ঐতিহ্যের পহেলা বৈশাখ
ঐতিহ্যের পহেলা বৈশাখ
পহেলা বৈশাখ উদযাপন আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জীবন্ত ধারা। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের সবচেড়ে বড় সার্বজনীন উৎসব। এদিন সবাই পেছনে ফেলে আসা শোক, দুঃখ, হতাশা সবকিছু ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশা করে আসন্ন বছর যেন হয় সুখের, সবকিছু হয় যেন সুন্দর। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের প্রথম খবর ১৯১৭ সালে পাওয়া যায়। তখন প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরপর ১৯৩৮ সালেও একই কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালের আগে ঘটা করে আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এর পুনঃজাগরণ ঘটায়। এভাবেই বাঙালির আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের শুরু হয়। যা আমাদের বাঙালিয়ানার পরিচয় বহন করে।
পহেলা বৈশাখ,বাঙ্গালী আর বাংলা বর্ষপঞ্জী একই সূত্রে গাঁথা। ঔপনিবেশিক আমলে প্রাচীন পন্ডিত মনিষীদের সুদীর্ঘ সাধনা ও গবেষনার ফল বাংলা বর্ষপঞ্জী। এ বর্ষপঞ্জী ঘূর্ণায়মান বিশ্বব্রহ্মান্ডের ভ্রাম্যমান প্রকৃতির আবর্তিত সময় গণণার পান্ডুলিপি। প্রাকৃতিক বৈচিত্র, দিন-রাত্রির পরিধি, গ্রহ-উপগ্রহের অবস্থান ও গতিবিধি, তিথি-নক্ষত্রের বিচার বিশ্লেষন ও জ্ঞানগর্ভ গবেষনার ফলেই বাংলা বর্ষপঞ্জীর দিন,মাস,ঋতু ও বর্ষপরিক্রমা নির্ধারিত। মূলত প্রাচীন বাংলার রাজা শশাঙ্কের আমল থেকেই বাংলা সন গণনার কাজ শুরু হলেও তা পূর্ণতা পায় সম্রাট আকবরের শাসনামলে। ইতিহাস বলে, খাজনা পরিশোধে কৃষকদের নানা ধরনের সমস্যা এড়িয়ে সহজে খাজনা আদায়ের জন্য সম্রাট আকবর আমির ফাতেউল্লাহ সিরাজিকে বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি করার আদেশ দেন। তিনি সৌর হিন্দু ও চান্দ্র হিজরি বর্ষবঞ্জির উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন হিজরি ৯৬৩ সনে, যা ছিল ইংরেজি ১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিল। আর মোগল আমলেই বাংলা বর্ষপঞ্জিকে রাজ্যব্যাপী সরকারি মর্যাদা দেওয়া হয়। সেই থেকে পালিত হয় বাংলা সন আর পহেলা বৈশাখে নববর্ষ। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের প্রথম খবর ১৯১৭ সালে পাওয়া যায়। তখন প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরপর ১৯৩৮ সালেও একই কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবহমান কাল ধরে এ বর্ষপঞ্জীর নির্দেশিত ধারায় বিশ্বের বাঙ্গালীদের দৈনন্দিন জীবন প্রবাহ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলা বর্ষের পথ পরিক্রমায় আবর্তিত হয় নানা রকমের বাঙালী উৎসব। কালের ধারাবাহিক আবর্তনে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে উদ্যাপিত হয় বাংলা নববর্ষের বরণ উৎসব। বিদায়ী বছরের অপূর্ণতা আর ব্যর্থতার কালিমা মোচন করে, অর্জন ও আগামী সম্ভাবনাকে সম্বল করে বাঙ্গালী নতুন বছরকে স্বাগত জানায় সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায়। ভবিষ্যতের ভূবন রচনায় পবিত্র পদযাত্রার দীপ্ত শপথে বাঙ্গালী বর্ষবরণের আয়োজন করে। বর্ষবরণকে ঘিরে বাঙ্গালীরা জাতি-ধর্ম-বর্ন-নির্বিশেষে আকন্ঠ নিমজ্জিত থাকে আনন্দ উদ্দীপনায়; উদ্যাপিত হয় নবান্ন উৎসব, হালখাতা উৎসব সহ নানা বাঙালী পার্বন। হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের আমেজ বাংলাদেশীদের জাতীয় স্বত্বার অস্তিত্বকে সুদৃঢ় করে রেখেছে। বাংলাদেশের প্রধান অনুষ্ঠান বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। এ’অনুষ্ঠানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান সহ সকল সম্প্রদায়ের স্বত:স্ফূর্ত সমাবেশ ঘটে। বঙ্গ জননীর সকল সন্তান যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে ছুটে আসে জননীর ¯স্নিগ্ধ আঁচলে। এ মিলন মেলা বাঙ্গালীদের ভ্রাতৃত্ববোধ,সহমর্মিতা ও সামাজিক বন্ধনকে সুসংহত করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে সমৃদ্ধ করার অংকুর এখানেই সুপ্ত থাকে। বাংলা বর্ষবরণ উৎসবেই বাঙ্গালীর চির অহংকারের সম্পদ -- ঐক্য,শান্তি ও প্রীতির সর্ম্পককে আরও উন্নত পর্যায়ে উন্নীত করার আত্মজাগরন ঘটে।
কিন্তু ক্রান্তি কালে যখন জাতির বর্ধিষ্ণু সম্প্রীতি অনিবার্য তখন কালের স্বীকারে তা বিপর্যস্ত ও বাধাগ্রস্ত প্রায়। আশির দশকে বাঙ্গালীদের চলমান ধ্যান ধারনায় পরিবর্তন আসে। ঐতিহ্যের পহেলা বৈশাখ দু’ধারায় বিভক্ত হয়। বাংলা বর্ষে দিন ও মাসের হিসাবে পরিবর্তনের ঘোষনা আসে। দু’টি ভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জীর অনুসরনে বাংলাদেশের বাঙ্গালীদের জীবনধারা দু’ধারায় বেঁকে চলে। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙ্গালী হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বন সহ সম্পূর্ণ জীবনাচার বাংলা বর্ষপঞ্জী নির্ভর; জীবনধারা বাংলা বর্ষপঞ্জীর(পূর্বের) সাথে সর্ম্পূনরূপে সম্পৃক্ত। কিন্তু বাংলাদেশে নব ঘোষিত বর্ষপঞ্জীতে পূর্বের বর্ষপঞ্জীর সাথে দিনের হিসেবে গরমিল থাকায় এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নববর্ষ উদযাপন সহ সকল উৎসব আয়োজনে অন্যদের সাথে পার্থক্য দেখা দেয়। বাংলাদেশে পরিবর্তিত বর্ষপঞ্জী অনুসারে জাতীয় পর্যায়ে বর্ষবরন উদযাপন হয়ে থাকে, অপরদিকে ঐদিন হিন্দুসম্প্রদায়ের বাঙ্গালীরা বর্ষবিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া প্রাচীন রীতি অনুসারে পরের দিন (প্রাচীন বাংলা পঞ্জী অনুসারে ১লা বৈশাখ) ধর্মীয় আদলে বর্ষবরন উদযাপন আয়োজনের ব্যস্ততায় তাদের তাড়া করে। ফলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে প্রাণের টান থাকা সত্বেও সকলের স্বতস্ফূর্ত অংশ গ্রহন নিশ্চিত হয়ে উঠে না। আবার জাতীয় সত্তার প্রতি সম্মান রেখে জাতির মহা মিলন মেলায় অনেকে ভীর জমায় বটে, কিন্তু বিভাজনের ছোঁয়া মনের স্বত:স্ফূর্ততাকে কিছুটা হলেও মলিন করে। মেলার রং আর মনের রং একাত্ম না হলে ব্যক্তির ভিতরের বাঙ্গালী জাতিগত স্বত্বাকে শতভাগ রাঙানো যায় কী ? একই দেশে একই বাঙ্গালী জাতি একই বাংলা বর্ষ বরণ অনুষ্ঠানের আনন্দে মেতে উঠার সুযোগ অনেকটা বিঘিœত।
প্রাচীন আর্য মনীষীদের সৃষ্ট বর্ষপঞ্জীকে পরিবর্তনের কোন যৌক্তিক গবেষনালদ্ধ সংগতি রয়েছে কীনা সেটা প্রশ্ন বিদ্ধ রেখেই পরিবর্তিত বর্ষপঞ্জীর আলোকেই চলছে বাঙ্গালীর সকল বাঙ্গালীপনা। অথচ এমনি এক মহতী বর্ষবরণ উৎসবের মহা মিলনের জোয়ার পরিবর্তনের ছোঁয়ায় অনেকটা স্রোতহারা, শ্রীহীন। বাংলাদেশী বাঙ্গালীদের মিলিত স্বত্বার উৎসবকে বিভক্ত করে একদিকে যেমন উৎসবের আমেজ কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে, অপরদিকে বাঙ্গালীর চিন্তাধারা দু’ধারায় বিভক্ত হওয়ার বীজ রোপন হয়েছে। বিশ্বের কোথাও গবেষনালদ্ধ বর্ষপঞ্জীতে পরিবর্তনের কোন প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। প্রসংগত ইংরেজী বর্ষের দিনপঞ্জী আর্ন্তজাতিক ভাবে স্বীকৃত এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় ধারার বর্ষপঞ্জী। কস্মিন কালেও কেউ এ বর্ষপঞ্জী পরিবর্তনের কারণ ভনুভব করেনি। প্রাকৃতিক বিষয়ে নজরদারী স্বাভাবিক ঘটনা নয়। মূলত: দিন রাত্রির আবর্তন প্রাকৃতিক বিষয়। যেখানে প্রাকৃতিক নিয়মের কোন পরিবর্তন হয়নি,চন্দ্র.সূর্য্য ,গ্রহ ,নক্ষত্রের অবস্থান ও গতিধারার কোন পরিবর্তন হয়নি, দিন - রাত ও জোয়ার-ভাটা একই নিয়মে আবর্তিত হয়; সেখানে দিন- মাস - বছর গণণায় পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনেকটা ধোঁয়াটে বটে। জাতীয় ক্ষেত্রে এর সুবিধা পরিস্কার না হলেও জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে সম্প্রীতি,সৌহার্দ্য ও ঐক্যের পদযাত্রায় যে কিছুটা চির ধরেছে তাতে সন্দেহ নেই। পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ উৎসব বাংলাদেশী অসাম্প্রদায়িক বাঙ্গালীর দীর্ঘদিনের লালিত ও গৌরব গাঁথা অর্জন। এ’অর্জনে বিসর্জনের যে মাত্রা যোগ হয়েছে তা জাতীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করার সম্ভাবনাকে আতংকিত করেছে। বাঙালী জাতি একই পথ বেয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রেখে বিশ্বে সমাদৃত হোক এ প্রত্যাশা বাংলার সকল বাঙালীর।
পহেলা বৈশাখ উদযাপন আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জীবন্ত ধারা। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের সবচেড়ে বড় সার্বজনীন উৎসব। এদিন সবাই পেছনে ফেলে আসা শোক, দুঃখ, হতাশা সবকিছু ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশা করে আসন্ন বছর যেন হয় সুখের, সবকিছু হয় যেন সুন্দর। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের প্রথম খবর ১৯১৭ সালে পাওয়া যায়। তখন প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরপর ১৯৩৮ সালেও একই কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালের আগে ঘটা করে আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এর পুনঃজাগরণ ঘটায়। এভাবেই বাঙালির আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের শুরু হয়। যা আমাদের বাঙালিয়ানার পরিচয় বহন করে।
পহেলা বৈশাখ,বাঙ্গালী আর বাংলা বর্ষপঞ্জী একই সূত্রে গাঁথা। ঔপনিবেশিক আমলে প্রাচীন পন্ডিত মনিষীদের সুদীর্ঘ সাধনা ও গবেষনার ফল বাংলা বর্ষপঞ্জী। এ বর্ষপঞ্জী ঘূর্ণায়মান বিশ্বব্রহ্মান্ডের ভ্রাম্যমান প্রকৃতির আবর্তিত সময় গণণার পান্ডুলিপি। প্রাকৃতিক বৈচিত্র, দিন-রাত্রির পরিধি, গ্রহ-উপগ্রহের অবস্থান ও গতিবিধি, তিথি-নক্ষত্রের বিচার বিশ্লেষন ও জ্ঞানগর্ভ গবেষনার ফলেই বাংলা বর্ষপঞ্জীর দিন,মাস,ঋতু ও বর্ষপরিক্রমা নির্ধারিত। মূলত প্রাচীন বাংলার রাজা শশাঙ্কের আমল থেকেই বাংলা সন গণনার কাজ শুরু হলেও তা পূর্ণতা পায় সম্রাট আকবরের শাসনামলে। ইতিহাস বলে, খাজনা পরিশোধে কৃষকদের নানা ধরনের সমস্যা এড়িয়ে সহজে খাজনা আদায়ের জন্য সম্রাট আকবর আমির ফাতেউল্লাহ সিরাজিকে বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি করার আদেশ দেন। তিনি সৌর হিন্দু ও চান্দ্র হিজরি বর্ষবঞ্জির উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন হিজরি ৯৬৩ সনে, যা ছিল ইংরেজি ১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিল। আর মোগল আমলেই বাংলা বর্ষপঞ্জিকে রাজ্যব্যাপী সরকারি মর্যাদা দেওয়া হয়। সেই থেকে পালিত হয় বাংলা সন আর পহেলা বৈশাখে নববর্ষ। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের প্রথম খবর ১৯১৭ সালে পাওয়া যায়। তখন প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরপর ১৯৩৮ সালেও একই কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবহমান কাল ধরে এ বর্ষপঞ্জীর নির্দেশিত ধারায় বিশ্বের বাঙ্গালীদের দৈনন্দিন জীবন প্রবাহ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলা বর্ষের পথ পরিক্রমায় আবর্তিত হয় নানা রকমের বাঙালী উৎসব। কালের ধারাবাহিক আবর্তনে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে উদ্যাপিত হয় বাংলা নববর্ষের বরণ উৎসব। বিদায়ী বছরের অপূর্ণতা আর ব্যর্থতার কালিমা মোচন করে, অর্জন ও আগামী সম্ভাবনাকে সম্বল করে বাঙ্গালী নতুন বছরকে স্বাগত জানায় সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায়। ভবিষ্যতের ভূবন রচনায় পবিত্র পদযাত্রার দীপ্ত শপথে বাঙ্গালী বর্ষবরণের আয়োজন করে। বর্ষবরণকে ঘিরে বাঙ্গালীরা জাতি-ধর্ম-বর্ন-নির্বিশেষে আকন্ঠ নিমজ্জিত থাকে আনন্দ উদ্দীপনায়; উদ্যাপিত হয় নবান্ন উৎসব, হালখাতা উৎসব সহ নানা বাঙালী পার্বন। হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের আমেজ বাংলাদেশীদের জাতীয় স্বত্বার অস্তিত্বকে সুদৃঢ় করে রেখেছে। বাংলাদেশের প্রধান অনুষ্ঠান বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। এ’অনুষ্ঠানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান সহ সকল সম্প্রদায়ের স্বত:স্ফূর্ত সমাবেশ ঘটে। বঙ্গ জননীর সকল সন্তান যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে ছুটে আসে জননীর ¯স্নিগ্ধ আঁচলে। এ মিলন মেলা বাঙ্গালীদের ভ্রাতৃত্ববোধ,সহমর্মিতা ও সামাজিক বন্ধনকে সুসংহত করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে সমৃদ্ধ করার অংকুর এখানেই সুপ্ত থাকে। বাংলা বর্ষবরণ উৎসবেই বাঙ্গালীর চির অহংকারের সম্পদ -- ঐক্য,শান্তি ও প্রীতির সর্ম্পককে আরও উন্নত পর্যায়ে উন্নীত করার আত্মজাগরন ঘটে।
কিন্তু ক্রান্তি কালে যখন জাতির বর্ধিষ্ণু সম্প্রীতি অনিবার্য তখন কালের স্বীকারে তা বিপর্যস্ত ও বাধাগ্রস্ত প্রায়। আশির দশকে বাঙ্গালীদের চলমান ধ্যান ধারনায় পরিবর্তন আসে। ঐতিহ্যের পহেলা বৈশাখ দু’ধারায় বিভক্ত হয়। বাংলা বর্ষে দিন ও মাসের হিসাবে পরিবর্তনের ঘোষনা আসে। দু’টি ভিন্ন বাংলা বর্ষপঞ্জীর অনুসরনে বাংলাদেশের বাঙ্গালীদের জীবনধারা দু’ধারায় বেঁকে চলে। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙ্গালী হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বন সহ সম্পূর্ণ জীবনাচার বাংলা বর্ষপঞ্জী নির্ভর; জীবনধারা বাংলা বর্ষপঞ্জীর(পূর্বের) সাথে সর্ম্পূনরূপে সম্পৃক্ত। কিন্তু বাংলাদেশে নব ঘোষিত বর্ষপঞ্জীতে পূর্বের বর্ষপঞ্জীর সাথে দিনের হিসেবে গরমিল থাকায় এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নববর্ষ উদযাপন সহ সকল উৎসব আয়োজনে অন্যদের সাথে পার্থক্য দেখা দেয়। বাংলাদেশে পরিবর্তিত বর্ষপঞ্জী অনুসারে জাতীয় পর্যায়ে বর্ষবরন উদযাপন হয়ে থাকে, অপরদিকে ঐদিন হিন্দুসম্প্রদায়ের বাঙ্গালীরা বর্ষবিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া প্রাচীন রীতি অনুসারে পরের দিন (প্রাচীন বাংলা পঞ্জী অনুসারে ১লা বৈশাখ) ধর্মীয় আদলে বর্ষবরন উদযাপন আয়োজনের ব্যস্ততায় তাদের তাড়া করে। ফলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে প্রাণের টান থাকা সত্বেও সকলের স্বতস্ফূর্ত অংশ গ্রহন নিশ্চিত হয়ে উঠে না। আবার জাতীয় সত্তার প্রতি সম্মান রেখে জাতির মহা মিলন মেলায় অনেকে ভীর জমায় বটে, কিন্তু বিভাজনের ছোঁয়া মনের স্বত:স্ফূর্ততাকে কিছুটা হলেও মলিন করে। মেলার রং আর মনের রং একাত্ম না হলে ব্যক্তির ভিতরের বাঙ্গালী জাতিগত স্বত্বাকে শতভাগ রাঙানো যায় কী ? একই দেশে একই বাঙ্গালী জাতি একই বাংলা বর্ষ বরণ অনুষ্ঠানের আনন্দে মেতে উঠার সুযোগ অনেকটা বিঘিœত।
প্রাচীন আর্য মনীষীদের সৃষ্ট বর্ষপঞ্জীকে পরিবর্তনের কোন যৌক্তিক গবেষনালদ্ধ সংগতি রয়েছে কীনা সেটা প্রশ্ন বিদ্ধ রেখেই পরিবর্তিত বর্ষপঞ্জীর আলোকেই চলছে বাঙ্গালীর সকল বাঙ্গালীপনা। অথচ এমনি এক মহতী বর্ষবরণ উৎসবের মহা মিলনের জোয়ার পরিবর্তনের ছোঁয়ায় অনেকটা স্রোতহারা, শ্রীহীন। বাংলাদেশী বাঙ্গালীদের মিলিত স্বত্বার উৎসবকে বিভক্ত করে একদিকে যেমন উৎসবের আমেজ কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে, অপরদিকে বাঙ্গালীর চিন্তাধারা দু’ধারায় বিভক্ত হওয়ার বীজ রোপন হয়েছে। বিশ্বের কোথাও গবেষনালদ্ধ বর্ষপঞ্জীতে পরিবর্তনের কোন প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। প্রসংগত ইংরেজী বর্ষের দিনপঞ্জী আর্ন্তজাতিক ভাবে স্বীকৃত এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় ধারার বর্ষপঞ্জী। কস্মিন কালেও কেউ এ বর্ষপঞ্জী পরিবর্তনের কারণ ভনুভব করেনি। প্রাকৃতিক বিষয়ে নজরদারী স্বাভাবিক ঘটনা নয়। মূলত: দিন রাত্রির আবর্তন প্রাকৃতিক বিষয়। যেখানে প্রাকৃতিক নিয়মের কোন পরিবর্তন হয়নি,চন্দ্র.সূর্য্য ,গ্রহ ,নক্ষত্রের অবস্থান ও গতিধারার কোন পরিবর্তন হয়নি, দিন - রাত ও জোয়ার-ভাটা একই নিয়মে আবর্তিত হয়; সেখানে দিন- মাস - বছর গণণায় পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনেকটা ধোঁয়াটে বটে। জাতীয় ক্ষেত্রে এর সুবিধা পরিস্কার না হলেও জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে সম্প্রীতি,সৌহার্দ্য ও ঐক্যের পদযাত্রায় যে কিছুটা চির ধরেছে তাতে সন্দেহ নেই। পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ উৎসব বাংলাদেশী অসাম্প্রদায়িক বাঙ্গালীর দীর্ঘদিনের লালিত ও গৌরব গাঁথা অর্জন। এ’অর্জনে বিসর্জনের যে মাত্রা যোগ হয়েছে তা জাতীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করার সম্ভাবনাকে আতংকিত করেছে। বাঙালী জাতি একই পথ বেয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রেখে বিশ্বে সমাদৃত হোক এ প্রত্যাশা বাংলার সকল বাঙালীর।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সায়েম মুর্শেদ ২৫/০৪/২০১৯সংস্কৃতি সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে একত্রিত করে।