মেছো মজারাজ
এক ছিল হাবু। খুব সহজ সরল আর বোকা সোকা মানুষ। সে বিয়ে করে ঘরে আনল এক সুন্দরী বৌ। হাবুর বউ দেখে পাড়ার নিন্দুকদের চোখ কপালে উঠে গেল। চর্তুমূখী সুন্দরী বৌয়ের রূপের প্রসংশায় হাবু ভেজায় খুশী। “কি গো হাবু, তা নতুন বৌ কেমন আদর যতœ করে।” ঠাট্টাকারীদের এমন সব প্রশ্নের উত্তরে হাবু শুধু বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসে। কোন উত্তর দেয় না। কারণ হাবুর বউ পুটির নিষেধ আছে।
হাবুর ত্রিকূলে কেউ না থাকলেও তেচালা খড়ের ছোট ঘর, পুকুর এবং ছোট একখন্ড ক্ষেতের আয়ে বেশ ভালই কাটতে লাগল। ক্ষেতের পরিচর্যা করে সময় পেলেই হাবু নদীতে মাছ ধরে। সংসারে নতুন বউয়ের আগমনে হাবুর চারিদিকে খুশির জোয়ার।
হাবুর মুখের আনন্দ বেশি দিন টিকল না। হাবু আজকাল খুব চিন্তায় নিমজ্জিত থাকে। কারণ তার সুন্দরী বৌটার দিকে মেছো ভূতের নজর পরেছে। হাবু প্রতিদিনের মত সেদিনও হাঁট থেকে এসে নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিল। দুপুর হয়ে গেল। কিন্তু কোন মাছই হাবু পেল না। বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। মুরব্বিরা বলে ভর দুপুরে নদীতে মাছ ধরলে না-কি মেছো ভূতে ধরে। হাবু ভাবছে তাহলে কি তার জালে যত মাছ পরছে সব মেছো ভূতে খেয়ে যাচ্ছে! হাবু মেছো ভ‚ত ভয় পায় না।
হাবু বাড়ী ফিরে যাবার আগে শেষ বারের মত নদীতে জাল ফেলল। সাথে সাথে জালের মধ্যে বিশাল হট্টগোল। মনে হচ্ছে বড় বোয়াল মাছ হয়তো পরেছে। ভাল হয়েছে। গত তিন চার দিন হাবুর খুব হাট টান যাচ্ছে। মাছটা ভালই ভাল তুলতে পারলে হাঁটে বিক্রি করলে নগদ কিছু টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু হাবু জাল তুলতে পারছে না। জাল পানির নিচে কিছুতে আটেেক গেছে। জালের ভিতর কোন সাড়া শব্দও নাই। মনে হয় মাছটিওবের হয়ে গেছে। হাবুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। জাল তোলার জন্য হাবু ভরা নদীতে ডুব দিল। হাবু চোখ বন্ধ করে হাত দিয়ে জালের নিশানা হাতড়াতে হাতড়াতে সে আবিষ্কার করল তার জালটি একটি বড় সুরঙ্গর ভিতর আটকে আছে।
হাবু শুনেছে মেছো ভ‚তেরা পানির নিচে সুড়ঙ্গর ভিতর থাকে। হাবুর সে কথা মনে পরতে গাবড়ে গেল। সে পানি থেকে উপরে উঠতে চাইল। কিন্তু চিংড়ি মাছের মত লম্বা একটি হাত তাকে ধরে ফেলল। হ্যাচকা টান দিয়ে গভীর সুড়ঙ্গর তলদেশে নিয়ে গেল। তার হাত পা কলাপাতার মত থর থরে কাঁপতে লাগল। সে অনুভব করতে পারছে তার হাত এখন কেউ ধরে নেই। নাকি সুরে অদ্ভুত টাইপের গলা “কি রে হাবু চোখ খুলিস না কেন?” হাবু চমকিত হয়ে চোখ খুলল। দেখল বোয়াল মাছের মত লম্বা চোয়ালের মুখ, কাকঁড়ার মত ধারালো আঙ্গুলযুক্ত দুটি হাত, গজার মাছের মত লাল টগবগে চোখগুলো কিন্তু মানুষের মত পা আছে। হাবু বুঝতে পারছে এটাই তা হলে মেছো ভুত!
