এম ভি শ্যাকর্ভিল-২১
পূর্বাভাস
জোসেফ কোথায়?জাহাজটা এখন কোথায়?ওর দেখার কথা ছিলো না এই ব্যাপারাটা।রাগে গজগজ করতে করতে বললো লুথার রোজারিও।
স্যার উনি মনে হয় ওয়াশরুমে গেছেন।জুবুথুবু হয়ে বললো লিসান।
এটা ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় হলো?জাহাজটা কোথায় আছে সেটা বলো,ওটা কি তাইমেনিয়ান বন্দরে ঘাটি করার কোন সম্ভাবনা আছে?
এখনো বলতে পারছি না স্যার!তবে আধ ঘন্টার মধ্যে ওটা তাইমেনিয়ান উপকূলের পাশ দিয়ে যাবে।
ঈশ্বর যেনো সদয় হয়...
***
বন্দরের এক সাধারণ খাবার হোটেলে মেষের মাংসের ঝোল দিয়ে গরম গরম ফাপা রুটি খাচ্ছে আর্থার টিউন।তার পাশে বসে খাচ্ছে আজমির ও জাহাজের অন্য কর্মীরা। সবাই দীর্ঘ জলপথ ভ্রমনের পর স্থলে আবিষ্ট হয়েছে তারা।নিরব ভক্ষন শেষে আর্থার আজমিরের দিকে তাকিয়ে বললো, গার্সিল রসদ নিয়ে ফিরেছে?
না,তবে এখনই চলে আসবে।
হুম বেশিক্ষন দেরি করা যাবে না।
জ্বী স্যার।
আজমির আর আর্থার টিউন কথা বলছে।অন্যরা নির্বিঘ্নে খেয়ে যাচ্ছে,এ ব্যাপারে তাদের কোন ভ্রক্ষেপ নেই...
***
অধ্যায়-১
ভোরের সূর্যটা ধীরে ধীরে তেজি হয়ে উঠছে।কেবিনের কাচের জানালায় ভেদ করে হালকা তীক্ষ্ণ আলো চলে গেছে বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আজমিরের মুখের উপর।আলোর কারনেই সকালের কড়া ঘুমটা ভাঙতে শুরু করেছে তার।সারারাতের ধকল থাকা সত্যেও রোজকার অভ্যাস মতো ঘুম ভাঙতে শুরু করে।
হাজার টন মেরিন ওয়েল বোঝাই রসদ নিয়ে এম.ভি শ্যাকর্ভিল জাহাজটা ছুটে চলেছে সোমালিয়ার দিকে।বিশাল প্রশান্তর বুকে চিরে।উত্তাল ভূমধ্যসাগর থেকে শান্ত প্রশান্তসাগর সব পথ চিনে বহুজাতিক জায়েন্ট দ্য ওল্ড আর্থ শিপিং কোম্পানির এই শ্যাকর্ভিল সিরিজের জাহাজ গুলো।বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আজমির এই শ্যাকর্ভিল-২১ এর জুনিয়র নাবিক।
আকাশ পরিষ্কার,কোথাও মেঘের কোন চিহ্ন নেই।রৌদ্রোজ্জল এই আকাশ দেখলে কেউ বলবে গত রাতে এই আকাশ জুড়ে ছিলো কালো মেঘ।চারদিক ছিলো ঘূর্নি বাতাস,ছিলো উত্তাল সমুদ্র।কত কষ্টই না করতে হয়েছে আর্থার টিউনকে।সহযোগী হিসেবে ছিলো আজমির।বলতে গেলে ঝড়টা গেছে আজমিরের উপর দিয়ে।সিনিয়র কিংবা প্রধান নাবিকদের অনুগত্যই তো জুনিয়রদের ধর্ম।তারউপর আছে ভয়।কারণ,এতো বড় জাহাজের জুনিয়র নাবিক হিসেবে এই প্রথম প্রশান্তর বুক চিরে যাচ্ছে তারা।তারউপর অনাকাক্ষিত ঝড়।এর আগে আজমির কাজ করেছে ভারত মহাসাগরে ছোট্ট লোকাল জাহাজ আনা নেওয়ার কাজ।শ্রীলঙ্কাকে থেকে ভারত,ভারত থেকে বাংলাদেশ।এই ছিলো তার গন্তব্য।কিন্তু ভাগ্য ফেরে শ্রীলঙ্কা থেকেই।সেখানেই পরিচয় হয় কোপার্ন ভিসুসের সাথে।শ্যাকর্ভিল জাহাজের লোকবল তদারকি করাই তার কাজ।সেইই শ্যাকর্ভিল-২১ এর জুনিয়র নাবিক হিসেবে কাজ পাইইয়ে দিয়েছিলো আজমির কে।কত শত কথা,কত শত প্যারা।ঘুষ,টেবিলের নিচেরর লেনদেন তারপর এই চাকুরি।তবে ভাগ্যটা তার সুপ্রসন্ন কিনা তা বলা মুশকিল।কারণ,চাকরি পাওয়ার পর থেকে নানাবিধ ঝামেলা লীগেয় আছে।আজ এ সমস্যা তো কাল ও সমস্যা।তার উপর প্রথম লং ট্রিপে গত রাতের ঝড়!
ক্লান্তি অবসাদ ঝেড়ে হাজার বছর পুরোনো সূর্যটার মৃদু আলো গায়ে মাখার জন্য কেবিন ছেড়ে ডেকের দিকে হাটা দেয়,আজমির।ডেক পুরো ভিজে চৌচির হয়ে গেছে।গার্সিল ডেকের এক দিকে পানিতে ভেজা পাঞ্জারির দড়ি গুছাচ্ছে।আধঘুম চোখে গার্সিলের দিকে তাকিয়ে আজমির বললো,গার্সিল দড়ি কতটুকু ভালো আছে? আর বইলেন না,সেইফটি বোটের দড়িটাই ভালো আছে।রাতে যা ধকল গেছে।এখন সোমালিয়া যাওয়ার আগে কোন বন্দর থেকে রসদ কিনার সময় দড়িও কিনতে হবে। কখন কি হয়ে যায়,আবার যদি ঝড় উঠে তাহলে বিপদে পড়তে হবে।এক নাগারে কথা গুলো বলে গেলো,গার্সিল।
হুম,তা ঠিক।তো স্যার কোথায়?তাকে জিজ্ঞাস করে দেখি সোমালিয়ার আগে কোন বন্দরে জাহাজ ভিড়াবে কিনা?
স্যার তো ঝড়ের পর অটো ক্যাপ্টেন মোডে দিয়ে নিকনের হাতের জাহাজ তুলে দিয়েছেন।তারপর পুরো এক বোতলন রেড ওয়াইন খেয়ে এখনো ঘুমাচ্ছেন।ওহহ,ঠিক আছে আমি ম্যাপ দেখছি।সামনে কোন বন্দর আছে কিনা।কাছে কোন বন্দর থাকলে স্যারকে ডাকবো।
গার্সিল আর কিছু না বলে দড়ির দিকে মনোযোগ দিলো।তাছাড়া তাকে ডেকের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা তেল পরিষ্কার করতে হবে।
আজমিরের কাধ পর্যন্ত লম্বা চুল গুলো প্রশান্তের বাতাসে দারুণ ভাবে উড়ছে।সকালের মিষ্টি বাতাসে আজ মিলির কথা খুব মনে পড়ছে তার।এই চুলগুলো মিলির অনেক পছন্দের।মিলি,এক তরুণীর নাম।যার প্রেমে সমুদ্র পারি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে আজমির।চুলগুলো যে মিলির পছন্দ এটা আজমিরের ধারণা।বাংলাদেশে থাকাকালীন একদিন মিলি আজমিরকে বলেছিলো,আপনার চুলগুলো দারুন!আহা,সেই তিন বাক্যের কথাটির কারনেই আজও প্রায় আড়াই বছর পরও আজমির প্রতি মাসের শেষ দিকে হালকা ছেটে সেই একই সাইজের করে রাখে।কিন্তু এটাও সত্য মিলির সাথে আজমিরের কোন ঘোষিত সম্পর্ক নেই।এই ভাবনাটাই পীড়া দেয়,এই ভাবনাটাই হাসায়।কিন্তু আজকের ভাবনা মন খারাপ করছে।আজমির চায় না সকালটা খারাপ করতে,তাই সে নিজের মনের বিরোদ্ধে লড়াই করতে থাকেড়ায়।দূর থেকে আজমিরকে ডেকের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিকন পাশে এসে দাঁড়ায়।
মন খারাপ ভাই?নিকন আজমিরের সমবয়সী।জাহাজে একমাত্র নিকনই আজমিরকে ভাই বলে ডাকে।অবশ্য আজমিরই তাকে এ অধিকার দিয়েছে।
না,ঠিক আছি।
সকাল সকাল আপনার মুখটা এমন বিবর্ন দেখাচ্ছে তাই বললাম।
কিছু হয়নি।নিকন তুমি এক কাজ করো,আমার জন্য হালকা সোডা দিয়ে এক বোতল হুইস্কি নিয়ে আসো।
সকাল বেলা হুইস্কি খাবেন?
