www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

কুড়িয়ে পাওয়া শ্বেত সোনা হীরা মাণিক

ব্যক্তি রাজনীতির নোংরা থাবায় যখন আমি বিধ্বস্ত যাযাবর তখন অগ্রজ কবি শফিক আমিনের ফোন এবং কিং সউদ সম্পাদিত মাসিক 'সন্ধ্যা' পত্রিকার 'লেখক-পাঠক সম্মিলন-২০১৭-এ নিমন্ত্রণ। স্থান: সদর, বরিশাল। কোনোরূপ ভাবনা ছাড়াই চলে যাই সম্মিলনে। সন্ধ্যা ৭ টায় সম্মিলন শেষ। বরিশালের পরিচিত বন্ধু-বান্ধব সকলকেই ফোন দেই কিন্তু কেউ ফোন ধরছেন না। এদিকে অগ্রজ শফিক ভাইর বাসায় যাওয়ারও ইচ্ছা নাই, কেননা যাযাবরের একটা নতুন অভ্যাস হয়েছে তখন। তাই ভাবনা কোথায় যাব? আবাসিক ভাড়া দেয়া যাযাবর আমি নই তাই অগত্যা উদ্দেশ্যহীন ঢাকায় যাত্রা।


ঢাকায় পৌঁছে ভাবলাম সংগঠনের কোনো নেতা নেত্রীর সঙ্গে দেখা করি হয়ত ভালো লাগবে। তাই বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় সংসদের অর্থ সম্পাদক কমরেড কাজী রিতা আপুকে ফোন দেই। পরদিন বিকেলে দেখা হবে কমরেডের সঙ্গে। যথাসময়ে চলে যাই 'সিপিবি' কেন্দ্রীয় অফিসে আমি ও বন্ধু কমরেড সমুদ্র শাঁচি । কিন্তু কমরেড কাজী রিতা ব্যস্ত, আসতে সময় লাগবে। অপেক্ষার সময়টা কী করে কাটাই ভাবছি, এমন সময় ফুটপাতে নজর। বাইছা লন ২০ টাকা। মোটা মোটা বড় বড় ইংরেজি বাংলা বই ২০ টাকা। বই খুঁজছি কোনটা নেব, খুঁজতে খুঁজতে পেলাম উর্দু ভাষার কবি নওশাদ নূরীর কবিতার অনুবাদ বই। যাহক সমুদ্র এবং আমি ৩ টা বই কিনলাম। আমি ১ টাই নিলাম, সমুদ্র ২ টা রেখে দিল।


অনেকদিন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া একজন যাযাবর আমি, কী করি, কী গড়ি, কী পড়ি? কিছুই ভালো লাগছে না। টেবিলে পড়ে থাকা বইয়ের স্তুপ থেকে নিলাম নওশাদ নূরীর কবিতার বইটা। পড়া শুরু করলাম, ভালো লাগছে বেশ। নতুন নতুন শব্দও শিখছি। কিন্তু এটা যে কোনো উর্দু ভাষীর লেখা কবিতার বই তা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। তবু ভালো লাগার দরুণ ৫ ফর্মার সব কবিতাগুলোই পড়ে ফেলি। তারপর লেখক সম্পর্কে জানতে গিয়ে আমার চোখ তো ছানা বড়া। হ্যাঁ আশ্চর্য় হওয়ারই কথা। আসুন জানি সে অবিশ্বাস্য ইতিহাস।


কবি নওশাদ নূরী (১৯২৬-২০০০) উর্দু ভাষী অবাঙালি হয়েও বাংলার আমৃত্যু বন্ধু। ১৯৫১ সালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের আপোসকামী রাজনৈতিক রূপান্তরের বিরুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে ভিক্ষার ঝুলি হাতে মার্কিন দুয়ারে না যাবার জন্য মিনতি ও সেই সাথে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর কবিতায়

'......দে দে রাম, দেলাদে রাম দেনে ওয়ালা সীতা রাম' অর্থাৎ ভারত হচ্ছে আজ নিলাম, করুণা করো ভিক্ষা দাও দানবীর সীতা রাম।

এই কবিতার কারণে কবির বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হলে তিনি পালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন । কিন্তু তিনি দেখলেন বাংলাকে রহিত করে এক মাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার পায়তারা করা হচ্ছে। তাঁর মন বিদ্রোহ করল, লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা 'মহেঞ্জোদারো'। কবিতায় তিনি লিখেছেন.....

