www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

হাওয়াবদল

পিছন থেকে 'অ্যাই নীলশার্ট' ডাকটা শুনেই আশেপাশে তাকালাম। দেখলাম, এখানে নীল শার্ট পরা একমাত্র ব্যক্তিটা আমিই। তারপর পিছনে ফিরে দেখি, কিছুটা দূর থেকে শতভাগ ফর্মাল লুকের একটা ছেলে গলায় টাই ঝুলিয়ে হাত উঁচু করে আমার দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমি দাঁড়ালাম। মতিঝিলের সন্ধ্যার রাস্তা। চারদিকে বেশ আলো থাকলেও ফুটপাতের এই দিকটায় একটু আবছা অন্ধকার তাই ছেলেটার চেহারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছেনা।

আমার অফিসের কলিগদের কেউনা। তাছাড়া এখানে নতুন জয়েন করেছি তাই পরিচিত কেউ হওয়ারও কথা না; তাহলে কে এই লোকটা? এসব ভাবতে ভাবতেই লোকটা তখন আমার সামনে চলে আসলো। তখন বেশ বিনয়ভাবে জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি কি আমাকে ডেকেছিলেন?'
-'হ্যাঁ, আমাকে আপনি চিনতে পারেননি, তাইনা?'
-'পারছিনা, তবে আপনাকে কি আমার চেনার কথা?'
-'তা অবশ্য না, আচ্ছা চলুন কোথাও একটু বসি তারপর আমার পরিচয় দিচ্ছি।'
-'চলুন'

পাশের একটা চা'য়ের স্টলে গিয়ে দুইজনে বসলাম। লোকটা চা অর্ডার করলো। নানান ধরণের ধান্দাবাজ আর বাটপারের জায়গা এই ঢাকা শহর। কথাটা মাথায় অবিরাম ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু তবুও কেনো যেনো অদ্ভুতভাবে এই লোকটাকে আমার সেরকম কিছুই মনে হচ্ছেনা। আমি তখনও চেনার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই কিছু মনে করতে পারছিনা। হাতে চা আসলো। প্রথম চুমুক দিয়েই বললাম, 'এবার বলুন, আপনি কে?' তারপর লোকটা আমাকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'আপনি কি কখনো ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছেন?'
-'হ্যাঁ, পড়েছিলাম। ২০১০ সালে; ময়মনসিংহ শহরে।'
-'মনে হচ্ছে এটাই ছিলো আপনার শেষ ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার ঘটনা।'
-'হ্যাঁ, কীভাবে বুঝলেন?'
-'জানেন তো, মানুষ তার জীবনের শেষ কোনো ঘটনা কখনো ভুলেনা।'
-'তা অবশ্য ঠিক।'
-'আচ্ছা বলুন তো, সেদিন ছিনতাইকারীরা আপনার কাছ থেকে কী নিয়েছিলো আর সেই দলে কতোজন ছিলো?'
-'যতোদূর মনে পড়ে সাত জন ছিলো আর নিয়েছিলো দুই হাজার টাকা এবং একটা কমদামী মোবাইল।'
-'সব মনে আছে দেখছি।'
-'মনে থাকবেনা? এখন পর্যন্ত এটাই আমার প্রথম ও শেষ এমন ঘটনা। এখন বলুন, আপনি কে? আপনি কি ঘটনাটা দেখেছেন? কিন্তু সেখানে ওই সাত জন ছাড়া তো আশেপাশে কেউ ছিলোনা। তাহলে কি আপনি সেই সাতজনেরই একজন ছিলেন?'
-'হা হা হা, ঠিক ধরেছেন। সেদিন সেখানে আমিও ছিলাম। তবে এখন ভয় পাবেন না। তার পরদিনই এসব ছেড়ে দিয়েছি। দেখছেন না, চাকরি-বাকরি নিয়ে কেমন কর্পোরেট মানুষ হয়ে গেছি।'
-'হ্যাঁ, তা'ই তো দেখছি।'

