বড় আদরের ছোট বোন
একই মানুষের একই সাথে ভাই-বোন সবসময় নাও থাকতে পারে। মা-বাবার একমাত্র সন্তানদের ক্ষেত্রে আপন ভাই বা বোন থাকার সম্ভাবনা একেবারেই নাই।সেইদিক থেকে তমালের সৌভাগ্য যে তার একটি ভাই ও একটি বোন আছে। তবে তার বোন তুলির ক্ষেত্রে এটা সত্যি নয়। তার দুটি ভাই আছে, বোন নেই। ভাই বোন একসাথে পেতে হলে একটি পরিবারে অন্তত দুটি ছেলে এবং দুটি মেয়ে থাকতে হবে। এটা আবার জনবহুল দেশের জন্য সমস্যা। এক সন্তান বা দুই সন্তান নীতিতে থাকলে সবাইকে ভাই বোন ছাড়া অথবা একটি ভাই কিংবা একটি বোন নিয়েই থাকতে হবে। অবশ্য এটা একই মায়ের সন্তান এর বেলায় প্রযোজ্য।তা নাহলে সৎ ভাই-বোন অথবা চাচাতো(কাকাতো-জ্যাঠাতো), মামাতো, খালাতো(মাসিতো), ফুফাতো (পিসিতো) ভাই-বোন অনেক হতে পারে। আরো ব্যাপকভাবে চিন্তা করলে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ থেকে সবার মধ্যে ভাইয়ের সম্পর্ক বজায় রাখা যায়।
সে যাই হোক বোন ছোট হলে তাকে আদর করা যায় আর বড় হলে তার কাছ থেকে আদর পাওয়া যায়। ভাই বড় হলে মিষ্টি অথবা দুষ্টু ভাবী পাওয়া যায়। সেইসাথে দেবর হিসেবে অনেক সুবিধা আদায় করা যায়। আর ভাবীর ভাই বোনেরা হয় তালত ভাই-বোন তাই তাদের সাথে বেশ দুষ্টুমি করা যায়। বড় বোনের বিয়ে হলে পাওয়া যায় দুলাভাই আর শ্যালক হিসেবে বিভিন্ন কথা শুনতে হয়। ছোট বোনের বিয়ে হলে সম্মন্ধি হিসেবে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। বোনের ছেলে মেয়ে থাকলে তবে মামা হওয়া যায়। বড় ভাই থাকলে প্রায়ই দাদাগিরি দেখায় আর ছোট ভাই থাকলে সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকতে হয়।
তমালের দাদাজান চার ছেলে ও তিন মেয়ের জন্মদাতা। সে কারণে বড় চাচা, মেজ চাচা, ছোট চাচা, বড় ফুফু, মেজ ফুফু, ছোট ফুফু সবই পেয়েছে তমাল। বাড়ীর যে কোন অনুষ্ঠানে চাচাতো ফুফাতো ভাই বোন মিলে একটা বড় জমায়েত হয়ে যায়। বাইরের লোকের খুব একটা দরকার হয় না। বড় চাচার ছেলে সজীব ভাইয়ার জন্মবার্ষিকীতে একটা বিশাল কেক কাটতে হয়েছিল। আর জবাই করতে হয়েছে একটা ছাগল। তাও পরের দিন রুটি দিয়ে খাওয়ার জন্য কোন গোশত ছিল না। কয়েকটা আলু জুটেছিল তমালের থালায়।
তারপরও সব ভাই বোন একসাথে মিলে হৈচৈ করার মজাই আলাদা। রাতে ঘুমাতে গিয়ে কে কোথায় শোবে তা নিয়ে শুরু হল জল্পনা কল্পনা। কেউ বলে তুই বেশি নড়াচড়া করিস আমি তোর পাশে শোব না। কেউ বলে তুই নাক ডাকিস, কেউ বলে এটা, কেউ বলে ওটা-এভাবে পরষ্পরের দোষ ধরার একটা প্রতিযোগিতা হয়ে গেল। অবশেষে দাদাজান ঠিক করে দিল কে কোথায় ঘুমাবে। রাতের অনেকটা গল্প করেই কেটে গিয়েছিল। মেজচাচার ছেলে রাজীব সবার চেয়ে লম্বা বলে তার নতুন নাম হয়েছে লম্বু। বোনদের কেউ মুটকি, কেউ শুটকি নামের অধিকারী হয়ে গেছে। ফারজানা আপুর নাম সংক্ষিপ্ত হয়ে হয়েছে ফারু আপা।
