতা মওলানা খুরশিদ আলম সাহেব এতোটাই ধৈর্যশীল কোন পেরেশানি তাকে গ্রাস করতে পারে না। তার হৃদয় খানি সাগরের মতো উদার । কিছুক্ষন পর পর তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় তালবিয়া। কিন্তুু একটু পরেই তার কোনো শব্দ শোনা যায় না । সে তার ভাবের জগতে চলে যায় । মিনায় রাত্রী যাপন একই তাবুর মধ্যে ৫৬ জন মহিলা এক সাথে দেড় হাত চওড়া একটা বিছানা , একটা বিছানা থেকে আর একটি বিছানা একটার সাথে আর একটি লাগানো । খাবার খাওয়া তাও বিছানায় বসে । নামাজ ঔ বিছানাতেই আদায় করতে হয় । তবুও সবারই মুখে শান্তি -প্রশান্তি বিরাজমান ।
আরাফার দিন দুপুরের খাবার ১২ টার মধ্যেই দিয়ে দিল। খাবার শেষে যার যার মতো ইবাদতে মশগুল জোহরের নামাজ শেষে । আমাদের হুজুর মাওলানা খুরশিদ আলম সাহেবের রোনাযারি আমাদের হৃদয় স্পর্শ করলো , বিগলিত হলো আমাদের মন । সামান্য একটু হলেও চোখের পানিতে চোখের পাতা ভিজে উঠলো আমিন সুম্মা আমিন, মনের মনি কোটায় দোলা খেতে লাগলো। হে আল্লাহ তোমার ডাকে আমি হাজির । তুমি আমাদের আরাফার ময়দানে আল্লাহর পিয়ারা বান্দাদের সাথে আহাযারি ও রোনাযারির জামাতে শামিল করেছো ।
মাওলানা খুরশিদ আলম সাহেবের নিষ্পাপ ঐ চোখ দুটি থেকে অশ্রু ঝরছে তো ঝরছেই মুনাজাতের বিলাপ যেন থামছেই না । হে আল্লাহ তুমি তোমার রহমতের হাতখানি তোমার বান্দাদের উপর প্রসারিত কর। যেমন ভুখা- মিসকিন খাবারের আশায় তার দাতার কাছে হাত পাতে , তেমনি আল্লাহর দরবারে দু হাত প্রসারিত করে ক্ষমা ভিক্ষা চাহিতেছে । মোনাজাত শেষ হলো হুজুর সবাইকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে সু-উচ্চ পাহাড়ের উপর বসে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হওয়ার আশা করছে । এমন সময় পরিস্কার আকাশে আধার নেমে আসলো। দূর্যোগের আভাস জানিয়ে দিল। যার যার জায়গায় সবাই বসে পড়লো। আকাশ বাতাস একাকার হয়ে গেলো , মেঘের গর্জন , প্রবল শীলা বৃষ্টি, ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়ে গেল। মনে হলো এই জীবনের ভবলীলা এখনই সাঙ্গ হবে ! প্রতিটি মানুষের কান্নার আহাজারী কান্নার মাতম ,পরোয়ার দেগারের কাছে প্রার্থনা। সবাই আকাশের দিকে হাত তুলে কত ভাবে কত রঙে যে পরোয়ার দিগারকে ডেকেছে । চোখের পানি,বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে গিয়েছে।এতো লোকের কান্নার রোল পরোয়ার দিগার সইতে পারে নাই বলেই হয়তো অল্প সময়ের মধ্যে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। আরাফার ময়দানে দেওয়া আহাজারী অল্লাহ কবুল করে নিল । শুধু বার বার একটি কথা মনের মধ্যে জাগ্রত হতে লাগলো , আল্লাহ তার ভান্ডার খুলে বসে আছে , বলছে তোমার আঁচল পেতে , হাত পেতে নাও ,তোমাদের এখন সুবর্ন সুযোগ আঁচল ভরে পাওয়ার দিন ,হাত ভরে পাওয়ার দিন। অনেক সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও মানুষের কান্না থামছেই না। যে ভাবে লুটিয়ে পরছিলো শাহানÑশাহর দরবারে ,আমিও দেখছিলাম আল্লাহর আশেক বান্দার প্রেমমুগ্ধ ভালোবাসা ।আমিও শরীক ছিলাম ! আমিও ভালোবেসেছিলাম তোমার প্রেমিক বান্দাদেরকে ।
সোনার মদিনায় যাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে । রাত্রীতেই ব্যাগ প্যাটরা গুছিয়ে রাখলাম । আমার রুমের অন্যন্যা সদস্যরা আমাকে যেমন সাহায্য করলো । আমিও তাদের যথা সাধ্য চেষ্টা করলাম সাহায্য করার ।
হারাম শরীফে শেষ নামাজ পড়ার জন্য মনটা আনচান করতে লাগলো ।চলেই তো যাবো ! আর কোনদিন আল্লাহর এই পবিত্র ঘরে আসার সৌভাগ্য হবে কিনা কে জানে! হায় আল্লাহ তোমার কাছে কায়মনে প্রার্থনা করি ! তুমি তোমার পবিত্র ভুমিতে কালো গিলাপের ,খোশবু এবং সবুজ গম্বুজের সুবাস নিতে আমাকে বার বার সাহায্য কর। আমাদের দলনেতা মাওলানা খুরশিদ আলম সাহেব মহিলাদের মসজিদে নামাজ পড়তে বার বার নিষেধ করেন । মহিলাদের ঘরে বসে নামাজ পড়া যে সওয়াব মসজিদে পড়া একই সওয়াব, তার এই কথা গুলো মোটেই আমার ভালো লাগতো না । যে কামড়াটা আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিল , খুবই ছোট , এই ছোট কামরায় আমরা সাত জন মহিলা থাকতাম । আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি । কিন্তুু সাত জন এক সাথে কিম্বা একই সময়ে নামাজ পড়া সম্ভব হতো না । কেউ নামাজ পড়তো কেউ বসে থাকতো । কিন্তুু আমাদের দলনেতা সেটা না ভেবেই বলতো মহিলারা মসজিদে নামাজ পড়তে যেন না যান । আমরা মহিলা আমাদের কারো সাথে কথা বলা নিষেধ তাই কোন উত্তর দিতাম না । কিন্তুু আমিতো এসেছি , এই কালো গিলাফের দর্শন পেতে। আমিতো এসেছি মসজিদে হারামে বসে আমার আল্লাহর নাম স্বরণ করতে । আমি কি করে হোটেলের রূমে বসে থাকবো ।
