ব্রজবুলি
কো তুঁহুঁ বোলবি মোয়।
হৃদয়মাহ মঝু জাগসি অনুখন,
আঁখউপর তুঁহুঁ রচলহি আসন
অরুণ নয়ন তব মরমসঙে মম
নিমিখ ন অন্তর হোয়॥
[প্রশ্ন]
-ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী
কী, কবিতার ভাষা দেখে নিশ্চয়ই মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন অনেকে। (অবশ্যই জ্ঞানী পাঠকদের বলছি না।)
আসলে আমিও সঞ্চয়িতার প্রথম দুইটা কবিতার দিকে আপনার মতই বিষ্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। একবার ভাবছিলাম, এটা কি হিন্দি না সংস্কৃত? আরেকবার ভাবছিলাম হয়তো বাংলা ভাষারই আদিরূপ ছিল এই ভাষা।
মূল আলোচনায় যাবার আগে পাঠকদের একটা গানের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, প্রায় সবাই শিরোনামহীন ব্যান্ডের রিমেকের কল্যাণে রবীন্দ্রনাথের গানটা শুনেছেন, এবং অনেকের হয়তো প্রিয় গান-
শাওন গগণে ঘোর ঘনঘটা
নিশিথ ইয়ামিনী রে
কুঞ্জপথে সখি কৈছে যাঁও
অবলা কামিনী রে. . .
এই গানটাও কিন্তু একই ভাষায় রচিত, আমরা অনেকে যেটাকে হিন্দি বলে ভুল করি।
ভাষাটার নাম হচ্ছে ব্রজবুলি। মধ্যযুগে ব্রজবুলি বাংলার একটি উপভাষা ছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে এত ভাষা থাকতে রবীন্দ্রনাথ তরুণ বয়সে ব্রজবুলি ভাষায় কবিতা রচনা করতে গেলেন কেন? কী এমন আছে এই ভাষায়? এর উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের একটু পিছনে ফিরে তাকাতে হবে।
প্রাচীন ভারতে বিদেহ নামে একটি রাজ্য ছিল যার রাজধানী ছিল মিথিলা। তখনকার যুগে মিথিলা খুব বিখ্যাত ছিল। শুধু তখনকার যুগে নয়, এযুগেও মিথিলা শব্দটা আমাদের দেশে শোনা যায়। অনেকের নাম, এমনকি একজন বিখ্যাত তারকার নামও মিথিলা। সে যাই হোক, তারকা মিথিলার কথা বাদ দেই। রাজধানী মিথিলার কথায় আসি।
১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জ্ঞানচর্চা, শিল্প ও সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মিথিলা। বাংলা থেকে অনেক ছাত্র মিথিলায় যেত জ্ঞানার্জনের জন্য। মিথিলার রাজসভার মহাকবির নাম বিদ্যাপতি। তিনিই সর্বপ্রথম ব্রজবুলি ভাষার সূচনা করেন। তিনি হিন্দি, বাংলা, প্রাকৃত আর সংস্কৃত ভাষা থেকে মধুর শব্দগুলি বেছে নিয়ে তৈরি করেন ব্রজবুলি। তার কাব্য তখন এতটাই বিখ্যাত হয়েছিল যে মানুষজন তা মুখস্থ করে রাখতো। বাংলার শিক্ষানবিসরা সেই ব্রজবুলি শিখে এসে এদেশে কাব্যচর্চা শুরু করলো। তখন ব্রজবুলিতে বাংলা শব্দের পরিমাণ আরো বেড়ে গেল। বৈষ্ণব কবিরা এ ধরণের কবিতা বিশেষ আগ্রহের সাথে রচনা শুরু করলো। আর কবিতার বিষয় বস্তু হলো প্রেম, রাধা কৃষ্ণের আকুল প্রেম। বাংলার কবিতা দেবতার দেবত্ব গাথা ছেড়ে নেমে এল ধরণীর মানব মানবীর প্রেমে।
আপাতদৃষ্টে ব্রজবুলিকে কাঠখোট্টা ভাষা মনে হলেও একবার বুঝে ফেললে এ ভাষাকে অনেক বেশিই কোমল লাগে। বলা হয়ে থাকে ব্রজবুলি মিষ্টি, সুরময় আর নরম একটা ভাষা, যেখানে সকল কঠিন শব্দকে এড়ানো হয়েছে। আর এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ এর প্রেমে পড়েছিলেন এবং এই ভাষায় প্রাচীন কবিদের অনুকরণে গান কবিতা লিখেছেন। যদিও পরিপক্ক রবীন্দ্রনাথকে পরে এই ছেলেমানুষী নিয়ে লজ্জায় পড়তে হয়েছিল!
কথা আর বাড়াবো না, শেষ করছি বড়ু চণ্ডীদাস নামক এক বৈষ্ণব কবির একটি সকাতর কবিতার পঙক্তি দিয়ে, কবিতার বিষয় কৃষ্ণের বাঁশী শুনে রাধার আকুলতা -
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নইকুলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাউলোঁ রান্ধন॥
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা॥
হৃদয়মাহ মঝু জাগসি অনুখন,
আঁখউপর তুঁহুঁ রচলহি আসন
অরুণ নয়ন তব মরমসঙে মম
নিমিখ ন অন্তর হোয়॥
[প্রশ্ন]
-ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী
কী, কবিতার ভাষা দেখে নিশ্চয়ই মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন অনেকে। (অবশ্যই জ্ঞানী পাঠকদের বলছি না।)
আসলে আমিও সঞ্চয়িতার প্রথম দুইটা কবিতার দিকে আপনার মতই বিষ্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। একবার ভাবছিলাম, এটা কি হিন্দি না সংস্কৃত? আরেকবার ভাবছিলাম হয়তো বাংলা ভাষারই আদিরূপ ছিল এই ভাষা।
মূল আলোচনায় যাবার আগে পাঠকদের একটা গানের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, প্রায় সবাই শিরোনামহীন ব্যান্ডের রিমেকের কল্যাণে রবীন্দ্রনাথের গানটা শুনেছেন, এবং অনেকের হয়তো প্রিয় গান-
শাওন গগণে ঘোর ঘনঘটা
নিশিথ ইয়ামিনী রে
কুঞ্জপথে সখি কৈছে যাঁও
অবলা কামিনী রে. . .
এই গানটাও কিন্তু একই ভাষায় রচিত, আমরা অনেকে যেটাকে হিন্দি বলে ভুল করি।
ভাষাটার নাম হচ্ছে ব্রজবুলি। মধ্যযুগে ব্রজবুলি বাংলার একটি উপভাষা ছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে এত ভাষা থাকতে রবীন্দ্রনাথ তরুণ বয়সে ব্রজবুলি ভাষায় কবিতা রচনা করতে গেলেন কেন? কী এমন আছে এই ভাষায়? এর উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের একটু পিছনে ফিরে তাকাতে হবে।
প্রাচীন ভারতে বিদেহ নামে একটি রাজ্য ছিল যার রাজধানী ছিল মিথিলা। তখনকার যুগে মিথিলা খুব বিখ্যাত ছিল। শুধু তখনকার যুগে নয়, এযুগেও মিথিলা শব্দটা আমাদের দেশে শোনা যায়। অনেকের নাম, এমনকি একজন বিখ্যাত তারকার নামও মিথিলা। সে যাই হোক, তারকা মিথিলার কথা বাদ দেই। রাজধানী মিথিলার কথায় আসি।
১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জ্ঞানচর্চা, শিল্প ও সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মিথিলা। বাংলা থেকে অনেক ছাত্র মিথিলায় যেত জ্ঞানার্জনের জন্য। মিথিলার রাজসভার মহাকবির নাম বিদ্যাপতি। তিনিই সর্বপ্রথম ব্রজবুলি ভাষার সূচনা করেন। তিনি হিন্দি, বাংলা, প্রাকৃত আর সংস্কৃত ভাষা থেকে মধুর শব্দগুলি বেছে নিয়ে তৈরি করেন ব্রজবুলি। তার কাব্য তখন এতটাই বিখ্যাত হয়েছিল যে মানুষজন তা মুখস্থ করে রাখতো। বাংলার শিক্ষানবিসরা সেই ব্রজবুলি শিখে এসে এদেশে কাব্যচর্চা শুরু করলো। তখন ব্রজবুলিতে বাংলা শব্দের পরিমাণ আরো বেড়ে গেল। বৈষ্ণব কবিরা এ ধরণের কবিতা বিশেষ আগ্রহের সাথে রচনা শুরু করলো। আর কবিতার বিষয় বস্তু হলো প্রেম, রাধা কৃষ্ণের আকুল প্রেম। বাংলার কবিতা দেবতার দেবত্ব গাথা ছেড়ে নেমে এল ধরণীর মানব মানবীর প্রেমে।
আপাতদৃষ্টে ব্রজবুলিকে কাঠখোট্টা ভাষা মনে হলেও একবার বুঝে ফেললে এ ভাষাকে অনেক বেশিই কোমল লাগে। বলা হয়ে থাকে ব্রজবুলি মিষ্টি, সুরময় আর নরম একটা ভাষা, যেখানে সকল কঠিন শব্দকে এড়ানো হয়েছে। আর এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ এর প্রেমে পড়েছিলেন এবং এই ভাষায় প্রাচীন কবিদের অনুকরণে গান কবিতা লিখেছেন। যদিও পরিপক্ক রবীন্দ্রনাথকে পরে এই ছেলেমানুষী নিয়ে লজ্জায় পড়তে হয়েছিল!
কথা আর বাড়াবো না, শেষ করছি বড়ু চণ্ডীদাস নামক এক বৈষ্ণব কবির একটি সকাতর কবিতার পঙক্তি দিয়ে, কবিতার বিষয় কৃষ্ণের বাঁশী শুনে রাধার আকুলতা -
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নইকুলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাউলোঁ রান্ধন॥
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা॥
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী. ২৩/১০/২০১৩নতুন কিছু শিখলাম! সত্যিই খুব ভাল লাগলো এই ব্যপারে জানতে পেরে।অসংখ্য ধন্যবাদ এতো ভালো একটি বিষয় পোস্ট করার জন্য।ধন্যবাদ এবং শুভকামনা আপনার জন্য।
-
আরজু নাসরিন পনি ২১/১০/২০১৩দারুণ !
রবীন্দ্রনাথের ব্রজবুলি ভাষা ব্যবহারের কথা জানতাম তবে আজকে বিস্তারিত জানলাম...ভালো লাগলো । -
রাসেল আল মাসুদ ২১/১০/২০১৩ধন্যবাদ রোদের ছায়া
-
রাসেল আল মাসুদ ২১/১০/২০১৩ধন্যবাদ , সুবীর কাস্মীর পেরেরা
-
রোদের ছায়া ২১/১০/২০১৩খুব সুন্দর একটি পোস্ট । আসলেই ব্রজবুলি বিষয়ে তেমন কিছু জানতাম না ।
-
সুবীর কাস্মীর পেরেরা ২১/১০/২০১৩অসাধারণ