ফসকে গেছে শিক্ষা ব্যবস্থা-আত্মহত্যা করে অরিত্রীরা
"আমার যত ভক্ত আছো/ শোনো, কথা আমার পাকা/ গান শুনে তালি দিও না/ দিও শুধু টাকা"। নকুল কুমার বিশ্বাসের গানটার কথা মনে পড়ছে বারবার, অরিত্রীর আত্মহত্যার খবর শোনার পর থেকেই। কেন এই গানটাই মনে পরল?? এমন প্রশ্ন যখন নিজেকে করি, তখন উত্তর মেলে না। কারণ, গান শুনে লোকে তালি দিবে, এটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক তো টাকা দেওয়া। গান শুনে টাকা দেওয়ার যে কথা বলেছেন শিল্পী, তার সাথে আমি একমত হতে পারি না। একই রকম ভাবে পারি না বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে একমত হতে। আমি একজন ছাত্র, আমিই যদি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আঙুল তুলি তবে আমাকে পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। তা হতে পারে মানসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি। আর যদি আঙুল না তুলি, তবে আমাকে করতে হবে অসাধু উপায় অবলম্বন। তা হতে পারে নকল, প্রশ্ন আউট ইত্যাদির মত অপরাধ। আমি আমার মাধ্যমিক জীবনে ষষ্ঠ থেকে এসএসসি পর্যন্ত এমন কোনো পরীক্ষা নাই, যেখানে নকল বা অসাধু উপায় অবলম্বন করি নাই। আমি বন্ধুদের সাথে বাঁজি বাঁধতাম, "তাওহীদ স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে নকল করব"। অথচ পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আমি ভালো ছাত্র বলেই স্কুলে, সমাজে পরিচিত ছিলাম এবং পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষার হলে নকল করা যায় এমন ধারণা আমার ছিল না। এখন প্রশ্ন হলো, আমি মাধ্যমিকে কেন এমন ধুধর্ষ নকলবাজ হতে গেলাম? উত্তরটা যদি দিতে চাই, তবে এমন হবে যে, আমার শিক্ষকরা আমাকে নৈতিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেটা কেমন? সেটা হলো, তারা আমাকে বলতো, ভালো রেজাল্ট না হলে তুমি বড় অফিসার হতে পারবে না, তোমার ভালো জামা থাকবে না, তোমার ভালো খাবার থাকবে না। আমি পরিবারের বড় ছেলে, সব সময় ভালো খাবারটা আমাকেই খেতে দেওয়া হত, সে থেকে আমি ভালো খাবারের প্রতি একটু আকৃষ্ট বেশি। যখন আমার শিক্ষক আমাকে বলে, 'ভালো রেজাল্ট না হলে তোমার ভালো খাবার থাকবে না', তখন আমি অসাধু উপায় আবিষ্কার করি এবং বলতে চাই, পরীক্ষার হলে নকল করা যায় এই ধারণা আমাকে বন্ধুরা বা কেউ শিখিয়ে দেয় নাই। আমি নিজে থেকে আবিষ্কার করেছি। সেই ষষ্ঠ শ্রেণীতে বসে আমি নকল আবিষ্কার করছি, শুধু ভালো রেজাল্টের আশায়, ভাবতে পারেন! কারণ, ভালো রেজাল্ট হলে আমার ভালো খাবার হবে। এখন প্রশ্ন, আমাকে নকলের দিকে ঠেলে দিলো কে? আমার শিক্ষক নাকি আমার অভিবাবক? মানুষ জন্মগত ভাবে ভালো খেতে চায়, ভালো পরতে চায়। এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক চিন্তা। সুতরাং, শিক্ষকই আমাকে নকলের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ আছে 'বাপ-মায় বানায় ভূত, মাস্টার বানায় পুত'। আমাকে আমার প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের শিক্ষকেরা পুত বানিয়েছিল আর মাধ্যমিকের শিক্ষকরা ভূত থেকে মানুষ বানাতে পারে নি।
বলছিলাম শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আমি একমত নই। গানের উদ্দেশ্য যেমন হাত তালি পাওয়া, শিক্ষার উদ্দেশ্য তেমনি ভালো মানসিকার মানুষ হওয়া, এক কথায় ভূত থেকে পুত হওয়া। কোনোটার উদ্দেশ্যই টাকা নয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের এমন শিক্ষা দেয় যে, আমাকে ভালো রেজাল্ট করে বড় অফিসার, মেডিকেল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি হতে হবে। আমি মনে করি, এসব হওয়া তো টাকার মালিক হওয়াই । সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি তার সঠিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করে? এমন কোনো শিক্ষক আছেন কি বাংলাদেশে, যে তার ছাত্রকে বলেননি 'ভালো রেজাল্ট করতে হবে'? আমার মনে হয়, নেই। এমনটাই ধারণা আমার, সেই ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে।