রাত তিনটার আগেই ছেলেকে সংগে নিয়ে বের হলাম ।শেষ দিকে হজ্বের কয়েকদিন আগে মসজিদে ঢুকা খুব অসাধ্য হয়ে পরেছিল ।অনেক কষ্ট মাথায় নিয়ে সেদিন আল্লাহর ঘরে পৌছেছিলাম ।আল্লাহর রহমতে মসজিদুল হারামে নামাজ পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম ।বুকের মধ্যে থেকে কষ্টের একটা পাথর সরে গেলো ।আল্লাহর কাছে বার বার শোকর করলাম । হৃদয়ের সব টুকু আকুতি ঢেলে দিয়ে মহান রাব্বুল আলামিনকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলাম।তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করে ফজরের নামাজের জন্য বসে রইলাম ।আযান শোনা মাত্রই আমার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলো ।ফজর নামাজ শেষেই তো ,আমাকে মক্কা থেকে বিদায় নিতে হবে।
সেদিন ফজরের নামাজ যিনি পড়ালেন,তা আমি এখনও ভুলিতে পারিনা।অর্পূব এক বেদন যেন ঝরে ঝরে পড়ছে, তার তেলাওয়াত থেকে অন্তরের সব তরঙ্গ যেন ভিতর বাহির করে আছড়ে পরছে।জানিনা কেন এমন মনে হলো।হয়তো আমার মনটা বড়ই ব্যাকুল ছিল ।মক্কা ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট এমন মনে করিয়ে দিল ।
নামাজ শেষে আল্লার ঘরখানা ভালো করে দেখলাম ।নীরব কান্নায় আমার চোখের পানি ঝরছে তো ঝরছে ।আমার জীবনটা পরম সৌভাগ্যবান যে নিজের ছেলেই মা বাবাকে হজ্ব পালন করাতে নিজেই সঙ্গী হয়েছে।মা বাবার জন্য যা যা করনীয় সমস্ত কিছু পালন করেছে।আমাদের যাতে কোন কিছুর কষ্ট না হয় ,সেদিকে তার সজাগ দৃষ্টি ছিল।খোদার কাছে আবারও বলি তুমি আমায় এমন সন্তান দান করেছো বলেই তো ,তোমার পবিত্র ঘর তাওয়াফ করার সৌভাগ্য হয়েছে । তোমার শোকর করি ,শোকর আলহামদুলিল্লাহ ।
মসজিদুল হারাম থেকে বের হতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছেনা ।বুকের পাজর খানা যেন ভেঙ্গে আসছে ।আর কিছুক্ষণ পরই আমরা এই পবিত্র ঘর খানা ফেলে চলে যাব সেটা ভাবতেই পারছিনা । তবু যেতে হবে ।
তাইয়াফ শহর
তাইয়াফ শহর সম্পর্কে আমার আগে থেকে তেমন কিছু ধারনা ছিলনা ।রাত্রিতে খবর এলো আমাদের তাইয়াফ শহর দেখতে নিয়ে যাবে ।আমার অন্তরে সুপ্ত একটা আকাঙ্খা জেগে উঠলো ।এই তাইয়াফ শহরে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর কেটেছে শৈশব ,এই মাটিতে জড়িয়ে আছে অনেক বেদনা দায়কস্মৃতি।ছোট বেলায় বইতে পড়েছিলাম প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) যে পথ দিয়ে হাটতো ,সেই পথে এক বুড়ি কাঁটা ছড়িয়ে রাখতো ।শত্রুরা পাথর ছুড়ে মারতো ।পাথরের আঘাতে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতবিক্ষত হতো ।যখন তায়েফ গমনের ঘটনা পরেছিলাম তখন শিশু হৃদয়ে আনেক কষ্ট পেয়েছিলাম ।চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু ঝরেছিল।এই তাইয়াফ শহরেই হযরত মোহাম্মদ সাঃ এর দুধ মা হালিমা বাস করতেন ।সেই তাইয়েফ শহরে রাসুল (সঃ) আরব বাসির অত্যাচারে আশ্রয় নিতে এসেছিল ।আশ্রয়তো দেনই নাই ,নূন্যতম মূল্যবোধের পরিচয়ও তারা দেননি । সেই তায়েফ শহর দেখতে যাবো,রাত যেন শেষ হচ্ছে না।মনের মধ্যে আনন্দ উৎকন্ঠা বেড়েই চলছে।
রাত পোহালো ,পূবের রক্তিম সূর্য উদিত হলো ।আমরা তৈরী হয়ে বাসের অপেক্ষায় বসে রইলাম।বাস যথা সময় অতিক্রম করে উপস্থিত হলো ।আমাদের গ্রুপের সবাই যেতে ইচ্ছা প্রকাশ না করায় ,আমরা প্রায় ৩০ জনের মতো তায়েফের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
গাড়ী চলছে তো চলছেই । কয়েক ঘন্টা পর সবুজের দেখা মিললো । আমরা তো সবাই অবাক ,এখানে এতো সবুজ এলো কি করে ।অরো কিছুদুর যাওয়ার পর দেখতে লাগলাম ,সবুজের বাগান।ফুলের বাগান। ফল ফলাদির বাগান ।সে এক মনোরম দৃশ্য ।পুরো শহরটা পাহারের উপরে ।উচু নিচু ঢালু,অর্পুব এক সৃষ্টি ।তায়েফ শহরটা অর্পূব সুন্দর ,আবহাওয়া স্বাভাবিক,যেন বাংলাদেশের আবহাওয়া।