আমার আর তার জীবন নিয়ে আরও অনেক কথা হলো আমাদের। আমার কাছে তার বদলে যাওয়ার ঘটনাটাও বললো।

সেসময় সে আনন্দমোহন কলেজে হিসাববিজ্ঞানে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করতো আর পাশাপাশি ছিনতাই-টিনতাই করতো। বেশ বড়লোক পরিবারের ছেলে হয়েও এসব করতো শুধুমাত্র সঙ্গদোষে। এখন সে সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি করে। বগুড়ায় থাকে। অফিশিয়াল এক কাজে হেডঅফিসে এসেছিলো আর এখানেই আমাকে দেখে চিনতে পেরে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে।

ছেলেটার আজকের বদলে যাওয়ার পিছনে প্রধান কারণ ছিলো তার ছোটবোনের মৃত্যু। আমার সাথে ঘটা সেই ঘটনার রাতেই সে বাসায় ফিরে দেখে তার ছোটবোন তানিশার ভীষণ জ্বর। রাত বাড়তে থাকে সেই সাথে বাড়তে থাকে তানিশার জ্বরও। শেষরাতের দিকে অবস্থা আরও বেগতিক দেখে হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়। তানিশাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো সাথে সেও উঠলো। আর তখনই তানিশা তাকে বলেছিলো,

"বোধহয় আর বাঁচবোনা রে, ভাইয়া। তোকে অনেক জ্বালিয়েছি। আমাকে মাফ করে দিস; আর তুই ভালোভাবে চলিস।"

তার মিনিটখানেক পরেই তানিশা সবাইকে কাঁদিয়ে জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিয়েই হঠাৎ পালিয়ে গেলো।

এসব বলতে বলতে টিস্যুপেপার দিয়ে আরেকবার চোখ মুছে পকেট থেকে একটা পাঁচ'শ টাকার নোট নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বললো, 'এই টাকাটা রাখুন। নগদ দু'হাজার টাকা আর মোবাইলটা বিক্রি করেছিলাম পনের'শ টাকায়; আমার ভাগে পড়েছিলো পাঁচ'শ টাকা। তাই এটা ফেরত দিতে চাচ্ছি। চাইলে পুরোটাই দিতে পারতাম কিন্তু এখন আমার কাছে এতো টাকা নেই। রাতেই বগুড়ার বাসে উঠতে হবে; বুঝেনই তো এতোদূরের পথ।' আমি তাকে বললাম, 'কোনো টাকাই আপনার দিতে হবেনা। আপনি বরং ভালোভাবে চলে যান।' কিন্তু তাকে তা'তে কোনোভাবেই রাজি করাতে পারিনি।

আমি নির্বিকার হয়ে অবশেষে টাকাটা নিলাম। তারপর সে বললো, 'ভাই জানেন? সে রাতে আমার বোনটা চলে যাওয়ার পর শপথ করেছিলাম আর কোনোদিন এসব করবোনা, ভালো হয়ে যাবো এবং সেদিন প্রথম যে মানুষটাকে আমার মনে পড়েছিলো সেটা ছিলেন আপনি। সেজন্যে আপনাকে আজও ভুলতে পারিনি। তারপর থেকে ভিতরে একটা অপরাধবোধ নিয়ে যতোটুকু পেরেছি আপনাকে খুঁজেছি কিন্তু ভাবিনি এতোবছর পর আবার আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে। এটা সত্যিই আল্লাহ্'র কৃপা।'

তারপর লোকটা নিজেকে হালকা করে নিয়ে আমাকে বিদায় দিয়ে রিকশায় চেপে চলে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে থেকে আমার হাতের পাঁচ'শ টাকার নোটটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৭৪৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০২/০৮/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • মধু মঙ্গল সিনহা ০৩/০৮/২০১৮
    দারুন। মন আনন্দে ভরে গেল,অনেক অনেক ...।
 
Quantcast