রাত পোহাবার আগে ১৯
মাসুমের অফিসে তেমন কোনো কাজ না থাকায় পিয়ন বাবুকে ডেকে গল্প জড়িয়ে দিলেন। পারিবারিক অনেক বিষয়েই গল্প করলো তারা। শেষে বলা কথাগুলো তাকে ভাবিয়ে তুললো। পিয়ন জানালো, মাসুম মাল ডেলিভারী পেপার্সসে সাইন না করায় রাজু আহম্মেদ গিয়েছিলো ম্যাডামের কাছে। ম্যাডাম নাকি খুব রেগেছে। যা তা বলেছে মাসুমের নামে। রাজু আহম্মেদ সে সব কথা সকল কর্মচারীদের কাছে দিগুণ করে বলে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে আরো একটু বাড়িয়ে বলেছে যে, মাসুম সাহেব ক্ষমতা পেয়েই তার অপব্যবহারে কোম্পানীকে তলিয়ে দেবার বৃথা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মাসুম অবশ্য কিছুটা প্রস্তুত ছিলো এমন একটা পরিস্থিতির জন্য। কিন্তু এতোটা বেশি নয়। তার ধারণা ছিলো যে, প্রথমেই তার চাকরীটা চলে যাবে। সে আশংকাটা এখনো রয়ে গেছে তার অন্তরে। পিয়ন বাবু চলে যেতেই মাসুম একবার কোম্পানীর কর্মচারীদের মধ্যে যাবার কথা ভাবলো। তার ধারণা, সেখানে গেলেই পরিস্থিতি কিছুটা অনুধাবন করা যাবে। কিন্তু মাসুম সেখানে গিয়ে যা জানালো তাতে তার মস্তিষ্কে বর্জপাত ভেঙ্গে পড়লো। সে নাকি এমডি কন্যাকে বাগাতে না পেরে তার প্রতিশোধ নেবার জন্যই কোম্পানীর এতো বড় একটা ক্ষতি করলো। মাসুম ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়লো।
কিন্তু সে ভাব গোপন করে স্বাভাবিক হবার চেষ্টায় রাজু আহম্মেদকে ডাকলো।
রাজু আহম্মদ এলো তবে তার মুখ-চোঁখের ভাব এমন যেন তার সঙ্গে মাসুমের আর জনমের শত্রুতা। মাসুম রাজু আহম্মেদকে দেখে হেসে বললেন,
“কী ব্যাপার রাজু সাহেব, শরীর খারাপ না মন খারাপ?”
কথা বললো না রাজু। শুধু দেখলো একবার।
মাসুম বললো,“যা হোক, স্যার তো কাল অফিসে আসছেন। আর মিস অদিতাও কাল থেকে জয়েন্ট করছে। আমি দু’দিন ছুটিতে থাকবো। আর হ্যাঁ, সামনে মাসে সম্ভবত আমরা একটা নতুন প্রজেক্ট পাচ্ছি। যাতে আমরা আমাদের কোম্পানীর তৈরিকৃত মাল সরবরাহ করতে পারবো।”
মাসুম আর কিছু বললো না। রাজু আহম্মেদ এতোক্ষণে কি একটা বলতে গিয়ে কথা পাল্টালো। তারপর বললো,“স্যার, আমি কী এখন আসবো।”
মাসুম আবার তাকালো রাজু আহম্মেদের দিকে। বেচারার চোখ-মুখ মলিন। তা হ্যাঁ, আসুন। তবে এই খাতাগুলো নিয়ে যান। কাল স্যারকে দিবেন।
ঃ জ্বি, আচ্ছা। বলে চলে গেলো রাজু আহম্মেদ।
মাসুম উদাস হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। রাজু আহম্মেদের এতোদিনের সাধনা, স্বপ্ন সব যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। আর এর জন্য দায়ি মাসুম সাহেব। মাসুম সাহেব প্রথম থেকেই ঘোর শত্রুতা করে তার নিজে না করতে পারবে না অন্যকেউ করতে দিবে না। একবার নয় বার বার হেরে গেছে রাজু মাসুমের কাছে। কিন্তু এতোবেশি বেশি কষ্ট রাজু এই প্রথম পেলো। তবে কি এমনি করেই বার বার কষ্ট পাবে রাজু? বার বার হেরে যাবে?
না, তা হতে পারে না। যে করেই হোক জিততে চায় সে। জিততেই হবে তাকে। হ্যাঁ, অদিতা অদিতাই একমাত্র ব্যক্তি সে পারে রাজুকে জিতিয়ে দিতে। অদিতা তার কথা শুনে। তাকে পছন্দ করে। তার ভালো-মন্দ ভাবে। রাজু তাকে যা বুঝাবে তাই বুঝবে। অবোধ সে বালিকা। তাকেই কাজে লাগাবে রাজু। লাগাতেই হবে তাকে। বুঝিয়ে দিতে মাসুমকে। রাজু আর একা নয়। স্বয়ং ম্যানেজার কন্যা তার সঙ্গে আছে।
মাসুম অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলো অপূর্ব অপরূপার বস্তি মুখি গলিতে। অফিস ছুটির অনেকটা পর বেরিয়েছে সে। মনটা ভালো নেই তার। মন তো জানে পরিণামের কথা। এখন সমস্যা হলো, কীভাবে সংসারটাকে টিকিয়ে রাখবে । এক মাসুমের উপর নির্ভর করে বোনদের লেখা-পড়া। আবার সংসার চালানো। এখন যদি সেই মাসুম হয়ে যায় সংসারের বোঝা তাহলে তার চলবে কি করে দিনগুলো? চোখগুলো অকারণে জ্বালা করছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। চোঁখের সামনে ভেসে উঠছে তার মা’র অসুস্থ মুখের ছবি। মা যেন কান্তি নিয়ে জোর করে জড়িয়ে জড়িয়ে বলছে, ভাবিস না বাবা। ভেঙ্গে পরিস না। যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন। সত্যের পথে কেউ হারিয়ে যায় না। একটু কষ্ট হয়। তুই ধৈর্য ধর। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্যশীলকে আল্লাহ নিজে পুরস্কার দেন।
মা। মা গো তুমি কোথায়। এ কি বলছে মাসুম। সে কি অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে! এমন লাগছে কেন তার। দূর থেকেই দেখতে পেলো মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। মাসুম এই দু’দিনে তার খোঁজ নেবে, কে এই মেয়ে? কী তার পরিচয়? এই ভেবেই সে ছুটি নিয়েছে। অবশ্য, ছুটি কাটার পেছনে আরো একটি কারণ আছে। তা হলো, এতো বড় একটা অপরাধ কারে এমডি কন্যার সামনে অত্যন্ত কিছুটা সময় না থাকায় ভালো। যেহেতু সে তাকে সইতে পারে না। রাগ কমলে হয়তো তার আর এতো খারাপ লাগবে না।
মাসুম দেখলো, মেয়েটা কেমন যেন উদাস হয়ে আছে। তাকে দেখেই একটু হাসলো। পরক্ষণেই চোঁখের পানি মুছলো। মেয়েটা কী কাঁদছিলো? কিন্তু কেন? মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেলো তার। দাঁড়ালো সে নির্বাক সেই দেবীর দিকে চেয়ে । ভাবলো, এমন যদি হতো একটি সুন্দর প্রাসাদের চূঁড়ায় মাসুম তার প্রাণের দেবীকে সাজিয়ে রাখতো তার নির্বাক প্রেমের স্বাক্ষী করে জনম জনম ধরে।
এমনি একটি মিষ্টি হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো প্রিয়া তারি প্রতিক্ষায়। যুগে যুগে অসংখ্য লোক দেখতো তাকে, তাদের ভিড়ে খুঁজতো প্রিয়া তার প্রিয় পুরুষটিকে। মাসুম ফিরে আসতো সহস্র প্রেমিকের অতৃপ্ত সৃষ্টির অন্তরায়।
কার কথাই চমকে উঠলো মাসুম।
ঃ কি হে। এখানে বসে এভাবে কার ধ্যান করছো?
একটা মাতাল লোক এসে তার কাঁধে হাত রাখলো।
একে কোনো দিন দেখেছে বলে মনে হলো না মাসুমের। লোকটা বলেই চলেছে,“ভুলে যাও। সব ভুলে যাও। আগে-পিছে যতো মায়া সব মিছে।” লোকটার কথাই করুণ শব্দ শুনতে পাচ্ছে মাসুম।
লোকটার একটা হাত ধরে সামনে বসালো মাসুম।
প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটাও তাকিয়ে আছে তার দিকে।
লোকটা বসতে চেয়েও বসলো না।
সেই একই কথা বার বার বলে চলে গেলো।
মাসুম তাকালো প্রিয়ার দিকে। না, কেউ আসছে না তাকে তাড়িয়ে দিতে। মাসুম চমকে উঠলো ভূত দেখার মতো।
মেয়েটা ইশারা করছে। মাসুমের মনে হলো যে, মেয়েটা বলছে তাদের বাসায় যেতে। মাসুম কি করবে বুঝতে পারছে না।
আজ তার সে রকম কোন প্রস্তুতি নেই। কাল তাদের বাসায় যাবে একবার যে করেই হোক, জানবে তার আসল পরিচয়। সরাসরি একবার কথাও বলবে মেয়েটার সঙ্গে। তাকে জানাবে তার মনের কথা।
জানাতে হবে, কেন ? সে কি জানে না বলেনি মাসুম ? সব কথা কি মুখেই বলতে হয়। মাসুমকেও তো কখনো বলেনি মেয়েটা। তবু মাসুম জানে অনেক বেশি জানে তাকে। আর তাকে পাবার জন্য সেটুকুই যথেষ্ট ।
কাঁদছে মেয়েটা বারবার চোঁখ মুছছে। খারাপ লাগছে মাসুমের। সে ও ইশারা করলো চোখ মুছো আর কেঁদনা। মেয়েটা বুঝলো কিনা কে জানে। মাসুম হাসলো। হাসানোর চেষ্টা করলো তাকে।
না হাসালো না মেয়েটা। কাঁদছেই আর চেয়ে আছে মলিন দৃষ্টিতে। মায়া লাগছে মাসুমের। ইচ্ছে করছে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিতে। অশ্রু মুছে দিয়ে বলতে, এতো কান্না কীসের? আমি তো তোমার কাছেই আছি, খুব কাছে। ভয় নেই, হারিয়ে যাবো না। চেয়ে আছে মাসুম। চেয়ে থাকার মধ্যেই যেন সব সুখ তার। আবার হাত ইশারা করলো মেয়েটা। কি যেন বুঝাতে চাইছে তাকে। বুঝতে পারছেন না। তবু মনে হলো, চলে যেতে বলছে না তো। হ্যাঁ, তাই বলেছিলো মেয়েটা। একটু পরেই ইয়া মোটা এক সুপুরুষ বেরিয়ে এলো মেয়েটার কাছে। তাকে ইশারা করতেই হাত ইশারা করে চলে গেলো মেয়েটা। মাসুমের বুকটা ধক করে উঠলো। কিছুক্ষণ পরে চলে গেলো সে। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
চলবেই
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
তাবেরী ১৬/০৩/২০১৭অনেক ভাল।
-
রবিউল হাসান ১৬/০৩/২০১৭বেশ ভালো লাগলো।
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ১৬/০৩/২০১৭দারুণ
একটি থেকে আরেকটি যেন আরো মজার লাগে।।
ধন্যবাদ