পথের দু’ধারের সবুজ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে পৌছে গেলাম তায়েফ শহরের মাঝে। গাড়ী থেকে নেমেই মনটা আনন্দে ভরে গেলে।সবুজ গাছের ছায়া ,এ যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা ।অর্পুব! অর্পুব ! তন্ময় হয়ে দাড়িয়ে রইলাম সৌন্দর্যকে সামনে রেখে । পাহাড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে পুরো শহর যেন সবুজে দোলায়েত।নিজের দেশের কথা মনে পড়ে গেল । এই সবুজ,এই আবহাওয়া যেন বাংলাদেশের । যেন সবুজের শহর ,সবুজের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। কোন কোলাহল নেই । পুরো শহরটি কোলাহল মুক্ত ।
🌹🏵🏵 বেগম সেলিনা খাতুন🏵🏵🌹
শৈশব থেকে মায়ের মুখে , মায়ের লালিত সপ্নের কথা শুনেছি । কালো গিলাফ ও সবুজ গম্ভুজের কথা শুনেছি । আমার মায়ের নিজের দেখার সৌভাগ্য হয়নি ,কিন্তু তিনি এতো বেশী হজ্জ সম্পর্কিত বই পড়তেন, তাই তার আল্লাহর ঘর এবং পবিত্র ভূমির প্রতি স্থানের কথা তার হৃদয়ে খোদাই করে লেখা হয়ে গিয়েছিল। সে আমাদের কে কাছে বসিয়ে বুঝিয়ে দিতো । মনোযোগ সহকারে তার কথা গুলো শ্রবন করতাম ।তার প্রতিটা কথায় মনের সান্নিধ্য লাভ করতাম ,তার কথায় প্রশান্তি, আবেগ ,তৃপ্তি এবং হৃদয়ে শিহরণ জাগতো। যেন আমি আল্লাহর ঘরের সামনে দাড়িয়ে দেখছি যমযমের ঝর্নাধারা , হারিয়ে গিয়েছি তাওয়াফের তরঙ্গ দোলায় , ছাফা-মারওয়ার আনন্দ বেদনায় শামিল হয়েছি আরাফার মিলন মেলায় , এবং মিনার তাবুর বর্ননা। যুমদালিফার পাথরের উপর ঘুমানো মনোরম সোনার মদিনার বর্ননা । যা এমন আবেগের সাথে শোনাতেন ,চোখের সামনে সব কিছু যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো । মায়ের একটাই সাধনা ছিল , আল্লাহর ঘরখানা নিজ হাতে স্পর্শ করার । তার আশা পূর্ন হয়নি , ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে তাকে বৈধব্য গ্রাস করেছিল । শেষ পর্যন্ত তাকেও অসুস্থ হয়ে বিছানায় থাকতে হয়েছে । মা নেক মানুষ ছিলেন মায়ের আশা পূর্ণ না হতেই এ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন ,না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আল্লাহ মাকে জান্নাতের সর্ব উচ্চু আসন দান করুন আমিন ।
হৃদয়ে শৈশব থেকে লালিত স্বপ্ন পূর্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় , হৃদয়ের উদ্যানে ফুল অংকরিত হলো। আতœার আলো উচ্ছসিত হলো , আমার হৃদয়ের সপ্ন আমাকে আনন্দ সাগরে ভাসাতে লাগলো। সারাদিন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম । কল্পনার স্বপ্ন , স্বপ্নের আবেশে পুলকিত ও শিহরিত হতে লাগলাম , কখনো আল্লাহর ঘর তাওয়াফ , কখনো শয়তানকে পাথর মারা, কখনো আল্লার ধ্যানে মগ্ন হওয়া। আমি আমার স্বামী ও আমার বড় ছেলে, আমরা তিনজন একত্রে আল্লাহর পবিত্র ভূমিতে আল্লাহর ডাকে সারা দিলাম ।
আজ প্রায় সপ্তাহ পার হলো , ভুলতে পারছি না মনের কোনোর আবেগ । আনন্দ আর ভালো লাগার সেই মূহুর্ত গুলো। হয়তো মনের কিছু কিছু আবেগ কাগজে কলমে তুলে ধরা কারো পক্ষে সম্ভব না। জানিনা, হয়তো কেও তুলে ধরতে পারে , আমি পারছিনা । কি লিখব ভাবতে ভাবতেই অনেক সময় পার হয়ে গেল ।
প্লেনে যাতায়াত আমার ভাগ্যে তেমন একটা সুযোগ হয়নি । ১১/০৭/২০১৯ ইং তারিখ বেলা ১১ টা বাজতেই প্লেনে উঠে বসলাম । সৌভাগ্য ক্রমে জানালার পাশে সিটটা পেয়ে গেলাম , সেই মূহুর্তের ভালো লাগা , আবেগ আর উচ্ছসিতে হারিয়ে গেলাম । জানালায় চোখ রাখতেই প্লেন শূন্যে উঠতে শুরু করলো। ছোট ছোট কাপুনি , ঝাকুনি শুরু হলো প্লেনে । সব যাত্রী একই উদ্দেশ্যে চলছে। প্রত্যেকটা লোকই এহরাম পড়া সাদা ধবধবে সেলাই বিহীন কাপড় পরিধান করা । এহরাম পড়া মানে , নিজেকে মৃত্যুর কোলে সপে দেওয়া । দুনিয়ার খেয়াল থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখা । সবার মুখে একই সাথে উচ্চারিত হতে লাগলো , “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শরিকালাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা , ওয়ান্নিায়ামাতা , লাকা ওয়াল মুলক লা শারি কালাক ”। এই কথাগুলো মনের গহীন ছুতে লাগলো, সারা শরীরে শিহরণ জাগলো । হে আল্লাহ তোমার ডাকে তোমার বান্দা হাজির।
