www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আন্দামান থেকে বলছি-- তৃতীয় পর্ব

২০ শে সেপ্টেম্বর ২০০১ থেকে ১৭ অগাস্ট ২০০৬ পর্যন্ত মধ্য-উত্তর আন্দামান ছিল আমার সরকারি চাকরির নিযুক্তি। এই পাঁচ বছর সময়কালে দুটি উচ্চতর মাধ্যমিক,চারটি উচ্চ মাধ্যমিক ও দুটি মাধ্যমিক স্কুলে আমার পোস্টিং হয়েছিল। এর মধ্যে চারটির কথা উল্লেখযোগ্য,মায়াবন্দর আদর্শ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় যার অন্যতম। এই স্কুলে হিন্দি,ইংরাজি,তামিল ও তেলেগু— মোট চারটি ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলার ঠাঁই নেই সেখানে; যদিও বহু বাঙালির বাস পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে।
এরপর দুর্গম পাহাড়ি এলাকাস্থিত চৈনপুর (যেখানে ১০০ ভাগ বাঙালির বাস) উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দেখলাম পুরোটাই হিন্দি মাধ্যম। কোনও একসময় এই স্কুলটির প্রারম্ভিক বিদ্যাশিক্ষা বাংলাতেই ছিল। প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ’র কুটকৌশলে বাংলা মাধ্যমের অকালমৃত্যু ঘটে।
চৈনপুরের দিকে যাওয়ার আনুমানিক ১০ কিলোমিটার আগে ‘মাধ্যমিক স্কুল’ টুগাপুর ৮’। এই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যম, তারপরে হিন্দি মাধ্যম। আহা বিস্ময়ে মরি-মরি! আবার অতি দুর্গম বনাঞ্চল, মোহনপুর, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের পাশে দেখি বাঁশের বেড়া ও পাতায় ছাওয়া একটা ভাঙা-চোরা ঘরের মধ্যে ছোট বাচ্চাদের লেখাপড়া চলছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম,ওটা নাকি বাংলা মাধ্যম প্রাধমিক বিভাগ (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত)। নিজের চোখে দেখতে হ’ল, পাঠশালার নামে বাঙালি শিশুদের ‘পাঠ-বন্দীশালা’। এই বন্দীশালা থেকে শিশুরা কবে যে মুক্তি পাবে,তা’ তাদের অদৃষ্টও বোধ হয় জানে না। মজার কথা হ’ল, ওই একই স্কুলে হিন্দি মাধ্যম শাখায় প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিশেষভাবে নির্মিত পরিচ্ছন্ন শ্রেণিকক্ষে,স্বচ্ছ আলোবাতাসের মধ্যে রমরমিয়ে চলছে লেখাপড়া।.....
সরকারি নির্দেশ ব’লে কথা! ট্রান্সফার অর্ডার। ১৭ইঅগাস্ট,২০০৮ মধ্য-উত্তর আন্দামান থেকে বিদায়, স্থানান্তর ফেরারগঞ্জ,আদর্শ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দ: আন্দামানে। এখানেও দেখি সেই একই চিত্র,তবে আর এক রূপে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার পরে,একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তে হবে হিন্দি মাধ্যমে। ওই একই স্কুলে আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা আছে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত; তবে তার শিক্ষা-মাধ্যম অবধারিতভাবে ‘হিন্দি’। এই মহান আদর্শ’র ফাঁদে প’ড়ে কালক্রমে কত বঙ্গসন্তানকেই যে একটু একটু ক’রে ‘অবাঙালি’ হয়ে যেতে হচ্ছে, তা’ তাদের অনেকেই জানে না। মনে পড়ে খরাজ মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই গানটি—‘হায় বাঙালি হায়! তুই আর বাঙালি নাই। তোর চলন-বলন কথার ধরণ...’
গান প্রসঙ্গে দেশাত্মবোধক একটা হিন্দি গানের কথা মনে প’ড়ে গেল:- ‘দুনিয়া কে রঙ্গ সহনা,আউর কুছ না মুহ সে কহনা’। ভাবার্থ খানিকটা এরকম— দুনিয়ার রঙ্গ-তামাশা সহ্য ক’রে যাও,আর মুখে রা’টি কেড়ো না’। এই অদ্ভুত উপদেশটি কে, কিভাবে নেবেন জানি না, তবে আন্দামান-নিকোবর প্রশাসনের, ‘বাংলা’র প্রতি যে ইচ্ছাকৃত উদাসীনতা বা বিমাতৃসুলভ মনোভাব আছে,একথা অনস্বীকার্য।
এসব ঘটনা ছাড়াও যখন দেখি বাংলা মাধ্যমে পাঠরত শিক্ষার্থীদের গণিত,বিজ্ঞান,ইতিহাস,ভূগোল ইত্যাদি গুরূত্বপূর্ণ বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকগুলো ইংরাজি ও হিন্দি ভাষায় মুদ্রিত,তখন বড় বিস্ময় জাগে মনে! কী বিচিত্র এই শিক্ষাব্যবস্থা!
আরও এক অদ্ভূত বিষয়ের কথা ব’লে আজকের পর্ব শেষ করব। পূর্বোক্ত স্কুলগুলিতে আমার কাজ ছিল,স্কুল-শুরুতে প্রার্থনাসহ শপথ-গ্রহণ করানো,নীতিকথা,সাধারণ জ্ঞান ও সবাই মিলে জাতীয় সঙ্গীত (সব মিলিয়ে, এখানে যাকে বলে ‘মর্ণিং অ্যাসেম্বলি’) গাওয়া। তা’ প্রার্থনা ইত্যাদি তো যেমন-তেমন, জাতীয় সঙ্গীতের ভাষা ও বিকৃত/অশ্রাব্য উচ্চারণ-ধ্বণি শুনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে হ’ল। এখানকার বেশিরভাগ স্কুলে জাতীয় সঙ্গীতের উচ্চারণ নমুনা:- ‘চানা-কানা-মানা-আদিনায়াকা-চায়াহে-বারাতা-বাগ্যাবিদাদা...দ্রাবিড়া-উতকালা বাঙ্গা’...ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এই বিকৃত উচ্চারণ আর কিছু নয়, হিন্দি-তামিল সংস্কৃতির মিশ্রণ-প্রভাবজাত।
জাতীয় সঙ্গীত আমাদের জাতীয় সম্পদ। তাই,এর মর্যাদা রক্ষা করা প্রতিটি ভারতবাসীর নৈতিক দায়িত্ব। এই গুরুদায়িত্ব বহন করতে গিয়ে আমি যখন বলি— ‘জাতীয় সঙ্গীতের ভাষাটি তো ভাই বিশুদ্ধ বাংলায়,তাই বাংলায় তা শুদ্ধ উচ্চারণই কাঙ্খিত’। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমার শিক্ষকজীবনে,শিক্ষার্থীদের জাতীয় সঙ্গীত শেখাতে গিয়ে দেখেছি, সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে হিন্দিভাষী শিক্ষক-শিক্ষকাদের জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে অজ্ঞতা। তাঁদের ধারণা, ‘রাষ্ট্রগান’-গানের ভাষা হিন্দি, তাই সেই ভাষায় উচ্চারণরীতিই প্রযুক্ত হবে। আর ভ্রান্ত-ধারণাজাত এই বিকৃত ট্রাডিশন আন্দামানে আজও সমানে চলেছে।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১১১৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৫/১১/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • অনিরুদ্ধ বুলবুল ১৫/১১/২০১৪
    প্রশাসন যেন মধ্যযুগেই বাস করছেন!
    বাংলার প্রতি অবজ্ঞাই এর একমাত্র কারণ।
    সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ।

    শুভেচ্ছা নিন।
    • রইসউদ্দিন গায়েন ১৫/১১/২০১৪
      প্রিয় পাঠক-লেখকবন্ধু অনিরুদ্ধ বুলবুল,
      প্রশাসনের বিরুদ্ধে আপনার কঠোর সমালোচনার জন্য ধন্যবাদ! সত্যিই এটা মধ্যযুগীয় মুর্খতা। কিন্তু পাশাপাশি আমি এ কথাও বলব যে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অন্যদের অজ্ঞতা বা ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞা-ই তার অন্যতম কারণ। আর অপ্রিয় হলেও সত্য এই-- হিন্দি ভাষার প্রতি অন্ধ-ভক্তি, চাটুকারিতা বা অন্ধ সমর্থন এবং রাষ্ট্রভাষা ব'লে অপ-প্রচার চালিয়ে বাংলা ভাষাকে নির্মূল করতে চাইছে।
 
Quantcast