হুম,যাও।
নিকন আর কিছু না বলে স্টোরেজ রুমের দিকে যেতে শুরু করে।অবশ্য তার কিছু বলারও নেই।ছয় মাস ধরে আজমিরের সাথে কাজ করছে। প্রায়ই দেখে আজমির কোন কারনেই হুট করে মন খারাপ করে বসে।
অধ্যায়-২
প্রশান্তর নীল পানির বুক চির শ্যাকর্ভিল-২১ ছুটে চলেছে সোমালিয়ার দিকে।সমুদ্রের বুকে সাদা ফেনার চিহ্ন রেখে জাহাজ ছুটে চলেছে।সুনীল আকাশের বিশালতার আড়াল থেকে এই সাদা দাগ,এই জাহাজকে অনুসরন করছে প্রিন্স আর্মানিয়ান শিপিং এর একটি প্রাইভেট মিনি স্যাটেলাইট।তাদের বহুদিনের স্বাদ দ্য ওল্ড আর্থ শিপিং কে পথে বসানো।নিজেদের অধিপত্তকে আরো বিস্তার করা।তাই তো এতো প্ল্যান।তবে তাদের মূল পরিকল্পনা কি তা কারো বোধগম্য নয়।বোধগম্য তো পরের বিষয় দ্য ওল্ড আর্থের মতো এতো বড় কোম্পানি-এতো এতো খোচর তাদের তবুও কারো কাছে কোন খোঁজ নেই যে তাদের বিরুদ্ধে এতো চক্রান্ত হচ্ছে।জানবেই বা কি করে তাদের পিছনে লেগেছে প্রিন্স আর্মানিয়ানের মতো কোম্পানি।কথিত আছে,তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলো ভুমধ্যসাগরের কুখ্যাত পাইরেটস দল হোয়াইট ওয়োলের সদস্য।সে জলদস্যুদের টাকায় স্থাপিত হয় আর্মানিয়ান শিপিং।যদিও বিভিন্ন প্রেস মিটিং গুলোতে এসব কথা উঠলে কখনোই স্বীকার করেনি।
প্রিন্স আর্মানিয়ানের গুপ্ত অভি্যানের ইনচার্জ লুথার রোজারিও।তার নির্দেশেই চলছে এই টীমের সকল কার্যকলাপ।কিন্তু টীমের কারো কাজেই সন্তুষ্ট না রোজারিও।মধ্যরাত থেকে তারা একটা মিনি স্যাটেলাইটের সিগন্যালের উপর কাজ করছে।
জাহাজটা যদি তাইমেনিয়ান বন্দরে ঘাটি করে তাহলে ওখানে আমাদের কর্মীরা তাদের অবস্থানের করাবে।আর এ ক্ষেত্রে তো সে আমাদের সাহায্য করবেই।তাকে সব বলা আছে।
রোজারিওয়ের কথায় সায় দিয়ে জোসেফ বললো,কিন্ত স্যার সে আমাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করবে না তো?
