www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মোরগের ডাইরি


রিদু যতোবার খেতে বসবে ততোবারই সাদা মোরগটা সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে তার মনের কথাগুলো বলবে। এতো ক্লান্তির পর প্রচন্ড ক্ষিধে নিয়ে খেতে বসে কি কানের কাছে কারো ক্যাচ-ক্যাচানি ভালো লাগে?
সারাদিন কতো কাজ করতে হয় রিদুকে। মা সকাল হতে না হতেই বলে, ঘুম থেকে উঠোরে। নামায পড়োরে। দাঁত ব্রাশ করোরে। বাবার সাথে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটোরে। পড়তে বসোরে। নাস্তা খাওরে। স্কুল যাওরে।
এই রকম নানা কত কথা বলে মা। তারপর সারাদিন পর স্কুল থেকে ফিরে একটু খেতে বসবো তাতে আবার তোর এতো কথা। এই মোরগ এখান থেকে যাবি নাকি লাঠি ঝাঁটা মারবো? আজ আমার একদম কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। যা এখান থেকে ভাগ্।
ঃ না যাবো না। এতোক্ষণে কথা বললো মোরগটা।
ঃ কী বললি? যাবি না?
ঃ না।
ঃ কেন?
ঃ আমার কথা না শুনলে আমি যাবো না।
ঃ তোর তো সাহস বাড়ছে দেখছি। মাকে বলবো, তোর কথা। মা তোকে জবাই করবে।
ঃ বলুন। তবে আপনি যদি মনি মাকে আমার কথা বলেন তাহলে আপনাকে তিনি পাগল বলবে।
ঃ কেন?
ঃ কেন আবার। এ বাড়ির কেউ আমার কথা বোঝে না শুধু আপনি ছাড়া। আপনি যে বোঝেন সে কথা বললেই মনি মা আপনাকে বলবে একটা পাগল।
মোরগের কথাই চমকে উঠলো রিদু। সত্যি তো মানুষ তো মোরগের কথা বোঝে না। রিদু যে বোঝে সেটাও মোরগেরই কৃতিত্ব। কারণ, মোরগের সেই ভূত বন্ধটা ছিলো সেটাই রিদুর মাথায় এই শক্তিটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে রিদু, মোরগ আর তার সেই ভূত বন্ধুটা, বন্ধু হবে বলেছে। মাঝে মাঝেই তাদের দেওয়া কথাটা ভুলে যায় রিদু। কিন্তু তাতে মোরগ একটুও রাগ করে না। মনে করিয়েও দেয় না।
এটা মোরগের একটা বিশেষ জ্ঞান। এছাড়াও তার আর একটা বিশেষ জ্ঞান আছে। আর তা হলো, রিদুকে সে যথেষ্ট সম্মান করে। কারণ, এই পৃথিবীতে তার তো আর কেউ নে যে।
এতোক্ষণ রিদুকে চুপ করে থাকতে দেখে মোরগটা তার কাছে এসে তার খাবারের প্লেটে একটা ঠোকর দিলো।
চিৎকার দিলো রিদু।  
ঃ এই মোরগ, কী র্কছিস?  
মোরগ নিরস কণ্ঠে বললো,“খাইনি আমি। আপনার ভাত ঝুটা করিনি।”
এবার রিদু মোরগের দিকে তাকিয়ে সেকি রাগ দেখিয়ে বললো,“আচ্ছা। এবার বল্ দিকি, তুই কী বলতে চাস্।”  
ঃ আমি আর কী বলবো। আমি তো বলতে চাইলেই আপনি রাগ করেন। আমার কষ্টটা আমি কাউকেই বুঝাতে পারি না। আর কষ্টের কথা অন্য কাউকে বলতে না পারলে সে কি কষ্ট হয়, সে আমি ভালো বুঝি। আপনারা ওসব বুঝেন না। আপনারা তো সুখে আছেন। বাবার খেয়ে রাজার মতো চলছেন। সে যা হোক, আমি আর আপনাকে যখন-তখন জ্বালাতে চাই না। তাই আমি আমার কষ্টগুলো রাখার একটা স্থায়ী জায়গা চাই।
ঃ মানে? ভ্রু কুঁচকালো রিদু। এটা আবার কেমন কথা?
ঃ বুঝলেন না? হ্যাঁ, না বুঝাটায় স্বাভাবিক। সুখিরা দুঃখিদের কথা বুঝতে পারে না। তাই সুখির কাছে দুঃখিদের কথা পাগলের প্রলাপের মতো শোনায়। কিন্তু তবু দুখিদের এই পাগলামোর প্রলাপ যে তাদের কাছে বড় সান্ত্বনা সে আপনি বুঝবেন না। নাই বা বুঝলেন; এখন শুধু এটুকু বুঝুন যে, আমার একটা ডাইরি চাই। আমাকে একটা ডাইরি দিন।
ঃ ডাইরি! আবার ভ্রু কুঁচকালো রিদু। ডাইরি তুই কী করবি?  
ঃ ডাইরিতে আমার মনের জমানো কষ্টগুলো লেখে রাখবো।
হাসলে রিদু।
ঃ কী বলছিস মোরগ! তুই লেখবি? তুই আবার লেখাপড়া কী জানিস?
ঃ হ্যাঁ, জানি তো।
ঃ লেখতে পারবি?
ঃ হ্যাঁ, পারবো।
অবাক হলো রিদু। মোরগের দিকে তাকালো সে। তাকে অনেক দুখি দেখাচ্ছে। কটা ভাত দিলো তার পাত থেকে। বললো,“নে, খেয়ে নে।”
মোরগটা খাচ্ছে না দেখে রিদু বললো,“ কী হলো, খাচ্ছিস না কেন্?”
মোরগ মনমরা হয়ে বলে,“ক্ষিধে নেই। ভালো লাগছে না।”
ঃ কেন? পুরুনো কথা মনে পড়ছে?
ঃ হ্যাঁ।
ঃ তোর ভূত বন্ধু কোথায়?
ঃ ওর বাবার কাছে গেছে। ওর বাবা অসুস্থ।
ঃ তাই বুঝি তোর একা একা লাগছে?
এ কথা শুনে কান্না পেলো মোরগের। কথা বলতে পারছে না সে।
ঃ কী হলো? রিদু বললো।
ঃ কিছু না।
ঃ বললেই হলো। আচ্ছা মোরগ, আমি তোকে ডাইরি কিনে দিলে তুই কী লেখবি?
ঃ কী আর লেখবো! পৃথিবীতে যাদের কেউ বেঁচে থাকে না তাদের যে কষ্টগুলো প্রতি মুহূর্তে তাদের কীভাবে পিড়া দেয় সেগুলো আমি আমার মতো করে লেখবো।  
ঃ তাই বুঝি! তো ঠিক আছে, এখন আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে। তুই তোর লেখা তৈরি কর; আমি ডাইরি দিচ্ছি।
রিদুর চলে যাওয়া দেখে তার মা রুমে ঢুকেই মোরগকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,“এই মুরগাটাকে নিয়ে আর পারি না। সারাদিন এতো জ্বালায়, কে জানে কিসে মুখ দিলো।” তারপর,“হই।” বলেই হাতের কাছে একটা লাঠি দিয়ে দিলো এক ঘা।
মোরগ তো ভাবতেই পারেনি এমনটি হবে। সে তো কোনো অপরাধ করেনি। ইস, পাটা আর একটু হলেই ভেঙ্গে যেতো। ঘর থেকে দৌড়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাটাকে দেখছে এমন সময় পেছন থেকে একটা ও বাড়ির ডাকনি মুরগি এসে দিলো এক ঠোকর। মুহূর্তে মনে হলো, পিঠের মাংসগুলো খুলে গেলো। মোরগ তারো প্রতিবাদ করতে পারলো না। মনে পড়লো তার মায়ের কথা। মা যখন তাকে আদর করতো তখন কেউ তাকে একটু মারতে চাইলেই মা তাকে বাঁধা দিতো। ভয়ে কেউ তার ধারের কাছে আসতে পারতো না। আজ মা তার আর আপন নেই। মায়ের এখন অনেকগুলো নতুন বাচ্চা হয়েছে। তাদের নিয়ে সে সুখেই আছে। তার কথা ভাববার আর সময় মায়ের কোথায়?
মোরগ আর কিছু বললো না কাউকে। রিদুর ঘরে গিয়ে তার টেবিলে রাখা একটা ছোট সুন্দর মলাটের ডাইরি নিয়ে লেখতে বসলো। লেখছে মোরগ তার মনের কথা ঃ
“আমি যেন এক জনম দুঃখি। আমার চারধারে কেউ নাই। কোন্ পাপে বিধাতার বিচারে আমি এমন এতোটা একলা জানি না। জন্মের পর থেকেই কাউকে দেখিনি। আমরা অনেকগুলো ভাই-বোন ছিলাম। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুরতায় সেবার অসুখে পড়ে একে-একে সবাই বিদায় নিলো পৃথিবী থেকে।
আমার চাচা, মামা, খালা, নানা-নানী কেউ রইলো না। আর আমি ভালোই ছিলাম। একটি মাত্র সন্তান আমি মায়ের তাই আমার সুখের সীমা ছিলো না। মালিকের রাজ্যে মাত্র দু’টি মোরগ-মুরগি। তাদেরও সে কি আদর। যখন-তখন বেশি বেশি খাবার দেয়। আহা! অল্প দিনেই বেড়ে উঠলাম আমি। কিন্তু সে সুখ আমার বেশিদিন সইলো না। মা আর আমাকে তেমন একটা আদর করেন না। সন্তান বড় হলে যা হয় আর কি? আমার কিছু ভালো লাগে না। মনে হয় আমার ভালোবাসা আর নাই। বাড়তি এক ধরনের আদর করে মালিকেরা। ঠিক রবি ঠাকুরের সে কথাটির মতো।


সুখ গেছে আছে শুধু
    সুখের ছলনা হৃদয়ে তোর
প্রেম গেছে- আছে শুধু
 প্রাণ-পণ মিছে আদর।

আমার ভালো লাগে না কিছু। সব সময় একা একা লাগে। মনের কথা বলার কেউ নাই। চারপাশে শুধু অনাদর আর অবহেলা।” হঠাৎ ভূতের আগমনে লেখা রেখে ফিরে তাকালো সে। দেখলো ভূত বন্ধু তিতুর সঙ্গে তার বাবা এসেছে। তিতুর বাবা মোরগকে দেখে বললো,“ভেবো না বাছা, এখন থেকে তুমি আর একা নও। আমরাও এখন থেকে তোমার সঙ্গে থাকবো। মোরগ হয়েই থাকবো।”
হঠাৎ মোরগের মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। সে মনের সুখে জোরে একটা ডাক ছাড়লো কু-ক্-রো কুক।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৩০০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৫/০৩/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • মোনালিসা ০১/০৪/২০১৭
    কিছুইনা
  • ইমানুর রহমান ৩১/০৩/২০১৭
    অনবদ্য লেখনী আপনার ৷ সত্যিই প্রশংসনীয় ৷
  • শাহারিয়ার ইমন ২৯/০৩/২০১৭
    ভাল লাগল
  • তাবেরী ২৬/০৩/২০১৭
    অনেক সুন্দর লাগল।
  • তাবেরী ২৬/০৩/২০১৭
    অনেক সন্দর লাগল।
  • অবাক করে দিলে বন্ধু!
    সত্যিই চোট্ট একটা থিম Choose করে অনেক বড় মাপের এবং বিশ্ব মানের একটা কম্পোজিশন করলে।

    সত্যিই বাংলা স্বার্থক ছোট গল্পের জগতে একটি অতুলনীয় ছোট গল্প হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।।

    অনেক অনেক ধন্যবাদ
    • রাবেয়া মৌসুমী ২৭/০৩/২০১৭
      গল্পের গভিরে পেৌছাতে পেরেছেন বলে অনেক অনেক ধন্যবাদ।অনেকেই তা পারেনা।শুব কামনা রইলো।
      • অনেক অনেক শুভকামনা রইল বন্ধু।

        আমি শুধু লিখেই যাইনা

        বরং ভাল মানের লেখার মূল্যায়ন মন্তব্য করতেই আমার বড় ভাল লাগে।

        ভালো থাকবেন এই প্রত্যাশা...
 
Quantcast