www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলে ও আমার জীবন ০১

'যে জলে আগুন জ্বলে', প্রথম কখন কোথায় নামটি শুনেছি মনে নেই। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত এবং আমার দেখা সর্ব্বোচ্চ মুদ্রণের কবিতার বই 'যে জলে আগুন জ্বলে'। কবি হেলাল হাফিজকে বলা হয় বাংলা কবিতার রাজপুত্র। কবিতার রাজপুত্র হেলাল হাফিজ বলেছেন দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ। আমি বলেছিলাম জীবন আমার একটাই, এক জীবনে হাসতে চাই। কিন্তু নোংড়া সমাজ আমাকে হাসতে দিল না, নিজেও হাসল না। দুঃখকে আপন করে যখন যাযাবর এই আমি, তখন মনে পড়ে হেলাল হাফিজের কথা। সিমু নামকরণের পূর্বে যখন প্রেম নিয়ে সিমুর সাথে প্রথম কথা হয় তখন বলেছিলাম কবিতা আমার প্রথম প্রেম। স্বরচিত কবিতার ডায়েরী আমার প্রথম ভালোবাসা। কবিতার প্রতি আজন্ম ভালোবাসা থেকেই সংগ্রহ করা আমার বিপরীত চরিত্রের কবি হেলাল হাফিজের 'যে জলে আগুন জ্বলে'। বলা বাহুল্য যখন সংগ্রহ করি তখন আমি যে 'দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ'র মত আরেক সাইফ তা দ্রুব সত্য। এবার লেখাটির নামকরণের স্বার্থকতা খুঁজে দেখি কতটুকুন সত্য হেলাল হাফিজের কবিতা ও আমার জীবন।

'যে জলে আগুন জ্বলে' কাব্যের প্রথম কবিতা 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়'। এখানে কবি বলেছেন...


এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
........
.......
......
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়।
যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।

অানাড়ি হাতে আমি আমার 'চিত্রপট এবং অন্যান্য হারিয়ে' কবিতার শেষে বলেছিলাম...

তোমরা কবি, আমি নির্বোধ, উদাস।
যে আমার চিত্রপট জাতির অসময়ে করেছে চুরি
তাকে আমি ভালোবাসি;কিন্তু ক্ষমা করব না
পুনশ্চ: আমি নির্বোধ,উদাস।

কবি প্রথমেই বলেছেন এখন যৌবন যার তার সময় মিছিল করার, যুদ্ধ করার আবার বলেছেন কোনো কোনো প্রেমিককে খুনী হতে হয়। আমি মিছিল ও যুদ্ধের কথা ভেবে খুনী হয়েছি আবার পুনশ্চ: নির্বোধ, উদাস হয়ে প্রেমে ডুবেছি। কবির মনে দেশের প্রতি যে টান, যে মমতা তা আমার ভেতর ছিল, আছে। কবির মনে হেলেনের প্রতি যে প্রেম তা আমার ছিল, আছে। এখানেই হেলাল হাফিজের কবিতা ও আমার জীবন একাকার।

দ্বিতীয় কবিতা 'নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল'-এ কবি বলেছেন....

'নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়
অলংকার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না।
একবার তোমার নোলক, দুল, হাতে চুড়ি
কটিদেশে বিছা করে অলংকৃত হতে দিলে
বুঝবে হেলেন, এ আঙুল সহজে বাজে না।

কবি চেয়েছেন তাঁর প্রেমিকা হেলেন তাঁর হাতের পাঁচটি আঙুল আপন করে নিক। কবি তার আঙুলকে হেলেনের নোলক, দুল, চুড়ি, কোমরের বিছায় অলংকৃত করে বাজাতে চেয়েছেন। বলেছেন এ আঙুল বাজে না। ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম, বেহালা যাই হোক সহজে যেখানে সেখানে এ আঙুলে প্রেম আসে না। তারপর কবি বলেছেন.....

