সংক্ষেপণ বিভ্রাট
গল্পঃ "সংক্ষেপণ বিভ্রাট"
লেখকঃ বর্ণ
তারিখঃ১৮/০৭/২০২১ইং
সময়ঃ১১:০০ ঘটিকা
হাইকোর্টে একটি কক্ষে আগে থেকেই একটি মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।এরই মাঝে ঘটলো এক বিপত্তি।কোথা থেকে একজন টাক মাথার বেঁটে মতো মানুষ,এসে কোর্ট রুমের পেছনের দিকটায় বেশ একটা গণ্ডগোল বাঁধিয়ে বসলো।
সে জজ সাহেবকে কিছু কথা বলতে চায় বলে স্থির করে এসেছে।কিন্তু এভাবে মন চাইলেই তো ল্যাজ দুলিয়ে চলে আসা যায় না।আর এলেও বিচারক তার কথা শোনেন না।তাই তাকে পথে বাধা দেয়া হলো।আগন্তুক লোকটিও ভীষণ জেদি।দুই দুই জন ষণ্ডামার্কা কন্সটেবল সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চ্যাংদোলা করেও তাকে বাইরে নিতে পারলেন না।
এদিকে জজ সাহেব কয়েকবার হাতুরি পেটা করেও যখন কোর্ট রুমের শোরগোল থামাতে পারলেন না।তখন তিনি লোকটিকে তার সমক্ষে আনায়ন করার নির্দেশ দিলেন।
আদেশ পাওয়া মাত্র কন্সটেবল দুজন তাকে ছেড়ে দিলেন।আগন্তুক ব্যক্তি তখন নিজেই অগ্রসর হয়ে বিচারপতির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো।
বিচারক তাকে এই বলে শাসালেন যে,এটা একটা আদালত কক্ষ।এখানে কথা বলতে গেলে নিয়ম মেনে এগোতে হয়।উকিল ধরতে হয়।মোকদ্দমা করতে হয় এবং আগন্তুক যে উপায়ে আদালতকক্ষে হাজির হয়ে বিজ্ঞ আদালতের কার্যে বিঘ্ন ঘটিয়েছে।তাতে তার কারাদণ্ড হবার বিধানও রয়েছে?
প্রত্যুত্তরে আগন্তুকের যুক্তি শুনে বিজ্ঞ বিচারক বুঝতে পারলেন, এ লোক কাজ হাসিল না করে হাল ছাড়ার পাত্র মোটেই নয়।বিধায় আর কালক্ষেপণ না করে তিনি তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য পেশ করতে বললেন।
চলমান মামলার রায় যেই পক্ষের অনুকূলে যাওয়ার মৃদু সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।সেই বাদী পক্ষের উকিল গলার সুর সপ্তমে চড়িয়ে তার বিরোধ করে বসলেন। বললেন, এমন ঘটনা ঘটলে তা শুধু রীতি বহির্ভূত কাজই হবে না,সেই সাথে বিজ্ঞ আদালতের অপমানও করা হবে বৈকি।
কিন্তু তার বিরোধে বিচারকের আদেশের কোনো হেরফের হলো না।
আগন্তুক কাঠগড়ায় প্রবেশ করলে চাপরাশি তাকে শপথ বাক্য পাঠ করালো।তারপর আগন্তুক তার বক্তব্য বলতে আরম্ভ করলো।
মহাশয়, আমি রজব আলী পরামানিক।বড় বাধ্য হয়ে আজ এহেন উপায় অবলম্বন করে আপনার শরণাগত হয়েছি।আমি যে সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি, তা কেবল আমার একার সমস্যা নয়।এই সমস্যা আমার সাথে সাথে আপনারও সমস্যা বটে।
ওই যে ওখানে যিনি বসে আছেন।যিনি উকিল সাহেব।তারও এই সমস্যা।
বিরোধে কাজ না হলে,বাদীপক্ষের উকিল তার বেঞ্চে বসে জল পান করছিলেন।আকস্মিকভাবে তাকে উপলক্ষ করায়, তার গলায় খানিকটা জল আটকে গিয়ে হেঁচকি আর কাশিতে মিলে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড করলেন উকিল মশাই।
জজ সাহেব বোধহয় রজব আলীর কথায় কিঞ্চিত রস বোধ করলেন।তিনি রজব আলীকে সমস্যার বিস্তারিত খুলে বলতে বললেন।
রজব আলী শুরু করলো।
আমার সমস্যাটি একটি জাতীয় সমস্যা হে মহাশয়।
আমার অভিযোগ,আমার ছেলে ও এই দেশে তার সমবয়সী সকল ছেলে মেয়েদের বিরুদ্ধে।
আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য থানায় থানায় ঘুরেছি।উকিলের পিছে পিছে ঘুরেছি।কেউই সাহায্য করেনি মহামান্য বিচারক।উলটো খেদিয়ে দিয়েছে।
বাদী পক্ষের উকিল এবার সরব হয়ে উঠলেন।
এমন আজব অভিযোগের পিছনে দৌড়ে কেউই নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাইবেন না বিজ্ঞ বিচারক।
আমার মনে হয় এই লোকটি মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত।তাই তার ভারসাম্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করা উচিত এবং আমাদের অর্ধসমাপ্ত মোকাদ্দমার রায়ের দিকে নজর দেয়া উচিৎ বলে মনে করছি।
বোঝা গেলো,বিচারক মহাশয় তার দীর্ঘ একঘেয়ে কাজের ফাঁকে রজব আলীকে সামান্য বিনোদনের পাত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন।তাই তিনি এবারও উকিলের কথায় কর্ণপাত করলেন না।
রজব আলী বলে চললো।
মহাশয়,আমার পুত্র নবীনকে সম্প্রতি ইন্টারনেটের বিভিন্ন সুবিধাদি ভোগ করার নিমিত্তে একখানা বড় পর্দা ওয়ালা মুঠোফোন খরিদ করে দিয়েছি।
আর মাঝে মধ্যে আমার পুত্রের কাছে আমিও সেই মুঠোফোন এর ব্যবহার বিধি শিখতে আরম্ভ করি। তখনি এই সমস্যাটি আমার নজরে আসে।
সমস্যা বলেন তো সমস্যা।এ তো যে সে সমস্যা নয়!আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে জনাব!কি বিড়ম্বনাই না হতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে!
জজ সাহেব তাকে সমস্যাটি খুলে বলার নির্দেশ দিলেন।
সেলফোনে বার্তা পাঠানোর একটি উপায় আছে,তা সকলে জানেন নিশ্চয়।চাইলে আপনি পয়সা খরচ করে যে কাউকে যে কোনো সময় লিখিত বার্তা পাঠাতে পারবেন।আমার পুত্রের নিকট হতে আমি বার্তা পাঠানোর পদ্ধতিটাই আয়ত্ত করছিলাম।
এমন সময় ক্রিং করে একটি বাজনা বেজে ওঠে।জানতে পারলাম,পুত্রের জনৈক বন্ধু তাকে বার্তা পাঠিয়েছে।আমি বার্তাটি দেখে অবাক হলাম।
পরিষ্কার ইংরাজিতে লেখা বার্তা।
হাই ব্রো।
আমার পুত্র আমার সম্মুখেই তাকে ফিরতি বার্তাটি পাঠিয়ে দিলো।সে লিখলো,
হ্যালো ব্রো।
আমাদের সময়ে আমার ব্রো এর মানে শিখেছিলাম চোখের ভ্রু,কিন্তু এই স্থানে সেই ব্রো এর কি অর্থ হতে পারে তার আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝালাম না।জিজ্ঞাসা করে জানতে পারা গেলো, এই ব্রো চোখের ভ্রুয়ের ব্রো নয়।এ হলো ব্রাদার এর ব্রো।ব্রাদার লিখতে বেশি সময় খরচ হয় বলে তারা এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে।
কি লজ্জা! কি লজ্জা!
এতে লজ্জার কি হলো ভায়া।কটমটিয়ে জানতে চাইলেন বাদীপক্ষের উকিল বাবুটি।
এ আপনি কি বলছেন কি উকিল মশাই!
লজ্জার কিছু হলো না মানে।আলবৎ হলো,একশোবার হলো।ওরা যে কতো সন্তর্পণে আপনার পাজামার ফিতে ধরে টান মারছে সে আপনি কদিন পরই টের পাবে।
উকিল এবার তার সম্মানহানির জের টেনে জজের নিকট আশ্রয় ভিক্ষা চাইলেন।জজ সাহেব ইশারায় তাকে বসতে বলে, আবার রজব আলীর কথায় কান দিলেন।
আজকালকার যুবা,ব্রাদারকে কেটে কুটে ব্রো করে নিয়েছে।আর আমাদের সময় কি দিন ছিলো জজ সাহেব!
একবার আমি আইসক্রিম বানান লিখতে গিয়ে বড় হাতের আই এর ওপর আস্তে করে একটা ছোট হাতের ফুটকি বসিয়ে দিয়েছিলাম।
তাই বলে প্রাইমারির নরেণ পণ্ডিত টানা তিন ক্লাস পর্যন্ত আমায় মনের সুখে কেলিয়েছে।
মাননীয় বিচারক, আমি চাই আপনি আমার পুত্রের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ গ্রহণ করে আশু ব্যবস্থার বন্দোবস্তো করুন।পরন্তু অতিসত্বর এইরূপ সংক্ষেপণ এর উপর কড়া হুশিয়ারি জারি করে আশু বিভ্রাট বিড়ম্বনা হতে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করুন।
বিজ্ঞ বিচারক এবার খানিক নড়েচড়ে বসলেন।তারপর তিনি, ব্রাদার কে ব্রো বলা হলে দেশ ও জাতি কিভাবে বিড়ম্বনার শিকার হতে পারে,তা জানতে চাইলেন।
রজব মিয়া আবার শুরু করলো।
দেখুন জনাব আজকের এই ব্রো থেকেই আগামী প্রজন্মের সমূহ বিপত্তি খাড়া হতে পারে।
আজ যারা ব্রাদারকে ব্রো আর সিস্টার কে সিস বানিয়েছে, তারাই কাল ফাদার কে ফ্রো বানিয়ে ছাড়বে।আর মিস্টার হয়ে যাবে মিস।তখন কে সামলাবে এই ঠ্যালা।
আর আমার মতো যাদের বানান ভুল করার বাতিক আছে।তাদের পক্ষে তো ব্রাদারের ব্রো টাকে ব্রা আর সিস্টারের সিস টাকে সস এবং ফাদারের ফ্রো টাকে একেবারে ফ্রাই পর্যন্ত বানিয়ে ফেলার ঝুঁকি আছে।
শুধু কি তাই?
সারা জীবন যাদের নাম মনে ধারণ করে আছি।নেইল আর্মস্ট্রং, ভেলেন্তিনা তেরেসকোভা।যারা কিনা বিশ্বজোড়া এস্ট্রোনট বলে খ্যাত। তারা হয়ে যাবে এ্যাস।ড্রাইভার কে কেউ আর ড্রাইভার বলবে না।ড্রাই ড্রাই করে চিক্কুর পাড়বে।
ডাক্তার হয়ে যাবে ডাক।অফিসার গুলো অফ আর বক্সার বাবাজীরা বক্স হয়ে যাবে।
কাকাতুয়াকে তখন সবাই কাক বলে ডাকবে।আর কাককে শুধু কা ডাকতে গিয়ে কাকের মতন নিজেরাই কা কা শুরু করে দিবে
আর সেই ব্যাধি যখন সবদিক ছাপিয়ে সাহিত্য জগতে পা রাখবে।তখন কি হাল হবে একবার ভাবুন। রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাবেন রব আর কাজী নজরুল হবেন কাজ।বঙ্কিমচন্দ্র হবেন বক আর বেচারা মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে যাবে মাণ।
আমি সেইটেই ভেবে ভেবে অস্থির হই।মান বলেন তো আমাদের এলাকায় এক জাতের বড় বড় কচুও কিন্তু আছে।তখন দুই মান'কে আলাদা কি করে করবেন বলুন তো।
বিচারক মশায় হাপ ছাড়লেন।আর বাদী পক্ষের উকিল বেশ যে মজা পেলেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল তার দিল খোলা ফিকফিক হাসির বহর দেখে।
রজব আলী এবার তার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করলো।
হাসবেন না মশাই,হাসবেন না। অতি শীঘ্র যদি এর একটা হেস্তনেস্ত না করে ফেলেন।তাহলে আপনার কি হাল হবে একবার ভেবে দেখেছেন।
উৎসাহ দেখিয়ে বিজ্ঞ বিচারক মুচকি হেসে জানতে চাইলেন।
কি হাল হতে পারে উকিল সাহেবের?