বুড়ো গোছের ভুত। তার পাশে বয়সে নবীন আরও কিছু মেছো ভুত আছে তবে ও গুলো খুব সাধারণ চেহারা। ভয় পাওয়ার মত তেমন কোন বিশেষণ নাই। বুড়ো ভুতটা নাকি মেছো ভুতদের রাজা। তার ইচ্ছা কোন মানুষ্যরমনী বিয়ে করবে। কিছু দনি আগে সে হাবুর বৌ পুটিকে দেখেছে। পুটির শরীরে সুন্দর বাসনা লাগানো ছিল। হাবুও মুরব্বিদের কাছে শুনেছে বিয়ের বাসনা নিয়ে যেখানে সেখানে যেতে নাই। ভুত-পেতের নজর লাগে। হাবু কখনো মানতো না। বিপদ যখন হয়েই গেছে। এবার বেঁচে গেলে সে খুব মানবে।
কিছু তরুণ ভ‚ত এসে কুর্নিশ করে জানতে চাইল, “মেছো মহারাজ! হুকুম দিন হাবুকে কি শাস্তি দেওয়া হবে।” হাবু ভাবছে শাস্তি কেন? নিশ্চই দুপুর বেলা নদীতে মাছ ধরা ভুতেরা বরদাস্ত করে না। হাবুর গাড় মটকানোর শাস্তি দেওয়া হলো। হাবু ভয় পেয়ে গেল। দেখলো কিছু চিংড়ি মাছের হাতের মত কাল বিদঘুটে, কুৎসিত হাত তার গলা টিপে ধরতে আসছে। হাবু পালানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। যত জোড়ে দৌড়াতে চাইছে পা তার চলছে না। হাবু শ্বাস নিতেও পারছে না। বাঁচার জন্য গলা ফাটিয়ে পাশের বাড়ীর খাঁ চাচাকে ডাকার চেষ্টা করছে কিন্তু গলা থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। হাতগুলো হাবুর মাথাটা জোড়ে চেপে ধরেছে। একটা সুড়ঙ্গর ভিতরে পুতে দিতে চাচ্ছে।
হাবু যখন চোখ মেলে তাকাল দেখল, পুটি পানির গøাস হাতে নিয়ে পাশে বসা। বারবার জিজ্ঞেস করছে “কি হয়েছে তোমার। তুমি ঘর ছেড়ে নদীর পাড়ে নাকি ঘুমাচ্ছিলে?” হাবু কোন কথা বলে না। ভূতের কথা বললে পুটি ভয় পেয়ে যাবে। বুকটা ধরপর করছে। একটু পানি খেয়ে নিল। বউকে প্রশমিত করার জন্য বলল “তুমি অত অস্থির হইয়ো না, নদীর ধারে ঠাÐা বাতাস তাই একটু ঘুমিয়ে নিলাম আর কি।” বেলা অনেক হয়ছে। সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পরেছে। শার্টটা কাধে করে হাবু হাটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। পুটি রান্না ঘরে যেতে যেতে বলল, দেখ হাঁটে থেকে কিছু মাছ-টাছ নিয়ে এসো।
সেদিন ভাদ্র পূর্ণিমার শেষ রাত ছিল। হাবু হাঁটে গিয়ে দেখল ইলিশ খুব সস্তা। এমনিতে হালি চার’শ টাকা থাকে কিন্তু আজ একই ইলিশের হালি দুইশ টাকায় বিকোচ্ছে। হাবু বড় থেকে একটা মাছ নব্বই টাকা দিয়ে কিনল। মাছটা হাতে নিয়ে পুটির কথা মনে পড়ল। পুটি মাছ দেখে আজ নিশ্চই খুব খুশি হবে। হাবু মাছ কিনে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি দিকে রওয়ানা হলো। কিন্তু যতিন বাবু নাছোড় বান্দা। অনেক দিন পরে হাবু এত বড় মাছ কিনেছে তাই তাকে চা খাওয়াতে হবে। রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে তাই গল্পের শেষ না করে উঠে গেল।
মফস্বলের হাঁট ইটের রাস্তাটা নদীর ঘাটাব্দি শেষ। খেয়া পারানোর পর সরু মেঠো রাস্তা। দু’পাশে ঘন গাছের আড়ে সব সময় চাপা আধার ঘাবটি মেরে থাকে। তে-পথার মাথা পর্যন্ত হাবুর সাথে দক্ষিণ পাড়ার একজন অপরিচিত লোক ছিল। এখন হাবু একা। আমাবশ্যার অন্ধাকারেও এ পথে হাবুর একা হাটার অভ্যাস আছে। কিন্তু আজ কেমন বুকটা ধুর-ধুর করছে। হাবুর হঠাৎ মেছো মহারাজের কথা মনে পড়ে গেল। মেছো মহারাজা হাবুর সুন্দরী বৌকে বিয়ে করতে চায়। এমন পাঁজি ভূতের কথা হাবু কোন দিন শুনেনি। সামনে ঠাকুর পাড়া। তাই হাবুর শরিরে যেন ভয়ে কাটা দিতে চাইল। ঠাকুর পাড়ার মানুষের বসতি খুব কম। অনেকে বলে ঠাকুর পাড়া আগে অনেক লোক ছিল কিন্তু সব পদ্ম ঘোস্বামীর পেটে গেছে। পদ্ম ঘোস্বামী খুব রূপবতী ছিল।কিন্তু পনের টাকা নিয়ে বরের বাবার সাথে বনিবনা হচ্ছিল না। আর তাই পদ্ম ঘোস্বামীর লগ্নভ্রষ্ট হয়েছিল। পদ্ম ঘোস্বামীর লগ্নভ্রষ্ট হওয়ায় বিয়ের রাতে তেঁতুল গাছে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আর সেই তেঁতুল গাছের নিচেই তাকে চাপামাটি দেওয়া হয়েছিল। তারপর এক ভাদ্রমাসের আমাবশ্যার রাতে সে কবর ভেঙ্গে উঠে এলো। আর গ্রামের অনেক লোককে ভয় দেখিয়ে, ঘাড় মটকে দিয়ে মেরে ফেলল। আরও অনেক লোক মহামারী রোগে মারা গেল। ভয়ে অনেক লোক গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। পরে পুরাহিতরা পদ্ম ঘোস্বামীর আত্মার শান্তির জন্য মাস ব্যাপি পূজা দিয়েছিল। তারপর থেকে আর কাউকে মারে নি। এই গল্প হবুর দাদির কাছে শোনা।
হাবু তেঁতুল গাছটার কাছাকাছি আসাতে কেমন একটা গরম ধমকা বাতাসে গাছটা আচমকা দুলিয়ে দিল। ভয়ে হাবুর শরীর অবস হয়ে গেল। হঠাৎ পিছনের দিকে থেকে কেউ একজন হাবুর দিকে হেঁটে আসছে দেখে হাবু বুকে একটু সাহস ফিরে এল। হাবু দাঁড়ালো একসাথে যাবে। হাবু খুব আনন্দিত হলো। হাবুর পরিচিত মানুষ থেকে সাহসে গলার জোর বেড়ে গেল। “কিরে কালু এত রাতে কাই গিছিলি।” কালু হাবুর কথার কোন উত্তর দেয় না রাস্তার পাশ ধরে হাটে। কালু হাবুদের পাশের বাড়ির ছনিম মাঝির ছেলে। বাঁশি বাজিয়ে সাপ ধরত। গ্রামের কত সাপ সে ধরেছে তার হিসাব নাই। হাঁটের দিনে সাপ খেলা দেখিয়ে অনেক টাকা কামিয়েছিল। কিন্তু একদিন সাপ ধরার বায়না নিয়ে বউয়ের কাছে বিদায় নিয়ে যে গেল ফিরল খাঁটিয়া করে। খুব বিষধর সাপ ছিল। এক ছোবলে না-কি মৃত্যু হয়েছিল। সমস্ত শরীর কাল হয়ে গিয়েছিল। বউটার কোন বাচ্চা টাচ্চা ছিল না তাই সে বাপের বাড়ী চলে গিয়েছি। তখন থেকে কালুর ভীটেয় আর প্রদীপ জ্বলেনি। কালু মরে গেছে সেটা মনে পরতেই হাবুর শরিরটা কেমন ছমছম করছে। তার পাশে কালু হাঁটছে সেই মরা কালু! হাবু আর কালুর মুখের দিকে তাকাতে পারল না। নিচের দিকে তাকিয়ে জোর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। কালু খুব ধীর গতিতে হাঁটছে। পাগুলো কেমন ছাগলের পায়ের মত! হাবু উধর্ব শ্বাসে হেঁটে কালুকে পিছনে ফেলে এসেছে। সাহস করে একবার পিছনে তাকালো, না পিছনে কেউ নাই। ঠাকুর পাাড়ার তেতুঁল গাছও ফেলে এসেছে অনেক দূর। হাবু জোরে দৌড়াচ্ছে। সামনে দেখল মাথা নিচু করে খাঁ চাচা হাটছে। হাবু এবার থামল। খাঁ চাচা অনেক দোয়া কালাম জানা লোক। তাকে দেখে হাবু বুকে হাপাতে হাপাতে বললঃ জানেন চাচা, ছনিম মাঝি ছেলে কালুও তো কবর থেকে উঠে এসেছে। ও ভূত হয়ে গেছে। আমার পাশে পাশে এতক্ষণ হাঁটছিল। আর ওর শরীর পুরাটাই মানুষের মত কিন্তু পা দুটা ছাগলের পায়ের মত। এ কথা বলার সাথে সাথে খাঁ চাচা পরনের লুঙ্গি উঁচু করে তার একটা পা এগিয়ে দিয়ে বললঃ “এ রকম” হাবু দেখল খাঁ চাচার পাটাও কালুর পায়ের মত ছাগলের পা। হাবু বেহুশ হয়ে গেল।
হাবুর যখন হুশ ফিরল দেখল সে ঘরে। তার শিয়রে খাঁ চাচা দোয়া কালাম পরে ফুক দিচ্ছে। তাকে একটা তাবিজও দিল। সেই থেকে হাবুর আর কখনো রাত করে হাঁটে যায় না। আর নদীতেও মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে।
====<><>====
হাবুর ত্রিকূলে কেউ না থাকলেও তেচালা খড়ের ছোট ঘর, পুকুর এবং ছোট একখন্ড ক্ষেতের আয়ে বেশ ভালই কাটতে লাগল। ক্ষেতের পরিচর্যা করে সময় পেলেই হাবু নদীতে মাছ ধরে। সংসারে নতুন বউয়ের আগমনে হাবুর চারিদিকে খুশির জোয়ার।
হাবুর মুখের আনন্দ বেশি দিন টিকল না। হাবু আজকাল খুব চিন্তায় নিমজ্জিত থাকে। কারণ তার সুন্দরী বৌটার দিকে মেছো ভূতের নজর পরেছে। হাবু প্রতিদিনের মত সেদিনও হাঁট থেকে এসে নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিল। দুপুর হয়ে গেল। কিন্তু কোন মাছই হাবু পেল না। বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। মুরব্বিরা বলে ভর দুপুরে নদীতে মাছ ধরলে না-কি মেছো ভূতে ধরে। হাবু ভাবছে তাহলে কি তার জালে যত মাছ পরছে সব মেছো ভূতে খেয়ে যাচ্ছে! হাবু মেছো ভ‚ত ভয় পায় না।
হাবু বাড়ী ফিরে যাবার আগে শেষ বারের মত নদীতে জাল ফেলল। সাথে সাথে জালের মধ্যে বিশাল হট্টগোল। মনে হচ্ছে বড় বোয়াল মাছ হয়তো পরেছে। ভাল হয়েছে। গত তিন চার দিন হাবুর খুব হাট টান যাচ্ছে। মাছটা ভালই ভাল তুলতে পারলে হাঁটে বিক্রি করলে নগদ কিছু টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু হাবু জাল তুলতে পারছে না। জাল পানির নিচে কিছুতে আটেেক গেছে। জালের ভিতর কোন সাড়া শব্দও নাই। মনে হয় মাছটিওবের হয়ে গেছে। হাবুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। জাল তোলার জন্য হাবু ভরা নদীতে ডুব দিল। হাবু চোখ বন্ধ করে হাত দিয়ে জালের নিশানা হাতড়াতে হাতড়াতে সে আবিষ্কার করল তার জালটি একটি বড় সুরঙ্গর ভিতর আটকে আছে।