একদিন একটি বেহালা নিজেকে বাজাবে বলে
আমার আঙুলে এসে দেখেছিলো
তার বিষাদের চেয়ে বিশাল বিস্তৃতি,
আমি তাকে চলে যেতে বলিনি তবুও
ফিরে গিয়েছিলো সেই বেহালা সলাজে।

কবির পাঁচটি আঙুলে বেহালা কী দেখেছিলো? কবি চলে যেতে না বললেও কেন বেহালা সলাজে চলে গেলো? কবির আঙুলে কি হেলেনের নাম খোদাই করা ছিল? নাম না হোক হেলেনের প্রতি ভালোবাসা খোদাই করা ছিল। যে বেহালার বিষাদ জগতের সবচেয়ে বেশি বিষাদে ভরা সেই বেহালা লাজে চলে গেলো। এতটাই বিষাদ কবির পাঁচটি আঙুলে। কেননা হেলেন আজ নেই। আমার আঙুলেও আজকাল তাই দেখতে পাই। এ আঙুল বাজে না, এ আঙুল বুঝে না।



তৃতীয় কবিতা 'দুঃসময়ে আমার যৌবন'-এ বলেছেন.....

মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই।


কবির মানব জন্ম কলঙ্ক হবে, পরবর্তী পুরুষের কাছে ভীরুর উপমা হবেন যদি তিনি দেশ মাতার দুঃসময়ে যৌবনকে শুধু নারীকে দিয়ে সাজান। এ কবিতা আমার বেঁচে থাকার পাথেয়। এ কবিতা আমার রাজপথে মিছিল করার, যুদ্ধ করার কবিতা। আমার উত্তরপুরুষে বীর পুরুষের উপমা হওয়ার কবিতা।


চতুর্থ কবিতা 'অস্ত্র সমপর্ণ'-এ বলেছেন....

অথচ তোমাকে আজ সেই আমি কারাগারে
সমর্পণ করে, ফিরে যাচ্ছি ঘরে
মানুষকে ভালোবাসা ভালোবাসি বলে।

যদি কোনোদিন আসে আবার দুর্দিন,
যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে
ভেঙে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার।


১৯৭২ সালে যুদ্ধ শেষে বাঙালি যখন অস্ত্র সমপর্ণ করে তখনকার কথা কবিতায়। কবি দেশকে স্বাধীন করে অস্ত্র জমা দিয়ে ঘরে ফিরছেন। আর বলছেন আবার প্রণয় হবে অস্ত্রের সাথে যেদিন প্রেম ফুরাবে, মানুষে মানুষে প্রেম হবে না। সেদিন তো এসেছে, আজ বুর্জোয়াগোষ্ঠী দেশকে চুষে চুষে খাচ্ছে আর কেড়ে নিচ্ছে মানুষে মানুষে প্রেম। কবি বৃদ্ধ হয়েছেন। কালো কারাগার ভাঙার কাজ এখন যৌবন যার তার, এখন যৌবন আমার। আমি ভাঙব কালো কারাগার, অস্ত্র নেব। দেশ মাতাকে মুক্ত করব।


পঞ্চম কবিতা 'অগ্ন্যুৎসব'-এ বলেছেন.....

ছিল তা অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি
সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে
জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে
রক্ত ঋণে স্বদেশ হলো,
তোমার দিকে চোখ ছিলো না
জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।

কবিতায় মুক্তযুদ্ধ অগ্ন্যুৎসব, কবি বুকের সবটুকু আগ্নেয়াস্ত্রে রেখে দেশ প্রেমের নামে জীবন বাজি ধরেছিল, রক্ত ঋণ দিয়ে স্বদেশ করলো জন্মভূমিকে। সেদিন হেলেনের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় ছিল না। তাই জন্মভূমিকে কবি হেলেনের সতীন বলেছেন। নিলয়, অভিজিৎ, তনু হত্যা, ব্লেডে পূজার যৌনাঙ্গ যখন রক্তাক্ত, দেশ জুড়ে যখন অগ্ন্যুৎসব তখন আমি রাজপথে, সিমুর তা সহ্য হতো না। দেশকে, আমজনতাকে সে সতীন বলল।

তারপর বলেছেন....

আজকে আবার জীবন আমার ভিন্ন স্বপ্নে অংকুরিত অগ্ন্যুৎসবে
তোমাকে চায় শুধুই তোমায়।

আজকে কবির জীবন ভিন্ন স্বপ্নে, আজকে কবি হেলেনকে চায়। আমিও সিমুকে চাই কিন্তু কবির হেলেন কোথায়? আর আমার সিমুই বা কোথায়?

তারপর......

রঙিন শাড়ির হলুদ পাড়ে ঋতুর প্লাবন নষ্ট করে
ভর দুপুরে শুধুই কেন হাত বেঁধেছো বুক ঢেকেছো
যুঁই চামেলী বেলীর মালায়,
আমার বুকে সেদিন যেমন আগুন ছিলো
ভিন্নভাবে জ্বলছে আজও,
তবু সবই ব্যর্থ হবে
তুমি কেবল যুঁই চামেলী বেলী ফুলেই মগ্ন হলে।

রঙিন শাড়ির হলুদ পাড়ে ঋতুর প্লাবন নষ্ট করেছো, ভর দুপুরে শুধুই কেন হাত বেঁধেছো? বুক ঢেকে রেখেছো কেন যুঁই চামেলী বেলীর মালায়? ঋতুর প্লাবন নষ্ট করাতে ওই রূপ তো কবিকে পোড়ায়, চোখে জল আনে, সেই জলে আগুন জ্বলে।
কবির বুকে সেদিন যেমন আগুন ছিলো, আজও তা ভিন্নভাবে জ্বলছে। তবু সবই ব্যর্থ। তুমি কেবল যুই চামেলী বেলী ফুলে মগ্ন হলে।

শাড়ি পরা সিমুকে কখনও দেখিনি, তবে কথা ছিল চোখ বুজে শাড়ি পরাব। হলুদ শাড়ি আমার বেশ পছন্দের। হয়ত হলুদ শাড়িটাই পরাতাম। কিন্তু আজ যখন দূর থেকে হলুদ শাড়ি পরা সিমুকে কল্পনায় দেখি তখন চোখের কোণে জল আসে, সেই জ্বলে হৃদয়ের ভেতর আগুন জ্বলে। সেদিন আমার বুকে যে প্রেম ছিল তা আজও ভিন্ন ভাবে জ্বলছে তাই তো কত কৌশলে এখনও সিমুকে ঘরে আনি, দূর থেকে অনুভব করি। কিন্তু সবই ব্যর্থ। সিমু কেবল যুঁই চামেলী বেলী ফুলে ব্যস্ত আছে। অথচ আমার চোখের জলে আগুন জ্বলে।


তারপর....

তার চেয়ে আজ এসো দু'জন জাহিদুরের গানের মতন
হৃদয় দিয়ে বোশেখ ডাকি, দু'জীবনেই বোশেখ আনি।

তুমি যুঁই চামেলী বেলী ফুলেই মগ্ন থেকো না হেলেন, এসো কবির জীবনে বোশেখ আনো, আনো তোমার জীবনেও। আর সিমু তুমি কি সুখী? না হলে এসো বোশেখ ডাকি, বোশেখ আনি।

তারপর কবি বলেছেন.....

জানো হেলেন, আগুন দিয়ে হোলি খেলায় দারুণ আরাম
খেলবো দু'জন এই শপথে
এসো স্ব-কাল শুদ্ধ করি দুর্বিনীত যৌবনেরে।

কবি বলেছেন, হেলেন তুমি কি জানো, আগুন দিয়ে হোলি খেলতে দারুণ আরাম, আসো দু'জনে হোলি খেলি আর বর্তমান দুঃসময়ের কালকে শুদ্ধ করি। এসো সিমু, এসো আগুন দিয়ে হোলি খেলি, দুঃসময়কে দু'জন শুদ্ধ করি এমনটাই হৃদয়ে বাজে সবসময়।


ষষ্ঠ কবিতা 'বেদনা বোনের মত'-এ বলেছেন.....

