www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ব্রেক আপ

ওয়ালিদ ছেলেটার মন বলতে কিছু নেই- সবাই তাই বলে।

কেউ ওকে কখনো কাঁদতে দেখে নি, এমনকি যখন ওর বাবা মারা গেল তখনও না। ওয়ালিদের হাসি দেখেছে খুব কম মানুষ। আর রাগ? সে তো ওর মধ্যে দুর্লভ। মোটামুটি সবাই, এমনকি ওর মাও জানতো তার ছেলের মধ্যে আবেগ, মায়া-মমতা জিনিসগুলো খুব কম কাজ করে। কিন্তু একজন মাত্র মানুষ ছিল, যে জানতো পৃথিবীর সবচেয়ে আবেগী, সবচেয়ে অনুভূতিকাতর একটা হৃদয় আছে ওয়ালিদের। কেউ তা জানে না, দেখে না, কারণ হৃদয়টা যে থাকে বুকের একান্ত গভীরে।

সেই একজন মাত্র মানুষটার নাম মুনা। ওয়ালিদের W আর মুনার M, একজন অন্যজনের সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও যেন খাপে খাপে মিলে যেত দুজন, মিশে যেত পরস্পরের মধ্যে। শুধু মনে প্রাণে বিশ্বাস নয়, তারা প্রমাণ পর্যন্ত করে ফেলেছে যে তাদের পক্ষে আলাদা হওয়া সম্ভব না। তিন তিনবার ভয়াভহ ভাবে ব্রেক আপ হওয়ার পরও তারা আলাদা হতে পারে নি, এক দুর্নিবার টানে আবার একত্রিত হয়েছে। শুধু একত্রিত হয়েছে বললে হয়তো ভুল হবে, আসলে তারা ভীষণভাবে একত্রিত হয়েছে। একত্রিত হয়েছে তাদের গভীরতম স্থানে।

কিন্তু আজ এটা কি হল? ওয়ালিদ নিজেই তাদের সম্পর্কটাকে গলা টিপে হত্যা করলো? চিরতরে ভেঙ্গে দিল তাদের W আর M এর কম্বিনেশন? কিন্তু আসলেই কি সে ভেঙে দিল? - ওয়ালিদ শান্ত আর স্থির দৃষ্টিতে ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবে। তার বুকের ভিতর ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা উথলে ওঠে।

ওয়ালিদ যেমন পৃথিবীতে একজন, মুনাও তেমনি। ওয়ালিদের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত, নিয়মের ছকে আবদ্ধ। তার অনুভব ক্ষমতাও হয়তো বা মাপা মাপা। আর ওদিকে মুনার তুলনা শুধু মুনাই। তবে একটা জিনিসের সাথে মুনার তুলনা চলে, তা হল বাতাস। সে এতটাই প্রবহমান, এতটাই বাঁধনছাড়া আর এতটাই চঞ্চল যে কখন কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে ঝগড়া বাধাচ্ছে, কোন নিরীহ পথচারীকে গাল দিচ্ছে, কোন পাড়ার ছেলেকে চড় মারছে এসবের হিসাব রাখা খুব কঠিন কাজ। এতটা বিপরীত আর এতটা উদ্ভট হওয়া সত্ত্বেও ওয়ালিদ মুনাকে ভালবেসেছিল, অস্তিত্বের প্রতিটা অংশ দিয়েই ভালবেসেছিল সে। কারণ মুনা বাতাসের মতই সদা সর্বদা ঘিরে থাকতো তাকে, বাতাসের মতই প্রতিনিয়ত অবাধ যাওয়া আসা ছিল তার বুকের ভিতরে। মুনাকে ছাড়া তার দম বন্ধ হয়ে আসতো। আর মুনাই বা কেমন! নিতান্ত গোবেচারা টাইপের অনুভূতিশূন্য একটা ছেলের উপর প্রতিনিয়ত বিচিত্র সব অত্যাচার চালাতো। আর সেই বিচিত্র অত্যাচারে অতিষ্ঠ হওয়ার পরিবর্তে মুগ্ধ হত ওয়ালিদ।

- আমাকে ভালোবাসো?
- হুম।
- কতখানি?
- এই নদীটায় যত পানি আছে।
- নদীটায় কত পানি আছে আমি জানি না, কিন্তু তুমি আমায় কতখানি ভালোবাসো জানতে চাই।
- হুম।
- কী হুম হুম করছো? নদী কতখানি গভীর তা বের করো।
- কীভাবে?
- নদীতে লাফ দাও। লাফ দিয়ে তলায় গিয়ে দেখ কতখানি গভীর। নদীর গভীরতা জানা খুবই প্রয়োজন, কারণ তোমার কথা অনুযায়ী এটার গভীরতা আর তোমার ভালবাসার গভীরতা সমান। তুমি এখনি লাফ দাও।
- মুনা আমি সাঁতার জানি না, এই নদীতে লাফ দিলে আমি বাঁচবো না।
- তুমি লাফ দেবে। যদি না দাও তাহলে আমাকে ভুলে যেতে হবে, কারণ তখন এটা প্রমাণ হবে তুমি আমায় বিন্দুমাত্র ভালবাসো না।
- মুনা প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো, আমি যদি লাফ দেই আমি বাঁচবো না, আর আমি মারা গেলে তুমি আমার ভালবাসা দিয়ে কি করবে?

মুনার মেজাজ চড়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
- হারামি তুই লাফ দিবি কিনা বল? খুব তো বলতিস, তোমার জন্য আমি মরতেও রাজি আছি। আমি তো মরতে বলছি না, শুধু লাফ দিতে বলছি। তুই যে কত বড় মিথ্যুক এতেই বোঝা যায়। তোর সাথে আমি আর নাই।

অসহায় ওয়ালিদকে সেদিন নদীতে নামতে হয়েছিল, স্বেচ্ছায় নয়, মুনা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল ওকে। পরে অবশ্য তার চিত্‍কারেই এক নৌকার মাঝি তুলে আনে ওয়ালিদকে। আসলে নদী মোটেও গভীর ছিল না, আর ওয়ালিদকে সে ফেলে দিয়েছিল নদীর কিনারে, ফলে মারা যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না।

বিছানায় শুয়ে ঘরের শাদা রং সিলিংয়ের দিকে ওয়ালিদ একটানা তাকিয়ে থাকে। স্মৃতিগুলো বিষন্ন পাল তুলে ভেসে বেড়ায় সেখানে। তার পাথরের মত চোখ জলে ছলছল করতে থাকে, কিন্তু সেই জল গড়িয়ে পড়ে না তার গাল বেয়ে। পরিবর্তে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, আর দুহাতে সজোরে মুঠি করে ধরে বিছানার চাদর।

- মুনা আজ তোমাকে রাহাতের সাথে দেখেছি।
- রাহাতের সাথে? তো?
- ভার্সিটির পিছনের রাস্তায়, রিকশায়।
- হুম, একটা দরকার ছিল, তাই ওর সাথে যাচ্ছিলাম।
- আমার সাথে এমনটা না করলেও পারতে।
- কেমনটা না করলেও পারতাম?
- তোমার দিকে তাকাতে আমার খুব ঘৃণাবোধ হচ্ছে। গত দুই বছর ধরে আমার সাথে যা করেছো তাই আমার জন্য যথেষ্ঠ। আর কিছু করে তোমার সাথে সাথে আমাকেও নর্দমার কীট বানিও না। আমি তোমার পথ থেকে সরে যাচ্ছি, কখনো পিছু ডেকো না।

মুনা স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। একটি কথাও উচ্চারণ করলো না, হয়তো তার বলার মত কিছুই ছিল না। ওয়ালিদ এলোমেলো পদে চলে গেল কদমতলা থেকে। স্মৃতিময় কদমতলা, তাদের কত কত যুগল স্মৃতির জন্মস্থান যে এই জায়গায় তা আর ওয়ালিদ ভাবতে চায় না। হয়তো বা মুনাও চায় না।

কিছুক্ষণের মধ্যে ওয়ালিদ দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যায়, মুনা তখনও বসে থাকে কদম তলাতেই।

রাহাতের কথা ওয়ালিদ কখনোই ভাবে নি, ভাববেও না। ওকে নিয়ে ভাবার মত সময় তার নেই। কিন্তু মুনা? তাকে নিয়েও কি তার ভাবার সময় নেই? না, সময় আছে, শুধু ভাবার হৃদয়টা নেই গতকালের মত। আজ সেখানে শুধুই ঘৃণা। ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা।

তবু তো বুকের ভিতর থেকে আগ্নেয়গিরির তপ্ত শ্বাস বের হয়, তবু ভাঙা দীর্ঘশ্বাসে ভাঙাচোরা ভাবনা খেলা করে আর ঝাপসা চোখের কোনায় চলে আসে বহু ঝাপসা দৃশ্য।

ছোট্ট পাখির ছানার মত মুনার বাড়িয়ে দেওয়া ঠোঁটে কতবার চুমু খেয়েছে ওয়ালিদ? খুব কি খারাপ ভাবে চুমু দিয়েছে সে? একটা চুমুও কি শুদ্ধভাবে দিতে পারে নি? নইলে আজ রাহাতকে কেন দেখলো সেই একই কাজ করতে? রাহাত হয়তোবা খুব ভাল ভাবে কাজটা সম্পন্ন করতে পারে, খুব দক্ষ আর শৈল্পিক ভাবে। আচ্ছা রাহাত কতদিন হল তার শিল্পের প্রকাশ ঘটিয়ে চলছিল মুনার ঠোঁটে? শুধু কি ঠোঁটে, আর কোথাও নয়? শিল্পী তার শিল্পকর্ম ঢেকে রাখতে পারে না।
কিন্তু ওয়ালিদ? সে কী করবে এখন? আরেকজনের ঠোঁটে নতুন করে শিল্পকর্মের চেষ্টা করবে?

ওয়ালিদের খুব বমি বমি লাগে। সে বিছানা থেকে এক লাফে উঠে বেসিনের দিকে যায়।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৩৮৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/০৯/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast