www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

রক্তাক্ত সূর্যোদয়

রাহেলা বেগম চালের গুড়ি রোদে দিচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন বাদলের কথা। আজ বাদলের রেজাল্ট হবে। হঠাৎ স্বামীর কন্ঠ শুনে সে দিকে তাকালেন তিনি।
দেখেছো বাদশার মা? বাদল এবারো অনেক ভালো করেছে। বাদল আমার বিশ্বাসের উপযুক্ত মর্যাদা রেখেছে। আজ ,আজ আমি মাথা উচু করে বলতে পারবো আমি কোন পোঁকা লাগা গাছ লাগাইনি। আমি ভালো বীজে ভালো গাছ লাগিয়েছি, ভালোফল ও পাবো ইনসাল্লাহ। দেখে নিও, এ বাদল আমাদের মুখ উজ্জল করবে..অসময়ে হাসতে হাসতে কথাগুলো বলতে বলতে বাসায় ঢুকলেন সওকত বাসার।
আলহামদুলিল্লাহ। হ্যা, বাদল আমাদের সরল মানুষ বুদ্ধি ও ভালো, তাই ওকে নিয়েই সকল আশা ভরসা, বাদশা টা কিছু করতে পারলো না, সারা দিন কি সব দলদর বার করে বেড়ায়, এত করে বললাম মার্ষ্টাসটা শেষ করে একটা চাকুরি বাকুরি কিছু কর । কে শুনে কার কথা। শুধু মিটিং আর মিছিল করলেই চলবে ? অভাবের সংসার উপযুক্ত সন্তান হয়েও..।
হ্যা বাদশার মা, তুমি ঠিকি বলেছো, চুলে পাক ধরেছে, আমি আর ক’দিন বাঁচবো ?
এই যা, তোমার আর বেশি কথা বলা স্বভাবটা গেল না । গাড়ির শব্দে সে দিকে তাকালেন রাহেলা বেগম। উভ্রান্ত উসকো খুসকো চেহারায় বাদশা প্রায় ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে। একরাশ অপ্রসন্নতা তার মলিন অধরে।
মা, ওমা। বাবা বাড়ি ফিরেছে?
হ্যা সে ফিরেছে, কিন্তু তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে তোর, কোন বিপদ হয়নিতো বাবা ?
কি যে বল মা, কই আমার তো কিছুই হয়নি? তুমি শুধু মিছে মিছি ভাবো। কই বাদল ফিরেছে, বাবুলটা যে কোথায় যায় কি করে?
না তোর বাবা সবে ফিরলো।
বাবা ফিরেছে ? ভালোই হল। মা তুমি একবার বাবাকে বলনা গ্রামে গিয়ে চাচাদের সপরিবারে নিয়ে আসুক? কতদিন ওদের দেখিনা দুষ্ট পরীটা বুঝি বড় হয়ে গেছে?
হ্যা,পরী এবার এস এস সি পরিক্ষা দিয়েছে। ভাবছি এবার তোদের বিয়েটা দিয়ে তোকে ঘরে আটকাবো।
কি যে বল মা, সে আর আমাকে দিয়ে হবেনা। আমি কি আর বন্দী থাকতে পারি, বাইরে আমার কত কাজ..তাছাড়া বন্দী জীবন আমার একদম ভালোলাগে না ।
কাজ, কিসের এত কাজ তোর শুনি ? রাগ করে মা। বাদশা বারান্দার হাতল ভাঙ্গা চেয়ারটায় বসে। মা বলেই চলেছে, সারা দিন খাওয়া নেই দাওয়া নেই লেখা পড়াও ছাড়লি, কিসের সব রাজনীতি করে বেড়াস, ও সব রাজনীতি দিয়ে কি হবে ? পেটে ভাত নেই, দেশের সেবায় ব্যাস্ত, ও সব দেশ প্রেমিকের কাজ। দুনিয়াতে বাঁচতে হলে টাকার দরকার । আর টাকার জন্য কাজ করতে হয়। ওসব উদাসিনতা ছেড়ে কাজে মন দে ,আমার আর ভালোলাগেনা। মা বাদশার কাছে এসে শান্ত কন্ঠে বুঝান তাকে। ও সব ছেড়ে দে বাবা। বিয়ে করে সংসারি হ। তুই আর যাসনে...