হাবু শুনেছে মেছো ভ‚তেরা পানির নিচে সুড়ঙ্গর ভিতর থাকে। হাবুর সে কথা মনে পরতে গাবড়ে গেল। সে পানি থেকে উপরে উঠতে চাইল। কিন্তু চিংড়ি মাছের মত লম্বা একটি হাত তাকে ধরে ফেলল। হ্যাচকা টান দিয়ে গভীর সুড়ঙ্গর তলদেশে নিয়ে গেল। তার হাত পা কলাপাতার মত থর থরে কাঁপতে লাগল। সে অনুভব করতে পারছে তার হাত এখন কেউ ধরে নেই। নাকি সুরে অদ্ভুত টাইপের গলা “কি রে হাবু চোখ খুলিস না কেন?” হাবু চমকিত হয়ে চোখ খুলল। দেখল বোয়াল মাছের মত লম্বা চোয়ালের মুখ, কাকঁড়ার মত ধারালো আঙ্গুলযুক্ত দুটি হাত, গজার মাছের মত লাল টগবগে চোখগুলো কিন্তু মানুষের মত পা আছে। হাবু বুঝতে পারছে এটাই তা হলে মেছো ভুত!
বুড়ো গোছের ভুত। তার পাশে বয়সে নবীন আরও কিছু মেছো ভুত আছে তবে ও গুলো খুব সাধারণ চেহারা। ভয় পাওয়ার মত তেমন কোন বিশেষণ নাই। বুড়ো ভুতটা নাকি মেছো ভুতদের রাজা। তার ইচ্ছা কোন মানুষ্যরমনী বিয়ে করবে। কিছু দনি আগে সে হাবুর বৌ পুটিকে দেখেছে। পুটির শরীরে সুন্দর বাসনা লাগানো ছিল। হাবুও মুরব্বিদের কাছে শুনেছে বিয়ের বাসনা নিয়ে যেখানে সেখানে যেতে নাই। ভুত-পেতের নজর লাগে। হাবু কখনো মানতো না। বিপদ যখন হয়েই গেছে। এবার বেঁচে গেলে সে খুব মানবে।
কিছু তরুণ ভ‚ত এসে কুর্নিশ করে জানতে চাইল, “মেছো মহারাজ! হুকুম দিন হাবুকে কি শাস্তি দেওয়া হবে।” হাবু ভাবছে শাস্তি কেন? নিশ্চই দুপুর বেলা নদীতে মাছ ধরা ভুতেরা বরদাস্ত করে না। হাবুর গাড় মটকানোর শাস্তি দেওয়া হলো। হাবু ভয় পেয়ে গেল। দেখলো কিছু চিংড়ি মাছের হাতের মত কাল বিদঘুটে, কুৎসিত হাত তার গলা টিপে ধরতে আসছে। হাবু পালানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। যত জোড়ে দৌড়াতে চাইছে পা তার চলছে না। হাবু শ্বাস নিতেও পারছে না। বাঁচার জন্য গলা ফাটিয়ে পাশের বাড়ীর খাঁ চাচাকে ডাকার চেষ্টা করছে কিন্তু গলা থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। হাতগুলো হাবুর মাথাটা জোড়ে চেপে ধরেছে। একটা সুড়ঙ্গর ভিতরে পুতে দিতে চাচ্ছে।
হাবু যখন চোখ মেলে তাকাল দেখল, পুটি পানির গøাস হাতে নিয়ে পাশে বসা। বারবার জিজ্ঞেস করছে “কি হয়েছে তোমার। তুমি ঘর ছেড়ে নদীর পাড়ে নাকি ঘুমাচ্ছিলে?” হাবু কোন কথা বলে না। ভূতের কথা বললে পুটি ভয় পেয়ে যাবে। বুকটা ধরপর করছে। একটু পানি খেয়ে নিল। বউকে প্রশমিত করার জন্য বলল “তুমি অত অস্থির হইয়ো না, নদীর ধারে ঠাÐা বাতাস তাই একটু ঘুমিয়ে নিলাম আর কি।” বেলা অনেক হয়ছে। সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পরেছে। শার্টটা কাধে করে হাবু হাটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। পুটি রান্না ঘরে যেতে যেতে বলল, দেখ হাঁটে থেকে কিছু মাছ-টাছ নিয়ে এসো।
সেদিন ভাদ্র পূর্ণিমার শেষ রাত ছিল। হাবু হাঁটে গিয়ে দেখল ইলিশ খুব সস্তা। এমনিতে হালি চার’শ টাকা থাকে কিন্তু আজ একই ইলিশের হালি দুইশ টাকায় বিকোচ্ছে। হাবু বড় থেকে একটা মাছ নব্বই টাকা দিয়ে কিনল। মাছটা হাতে নিয়ে পুটির কথা মনে পড়ল। পুটি মাছ দেখে আজ নিশ্চই খুব খুশি হবে। হাবু মাছ কিনে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি দিকে রওয়ানা হলো। কিন্তু যতিন বাবু নাছোড় বান্দা। অনেক দিন পরে হাবু এত বড় মাছ কিনেছে তাই তাকে চা খাওয়াতে হবে। রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে তাই গল্পের শেষ না করে উঠে গেল।
মফস্বলের হাঁট ইটের রাস্তাটা নদীর ঘাটাব্দি শেষ। খেয়া পারানোর পর সরু মেঠো রাস্তা। দু’পাশে ঘন গাছের আড়ে সব সময় চাপা আধার ঘাবটি মেরে থাকে। তে-পথার মাথা পর্যন্ত হাবুর সাথে দক্ষিণ পাড়ার একজন অপরিচিত লোক ছিল। এখন হাবু একা। আমাবশ্যার অন্ধাকারেও এ পথে হাবুর একা হাটার অভ্যাস আছে। কিন্তু আজ কেমন বুকটা ধুর-ধুর করছে। হাবুর হঠাৎ মেছো মহারাজের কথা মনে পড়ে গেল। মেছো মহারাজা হাবুর সুন্দরী বৌকে বিয়ে করতে চায়। এমন পাঁজি ভূতের কথা হাবু কোন দিন শুনেনি। সামনে ঠাকুর পাড়া। তাই হাবুর শরিরে যেন ভয়ে কাটা দিতে চাইল। ঠাকুর পাড়ার মানুষের বসতি খুব কম। অনেকে বলে ঠাকুর পাড়া আগে অনেক লোক ছিল কিন্তু সব পদ্ম ঘোস্বামীর পেটে গেছে। পদ্ম ঘোস্বামী খুব রূপবতী ছিল।কিন্তু পনের টাকা নিয়ে বরের বাবার সাথে বনিবনা হচ্ছিল না। আর তাই পদ্ম ঘোস্বামীর লগ্নভ্রষ্ট হয়েছিল। পদ্ম ঘোস্বামীর লগ্নভ্রষ্ট হওয়ায় বিয়ের রাতে তেঁতুল গাছে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আর সেই তেঁতুল গাছের নিচেই তাকে চাপামাটি দেওয়া হয়েছিল। তারপর এক ভাদ্রমাসের আমাবশ্যার রাতে সে কবর ভেঙ্গে উঠে এলো। আর গ্রামের অনেক লোককে ভয় দেখিয়ে, ঘাড় মটকে দিয়ে মেরে ফেলল। আরও অনেক লোক মহামারী রোগে মারা গেল। ভয়ে অনেক লোক গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। পরে পুরাহিতরা পদ্ম ঘোস্বামীর আত্মার শান্তির জন্য মাস ব্যাপি পূজা দিয়েছিল। তারপর থেকে আর কাউকে মারে নি। এই গল্প হবুর দাদির কাছে শোনা।
হাবু তেঁতুল গাছটার কাছাকাছি আসাতে কেমন একটা গরম ধমকা বাতাসে গাছটা আচমকা দুলিয়ে দিল। ভয়ে হাবুর শরীর অবস হয়ে গেল। হঠাৎ পিছনের দিকে থেকে কেউ একজন হাবুর দিকে হেঁটে আসছে দেখে হাবু বুকে একটু সাহস ফিরে এল। হাবু দাঁড়ালো একসাথে যাবে। হাবু খুব আনন্দিত হলো। হাবুর পরিচিত মানুষ থেকে সাহসে গলার জোর বেড়ে গেল। “কিরে কালু এত রাতে কাই গিছিলি।” কালু হাবুর কথার কোন উত্তর দেয় না রাস্তার পাশ ধরে হাটে। কালু হাবুদের পাশের বাড়ির ছনিম মাঝির ছেলে। বাঁশি বাজিয়ে সাপ ধরত। গ্রামের কত সাপ সে ধরেছে তার হিসাব নাই। হাঁটের দিনে সাপ খেলা দেখিয়ে অনেক টাকা কামিয়েছিল। কিন্তু একদিন সাপ ধরার বায়না নিয়ে বউয়ের কাছে বিদায় নিয়ে যে গেল ফিরল খাঁটিয়া করে। খুব বিষধর সাপ ছিল। এক ছোবলে না-কি মৃত্যু হয়েছিল। সমস্ত শরীর কাল হয়ে গিয়েছিল। বউটার কোন বাচ্চা টাচ্চা ছিল না তাই সে বাপের বাড়ী চলে গিয়েছি। তখন থেকে কালুর ভীটেয় আর প্রদীপ জ্বলেনি। কালু মরে গেছে সেটা মনে পরতেই হাবুর শরিরটা কেমন ছমছম করছে। তার পাশে কালু হাঁটছে সেই মরা কালু! হাবু আর কালুর মুখের দিকে তাকাতে পারল না। নিচের দিকে তাকিয়ে জোর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। কালু খুব ধীর গতিতে হাঁটছে। পাগুলো কেমন ছাগলের পায়ের মত! হাবু উধর্ব শ্বাসে হেঁটে কালুকে পিছনে ফেলে এসেছে। সাহস করে একবার পিছনে তাকালো, না পিছনে কেউ নাই। ঠাকুর পাাড়ার তেতুঁল গাছও ফেলে এসেছে অনেক দূর। হাবু জোরে দৌড়াচ্ছে। সামনে দেখল মাথা নিচু করে খাঁ চাচা হাটছে। হাবু এবার থামল। খাঁ চাচা অনেক দোয়া কালাম জানা লোক। তাকে দেখে হাবু বুকে হাপাতে হাপাতে বললঃ জানেন চাচা, ছনিম মাঝি ছেলে কালুও তো কবর থেকে উঠে এসেছে। ও ভূত হয়ে গেছে। আমার পাশে পাশে এতক্ষণ হাঁটছিল। আর ওর শরীর পুরাটাই মানুষের মত কিন্তু পা দুটা ছাগলের পায়ের মত। এ কথা বলার সাথে সাথে খাঁ চাচা পরনের লুঙ্গি উঁচু করে তার একটা পা এগিয়ে দিয়ে বললঃ “এ রকম” হাবু দেখল খাঁ চাচার পাটাও কালুর পায়ের মত ছাগলের পা। হাবু বেহুশ হয়ে গেল।
হাবুর যখন হুশ ফিরল দেখল সে ঘরে। তার শিয়রে খাঁ চাচা দোয়া কালাম পরে ফুক দিচ্ছে। তাকে একটা তাবিজও দিল। সেই থেকে হাবুর আর কখনো রাত করে হাঁটে যায় না। আর নদীতেও মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে।
====<><>====
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জাহিদুর রহমান ১৬/০৪/২০১৫Bou er kotha vablaee poran ta kamon korea utha
-
সৈয়দ আলি আকবর, ১৩/০৪/২০১৫দারুন লিখেছেন
-
সাইদুর রহমান ১৩/০৪/২০১৫খুব ভালো লাগলো
গল্পটি। অনেক শুভেচ্ছা। -
পরিতোষ ভৌমিক ১২/০৪/২০১৫খুব সুন্দর শিশুতোষ লেখা ।। অনেক অনেক শুভেচ্ছা লেখককে ।
-
সবুজ আহমেদ কক্স ১২/০৪/২০১৫নাইস গল্প
-
ফারুক নুর ১১/০৪/২০১৫ভালো লিখেছেন ।