আরও বলছিলাম একমত না হলে নানা ঝামলায় পরতে হয়। যেমন, আমার সেই ভালো ছাত্রের প্রসংশাটা এখন আর কারও থেকে পাই না। কারণ, আমার এখন আর ভালো রেজাল্ট হয় না। নকল করা বাদ দিয়েছি, ইন্টারে এসে। কেন বাদ দিয়েছি? কেউ আমাকে বুঝায়নি, নকল করা বাদ দিতে। আমাকে বুঝেয়েছে 'বই'। ইন্টার থেকে ক্লাসের বইয়ের তুলনায় বাহিরের বই বেশি পড়ি আমি। বাহিরের বই থেকেই শিখেছি আমাকে ভুল শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রশ্ন আসতে পারে, তবে কেন এখনও আমি কলেজে যাই? উত্তর হবে, শুধু অভিনয় করতে। কারণ, এখনও আমি নিজে উপার্জন করি না যে, অভিবাবকের কথা অমান্য করব। এ প্রশ্নটা সবার যে, অরিত্রীরা কতটুকুন বাহিরের বই পড়ার সময় পায়? একটুও পায় না, কারণ সকালে কোচিং, দুপুরে স্কুল, বিকালে প্রাইভেট, রাত্রে বাড়ির কাজ, মধ্য রাত্রে রিভিশন। নেই খেলার মাঠ, সময়, নেই কোনো সাংস্কৃতিক বিনোদন। অরিত্রীরা বুঝবে কী করে নকল করা অন্যায়? আমি বলতে চাই অরিত্রী এবং অরিত্রীর বাবা মাকে যে শিক্ষিকা নকলের দায়ে অপমান করেছেন, তার ফাঁসি নয় শুধু, তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা উচিৎ। এই শিক্ষিকাদের কারণেই আমি এখন খারাপ ছাত্র, নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর আমার আস্থা। আমাকে মানসিক অত্যাচারিত হতে হয় বন্ধুদের কাছে, বাবা মায়ের কাছে, এমনকি ছোট ভাই বোনদের কাছেও। সামাজিক রাজনৈতিক ভাবেও আমি হই হেয় প্রতিপন্ন, কারণ আমার রেজাল্ট খারাপ। আমি যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাহিরে বন্ধুদের তুলনায় বেশি জানি, তার কোনো ক্রেডিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাবা, মা, সমাজ আমাকে দিতে চায় না। কারণ, আমার রেজাল্ট খারাপ।
একটা কথা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রচারিত যে, লক্ষ- কোটি গ্রাজুয়েট বেকার। 'কেন বেকার' এই প্রশ্নটা বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদ সবাই করে। আমি করি না, কারণ গ্রাজুয়েট মানেই চাকরি নয়, কাড়ি কাড়ি টাকা কামানো নয়। গ্রাজুয়েট মানে ভূত থেকে পুত হওয়া। সেই পুত কি শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের বানায়? যদি বলেন বানায়, তবে বুড়ো আঙুল আপনাকে।
শুধু অরিত্রী নয়, চৈতী রায়ও ২০১২ সালে ভিকারুননিসায়ই একই কারণে আত্মহত্যা করেছিল। কয়েকদিন আগে ববিতে চান্স না পেয়ে মিম নদীতে ঝাপিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। ঢাবি, জাবি, রাবি সব খানেই চলছে আত্মহত্যা। এই আত্মহত্যার পেছনে দায়ী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ফসকে যাওয়া। আর তখনই শিক্ষা ব্যবস্থা ফসকে যায়, যখন আমাদের অভিবাবক এবং শিক্ষকরা শিক্ষা নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দেয়। সাময়িক বরখাস্ত, এমপিও বাতিল বা এরকম দুই চারজন শিক্ষককে বিচারের আওতায় এনেই মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা যাবে না ফসকে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থাকে। অরিত্রীদের আত্মহত্যা প্রচারণার অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচার হোক, তা হোক শিক্ষক-শিক্ষিকা বা অভিবাবক। শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদেরকে পুত হতে সাহায্য করুক, সেই কামনা রইল রাষ্ট্রের কাছে।
© সাইফ
বলছিলাম শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আমি একমত নই। গানের উদ্দেশ্য যেমন হাত তালি পাওয়া, শিক্ষার উদ্দেশ্য তেমনি ভালো মানসিকার মানুষ হওয়া, এক কথায় ভূত থেকে পুত হওয়া। কোনোটার উদ্দেশ্যই টাকা নয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের এমন শিক্ষা দেয় যে, আমাকে ভালো রেজাল্ট করে বড় অফিসার, মেডিকেল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি হতে হবে। আমি মনে করি, এসব হওয়া তো টাকার মালিক হওয়াই । সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি তার সঠিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করে? এমন কোনো শিক্ষক আছেন কি বাংলাদেশে, যে তার ছাত্রকে বলেননি 'ভালো রেজাল্ট করতে হবে'? আমার মনে হয়, নেই। এমনটাই ধারণা আমার, সেই ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে।
আরও বলছিলাম একমত না হলে নানা ঝামলায় পরতে হয়। যেমন, আমার সেই ভালো ছাত্রের প্রসংশাটা এখন আর কারও থেকে পাই না। কারণ, আমার এখন আর ভালো রেজাল্ট হয় না। নকল করা বাদ দিয়েছি, ইন্টারে এসে। কেন বাদ দিয়েছি? কেউ আমাকে বুঝায়নি, নকল করা বাদ দিতে। আমাকে বুঝেয়েছে 'বই'। ইন্টার থেকে ক্লাসের বইয়ের তুলনায় বাহিরের বই বেশি পড়ি আমি। বাহিরের বই থেকেই শিখেছি আমাকে ভুল শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রশ্ন আসতে পারে, তবে কেন এখনও আমি কলেজে যাই? উত্তর হবে, শুধু অভিনয় করতে। কারণ, এখনও আমি নিজে উপার্জন করি না যে, অভিবাবকের কথা অমান্য করব। এ প্রশ্নটা সবার যে, অরিত্রীরা কতটুকুন বাহিরের বই পড়ার সময় পায়? একটুও পায় না, কারণ সকালে কোচিং, দুপুরে স্কুল, বিকালে প্রাইভেট, রাত্রে বাড়ির কাজ, মধ্য রাত্রে রিভিশন। নেই খেলার মাঠ, সময়, নেই কোনো সাংস্কৃতিক বিনোদন। অরিত্রীরা বুঝবে কী করে নকল করা অন্যায়? আমি বলতে চাই অরিত্রী এবং অরিত্রীর বাবা মাকে যে শিক্ষিকা নকলের দায়ে অপমান করেছেন, তার ফাঁসি নয় শুধু, তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা উচিৎ। এই শিক্ষিকাদের কারণেই আমি এখন খারাপ ছাত্র, নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর আমার আস্থা। আমাকে মানসিক অত্যাচারিত হতে হয় বন্ধুদের কাছে, বাবা মায়ের কাছে, এমনকি ছোট ভাই বোনদের কাছেও। সামাজিক রাজনৈতিক ভাবেও আমি হই হেয় প্রতিপন্ন, কারণ আমার রেজাল্ট খারাপ। আমি যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাহিরে বন্ধুদের তুলনায় বেশি জানি, তার কোনো ক্রেডিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাবা, মা, সমাজ আমাকে দিতে চায় না। কারণ, আমার রেজাল্ট খারাপ।
একটা কথা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রচারিত যে, লক্ষ- কোটি গ্রাজুয়েট বেকার। 'কেন বেকার' এই প্রশ্নটা বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদ সবাই করে। আমি করি না, কারণ গ্রাজুয়েট মানেই চাকরি নয়, কাড়ি কাড়ি টাকা কামানো নয়। গ্রাজুয়েট মানে ভূত থেকে পুত হওয়া। সেই পুত কি শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের বানায়? যদি বলেন বানায়, তবে বুড়ো আঙুল আপনাকে।
শুধু অরিত্রী নয়, চৈতী রায়ও ২০১২ সালে ভিকারুননিসায়ই একই কারণে আত্মহত্যা করেছিল। কয়েকদিন আগে ববিতে চান্স না পেয়ে মিম নদীতে ঝাপিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। ঢাবি, জাবি, রাবি সব খানেই চলছে আত্মহত্যা। এই আত্মহত্যার পেছনে দায়ী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ফসকে যাওয়া। আর তখনই শিক্ষা ব্যবস্থা ফসকে যায়, যখন আমাদের অভিবাবক এবং শিক্ষকরা শিক্ষা নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দেয়। সাময়িক বরখাস্ত, এমপিও বাতিল বা এরকম দুই চারজন শিক্ষককে বিচারের আওতায় এনেই মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা যাবে না ফসকে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থাকে। অরিত্রীদের আত্মহত্যা প্রচারণার অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচার হোক, তা হোক শিক্ষক-শিক্ষিকা বা অভিবাবক। শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদেরকে পুত হতে সাহায্য করুক, সেই কামনা রইল রাষ্ট্রের কাছে।
© সাইফ
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৭/১২/২০১৮মানুষের জীবনের মূল্য আমরা এখনও বুঝতে পারি না।