'হতে পারে, কোন ঝড়
হতে পারে, কোন নদী
হতে পারে, কোন বিজেতা
হতে পারে, কোন লুটেরা
সভ্যতার শহর মাটির নিচে
ধুলার নিচে কথামালা
হে ঐতিহাসিকগণ!
মানুষ তাকে বলে মৃতটিলা
এখানে কোন মহামারির আগমন ঘটেছিল
কোন দুর্যোগ হয়ত এখানে নেমে এসেছিল।.............

তিনি উর্দু ভাষায় পাক শাসককে মহামারি বলে ৫২'র বাংলা ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন।


বাংলা ভূখণ্ডে স্থায়ী ভাবে বসবাসের প্রথম পর্যায়ে তার সমমনা সতীর্থ হিসেবে সখ্য গড়ে ওঠে কমরেড রনেশ দাশ গুপ্তসহ প্রগতিশীল লেখক ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। ফলত এখানেও প্রগতি ধারার বিভিন্ন ফ্রন্টের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে ওঠে এবং ক্রমান্বয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। হক-ভাসানী যুক্তফ্রন্ট এবং পরবর্তী সময়ে ভাসানী ন্যাপের সমর্থক হয়ে কাজ করেন।


ষাটের দশকের দ্বীতিয়ার্ধে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির(ভাসানী) পূর্ব পাকিস্তানি নেতা মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়ার (রংপুরের) অর্থানুকূল্যে 'রুদাদ' নামে ১ টি সাপ্তাহিক উর্দু পত্রিকা সম্পাদনা করলেন। কিন্তু প্রগিতিশীল এই পত্রিকা বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারেন নি তিনি। এরপর তিনি দূরদর্শী নেতা তাজউদ্দিন আহমদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬৯ সালে সম্পাদনা করেন আরেকটি সাপ্তাহিক উর্দু পত্রিকা 'জরিদা'। জরিদায় বাঙালি জনতার সমধ্বনিতে উর্দুতে শ্লোগান দেয়া হয়।

'তেরি নাজাত মেরি নাজাত, ছে নুকাত ছে নুকাত'
অর্থাৎ তোমার মুক্তি আমার মুক্তি ছয় দফা ছয় দফা।


এছাড়াও জরিদার প্রত্যেক সংখ্যায় একজন বাঙালি নেতার সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হতো। এতে উর্দু ভাষীরা বাঙালিদের ন্যায্য দাবি বুঝতে পারে এবং নৈতিক সমর্থন জানায়।

এছাড়াও পাক সরকার রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করলে কবি নওশাদ নূরী সমাবেসে গেছেন, বিবৃতি দিয়েছেন এবং সামরিক শাসকচক্রকে অভিযুক্ত করেছেন। এই প্রতিবাদে নওশাদ নূরীর নেতৃত্বে কবি আহমদ ইলিয়াস, আলী আহমদ খান, মাসুদ আলম প্রমুখ প্রবীণ ও নবীন উর্দু ভাষীরা সোচ্চার হয়েছিলেন।

বাংলাদেশে বসবাস ও চর্চারত উর্দু লেখকদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে তিনি সকলকে এক কাতারবন্দি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখানকার উর্দু লেখকদের মধ্যে মোটামোটি তিন ধারা প্রবাহিত- প্রগতি,ধর্মীয়, নিরীহ। এই ধারার লেখকদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনে তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। শেষমেশ প্রগতিধারার লেখকদেরই পরিপুষ্ট করেছেন ও সানিধ্যে থেকেছেন।

এরপর ৭১-এ কবি নওশাদ নূরী ২৬ মার্চ কালো রাত্রি নিয়ে লিখেন 'ছাব্বিশে মার্চ' নামে কবিতা। যে কবিতায় স্পষ্ট লেখা....


'এখন, এই ঢাকাতে, করাচীর কল্পনা দুঃখজনক,
কামান থেকে রাঙামাটির দূরত্ব আজ বহুগুণ বেড়ে গেছে।
সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়াই একমাত্র পথ,
আর কোনো ওষুধ নেই;


৭১-এ কবি নওশাদ নূরী পাক সৈন্য কর্তৃক অত্যাচারিত হয়েছেন। নানাভাবে হেনেস্তা করেছে পাক সেনারা তাকে। তখন খুব কঠিন ও কষ্টে দিন কাটিয়েছেন নওশাদ।যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।


হ্যাঁ, স্বাধীনতা উত্তর তিনি পাকিস্তানে চলে যান নি, তার চার ছেলে মেয়েকে গড়ে তুলেছেন আবহমান বাঙালির সংস্কৃতিতে, ঐতিয্যে। (হয়ত নিজ কুলাঙ্গার জাতির প্রতি এটাও ছিল তার ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ)।



এরপর ৭৫এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণ নিয়ে লিখেন 'উত্থান-উৎস' কবিতা। কবিতায় বলেছেন....

... সে আছে, সে আছে-
সর্বদা হাজির সে যে, অফুরান শক্তি হয়ে
সে আছে, সে আছে
সে অমর, মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত্যু নেই তার।


১৭ আগষ্ট'৭৫ বঙ্গবন্ধুর দাফনের পর লেখেন 'টুঙ্গিপাড়া' নামক কবিতা। কবিতায় বলেন....


তোমরা কি জানো? তোমরা কী জানো?
পথের শুরুটা হয়েছিল এইখানে,
পথ খোয়া গেল, হায়, সেও এইখানে।


কবি পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশে সিকান্দার আবু জাফর, শাহীদ কাদরী, শওকত ওসমান, হাসান হাফুজুর রহমান, জহির রায়হান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সহ স্বাধীন বাংলার বিখ্যাত সব প্রগতিশীল কবি ও সাহিত্যিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
(তথ্যসূত্র:কমরেড আইয়ুব হোসেন ও কমরেড শামীম জামানভি)।


কবির উর্দুতে লেখা কবিতাগুলো অনুবাদ করেছেন কবি আসাদ চৌধুরী, কবি আল মুজাহেদী, মোহাম্মদ হাসান, বশীর আল হেলাল সহ অনেকে।


শত্রুর ঘরে জন্ম নেওয়া আমার বন্ধু, বাংলার বন্ধু নওশাদ নূরী ২০০০ সালের ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। তার লেখাসমূহ উর্দুতে হওয়ার কারণে তিনি বাঙালিদের কাছে কম পরিচিত কিন্তু যেখানেই উর্দু ভাষা সেখানেই কবি নওশাদ নূরী। আমাদের উচিৎ দুর্দিনের অপ্রত্যাশিত বন্ধু নওশাদ নূরীকে বাঁচিয়ে রাখা। যা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরো একধাপ উজ্জলতা এনে দিবে।



নওশাদ নূরীর কবিতা( আইয়ুব হোসেন ও শামীম জামানভি সম্পাদিত)'র বই পাওয়া যাবে...


'হক্কানী পাবলিশার্স,
মমতাজ প্লাজা,
বাড়ি #৭,রোড#৪
ধানমন্ডি,ঢাকাতে।
ফোন ৯৬৬১১৪১।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১৩৩৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২২/১২/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • এন আই পারভেজ ২৩/১২/২০১৭
    সুন্দর হয়েছে।
  • একনিষ্ঠ অনুগত ২৩/১২/২০১৭
    খুব সুন্দর আলোচনা। কবি নওশাদ নূরীর প্রতি সালাম।
  • shamim mashrafe tushar ২২/১২/২০১৭
    sotti kobi tumi osadharon lekho
 
Quantcast