ইংরাজি ভাষায় উকিলদের তো প্রোসিকিউটর বলে,তাইনা জনাব।
তা বলি,আপনার প্রো এর পরে যে সিকিউটর টা আছে,তার সিকিউরিটি কি আপনি দিতে পারেন?
আর ধরুন জজ সাহেব আপনার কথাই যদি বলি।আপনাকে তো ইংরেজি ভাষায় ব্যারিস্টার বলা হয়ে থাকে।কাল যদি হঠাৎ করে কেউ……….।
জজ সাহেবের ভাগ্য নিতান্তই সুপ্রসন্ন।এই রকম বিপদসংকুল একটি মুহুর্তে, পেছন থেকে দেওয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং করে বাজনা বাজিয়ে জানান দিলো,আজকের মতো কোর্ট এখানেই মুলতবি।আর সেই সাথে ব্যারিস্টার মহোদয়ের ইজ্জতটাও আজকের মতো অক্ষত রইলো।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে,বিচারক এবং উকিল উভয়েই আর কোনো ঝুঁকি না নিয়ে তল্পিতল্পা গুছিয়ে, দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়লেন।
---------*******---------
লেখকঃ বর্ণ
তারিখঃ১৮/০৭/২০২১ইং
সময়ঃ১১:০০ ঘটিকা
হাইকোর্টে একটি কক্ষে আগে থেকেই একটি মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।এরই মাঝে ঘটলো এক বিপত্তি।কোথা থেকে একজন টাক মাথার বেঁটে মতো মানুষ,এসে কোর্ট রুমের পেছনের দিকটায় বেশ একটা গণ্ডগোল বাঁধিয়ে বসলো।
সে জজ সাহেবকে কিছু কথা বলতে চায় বলে স্থির করে এসেছে।কিন্তু এভাবে মন চাইলেই তো ল্যাজ দুলিয়ে চলে আসা যায় না।আর এলেও বিচারক তার কথা শোনেন না।তাই তাকে পথে বাধা দেয়া হলো।আগন্তুক লোকটিও ভীষণ জেদি।দুই দুই জন ষণ্ডামার্কা কন্সটেবল সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চ্যাংদোলা করেও তাকে বাইরে নিতে পারলেন না।
এদিকে জজ সাহেব কয়েকবার হাতুরি পেটা করেও যখন কোর্ট রুমের শোরগোল থামাতে পারলেন না।তখন তিনি লোকটিকে তার সমক্ষে আনায়ন করার নির্দেশ দিলেন।
আদেশ পাওয়া মাত্র কন্সটেবল দুজন তাকে ছেড়ে দিলেন।আগন্তুক ব্যক্তি তখন নিজেই অগ্রসর হয়ে বিচারপতির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো।
বিচারক তাকে এই বলে শাসালেন যে,এটা একটা আদালত কক্ষ।এখানে কথা বলতে গেলে নিয়ম মেনে এগোতে হয়।উকিল ধরতে হয়।মোকদ্দমা করতে হয় এবং আগন্তুক যে উপায়ে আদালতকক্ষে হাজির হয়ে বিজ্ঞ আদালতের কার্যে বিঘ্ন ঘটিয়েছে।তাতে তার কারাদণ্ড হবার বিধানও রয়েছে?
প্রত্যুত্তরে আগন্তুকের যুক্তি শুনে বিজ্ঞ বিচারক বুঝতে পারলেন, এ লোক কাজ হাসিল না করে হাল ছাড়ার পাত্র মোটেই নয়।বিধায় আর কালক্ষেপণ না করে তিনি তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য পেশ করতে বললেন।
চলমান মামলার রায় যেই পক্ষের অনুকূলে যাওয়ার মৃদু সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।সেই বাদী পক্ষের উকিল গলার সুর সপ্তমে চড়িয়ে তার বিরোধ করে বসলেন। বললেন, এমন ঘটনা ঘটলে তা শুধু রীতি বহির্ভূত কাজই হবে না,সেই সাথে বিজ্ঞ আদালতের অপমানও করা হবে বৈকি।
কিন্তু তার বিরোধে বিচারকের আদেশের কোনো হেরফের হলো না।
আগন্তুক কাঠগড়ায় প্রবেশ করলে চাপরাশি তাকে শপথ বাক্য পাঠ করালো।তারপর আগন্তুক তার বক্তব্য বলতে আরম্ভ করলো।
মহাশয়, আমি রজব আলী পরামানিক।বড় বাধ্য হয়ে আজ এহেন উপায় অবলম্বন করে আপনার শরণাগত হয়েছি।আমি যে সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি, তা কেবল আমার একার সমস্যা নয়।এই সমস্যা আমার সাথে সাথে আপনারও সমস্যা বটে।
ওই যে ওখানে যিনি বসে আছেন।যিনি উকিল সাহেব।তারও এই সমস্যা।
বিরোধে কাজ না হলে,বাদীপক্ষের উকিল তার বেঞ্চে বসে জল পান করছিলেন।আকস্মিকভাবে তাকে উপলক্ষ করায়, তার গলায় খানিকটা জল আটকে গিয়ে হেঁচকি আর কাশিতে মিলে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড করলেন উকিল মশাই।
জজ সাহেব বোধহয় রজব আলীর কথায় কিঞ্চিত রস বোধ করলেন।তিনি রজব আলীকে সমস্যার বিস্তারিত খুলে বলতে বললেন।
রজব আলী শুরু করলো।
আমার সমস্যাটি একটি জাতীয় সমস্যা হে মহাশয়।
আমার অভিযোগ,আমার ছেলে ও এই দেশে তার সমবয়সী সকল ছেলে মেয়েদের বিরুদ্ধে।
আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য থানায় থানায় ঘুরেছি।উকিলের পিছে পিছে ঘুরেছি।কেউই সাহায্য করেনি মহামান্য বিচারক।উলটো খেদিয়ে দিয়েছে।
বাদী পক্ষের উকিল এবার সরব হয়ে উঠলেন।
এমন আজব অভিযোগের পিছনে দৌড়ে কেউই নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাইবেন না বিজ্ঞ বিচারক।
আমার মনে হয় এই লোকটি মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত।তাই তার ভারসাম্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করা উচিত এবং আমাদের অর্ধসমাপ্ত মোকাদ্দমার রায়ের দিকে নজর দেয়া উচিৎ বলে মনে করছি।
বোঝা গেলো,বিচারক মহাশয় তার দীর্ঘ একঘেয়ে কাজের ফাঁকে রজব আলীকে সামান্য বিনোদনের পাত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন।তাই তিনি এবারও উকিলের কথায় কর্ণপাত করলেন না।
রজব আলী বলে চললো।
মহাশয়,আমার পুত্র নবীনকে সম্প্রতি ইন্টারনেটের বিভিন্ন সুবিধাদি ভোগ করার নিমিত্তে একখানা বড় পর্দা ওয়ালা মুঠোফোন খরিদ করে দিয়েছি।
আর মাঝে মধ্যে আমার পুত্রের কাছে আমিও সেই মুঠোফোন এর ব্যবহার বিধি শিখতে আরম্ভ করি। তখনি এই সমস্যাটি আমার নজরে আসে।
সমস্যা বলেন তো সমস্যা।এ তো যে সে সমস্যা নয়!আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে জনাব!কি বিড়ম্বনাই না হতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে!
জজ সাহেব তাকে সমস্যাটি খুলে বলার নির্দেশ দিলেন।
সেলফোনে বার্তা পাঠানোর একটি উপায় আছে,তা সকলে জানেন নিশ্চয়।চাইলে আপনি পয়সা খরচ করে যে কাউকে যে কোনো সময় লিখিত বার্তা পাঠাতে পারবেন।আমার পুত্রের নিকট হতে আমি বার্তা পাঠানোর পদ্ধতিটাই আয়ত্ত করছিলাম।
এমন সময় ক্রিং করে একটি বাজনা বেজে ওঠে।জানতে পারলাম,পুত্রের জনৈক বন্ধু তাকে বার্তা পাঠিয়েছে।আমি বার্তাটি দেখে অবাক হলাম।
পরিষ্কার ইংরাজিতে লেখা বার্তা।
হাই ব্রো।
আমার পুত্র আমার সম্মুখেই তাকে ফিরতি বার্তাটি পাঠিয়ে দিলো।সে লিখলো,
হ্যালো ব্রো।
আমাদের সময়ে আমার ব্রো এর মানে শিখেছিলাম চোখের ভ্রু,কিন্তু এই স্থানে সেই ব্রো এর কি অর্থ হতে পারে তার আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝালাম না।জিজ্ঞাসা করে জানতে পারা গেলো, এই ব্রো চোখের ভ্রুয়ের ব্রো নয়।এ হলো ব্রাদার এর ব্রো।ব্রাদার লিখতে বেশি সময় খরচ হয় বলে তারা এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে।
কি লজ্জা! কি লজ্জা!
এতে লজ্জার কি হলো ভায়া।কটমটিয়ে জানতে চাইলেন বাদীপক্ষের উকিল বাবুটি।
এ আপনি কি বলছেন কি উকিল মশাই!
লজ্জার কিছু হলো না মানে।আলবৎ হলো,একশোবার হলো।ওরা যে কতো সন্তর্পণে আপনার পাজামার ফিতে ধরে টান মারছে সে আপনি কদিন পরই টের পাবে।
উকিল এবার তার সম্মানহানির জের টেনে জজের নিকট আশ্রয় ভিক্ষা চাইলেন।জজ সাহেব ইশারায় তাকে বসতে বলে, আবার রজব আলীর কথায় কান দিলেন।
আজকালকার যুবা,ব্রাদারকে কেটে কুটে ব্রো করে নিয়েছে।আর আমাদের সময় কি দিন ছিলো জজ সাহেব!
একবার আমি আইসক্রিম বানান লিখতে গিয়ে বড় হাতের আই এর ওপর আস্তে করে একটা ছোট হাতের ফুটকি বসিয়ে দিয়েছিলাম।
তাই বলে প্রাইমারির নরেণ পণ্ডিত টানা তিন ক্লাস পর্যন্ত আমায় মনের সুখে কেলিয়েছে।
মাননীয় বিচারক, আমি চাই আপনি আমার পুত্রের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ গ্রহণ করে আশু ব্যবস্থার বন্দোবস্তো করুন।পরন্তু অতিসত্বর এইরূপ সংক্ষেপণ এর উপর কড়া হুশিয়ারি জারি করে আশু বিভ্রাট বিড়ম্বনা হতে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করুন।
বিজ্ঞ বিচারক এবার খানিক নড়েচড়ে বসলেন।তারপর তিনি, ব্রাদার কে ব্রো বলা হলে দেশ ও জাতি কিভাবে বিড়ম্বনার শিকার হতে পারে,তা জানতে চাইলেন।
রজব মিয়া আবার শুরু করলো।
দেখুন জনাব আজকের এই ব্রো থেকেই আগামী প্রজন্মের সমূহ বিপত্তি খাড়া হতে পারে।
আজ যারা ব্রাদারকে ব্রো আর সিস্টার কে সিস বানিয়েছে, তারাই কাল ফাদার কে ফ্রো বানিয়ে ছাড়বে।আর মিস্টার হয়ে যাবে মিস।তখন কে সামলাবে এই ঠ্যালা।
আর আমার মতো যাদের বানান ভুল করার বাতিক আছে।তাদের পক্ষে তো ব্রাদারের ব্রো টাকে ব্রা আর সিস্টারের সিস টাকে সস এবং ফাদারের ফ্রো টাকে একেবারে ফ্রাই পর্যন্ত বানিয়ে ফেলার ঝুঁকি আছে।
শুধু কি তাই?
