মাতৃপরিচয়
নদীর দুধারের চমৎকার দৃশ্যাবলি আনিস কে স্পর্শ করছে না।অন্য সময় হলে হয়তো খুব মুগ্ধ হত আনিস।মুগ্ধ হবার চমৎকার একটা ক্ষমতা আছে ওর মধ্যে।কোন কিছুর ভিতরকার সৌন্দর্য বের করে নিয়ে আসতে পারে ও।সব কিছুর মধ্যেই সৌন্দর্য খোজে।প্রকৃতি তাকে মুগ্ধ করে।
কিন্তু আজ...
আজ কোন কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করছে না।লঞ্চটা নদীর মাঝ দিয়ে ঢেউ কেটে চলে যাচ্ছে।বরিশাল গামি বিশাল লঞ্চ টার ছাদে বসে আছে আনিস।লঞ্চের চলার পথে বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি হচ্ছে।ঢেউ গুলো বড় হতে হতে একসময় নদী তীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।চমৎকার দেখতে লাগে সেটা।দুপাশে সবুজ গ্রাম,নদীতে নৌকা।
রানী মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল এসব।আনিসের দিকে তাকালো ও।মন খারাপ করে বসে আছে।নিশ্চই অনেক কষ্ট পাচ্ছে।আনিসের কাঁধে হাত রাখলো রানী।বলল,
"কি হল মন খারাপ?"
"মন ভাল রাখি কি করে বল?যতক্ষন না জানতে পারছি..."কথা শেষ না করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আনিস।রানী আবার বলে।
"দেখ চারপাশ টা কি সুন্দর।"
আনিস উঠে দাড়ায়।রানীর দিকে তাকিয়ে বলে,
"আচ্ছা রানী বাবার সব কথা যদি সত্য হয় তাহলে কি তুমি আমাকে ঘৃণা করবে?"
রানী কাছে এগিয়ে এসে আনিস কে জড়িয়ে ধরে।বলে,
"কক্ষনো না।আমি তোমাকে ঘৃণা করব কেন?আমি তোমার স্ত্রী,তোমার প্রেমিকা।"
"আমার খুব ভয় হচ্ছে রানী।মনে হচ্ছে বাবার সব কথা যেন মিথ্যা হয়।আচ্ছা বাবার কি দরকার ছিল এসব কথা বলার?"
"উনি তোমাকে সব কিছু খুলে বলতে না পেরে অপরাধবোধে ভুগছিলেন।তাই শেষ পর্যন্ত সব জানিয়েছেন।
আনিস চারপাশে তাকিয়ে দেখল।সত্যিই কত সুন্দর!
####
গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে বিকেল হয়ে গেল।লোকজন কে জিজ্ঞেস করে বাবার নির্দেশনা মত অনেক কষ্টে সেই বাড়িটা খুজে পাওয়া গেল।
বাড়ির সামনে কতগুলো বাচ্চা খেলা করছিল।আনিস ওদের কে বলল,
"বাড়ির ভিতর থেকে কাউকে ডেকে দিবে?বলবে ঢাকা থেকে এসেছে।"
একটা মেয়ে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে গেল।কিছুক্ষন পর একজন বৃদ্ধা মহিলা বাইরে এলেন।বয়স সত্তর হবে।বাইরে এসে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন শহুরে আগন্তুক দের দিকে।
আনিসের বুকটা কেঁপে উঠলো।এই কি সেই মহিলা,যার খোঁজে এতদূর এসেছে সে?
আনিস জিজ্ঞেস করে,"আপনি কি রাবেয়া খাতুন?"
আনিসের কথা শুনে বৃদ্ধা কেঁপে উঠলেন।বললেন,
"না আমি না।কিন্তু আপনারা কেডা?ক্যান আইছেন?"
"আমরা ওনার কাছে এসেছি।উনি কি আছেন?"
"না,ও নাই"
"উনি আপনার কে হয়?"
"আমার বুইন।আমার কত আদরের বুইন",ডুকরে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা।
রানী গিয়ে মহিলাকে জড়িয়ে ধরে।বারান্দায় একটা মাদুর বিছানো।সেখানে গিয়ে বসল ওরা।রানী বলল,
"আমরা ওনার কথা জানতে এসেছি।ঢাকা থেকে এসেছি।বলুন না ওনার কথা।উনি কোথায়?"
"ও তো নাইরে বাজান।গেরামের মানুষের কথায়,লজ্জায় ও চইলা গেল।ঐ যে গাছটা দেহেন,ঐডার ডালে ফাস দিয়া মরলো।"বলতে বলতে আবার কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা।
আনিসের বুক ফেটে কান্না আসছে।যার জন্য এতদূর আসলো,সেই নেই...
কিছুক্ষন পর বৃদ্ধা আবার বলতে লাগলেন,
"ওর পোলাডারে এক সাহেব আইসা নিয়া গেল।জানিনা কই আছে।"
রানী জিজ্ঞেস করল,"কিভাবে কি হয়েছিল আমাদের বলুন না।"
"সব কিছু কি সুন্দর আছিল।আমরা দুই বুইন,এক ভাই আছিলাম।আমাগো বাপের অবস্থাও ভাল ছিল,কোন অভাব ছিলনা।কিন্তু হঠাৎ কইরা কি যে শুরু হইল।সবাই কেমন জানি ক্ষ্যাপা হইয়া যাইতে লাগল।একদিন হুনলাম ঢাকায় নাকি যুদ্ধ শুরু হইছে।পাকিস্তানি মিলিটারিরা নাকি সব কিছু জ্বালায়ে দিতাছে,মানুষ মাইরা ফালাইতেছে।আমরা ভাবছিলাম আমরা গেরামের মানুষ আমাগো আর কি হইব?একদিন আমার ভাইযান বাড়ি থেইকা পালায়ে গেল।হে নাকি যুদ্ধে গেছিল।
একদিন আমাগো গেরামে মিলিটারি আইলো।আমরা ডরে(ভয়ে) যে যেদিকে পারি পালাইতে লাগলাম।কে কই যামু,কি করমু,কিচ্ছু জানিনা।মিলিটারিরা সামনে যারে পায় তারেই গুলি দেয়।সব বাড়িতে আগুন জ্বালায়ে দিল।সব জায়গায় খালি মাইনষের চেচামেচি,আগুন,গুলির শব্দ,মিলিটারি।গেরামের কম বয়সী মাইয়া গো ধইরা নিয়া গেল।আমরা পালায়ে ছিলাম।কিন্তু আমার রাবেয়া..."
কথা শেষ না করে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা।অনেকক্ষন কাদেন।রানী,আনিস চুপ করে বসে থাকে।বৃদ্ধা আবার বলতে লাগলেন,
"সেই সময় যে কেমনে পালায়ে ছিলাম,কি অবস্থা যে হইছিল সেইটা আমরাই জানি।চারিদিকে খালি যুদ্ধ,গোলাগুলি।আমাগো গেরামে মিলিটারি ক্যাম্প ছিল।সেই ক্যাম্পেই রাবেয়ারে আটকায়ে রাখছে।আমার বাপেরে মাইরা ফালাইলো কুত্তার বাচ্চারা,আর আমার ভাই আর কোন দিন ফিরা আইলো না।"
চোখের পানি মুছে রানী জিজ্ঞেস করলো,"আর রাবেয়া?"
"একদিন গেরামে মুক্তিবাহিনী আইলো।হেরা মিলিটারি ক্যাম্পে গোলাগুলি করলো।মনে হইতেছিল যেন কেয়ামত হইতেছে।আমার চাচায় কইতেছিল আর ভয় নাই,মিলিটারি আইসা গেছে।
সারারাত চলল গোলাগুলি।পরে হুনলাম মুক্তিরা নাকি মিলিটারি গো শেষ কইরা দিছে।অনেক মিলিটারি মারা গেছে,অনেকে পালাইছে।২ দিন পরেই হুনি দেশ স্বাধীন হইছে।
সবাই কত আনন্দ করতে ছিল।কিন্তু আমাগো মধ্যে কোন আনন্দ নাই।বাপজান নাই,ভাইয়ের কোন খবর নাই।আমি চিন্তা করি রাবেয়ার কথা।বাইচা আছে?বাইচা থাইকা লাভ কি?
হেইদিন রাবেয়া আইলো।ওরে জড়াইয়া ধইরা কতক্ষন যে কানছি।কিন্তু মায়ে ওরে লইয়া ভয় পাইলো।ও কোন কথা কইতে পারতেছিল না।জানোয়ার গুলা ওরে শেষ কইরা দিছে।আমরা বাড়িতে উঠলাম।আমাগো বাড়িতে সব কিছু লুট হইয়া গেছিল।
কয়েকদিন পর ঝামেলা শুরু হইলো।রাবেয়ার পেটে বাচ্চা আইলো।এত ধাক্কায় মায় ও মইরা গেল।আমরা বিপদে পড়লাম।ঐ সময় চাচা অনেক সাহায্য করছিলেন।ব্যাপারটা আমি চাপা দেওনের চেষ্টা করলাম।কিন্তু গেরামের সবাই জাইনা গেল।
রাবেয়া এমনি ই কেমন জানি হইয়া গেছিল।তারপরে একদম কথা কওয়া বন্ধ কইরা দিল।বাচ্চা হওনের সময় আমার বুইন কি যে কষ্ট পাইলো।কারো কোন সাহায্য পাইলাম না।
যুদ্ধের সময় সবাই একলগে কষ্ট পাইছি কিন্তু এখন মানুষ গুলা যেন কেমন হইয়া গেল।এত কথা শুনতে না পাইরা রাবেয়া একদিন গলায় ফাস দিল।
একজন মুক্তিযোদ্ধা আইছিল গেরামে।কি যেন অফিসার।হে সব শুইনা রাবেয়ার পোলাডারে নিতে চাইলো,আমিও দিলাম।না দিয়া কি কোন উপায় ছিল?আমার নিজের ই কোন ঠিক ঠিকানা নাই,পোলারে মানুষ করুম কেমনে?আর লোকের কথায় আমি আর সহ্য করতে পারিনাই।"
অঝোরে কাদছেন বৃদ্ধা।ভয়ংকর সেসব স্মৃতি আবার হানা দিয়েছিল তার মনে।ওরা চুপ করে শুনছিল।আনিস বলল,
"আমার মায়ের কবর টা কোথায়?"
বৃদ্ধা চমকে উঠলেন।বললেন,
"কি বললা,তোমার মা?"
"হ্যাঁ আমার মা,রাবেয়া,আপনার বোন।"
বৃদ্ধা এক দৃষ্টিতে আনিসের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।তারপর ধরা গলায় বলল,
"আসো আমার লগে।'
ওরা নিরবে বৃদ্ধা কে অনুসরণ করল।তিনি একটা জংলা মতন জায়গায় ওদের নিয়ে এলেন।আঙ্গুল তুলে একটা জায়গা দেখালেন।বলে না দিলে বুঝা যাবেনা যে এটা করব।চারিদিকে ঝোপঝাড় ছেয়ে আছে।
আনিসের দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে।এই খানে তার মা শুয়ে আছে।এই মা তার জন্য কত কষ্ট করেছে।আনিসের মনে প্রশ্ন জাগে,
"তার মা কি কোন দিন তাকে ভালবেসেছিল?নাকি ঘৃণা করেছিল?সব মায়েরা যেমন প্রম মমতায় সন্তান কে আগলে রাখে ওর মা কি ওকে তেমনি আগলে রেখেছিল নাকি ঘৃণায় দূরে রেখেছিল?"
এসব জানার কোন উপায় নেই।জানতেও ইচ্ছা হয়না আনিসের।নিজেই নিজেকে ঘৃণা করতে থাকে।অজানা একটা অনুভূতি,অন্যরকম একটা কষ্ট তাকে ঘিরে ধরে।সে কোন বাঙালির সন্তান না,সে এমন সন্তান যাকে তার মা ঘৃণা করত।অস্থির হয়ে ওঠে আনিস।রানী ওকে ধরে নিয়ে আসে ওখান থেকে।
######
বিশাল বড় লঞ্চ টা নদীর মাঝ দিয়ে চলছে বিশাল বিশাল ঢেউ কেটে।লঞ্চটা চলার ফলে যে স্রোত তৈরি হয় তাতে দুপাশের মাছ ধরার নৌকা গুলো দুলে উঠছে।
আনিস লঞ্চের বারান্দায় দাড়ানো।রানী তার পাশে এসে দাড়ালো।বলল,
"তুমি নিজেকে নিজে ঘৃণা করছ?"
"হ্যাঁ রানী।তুমি না থাকলে আমি আত্মহত্যা করতাম।"
"শুধু শুধু কেন তুমি বোকার মত করছ?তুমি যেখানেই জন্ম নাওনা কেন তুমি বড় হয়াছ একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে।"
আনিস কিছু না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো।রানী বলল,
"তুমি কেন শুধু তোমার পিতার দিকটা দেখছ?তুমি কেন ভুলে যাচ্ছ তুমি যার গর্ভে জন্মেছ তিনি তো একজন যোদ্ধা,একজন বাঙালি।তোমার মা শুধু যে একজন বাঙালি তাই নয়,তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।তিনি তার সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করে গেছেন।তোমার গর্ব হওয়া উচিত।
আচ্ছা দেশ তো মায়ের সাথেই তুলনীয় তাইনা?মায়ের পরিচয়েই তো দেশের পরিচয়।"
আনিসের সত্যিই ভাল লাগলো।রানী তো ঠিক ই বলেছে।আনিস রানীকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে লঞ্চের বারান্দায়।সত্যিই দেশটা কত সুন্দর।কতইনা সুন্দর।এই দেশের এক নারীর গর্ভেই তো তার জন্ম।
এই দেশের আলো বাতাসেই তো সে বড় হয়েছে।এটাতো তার ই দেশ।
অজানা এক ভাল লাগার অনুভূতি হতে লাগলো আনিসের।
দেখতে লাগলো নদীর বড় বড় স্রোত।স্রোতে দুলে ওঠা ছোট ছোট নৌকা,দুপাশের সবুজ গ্রাম।
এই তো তার মা।এইতো তার দেশ।
স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ...
(গল্পটি আমি লিখেছিলাম ২০০৯ সালে।তখন আমার বয়স ১৫ বছর।তাই লেখাটিতে কিছুটা কম বয়সি আবেগ-ছেলেমানুষি আছে।লেখাটা অপরিণত ও বটে।এতদিন এটা কাগজের পাতায় ছিল।সম্পূর্ণ অপরিবর্তীত ভাবে লেখাটি তুলে দিলাম।কিশোর বয়সের অপরপক্কতা কে পাঠক ক্ষনা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আসা করি)
কিন্তু আজ...
আজ কোন কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করছে না।লঞ্চটা নদীর মাঝ দিয়ে ঢেউ কেটে চলে যাচ্ছে।বরিশাল গামি বিশাল লঞ্চ টার ছাদে বসে আছে আনিস।লঞ্চের চলার পথে বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি হচ্ছে।ঢেউ গুলো বড় হতে হতে একসময় নদী তীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।চমৎকার দেখতে লাগে সেটা।দুপাশে সবুজ গ্রাম,নদীতে নৌকা।
রানী মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল এসব।আনিসের দিকে তাকালো ও।মন খারাপ করে বসে আছে।নিশ্চই অনেক কষ্ট পাচ্ছে।আনিসের কাঁধে হাত রাখলো রানী।বলল,
"কি হল মন খারাপ?"
"মন ভাল রাখি কি করে বল?যতক্ষন না জানতে পারছি..."কথা শেষ না করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আনিস।রানী আবার বলে।
"দেখ চারপাশ টা কি সুন্দর।"
আনিস উঠে দাড়ায়।রানীর দিকে তাকিয়ে বলে,
"আচ্ছা রানী বাবার সব কথা যদি সত্য হয় তাহলে কি তুমি আমাকে ঘৃণা করবে?"
রানী কাছে এগিয়ে এসে আনিস কে জড়িয়ে ধরে।বলে,
"কক্ষনো না।আমি তোমাকে ঘৃণা করব কেন?আমি তোমার স্ত্রী,তোমার প্রেমিকা।"
"আমার খুব ভয় হচ্ছে রানী।মনে হচ্ছে বাবার সব কথা যেন মিথ্যা হয়।আচ্ছা বাবার কি দরকার ছিল এসব কথা বলার?"
"উনি তোমাকে সব কিছু খুলে বলতে না পেরে অপরাধবোধে ভুগছিলেন।তাই শেষ পর্যন্ত সব জানিয়েছেন।
আনিস চারপাশে তাকিয়ে দেখল।সত্যিই কত সুন্দর!
####
গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে বিকেল হয়ে গেল।লোকজন কে জিজ্ঞেস করে বাবার নির্দেশনা মত অনেক কষ্টে সেই বাড়িটা খুজে পাওয়া গেল।
বাড়ির সামনে কতগুলো বাচ্চা খেলা করছিল।আনিস ওদের কে বলল,
"বাড়ির ভিতর থেকে কাউকে ডেকে দিবে?বলবে ঢাকা থেকে এসেছে।"
একটা মেয়ে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে গেল।কিছুক্ষন পর একজন বৃদ্ধা মহিলা বাইরে এলেন।বয়স সত্তর হবে।বাইরে এসে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন শহুরে আগন্তুক দের দিকে।
আনিসের বুকটা কেঁপে উঠলো।এই কি সেই মহিলা,যার খোঁজে এতদূর এসেছে সে?
আনিস জিজ্ঞেস করে,"আপনি কি রাবেয়া খাতুন?"
আনিসের কথা শুনে বৃদ্ধা কেঁপে উঠলেন।বললেন,
"না আমি না।কিন্তু আপনারা কেডা?ক্যান আইছেন?"
"আমরা ওনার কাছে এসেছি।উনি কি আছেন?"
"না,ও নাই"
"উনি আপনার কে হয়?"
"আমার বুইন।আমার কত আদরের বুইন",ডুকরে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা।
রানী গিয়ে মহিলাকে জড়িয়ে ধরে।বারান্দায় একটা মাদুর বিছানো।সেখানে গিয়ে বসল ওরা।রানী বলল,
"আমরা ওনার কথা জানতে এসেছি।ঢাকা থেকে এসেছি।বলুন না ওনার কথা।উনি কোথায়?"
"ও তো নাইরে বাজান।গেরামের মানুষের কথায়,লজ্জায় ও চইলা গেল।ঐ যে গাছটা দেহেন,ঐডার ডালে ফাস দিয়া মরলো।"বলতে বলতে আবার কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা।
আনিসের বুক ফেটে কান্না আসছে।যার জন্য এতদূর আসলো,সেই নেই...
কিছুক্ষন পর বৃদ্ধা আবার বলতে লাগলেন,
"ওর পোলাডারে এক সাহেব আইসা নিয়া গেল।জানিনা কই আছে।"
রানী জিজ্ঞেস করল,"কিভাবে কি হয়েছিল আমাদের বলুন না।"
"সব কিছু কি সুন্দর আছিল।আমরা দুই বুইন,এক ভাই আছিলাম।আমাগো বাপের অবস্থাও ভাল ছিল,কোন অভাব ছিলনা।কিন্তু হঠাৎ কইরা কি যে শুরু হইল।সবাই কেমন জানি ক্ষ্যাপা হইয়া যাইতে লাগল।একদিন হুনলাম ঢাকায় নাকি যুদ্ধ শুরু হইছে।পাকিস্তানি মিলিটারিরা নাকি সব কিছু জ্বালায়ে দিতাছে,মানুষ মাইরা ফালাইতেছে।আমরা ভাবছিলাম আমরা গেরামের মানুষ আমাগো আর কি হইব?একদিন আমার ভাইযান বাড়ি থেইকা পালায়ে গেল।হে নাকি যুদ্ধে গেছিল।
একদিন আমাগো গেরামে মিলিটারি আইলো।আমরা ডরে(ভয়ে) যে যেদিকে পারি পালাইতে লাগলাম।কে কই যামু,কি করমু,কিচ্ছু জানিনা।মিলিটারিরা সামনে যারে পায় তারেই গুলি দেয়।সব বাড়িতে আগুন জ্বালায়ে দিল।সব জায়গায় খালি মাইনষের চেচামেচি,আগুন,গুলির শব্দ,মিলিটারি।গেরামের কম বয়সী মাইয়া গো ধইরা নিয়া গেল।আমরা পালায়ে ছিলাম।কিন্তু আমার রাবেয়া..."
কথা শেষ না করে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা।অনেকক্ষন কাদেন।রানী,আনিস চুপ করে বসে থাকে।বৃদ্ধা আবার বলতে লাগলেন,
"সেই সময় যে কেমনে পালায়ে ছিলাম,কি অবস্থা যে হইছিল সেইটা আমরাই জানি।চারিদিকে খালি যুদ্ধ,গোলাগুলি।আমাগো গেরামে মিলিটারি ক্যাম্প ছিল।সেই ক্যাম্পেই রাবেয়ারে আটকায়ে রাখছে।আমার বাপেরে মাইরা ফালাইলো কুত্তার বাচ্চারা,আর আমার ভাই আর কোন দিন ফিরা আইলো না।"
চোখের পানি মুছে রানী জিজ্ঞেস করলো,"আর রাবেয়া?"
"একদিন গেরামে মুক্তিবাহিনী আইলো।হেরা মিলিটারি ক্যাম্পে গোলাগুলি করলো।মনে হইতেছিল যেন কেয়ামত হইতেছে।আমার চাচায় কইতেছিল আর ভয় নাই,মিলিটারি আইসা গেছে।
সারারাত চলল গোলাগুলি।পরে হুনলাম মুক্তিরা নাকি মিলিটারি গো শেষ কইরা দিছে।অনেক মিলিটারি মারা গেছে,অনেকে পালাইছে।২ দিন পরেই হুনি দেশ স্বাধীন হইছে।
সবাই কত আনন্দ করতে ছিল।কিন্তু আমাগো মধ্যে কোন আনন্দ নাই।বাপজান নাই,ভাইয়ের কোন খবর নাই।আমি চিন্তা করি রাবেয়ার কথা।বাইচা আছে?বাইচা থাইকা লাভ কি?
হেইদিন রাবেয়া আইলো।ওরে জড়াইয়া ধইরা কতক্ষন যে কানছি।কিন্তু মায়ে ওরে লইয়া ভয় পাইলো।ও কোন কথা কইতে পারতেছিল না।জানোয়ার গুলা ওরে শেষ কইরা দিছে।আমরা বাড়িতে উঠলাম।আমাগো বাড়িতে সব কিছু লুট হইয়া গেছিল।
কয়েকদিন পর ঝামেলা শুরু হইলো।রাবেয়ার পেটে বাচ্চা আইলো।এত ধাক্কায় মায় ও মইরা গেল।আমরা বিপদে পড়লাম।ঐ সময় চাচা অনেক সাহায্য করছিলেন।ব্যাপারটা আমি চাপা দেওনের চেষ্টা করলাম।কিন্তু গেরামের সবাই জাইনা গেল।
রাবেয়া এমনি ই কেমন জানি হইয়া গেছিল।তারপরে একদম কথা কওয়া বন্ধ কইরা দিল।বাচ্চা হওনের সময় আমার বুইন কি যে কষ্ট পাইলো।কারো কোন সাহায্য পাইলাম না।
যুদ্ধের সময় সবাই একলগে কষ্ট পাইছি কিন্তু এখন মানুষ গুলা যেন কেমন হইয়া গেল।এত কথা শুনতে না পাইরা রাবেয়া একদিন গলায় ফাস দিল।
একজন মুক্তিযোদ্ধা আইছিল গেরামে।কি যেন অফিসার।হে সব শুইনা রাবেয়ার পোলাডারে নিতে চাইলো,আমিও দিলাম।না দিয়া কি কোন উপায় ছিল?আমার নিজের ই কোন ঠিক ঠিকানা নাই,পোলারে মানুষ করুম কেমনে?আর লোকের কথায় আমি আর সহ্য করতে পারিনাই।"
অঝোরে কাদছেন বৃদ্ধা।ভয়ংকর সেসব স্মৃতি আবার হানা দিয়েছিল তার মনে।ওরা চুপ করে শুনছিল।আনিস বলল,
"আমার মায়ের কবর টা কোথায়?"
বৃদ্ধা চমকে উঠলেন।বললেন,
"কি বললা,তোমার মা?"
"হ্যাঁ আমার মা,রাবেয়া,আপনার বোন।"
বৃদ্ধা এক দৃষ্টিতে আনিসের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।তারপর ধরা গলায় বলল,
"আসো আমার লগে।'
ওরা নিরবে বৃদ্ধা কে অনুসরণ করল।তিনি একটা জংলা মতন জায়গায় ওদের নিয়ে এলেন।আঙ্গুল তুলে একটা জায়গা দেখালেন।বলে না দিলে বুঝা যাবেনা যে এটা করব।চারিদিকে ঝোপঝাড় ছেয়ে আছে।
আনিসের দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে।এই খানে তার মা শুয়ে আছে।এই মা তার জন্য কত কষ্ট করেছে।আনিসের মনে প্রশ্ন জাগে,
"তার মা কি কোন দিন তাকে ভালবেসেছিল?নাকি ঘৃণা করেছিল?সব মায়েরা যেমন প্রম মমতায় সন্তান কে আগলে রাখে ওর মা কি ওকে তেমনি আগলে রেখেছিল নাকি ঘৃণায় দূরে রেখেছিল?"
এসব জানার কোন উপায় নেই।জানতেও ইচ্ছা হয়না আনিসের।নিজেই নিজেকে ঘৃণা করতে থাকে।অজানা একটা অনুভূতি,অন্যরকম একটা কষ্ট তাকে ঘিরে ধরে।সে কোন বাঙালির সন্তান না,সে এমন সন্তান যাকে তার মা ঘৃণা করত।অস্থির হয়ে ওঠে আনিস।রানী ওকে ধরে নিয়ে আসে ওখান থেকে।
######
বিশাল বড় লঞ্চ টা নদীর মাঝ দিয়ে চলছে বিশাল বিশাল ঢেউ কেটে।লঞ্চটা চলার ফলে যে স্রোত তৈরি হয় তাতে দুপাশের মাছ ধরার নৌকা গুলো দুলে উঠছে।
আনিস লঞ্চের বারান্দায় দাড়ানো।রানী তার পাশে এসে দাড়ালো।বলল,
"তুমি নিজেকে নিজে ঘৃণা করছ?"
"হ্যাঁ রানী।তুমি না থাকলে আমি আত্মহত্যা করতাম।"
"শুধু শুধু কেন তুমি বোকার মত করছ?তুমি যেখানেই জন্ম নাওনা কেন তুমি বড় হয়াছ একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে।"
আনিস কিছু না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো।রানী বলল,
"তুমি কেন শুধু তোমার পিতার দিকটা দেখছ?তুমি কেন ভুলে যাচ্ছ তুমি যার গর্ভে জন্মেছ তিনি তো একজন যোদ্ধা,একজন বাঙালি।তোমার মা শুধু যে একজন বাঙালি তাই নয়,তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।তিনি তার সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করে গেছেন।তোমার গর্ব হওয়া উচিত।
আচ্ছা দেশ তো মায়ের সাথেই তুলনীয় তাইনা?মায়ের পরিচয়েই তো দেশের পরিচয়।"
আনিসের সত্যিই ভাল লাগলো।রানী তো ঠিক ই বলেছে।আনিস রানীকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে লঞ্চের বারান্দায়।সত্যিই দেশটা কত সুন্দর।কতইনা সুন্দর।এই দেশের এক নারীর গর্ভেই তো তার জন্ম।
এই দেশের আলো বাতাসেই তো সে বড় হয়েছে।এটাতো তার ই দেশ।
অজানা এক ভাল লাগার অনুভূতি হতে লাগলো আনিসের।
দেখতে লাগলো নদীর বড় বড় স্রোত।স্রোতে দুলে ওঠা ছোট ছোট নৌকা,দুপাশের সবুজ গ্রাম।
এই তো তার মা।এইতো তার দেশ।
স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ...
(গল্পটি আমি লিখেছিলাম ২০০৯ সালে।তখন আমার বয়স ১৫ বছর।তাই লেখাটিতে কিছুটা কম বয়সি আবেগ-ছেলেমানুষি আছে।লেখাটা অপরিণত ও বটে।এতদিন এটা কাগজের পাতায় ছিল।সম্পূর্ণ অপরিবর্তীত ভাবে লেখাটি তুলে দিলাম।কিশোর বয়সের অপরপক্কতা কে পাঠক ক্ষনা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আসা করি)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ওয়াহিদ ১৫/০৯/২০১৩
-
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী. ১৪/০৯/২০১৩কোন উপমাই এর সঙ্গে যায় না। এ লেখা হৃদয়ের গভীরের হতে আসা।তবে আমি যেটা বলতে চাই তা হলো এত অল্প বয়সে আপনার যে অনুভূতি কাজ করেছে তা সত্যিই প্রসংশার দাবিদার।
-
পল্লব ১৫/০৮/২০১৩অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী লেখা। পড়তে পড়তে ৭১-এর সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা ভেবে হৃদয় মুচড়ে উঠে।
এক কথায় অসাধারণ .......
কোন মন্তব্যের ক্ষমতা হয় এই সব গল্পের জন্য মন্তব্য করার ,এইটাই মনে করি .....
অনেক অনেক দোয়া ,শুভকামনা রয়ল ....