ছোট ফুফুর বিয়েতে সব ভাইদের একই কাপড়ের পাঞ্জাবী আর বোনদের লেহেঙ্গা বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। পুরো ক্লাবের সব অতিথিদের চোখ আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারছিল ওদেরকে। বলার দরকার হচ্ছিল না যে ওরা ভাই-বোন। কয়েকটি ছবিতে একসাথে সবাইকে দেখে মনে হয় যেন কোন বাহিনীর সদস্য সবাই। বরপক্ষের সবাইকে বেশ চমক দেখানো সম্ভব হয়েছিল। আসলে সব জায়গায়তো ভাই বোনের এমন মিল থাকে না। একেক জনের একেক রুচি হয়। কেউ লম্বা টাই পড়তে চায় তো কেউ নেক টাই। কেউ মাথায় ফুল দিতে চায় তো কেউ টিকলি। তাই সবাই খুব উপভোগ করছিল বিষয়টা। অনেকে আবার বেশি ভাই বোন আছে এটা দেখাতে লজ্জা পাই। অবশ্য এখানেও যে দু একজন আপত্তি করে নি তা নয়। শুধু দাদার দাপটে সবাই চুপ করে থেকেছে। আব্বা, চাচু, ফুফু সবাই দাদাজানকে প্রচণ্ড ভয় পায়। তাই দাদার আদেশ মেনে না নিয়ে কোন উপায় নাই। দাদার আদেশ অমান্য করলে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে এটা স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া আছে। এটা ভাই-বোনদের মধ্যে মিল থাকার একটা কারণ হতে পারে।
ঠিক তার উল্টোটা ঘটে তমালের নানার বাড়ীতে। নানার দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর অনেকদিন কোন সন্তান না হওয়ায় তিনি দ্বিতীয় বিয়েটা করেন। তাতেও কোন ফল হলো না। পরে এক হুজুরের পানি পড়ায় কাজ হলো। কিছুদিন হুজুর ও তার এক সাগরেদ এর খেদমত করার ফলে বড় নানীর কোল জুড়ে এল তমালের আম্মা জান্নাতুল ফেরদৌস আর ছোট নানী জন্ম দিল তমালের একমাত্র মামা মোহাম্মদ হেফাজত ইসলামকে। হেফাজত মামাকে সংক্ষেপে ওরা হেফাজ মামা বলেই ডাকে। মুশকিল হলো দুই ভাই-বোনের মধ্যে কোন মিল নাই।
নানা অল্প বয়সে রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে মামাই সব সম্পত্তির অধিকারী হয়ে যায়। এমনকি তমালের মায়ের অংশটাও বিভিন্ন কৌশলে নিজের নামে করে নেয়। একেতো সৎভাই তার উপর খুব খারাপ প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় মামার বাড়িতে খুব একটা যাওয়া হয়না তমালদের। আগে প্রায়ই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তমালদের বাসায় আসতেন হেফাজ মামা। নানার বাড়িতে ওরশ হলে তবরুক নিয়ে আসতেন। ছোট ভাই তুষারকে একবার কুকুর কামড় দিয়েছিল তখন মামা নিয়ে গিয়ে থাল পড়া দিয়েছিলেন। বোন তুলি প্রচণ্ড পেট ব্যাথায় কিছুদিন কষ্ট পাচ্ছিল। মামা আসন শরীফের মাটি এনে পেটে লেপে দিয়েছিলেন। কুফরী কালামে আক্রান্ত বিভিন্ন রোগীর সমস্যা সমাধানের জন্য মামা জ্বীন চালান দেন। তমালের বাবা মিজানুর রহমান এসব একদম পছন্দ করেন না। তিনি বাংলার অধ্যাপক। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু উপন্যাস তাঁর পড়া আছে। তিনি প্রায় আম্মাকে বলতেন তোমার ভাইয়ের আসল উদ্দেশ্য হলো তোমার জমিটা লিখিয়ে নেয়া। শেষে তাই হয়েছিল এতিম খানা করবে বলে আম্মার কাছ থেকে জমিটা মামা লিখিয়ে নিয়েছিল। এরপর থেকে খুব একটা আর আসেননা তিনি। সম্পত্তির জন্য ভাই বোনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ভাই ভাইকে খুন করে এমন ঘটনা বিরল নয়।
তমাল বিজ্ঞানমনষ্ক। তাই তার মামার এসব সে বিশ্বাস করে না। সে তুলি ও তুষারকে মামার কেরামতি সব ফাঁস করে দেয়। তুলি তমালের চেয়ে মাত্র দেড় বছরের ছোট। বলতে গেলে বুদ্ধি হওয়ার বয়স থেকে দুজন একসাথে থাকে সবসময়। স্কুল আলাদা হলেও দুজন একসাথে যায় একসাথে আসে। পড়ালেখার ক্ষেত্রে বোনকে খুব সাহায্য করে তমাল। মাঝে মাঝে তুলির বান্ধবী তরু আসে ওদের বাসায়, কথা হয় তমালের সাথে। তরুর বড় ভাই তমালের মতো নয়। কথায় কথায় শাসন করে। পড়াশুনায় ভালো নয় বলে তাকে তেমন কোন সাহায্য করতে পারে না। তরু তার মাকে বলে পরীক্ষার আগে তুলির সাথে কিছুদিন অংক করতে আসে। যাওয়ার সময় তমাল তরুকে পৌঁছে দেয়। তরুর বড় ভাইকে তমাল ‘ভাইয়া’ বলে ডাকে। লাজুক স্বভাবের তমালকে খুব স্নেহ করে সবাই। তরুর মা-তো কিছু একটা খেতে দিবেই। বলে- তোমার কারণে তরু অনেক ভাল করছে। আর তমাল ভাবে ছোট বোন থাকলে কত সুবিধা। তুলিইতো তমালের নামে প্রশংসা করে তরুকে মুগ্ধ করেছে।
তুলি অবশ্য তমাল যে কলেজে পড়ে সে কলেজে পড়েনি। তবুও ভাই-বোনের সম্পর্ক একই রকম রয়ে গেছে। তুলির সহপাঠীদের বাসার অনুষ্ঠানগুলোতে তমালকে যেতে হয় তুলির সাথে। তুলি গান গাইলে তমালই তার সাথে তবলা বাজায়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মধ্যমনি এই ভাই-বোন। তমাল থাকায় তুলির জন্য যাওয়া আসার অনেক সুবিধা হয়। এমনকি তুলির সঙ্গে যে ভাইয়ার খুব ভাব সেও তমালকে খুব স্নেহ করে। বয়সে তমালের চেয়ে দুই-তিন বছরের বড় হওয়ায় তমালকে তিনি অনেক সাহযোগিতা করেন। বলতে গেলে এই দিদার ভাইয়ের হাত ধরে তমাল রজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়।
ছোট ভাই তুষার প্রায় সাত বছরের ছোট বলে তাকে কোলে নেয়ার জন্য তমাল-তুলির মধ্যে অনেক ঝগড়া হয়। বিছানায় পাখার বাতাস যেদিকে বেশি লাগে সেদিকে শোয়ার জন্য তমাল-তুলির মধ্যে ঝগড়া হয়। বয়সের কারণে তুষারের সাথে একটু দুরত্ব থাকলেও দুজনই তুষারের সুবিধার দিকটা খুব খেয়াল রাখে। তবে তুষার ওদের মতো হয়নি। সে অল্প বয়সে লুকিয়ে ধুমপান শুরু করে। এলাকার নেতৃস্থানীয়দের সাথে মেলামেশা করে। কোন মেয়ের প্রেমে প্রত্যাখাত হয়ে ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিশিষ্ট ছাত্রনেতা হয়ে কারাগারে যায়। জামিনে মুক্তি পেলে দলের কর্মীরা তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে। তার মতাদর্শের সাথে তমাল-তুলির মতাদর্শের ভিন্নতা আছে। তুষারের দৃষ্টিতে জীবন যাপনের জন্য নয়, জীবন উপভোগের জন্য।
তুলি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করতেই তার বিয়ে হয় দিদার ভাইয়ের সাথে। বিয়ের দিনই তমাল প্রথম উপলব্ধি করে প্রায় পঁচিশ বছরের ভাই-বোনের সম্পর্কে একটা দুরত্ব তৈরি হচ্ছে। এখন ইচ্ছে হলেই তুলি যেকোন জায়গায় তমালের সাথে যেতে পারবেনা। অনুমতি নিতে হবে অন্য কারো। ঘরে ঢুকে জামা কাপড় এখানে সেখানে খুলে রাখলে কেউ বলবে না। বন্ধের দিনে হারমোনিয়াম তবলা নিয়ে বসতে হবে না। নতুন নতুন রেসিপির স্বাদ পরীক্ষা করে আর বলতে হবে না এটা সুস্বাদু হয়েছে কিনা। তুলির বর দিদার ভাই এডভোকেট। তাঁকে নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়না । সমস্যা হয় বোনের শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী, দেবর, ননদদের নিয়ে। ওরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ, আপত্তি তুলে সম্পর্কটা ভালো থাকতে দেয় না। যদিও তুলির ননদিনীদের সাথে তমালের সম্পর্ক খুবই ভালো।
তমাল প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বিয়ে করতে নারাজ। তরু অনেক দিন তমালের জন্য অপেক্ষা করে। শেষে পরিবারের চাপে এক অধ্যাপককে বিয়ে করে। তমালের সারাদিন কাটে মেডিক্যাল আর চেম্বারে রোগী দেখে। বাইরেও রোগী দেখতে যায়। একবার তমালের সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তমালকে পাঠালেন বিশিষ্ট শিল্পপতি এনায়েত উল্লাহ সাহেবের বাড়ীতে। তমালের ব্যবহারে তিনি বেশ সন্তুষ্ট হলেন। পরিচয় হল তাঁর একমাত্র মেয়ে শিরীনের সাথে। প্রাইভেট বিশ্বিবিদ্যালয়ে এমবিবিএস পড়ছে। এনায়েত সাহেবের অনুরোধে শিরীনকে সহযোগিতার দায়িত্ব নিল তমাল। দ্রুত সম্পর্কের উন্নতি হল। প্রস্তাব এল শিরীনকে বিয়ে করলে বিদেশে পড়তে যাওয়ার খরচ দেবে। তমাল চিন্তা করে এভাবে পড়ে থাকলে হবে না। যেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের ভিড় সেখানে টিকে থাকতে হলে তাকে বাইরে যেতেই হবে। অবশেষে বাধ্য হল নিজেকে সমর্পন করতে শ্বশুড়ের অর্থের কাছে। শিরীনদের আভিজাত্যের সাথে তমালদের পরিবারের অবস্থার অনেক ব্যবধান। তাই শিরীন তার বাবার বাড়িতেই থাকে। ফলে ধীরে ধীরে পরিবারের সবার সাথে তমালের সম্পর্ক হালকা হয়ে যায়। বোনকে দেখাতো দুরের কথা মা বাবাকে দেখতে যাওয়ার সময় পর্যন্ত হয়না। এখন আর ভাই-বোন নয়। ওদের পরিচয় ওরা প্রত্যেকে আলাদা মানুষ, আলাদা পরিবারের সদস্য। ব্যস্ততার কারণে বোনের বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যেতে পারেনি তমাল। শুধু ব্যস্ততাই নয় সম্ভবত শিরীন পছন্দ করেনা বলে তেমন চেষ্টাও করেনি।
তারপর দেশত্যাগ। শুধু অর্থের সম্পর্ক টিকে থাকে বাবা-মা'র সাথে আর বোনের সাথে ফোনের আলাপ।
সে যাই হোক বোন ছোট হলে তাকে আদর করা যায় আর বড় হলে তার কাছ থেকে আদর পাওয়া যায়। ভাই বড় হলে মিষ্টি অথবা দুষ্টু ভাবী পাওয়া যায়। সেইসাথে দেবর হিসেবে অনেক সুবিধা আদায় করা যায়। আর ভাবীর ভাই বোনেরা হয় তালত ভাই-বোন তাই তাদের সাথে বেশ দুষ্টুমি করা যায়। বড় বোনের বিয়ে হলে পাওয়া যায় দুলাভাই আর শ্যালক হিসেবে বিভিন্ন কথা শুনতে হয়। ছোট বোনের বিয়ে হলে সম্মন্ধি হিসেবে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। বোনের ছেলে মেয়ে থাকলে তবে মামা হওয়া যায়। বড় ভাই থাকলে প্রায়ই দাদাগিরি দেখায় আর ছোট ভাই থাকলে সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকতে হয়।
তমালের দাদাজান চার ছেলে ও তিন মেয়ের জন্মদাতা। সে কারণে বড় চাচা, মেজ চাচা, ছোট চাচা, বড় ফুফু, মেজ ফুফু, ছোট ফুফু সবই পেয়েছে তমাল। বাড়ীর যে কোন অনুষ্ঠানে চাচাতো ফুফাতো ভাই বোন মিলে একটা বড় জমায়েত হয়ে যায়। বাইরের লোকের খুব একটা দরকার হয় না। বড় চাচার ছেলে সজীব ভাইয়ার জন্মবার্ষিকীতে একটা বিশাল কেক কাটতে হয়েছিল। আর জবাই করতে হয়েছে একটা ছাগল। তাও পরের দিন রুটি দিয়ে খাওয়ার জন্য কোন গোশত ছিল না। কয়েকটা আলু জুটেছিল তমালের থালায়।
তারপরও সব ভাই বোন একসাথে মিলে হৈচৈ করার মজাই আলাদা। রাতে ঘুমাতে গিয়ে কে কোথায় শোবে তা নিয়ে শুরু হল জল্পনা কল্পনা। কেউ বলে তুই বেশি নড়াচড়া করিস আমি তোর পাশে শোব না। কেউ বলে তুই নাক ডাকিস, কেউ বলে এটা, কেউ বলে ওটা-এভাবে পরষ্পরের দোষ ধরার একটা প্রতিযোগিতা হয়ে গেল। অবশেষে দাদাজান ঠিক করে দিল কে কোথায় ঘুমাবে। রাতের অনেকটা গল্প করেই কেটে গিয়েছিল। মেজচাচার ছেলে রাজীব সবার চেয়ে লম্বা বলে তার নতুন নাম হয়েছে লম্বু। বোনদের কেউ মুটকি, কেউ শুটকি নামের অধিকারী হয়ে গেছে। ফারজানা আপুর নাম সংক্ষিপ্ত হয়ে হয়েছে ফারু আপা।
ছোট ফুফুর বিয়েতে সব ভাইদের একই কাপড়ের পাঞ্জাবী আর বোনদের লেহেঙ্গা বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। পুরো ক্লাবের সব অতিথিদের চোখ আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারছিল ওদেরকে। বলার দরকার হচ্ছিল না যে ওরা ভাই-বোন। কয়েকটি ছবিতে একসাথে সবাইকে দেখে মনে হয় যেন কোন বাহিনীর সদস্য সবাই। বরপক্ষের সবাইকে বেশ চমক দেখানো সম্ভব হয়েছিল। আসলে সব জায়গায়তো ভাই বোনের এমন মিল থাকে না। একেক জনের একেক রুচি হয়। কেউ লম্বা টাই পড়তে চায় তো কেউ নেক টাই। কেউ মাথায় ফুল দিতে চায় তো কেউ টিকলি। তাই সবাই খুব উপভোগ করছিল বিষয়টা। অনেকে আবার বেশি ভাই বোন আছে এটা দেখাতে লজ্জা পাই। অবশ্য এখানেও যে দু একজন আপত্তি করে নি তা নয়। শুধু দাদার দাপটে সবাই চুপ করে থেকেছে। আব্বা, চাচু, ফুফু সবাই দাদাজানকে প্রচণ্ড ভয় পায়। তাই দাদার আদেশ মেনে না নিয়ে কোন উপায় নাই। দাদার আদেশ অমান্য করলে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে এটা স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া আছে। এটা ভাই-বোনদের মধ্যে মিল থাকার একটা কারণ হতে পারে।
ঠিক তার উল্টোটা ঘটে তমালের নানার বাড়ীতে। নানার দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর অনেকদিন কোন সন্তান না হওয়ায় তিনি দ্বিতীয় বিয়েটা করেন। তাতেও কোন ফল হলো না। পরে এক হুজুরের পানি পড়ায় কাজ হলো। কিছুদিন হুজুর ও তার এক সাগরেদ এর খেদমত করার ফলে বড় নানীর কোল জুড়ে এল তমালের আম্মা জান্নাতুল ফেরদৌস আর ছোট নানী জন্ম দিল তমালের একমাত্র মামা মোহাম্মদ হেফাজত ইসলামকে। হেফাজত মামাকে সংক্ষেপে ওরা হেফাজ মামা বলেই ডাকে। মুশকিল হলো দুই ভাই-বোনের মধ্যে কোন মিল নাই।
নানা অল্প বয়সে রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে মামাই সব সম্পত্তির অধিকারী হয়ে যায়। এমনকি তমালের মায়ের অংশটাও বিভিন্ন কৌশলে নিজের নামে করে নেয়। একেতো সৎভাই তার উপর খুব খারাপ প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় মামার বাড়িতে খুব একটা যাওয়া হয়না তমালদের। আগে প্রায়ই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তমালদের বাসায় আসতেন হেফাজ মামা। নানার বাড়িতে ওরশ হলে তবরুক নিয়ে আসতেন। ছোট ভাই তুষারকে একবার কুকুর কামড় দিয়েছিল তখন মামা নিয়ে গিয়ে থাল পড়া দিয়েছিলেন। বোন তুলি প্রচণ্ড পেট ব্যাথায় কিছুদিন কষ্ট পাচ্ছিল। মামা আসন শরীফের মাটি এনে পেটে লেপে দিয়েছিলেন। কুফরী কালামে আক্রান্ত বিভিন্ন রোগীর সমস্যা সমাধানের জন্য মামা জ্বীন চালান দেন। তমালের বাবা মিজানুর রহমান এসব একদম পছন্দ করেন না। তিনি বাংলার অধ্যাপক। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু উপন্যাস তাঁর পড়া আছে। তিনি প্রায় আম্মাকে বলতেন তোমার ভাইয়ের আসল উদ্দেশ্য হলো তোমার জমিটা লিখিয়ে নেয়া। শেষে তাই হয়েছিল এতিম খানা করবে বলে আম্মার কাছ থেকে জমিটা মামা লিখিয়ে নিয়েছিল। এরপর থেকে খুব একটা আর আসেননা তিনি। সম্পত্তির জন্য ভাই বোনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ভাই ভাইকে খুন করে এমন ঘটনা বিরল নয়।
তমাল বিজ্ঞানমনষ্ক। তাই তার মামার এসব সে বিশ্বাস করে না। সে তুলি ও তুষারকে মামার কেরামতি সব ফাঁস করে দেয়। তুলি তমালের চেয়ে মাত্র দেড় বছরের ছোট। বলতে গেলে বুদ্ধি হওয়ার বয়স থেকে দুজন একসাথে থাকে সবসময়। স্কুল আলাদা হলেও দুজন একসাথে যায় একসাথে আসে। পড়ালেখার ক্ষেত্রে বোনকে খুব সাহায্য করে তমাল। মাঝে মাঝে তুলির বান্ধবী তরু আসে ওদের বাসায়, কথা হয় তমালের সাথে। তরুর বড় ভাই তমালের মতো নয়। কথায় কথায় শাসন করে। পড়াশুনায় ভালো নয় বলে তাকে তেমন কোন সাহায্য করতে পারে না। তরু তার মাকে বলে পরীক্ষার আগে তুলির সাথে কিছুদিন অংক করতে আসে। যাওয়ার সময় তমাল তরুকে পৌঁছে দেয়। তরুর বড় ভাইকে তমাল ‘ভাইয়া’ বলে ডাকে। লাজুক স্বভাবের তমালকে খুব স্নেহ করে সবাই। তরুর মা-তো কিছু একটা খেতে দিবেই। বলে- তোমার কারণে তরু অনেক ভাল করছে। আর তমাল ভাবে ছোট বোন থাকলে কত সুবিধা। তুলিইতো তমালের নামে প্রশংসা করে তরুকে মুগ্ধ করেছে।
তুলি অবশ্য তমাল যে কলেজে পড়ে সে কলেজে পড়েনি। তবুও ভাই-বোনের সম্পর্ক একই রকম রয়ে গেছে। তুলির সহপাঠীদের বাসার অনুষ্ঠানগুলোতে তমালকে যেতে হয় তুলির সাথে। তুলি গান গাইলে তমালই তার সাথে তবলা বাজায়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মধ্যমনি এই ভাই-বোন। তমাল থাকায় তুলির জন্য যাওয়া আসার অনেক সুবিধা হয়। এমনকি তুলির সঙ্গে যে ভাইয়ার খুব ভাব সেও তমালকে খুব স্নেহ করে। বয়সে তমালের চেয়ে দুই-তিন বছরের বড় হওয়ায় তমালকে তিনি অনেক সাহযোগিতা করেন। বলতে গেলে এই দিদার ভাইয়ের হাত ধরে তমাল রজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়।
ছোট ভাই তুষার প্রায় সাত বছরের ছোট বলে তাকে কোলে নেয়ার জন্য তমাল-তুলির মধ্যে অনেক ঝগড়া হয়। বিছানায় পাখার বাতাস যেদিকে বেশি লাগে সেদিকে শোয়ার জন্য তমাল-তুলির মধ্যে ঝগড়া হয়। বয়সের কারণে তুষারের সাথে একটু দুরত্ব থাকলেও দুজনই তুষারের সুবিধার দিকটা খুব খেয়াল রাখে। তবে তুষার ওদের মতো হয়নি। সে অল্প বয়সে লুকিয়ে ধুমপান শুরু করে। এলাকার নেতৃস্থানীয়দের সাথে মেলামেশা করে। কোন মেয়ের প্রেমে প্রত্যাখাত হয়ে ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিশিষ্ট ছাত্রনেতা হয়ে কারাগারে যায়। জামিনে মুক্তি পেলে দলের কর্মীরা তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে। তার মতাদর্শের সাথে তমাল-তুলির মতাদর্শের ভিন্নতা আছে। তুষারের দৃষ্টিতে জীবন যাপনের জন্য নয়, জীবন উপভোগের জন্য।
তুলি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করতেই তার বিয়ে হয় দিদার ভাইয়ের সাথে। বিয়ের দিনই তমাল প্রথম উপলব্ধি করে প্রায় পঁচিশ বছরের ভাই-বোনের সম্পর্কে একটা দুরত্ব তৈরি হচ্ছে। এখন ইচ্ছে হলেই তুলি যেকোন জায়গায় তমালের সাথে যেতে পারবেনা। অনুমতি নিতে হবে অন্য কারো। ঘরে ঢুকে জামা কাপড় এখানে সেখানে খুলে রাখলে কেউ বলবে না। বন্ধের দিনে হারমোনিয়াম তবলা নিয়ে বসতে হবে না। নতুন নতুন রেসিপির স্বাদ পরীক্ষা করে আর বলতে হবে না এটা সুস্বাদু হয়েছে কিনা। তুলির বর দিদার ভাই এডভোকেট। তাঁকে নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়না । সমস্যা হয় বোনের শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী, দেবর, ননদদের নিয়ে। ওরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ, আপত্তি তুলে সম্পর্কটা ভালো থাকতে দেয় না। যদিও তুলির ননদিনীদের সাথে তমালের সম্পর্ক খুবই ভালো।
তমাল প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বিয়ে করতে নারাজ। তরু অনেক দিন তমালের জন্য অপেক্ষা করে। শেষে পরিবারের চাপে এক অধ্যাপককে বিয়ে করে। তমালের সারাদিন কাটে মেডিক্যাল আর চেম্বারে রোগী দেখে। বাইরেও রোগী দেখতে যায়। একবার তমালের সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তমালকে পাঠালেন বিশিষ্ট শিল্পপতি এনায়েত উল্লাহ সাহেবের বাড়ীতে। তমালের ব্যবহারে তিনি বেশ সন্তুষ্ট হলেন। পরিচয় হল তাঁর একমাত্র মেয়ে শিরীনের সাথে। প্রাইভেট বিশ্বিবিদ্যালয়ে এমবিবিএস পড়ছে। এনায়েত সাহেবের অনুরোধে শিরীনকে সহযোগিতার দায়িত্ব নিল তমাল। দ্রুত সম্পর্কের উন্নতি হল। প্রস্তাব এল শিরীনকে বিয়ে করলে বিদেশে পড়তে যাওয়ার খরচ দেবে। তমাল চিন্তা করে এভাবে পড়ে থাকলে হবে না। যেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের ভিড় সেখানে টিকে থাকতে হলে তাকে বাইরে যেতেই হবে। অবশেষে বাধ্য হল নিজেকে সমর্পন করতে শ্বশুড়ের অর্থের কাছে। শিরীনদের আভিজাত্যের সাথে তমালদের পরিবারের অবস্থার অনেক ব্যবধান। তাই শিরীন তার বাবার বাড়িতেই থাকে। ফলে ধীরে ধীরে পরিবারের সবার সাথে তমালের সম্পর্ক হালকা হয়ে যায়। বোনকে দেখাতো দুরের কথা মা বাবাকে দেখতে যাওয়ার সময় পর্যন্ত হয়না। এখন আর ভাই-বোন নয়। ওদের পরিচয় ওরা প্রত্যেকে আলাদা মানুষ, আলাদা পরিবারের সদস্য। ব্যস্ততার কারণে বোনের বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যেতে পারেনি তমাল। শুধু ব্যস্ততাই নয় সম্ভবত শিরীন পছন্দ করেনা বলে তেমন চেষ্টাও করেনি।
তারপর দেশত্যাগ। শুধু অর্থের সম্পর্ক টিকে থাকে বাবা-মা'র সাথে আর বোনের সাথে ফোনের আলাপ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
তাইবুল ইসলাম ১৩/০৫/২০১৪
-
সুমাইয়া বরকতউল্লাহ্ ১০/০৫/২০১৪গল্পটি বড়ো। অল্প পড়েছি। ভালো লেগেছে।
-
কবি মোঃ ইকবাল ১০/০৫/২০১৪স্মৃতিময়ী এক অনন্য বাস্তবতার গল্প।
খুব ভালো লাগলো।
আর এটা জেনে আপনার ভাল লাগবে যে আমার ডাক নাম "তুষার"
আপনার গল্পে স্থান পেয়ে খুবই প্রীত হলাম
শুভেচ্ছা নেবেন