সারা জীবন যাদের নাম মনে ধারণ করে আছি।নেইল আর্মস্ট্রং, ভেলেন্তিনা তেরেসকোভা।যারা কিনা বিশ্বজোড়া এস্ট্রোনট বলে খ্যাত। তারা হয়ে যাবে এ্যাস।ড্রাইভার কে কেউ আর ড্রাইভার বলবে না।ড্রাই ড্রাই করে চিক্কুর পাড়বে।
ডাক্তার হয়ে যাবে ডাক।অফিসার গুলো অফ আর বক্সার বাবাজীরা বক্স হয়ে যাবে।
কাকাতুয়াকে তখন সবাই কাক বলে ডাকবে।আর কাককে শুধু কা ডাকতে গিয়ে কাকের মতন নিজেরাই কা কা শুরু করে দিবে
আর সেই ব্যাধি যখন সবদিক ছাপিয়ে সাহিত্য জগতে পা রাখবে।তখন কি হাল হবে একবার ভাবুন। রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাবেন রব আর কাজী নজরুল হবেন কাজ।বঙ্কিমচন্দ্র হবেন বক আর বেচারা মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে যাবে মাণ।
আমি সেইটেই ভেবে ভেবে অস্থির হই।মান বলেন তো আমাদের এলাকায় এক জাতের বড় বড় কচুও কিন্তু আছে।তখন দুই মান'কে আলাদা কি করে করবেন বলুন তো।
বিচারক মশায় হাপ ছাড়লেন।আর বাদী পক্ষের উকিল বেশ যে মজা পেলেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল তার দিল খোলা ফিকফিক হাসির বহর দেখে।
রজব আলী এবার তার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করলো।
হাসবেন না মশাই,হাসবেন না। অতি শীঘ্র যদি এর একটা হেস্তনেস্ত না করে ফেলেন।তাহলে আপনার কি হাল হবে একবার ভেবে দেখেছেন।
উৎসাহ দেখিয়ে বিজ্ঞ বিচারক মুচকি হেসে জানতে চাইলেন।
কি হাল হতে পারে উকিল সাহেবের?
ইংরাজি ভাষায় উকিলদের তো প্রোসিকিউটর বলে,তাইনা জনাব।
তা বলি,আপনার প্রো এর পরে যে সিকিউটর টা আছে,তার সিকিউরিটি কি আপনি দিতে পারেন?
আর ধরুন জজ সাহেব আপনার কথাই যদি বলি।আপনাকে তো ইংরেজি ভাষায় ব্যারিস্টার বলা হয়ে থাকে।কাল যদি হঠাৎ করে কেউ……….।
জজ সাহেবের ভাগ্য নিতান্তই সুপ্রসন্ন।এই রকম বিপদসংকুল একটি মুহুর্তে, পেছন থেকে দেওয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং করে বাজনা বাজিয়ে জানান দিলো,আজকের মতো কোর্ট এখানেই মুলতবি।আর সেই সাথে ব্যারিস্টার মহোদয়ের ইজ্জতটাও আজকের মতো অক্ষত রইলো।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে,বিচারক এবং উকিল উভয়েই আর কোনো ঝুঁকি না নিয়ে তল্পিতল্পা গুছিয়ে, দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়লেন।
---------*******---------
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ২৮/০৮/২০২৩মন্দ নয়
-
মুহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন ১৮/০৭/২০২১গল্পটি মন্দ হয়নি। তবে আরো গুরুগম্ভীর হওয়া দরকার ছিল। ধন্যবাদ চেস্টা করার জন্য।