প্লেনের গতি উপরের দিকে উঠছে তো উঠছেই । মাঝে মাঝে সতর্ক বাণী শোনা যাচ্ছে, সিট বেল ঠিক মতো সবাই বেধেছেন ? বিমান বালার হুশিয়ারী ,প্লেনের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত বীর দর্পে চলাফেরা । আবার ও শতর্ক বানীতে বলা হচ্ছে, প্লেনটি এখন ৩৮ হাজার ফিট উপরে রান ওয়েতে আছে । আকাশে দুর্যোগ নেমে এসেছে , আপনারা কেউ ভয় পাবেন না । সবাই সৃষ্টি কর্তাকে স্বরণ করেন । প্লেনের সমস্ত যাত্রী হাজী হওয়ার উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা শরীফ যাচ্ছে। প্রত্যেকেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুুত । দুর্যোগ বেশী সময় স্থায়ী করে নাই । আকাশ পরিস্কার হয়ে গেল । সবাই স¦স্তির নিশ্বাস ফেললো । আমি ও আমার অভ্যাস গত কাজ থেকে বিরত না থেকে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ছবি তুলার প্রস্তুতি নিলাম । ছবি আর কী তুলবো , চোখ তো ছানাবড়া , জানালা দিয়ে দৃশ্য গুলো দেখতে দেখতে ভাবনার জগতে চলে গেলাম । সারা জীবন , মেঘ দেখতাম মাথা উচু করে । চোখ দুটি কপালে তুলে , আর প্লেনে বসে মেঘ দেখছি মাথা নিচু করে , চোখ নিচু করে । মেঘের রাজ্যে দুধ রঙা মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। অপূর্ব দৃশ্য , এই দৃশ্্েযর সৌন্দর্যের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। যতটুকু পারি তুলে ধরার চেষ্টা করছি । মেঘের গায়ের রঙ দুধের মতো সাদা আকৃতি! কোথাও পাহাড়ের মতো, কোথাও গাছের মতো, কোথাও নদীর মতো মনে হচ্ছে ,যেন ছোট ছোট ঢেউ কিল বিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে । কোথাও মেঘের উপর মেঘ । মেঘের উপর মেঘ মানে প্লেনে বসে দেখতে পাচ্ছিলাম প্লেনে নিচের দিকে তাকালেও মেঘ উপরের দিকে নীল আকাশে মেঘের আনাগোনা । তুলা তুলা মেঘ গুলো নীলের সঙ্গে মাখা মাখি । দুধের সমুদ্রে দুধের তুফান।
মেঘ রাজ্য ছাড়িয়ে মরুভূমির রাজ্যে পৌছাতেই শুধু মরুভূমি আর মরুভ’মি ,এই মরুভূমির কোন কুল নেই , কিনারা নেই । আছে শুধু জন মানবহীন অথৈই পাথার । পাহাড় পর্বত দেখে মনের মধ্যে যে ভাবের উদয় হলো , যে অনুভব অনুভূতি মনের মধ্যে আন্দোলিত শুরু করলো । আল্লাহর প্রতি মহব্বত , প্রেম-ভালবাসার তরঙ্গ দোলায় ভাসতে লাগলাম ।
বিমানের চাকা ঘুরছে তো ঘুরছে , আরো জোরে ঘুরছে। আমার ভাগ্যের চাকাও মনে হয় ঘুরছে । ভাগ্য আমাকে নিয়ে যাবে তো আমার গন্তব্যে ? জানি না আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না । তবে আমার মন বলছে আমি তো আল্লাহর মেহমান মক্কার মুসাফির,মদিনার পথিক ।তার ইচ্ছাতে সব কিছু হবে। আমার কিসের ভয় ।মাঝে মাঝে বিমান থর থর করে কাঁপছে ।আমার মনের মধ্যে ভাবের তরক্সগ দোলা খাচ্ছে।অজানার উদ্দেশ্যে চলছি।পশ্চিমের অভিমুখে ।সময় যত পার হচ্ছে,মনের উত্তেজনা ততই বেড়ে যাচ্ছে ।মনের মধ্যে পাওয়ার আনন্দে মন বলছে হে কালো গিলাফ হে সবুজ গম্ভুজ আামি আসছি ,আমি আরো কাছে আসছি ।
আমরা মক্কায় বিকেল ৪টা নাগাদ পৌঁছালাম । সবাই এহরাম অবস্থায় , খাওয়া দাওয়া শেষ করে , তাওয়াফের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । আমাদের সফর সঙ্গি -১৬৫ জন । প্রথম যখন কালো গিলাফের দর্শন পাই , তাকে স্পর্শ লাভের অস্থিরতা ব্যাকুলতা যে কি ছিল তা অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা । যে শহর জীবনের প্রথম দেখলাম । দেখেই হৃদয়ের গভীরে নিজের জন্মভূমির চেয়ে বেশি ভালোবেসে ফেললাম । এ যেন প্রতিটি জায়গা আমার চেনা জানা । সেই সময় সেই প্রথম দিনটি বড় প্রিয় ছিল । তাওয়াফ শেষে সায়ী, সাফা-মারওয়া শেষ করে মসজিদুল হারামে তাহাজ্জুদ নামাজ শেষ করে , ফজরের আযানের ধ্বনির অপেক্ষায় বসে জিকিরে মগ্ন হয়ে গেলাম ।
মহাকবি কায়কোবাদের কবিতাটি মনে পড়ে গেলো ।
কে ঐ শোনালো মোরে আযানরে ধ্বনি
র্মমে র্মমে সইে সূর বাজলি কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ নাচলি ধমনী
কে ঐ শোনালো মোরে আযানরে ধ্বন।
ফজরের নামাজ শেষ হতেই , সামনে খেজুর ভর্তি বাটি ধরা হলো , দুটি খেজুর তুলে নিয়ে খেয়ে নিলাম , যমযমের পানি পান করে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । আমাদের গাইড ছিলেন মওলানা খুরশিদ আলম সাহেব তার আন্তরিকতা তুলনা বিহীন । নূরাণী চেহারার মাঝে প্রান খুলে হাসতেন । মাঝে মাঝে সবাইকে সচল রাখার জন্য মজার মজার কথা বলতেন । ওনি যখন “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লাশারিকালাক লাব্বাইক ইন্নাল হামদা , ওয়ান্নিমাতা , লাকা ওয়াল মুলক, লা শারি কালাক বলতেন আমরা সবাই তার সাথে সাথে বলতাম , এই শব্দগুলো মনের সাগরে ঢেউ খেলতো ।
হে আল্লাহ আমি তোমার ডাকে হাজির হয়েছি তোমার পবিত্র ভূমিতে , আমি তোমার মেহমান , আমি তোমার দেওয়া দ্বায়িত্ব হজ্জের আহকাম গুলো যেন ঠিক মতো পালন করতে পারি । তুমি তা সহজ করে দাও ,আসান করে দাও ,কবুল করে নাও ।
তাওয়াফঃ
আজকের তাওয়াফ হজ্জের প্রথম তাওয়াফ মানে ফরজ তাওয়াফ । দিন রাত ২৪ ঘন্টা তাওয়াফ চলছে ।কোন এক সময়ও জন সমুদ্রের কমতি ন্ইে । শুধু বেড়েই চলছে ।
যে দিন প্রথম তাওয়াফ করলাম সে দিনের বর্ণনা কি ভাবে লিখবো ? নাহ পারছিনা তবু লিখতে মন চাইছে । সেই সাতটি ঘূর্নয়নের স্বাদ , অপূর্ব , অতুলনীয়। তাই মাঝ পথে কলম থামিয়ে আপনাদের বলছি জীবনে একবার হলেও আল্লাহর পবিত্র ঘরখানা দর্শন করে যান ।
তাওয়াফের শেষ চক্করে ঐ কালো গিলাফ স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। আহা কী যে প্রশান্তি , শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন এক সাথে বলে উঠলো হায় আল্লাহ আমার মাবুদ , সারা জাহানের মালিক তোমাকে পেয়েছি । তোমার ঘর আমি ছুতে পেরেছি ্ । তুমি আমায় এতো ভালোবাসো , আমি যা তোমার কাছে প্রাপ্য নই , তুমি তার অধিক দিয়েছো , আমি তাহার শোকর করি । হে আল্লাহ আমি তোমার নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যান কামনা করি । মৃত্যুর পর সুখময় জীবন এবং জাহান্নামের আগুন হইতে পানা চাই। তাওয়াফের শেষ প্রদক্ষিনের পর মাকামে ইব্রাহীমের বাইরে তাওয়াফের দুই রাকাত নামাজ আদায় করে , মুনাজাতে চোখের পানি যেন থামতেই চাচ্ছে না । জানিনা সে পানি কিসের ছিল।আটই যিলহজ্জ থেকে পবিত্র হজ্জের কাজ শুরু হয় গেল। আমরা ভোরেই মিনার ্উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । সবার মনের মধ্যেই হজ্জের তরঙ্গমালা দোলা খেতে লাগলো । সামনে পিছনে ডানে বামে , কাফেলার পর কাফেলার মুখে একই সুর ধ্বনীত হতে লাগলো “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লাশারিকালাক লাব্ব্্্্্ইাক, ইন্নাল হামদা , ওয়ান্নিমাতা , লাকা ওয়াল মুলক, লাশারি কালাক । সারা জীবন আমার বুকের মধ্যে যে লালিত স্বপ্ন পুষে রেখেছিলাম , তা যেন পূরন হতে চলছে । হৃদয়ে মধুর স্পন্দন দোল খাচ্ছে। মনের গহীন থেকে বার বার একটাই বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে। হায় আল্লাহ হায় মাবুদ , তুমি আমাকে এতো এতো ভালোবাসো , আমি বুঝিনি । আজ বুঝতে পেরেছি , আমি যতটা প্রাপ্য ,উপযুক্ত,তুমি আমাকে তার অনেক অনেক বেশী দিয়েছো । হায় আল্লাহ আমি তোমার নিয়ামতের শোকর করি,শোকর আলহামদুলিল্লাহ ।
আরাফার ময়দানের কথা কি ভাবে যে লিখবো ! মীনা থেকে আরাফার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম বিকেল ৪টা থেকে ৫ টার মধ্যে। আমাদের বাস নামিয়ে দিল , আমাদের তাবু থেকে বেশ খানিকটা দুরে ওখান থেকে আমরা পায়ে হেঁটে তাবুতে পৌছালাম । অনেক বড় একটা তাবু , পাহাড়ের উপর । পুরুষ মহিলা একই তাবুর মধ্যে এক দিকে পুরুষ , একদিকে মহিলা । মাঝখানে বিছানার চাদর একটার মধ্যে একটা বেধে আড়াল করে দেওয়া,সারারাত সবাই নামাজ জিকির তেলাওয়াত নিয়ে ব্যাস্ত ।
ভোর থেকে তালবিয়ার আওয়াজে মুখরিত আরাফার ময়দান ,“লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক
লাশারিকালাক লাব্বাইক ,ইন্নাল হামদা , ওয়ান্নিমাতা , লাকা ওয়াল মুলক, লা শারি কালাক ।হাজির,হে আল্লাহ আমি হাজির।তোমার গুনাহগার বান্দা তোমার দুয়ারে হাজির। তুমি আমার সব আহকামগুলো সহজ করে দাও আসান করে দাও কবুল করে নাও ।
হে আল্লাহ , তুমি আমায় যে নিয়ামত দান করেছো , আমি তার শোকর করি। হে আল্লাহ আমি যা প্রাপ্য নই তুমি আমায় তার চেয়ে অধিক দিয়েছো ।হায় মাবুদ কি বলে যে তোমায় ধন্যবাদ দিবো, তা আমার জানা নেই। জানা নেই , জানা নেই।
আরাফার আকাশে বাতাসে এক মধুর আওয়াজ , তোমাকে অভিনন্দন , তুমি এসেছো , মারহাবা জানালে রহমতের ভূমিতে তোমাকে মারহাবা ! মারহাবা!
