তিনি আমাকে চিনলেন না
—এই ছেলে, শোন।
ডাক শুনে পিছনে ফিরে তাকালাম। অপরিচিত এক ভদ্রলোক। বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে হয়তো। মুখভর্তি সাদা দাড়ি, কাঁচা-পাকা চুল, শ্যামবর্ণ আর কী অপূর্ব চোখের চাহুনি, কী আবেদনময়— দেখে মায়া লাগে। ভদ্রলোকের গায়ে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী, মুখ হাস্যোজ্জ্বল।
—জী, আমাকে বলছেন?
—হ্যাঁ, কী নাম তোমার?
—আলামিন।
—বাড়ি কোথায়?
—কচুয়া।
—পি সি কলেজে পড়, না?
—হ্যাঁ।
—কোন সাবজেক্ট?
—ইসলামের ইতিহাস।
—মেসে উঠেছ?
—হ্যাঁ, শরিফা মঞ্জিল।
—তোমার বাবার নাম কী? কী করেন?
—রফিকুল ইসলাম। সোনালি ব্যাংকে চাকরি করেন।
—কচুয়ায়?
—না, মোল্লারহাট।
—ক ভাই-বোন তোমরা?
—তিন ভাই, তিন বোন।?
—বেশ, ভালো ভালো। কলেজে যাও? আচ্ছা যাও তাহলে। ও কী যেন নাম বলছিলা?
—আলামিন।
—আলামিন! আচ্ছা ঠিক আছে যাও।
ভদ্রলোককে সেদিন ভালোই লেগেছিল। এমন সদালাপী মানুষ আজকাল দেখাই যায় না। আবার মনে হলো, এতগুলো প্রশ্ন তিনি কেন করলেন? নিশ্চয়ই কারণ আছে। আজকাল স্বার্থ ছাড়া কেউ কোনো কাজ করে নাকি? পরক্ষণেই মনে হলো, এই লোকটা সম্ভবত সেই দলের নন। এমন মায়া মায়া চেহারা, কী অপূর্ব ব্যাবহার। হয়তো চাকরি থেকে সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। অফুরন্ত অবসর। কিছুতেই সময় কাটতে চায় না। তাই আমার সাথে সামান্য বাক্য বিনিময়।
পরদিনও কলেজে যাবার পথে ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলো। বাদলের চায়ের দোকানে বসে গল্প করিছিলেন দুজন লোকের সাথে। সম্ভবত আমাকে দেখে উঠে আসলেন। আমি সুন্দর করে একটা সালাম করলাম তাকে। তিনি সালামের জবাব দেবার পর বললেন, কলেজে যাও?
—হ্যাঁ।
—কী যেন নাম তোমার?
আমি নাম বললাম। বলতে হলো নয়, আসলে উত্তর করতে হলো আরো কিছু প্রশ্নের। গতকালের প্রশ্নগুলোই ছিল বেশি। লোকটার এ রকম ভুলোমন দেখে খুব হাসি পেল। ভদ্রতার খাতিরে উল্টা-পাল্টা কিছু করলাম না। শেষে আমিই একটা অর্ধেক প্রশ্ন ছুঁড়লাম তার দিকে— কাকা, আপনি সম্ভবত আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন?
—না, এই খোঁজ-খবর নিলাম আর কি।
তৃতীয় দিনও বাদলের চায়ের দোকানের সামনেই ভদ্রলোকের সাথে আবার দেখা। আবার সেই একই প্রশ্নোত্তর। লোকটার আচরণে বিরক্তবোধ করছিলাম। ভাবলাম পাগল টাইপের কিছু একটা হবে হয়তো। চতুর্থ দিনও কলেজে যাবার পথে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ঘুরে-ফিরে সেই একই বাক্য বিনিময়। বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেল। কিন্তু মানুষের সাথে অভদ্র আচরণ করার মতো ছেলে আমি সেকালে ছিলাম না।
এরপর থেকে লোকটাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতাম যথাসাধ্য। রাস্তা বদলে অন্য রাস্তায় যাতায়াত আরম্ভ করলাম। যদিও দূরত্ব বেড়ে যায় দ্বিগুন। কিন্তু লোকটার হাত থেকে নিস্তার পেলাম না। সেই অতি-পরিচিত প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাকে বারবার দিতে হলো।
ক্রমেই লোকটার সম্পর্কে আমার কৌতুহল বাড়তে লাগল। এলাকার বেশ কিছু লোকের কাছে তার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। তারা যে তথ্য দিল তাতে উপকৃত বা আশ্বস্ত কোনোটাই হতে পারলাম না। বেশির ভাগ লোকই তাকে চেনে না। ভালো করে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, এখানে তার মেয়ের বাসা আছে। অবশ্য তার মেয়েও এই এলাকায় মাস তিনেক আগে এসেছে।ভাড়া বাসায় থাকে। মেয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছেন তিনি। আমার লোকটাকে পাগল বা মানসিক রোগী মনে হলেও যারা তাকে চেনে তাদের ধারণা তিনি পাগল বা মানসিক রোগী নন। তবে মনভোলা টাইপের কিছু একটা হবেন। লোকটার হাত থেকে কীভাবে বাঁচা যায় সেই চিন্তা আমার মাথাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। অনেক ভেবে একটা বুদ্ধি বের করে শেষ পর্যন্ত তার সরকার প্রয়োগও করলাম।
পরের দিন আমাকে দেখেই লোকটা এগিয়ে আসেন। তিনি আমাকে কোনো প্রশ্ন করার আগেই আমি প্রশ্ন করলাম, কাকা কেমন আছেন?
—ভালো ...
উনি আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমি তাকে আর সুযোগ দিলাম না।
—কাকার বাসা কোথায়?
—এখানে মেয়ের বাসায় থাকি। বাসি খুলনা, দৌলতপুর।
—কাকার ছেলে-মেয়ে?
—পরে বলব। আজ একটু তাড়া আছে।
বিজয় সব সময় আনন্দের। কিন্তু এই বিজয় মনকে সামান্য সময় পুলকিত করে রাখলেও স্থায়ী প্রশান্তি দিতে পারল না। বিকেলবেলা তিনজন বন্ধুর সাথে দেখা। ওদের ঘটনাটা খুলে বললে খ্যাতির বিড়ম্বনার মতো একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। বন্ধুমহলে আমার এতদিনের পরিচিত কঞ্জুস নামটা ঘুচে যায়। সবাই আমাকে দাতা হাতেম বলে ডাকতে শুরু করল। দোষ অবশ্য আমারই। ভেবেছিলাম বিশ-বাইশ টাকার মধ্যে একটা ছোট-খাট নাস্তা করাব। কিন্তু রেস্টুরেন্টে ঢুকে বললাম, কে কি খাবি অর্ডার দে। এমন একটা কথার পর শেষ পর্যন্ত বিল যে মাত্র তিপ্পান্ন টাকা হলো, সেজন্য বন্ধুদের —ধন্যবাদ দেয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা না করে উল্টা মনে মনে ওদের গালি-গালাজ করলাম।
তারপরদিন বাদলের চায়ের দোকানে তাকে দেখে আমি নিজেই এগিয়ে যাই। সালাম বিনিময়ের পরে তাকে প্রশ্ন করতে থাকি অনবরত। অনেক প্রশ্নের উত্তর করলেন আবার কিছু এড়িয়ে গেলেন। আজ তাকেই আমার উপর বিরক্ত হতে দেখলাম। এরপর থেকে লোকটার সাথে আর দেখা নাই। বাদলের চায়ের দোকানেও দেখা যায় না। প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগল। মনে মনে ভাবলাম, যাক একটা সমস্যা থেকে তো বাঁচা গেল। কিন্তু দশ-বারোদিন যেতে না যেতে কেন জানি বারবার ঐ লোকটার কথাই আমার মনে পড়তে লাগল। কী-বা এমন দোষ ছিল লোকটার। আমাকেই মাঝে-মধ্যে একটু আধটু জ্বালাতন করতেন। তাকে পাগল ভেবে আমি যে আচরণ করেছি তা পাগলামী, নির্বুদ্ধিতা না বুদ্ধির পরিচয়— তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলাম। কি আশ্চর্য! যাকে আমি এড়িয়ে চলতে চেয়েছি, তার কথাই ঘুরে-ফিরে বারবার মনের মধ্যে নাড়াচাড়া দিতে লাগল। কোথায় গেল, কেমন আছে, এখন কী করছেন— এমন অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর জানার লোভ সামলাতে পারলাম না। চলে গেলাম সোজা ওনার মেয়ের বাসায়। দোতলা ফ্লাটের ওপরের তলায় ওনার মেয়ে-জামাই শামসুল হক থাকেন। আমি দুবার কলিংবেল চাপলাম। দরজা খুললেন এক ভদ্রলোক। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে। দারুণ সুদর্শন। অনুমান করলাম ইনিই শামসুল হক। ভদ্রলোক বিস্ময়ভরা চোখে ক্ষাণিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। তারপর বললেন, কাকে চাই?