কারুকার্যময় চারু ঘরের নমুনা দিয়ে
একদিন ভরা ছিল আমার দু'রেটিনার সীমিত সীমানা,
অথচ তেমন কোনো সীমাবদ্ধতাকে আর এখন মানি না।

কী দারুণ বেদনা আমাকে তড়িতাহতের মতো কাঁপালো তুমুল
ক্ষরণের লাল স্রোত আজন্ম পুরোটা ভেতর উল্টে পাল্টে খেলো,
নাকি অলক্ষ্যে এভাবেই
এলোমেলো আমাকে পাল্টালো,নিপুণ নিষ্ঠায়
বেদনার নাম করে বোন তার শুশ্রূষায়
যেন আমাকেই সংগোপনে যোগ্য করে গেলো।

হেলাল হাফিজের মত কারুকার্যময় চারু ঘরের নমুনা দিয়ে দু'রেটিনার সীমিত সীমানায় আমার আর সিমুর জীবন সাজানো ছিলো। অথচ প্রকৃতির বাস্তবতায় সে সীমানা এখন আর মানি না। বেদনা বোনের মত শুশ্রূষা দিয়ে আমাকে দিয়ে এখন সাজায় আমার সমাজ, দেশ, পৃথিবী।


সপ্তম কবিতা 'ইচ্ছা ছিলো'-তে বলেছেন...

ইচ্ছা ছিল রাজা হবো
তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে
শুধু তুমি অন্য ঘরে।

কবির ইচ্ছে হেলেনকে নিয়ে রাজা হবেন, সাম্রাজ্য বাড়াবেন। আমার মনেও ছিল রাজা হবো, সাম্রাজ্য বাড়াবো। প্রত্যেক মৌলিক প্রেমিকের মনেই তা থাকে। কিন্তু হেলেন, সিমু আর মৌলিক প্রেমিকের প্রেমিকা থাকে অন্যে ঘরে। এখানেই হেলাল হাফিজের কবিতায় আমি একাকার।


অষ্টম কবিতা 'প্রতিমা'তে বলেছেন...

অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে
মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল।

এ আমার মোহ বলো, খেলা বলো
অবৈধ মুদ্রার মতো অচল আকাঙ্ক্ষা কিংবা
যা খুশি তা বলো,
সে আমার সোনালি গৌরব
নারী, সে আমার অনুপম প্রেম।

সিমু আমাকে বলেছিল, বিরহে নাকি প্রেমের পূর্ণতা পায়। কবিও তা বললেন কিন্তু সাথে যা বললেন তা ছিলো সকলের অজানা। কে আছে জগতে যে দুঃখকে সোনালি গৌরব বলে? আমিও দুঃখকে আজ কবির সাথে তাল মিলিয়ে সোনালি গৌরব করে নিলাম।

প্রথম ফর্মা শেষে হেলাল হাফিজের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান রেখে আবারও স্বীকার করলাম হেলাল হাফিজের কবিতা আমার জীবনের প্রতিচ্ছবি, আমার পথ নির্দেশক। আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। 'যে জলে আগুন জ্বলে'র কবিতা আর আমার জীবন একাকার। হেলাল হাফিজ বাংলা কবিতায় বাঁচবেন বলব না, আমি তার অনুজ বলে জোড় গলায় বললাম তিনি বেঁচে গিয়েছেন, তিনি মৃত্যুর আগেই অমর হয়েছেন।


দ্বিতীয় ফর্মা আসছে, সম্মানিত সুধি সাথেই থাকুন।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১৩৪৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৫/০১/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast