দূরত্ব
বহুদিন বাদে গ্রামে এসেছি, গ্রাম সমন্ধে তেমন কোনো ধারনা নেই, ওই যেটুকু বইতে পড়া, সবুজ ঘাস আর গাছের ছায়াতেই ঞ্জান আটকে আছে, আমার নাম পলাশ, যখন আমার বয়স ৪ তখন আমাকে শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পড়াশোনার জন্য, তারপর আমাকে একটা বারের জন্যও আর গ্রামে আনা হয়নি, কেন আনা হয়নি তার উত্তর আমারো অজানা...।
গ্রাম খুবই সুন্দর হয়, বিশেষ করে এই সৌন্দর্য ধরা পরে শহরবাসীর চোখে, আঁকাবাঁকা লাল মাটির পথ দেখেও তারা কঠিন ইংরেজী আওড়াতে - আওড়াতে বলে বিউটিফুল,
আমি এখন যে পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি সেটা মাটির রাস্তা। রাস্তার দুপারে বেশ কিছু শিমূল গাছ, বসন্ত কালে শিমূল গাছ সেজে ওঠে, এই সৌন্দর্যকে সরস্বতীপূজোয় কোনো নাবালীকার শাড়ি পরে মুহূর্তে নারী হয়ে যাবার সঙ্গে তুলনা করলে মন্দ হয় না।
জমিতে চাষিরা চাষ করছে, কেউ কেউ আবার সমস্ত কিছু গুছিয়ে বাড়ি যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে...
আমার বাড়িটা ঠিক কোন রাস্তায় তা আমি জানি না, চিঠিতে বাবা যে ঠিকানাটা লিখে দিয়েছে তা এক বৃদ্ধকে জিঞ্জাসা করলাম, সে বৃদ্ধ ঠিকানা শুনে মিনিট দুয়েক হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর আমতা আমতা করে বললো তুই হরির ছেলে? উত্তরে হ্যাঁ বলতেই তাকিয়ে থাকার ঘনত্বটা আরো গাঢ় হয়ে উঠলো, মনে হচ্ছে পৃথিবীর অষ্টর আশ্চর্য তাকে না জানিয়েই তার সামনে হঠাৎ উদয় হয়েছে।
কি কাকা কি দেখছো, বাড়িটা কোথায়? কতদুর? কোন রাস্তা দিয়ে যাব, কথাটা বলতেই বৃদ্ধ বা হাত উচিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিলেন ওই পথ.. আমি এগোতে থাকলাম,
বিকেল শেষে গ্রামের বুকে সন্ধা নেমে এসেছে, শহরে এমন সৌন্দর্য কোথায়? ব্যাপারটা অনেক টা নদীর এপার আর ওপারের মতন, গ্রামের মানুষ হঠাৎ শহরে গেলে তারো অনেকটা এই দশা হয়, আসলে আমরা কেউ কারো জায়গাতেই খুশি নয়,
রাস্তা ফুরোচ্ছে একটা ছোট্ট-মোট্ট গ্রাম সামনে এগিয়ে আসছে, আজ বহুদিন হলো বাবাকে বাবা বলে ডাকিনি, বাবাকে বুকে জাপটে ধরে আদর খাইনি, তাও কতদিন তা গুনে বলা অসম্ভব, আজ দেখবো। কেমন আছে লোকটা...
একটা সময় চোখ পরলো রাস্তা থেকে বেশ দূরে একটা জমিতে, দেখেই চমকে উঠলাম, সেখানে দাউ - দাউ করে আগুন জ্জ্বলছে, মনে হলো কারো বাড়িতে আগুন ধরেছে, টিন-খড়ের বাড়ি পুড়ে যাচ্ছে চোখবুজে, কেউ নেভানোর চেষ্টাও করছে না...।
খানিক বাদে মনে পরলো ছোটোবেলায় বইতে পড়েছিলাম-
'ফাল্গুন মাসের সন্ধ্যায় ফাঁকা জমিগুলো দপ করিয়া জ্জ্বলিয়া ওঠে, দেখে মনে হইতে পারে কোনো খড়ের গৃহে আগুন লাগিয়াছে কিংবা কোনো অগ্নি দেবতা রুষ্ঠ হইয়া গিয়াছেন কোনো গ্রাম্য পরিবারের ওপর, কিন্তু এমধ্যে কোনটাই সত্য নহে, ফাল্গুন মাসে ঘরে শস্য ওঠে এবং ঘটা করিয়া সেই শস্যর ভুষি পোড়ানো হয়...'
একটা সময় মনে হলো শস্যার ভুষি পোড়াইলে কারো ঘর পোড়ে না ঠিকই, কিন্তু জমির বুক পোড়ে, যা কেউ বুঝতে পারে না....!
একটা ছোট্ট-মোট্ট গ্রামে ঢুকলাম, আরেকজনকে ঠিকানা জিঞ্জেস করতেই সে একটা বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে বললো ওইযে বাড়িটা, আমি অত্যন্ত আনন্দে বাড়িতে ঢুকলাম, ছোটোবেলায় তেমন কোনো কথাই মনে নেই আমার, বাবা বেশ কয়েকবার আমাকে দেখতে শহরে গিয়েছে তাই একমাত্র সেই আমার চেনা, আর এই বাড়িতে কেউ থাকবার কথা নয়, খানিকটা এগোতেই মাটির দেওয়ালে মায়ের একটা ছবি দেখলাম, মা মারা যাবার পরই আমাকে শহরে পাঠানো হয়েছিল এখানে থাকলে নাকি আমি খারাপ হয়ে যাব।
আরে পলাশ না? মহিলাকে ঠিক চিনতে পারলাম না, প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলতেই একটি পিড়ি এগিয়ে দিল, পিড়িতে বসতে বসতে মহিলাকে প্রশ্ন করলাম আচ্ছা বাবা কোথায় গেছে? ভদ্রমহিলা বলল, উনি একটু দোকানে গেছে তুমি বোসো এখুনি চলে আসবে। বুঝতে বাকি রইলো না ভদ্রমহিলা কে, আমাকে একগ্লাস জল এনে দিয়ে ভদ্রমহিলা গল্প জুড়লেন তা তুমি আছো কেমন? আমি বললাম ভালো আছি, ভদ্রতার খাতিরে আমাকেও বলতে হলো আপনি কেমন আছেন? অমনি একটা ভুমিকম্প হলো, ভদ্রমহিলা খানিক চিৎকার করেই বললেই আমাকে আপনি করে বলছো কেন? আমি তোমার মা না হই মায়ের মতন তো!
মা আর মায়ের মতন এই দুটোর ভিন্নতা নিয়ে আমি তর্কে গেলাম না, একভাবে তাকিয়ে রইলাম রাস্তার দিকে, কতদিন ধরে বাবাকে দেখিনা, জড়িয়ে ধরি না, কখন আসবে লোকটা?
এদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে, ভদ্রমহিলা ডিমলাইট ধরাতে ধরাতে বললো, তুমি বোসো আমি তোমার জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করি, এই বলে তিনি ভেতরে চলে গেল, আমি চেয়ে রইলাম রাস্তার দিকে,
পাশের ঘর থেকে অনেকক্ষন থেকে একটা শিশুর কান্নার শব্দ কানে আসছিল সঙ্গে ভদ্রমহিলার গলার শব্দও, এই তোর বাবা এলো বলে চুপ কর, চুপ কর, বাবা চকলেট আনতে গেছে, এখুনি চলে আসবে, বাচ্চা গলায় শুনতে পেলাম আমি বাবার কাছে যাব, আমি বাবার কাছে যাব....
খানিক বাদে বাবা এলো, আমাকে দেখে বললো আরে পলাশ কখন এলি, আমি বললাম এই বিকেলে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা ছেলেটা পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এসে বাবাকে জাপটে ধরে আদর খেয়ে বললো বাবা চকলেট এনেছো?
আমি তখন বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখনো জমির বুক দাউ দাউ করে জ্বলছে..
খানিকটা মন খারাপ খানিকটা হেসে বললাম, মানুষ আজ পর্যন্ত মানুষের মনের খোঁজই রাখতে পারলো না জমির কি করে রাখবে!
-:সমাপ্ত:-
(গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক...)
গ্রাম খুবই সুন্দর হয়, বিশেষ করে এই সৌন্দর্য ধরা পরে শহরবাসীর চোখে, আঁকাবাঁকা লাল মাটির পথ দেখেও তারা কঠিন ইংরেজী আওড়াতে - আওড়াতে বলে বিউটিফুল,
আমি এখন যে পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি সেটা মাটির রাস্তা। রাস্তার দুপারে বেশ কিছু শিমূল গাছ, বসন্ত কালে শিমূল গাছ সেজে ওঠে, এই সৌন্দর্যকে সরস্বতীপূজোয় কোনো নাবালীকার শাড়ি পরে মুহূর্তে নারী হয়ে যাবার সঙ্গে তুলনা করলে মন্দ হয় না।
জমিতে চাষিরা চাষ করছে, কেউ কেউ আবার সমস্ত কিছু গুছিয়ে বাড়ি যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে...
আমার বাড়িটা ঠিক কোন রাস্তায় তা আমি জানি না, চিঠিতে বাবা যে ঠিকানাটা লিখে দিয়েছে তা এক বৃদ্ধকে জিঞ্জাসা করলাম, সে বৃদ্ধ ঠিকানা শুনে মিনিট দুয়েক হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর আমতা আমতা করে বললো তুই হরির ছেলে? উত্তরে হ্যাঁ বলতেই তাকিয়ে থাকার ঘনত্বটা আরো গাঢ় হয়ে উঠলো, মনে হচ্ছে পৃথিবীর অষ্টর আশ্চর্য তাকে না জানিয়েই তার সামনে হঠাৎ উদয় হয়েছে।
কি কাকা কি দেখছো, বাড়িটা কোথায়? কতদুর? কোন রাস্তা দিয়ে যাব, কথাটা বলতেই বৃদ্ধ বা হাত উচিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিলেন ওই পথ.. আমি এগোতে থাকলাম,
বিকেল শেষে গ্রামের বুকে সন্ধা নেমে এসেছে, শহরে এমন সৌন্দর্য কোথায়? ব্যাপারটা অনেক টা নদীর এপার আর ওপারের মতন, গ্রামের মানুষ হঠাৎ শহরে গেলে তারো অনেকটা এই দশা হয়, আসলে আমরা কেউ কারো জায়গাতেই খুশি নয়,
রাস্তা ফুরোচ্ছে একটা ছোট্ট-মোট্ট গ্রাম সামনে এগিয়ে আসছে, আজ বহুদিন হলো বাবাকে বাবা বলে ডাকিনি, বাবাকে বুকে জাপটে ধরে আদর খাইনি, তাও কতদিন তা গুনে বলা অসম্ভব, আজ দেখবো। কেমন আছে লোকটা...
একটা সময় চোখ পরলো রাস্তা থেকে বেশ দূরে একটা জমিতে, দেখেই চমকে উঠলাম, সেখানে দাউ - দাউ করে আগুন জ্জ্বলছে, মনে হলো কারো বাড়িতে আগুন ধরেছে, টিন-খড়ের বাড়ি পুড়ে যাচ্ছে চোখবুজে, কেউ নেভানোর চেষ্টাও করছে না...।
খানিক বাদে মনে পরলো ছোটোবেলায় বইতে পড়েছিলাম-
'ফাল্গুন মাসের সন্ধ্যায় ফাঁকা জমিগুলো দপ করিয়া জ্জ্বলিয়া ওঠে, দেখে মনে হইতে পারে কোনো খড়ের গৃহে আগুন লাগিয়াছে কিংবা কোনো অগ্নি দেবতা রুষ্ঠ হইয়া গিয়াছেন কোনো গ্রাম্য পরিবারের ওপর, কিন্তু এমধ্যে কোনটাই সত্য নহে, ফাল্গুন মাসে ঘরে শস্য ওঠে এবং ঘটা করিয়া সেই শস্যর ভুষি পোড়ানো হয়...'
একটা সময় মনে হলো শস্যার ভুষি পোড়াইলে কারো ঘর পোড়ে না ঠিকই, কিন্তু জমির বুক পোড়ে, যা কেউ বুঝতে পারে না....!
একটা ছোট্ট-মোট্ট গ্রামে ঢুকলাম, আরেকজনকে ঠিকানা জিঞ্জেস করতেই সে একটা বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে বললো ওইযে বাড়িটা, আমি অত্যন্ত আনন্দে বাড়িতে ঢুকলাম, ছোটোবেলায় তেমন কোনো কথাই মনে নেই আমার, বাবা বেশ কয়েকবার আমাকে দেখতে শহরে গিয়েছে তাই একমাত্র সেই আমার চেনা, আর এই বাড়িতে কেউ থাকবার কথা নয়, খানিকটা এগোতেই মাটির দেওয়ালে মায়ের একটা ছবি দেখলাম, মা মারা যাবার পরই আমাকে শহরে পাঠানো হয়েছিল এখানে থাকলে নাকি আমি খারাপ হয়ে যাব।
আরে পলাশ না? মহিলাকে ঠিক চিনতে পারলাম না, প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলতেই একটি পিড়ি এগিয়ে দিল, পিড়িতে বসতে বসতে মহিলাকে প্রশ্ন করলাম আচ্ছা বাবা কোথায় গেছে? ভদ্রমহিলা বলল, উনি একটু দোকানে গেছে তুমি বোসো এখুনি চলে আসবে। বুঝতে বাকি রইলো না ভদ্রমহিলা কে, আমাকে একগ্লাস জল এনে দিয়ে ভদ্রমহিলা গল্প জুড়লেন তা তুমি আছো কেমন? আমি বললাম ভালো আছি, ভদ্রতার খাতিরে আমাকেও বলতে হলো আপনি কেমন আছেন? অমনি একটা ভুমিকম্প হলো, ভদ্রমহিলা খানিক চিৎকার করেই বললেই আমাকে আপনি করে বলছো কেন? আমি তোমার মা না হই মায়ের মতন তো!
মা আর মায়ের মতন এই দুটোর ভিন্নতা নিয়ে আমি তর্কে গেলাম না, একভাবে তাকিয়ে রইলাম রাস্তার দিকে, কতদিন ধরে বাবাকে দেখিনা, জড়িয়ে ধরি না, কখন আসবে লোকটা?
এদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে, ভদ্রমহিলা ডিমলাইট ধরাতে ধরাতে বললো, তুমি বোসো আমি তোমার জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করি, এই বলে তিনি ভেতরে চলে গেল, আমি চেয়ে রইলাম রাস্তার দিকে,
পাশের ঘর থেকে অনেকক্ষন থেকে একটা শিশুর কান্নার শব্দ কানে আসছিল সঙ্গে ভদ্রমহিলার গলার শব্দও, এই তোর বাবা এলো বলে চুপ কর, চুপ কর, বাবা চকলেট আনতে গেছে, এখুনি চলে আসবে, বাচ্চা গলায় শুনতে পেলাম আমি বাবার কাছে যাব, আমি বাবার কাছে যাব....
খানিক বাদে বাবা এলো, আমাকে দেখে বললো আরে পলাশ কখন এলি, আমি বললাম এই বিকেলে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা ছেলেটা পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এসে বাবাকে জাপটে ধরে আদর খেয়ে বললো বাবা চকলেট এনেছো?
আমি তখন বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখনো জমির বুক দাউ দাউ করে জ্বলছে..
খানিকটা মন খারাপ খানিকটা হেসে বললাম, মানুষ আজ পর্যন্ত মানুষের মনের খোঁজই রাখতে পারলো না জমির কি করে রাখবে!
-:সমাপ্ত:-
(গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক...)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
বেগম সেলিনা খাতুন ২৪/০৩/২০১৯খুব সুন্দর হয়েছে, আপনার লেখা। চমৎকার বাস্তবমুখি ঘটনা।
-
পরিতোষ ভৌমিক ২ ২৪/০৩/২০১৯খুব ভাল লাগলো। অনেকের মননের না বলা ককথাগুলো গোছানো ভাবে বলা হল।
-
Mahfuza Sultana ২০/০৩/২০১৯পাতায় ভাল লাগা রেখে গেলাম
-
সোহেল রানা আশিক ২০/০৩/২০১৯fine
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ১৩/০৩/২০১৯চমৎকার
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৮/০৩/২০১৯ভালো লাগলো।