www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আদিবাসী

অনেক কষ্টে হিমু এবার চট্টগ্রামের বান্দরবানে কেওক্রাডং এর চূড়ায় দাড়িয়ে জোৎস্না দেখার ব্যবস্থা করলো। ঘন জঙ্গল পেরিয়ে পাহড়ের চূড়া থেকে জোৎস্না দেখতে কেমন লাগে এ বিষয়ে একটা পরীক্ষা চালানো দরকার। এখন তাকেই পরবর্তী সব পদক্ষেপ ঠিক করতে হবে। হিমুর আদিপিতার অবর্তমানে তার উপর অনেক দায়িত্ব এসে পড়েছে। কিছুদিন ধরে হিমু সঙ্গীত নিয়েও ভাবছে সে। ঘন ঝোপঝাড় পেরিয়ে কয়েকটি ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখে একাকী পথ চলতে বেশ ভালোই লাগছে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সে পৌঁছে যাবে চুড়ায়। রাতটা সেখানে কাটিয়ে ভোরে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে রওনা দেবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। এবারের খরচটা ব্যবস্থা করেছে রূপা । মেয়েদের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কবাণী থাকা স্বত্ত্বেও রূপার কাছ থেকে মাঝে মাঝে সাহায্য নিতে হয়। বাদল অবশ্য সাথে আসতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে উঠার বিশেষ কৌতুহল সামলাতে পারছিল না। কিন্তু পরের দিন একটা পরীক্ষা থাকায় ঘর থেকে অনুমতি নেয়া গেল না। পাহাড়ের একটা স্বকীয়তা হলো তার রুক্ষতা। পাথুরে মাটি পরিবেশকে যতটা সবুজ করেছে তা চেয়ে রুক্ষ করেছে বেশী। ঝুম চাষের জন্য ঢালু পাহাড়কে চাষের উপযোগী করে তুলতে গিয়ে প্রায়ই পাহাড়গুলিতে আগুন দিয়ে আগাছা পোড়াতে হয়। এই পোড়া মাটির মানুষগুলোর চলাফেরা তাকানো সবকিছুই কেমন যেন রুক্ষ মনে হয়। তবুও রুমা বাজার, বগা লেইক এর মতো দোকানপাট ভরা জায়গাও মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। বাঙ্গালীদের ব্যাপারে এদের ধারণা খুব একটা ইতিবাচক নয়। একই দেশের মানুষ হয়েও ওরা উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিস্বত্ত্বা হিসেবে পরিচিত হয়। যে কোন বিষয়ে কোটা পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। অথচ তাদের হিসেবে তারাই আদিবাসী। তাদের সংস্কৃতিই আমাদের আদি সংস্কৃতি। আমাদের বর্তমান সংস্কৃতি একটা ধার করা সংস্কৃতি। বিভিন্ন দিবস পালন, বার্থ ডে, থার্টিফার্স্ট নাইট, হ্যাপি নিউ ইয়ার সবই বিজাতীয় সংস্কৃতি। ব্রিটিশরা চলে গেছে অনেকদিন। কিন্তু ওদের রেখে যাওয়া পোশাক, টাই, জুতা আমাদের মধ্যে রেখে গেছে। অফিস আদালত সবকিছুতে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। ওরা পাহাড় পর্যন্ত এগুতে পারেনি। তাই পাহাড়ীদের সংস্কৃতিতে ওদের প্রভাব খুব একটা পড়েনি। পশ্চিম পাকিস্তানীরাও প্রভাব ফেলতে পারে নি। ওদের মাঝেই আমরা আমাদের আদিরূপ এখন কিছুটা খুঁজে পাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে যেটুকু অধিকার পাওয়ার কথা তার কিছুই ওরা পাচ্ছে না। বরং বিভিন্নভাবে শোষিত হচ্ছে বলে ওদের অভিযোগ আছে। অনেক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। কোন কাজ হয়নি। আবার শান্তিবাহিনীকে চাঁদা দিতে হয়। ফলে ব্যবসায়ীরাও খুব একটা অগ্রসর হয় না। পাহাড়ী বাঙ্গালীদের অনেকেই পিতার লেখা পড়েছে। কেননা হলুদ পাঞ্জাবী দেখে কেউ কেউ মন্তব্য করছে- দেখ! দেখ! হিমু হয়েছে। এটা এখন একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রথম দিকে এটা ছিল না। হিমালয়ইতো হিমু। এটা তার ডাকনাম। এটা আবার হওয়ার কি আছে। কেউ কি চাইলে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল হতে পারে। ওরা এটাকে সন্ন্যাসী হওয়ার মতো একটা ভিন্ন কিছু মনে করে। তাছাড়া শুধু কি পাঞ্জাবী পাল্টালে হবে, মনটা পাল্টেছে কিনা দেখতে হবে না। কয়জন হিমুর আদর্শ গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া হিমুর সংখ্যা বাড়া মানে বেকারত্ব বৃদ্ধি। তাই সমাজের অন্যান্যরা এ সংখ্যাটা খুব একটা বাড়তে দিতে চাইবে না। রূপার মতো কয়টা মেয়েই বা হিমুদের ভালোবেসে মহিলা হিমু হবে। বাদলের মতো বোকা ভক্তই বা কয়টা পাওয়া যাবে। তার উপর আবার একই সময়ে একজনকে বিভ্রান্ত করা গেলেও অনেক লোককে একসঙ্গে বিভ্রান্ত করা খুবই কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে সবাইকে সবসময় বোকা বানানো যায় না। তাই হিমু কম হওয়ায় ভালো। আর ভালো জিনিস কম বলেই ভালোর কদর বেশি। মানুষ যখন প্রথম তৈরী হলো তখন তার মর্যাদা এত বেশি ছিল যে ফেরেশতারাও তাঁকে সেজদা করল। কিন্তু আজকে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশগুলোতে মানুষ কুকুর বিড়ালের মতো যেখানে সেখানে কোনরকমে একটু মাথা রাখার ঠাঁই করে নিচ্ছে। সাড়ে সাতশ কোটি মানুষের ভীড়ে মানুষ নিজেই কখন তার শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়ে ফেলেছে সে টেরও পায়নি। মানুষে মানুষে কত ব্যবধান। কেউ ভোগের চুড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। আর কেউ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব, সর্বহারা। একদিকে ক্ষুধা আরা দারিদ্র্য আর অন্যদিকে মহাকাশ অভিযানের নামে কোটি কোটি ডলার খরচ। কিছুদূর পরপর একটা ছোট পাড়া চোখে পড়ে। এরাও একসাথে থাকতে পারেনি। অনেক বিভাজন এদের মধ্যেও। চাকমা, মার্মা, খাসিয়া অনেক গোত্র। মধ্যযুগের গোত্রপ্রথা এদের মধ্যে এখনো প্রকটভাবে বিদ্যমান। একটা পাড়ায় একটা গোত্র বাস করে। এদের বাজার, সামাজিক অনুষ্ঠান সবই ভিন্ন ভিন্ন। গোত্রপ্রধানরা মিলে এক একটা সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাস্তবায়ন করে। রোদের তাপটা বেশি হওয়ায় খুব গরম লাগছে। একটা ঝর্ণা দেখতে পেয়ে হিমু মুখে মাথায় পানির ঝাপটা দিয়ে নিল। আশ্চর্য ঠাণ্ডা ঝর্ণার পানি। এত গরমেও পানিটা এত ঠাণ্ডা কিভাবে থাকে যেন বরফ গলে আসছে। প্রকৃতির এই দান দুহাত ভরে গ্রহণ করে নিল সে। পান করলো প্রান ভরে। তৃষিত কণ্ঠ যেন অমৃতের পরশ পেয়ে তৃপ্ত হলো। আবার এমনও হতে পারে সে খুব পিপাসার্ত বলেই এত ভালো লাগছে। নয়তো এ ঝর্ণার পাশ দিয়ে পাহাড়ী ছেলেগুলো বিশাল বস্তা পিঠে নিয়ে চলে যাচ্ছে। একবার ঝর্ণাটার দিকে দেখছেও না। আসলে যা আমাদের কাছে থাকে তা যত সুন্দরই হোক সবসময় যা দূরের তার সৌন্দর্য্যই আমাদের বেশি আকর্ষন করে। এদের কাছে হয়তো ঢাকার বহুতল বাড়িগুলোই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ফ্ল্যাট, টাইলস, প্রাইভেট কার, ফ্লাইওভার, চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, রমনার বটমূল, সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যান, জাদুঘর, সুপার মার্কেট, নিয়ন বাতি এসব বেশি আকর্ষনীয় এদের কাছে। এনজিও কর্মীদের সহায়তায় এরাও উন্নত সেনিটেশন, জেনারেটর, টেলিভিশন, মোবাইল নেটওয়ার্ক সবকিছুই এখানে পৌঁছে গেছে। ধীরে ধীরে এদের সংস্কৃতিও লুপ্ত হয়ে যাবে। সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন থেকে কারো মুক্তি নেই। কোথাও কোথাও এমন নীরব যে পোকাদের সম্মিলিত ডাক একটা চমৎকার সঙ্গীতের অবতারণা করে চলেছে। হিমু মোবাইলে শব্দটা রেকর্ড করে রাখলো। বিভিন্ন নাটকে কীবোর্ড দিয়ে এ শব্দটা তৈরী করে রাতের আবহ তৈরী করা হয়। এখান থেকে রেকর্ড করলে আরো অনেক ভালো শোনাতো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই চূড়ায় পৌঁছল হিমু। বিশাল আকৃতির পূর্ণিমার চাঁদটা যেন খুব কাছে মনে হলো। জোৎস্না স্নাত পাহাড়ের চারদিকের গাছগুলির মাথায় চাঁদের আলো পড়ে যে অপরূপ দৃশ্য তৈরী হয়েছে তা কোন শিল্পী তার তুলির আঁচড়ে নিখুঁতভাবে তুলে ধরতে পারবে কিনা জানে না। তাবে মহান স্রষ্টা এমন দৃশ্য প্রায়ই চাইলে তৈরী করতে পারে। প্রায় সারারাত চাঁদের আলোয় স্নান করে ভোরের আগে নামতে শুরু করলো পর্বতশৃঙ্গ থেকে। চাঁদটা এখনো হিমুকে দেখে আছে। হিমুর সেদিকে কোন খেয়াল নেই। এমনই হঠাৎ উঠে চলে যাওয়ার অভ্যাসটা চাঁদের বেলায়ও প্রযোজ্য হলো। চাঁদকে হতভম্ব করে দিয়ে হিমু চলল পাহাড়ের পাদদেশে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮০৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৩/১১/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • Înšigniã Āvî ২৫/১১/২০১৩
    খুব ভাল লাগলো
  • প্রবাসী পাঠক ২৩/১১/২০১৩
    ভাল লিখেছেন ভাই।
    হিমুর আদি পিতাকে বড্ড মিস করি।
    • ধন্যবাদ প্রবাসী পাঠক। হিমুর আদি পিতাকে আমিও খুব মিস করি। একটা জিজ্ঞাসা আছে। আপনার মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ব্যবহৃত তথ্যসূত্র আমার প্রবন্ধে ব্যবহার করলে আপনার কি কোন আপত্তি থাকবে?
      • প্রবাসী পাঠক ২৮/১১/২০১৩
        না প্রবীর ভাই আমার কোন আপত্তি নেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন লেখা বা তথ্য যতটা শেয়ার করা যায় ততই লোক এই তথ্যগুলো জান্তা পারবে তাই এই ব্যাপারে আপত্তি করার প্রশ্নই আসে না। আমার লেখার কোন তথ্য বা তথ্যসুত্র যদি আপনার লেখায় কোন কাজে আসে তাহলে নিজেকে সম্মানিত বোধ করব।
        ধন্যবাদ প্রবীর ভাই।
 
Quantcast