রাত পোহাবার আগে ২৫
এই প্রথম মমদের বাসায় এলো অন্তু। মাঝারি আকৃতির সাজানো-গোছানো একটি ফ্ল্যাট। সুরুচিপূর্ণ আসবাব পত্র। ওরা বসলো মাসুমের রুমে। মাসুমকে তখনো উত্তেজিত দেখাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর মম এলো ট্রেতে কিছু মিষ্টি বিস্কুট আর জুসসহ। মমকে দেখেই মিষ্টি হাসি দিলো অন্তু। মমও ছোট করে একটা হাসি দিলো। সুন্দর দেখাচ্ছে মমকে। আকাশি সেলুয়ার, উড়না, গোলাপি কামিজ পরা। ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে পিঠে। অন্তুর কাছে মনে হলো, যেন শিশির ভেজা এক ফুটন্ত তাজা গোলাপ। কাছে এসে ছোট্ট করে ছালাম দিলো মম। মাসুম তখনো হাফাচ্ছিলো। মম ওদের সামনে খাবারগুলো রেখে চলে গেলো। তবে যাওয়ার আগে বলে গেলো যে, তারা যেন খেয়ে নেয়। অন্তু দেখলো, ঘরের প্রতিটি জিনিস পরি পাটি সাজানো গোছানো,অন্তুর উদাসিনতা লক্ষ্য করে বল্ল নিন অন্তু সাহেব খান।
অন্তু হাত বাড়ালো খাবারের দিকে। মাসুমকেও এগিয়ে দিলো। খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ গল্প-গুজবের পর চলে গেলো অন্তু। কিছুতেই স্বস্থির পাচ্ছে না মাসুম। একে তো অভাব লেগেই আছে নিত্বনৈমিতক তার উপর এমন অসন্মানের গোগ্রাস। শুয়ে থাকলো মাসুম সারাটা বিকেল। হাজারো দুর্ভাবনা অস্থির করে তুলছে তাকে। প্রিয়া হারা সেই তীব্র ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠলো। একের পর এক কষ্টের তিব্রতা নিস্তেজ করে দিয়েছে তার দূরন্ত চলার গতি। কোথাও এক ফোটা সুখ নেই যেন। চারদিকে শূন্যতা, হাহাকার আর অরাজকতার অন্ধকারে পিচ্ছিল জীবনের আস্তাবল।
মাগো, আমি আর পারি না মা। বাবা, তুমি কোথায়? আমি পারলাম না তোমার সম্মান ধরে রাখতে। কাঁদছে মাসুম। নিভেদ সেই কান্নায় ভেসে যাচ্ছে তার না পাওয়ার কষ্ট-গ্লানি। সে রাতে কিছু খেলো না মাসুম। মম’র খুব কষ্ট হলো। মুন্নির মনটা ভালো নেই। সেও কথা বলছে না। মুক্তার কাশি বেড়েছে। সে মাঝে মাঝেই কঠিন ভাবে কাশছে। রাতে ঘুম হলো না মম’র। সকালে উঠে ভাইয়ার ঘরে গিয়ে দেখলো, মাসুম ঘরে নেই। চলে গেছে বাইরে।
মুক্তা, মুন্নি তখনো ঘুমাচ্ছে। মম আস্তে আস্তে চলে গেলো সেই ঝাউ তলায় টোনাটুনির কাছে। টোনাটুনির দুটি বাচ্চা হয়েছে। এখনো পাখা গজায়নি তাদের। অন্তু চেয়ে আছে মম’র দিকে। মম’র মনটা ভালো নেই তাই অন্তুর দিকে চাইতেই অশ্র এলো তার। মম’র কষ্টে কাতর মনের ভাব বুঝতে পারলো সে। ছোট্ট একটা কাগজে কিছু লেখে পুরানো কলমে বেঁধে ছুড়ে দিলো সেটা মম’র সামনে। মম সেটা খুলে পড়লো। অন্তু কিছু বলতে চায়। ছাদে যেতে বলছে। সময় কম তাই এখনি যেতে হবে।
মম চলে গেলো ছাদে। মুন্নির ঘুম ভাঙ্গতেই মনে হলো বারেকের কথা। বারিক তাকে বার বার করে দেখা করতে বলেছে। সম্পার কথার রেশ ধরেই মুন্নি বারেককে বস্ করেছে। বারেক তার সব কথা মেনে নিয়েছে। কোনো প্রকার বেয়াদবি আচারণ করেনি তার সাথে। মুন্নি এখন সকল পথে স্বাধীন। কেউ তাকে বিরক্ত করে না। এমন কি সবাই তাকে সম্মানের সহিত মান্য করে। বেশ কিছু দিন হলো মুন্নির সাড়ায় বারিক অনেকটা ভালো হয়ে গেছে। সে আর অন্যায় করে না। বারিকের পৃথিবীটা এখন স্বপ্নের মতো রঙ্গিন হয়ে উঠেছে। তাই সে অনেক কিছু কিনেছে মুন্নির জন্য।
সব উন্নত মানের পণ্য সামগ্রী সঙ্গে কিছু কাপড়। মুন্নি সে সবে প্রথমে আপত্তি করলেও পরে কি ভেবে আর আপত্তি করেনি। সামনে তার পরীক্ষার ফরম পূরণ থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যায় ভার বহন করছে বারিক। মাঝে মাঝেই নগদ টাকা দেয় বারিক। সে জানে, এখন মাসুমের চাকরীহীন সংসারে দরিদ্রতা বাসা বেঁধেছে। আর তাই সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে আপন হতে চায় বারিক তাদের। কিন্তু মুন্নির কোনো টাকাই সংসারের কাজে লাগায় না মম কিংবা মাসুম। মাসুম মুন্নিকে জানিয়ে দিয়েছে, তার অভাবের সংসারের কোনো পাপিষ্টের আঁচড় লাগতে দিবে না। মুন্নি চেয়েছে, মুক্তার চিকিৎসা করাতে তাতেও রাজি হয় না কেউ। মুক্তা এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর দিকে। মুন্নি মানতে পারে না মুক্তার এই অপমৃত্যু। তর্ক বেঁধে যায় ভাই-বোনেতে। জেদ করেই মুক্তার ভার বহন করে মুন্নি।
। মুক্তা খুশি হয় মুন্নির উপর। বিভিন্ন খাদ্য আর দামি দামি পোশাক পড়ে মুন্নি, মুক্তা। মম সইতে পারে না এই অপমানের ভার। কষ্ট হয় তার। মাসুম ঁেচাখের পানি ফেলে নির্ভিতে নিরালায়। মাসুমকে সান্ত¡না দেয় মম। কথা বলে না মাসুম। শুধু চেয়ে থাকে চাতক পাখির মতো।
এমনি করেই অশান্তির দাড় বেয়েই চলে সময়ের লিলা। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না মাসুম। ঋণ বাড়তে বাড়তে ঋণের পথও বন্ধ হয়ে যায় এক সময়। অসহায় হয়ে পড়ে মাসুম যন্ত্রনার লোনা জলে বারে বারে ভেজে উঠে দু’চোখ। কিছুতেই ফিরাতে পারে না মাসুম তার হারানো সুখের দিনগুলি। আস্তে আস্তে অনেক দূরে চলে যায় তার প্রিয়জনদের সীমানা। মুন্নি, মুক্তা, মম, মাসুম ওরা যেন হয়ে যায় ছিন্ন ভিন্ন কটি প্রাণ। মুন্নি বার বার ফিরে যেতে চায় মাসুম আর মম’র কাছে। কিন্তু না সে সামান্যতেই নিশেষ করে দিতে পারে বাবা-মা, ভাই-বোনদের আদর্শ, সম্মান। সে কিছুতেই মাসুমের বোন হতে পারে না। মমও মানতে পারে না মুন্নিকে। মম সব কষ্ট মেনে নিয়েছে বাবা-ভাইয়ের সম্মান রক্ষার্থে। মম পারবে সৌন্দর্যের জন্য ত্যাগী হতে। সততার জন্য যুদ্ধ করতে। তবু কিছুতেই মানতে চাইবে না অন্যায় চমকানো সুখ। অসম্মান করতে পারবে না সে তার ভাইকে। এমন কি বাবা-মায়ের আদর্শকে। মুন্নি তার বোন, বয়সে বড় সব জেনে-শুনে অন্যায় পথে পা বাড়িয়েছে। আর একজন অন্যায় কারীকে প্রশ্রয় দিতে পারে না মম।
মম বার বার নিষেধ করেছে মুন্নিকে। মুন্নি সব জেনে, সব বুঝেও অন্যায় করছে। স্বস্থি দিচ্ছে তার মৃত্যু বাবা-মায়ের আত্মাকে। কষ্ট দিচ্ছে তার অন্নদাতা সততার সৈনিক সম্মানের প্রতিক প্রিয় ভাইটিকে। সামান্য অর্থের কারণে যার এতোটা অধপতন হয় সে কখনো মম’র বোন হতে পারে না। ছিঃ! নিজের প্রয়োজনে মানুষ এতোটা হীন হতে পারে! পারলো মুন্নি তাদেরি বোন হয়ে অর্থের কারণে নিজের সম্মানকে অসৎ লোকের কাছে বিসর্জন দিতে। একটা লোক দিনের পর দিন অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে তা কী বিনা প্রতিদানে। একি হতে পারে?
না না সার্থ ছাড়া সার্তান্ধ পৃথিবীতে মানুষ এক পাও চলে না। হ্যাঁ, মুন্নি হারিয়ে গেছে অসত্যের অন্ধকারে। সেখানে মিথ্যের মায়ায় আলেয়ার আলো আছে। রং করা ঝলসানো রঙ্গীন স্বপ্ন আছে। যেখান থেকে সত্যের প্রদীপ শিখার আলোকে মনে হবে মলিন। আর এই মলিন আলো পারবে না তার উচ্চাকাংক্ষি মনের মিথ্যে মাধুরীকে ধরে রাখতে। পারবে না তাকে ফিরিয়ে আনতে। পারবে না মম কিংবা মাসুম। অজান্তে ভাবনার তল বেয়ে অশ্রু জমে মম’র চোখে। মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলির কথা। ফেঁপে উঠে বুকের ভেতরে জমানো বাঁধ ভাঙ্গা কান্না। নিজেকে ধরে রাখতে পারে না মম।
অনেক দিন পর অদিতাকে দেখে উচ্ছ্বাসের হাসি দিলো দিনা। কী ব্যাপার অদি, এতোদিন পর বুঝি আমাকে মনে পড়লো তোর?
ঃ আরে না। চাইলেই কি সব ভোলা যায়। কাজে ব্যাস্ত ছিলাম। তা হঠাৎ কী মনে করে? কাজের খবর কী?
ঃ সব ভালো। আমি সাকসেস।
ঃ তাই ,তো বেচারাকে বাঁজাতে গিয়ে নিজেও বাজিস নি তো?
ঃ তা কি আর হয়। অন্যেকে বাঁজাতে গেলে নিজেতো বাঁজতেই হবে।
ঃ বলিস কী?
ঃ হ্যাঁ। সত্যিই ভাবি মাসুমের তুলনা হয় না। বাবার ধারণা সম্পূর্ণ ঠিক। বাবা মানুষ চিনতে ভুল করে নি। আমাদের এতো কিছুর ভার একমাত্র সেই পারবে বহন করতে।
ঃ শুধু কি এতো কিছুর। আমার এই মিষ্টি ননদিনির ভারো যে তাকে বইতে হবে।
ঃ যা ভাবি। তুমি যে কি না।
ঃ আমি আবার কি হতে যাবো কেন। আমি তো সেই আমি। আচ্ছা আদি, তুই যে তার এতো কিছু করলি মাসুম বুঝতে পারেনি?
ঃ কেন? আমি কি এতো কাঁচা যে, অল্পতে ধরা পরে যাবো?
ঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি তো ভুলেই যায় আমার ননদি পাক্কা প্লেয়ার।
ঃ হ্যাঁ, মেয়েটার কার দেখতে হবে না? বাবা আমাকে সাহায্য করেছে বলেই..
ঃ পারিস নি তুই। আমার মন বলছে, মাসুম এতো সহজে ধরা দিবে না তোকে। যতোটা জানি, তাতে ও বড় জেদি আর এক রোখা। আর তাছাড়া ওকে বুঝতে গিয়ে তুই ওর কোনো কঠিন ধরনের ক্ষতি করিস নি তো?
ঃ আরে না। ওর মতো ভালো মানুষ কষ্টে কষ্টে কস্টি পাথর হবে তবু কঠিন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর কষ্টি পাথর অনেক দামি যাকে আমার চাই-ই-চাই।
ঃ অদি, তুই বড় সার্থপর রে।
ঃ কেন?
ঃ না। যে নিজের কথা ভাবতে গিয়ে অন্যকে ভুলে যায় সে তো তাই।
ঃ ভাবি?
ঃ সে থাক গে। এবার ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। আর দেরি করিস না। সোনাকে ফেলে রাখতে নাই; তাতে সবার নজর পড়ে।
ঃ না ভাবি। ওকে আমি কারো নজর পড়তে দিবো না। ও শুধুই আমার। আমার থাকবে। আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরে রাখবো ওকে।
হাসলো দিনা অদির কথাই। বললো,“পারবি তো?”
ঃ হ্যাঁ। পারতেই হবে আমাকে। তুমি দোয়া করো ভাবি, আমি যেন পারি।
ঃ পারবি রে দিনা? পিঠে হাত রেখে ভাবী বলে, যার এত বিশ্বাস,ভালোবাসা আর প্রচেষ্টায় মানুষকে তার সার্থকতার দারে পৌঁছে দেয়। আমি তোকে দোয়া করছি।
হাসলো অদিতি দিনার কথাই। হঠাৎ দাঁড়িয়ে বললো,“আজ আসি ভাবি।”
ঃ সে কি রে, এভাবে যাবি?
ঃ হ্যাঁ, গেলাম। বলেই চলে গেলো অদিতি।
দিনা ওর চলে যাওয়ার পানে চেয়ে বললো,“পাগলি মেয়ে।” এই দিনা অদির মামাতো ভাইয়ের বৌ। প্রায় বান্ধবীর মতোই ওরা ফ্রী। সব বিষয়েই অদিতা দিনার সঙ্গে পরামর্শ করে। আর দিনাও যথা সম্ভব সাহায্য করে তাকে। অদিতা এই ক’মাসে যা করেছে সব বলেছে তাকে প্রতি মুহূর্তে। শেষে তো দিনা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো, না জানি মেয়েটা সত্যি সত্যি ঐ রাজুর প্রতি আসক্ত হয়ে যায়। কিন্তু না এখন আর ভয় নেই তার। এখন যা একটু ভয় মাসুমকে নিয়ে। মাসুম এখন কি যে করে। সে কী ধরা দিবে অদিতাকে?
চলবেই
অন্তু হাত বাড়ালো খাবারের দিকে। মাসুমকেও এগিয়ে দিলো। খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ গল্প-গুজবের পর চলে গেলো অন্তু। কিছুতেই স্বস্থির পাচ্ছে না মাসুম। একে তো অভাব লেগেই আছে নিত্বনৈমিতক তার উপর এমন অসন্মানের গোগ্রাস। শুয়ে থাকলো মাসুম সারাটা বিকেল। হাজারো দুর্ভাবনা অস্থির করে তুলছে তাকে। প্রিয়া হারা সেই তীব্র ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠলো। একের পর এক কষ্টের তিব্রতা নিস্তেজ করে দিয়েছে তার দূরন্ত চলার গতি। কোথাও এক ফোটা সুখ নেই যেন। চারদিকে শূন্যতা, হাহাকার আর অরাজকতার অন্ধকারে পিচ্ছিল জীবনের আস্তাবল।
মাগো, আমি আর পারি না মা। বাবা, তুমি কোথায়? আমি পারলাম না তোমার সম্মান ধরে রাখতে। কাঁদছে মাসুম। নিভেদ সেই কান্নায় ভেসে যাচ্ছে তার না পাওয়ার কষ্ট-গ্লানি। সে রাতে কিছু খেলো না মাসুম। মম’র খুব কষ্ট হলো। মুন্নির মনটা ভালো নেই। সেও কথা বলছে না। মুক্তার কাশি বেড়েছে। সে মাঝে মাঝেই কঠিন ভাবে কাশছে। রাতে ঘুম হলো না মম’র। সকালে উঠে ভাইয়ার ঘরে গিয়ে দেখলো, মাসুম ঘরে নেই। চলে গেছে বাইরে।
মুক্তা, মুন্নি তখনো ঘুমাচ্ছে। মম আস্তে আস্তে চলে গেলো সেই ঝাউ তলায় টোনাটুনির কাছে। টোনাটুনির দুটি বাচ্চা হয়েছে। এখনো পাখা গজায়নি তাদের। অন্তু চেয়ে আছে মম’র দিকে। মম’র মনটা ভালো নেই তাই অন্তুর দিকে চাইতেই অশ্র এলো তার। মম’র কষ্টে কাতর মনের ভাব বুঝতে পারলো সে। ছোট্ট একটা কাগজে কিছু লেখে পুরানো কলমে বেঁধে ছুড়ে দিলো সেটা মম’র সামনে। মম সেটা খুলে পড়লো। অন্তু কিছু বলতে চায়। ছাদে যেতে বলছে। সময় কম তাই এখনি যেতে হবে।
মম চলে গেলো ছাদে। মুন্নির ঘুম ভাঙ্গতেই মনে হলো বারেকের কথা। বারিক তাকে বার বার করে দেখা করতে বলেছে। সম্পার কথার রেশ ধরেই মুন্নি বারেককে বস্ করেছে। বারেক তার সব কথা মেনে নিয়েছে। কোনো প্রকার বেয়াদবি আচারণ করেনি তার সাথে। মুন্নি এখন সকল পথে স্বাধীন। কেউ তাকে বিরক্ত করে না। এমন কি সবাই তাকে সম্মানের সহিত মান্য করে। বেশ কিছু দিন হলো মুন্নির সাড়ায় বারিক অনেকটা ভালো হয়ে গেছে। সে আর অন্যায় করে না। বারিকের পৃথিবীটা এখন স্বপ্নের মতো রঙ্গিন হয়ে উঠেছে। তাই সে অনেক কিছু কিনেছে মুন্নির জন্য।
সব উন্নত মানের পণ্য সামগ্রী সঙ্গে কিছু কাপড়। মুন্নি সে সবে প্রথমে আপত্তি করলেও পরে কি ভেবে আর আপত্তি করেনি। সামনে তার পরীক্ষার ফরম পূরণ থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যায় ভার বহন করছে বারিক। মাঝে মাঝেই নগদ টাকা দেয় বারিক। সে জানে, এখন মাসুমের চাকরীহীন সংসারে দরিদ্রতা বাসা বেঁধেছে। আর তাই সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে আপন হতে চায় বারিক তাদের। কিন্তু মুন্নির কোনো টাকাই সংসারের কাজে লাগায় না মম কিংবা মাসুম। মাসুম মুন্নিকে জানিয়ে দিয়েছে, তার অভাবের সংসারের কোনো পাপিষ্টের আঁচড় লাগতে দিবে না। মুন্নি চেয়েছে, মুক্তার চিকিৎসা করাতে তাতেও রাজি হয় না কেউ। মুক্তা এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর দিকে। মুন্নি মানতে পারে না মুক্তার এই অপমৃত্যু। তর্ক বেঁধে যায় ভাই-বোনেতে। জেদ করেই মুক্তার ভার বহন করে মুন্নি।
। মুক্তা খুশি হয় মুন্নির উপর। বিভিন্ন খাদ্য আর দামি দামি পোশাক পড়ে মুন্নি, মুক্তা। মম সইতে পারে না এই অপমানের ভার। কষ্ট হয় তার। মাসুম ঁেচাখের পানি ফেলে নির্ভিতে নিরালায়। মাসুমকে সান্ত¡না দেয় মম। কথা বলে না মাসুম। শুধু চেয়ে থাকে চাতক পাখির মতো।
এমনি করেই অশান্তির দাড় বেয়েই চলে সময়ের লিলা। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না মাসুম। ঋণ বাড়তে বাড়তে ঋণের পথও বন্ধ হয়ে যায় এক সময়। অসহায় হয়ে পড়ে মাসুম যন্ত্রনার লোনা জলে বারে বারে ভেজে উঠে দু’চোখ। কিছুতেই ফিরাতে পারে না মাসুম তার হারানো সুখের দিনগুলি। আস্তে আস্তে অনেক দূরে চলে যায় তার প্রিয়জনদের সীমানা। মুন্নি, মুক্তা, মম, মাসুম ওরা যেন হয়ে যায় ছিন্ন ভিন্ন কটি প্রাণ। মুন্নি বার বার ফিরে যেতে চায় মাসুম আর মম’র কাছে। কিন্তু না সে সামান্যতেই নিশেষ করে দিতে পারে বাবা-মা, ভাই-বোনদের আদর্শ, সম্মান। সে কিছুতেই মাসুমের বোন হতে পারে না। মমও মানতে পারে না মুন্নিকে। মম সব কষ্ট মেনে নিয়েছে বাবা-ভাইয়ের সম্মান রক্ষার্থে। মম পারবে সৌন্দর্যের জন্য ত্যাগী হতে। সততার জন্য যুদ্ধ করতে। তবু কিছুতেই মানতে চাইবে না অন্যায় চমকানো সুখ। অসম্মান করতে পারবে না সে তার ভাইকে। এমন কি বাবা-মায়ের আদর্শকে। মুন্নি তার বোন, বয়সে বড় সব জেনে-শুনে অন্যায় পথে পা বাড়িয়েছে। আর একজন অন্যায় কারীকে প্রশ্রয় দিতে পারে না মম।
মম বার বার নিষেধ করেছে মুন্নিকে। মুন্নি সব জেনে, সব বুঝেও অন্যায় করছে। স্বস্থি দিচ্ছে তার মৃত্যু বাবা-মায়ের আত্মাকে। কষ্ট দিচ্ছে তার অন্নদাতা সততার সৈনিক সম্মানের প্রতিক প্রিয় ভাইটিকে। সামান্য অর্থের কারণে যার এতোটা অধপতন হয় সে কখনো মম’র বোন হতে পারে না। ছিঃ! নিজের প্রয়োজনে মানুষ এতোটা হীন হতে পারে! পারলো মুন্নি তাদেরি বোন হয়ে অর্থের কারণে নিজের সম্মানকে অসৎ লোকের কাছে বিসর্জন দিতে। একটা লোক দিনের পর দিন অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে তা কী বিনা প্রতিদানে। একি হতে পারে?
না না সার্থ ছাড়া সার্তান্ধ পৃথিবীতে মানুষ এক পাও চলে না। হ্যাঁ, মুন্নি হারিয়ে গেছে অসত্যের অন্ধকারে। সেখানে মিথ্যের মায়ায় আলেয়ার আলো আছে। রং করা ঝলসানো রঙ্গীন স্বপ্ন আছে। যেখান থেকে সত্যের প্রদীপ শিখার আলোকে মনে হবে মলিন। আর এই মলিন আলো পারবে না তার উচ্চাকাংক্ষি মনের মিথ্যে মাধুরীকে ধরে রাখতে। পারবে না তাকে ফিরিয়ে আনতে। পারবে না মম কিংবা মাসুম। অজান্তে ভাবনার তল বেয়ে অশ্রু জমে মম’র চোখে। মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলির কথা। ফেঁপে উঠে বুকের ভেতরে জমানো বাঁধ ভাঙ্গা কান্না। নিজেকে ধরে রাখতে পারে না মম।
অনেক দিন পর অদিতাকে দেখে উচ্ছ্বাসের হাসি দিলো দিনা। কী ব্যাপার অদি, এতোদিন পর বুঝি আমাকে মনে পড়লো তোর?
ঃ আরে না। চাইলেই কি সব ভোলা যায়। কাজে ব্যাস্ত ছিলাম। তা হঠাৎ কী মনে করে? কাজের খবর কী?
ঃ সব ভালো। আমি সাকসেস।
ঃ তাই ,তো বেচারাকে বাঁজাতে গিয়ে নিজেও বাজিস নি তো?
ঃ তা কি আর হয়। অন্যেকে বাঁজাতে গেলে নিজেতো বাঁজতেই হবে।
ঃ বলিস কী?
ঃ হ্যাঁ। সত্যিই ভাবি মাসুমের তুলনা হয় না। বাবার ধারণা সম্পূর্ণ ঠিক। বাবা মানুষ চিনতে ভুল করে নি। আমাদের এতো কিছুর ভার একমাত্র সেই পারবে বহন করতে।
ঃ শুধু কি এতো কিছুর। আমার এই মিষ্টি ননদিনির ভারো যে তাকে বইতে হবে।
ঃ যা ভাবি। তুমি যে কি না।
ঃ আমি আবার কি হতে যাবো কেন। আমি তো সেই আমি। আচ্ছা আদি, তুই যে তার এতো কিছু করলি মাসুম বুঝতে পারেনি?
ঃ কেন? আমি কি এতো কাঁচা যে, অল্পতে ধরা পরে যাবো?
ঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি তো ভুলেই যায় আমার ননদি পাক্কা প্লেয়ার।
ঃ হ্যাঁ, মেয়েটার কার দেখতে হবে না? বাবা আমাকে সাহায্য করেছে বলেই..
ঃ পারিস নি তুই। আমার মন বলছে, মাসুম এতো সহজে ধরা দিবে না তোকে। যতোটা জানি, তাতে ও বড় জেদি আর এক রোখা। আর তাছাড়া ওকে বুঝতে গিয়ে তুই ওর কোনো কঠিন ধরনের ক্ষতি করিস নি তো?
ঃ আরে না। ওর মতো ভালো মানুষ কষ্টে কষ্টে কস্টি পাথর হবে তবু কঠিন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর কষ্টি পাথর অনেক দামি যাকে আমার চাই-ই-চাই।
ঃ অদি, তুই বড় সার্থপর রে।
ঃ কেন?
ঃ না। যে নিজের কথা ভাবতে গিয়ে অন্যকে ভুলে যায় সে তো তাই।
ঃ ভাবি?
ঃ সে থাক গে। এবার ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। আর দেরি করিস না। সোনাকে ফেলে রাখতে নাই; তাতে সবার নজর পড়ে।
ঃ না ভাবি। ওকে আমি কারো নজর পড়তে দিবো না। ও শুধুই আমার। আমার থাকবে। আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরে রাখবো ওকে।
হাসলো দিনা অদির কথাই। বললো,“পারবি তো?”
ঃ হ্যাঁ। পারতেই হবে আমাকে। তুমি দোয়া করো ভাবি, আমি যেন পারি।
ঃ পারবি রে দিনা? পিঠে হাত রেখে ভাবী বলে, যার এত বিশ্বাস,ভালোবাসা আর প্রচেষ্টায় মানুষকে তার সার্থকতার দারে পৌঁছে দেয়। আমি তোকে দোয়া করছি।
হাসলো অদিতি দিনার কথাই। হঠাৎ দাঁড়িয়ে বললো,“আজ আসি ভাবি।”
ঃ সে কি রে, এভাবে যাবি?
ঃ হ্যাঁ, গেলাম। বলেই চলে গেলো অদিতি।
দিনা ওর চলে যাওয়ার পানে চেয়ে বললো,“পাগলি মেয়ে।” এই দিনা অদির মামাতো ভাইয়ের বৌ। প্রায় বান্ধবীর মতোই ওরা ফ্রী। সব বিষয়েই অদিতা দিনার সঙ্গে পরামর্শ করে। আর দিনাও যথা সম্ভব সাহায্য করে তাকে। অদিতা এই ক’মাসে যা করেছে সব বলেছে তাকে প্রতি মুহূর্তে। শেষে তো দিনা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো, না জানি মেয়েটা সত্যি সত্যি ঐ রাজুর প্রতি আসক্ত হয়ে যায়। কিন্তু না এখন আর ভয় নেই তার। এখন যা একটু ভয় মাসুমকে নিয়ে। মাসুম এখন কি যে করে। সে কী ধরা দিবে অদিতাকে?
চলবেই
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মধু মঙ্গল সিনহা ২৭/০৪/২০১৭ভালো লাগল।