মা তুমি কি বলছো ? তুমি না আমার মা, আমার অহংকার। আমার শক্তি। তুমি কি চাওনা মা, এই দেশ, এই মাটি এই মায়ার মাতৃভূমি, তার অপার স্নেহের মমতার চাদরে জড়িয়ে থাকতে এখানেই তো সব সুখ মা। মাগো এই যে সবুজ শ্যামল প্রকৃতি এখানে নদীর বয়ে চলা, পাখির গান, মাঠে মাঠে সবুজ সোনালি ফসল, সব কিছুতেই যেন বাঙ্গালি মনের মাধুরি মেশানো সুখ।
আচ্ছা মা তুমি কি চাও এ সুখ হারাতে? তুমি কি চাও এ মায়ার মমতা ভুমি অন্যতে বিলিন হয়ে যাক ? ন্যায়ের মুখোশ পরে অন্যায়ের শোষকরা দেশটাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিক, তুমি কি পারবে মাগো অরাজকতার দূর্বিপকে নিষ্পেশিত হয়ে কিছু দালাল আর ভিনদেশিদের বদশোসনের কারাদন্ডে নিজ অস্তিত্বকে রুদ্ধ করে বাঁচতে? ওরা যে ছিনিয়ে নিতে চায় আমাদের মাতৃভাষা। বাংলা ভাষায় কথা বলার সবটুকু আধিকার, উদাস হয় বাদশা রাগে অভিমানে শক্ত হয়ে যায় তার চেতনা।
এ তুই কি বলছিস বাদশা। এ দেশ তো আমাদের কিন্তু ওরা কারা ?
মা মাগো, তুমি জানোনা মা,ওরা সুযোগ পেয়ে বাঙ্গালির বুকে আঘাত হানার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে আর ওদের মদদ দিচ্ছে এ দেশেরি কিছু বিশ্বাস ঘাতক। ওরা আস্থে আস্থে এগিয়ে আসছে। হয়তো যে কোন মহূর্তে ঝাপিয়ে পড়তে পারে আমাদের এই বাঙ্গালিদের উপর। বাংলাকে সমুলে উৎখাত করাই ওদের উদ্দেশ্য।
এ কি বলছিস তুই?
হ্যা মা, কিন্তু ওরা জানেনা, ওরা কেবলি বাঙ্গালিকে দেখেছে, শান্ত বাঙ্গলিদের উদার সজীবতা দেখেছে, দেখেছে বাঙ্গালিদের অসহায়ত্ব, কিন্তু ওরা জানেনা তিল তিল করে বেড়ে উঠা বাঙ্গালি দামাল ছেলেদের কথা। এ দেশ মা তার বুকের স্নেহ ঢেলে তাদের লালন করেছে। এখন আর একা নয় সে, এই মায়ের বুকে একটা আঁচড় পড়তে দেবেনা তারা, এই মাকে বাঁচাতে রক্ত দেবে, জীবন দিবে, হাজারো বাঙ্গালি প্রস্তুত আজ । এ মা যে আমাদের ভালোবাসা মাগো, লাখো লাখো মানুষের প্রণয় ভূমি। এ ভূমিতে নিজের ভাষার অপমান..
উদাস হয়ে ছেলের কথা শুনছিলেন রাহেলা বেগম, এবার যেন বললেন কিছু-হঠাৎ দেশটা এমন হল কেন বাদশা? চোখ বুজলেই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি কান্নার হা হা কার, বাতাসে ভেসে আসে তাজা রক্তের গন্ধ, আর বারূদ বুলেটের গর্জন। তবে কি সত্যি সত্যি ওরা...?
হ্যা মা, ওরা অনেক আগে থেকেই সাজিয়েছে বিস্তর ষড়যন্ত্র। দেশের অবস্থা মোটেও ভালো না। বাবুল আর বাদলটা যে কোথায় গেল। ওদের সঙ্গে কথা বলে আমায় একবার যেতে হবে। যেতে হবে শুনেই যেন চমকে উঠলেন রাহেলা বেগম। কোথায় যেন কুকিয়ে উঠলো তার। বাদশাকে ডাকতে ডাকতে বাদশার পাশে এসে দাড়াইলো তমাল। তমাল তাদেরই দলের ছাত্র সদস্য। পাশা পাশি থাকে ওরা।
বাদশা ভাই ? কি খবর ও দিককার। সুযোগ টাকে কাজে লাগালো রাহেলা বানু, দ্রুত ঘরে গিয়ে স্বামীকে চুপি চুপি বললেন ওগো শুন বাদশাকে এবেলা থামাতেই হবে, ওকে বাঁচাতে হবে, ও যে বড়ই জেদি আর বেশামাল।
মা ওমা, কোথায় তুমি এসোনা ,আমার এখনি বেরুতে হবে যে।
কোথায় যাবি বাদশা?
ও তুমি চিনবেনা মা । কখন কোথায় যাবো ..
না বাদশা, এ সংকট মূহুর্তে আমি তোকে কোথাও যেতে দেবনা বাবা।
এ তুমি কি বলছো মা? তুমি কি পাগল হলে, এই চরম মূহুর্তে হাতগুটিয়ে ঘরে বসে থাকবো? দেশের প্রতি এই কি তোমার শ্রদ্ধা বোধ, এই তোমার ভালোবাসা। অথচ একটু আগেই তুমি বললে এ দেশ আমাদের ।আমাদের দেশ আমাদের মা, সেই মায়ের মুখের ভাষা কেড়ে নিবে আর আমরা লুকিয়ে রবো ? কিন্তু কেন মা, ভয়ে? যদি মরে যাই ? এই কি তোমার মাতৃত্ব..
বাদশা..তুই এখন বুঝবিনা বাবা, তোর সন্তান হলে তখন বুঝবি সন্তানের বিপদ আশঙ্কা মা বাবাকে..
না মা , তাই বলে তুমি আমাকে বাঁধা দিও না, আমি তোমার কথা শুনতে পারবো না , পারবো না অভিশাপ্ত জীবন নিয়ে বাঁচতে। তুমি দোয়া কর মা, অকুতো ভয় তোমার ছেলেরা বীরত্বের সঙ্গে লড়বে, প্রতিবাদ করবে, সংগ্রাম করবে, প্রয়োজনে জীবন দিবে। তোমার ছেলেরা ভীরু নয়।
সাব্বাস বেটা, সাব্বাস! এই না হলে তুই আমার ছেলে ? কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বাদশার বাবা সওকত বাসার। মুখে একরাশ গর্বের উজ্জল হাসি।
বাবা!
হ্যা রে বাদশা, বাপ আমার। সত্যিকারের দেশ প্রেমিকেরা মৃতুকে ভয় পায়না। বাদশার মা তুমি মনে রেখ, তুমি জেনে রেখ-
সত্যে পথের সৈনিক যারা
সত্যের সংগ্রামে
নিঃবিঘ্নে এগিয়ে চলে
জীবনকে বাজি ধরে।
ঢুবায়ে দিতে অসতের তরী
ছিনিয়ে আনিতে জয়
মৃত্যু সেতো হয়না মরণ
হয়না জীবনের ক্ষয়।
বলি, হে জোয়ান তব দুহাতে ধর
সত্যর তরবারি
অন্যায়ের কালি মুছিয়া ফেলিতে
মিথ্যেকে দিতে বলি।
বাবা তুমি..
হ্যা ,আমি একদিন রাজনীতি করার জন্য তোকে দুরে ঠেলে দিয়েছিলাম, আর আজ এ দেশের স্বার্থে তোকে সপে দিলাম। তুই দেশের জন্য লড়াই করবি, ভাষার জন্য অস্ত্র ধরবি, শুধু তুই নয় হাজার হাজার বাদশা এ লড়াই করবে । আমি তোকে পিতা হয়ে উৎসর্গ করলাম। ফি আমান ইল্লাহ।
এ তুমি কি বলছো ?
হ্যা, তুমিও মা হয়ে বাদশার জন্য দোয়া কর।
না না, আমি ওকে এভাবে যেতে দিব না। শোন বাবা, আমার কথা শোন। একটু পরে যাস..
কি এত শুনবে শুনি, হুঙ্কার ছাড়েন সওকত বাসার। দেশের অবস্থা খারাপ। আর কত মুখ বুজে শইবো আমরা বাঙ্গালিরা।
তাই বলে আর কি কেউ নাই ঐসব করার জন্য আমার বাদশা ছাড়া?
মা তুমি কি বলছো, আর কোন বাদল, বাদশাও তো কোন মায়ের সন্তান। তুমি কাঁদবে না তাদের কাঁদাবে এ কেমন তোমার স্বার্থপরতা। তুমি তো মা, আমাকে দেশের জন্য হাসি মুখে বিলিয়ে বাঙ্গালি জাতির মধ্যে খুজে নিয়। আমি চল্লাম, আমার অনেক দেরি হয়ে গেল। তাছাড়া মিমাংসার কথা চলছে মা, ওরা আমাদের দাবি মেনে নিলেই আর কোন সমস্যা হবে না, আমরা কোন সংঘাত চাই না, হানা হানি চাইনা, সন্ধি চাই,অরাজকতার অবসান চাই, বাংলা ভাষায় কথা বলতে চাই, আমাদের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই ...। বাবা মা,পরে কথা হবে,আসছি..।


বাদশা যাসনে শোন আমার কথা শোন বাবা। বাদশার সামনে গিয়ে দাড়ায় মা। তোকে বাঁধা দিবনা, অনেক কষ্ট করে অনেক কাঁঠ-খড়ি পুড়িয়ে বড় করেছি তোকে। জানি দেশের জন্য এ ত্যাগ তোর মহত্বি, তবুও আমাদের প্রতি তোর কিছু কতর্ব্য আছে। আমি এ ও জানি এমন সংকট মহূর্তে দেশ রক্ষা করার চেয়ে বড় কতর্ব্য কিছু নেই, তার পরও..।
সে কি! বাবা, মা যে কাঁদছে ? প্রিজ মা তুমি কাঁদবে না ।
হ্যা কাঁদবোনা, আগে বল আমার একটা কথা শুনবি ?
আচ্ছা বল,
তুই একবার আজকেই গ্রামে গিয়ে তোর চাচাদের সপরিবারে নিয়ে আয়। তোর বাবা যেতে পারছেনা..বাদশা বুঝতে পারে মায়ের চালাকি, মা তুমি বুঝতে পারছো না..
না আমি বুঝিনা, বুঝতে চাইনা।
লক্ষী মা, রাগ করোনা বাদশা মায়ের খুব কাছে দাড়ায়। গ্রামে বাদলকে পাঠিয়ে দাও, সেই বরং গ্রামে কদিন থেকে আসুক। ঢাকার যে অবস্থা, কখন কি হয়। আনমনা হয় বাদশা।
বাদশা। যা না বাবা, তোর মা যখন এত করে বলছে তাছাড়া তোর চাচিও তোকে একবার যেতে বলছিল।
বাবা। বাবা তোমরা বুঝতে পারছো না।
হা রে বলছি তোর মায়ের জন্য বেচারি..। মাত্রতো একটা রাতের ব্যাপার? তুই বরং আজ রাতেই চলে গিয়ে সকালের গাড়িতে ফিরবি?
আচ্ছা ঠিক আছে,আজ একটা জরুরি মিটিং আছে। মিটিং শেষে রওনা দিব, যদি সময় পাই। আর তোমরা বাদল বাবুল কে সাবধানে দেখে রেখ। কই ওরা তো এখনো এলোনা? কাল বাবুল টাকে অনেক করে বকেছি তাই না মা ? তুমি রাগ করেছিলে? বাদল ওকে বেশি ভালোবাসে। ওকে দেখে রেখ।
তুই পায়েস খেতে চেয়েছিলি রেধেছি খেয়ে যা?
ওহ রেধেছো, সেতো বাদলেরো পছন্দ। ওরা তো নেই, তাহলে বাসায় এসে সকলে এক সঙ্গে খেয়ে তার পর গ্রামে যাবো।
চলি মা, চলে গেল বাদশা..।
মা চেয়ে দেখছেন বাদশার চলে যাওয়ার পানে, চোখে মুখে এক রাশ বিদ্রোহ তার।
কোথা থেকে চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো বাবুল। পরনে ময়লা র্শাট আর বাদশার লুঙ্গি। মায়ের মনে হল এ অবস্তায় বাবুলকে দেখলে বাদশা নিশ্চয় মারতো। আর অমনি চেঁচিয়ে কেঁদে বাড়ি টাকে মাথায় তুলতো বাবুল। ভাগ্যিস বাদশা চলে গেছে। এই ছোট আর বড়তে একটু ক্ষন বনি বনাত নাই। বাবুল অবুঝ,বাদশা যা মানতে চায়না বাবুল তাই করে। অথচ বাদল ওদের দুজনার চেয়ে একে বারে ভিন্ন। বড় শান্ত আর নিরব স্বভাবের সে। মেধাবি এ ছেলেটার প্রতি অন্য এক ধরনের মায়া যেন জয় করেছে সকলের অন্তর। বাবুল দুষ্টামি করে মার খেয়ে কাঁদলে তার প্রথম শান্তনা বাদল। দুষ্টামিতে সেরা হলেও সুবোধ ছেলেটি বাদলের স্নেহে পোষ মানা যেন। বাবা মায়ের কাছে বাবুলের যতটা আবদার নাই তার দিগুন বাহনা বাদলের কাছে। বড় বেশি ভাব দুজনাতে। আর তারই রেশ ধরে বাবুলের এই বৃথা চিৎকার। কাল সকালেই তার নতুন জামা চাই, স্কুলে যাবার আগেই নতুন বই চাই, জুতা চাই। তার সহ পাটি রতনের বাবা রতনের জন্য স্কুল ড্রেস কিনেছে বই কিনেছে ,আর তার কিছু কেনা হয়নি এখনো ?
এই ছেলে এ সব কাকে শুনাচ্ছো শুনি? বলেছিই তো, কাল তোর বাবার বেতন হবার কথা, হলেই সব কিনে দিব। রাগ দেখালেন রাহেলা বেগম, বাদশার জন্য মনটা ভিষণ খারাপ লাগছে। বড় জেদি আর একরোখা ছেলে, না জানি কখন কি করে বসে। বাবুল বলেই চলেছে কত কথা, রাহেলা বেগম শইতে না পেরে দিলেন এক পিটনি, মার খেয়ে চিৎকার করে পালাতে গিয়ে বাদলের সঙ্গে ধাক্কা লাগলো। বাদল জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে?
বাবুলের কান্না বেড়ে গেল, কাঁদতে কাঁদতেই বললো। ভাইয়া দেখনা মা আমায় বড় লাঠি দিয়ে মেরেছে ? অনেক জোরে মেরেছে ?
তুই নিশ্চয় দুষ্টামি করেছিস?
না আমি শুধু বই আর জুতা কিনে দিতে বলেছিলাম..
ঠিক আছে ভাই আর কাঁদিস না। আমি তোকে সব কিনে দিব। আর এখন মার কাছে যাস না মার মনটা ভালো নেই।
বাবুল ফুপাতে ফুপাতে চলে গেল।
অনেক রাত। গাঢ় অন্ধকার। গোটা শহর যেন অজানা অতংকে শংকিত এক থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। বাদশার সব কথায় শুনেছে বাদল। মা বাদশার কথা বলতে গিয়ে সে কি কান্না, বাদলেরও কান্না পাচ্ছিল তবুও কাঁদেনি সে। আকুত ভয় বীর ভাইটি যে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে এতটুকু মায়ার টানে সে কেন কেঁদে তার চলার পথকে ভিজিয়ে দিবে? নিরবে সব শুনেছে বাদল।
ঘুম আসছে না দুচোখে। বাদশা ফিরেনি, কাল সকালে একবার খোজ নিবে সে। সত্যি কি সে গ্রামে গেছে, বাবার ধারনা বিশ্বাস হচ্ছেনা তার। পরিস্থিতি ভালো না, চার দিকে চলছে বাংলা ভাষাকে কেড়ে নেবার গোপন ষড়যন্ত্র। কিন্তু বাঙ্গালিরা বাংলা ভাষাকে ছাড়বেনা, জীবন দিতে প্রস্তুত ওরা।
সারারাত ঘুম হল না, কিসের যেন উত্তেজনায় প্রচন্ড এক হাহাকার। শুণ্যতা আর আত্ম বিদ্রোহে উদিত হল প্রভাতি কিরন রবি। ফজরের নামাজ পড়েই শুণ্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে বাদল। ব্যাস্ত শহর যেন অষাঢ় ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়েছে। কোথাও কোন সাড়া নেই, জন মানুষের দেখা নেই, সকলেই গা ঢাকা দিয়ে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজ নিজ গৃহে। আর কেন বা ঘুমাবেনা জাগলেই যদি শব্দ হয় আর তাতেই যদি জীবন টা চলে যায়। চলছে বাদল এই তো সামনেই তার গন্তব্য।
সকাল আটটা বাজে, বাদল কি এখনো জাগেনি? মা রাহেলা বেগম
বাদলের ঘরের দরজায় গিয়ে অবাক হলেন, একি! বাদল আবার কোথায় গেল এত সকালে ?
বাবুল ও বাবুল ওঠতো, দেখ বাদল আবার এত সকালে কোথায় গেল, দেখতো মসজিতে গেল নাকি? বাবুল উঠতে চেয়ে পাশ ফিরে আবার শুলো,
কি হল উঠ না, দেখ একবার। দেশের যে অবস্থা, তোর বাবা তো সারা রাত ঘুমায় নি। বাদশাটাযে কোথায় থাকলো কে জানে? মনটা কিছুতেই স্বস্থির পাচ্ছেনা। টেনশনে সওকত বাসারের হার্ডের সমস্যা বেড়েছে। বাদল ঘরে নাই শুনলে আবার কি হতে কি হয়।
চমকে উঠলো বাবুল দ্রুত চলে গেল সে। বাবুলের এভাবে চলে যাওয়া দেখে গুমড়ে কান্না এলো রাহেলা বেগমের, কেন এমন লাগছে তার বুঝতে পারছেনা তিনি। আঁচলে চোখ মুছে ওজু করতে গেলেন তিনি প্রতি সকালে কোরান পড়েন, আজো পড়তে বসার আগে বাদলের ঘরে গিয়েছিলেন।
মা মাগো শুনেছো? প্রায় হাপাতে হাপাতে দৌড়ে এলো বাবুল, তরুর দাদা বললো একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে। রাস্থায় কেউ বেরুতে পারছে না। বাদল ভাইয়া যে কোথায় গেল । আমার ভিষন ভয় হচ্ছে। বাবুলের কথায় চমকে উঠলেন রাহেলা বেগম। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না। বাবুল ছুটে গেল বাবার কাছে,আব্বা শুনেছো শহরে চুয়াল্লিশ ধারা জারি হয়েছে। চুয়াল্লিশ ধারা কি বাবা? সওকত বাশার আগেই শুনেছেন এ খবর, বাবুলের প্রশ্নে কোন উত্তর করলেন না তিনি। শুধু বাইরে যেতে নিষেধ করলেন তাকে। বাবুল কিছু বুঝতে না পারলেও বুঝতে পেরেছে, বাদশা বাদল তার দু ভাই দেশের জন্য বিপদে পড়েছে।
রাজ পথে মিছিল চলছে, শত শত ছাত্র সে মিছিলে। মানবেনা তারা এ অবিচার,উর্দুকে মাতৃভাষা মানবে না তারা। সকলের দাবি বাঙ্গালির দাবি, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। আর সেই স্লোগানে এগিয়ে চলছে ছাত্র মিছিল। সকলের মুখে স্লোগান হচ্ছে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। হঠাৎ ক্যাদানি গ্যাস ছুড়ায় অস্থির জনতা । অগনিত গুলির শব্দ, মহূর্তে রাজ পথ লাল হল, লুটিয়ে পড়লো তাজা প্রাণ, মিছিল ভেঙ্গে চলে যাচ্ছে যে যার মত। উত্তেজনার মধ্যে থেকে সকলের অলক্ষে হারিয়ে গেল কিছু তাজা প্রাণের নিরব দেহ। তাদের মধ্যে চলে গেল দুরন্ত বাদশা, তাকে আর খুজে পাওয়া গেল না।
বাদল ফিরে এলো ঠিকি, মায়ের বাধ্য সন্তানের মত কিন্তু বাবুলের বুক ভাঙ্গা কাঁন্নাকে থামিয়ে দিচ্ছে না সে। বলছে না আদর করে লক্ষী ভাই আমার কাঁদছিস কেন তুই? কি হয়েছে? ভাইয়া মেরে ছে? মা বকেছে নিশ্চয়? কাঁদিস না চল বাজারে গিয়ে লাঁঠিম কিনে দিব?
সেই যে বাবুল কাঁদছে কেবলি কাঁদছে..ভাইয়ার কাছে অনেক চাওয়া তার, এখন কে তাকে আদর করবে? সওকত বাসার অচেতন হয়ে পড়ে আছে কয়েক ঘন্টা, রাহেলা বেগম নিরব নিস্তব্দ, কথা বলতে পারছেনা তিনি শুধু দুচোখে ঝরছে বিরাম হীন লোনা জল। চলে যায় তিন দিন, রাহেলা বেগম কথা বলেন। লাল চাদরে জড়িয়ে ঘুমানো বাদলের কথা, একা একা বলে চলে,বাদশা গ্রামে গেছে, ফিরে এলেই দুভাই পায়েস খাবে আতপ চালের পায়েস ওদের খুব পছন্দ। কিন্তু বাদশা যে এখনো এলোনা। কখন আসবে? ওর ছোট চাচাকে নিতে গেছে সে ।
আসবে বলে গেছে..
না । বাদশা এলোনা আর কোন দিনও, কিন্তু মা? সাড়া পেলেই সুধায়, কে, বাদশা এলি? কেউ সাড়া দেয়না ক্লান্ত মাতার ডাকে, মা পথ চেয়ে দিন গুনে..
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭৯৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৪/০২/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast