তোমায় নিয়েই গল্প হোক
এখন সময়টা এরকমই। সকাল সকালে সবিতা এসে ছুঁয়ে যায় ঘুম কাতুরে বনানীর উঁচু ডাল, দেওয়াল ঘেসে ওঠা সুপারির ডগা, ছাদের কার্নিশের লাগোয়া এন্টেনা।খানিক পরেই টিয়াঠুটি আমের গা চুঁইয়ে রোদ এসে পড়ে বারান্দায়। দুপুরে ভানুর মার্তন্ড নৃত্য বর্ণনাতীত, বাঙালি তাই সম্ভবত এসি ও কুলার মুখী। বিকেল গড়িয়ে গোধূলি আসে। পড়শী দালানের ছায়ারা দীর্ঘতর ও ঘনিষ্ঠ হয়। যেন কতকালের পুরোনো কথা জমে আছে। এখনই সব ফিশ ফিশ...কথা ফুরোয় না। এ সময়টা বড় প্রিয় চন্দ্রার। দোতালার ছোট ছাদটা যেন তার পৃথিবী। নীচে অবাক পৃথিবীর অস্পষ্ট কোলাহল, দিকচক্রবালে অবাচী মেঘের রাতুল উর্মিমালা । নির্মোহ হাওয়া কি নিরপেক্ষ- কোথাও কোনো মিথ্যে মিশে নেই। মন গুন গুনিয়ে ওঠে- "ও গানওলা আরেকটা গান গাও/ আমার আর কিচ্ছু করার নেই/ কোথাও যাবার নেই"।
আজকের সন্ধ্যাটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। হওয়া অফিসের খবর আগে ছিলই। বিকেল থেকেই একেবারে সেই "আকাশ কটাহে ধুম্র মেঘের ঘটা"। দিগন্তে যেখানে উঁচু বহুতল গুলোর মাঝে মাঝে বিটপীরা উর্ধবাহু ছায়াঘন, সেখানের সজল নীল নবঘন যেন কোনো ষোড়শীর মত চুম্বনরত। বাতাস যেন পাগলপারা। বৃষ্টির ছাট একরকম আগন্তুক অতিথির মতো খোলা জানালা দিয়ে খাটের অর্ধেকটা ভিজিয়ে ফেলেছে। হুশ হতেই কাঁচের জানলাটা টেনে বন্ধ করে দেয় চন্দ্রা। এই বর্ষণ মন্দ্রিত অন্ধকার, এই ব্যাকুল করা ধারাবারি পতনের শব্দ, থেকে থেকে চমকে দেওয়া বুক কাঁপানো জিমুতনাদ, এই নির্মোহ আকাশসলিলে নিজেকে মিশিয়ে দিতে কে না চায়। ভাবনারা সব এলোমেলো হয়ে যায়, মন কেমন আনচান করে ওঠে। কাঁচের সার্শিতে জোলো বাতাসের ঝাপটা, ঠান্ডা বাতাসের শিরশিরানি- একটা চাদর টেনে নেয় চন্দ্রা। হঠাৎই মনের তন্ত্রীতে বাজে গৌরীপ্রসন্ন-
" মনে পড়ে যায় সেই প্রথম দেখার স্মৃতি/
মনে পড়ে যায় সেই হৃদয় দেবার তিথি"।
কেন এমন হয়? কেন , কেন...হঠাৎ করে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় মনের মাটির কুঁড়ে, দাওয়া, নিকোনো উঠোন, গাছপালা সব, সঅঅব....।
ফ্ল্যাশ ব্যাক- বছর চারেক আগে। কোনো এক শীত সন্ধ্যায় ভীষন ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটাকে টানতে টানতে কোনো রকম ঘর অবধি এনে সোফায় এলিয়ে দিয়েছিল চন্দ্রা। তখন অবসাদে ঘটনা টা অতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ওভাবেই কতক্ষন ছিল সে জানে না। ঘুম যখন ভাঙলো তখন সে শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে।
জানলার বাইরে আবছা কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীত সকাল। গায়ের কম্বলটা আলতো সরিয়ে উঠে বসতেই এক বৃদ্ধা সাবধানী ভঙ্গিতে মৃদু নিষেধাজ্ঞা জানায়-" ওভাবে উঠবে না গো দিদিমণি। হাতে চ্যানেল করা আছে। কম্বলের ঘষা লেগে খুলে যেতি পারে। ব্যাথা পেতি পারেন। ব্যাপারে কাল সারারাত কি জমে মানুষে টানা টানি। যখন যা লাগবে আমাকে বলবেন। আপনার তো সারারাত জ্বর। " বোঝা গেল এ মুহূর্তে সে আরোগ্যালয়ে, এবং ইনি হলেন তার সর্বক্ষণের সেবিকা তথা আয়া মাসী। চোখের চাহনি কিছুর অনুসন্ধানে, বুঝতে পেরেই সে এগিয়ে দিল মোবাইল। " এই নিন। রাতে দাদাবাবু দিয়ে গেছেন। এইসব এখানে চলে না। আর আপনার বেশি কথা বলায় বারণ" । এই বলেই সে পাশের সহকর্মীর দিকে উদ্বেগ পূর্ণ আগ্রহ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেয়- "জানো তো দিদি ওই পাশের 13 নম্বর বেডের পেশেন্ট টা না কাল রাতে....."। চন্দ্রা আর ওইসব কথা শুনতে পায় না। মুঠোফোনা দৃষ্টি তার স্থির। 12 টা মিসকল। একটা মেসেজ। অফিস থেকে দেবা, অর্থাৎ দেবারতি। ওর কাছেই মনের সব কথা উজাড় করেছে এতদিন। রিফ্লেক্সেই আঙ্গুল চলে যায় ডায়াল বাটন এ। ওপর থেকে ভেসে আসে- " কিরে কেমন আছিস, কতবার ট্রাই করেছি। ঘুমাচ্ছিলিস নাকি। যা গেছে না কাল রাত টা। ওফ ফ! থ্যাংক গড।" ও বরাবরই একটু ঈশ্বর বিশ্বাসী। অনেক প্রসাদী সন্দেশ ভক্ষণ ও মন্দির দর্শন হয়েছে ওর কল্যানে। তবে ওর কথা অনর্গল। এটুকুই যা....। আবার অধৈয্য প্রশ্ন আসে, " কিরে, কথা বলছিস না কেন। আমি যাচ্ছি তোর ওখানে , বেরিয়ে পড়েছি, "। চন্দ্রা উত্তর দেয়- " না, মানে আমি ঠিক আছি, জ্বর আছে সামান্য, ঠিক আছে তুই আয়।" মেসেজটা কার দেখার দরকার। দেবা খবর পেলো কি করে? চন্দ্রা কল টা কাটতে যাবে, এমন সময়-" শোন না একটা কথা।" দেবা বলে চলে -" কাল তখন অনেক রাত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও গোছগাছ করে শুতে যাবো, এমন সময় অবনীশ এর ফোনটা এলো। তারপর, তারপর শুনবি? গেস কর, আহা কর না।" ভনিতা ভালো লাগছিলো না চন্দ্রার। দেবা বরাবরই এরকম। বড্ড সাসপেন্স রাখে। অন্তিমে সব কথা চিরকাল অশ্বডিম্ব প্রসব করে। তারপর চন্দ্রা সুধায়, বল। দেবা-" আরে তোর হাতিমি, অবনীশ- যাকে তুই একই সাথে হাতি ও তিমি রূপে আবিষ্কার করেছিলি, সেই গলুমলু অবনীশ, সে কি কান্না কি কান্না। কোনো পুরুষ মানুষ যে ঐভাবে কাঁদতে পারে, জাস্ট ভাবা যায়না রে। লোকটা তোকে ভীষণ ভালোবাসে রে। হি লাভস ইউ এ লট। তোর সব ধারণা ভুল। কাল রাতে আমি অন্য অবনীশ কে দেখেছি রে। সরি, শুনেছি। হাউ লাকি
ইউ আর, মাই ডিয়ার।আরে, শোন না এসব কথা আবার ওকে বলিস না যেন। জানিস ও রাতে বাড়ি যায় নি। এখনো ওপিডি বা তার আশেপাশে কোথাও আছে বোধহয়। খাওয়া জোটেনি, বাবু সিগারেট ফুঁকছেন হয়তো। দেখি ফোন করে। তুই যেন...."। আর শুনতে পাচ্ছে না চন্দ্রা। দুচোখে ধারাপাত প্লাবিত করেছে তার মেয়েলি মন, এক নারী থেকে স্ত্রী হয়ে ওঠা মন, তার সত্ত্বা। এক দোমড়ানো মোচড়ানো যন্ত্রনা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। বুকের ভিড় থেকে দল পাকানো কষ্টটা উঠে আটকে আছে গলার কাছটাতে। ডুকরে উঠে আসছে কান্নার রোল। দু হাত দিয়ে খিমছে ধরেছে বিছানার চাদর। এ যে কি অব্যক্ত যন্ত্রনা...। একটাই মেসেজ। মেসেজটা খুলে সে নিজেকে আর সামলাতে পারল না।চেপে রাখা যন্ত্রনা সশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। ইনবক্স প্লাবিত দুটি শব্দবন্ধে-"ভালো আছো?", 💐💐তোমার অবনীশ।
"এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শুন্য মন্দির মোর।।"....বিদ্যাপতি।
আজকের সন্ধ্যাটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। হওয়া অফিসের খবর আগে ছিলই। বিকেল থেকেই একেবারে সেই "আকাশ কটাহে ধুম্র মেঘের ঘটা"। দিগন্তে যেখানে উঁচু বহুতল গুলোর মাঝে মাঝে বিটপীরা উর্ধবাহু ছায়াঘন, সেখানের সজল নীল নবঘন যেন কোনো ষোড়শীর মত চুম্বনরত। বাতাস যেন পাগলপারা। বৃষ্টির ছাট একরকম আগন্তুক অতিথির মতো খোলা জানালা দিয়ে খাটের অর্ধেকটা ভিজিয়ে ফেলেছে। হুশ হতেই কাঁচের জানলাটা টেনে বন্ধ করে দেয় চন্দ্রা। এই বর্ষণ মন্দ্রিত অন্ধকার, এই ব্যাকুল করা ধারাবারি পতনের শব্দ, থেকে থেকে চমকে দেওয়া বুক কাঁপানো জিমুতনাদ, এই নির্মোহ আকাশসলিলে নিজেকে মিশিয়ে দিতে কে না চায়। ভাবনারা সব এলোমেলো হয়ে যায়, মন কেমন আনচান করে ওঠে। কাঁচের সার্শিতে জোলো বাতাসের ঝাপটা, ঠান্ডা বাতাসের শিরশিরানি- একটা চাদর টেনে নেয় চন্দ্রা। হঠাৎই মনের তন্ত্রীতে বাজে গৌরীপ্রসন্ন-
" মনে পড়ে যায় সেই প্রথম দেখার স্মৃতি/
মনে পড়ে যায় সেই হৃদয় দেবার তিথি"।
কেন এমন হয়? কেন , কেন...হঠাৎ করে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় মনের মাটির কুঁড়ে, দাওয়া, নিকোনো উঠোন, গাছপালা সব, সঅঅব....।
ফ্ল্যাশ ব্যাক- বছর চারেক আগে। কোনো এক শীত সন্ধ্যায় ভীষন ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটাকে টানতে টানতে কোনো রকম ঘর অবধি এনে সোফায় এলিয়ে দিয়েছিল চন্দ্রা। তখন অবসাদে ঘটনা টা অতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ওভাবেই কতক্ষন ছিল সে জানে না। ঘুম যখন ভাঙলো তখন সে শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে।
জানলার বাইরে আবছা কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীত সকাল। গায়ের কম্বলটা আলতো সরিয়ে উঠে বসতেই এক বৃদ্ধা সাবধানী ভঙ্গিতে মৃদু নিষেধাজ্ঞা জানায়-" ওভাবে উঠবে না গো দিদিমণি। হাতে চ্যানেল করা আছে। কম্বলের ঘষা লেগে খুলে যেতি পারে। ব্যাথা পেতি পারেন। ব্যাপারে কাল সারারাত কি জমে মানুষে টানা টানি। যখন যা লাগবে আমাকে বলবেন। আপনার তো সারারাত জ্বর। " বোঝা গেল এ মুহূর্তে সে আরোগ্যালয়ে, এবং ইনি হলেন তার সর্বক্ষণের সেবিকা তথা আয়া মাসী। চোখের চাহনি কিছুর অনুসন্ধানে, বুঝতে পেরেই সে এগিয়ে দিল মোবাইল। " এই নিন। রাতে দাদাবাবু দিয়ে গেছেন। এইসব এখানে চলে না। আর আপনার বেশি কথা বলায় বারণ" । এই বলেই সে পাশের সহকর্মীর দিকে উদ্বেগ পূর্ণ আগ্রহ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেয়- "জানো তো দিদি ওই পাশের 13 নম্বর বেডের পেশেন্ট টা না কাল রাতে....."। চন্দ্রা আর ওইসব কথা শুনতে পায় না। মুঠোফোনা দৃষ্টি তার স্থির। 12 টা মিসকল। একটা মেসেজ। অফিস থেকে দেবা, অর্থাৎ দেবারতি। ওর কাছেই মনের সব কথা উজাড় করেছে এতদিন। রিফ্লেক্সেই আঙ্গুল চলে যায় ডায়াল বাটন এ। ওপর থেকে ভেসে আসে- " কিরে কেমন আছিস, কতবার ট্রাই করেছি। ঘুমাচ্ছিলিস নাকি। যা গেছে না কাল রাত টা। ওফ ফ! থ্যাংক গড।" ও বরাবরই একটু ঈশ্বর বিশ্বাসী। অনেক প্রসাদী সন্দেশ ভক্ষণ ও মন্দির দর্শন হয়েছে ওর কল্যানে। তবে ওর কথা অনর্গল। এটুকুই যা....। আবার অধৈয্য প্রশ্ন আসে, " কিরে, কথা বলছিস না কেন। আমি যাচ্ছি তোর ওখানে , বেরিয়ে পড়েছি, "। চন্দ্রা উত্তর দেয়- " না, মানে আমি ঠিক আছি, জ্বর আছে সামান্য, ঠিক আছে তুই আয়।" মেসেজটা কার দেখার দরকার। দেবা খবর পেলো কি করে? চন্দ্রা কল টা কাটতে যাবে, এমন সময়-" শোন না একটা কথা।" দেবা বলে চলে -" কাল তখন অনেক রাত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও গোছগাছ করে শুতে যাবো, এমন সময় অবনীশ এর ফোনটা এলো। তারপর, তারপর শুনবি? গেস কর, আহা কর না।" ভনিতা ভালো লাগছিলো না চন্দ্রার। দেবা বরাবরই এরকম। বড্ড সাসপেন্স রাখে। অন্তিমে সব কথা চিরকাল অশ্বডিম্ব প্রসব করে। তারপর চন্দ্রা সুধায়, বল। দেবা-" আরে তোর হাতিমি, অবনীশ- যাকে তুই একই সাথে হাতি ও তিমি রূপে আবিষ্কার করেছিলি, সেই গলুমলু অবনীশ, সে কি কান্না কি কান্না। কোনো পুরুষ মানুষ যে ঐভাবে কাঁদতে পারে, জাস্ট ভাবা যায়না রে। লোকটা তোকে ভীষণ ভালোবাসে রে। হি লাভস ইউ এ লট। তোর সব ধারণা ভুল। কাল রাতে আমি অন্য অবনীশ কে দেখেছি রে। সরি, শুনেছি। হাউ লাকি
ইউ আর, মাই ডিয়ার।আরে, শোন না এসব কথা আবার ওকে বলিস না যেন। জানিস ও রাতে বাড়ি যায় নি। এখনো ওপিডি বা তার আশেপাশে কোথাও আছে বোধহয়। খাওয়া জোটেনি, বাবু সিগারেট ফুঁকছেন হয়তো। দেখি ফোন করে। তুই যেন...."। আর শুনতে পাচ্ছে না চন্দ্রা। দুচোখে ধারাপাত প্লাবিত করেছে তার মেয়েলি মন, এক নারী থেকে স্ত্রী হয়ে ওঠা মন, তার সত্ত্বা। এক দোমড়ানো মোচড়ানো যন্ত্রনা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। বুকের ভিড় থেকে দল পাকানো কষ্টটা উঠে আটকে আছে গলার কাছটাতে। ডুকরে উঠে আসছে কান্নার রোল। দু হাত দিয়ে খিমছে ধরেছে বিছানার চাদর। এ যে কি অব্যক্ত যন্ত্রনা...। একটাই মেসেজ। মেসেজটা খুলে সে নিজেকে আর সামলাতে পারল না।চেপে রাখা যন্ত্রনা সশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। ইনবক্স প্লাবিত দুটি শব্দবন্ধে-"ভালো আছো?", 💐💐তোমার অবনীশ।
"এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শুন্য মন্দির মোর।।"....বিদ্যাপতি।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।