—জী, আমি আপনার কাছেই এসেছি। আপনিই তো শামসুল হক?
—হ্যাঁ। কিন্তু...
—আমি আসলে আপনার শ্বশুরের সাথে একটু দেখা করব। বেশ কিছুদিন হলো ওনার সাথে দেখা হয় না।
—কিন্তু উনিতো তার ছেলের কাছে চলে গেছেন।
—কোথায়?
—ঢাকায়।
—ও আচ্ছা। ঠিক আছে, আসি।
—দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বললেন। ভেতরে আসলে খুশি হতাম।
—না আজ নয়, অন্য একদিন।
আমি চলে আসব এমন সময় চার-পাঁচ বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে ঘরের ভেতর থেকে দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে বলল, আংকেল, তোমার নাম কি আলামিন?
—হ্যাঁ, কিন্তু তোমাকে কে বলল?
—আমি জানি। ভেতরে আস। আম্মু তোমাকে ডাকছে।
শামসুল হক বললেন, আমার মেয়ে যেথেতু বলেছে, আপনাকে ভেতরে আসতেই হবে। নইলে দেখবেন এখনই কান্নাকাটি শুরু করবে।
—হ্যাঁ আংকেল, তুমি ভেতরে না আসলে আমি সত্যি সত্যি কান্নাকাটি শুরু করব।
অদ্ভুত মিষ্টি একটা মেয়ে। কী সুন্দর করে কথা বলে! আমি মেয়েটার সাথে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, কি নাম তোমার?
—গোলাপ।
বাহ্! ভারী সুন্দর নামতো! কে রেখেছে?
—আমি নিজে।
—তুমি?
—আব্বু রেখেছিল চামেলি। কিন্তু আমিতো চামেলি দেখি নি। তাই আমি রেখেছি গোলাপ। ভালো হয়েছে না?
—হ্যাঁ, অবশ্যই ভালো হয়েছে।
—আলামিন অর্থ বিশ্বাসী না আংকেল?
—হ্যাঁ, কিন্তু তুমি পঁচা।
আমি গোলাপের মুখের দিকে তাকালাম। মানুষ কী অদ্ভুত! এত ছোট্ট শিশু,তাও অভিমানের ভাষাটা ঠিক-ই জানে।
ইতোমধ্যে গোলাপের আম্মু সোফার ওপরে এসে বসলেন।
—দাঁড়িয়ে রইলে কেন? তুমি কিন্তু গোলাপের কথায় কিছু মনে কোরো না।
আমি সোফায় বসতে বসতে বললাম, না কিছু মনে করি নি।
—আব্বাকে তিনদিন হলো ভাইয়া নিয়ে গেছে। যাবার আগে আব্বা তোমার কথা আমাকে বলেছে। আব্বা তোমাকে খুব জ্বালিয়েছে, না?
এমন প্রশ্নের উত্তর কী হয় বা হতে পারে আমার তা জানা ছিল না। গোলাপের আম্মুর মুখের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকালাম।
—তুমি কি জানো, আব্বা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল?
এ প্রশ্নের উত্তরে আমি না-সূচক মাথা নাড়ালাম।
—আব্বার অবস্থা খারাপ দেখে ভাইয়া তাকে ঢাকায় নিয়ে গেছে চিকিৎসার জন্য।
—আবার কবে আসবেন তিনি?
—বলতে পারি না। — বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন গোলাপের আম্মু।
শামসুল হক বললেন, আব্বার খুব অসুস্থ। কী হয় আল্লাহ জানেন।
—কী হয়েছে তার?
—হার্ট এটাক করেছিলেন।
—হার্ট এটাক! চমকে উঠলাম আমি।
—হ্যাঁ, গত বছর রাজন, আমার শ্যালক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর থেকে তিনি অন্য রকম হয়ে যান। এখানে এসে কিছুদিন ভালো-ই ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কী যে হলো!
—কবে ঢাকায় নেয়া হয়েছ?
—তিন দিন হলো।
আমি শামসুল হক সাহেবের সাথে কথা বলেছিলাম, সেই ফাঁকে গোলাপের আম্মু ভেতরের ঘর থেকে ফ্রেমে বাঁধানো একটা ফটোগ্রাফ এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন, আব্বা তোমাকে এটা দিতে বলেছে। আব্বা জানত, তুমি আসবে।
আমি ফটোগ্রাফটা হাতে নিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। শামসুল হক বললেন, ওটা রাজনের ছবি, অনেকটা তোমার মতো দেখতে!
ছবিটা দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বের হয়ে আসলাম গোলাপদের বাসা থেকে। নিজেকে বারবার ধিক্কার দিতে লাগলাম। তুই এত নিষ্ঠুর! একজন বাবার বুকে ছুটি চালিয়েছিস!
সেদিন-ই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দেখাও হয়েছিল বাবার মতো সেই ভদ্রলোকের সাথে। কিন্তু তিনি আমাকে চিনলেন না। সত্যি-ই একেবারেই চিনলেন না। কারন একটিবারে জন্যও তিনি জিজ্ঞাসা করলেন না, তোমার নাম যেন কী
ডাক শুনে পিছনে ফিরে তাকালাম। অপরিচিত এক ভদ্রলোক। বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে হয়তো। মুখভর্তি সাদা দাড়ি, কাঁচা-পাকা চুল, শ্যামবর্ণ আর কী অপূর্ব চোখের চাহুনি, কী আবেদনময়— দেখে মায়া লাগে। ভদ্রলোকের গায়ে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী, মুখ হাস্যোজ্জ্বল।
—জী, আমাকে বলছেন?
—হ্যাঁ, কী নাম তোমার?
—আলামিন।
—বাড়ি কোথায়?
—কচুয়া।
—পি সি কলেজে পড়, না?
—হ্যাঁ।
—কোন সাবজেক্ট?
—ইসলামের ইতিহাস।
—মেসে উঠেছ?
—হ্যাঁ, শরিফা মঞ্জিল।
—তোমার বাবার নাম কী? কী করেন?
—রফিকুল ইসলাম। সোনালি ব্যাংকে চাকরি করেন।
—কচুয়ায়?
—না, মোল্লারহাট।
—ক ভাই-বোন তোমরা?
—তিন ভাই, তিন বোন।?
—বেশ, ভালো ভালো। কলেজে যাও? আচ্ছা যাও তাহলে। ও কী যেন নাম বলছিলা?
—আলামিন।
—আলামিন! আচ্ছা ঠিক আছে যাও।
ভদ্রলোককে সেদিন ভালোই লেগেছিল। এমন সদালাপী মানুষ আজকাল দেখাই যায় না। আবার মনে হলো, এতগুলো প্রশ্ন তিনি কেন করলেন? নিশ্চয়ই কারণ আছে। আজকাল স্বার্থ ছাড়া কেউ কোনো কাজ করে নাকি? পরক্ষণেই মনে হলো, এই লোকটা সম্ভবত সেই দলের নন। এমন মায়া মায়া চেহারা, কী অপূর্ব ব্যাবহার। হয়তো চাকরি থেকে সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। অফুরন্ত অবসর। কিছুতেই সময় কাটতে চায় না। তাই আমার সাথে সামান্য বাক্য বিনিময়।
পরদিনও কলেজে যাবার পথে ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলো। বাদলের চায়ের দোকানে বসে গল্প করিছিলেন দুজন লোকের সাথে। সম্ভবত আমাকে দেখে উঠে আসলেন। আমি সুন্দর করে একটা সালাম করলাম তাকে। তিনি সালামের জবাব দেবার পর বললেন, কলেজে যাও?
—হ্যাঁ।
—কী যেন নাম তোমার?
আমি নাম বললাম। বলতে হলো নয়, আসলে উত্তর করতে হলো আরো কিছু প্রশ্নের। গতকালের প্রশ্নগুলোই ছিল বেশি। লোকটার এ রকম ভুলোমন দেখে খুব হাসি পেল। ভদ্রতার খাতিরে উল্টা-পাল্টা কিছু করলাম না। শেষে আমিই একটা অর্ধেক প্রশ্ন ছুঁড়লাম তার দিকে— কাকা, আপনি সম্ভবত আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন?
—না, এই খোঁজ-খবর নিলাম আর কি।
তৃতীয় দিনও বাদলের চায়ের দোকানের সামনেই ভদ্রলোকের সাথে আবার দেখা। আবার সেই একই প্রশ্নোত্তর। লোকটার আচরণে বিরক্তবোধ করছিলাম। ভাবলাম পাগল টাইপের কিছু একটা হবে হয়তো। চতুর্থ দিনও কলেজে যাবার পথে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ঘুরে-ফিরে সেই একই বাক্য বিনিময়। বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেল। কিন্তু মানুষের সাথে অভদ্র আচরণ করার মতো ছেলে আমি সেকালে ছিলাম না।
এরপর থেকে লোকটাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতাম যথাসাধ্য। রাস্তা বদলে অন্য রাস্তায় যাতায়াত আরম্ভ করলাম। যদিও দূরত্ব বেড়ে যায় দ্বিগুন। কিন্তু লোকটার হাত থেকে নিস্তার পেলাম না। সেই অতি-পরিচিত প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাকে বারবার দিতে হলো।
ক্রমেই লোকটার সম্পর্কে আমার কৌতুহল বাড়তে লাগল। এলাকার বেশ কিছু লোকের কাছে তার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। তারা যে তথ্য দিল তাতে উপকৃত বা আশ্বস্ত কোনোটাই হতে পারলাম না। বেশির ভাগ লোকই তাকে চেনে না। ভালো করে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, এখানে তার মেয়ের বাসা আছে। অবশ্য তার মেয়েও এই এলাকায় মাস তিনেক আগে এসেছে।ভাড়া বাসায় থাকে। মেয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছেন তিনি। আমার লোকটাকে পাগল বা মানসিক রোগী মনে হলেও যারা তাকে চেনে তাদের ধারণা তিনি পাগল বা মানসিক রোগী নন। তবে মনভোলা টাইপের কিছু একটা হবেন। লোকটার হাত থেকে কীভাবে বাঁচা যায় সেই চিন্তা আমার মাথাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। অনেক ভেবে একটা বুদ্ধি বের করে শেষ পর্যন্ত তার সরকার প্রয়োগও করলাম।
পরের দিন আমাকে দেখেই লোকটা এগিয়ে আসেন। তিনি আমাকে কোনো প্রশ্ন করার আগেই আমি প্রশ্ন করলাম, কাকা কেমন আছেন?
—ভালো ...
উনি আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমি তাকে আর সুযোগ দিলাম না।
—কাকার বাসা কোথায়?
—এখানে মেয়ের বাসায় থাকি। বাসি খুলনা, দৌলতপুর।
—কাকার ছেলে-মেয়ে?
—পরে বলব। আজ একটু তাড়া আছে।
বিজয় সব সময় আনন্দের। কিন্তু এই বিজয় মনকে সামান্য সময় পুলকিত করে রাখলেও স্থায়ী প্রশান্তি দিতে পারল না। বিকেলবেলা তিনজন বন্ধুর সাথে দেখা। ওদের ঘটনাটা খুলে বললে খ্যাতির বিড়ম্বনার মতো একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। বন্ধুমহলে আমার এতদিনের পরিচিত কঞ্জুস নামটা ঘুচে যায়। সবাই আমাকে দাতা হাতেম বলে ডাকতে শুরু করল। দোষ অবশ্য আমারই। ভেবেছিলাম বিশ-বাইশ টাকার মধ্যে একটা ছোট-খাট নাস্তা করাব। কিন্তু রেস্টুরেন্টে ঢুকে বললাম, কে কি খাবি অর্ডার দে। এমন একটা কথার পর শেষ পর্যন্ত বিল যে মাত্র তিপ্পান্ন টাকা হলো, সেজন্য বন্ধুদের —ধন্যবাদ দেয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা না করে উল্টা মনে মনে ওদের গালি-গালাজ করলাম।
তারপরদিন বাদলের চায়ের দোকানে তাকে দেখে আমি নিজেই এগিয়ে যাই। সালাম বিনিময়ের পরে তাকে প্রশ্ন করতে থাকি অনবরত। অনেক প্রশ্নের উত্তর করলেন আবার কিছু এড়িয়ে গেলেন। আজ তাকেই আমার উপর বিরক্ত হতে দেখলাম। এরপর থেকে লোকটার সাথে আর দেখা নাই। বাদলের চায়ের দোকানেও দেখা যায় না। প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগল। মনে মনে ভাবলাম, যাক একটা সমস্যা থেকে তো বাঁচা গেল। কিন্তু দশ-বারোদিন যেতে না যেতে কেন জানি বারবার ঐ লোকটার কথাই আমার মনে পড়তে লাগল। কী-বা এমন দোষ ছিল লোকটার। আমাকেই মাঝে-মধ্যে একটু আধটু জ্বালাতন করতেন। তাকে পাগল ভেবে আমি যে আচরণ করেছি তা পাগলামী, নির্বুদ্ধিতা না বুদ্ধির পরিচয়— তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলাম। কি আশ্চর্য! যাকে আমি এড়িয়ে চলতে চেয়েছি, তার কথাই ঘুরে-ফিরে বারবার মনের মধ্যে নাড়াচাড়া দিতে লাগল। কোথায় গেল, কেমন আছে, এখন কী করছেন— এমন অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর জানার লোভ সামলাতে পারলাম না। চলে গেলাম সোজা ওনার মেয়ের বাসায়। দোতলা ফ্লাটের ওপরের তলায় ওনার মেয়ে-জামাই শামসুল হক থাকেন। আমি দুবার কলিংবেল চাপলাম। দরজা খুললেন এক ভদ্রলোক। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে। দারুণ সুদর্শন। অনুমান করলাম ইনিই শামসুল হক। ভদ্রলোক বিস্ময়ভরা চোখে ক্ষাণিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। তারপর বললেন, কাকে চাই?
—জী, আমি আপনার কাছেই এসেছি। আপনিই তো শামসুল হক?
—হ্যাঁ। কিন্তু...
—আমি আসলে আপনার শ্বশুরের সাথে একটু দেখা করব। বেশ কিছুদিন হলো ওনার সাথে দেখা হয় না।
—কিন্তু উনিতো তার ছেলের কাছে চলে গেছেন।
—কোথায়?
—ঢাকায়।
—ও আচ্ছা। ঠিক আছে, আসি।
—দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বললেন। ভেতরে আসলে খুশি হতাম।
—না আজ নয়, অন্য একদিন।
আমি চলে আসব এমন সময় চার-পাঁচ বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে ঘরের ভেতর থেকে দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে বলল, আংকেল, তোমার নাম কি আলামিন?
—হ্যাঁ, কিন্তু তোমাকে কে বলল?
—আমি জানি। ভেতরে আস। আম্মু তোমাকে ডাকছে।
শামসুল হক বললেন, আমার মেয়ে যেথেতু বলেছে, আপনাকে ভেতরে আসতেই হবে। নইলে দেখবেন এখনই কান্নাকাটি শুরু করবে।
—হ্যাঁ আংকেল, তুমি ভেতরে না আসলে আমি সত্যি সত্যি কান্নাকাটি শুরু করব।
অদ্ভুত মিষ্টি একটা মেয়ে। কী সুন্দর করে কথা বলে! আমি মেয়েটার সাথে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, কি নাম তোমার?
—গোলাপ।
বাহ্! ভারী সুন্দর নামতো! কে রেখেছে?
—আমি নিজে।
—তুমি?
—আব্বু রেখেছিল চামেলি। কিন্তু আমিতো চামেলি দেখি নি। তাই আমি রেখেছি গোলাপ। ভালো হয়েছে না?
—হ্যাঁ, অবশ্যই ভালো হয়েছে।
—আলামিন অর্থ বিশ্বাসী না আংকেল?
—হ্যাঁ, কিন্তু তুমি পঁচা।
আমি গোলাপের মুখের দিকে তাকালাম। মানুষ কী অদ্ভুত! এত ছোট্ট শিশু,তাও অভিমানের ভাষাটা ঠিক-ই জানে।
ইতোমধ্যে গোলাপের আম্মু সোফার ওপরে এসে বসলেন।
—দাঁড়িয়ে রইলে কেন? তুমি কিন্তু গোলাপের কথায় কিছু মনে কোরো না।
আমি সোফায় বসতে বসতে বললাম, না কিছু মনে করি নি।
—আব্বাকে তিনদিন হলো ভাইয়া নিয়ে গেছে। যাবার আগে আব্বা তোমার কথা আমাকে বলেছে। আব্বা তোমাকে খুব জ্বালিয়েছে, না?
এমন প্রশ্নের উত্তর কী হয় বা হতে পারে আমার তা জানা ছিল না। গোলাপের আম্মুর মুখের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকালাম।
—তুমি কি জানো, আব্বা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল?
এ প্রশ্নের উত্তরে আমি না-সূচক মাথা নাড়ালাম।
—আব্বার অবস্থা খারাপ দেখে ভাইয়া তাকে ঢাকায় নিয়ে গেছে চিকিৎসার জন্য।
—আবার কবে আসবেন তিনি?
—বলতে পারি না। — বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন গোলাপের আম্মু।
শামসুল হক বললেন, আব্বার খুব অসুস্থ। কী হয় আল্লাহ জানেন।
—কী হয়েছে তার?
—হার্ট এটাক করেছিলেন।
—হার্ট এটাক! চমকে উঠলাম আমি।
—হ্যাঁ, গত বছর রাজন, আমার শ্যালক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর থেকে তিনি অন্য রকম হয়ে যান। এখানে এসে কিছুদিন ভালো-ই ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কী যে হলো!
—কবে ঢাকায় নেয়া হয়েছ?
—তিন দিন হলো।
আমি শামসুল হক সাহেবের সাথে কথা বলেছিলাম, সেই ফাঁকে গোলাপের আম্মু ভেতরের ঘর থেকে ফ্রেমে বাঁধানো একটা ফটোগ্রাফ এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন, আব্বা তোমাকে এটা দিতে বলেছে। আব্বা জানত, তুমি আসবে।
আমি ফটোগ্রাফটা হাতে নিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। শামসুল হক বললেন, ওটা রাজনের ছবি, অনেকটা তোমার মতো দেখতে!
ছবিটা দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বের হয়ে আসলাম গোলাপদের বাসা থেকে। নিজেকে বারবার ধিক্কার দিতে লাগলাম। তুই এত নিষ্ঠুর! একজন বাবার বুকে ছুটি চালিয়েছিস!
সেদিন-ই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দেখাও হয়েছিল বাবার মতো সেই ভদ্রলোকের সাথে। কিন্তু তিনি আমাকে চিনলেন না। সত্যি-ই একেবারেই চিনলেন না। কারন একটিবারে জন্যও তিনি জিজ্ঞাসা করলেন না, তোমার নাম যেন কী
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
রুখসানা কাজল ২৩/০৭/২০১৪
-
রফছান খাঁন ১৮/০৭/২০১৪ভিতরটায় একটু বিরক্ত হয়েছিলাম কিন্তু শেষটা মুছে দিয়েছে ।
-
কবি মোঃ ইকবাল ১৮/০৭/২০১৪পড়লাম গল্পটি। ভালো লাগলো।
ভাল লাগল।