জোসেফ তোমাকে এখন আরো অনেক কিছু দেখার বাকি আছে।বিশ্বাসী কুকুর কখনো বিশ্বাস ঘাতকতা করে না।আর সেই কুকুরের মনিব যদি হয় গ্রেট আর্মানিয়ান শিপিং এর মতো জায়েন্ট।
রোজারিওয়ের কথায় আর কারো কোন দ্বিমত থাকলো না।
জোসেফ তুমি এক কাজ কর বন্দরে আমাদের লোকদের সাথে যোগাযোগ করো।আমার মনে হয় জাহাজের দীর্ঘ ভ্রমনের রসহীন তিক্ত জীবনে একমাত্র বন্দরের প্রস্টিটিউট দিয়েই তাদের আটকে রাখা যাবে।
প্রস্টিটিউট,কথাটি শুনেই জোসেফ আঢ় চোখে তাকায় রোজারিওর দিকে।
বোধহয় রোজারিও চোখের ভাষা পড়তে পারেন।তাই তিনি কাউকে কথার সুযোগ না দিয়ে বললেন,ওরা হচ্ছে নেড়ি কুকুর একটূ এটো পেলে ছুটে যাবে।আর কথা না বলে,তুমি ফোন দাও বন্দরে।আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
সিগারেট খাওয়ার জন্য রোজারিও মিডিয়া হলের বাইরে চলে আসলেন।
জোসেফ টেলিফোন করে তাইমেনিয়ান বন্দরের এক হোটেল ম্যানেজারের কাছে।
হ্যালো, এটা কী হোটেল ব্লু নাইট?
টেলিফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর জবাব এলো-জ্বী,কে বলছেন?
আমি জোসেফ মার্তিয়ানো,সিনিওর ইনচার্জ দ্য গ্রেট আর্মানিয়ান শিপিং কোম্পানি।
জ্বী স্যার, বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?এবার জবাব কিছুটা নত স্বরে।
আমাদের কিছু কর্মী আজ আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে!যেকোন মানুষ আমাদের নাম করে আপনাদের হোটেল ব্যবহার করতে পারে।আমার লোকেরা আপনার সামনে গিয়ে একটি কোড বলবে।।আমি কোডটি বলছি মনে রাখুন।
জ্বী স্যার কোডটি বলুন।
KH978 SIR LUCASTIANO.
ঠিক আছে স্যার,আমি কোড ব্যাতিত কাউকে আপনাদের লোক বলে গিন্য করবো না।কিন্তু স্যার তাদের কাজটা কি আমাদের সাথে গুপ্ত কিছু?
হুম,আর শূনুন আপনি এখনি কিছু প্রস্টিটিউট তৈরি রাখুন।এবং কিছু রুম খালি রাখুন।আমার লোকেরা এসে প্রস্টিটিউটদের কিছুক্ষনের জন্য নিয়ে যাবে।এবং ফিরে এসে আপনার রুম ব্যাবহার করবে।
প্রস্টিটিউটদের নাম শুনে একটু ভড়কে গেলো ম্যানেজার।সরি স্যার,আমরা তো প্রস্টিটিউটদের রুমে উঠতে দেই না।আর তাদের সাথেও আমাদের কোন যোগাযোগ নেই।
একটূ রাগী স্বরে জোসেফ বললো,ন্যাকা সাজবেন না।দুনিয়ার সকল বন্দরের খোঁজ আমরা রাখি।এবং কোন হোটেলে কি হয় তা আমাদের অজানা নয়।এক নাগারে কথা গুলো বলে একটু থামলো,জোসেফ।তারপর মৃদু স্বরে বললো,এর জন্য আপনারা এবং প্রস্টিটিউটরা মোটা অংকের ক্যাশ পাবেন।কথাটা বলেই টেলিফোনটি নামিয়ে রাখল,জোসেফ।
টেলিফোনের ওপারের হোটেল ম্যানেজার ভাবছে রাতের আঁধারে তাদের হোটেলের রমরমা ব্যবসার কথা রাঘব বোয়ালদের অজানা নয়।তবে দিনের বেলা প্রস্টিটিউটদের হোটেলে আনা হলে পুলিশি ঝামেলা একটু বাড়তে পারে।তবে গ্রেট আর্মানিয়ানের মতো কোম্পানির স্বার্থে এটা কোন ব্যাপারই না।তাই আর সাত পাঁচ না ভেবে সে তার পার্সোনাল মুঠোফোন থেকে নাম্বার ডায়েল করতে শুরু করলো।
জোসেফ কোথায়?জাহাজটা এখন কোথায়?ওর দেখার কথা ছিলো না এই ব্যাপারাটা।রাগে গজগজ করতে করতে বললো লুথার রোজারিও।
স্যার উনি মনে হয় ওয়াশরুমে গেছেন।জুবুথুবু হয়ে বললো লিসান।
এটা ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় হলো?জাহাজটা কোথায় আছে সেটা বলো,ওটা কি তাইমেনিয়ান বন্দরে ঘাটি করার কোন সম্ভাবনা আছে?
এখনো বলতে পারছি না স্যার!তবে আধ ঘন্টার মধ্যে ওটা তাইমেনিয়ান উপকূলের পাশ দিয়ে যাবে।
ঈশ্বর যেনো সদয় হয়...
***
বন্দরের এক সাধারণ খাবার হোটেলে মেষের মাংসের ঝোল দিয়ে গরম গরম ফাপা রুটি খাচ্ছে আর্থার টিউন।তার পাশে বসে খাচ্ছে আজমির ও জাহাজের অন্য কর্মীরা। সবাই দীর্ঘ জলপথ ভ্রমনের পর স্থলে আবিষ্ট হয়েছে তারা।নিরব ভক্ষন শেষে আর্থার আজমিরের দিকে তাকিয়ে বললো, গার্সিল রসদ নিয়ে ফিরেছে?
না,তবে এখনই চলে আসবে।
হুম বেশিক্ষন দেরি করা যাবে না।
জ্বী স্যার।
আজমির আর আর্থার টিউন কথা বলছে।অন্যরা নির্বিঘ্নে খেয়ে যাচ্ছে,এ ব্যাপারে তাদের কোন ভ্রক্ষেপ নেই...
***
অধ্যায়-১
ভোরের সূর্যটা ধীরে ধীরে তেজি হয়ে উঠছে।কেবিনের কাচের জানালায় ভেদ করে হালকা তীক্ষ্ণ আলো চলে গেছে বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আজমিরের মুখের উপর।আলোর কারনেই সকালের কড়া ঘুমটা ভাঙতে শুরু করেছে তার।সারারাতের ধকল থাকা সত্যেও রোজকার অভ্যাস মতো ঘুম ভাঙতে শুরু করে।
হাজার টন মেরিন ওয়েল বোঝাই রসদ নিয়ে এম.ভি শ্যাকর্ভিল জাহাজটা ছুটে চলেছে সোমালিয়ার দিকে।বিশাল প্রশান্তর বুকে চিরে।উত্তাল ভূমধ্যসাগর থেকে শান্ত প্রশান্তসাগর সব পথ চিনে বহুজাতিক জায়েন্ট দ্য ওল্ড আর্থ শিপিং কোম্পানির এই শ্যাকর্ভিল সিরিজের জাহাজ গুলো।বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আজমির এই শ্যাকর্ভিল-২১ এর জুনিয়র নাবিক।
আকাশ পরিষ্কার,কোথাও মেঘের কোন চিহ্ন নেই।রৌদ্রোজ্জল এই আকাশ দেখলে কেউ বলবে গত রাতে এই আকাশ জুড়ে ছিলো কালো মেঘ।চারদিক ছিলো ঘূর্নি বাতাস,ছিলো উত্তাল সমুদ্র।কত কষ্টই না করতে হয়েছে আর্থার টিউনকে।সহযোগী হিসেবে ছিলো আজমির।বলতে গেলে ঝড়টা গেছে আজমিরের উপর দিয়ে।সিনিয়র কিংবা প্রধান নাবিকদের অনুগত্যই তো জুনিয়রদের ধর্ম।তারউপর আছে ভয়।কারণ,এতো বড় জাহাজের জুনিয়র নাবিক হিসেবে এই প্রথম প্রশান্তর বুক চিরে যাচ্ছে তারা।তারউপর অনাকাক্ষিত ঝড়।এর আগে আজমির কাজ করেছে ভারত মহাসাগরে ছোট্ট লোকাল জাহাজ আনা নেওয়ার কাজ।শ্রীলঙ্কাকে থেকে ভারত,ভারত থেকে বাংলাদেশ।এই ছিলো তার গন্তব্য।কিন্তু ভাগ্য ফেরে শ্রীলঙ্কা থেকেই।সেখানেই পরিচয় হয় কোপার্ন ভিসুসের সাথে।শ্যাকর্ভিল জাহাজের লোকবল তদারকি করাই তার কাজ।সেইই শ্যাকর্ভিল-২১ এর জুনিয়র নাবিক হিসেবে কাজ পাইইয়ে দিয়েছিলো আজমির কে।কত শত কথা,কত শত প্যারা।ঘুষ,টেবিলের নিচেরর লেনদেন তারপর এই চাকুরি।তবে ভাগ্যটা তার সুপ্রসন্ন কিনা তা বলা মুশকিল।কারণ,চাকরি পাওয়ার পর থেকে নানাবিধ ঝামেলা লীগেয় আছে।আজ এ সমস্যা তো কাল ও সমস্যা।তার উপর প্রথম লং ট্রিপে গত রাতের ঝড়!
ক্লান্তি অবসাদ ঝেড়ে হাজার বছর পুরোনো সূর্যটার মৃদু আলো গায়ে মাখার জন্য কেবিন ছেড়ে ডেকের দিকে হাটা দেয়,আজমির।ডেক পুরো ভিজে চৌচির হয়ে গেছে।গার্সিল ডেকের এক দিকে পানিতে ভেজা পাঞ্জারির দড়ি গুছাচ্ছে।আধঘুম চোখে গার্সিলের দিকে তাকিয়ে আজমির বললো,গার্সিল দড়ি কতটুকু ভালো আছে? আর বইলেন না,সেইফটি বোটের দড়িটাই ভালো আছে।রাতে যা ধকল গেছে।এখন সোমালিয়া যাওয়ার আগে কোন বন্দর থেকে রসদ কিনার সময় দড়িও কিনতে হবে। কখন কি হয়ে যায়,আবার যদি ঝড় উঠে তাহলে বিপদে পড়তে হবে।এক নাগারে কথা গুলো বলে গেলো,গার্সিল।
হুম,তা ঠিক।তো স্যার কোথায়?তাকে জিজ্ঞাস করে দেখি সোমালিয়ার আগে কোন বন্দরে জাহাজ ভিড়াবে কিনা?
স্যার তো ঝড়ের পর অটো ক্যাপ্টেন মোডে দিয়ে নিকনের হাতের জাহাজ তুলে দিয়েছেন।তারপর পুরো এক বোতলন রেড ওয়াইন খেয়ে এখনো ঘুমাচ্ছেন।ওহহ,ঠিক আছে আমি ম্যাপ দেখছি।সামনে কোন বন্দর আছে কিনা।কাছে কোন বন্দর থাকলে স্যারকে ডাকবো।
গার্সিল আর কিছু না বলে দড়ির দিকে মনোযোগ দিলো।তাছাড়া তাকে ডেকের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা তেল পরিষ্কার করতে হবে।
আজমিরের কাধ পর্যন্ত লম্বা চুল গুলো প্রশান্তের বাতাসে দারুণ ভাবে উড়ছে।সকালের মিষ্টি বাতাসে আজ মিলির কথা খুব মনে পড়ছে তার।এই চুলগুলো মিলির অনেক পছন্দের।মিলি,এক তরুণীর নাম।যার প্রেমে সমুদ্র পারি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে আজমির।চুলগুলো যে মিলির পছন্দ এটা আজমিরের ধারণা।বাংলাদেশে থাকাকালীন একদিন মিলি আজমিরকে বলেছিলো,আপনার চুলগুলো দারুন!আহা,সেই তিন বাক্যের কথাটির কারনেই আজও প্রায় আড়াই বছর পরও আজমির প্রতি মাসের শেষ দিকে হালকা ছেটে সেই একই সাইজের করে রাখে।কিন্তু এটাও সত্য মিলির সাথে আজমিরের কোন ঘোষিত সম্পর্ক নেই।এই ভাবনাটাই পীড়া দেয়,এই ভাবনাটাই হাসায়।কিন্তু আজকের ভাবনা মন খারাপ করছে।আজমির চায় না সকালটা খারাপ করতে,তাই সে নিজের মনের বিরোদ্ধে লড়াই করতে থাকেড়ায়।দূর থেকে আজমিরকে ডেকের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিকন পাশে এসে দাঁড়ায়।
মন খারাপ ভাই?নিকন আজমিরের সমবয়সী।জাহাজে একমাত্র নিকনই আজমিরকে ভাই বলে ডাকে।অবশ্য আজমিরই তাকে এ অধিকার দিয়েছে।
না,ঠিক আছি।
সকাল সকাল আপনার মুখটা এমন বিবর্ন দেখাচ্ছে তাই বললাম।
কিছু হয়নি।নিকন তুমি এক কাজ করো,আমার জন্য হালকা সোডা দিয়ে এক বোতল হুইস্কি নিয়ে আসো।
সকাল বেলা হুইস্কি খাবেন?
হুম,যাও।
নিকন আর কিছু না বলে স্টোরেজ রুমের দিকে যেতে শুরু করে।অবশ্য তার কিছু বলারও নেই।ছয় মাস ধরে আজমিরের সাথে কাজ করছে। প্রায়ই দেখে আজমির কোন কারনেই হুট করে মন খারাপ করে বসে।
অধ্যায়-২
প্রশান্তর নীল পানির বুক চির শ্যাকর্ভিল-২১ ছুটে চলেছে সোমালিয়ার দিকে।সমুদ্রের বুকে সাদা ফেনার চিহ্ন রেখে জাহাজ ছুটে চলেছে।সুনীল আকাশের বিশালতার আড়াল থেকে এই সাদা দাগ,এই জাহাজকে অনুসরন করছে প্রিন্স আর্মানিয়ান শিপিং এর একটি প্রাইভেট মিনি স্যাটেলাইট।তাদের বহুদিনের স্বাদ দ্য ওল্ড আর্থ শিপিং কে পথে বসানো।নিজেদের অধিপত্তকে আরো বিস্তার করা।তাই তো এতো প্ল্যান।তবে তাদের মূল পরিকল্পনা কি তা কারো বোধগম্য নয়।বোধগম্য তো পরের বিষয় দ্য ওল্ড আর্থের মতো এতো বড় কোম্পানি-এতো এতো খোচর তাদের তবুও কারো কাছে কোন খোঁজ নেই যে তাদের বিরুদ্ধে এতো চক্রান্ত হচ্ছে।জানবেই বা কি করে তাদের পিছনে লেগেছে প্রিন্স আর্মানিয়ানের মতো কোম্পানি।কথিত আছে,তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলো ভুমধ্যসাগরের কুখ্যাত পাইরেটস দল হোয়াইট ওয়োলের সদস্য।সে জলদস্যুদের টাকায় স্থাপিত হয় আর্মানিয়ান শিপিং।যদিও বিভিন্ন প্রেস মিটিং গুলোতে এসব কথা উঠলে কখনোই স্বীকার করেনি।
প্রিন্স আর্মানিয়ানের গুপ্ত অভি্যানের ইনচার্জ লুথার রোজারিও।তার নির্দেশেই চলছে এই টীমের সকল কার্যকলাপ।কিন্তু টীমের কারো কাজেই সন্তুষ্ট না রোজারিও।মধ্যরাত থেকে তারা একটা মিনি স্যাটেলাইটের সিগন্যালের উপর কাজ করছে।
জাহাজটা যদি তাইমেনিয়ান বন্দরে ঘাটি করে তাহলে ওখানে আমাদের কর্মীরা তাদের অবস্থানের করাবে।আর এ ক্ষেত্রে তো সে আমাদের সাহায্য করবেই।তাকে সব বলা আছে।
রোজারিওয়ের কথায় সায় দিয়ে জোসেফ বললো,কিন্ত স্যার সে আমাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করবে না তো?
জোসেফ তোমাকে এখন আরো অনেক কিছু দেখার বাকি আছে।বিশ্বাসী কুকুর কখনো বিশ্বাস ঘাতকতা করে না।আর সেই কুকুরের মনিব যদি হয় গ্রেট আর্মানিয়ান শিপিং এর মতো জায়েন্ট।
রোজারিওয়ের কথায় আর কারো কোন দ্বিমত থাকলো না।
জোসেফ তুমি এক কাজ কর বন্দরে আমাদের লোকদের সাথে যোগাযোগ করো।আমার মনে হয় জাহাজের দীর্ঘ ভ্রমনের রসহীন তিক্ত জীবনে একমাত্র বন্দরের প্রস্টিটিউট দিয়েই তাদের আটকে রাখা যাবে।
প্রস্টিটিউট,কথাটি শুনেই জোসেফ আঢ় চোখে তাকায় রোজারিওর দিকে।
বোধহয় রোজারিও চোখের ভাষা পড়তে পারেন।তাই তিনি কাউকে কথার সুযোগ না দিয়ে বললেন,ওরা হচ্ছে নেড়ি কুকুর একটূ এটো পেলে ছুটে যাবে।আর কথা না বলে,তুমি ফোন দাও বন্দরে।আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
সিগারেট খাওয়ার জন্য রোজারিও মিডিয়া হলের বাইরে চলে আসলেন।
জোসেফ টেলিফোন করে তাইমেনিয়ান বন্দরের এক হোটেল ম্যানেজারের কাছে।
হ্যালো, এটা কী হোটেল ব্লু নাইট?
টেলিফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর জবাব এলো-জ্বী,কে বলছেন?
আমি জোসেফ মার্তিয়ানো,সিনিওর ইনচার্জ দ্য গ্রেট আর্মানিয়ান শিপিং কোম্পানি।
জ্বী স্যার, বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?এবার জবাব কিছুটা নত স্বরে।
আমাদের কিছু কর্মী আজ আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে!যেকোন মানুষ আমাদের নাম করে আপনাদের হোটেল ব্যবহার করতে পারে।আমার লোকেরা আপনার সামনে গিয়ে একটি কোড বলবে।।আমি কোডটি বলছি মনে রাখুন।
জ্বী স্যার কোডটি বলুন।
KH978 SIR LUCASTIANO.
ঠিক আছে স্যার,আমি কোড ব্যাতিত কাউকে আপনাদের লোক বলে গিন্য করবো না।কিন্তু স্যার তাদের কাজটা কি আমাদের সাথে গুপ্ত কিছু?
হুম,আর শূনুন আপনি এখনি কিছু প্রস্টিটিউট তৈরি রাখুন।এবং কিছু রুম খালি রাখুন।আমার লোকেরা এসে প্রস্টিটিউটদের কিছুক্ষনের জন্য নিয়ে যাবে।এবং ফিরে এসে আপনার রুম ব্যাবহার করবে।
প্রস্টিটিউটদের নাম শুনে একটু ভড়কে গেলো ম্যানেজার।সরি স্যার,আমরা তো প্রস্টিটিউটদের রুমে উঠতে দেই না।আর তাদের সাথেও আমাদের কোন যোগাযোগ নেই।
একটূ রাগী স্বরে জোসেফ বললো,ন্যাকা সাজবেন না।দুনিয়ার সকল বন্দরের খোঁজ আমরা রাখি।এবং কোন হোটেলে কি হয় তা আমাদের অজানা নয়।এক নাগারে কথা গুলো বলে একটু থামলো,জোসেফ।তারপর মৃদু স্বরে বললো,এর জন্য আপনারা এবং প্রস্টিটিউটরা মোটা অংকের ক্যাশ পাবেন।কথাটা বলেই টেলিফোনটি নামিয়ে রাখল,জোসেফ।
টেলিফোনের ওপারের হোটেল ম্যানেজার ভাবছে রাতের আঁধারে তাদের হোটেলের রমরমা ব্যবসার কথা রাঘব বোয়ালদের অজানা নয়।তবে দিনের বেলা প্রস্টিটিউটদের হোটেলে আনা হলে পুলিশি ঝামেলা একটু বাড়তে পারে।তবে গ্রেট আর্মানিয়ানের মতো কোম্পানির স্বার্থে এটা কোন ব্যাপারই না।তাই আর সাত পাঁচ না ভেবে সে তার পার্সোনাল মুঠোফোন থেকে নাম্বার ডায়েল করতে শুরু করলো।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ১৪/০৪/২০২২অপূর্ব লেখনী
-
জামাল উদ্দিন জীবন ০৭/১০/২০২১সুন্দর লিখনি।
-
শাহনূর ১১/০৩/২০২১এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম। অনেক কিছু জানলাম, সুন্দর সাবলীল পাঠ! অনেক অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা রইলো।
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ২৬/০২/২০২১লম্বা লেখনী। তবে সুখপাঠ্য।
-
ফয়জুল মহী ২৬/০২/২০২১অনন্য !
অধিক ভাল লাগলো!