আমি আনন্দে , আবেগে উদ্ভাসিত হলাম , হৃদয়ের সবটুকু কৃতজ্ঞতা নিবেদন করলাম , মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে ।
খুরশিদ আলম সাহেব , অন্যান্য যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তাদের ক্রন্দনের কাছে আমার ক্রন্দন হয়তো আলাদা । মনে হচ্ছে ওনারা যে ভাবে আমার রবকে ডাকছে আমি মনে হয় সে ভাবে পারছি না । তা আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বলছি , হে আল্লাহ তোমার পেয়ারা বান্দার তোমার কাছে যা চাওয়া পাওয়া ,আমাকেও সামিল কর।
মক্কা থেকে যখন মিনার যাত্রা পথে লক্ষ লক্ষ হাজীর ইহরামের সাদা লিবানে নূরানি চেহারার দৃশ্য যে কি অপূর্ব, তা কি ভাবে বর্ণনা করবো, কিসের সাথে তুলনা করব জানিনা । এ দৃশ্য যে তুলনাহীন । শুধু একটি কথাই বলতাম হায় আল্লাহ তুমি আম্য়া কী দেখাচ্ছো । আমি তোম্রা এত প্রিয় বান্দা , তুমি আমার জন্য এত ভালবাসা , এতো নিয়ামত রেখেছো তা আমার বুঝতে এত দেরী হলো কেন? আমি কেন এতো দেরীতে তোমার পবিত্র ভূমিতে তোমার ডাকে সারা দিলাম ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের এতটাই শক্তি দান করলেন , আমরা মক্কা থেকে মীনা পর্যন্ত পায়ে হেঁটেই গন্তব্য স্থানে পৌছালাম । সে যে কী মধুর অনুভূতি আজও শরীরের শিহরন জাগে । “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক,লাব্বাইক লা শারিকালাক লাব্বাইক,ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিমাতা,লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকালাক।
একই সাথে যখন বার বার উচ্চারিত হয়।তখন হৃদয়ের জগতে ঝড় বইতে থাকে।সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উতাল পাতাল ঢেউ জাগতে থাকে।জীবন যেন বদলে গেল,বদলে দিলো।
আমাদের দলনেতা মওলানা খুরশিদ আলম সাহেব এতোটাই ধৈর্যশীল কোন পেরেশানি তাকে গ্রাস করতে পারে না। তার হৃদয় খানি সাগরের মতো উদার । কিছুক্ষন পর পর তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় তালবিয়া। কিন্তুু একটু পরেই তার কোনো শব্দ শোনা যায় না । সে তার ভাবের জগতে চলে যায় । মিনায় রাত্রী যাপন একই তাবুর মধ্যে ৫৬ জন মহিলা এক সাথে দেড় হাত চওড়া একটা বিছানা , একটা বিছানা থেকে আর একটি বিছানা একটার সাথে আর একটি লাগানো । খাবার খাওয়া তাও বিছানায় বসে । নামাজ ঔ বিছানাতেই আদায় করতে হয় । তবুও সবারই মুখে শান্তি -প্রশান্তি বিরাজমান ।
আরাফার দিন দুপুরের খাবার ১২ টার মধ্যেই দিয়ে দিল। খাবার শেষে যার যার মতো ইবাদতে মশগুল জোহরের নামাজ শেষে । আমাদের হুজুর মাওলানা খুরশিদ আলম সাহেবের রোনাযারি আমাদের হৃদয় স্পর্শ করলো , বিগলিত হলো আমাদের মন । সামান্য একটু হলেও চোখের পানিতে চোখের পাতা ভিজে উঠলো আমিন সুম্মা আমিন, মনের মনি কোটায় দোলা খেতে লাগলো। হে আল্লাহ তোমার ডাকে আমি হাজির । তুমি আমাদের আরাফার ময়দানে আল্লাহর পিয়ারা বান্দাদের সাথে আহাযারি ও রোনাযারির জামাতে শামিল করেছো ।
মাওলানা খুরশিদ আলম সাহেবের নিষ্পাপ ঐ চোখ দুটি থেকে অশ্রু ঝরছে তো ঝরছেই মুনাজাতের বিলাপ যেন থামছেই না । হে আল্লাহ তুমি তোমার রহমতের হাতখানি তোমার বান্দাদের উপর প্রসারিত কর। যেমন ভুখা- মিসকিন খাবারের আশায় তার দাতার কাছে হাত পাতে , তেমনি আল্লাহর দরবারে দু হাত প্রসারিত করে ক্ষমা ভিক্ষা চাহিতেছে । মোনাজাত শেষ হলো হুজুর সবাইকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে সু-উচ্চ পাহাড়ের উপর বসে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হওয়ার আশা করছে । এমন সময় পরিস্কার আকাশে আধার নেমে আসলো। দূর্যোগের আভাস জানিয়ে দিল। যার যার জায়গায় সবাই বসে পড়লো। আকাশ বাতাস একাকার হয়ে গেলো , মেঘের গর্জন , প্রবল শীলা বৃষ্টি, ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়ে গেল। মনে হলো এই জীবনের ভবলীলা এখনই সাঙ্গ হবে ! প্রতিটি মানুষের কান্নার আহাজারী কান্নার মাতম ,পরোয়ার দেগারের কাছে প্রার্থনা। সবাই আকাশের দিকে হাত তুলে কত ভাবে কত রঙে যে পরোয়ার দিগারকে ডেকেছে । চোখের পানি,বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে গিয়েছে।এতো লোকের কান্নার রোল পরোয়ার দিগার সইতে পারে নাই বলেই হয়তো অল্প সময়ের মধ্যে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। আরাফার ময়দানে দেওয়া আহাজারী অল্লাহ কবুল করে নিল । শুধু বার বার একটি কথা মনের মধ্যে জাগ্রত হতে লাগলো , আল্লাহ তার ভান্ডার খুলে বসে আছে , বলছে তোমার আঁচল পেতে , হাত পেতে নাও ,তোমাদের এখন সুবর্ন সুযোগ আঁচল ভরে পাওয়ার দিন ,হাত ভরে পাওয়ার দিন। অনেক সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও মানুষের কান্না থামছেই না। যে ভাবে লুটিয়ে পরছিলো শাহানÑশাহর দরবারে ,আমিও দেখছিলাম আল্লাহর আশেক বান্দার প্রেমমুগ্ধ ভালোবাসা ।আমিও শরীক ছিলাম ! আমিও ভালোবেসেছিলাম তোমার প্রেমিক বান্দাদেরকে ।
সোনার মদিনায় যাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে । রাত্রীতেই ব্যাগ প্যাটরা গুছিয়ে রাখলাম । আমার রুমের অন্যন্যা সদস্যরা আমাকে যেমন সাহায্য করলো । আমিও তাদের যথা সাধ্য চেষ্টা করলাম সাহায্য করার ।
হারাম শরীফে শেষ নামাজ পড়ার জন্য মনটা আনচান করতে লাগলো ।চলেই তো যাবো ! আর কোনদিন আল্লাহর এই পবিত্র ঘরে আসার সৌভাগ্য হবে কিনা কে জানে! হায় আল্লাহ তোমার কাছে কায়মনে প্রার্থনা করি ! তুমি তোমার পবিত্র ভুমিতে কালো গিলাপের ,খোশবু এবং সবুজ গম্বুজের সুবাস নিতে আমাকে বার বার সাহায্য কর। আমাদের দলনেতা মাওলানা খুরশিদ আলম সাহেব মহিলাদের মসজিদে নামাজ পড়তে বার বার নিষেধ করেন । মহিলাদের ঘরে বসে নামাজ পড়া যে সওয়াব মসজিদে পড়া একই সওয়াব, তার এই কথা গুলো মোটেই আমার ভালো লাগতো না । যে কামড়াটা আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিল , খুবই ছোট , এই ছোট কামরায় আমরা সাত জন মহিলা থাকতাম । আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি । কিন্তুু সাত জন এক সাথে কিম্বা একই সময়ে নামাজ পড়া সম্ভব হতো না । কেউ নামাজ পড়তো কেউ বসে থাকতো । কিন্তুু আমাদের দলনেতা সেটা না ভেবেই বলতো মহিলারা মসজিদে নামাজ পড়তে যেন না যান । আমরা মহিলা আমাদের কারো সাথে কথা বলা নিষেধ তাই কোন উত্তর দিতাম না । কিন্তুু আমিতো এসেছি , এই কালো গিলাফের দর্শন পেতে। আমিতো এসেছি মসজিদে হারামে বসে আমার আল্লাহর নাম স্বরণ করতে । আমি কি করে হোটেলের রূমে বসে থাকবো ।
রাত তিনটার আগেই ছেলেকে সংগে নিয়ে বের হলাম ।শেষ দিকে হজ্বের কয়েকদিন আগে মসজিদে ঢুকা খুব অসাধ্য হয়ে পরেছিল ।অনেক কষ্ট মাথায় নিয়ে সেদিন আল্লাহর ঘরে পৌছেছিলাম ।আল্লাহর রহমতে মসজিদুল হারামে নামাজ পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম ।বুকের মধ্যে থেকে কষ্টের একটা পাথর সরে গেলো ।আল্লাহর কাছে বার বার শোকর করলাম । হৃদয়ের সব টুকু আকুতি ঢেলে দিয়ে মহান রাব্বুল আলামিনকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলাম।তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করে ফজরের নামাজের জন্য বসে রইলাম ।আযান শোনা মাত্রই আমার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলো ।ফজর নামাজ শেষেই তো ,আমাকে মক্কা থেকে বিদায় নিতে হবে।
সেদিন ফজরের নামাজ যিনি পড়ালেন,তা আমি এখনও ভুলিতে পারিনা।অর্পূব এক বেদন যেন ঝরে ঝরে পড়ছে, তার তেলাওয়াত থেকে অন্তরের সব তরঙ্গ যেন ভিতর বাহির করে আছড়ে পরছে।জানিনা কেন এমন মনে হলো।হয়তো আমার মনটা বড়ই ব্যাকুল ছিল ।মক্কা ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট এমন মনে করিয়ে দিল ।
নামাজ শেষে আল্লার ঘরখানা ভালো করে দেখলাম ।নীরব কান্নায় আমার চোখের পানি ঝরছে তো ঝরছে ।আমার জীবনটা পরম সৌভাগ্যবান যে নিজের ছেলেই মা বাবাকে হজ্ব পালন করাতে নিজেই সঙ্গী হয়েছে।মা বাবার জন্য যা যা করনীয় সমস্ত কিছু পালন করেছে।আমাদের যাতে কোন কিছুর কষ্ট না হয় ,সেদিকে তার সজাগ দৃষ্টি ছিল।খোদার কাছে আবারও বলি তুমি আমায় এমন সন্তান দান করেছো বলেই তো ,তোমার পবিত্র ঘর তাওয়াফ করার সৌভাগ্য হয়েছে । তোমার শোকর করি ,শোকর আলহামদুলিল্লাহ ।
মসজিদুল হারাম থেকে বের হতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছেনা ।বুকের পাজর খানা যেন ভেঙ্গে আসছে ।আর কিছুক্ষণ পরই আমরা এই পবিত্র ঘর খানা ফেলে চলে যাব সেটা ভাবতেই পারছিনা । তবু যেতে হবে ।
তাইয়াফ শহর
তাইয়াফ শহর সম্পর্কে আমার আগে থেকে তেমন কিছু ধারনা ছিলনা ।রাত্রিতে খবর এলো আমাদের তাইয়াফ শহর দেখতে নিয়ে যাবে ।আমার অন্তরে সুপ্ত একটা আকাঙ্খা জেগে উঠলো ।এই তাইয়াফ শহরে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর কেটেছে শৈশব ,এই মাটিতে জড়িয়ে আছে অনেক বেদনা দায়কস্মৃতি।ছোট বেলায় বইতে পড়েছিলাম প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) যে পথ দিয়ে হাটতো ,সেই পথে এক বুড়ি কাঁটা ছড়িয়ে রাখতো ।শত্রুরা পাথর ছুড়ে মারতো ।পাথরের আঘাতে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতবিক্ষত হতো ।যখন তায়েফ গমনের ঘটনা পরেছিলাম তখন শিশু হৃদয়ে আনেক কষ্ট পেয়েছিলাম ।চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু ঝরেছিল।এই তাইয়াফ শহরেই হযরত মোহাম্মদ সাঃ এর দুধ মা হালিমা বাস করতেন ।সেই তাইয়েফ শহরে রাসুল (সঃ) আরব বাসির অত্যাচারে আশ্রয় নিতে এসেছিল ।আশ্রয়তো দেনই নাই ,নূন্যতম মূল্যবোধের পরিচয়ও তারা দেননি । সেই তায়েফ শহর দেখতে যাবো,রাত যেন শেষ হচ্ছে না।মনের মধ্যে আনন্দ উৎকন্ঠা বেড়েই চলছে।
রাত পোহালো ,পূবের রক্তিম সূর্য উদিত হলো ।আমরা তৈরী হয়ে বাসের অপেক্ষায় বসে রইলাম।বাস যথা সময় অতিক্রম করে উপস্থিত হলো ।আমাদের গ্রুপের সবাই যেতে ইচ্ছা প্রকাশ না করায় ,আমরা প্রায় ৩০ জনের মতো তায়েফের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
গাড়ী চলছে তো চলছেই । কয়েক ঘন্টা পর সবুজের দেখা মিললো । আমরা তো সবাই অবাক ,এখানে এতো সবুজ এলো কি করে ।অরো কিছুদুর যাওয়ার পর দেখতে লাগলাম ,সবুজের বাগান।ফুলের বাগান। ফল ফলাদির বাগান ।সে এক মনোরম দৃশ্য ।পুরো শহরটা পাহারের উপরে ।উচু নিচু ঢালু,অর্পুব এক সৃষ্টি ।তায়েফ শহরটা অর্পূব সুন্দর ,আবহাওয়া স্বাভাবিক,যেন বাংলাদেশের আবহাওয়া।
পথের দু’ধারের সবুজ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে পৌছে গেলাম তায়েফ শহরের মাঝে। গাড়ী থেকে নেমেই মনটা আনন্দে ভরে গেলে।সবুজ গাছের ছায়া ,এ যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা ।অর্পুব! অর্পুব ! তন্ময় হয়ে দাড়িয়ে রইলাম সৌন্দর্যকে সামনে রেখে । পাহাড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে পুরো শহর যেন সবুজে দোলায়েত।নিজের দেশের কথা মনে পড়ে গেল । এই সবুজ,এই আবহাওয়া যেন বাংলাদেশের । যেন সবুজের শহর ,সবুজের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। কোন কোলাহল নেই । পুরো শহরটি কোলাহল মুক্ত ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ইতি হালদার ২৭/০৫/২০২০চমৎকার প্রকাশ। তারুন্য ব্লগে আমি নুতন সদস্য আমার পাতায় সাদর আমন্ত্রণ ।মতামত প্রদান করে উৎসাহ প্রদান করুন ।
-
ইসমাইল জসীম ১৯/০৫/২০২০তায়েফ শহর রাতের শহর। এ শহরে মাথার উপর দিয়ে মেঘেরা ভাসে। উপর থেকে নীচের তায়েফ দেখতে খুবই সুন্দর বিশেষ করে রিং রোড। ধন্যবাদ আপনাকে।
-
কে এম শাহ্ রিয়ার ১৬/০৫/২০২০খুবই ভালো হয়েছে!
-
ফয়জুল মহী ১৩/০৫/২০২০নিখুঁত প্রকাশ,