ক্ষমতা
পর্ব-১। পুণম ডাক্তার হিসেবে বেশ নাম করেছে। মেডিকেলের গাইনী বিভাগে কাজ করে সে। শৈশবে স্বপ্ন দেখতো বড় ডাক্তার হবে। গ্রামে যখন প্রসবের সময় অদক্ষ ধাত্রীদের হাতে কোন শিশুর মৃত্যুর কথা শুনত, তখন ভাবতো সে এমন দক্ষতা অর্জন করবে যাতে তার হাতে কোন শিশু জন্মের সময় মারা না যায়। বাস্তবেও তাই হয়েছে। লোকে বলে পুণম আপা ধন্বন্তরী। অনেক জটিল রোগীর সফল অপারেশন করেছে সে। এদেশে এখনো সব উন্নত যন্ত্রপাতি আসে নি। তবে একসময় আসবে বলে তার বিশ্বাস। কোন ডাক্তারের সুনাম বাড়লে হাজার রকম ঝামেলাও বাড়ে। যাদের সুনাম নেই তারা নানা রকম গুজব ছড়ায়। পুণম শুনেছে তার নামে প্রচার করা হচ্ছে -উনার কাছে গেলে নরম্যাল ডেলিভারিও সিজার করায়। টাকা খাওয়ার ফন্দি। এদের কথায় প্ররোচিত হয়ে যত মা ও সন্তান প্রাণ হারাচ্ছে সে জন্য কি এরা দায়ী নয়। আজকে কাজে মন বসছে না। একটা প্রভাবশালী চক্র প্রভাব খাটিয়ে তাকে প্রমোশনের নামে প্রহসন করে গ্রামের একটা মেডিক্যালের প্রধান করে পাঠাচ্ছে। গ্রামে যেতে তার আপত্তি নাই। কিন্তু যতটা খবর পেয়েছে তাতে খুব দুশ্চিন্তার কারণও আছে। ওখানে কেউ খুব একটা টিকতে পারে না। প্রভাবশালীদের ইচ্ছেমতো সব রিপোর্ট দিতে হয়। ওদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলে অসহ্য নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। একবার এক নার্সকে নাকি ওখানকার চেয়ারম্যানের ছোট ভাই জোর করে একটা কেবিনে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। বাইরে দাড়ানো ছিল দুইজন ক্যাডার। এতগুলো ডাক্তার, নার্স, স্টাফ কেউ কিছু করতে পারল না।
পর্ব-২। ওদের আখাড়াটা চালের গুদামের ভেতরে। চেয়ারম্যানের ভাই বাদশা মিয়া বসে আছে একটা রিভোলভিং চেয়ারে। এসি রুমে। পনের মিনিট পর পর এয়ার ফ্রেশনার সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। মেডিক্যালের ঘটনাটা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আসছে। তার ভাই অবশ্য ঘটনাস্থলে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং চিকিৎসার জন্য কিছু টাকাও দিয়ে এসছে। তবুও নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি এনজিও বেশ বাড়াবাড়ি করছে। থানার ওসি অবশ্য এর মধ্যে একবার দেখা করে গেছে। চেয়ারম্যান সাহেবের ফোন আসল। -ছোট ভাই তুমি কয়দিনের লাইগা পাহাড়ের নীল কুঠিয়ায় গিয়া থাক। পরিস্থিতি শান্ত হইলে আমি ফোন করুমনে। এখানকার সব আমি সামাল দিমু। কোন চিন্তা কইরো না। -ঠিক আছে, ভাইজান। ও পাশ থেকে ফোন রেখে দিল। একটা সাধারণ নার্সের সাথে একটু মজা করার জন্য তাকে এলাকা ছাড়তে হবে। তবুও ভাইজান যখন কইছে গা ঢাকা দিয়া থাকি। বাদশা মিয়া পাহাড়ে নীল কুঠিয়ায় এসেছে দুদিন হল। এখানে ওদের চোরাই গাছ, ইলেকট্রিকের তার, চোরাই খাম্বা, আর বিভিন্ন পুরোনো মূর্তি ও শিল্পকর্ম পাচারের ব্যবসা আছে। একবার কয়েকজন পাহাড়ী মেয়েকেও বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। দুদিনেই ব্যবসাটা গুছিয়ে নিয়েছে। আজকে একটু দোচোয়ানির ব্যবস্থা করতে বলেছে কেয়ারটেকারকে। তার সেবার জন্য মহুয়া নামে এক পাহাড়ী মেয়ে আছে। বাদশা মিয়া মহুয়াকে ডাকল। মহুয়ার আরাম পেয়ে বাদশা মিয়া ঘুমিয়ে পড়ে। মহুয়া টাকা নিয়ে যায়। তার বাবাকে দেয়। বাবা কাঁদে। টাকা না পেলে বাজার করতে পারতো না। অভাবের তাড়নায় কত মহুয়া কত বাবুজিকে আরাম দিয়ে ঘুম পাড়ায় দিনের সূর্য তার খবর রাখে না। তার খবর রাখে রাতের আকাশের চাঁদ আর তারারা।
পর্ব-৩। ডাক্তার পুণমের মনটা আজ ভালো নেই। এখানে আসার পর থেকে একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই আছে। রোগীদের জন্য আসা সরকারী ঔষধ চুরি হয়ে যায়। নিয়োগকৃত ডাক্তারদের অধিকাংশই উপস্থিত থাকে না। সরকারী কোয়ার্টারে থেকে ওরা ভিজিট নিয়ে রোগী দেখে। সিলিণ্ডার আছে, অক্সিজেন নাই। কোথায় গেছে কোন রেকর্ড নাই। বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেল কাছেই একটা ক্লিনিকে কম দামে বিক্রি করা হয়েছে। কোন রোগী আসলে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাগজ লিখে দিয়েই দায়িত্ব শেষ। বিশটা শয্যায় চার জন রোগীও নাই। যারা আছে তারাও ঠিক রোগী নয়। রাজনৈতিক কারণে মেডিকেলে আশ্রয় নিয়েছে। আজকে একজন ভর্তি হতে এসেছিল। পুণম দেয়নি। বলেছে যারা আছে তাদেরকেও দু- একদিনের মধ্যে ডিসচার্জ করে দেবে। ডাক্তারদের নিয়ে একটা মিটিং করতে হবে। স্টাফদের দাপট ডাক্তারদের চেয়ে বেশি। চরম অব্যবস্থাপনা। একবার চেষ্টা করে দেখতে হবে ঠিক করা যায় কি না। একটা ফোন আসল। -হ্যালো, ডাক্তার পুণম বলছি। -আপা, আচ্ছালামালাইকুম। আমি বাচ্চু চেয়ারম্যান বলতাছি। -হ্যা, বলুন চেয়ারম্যান সাহেব। আপনার জন্য কি করতে পারি। -আপা, আপনে মাইয়া মানুষ। ইজ্জতের ডর থাকলে পোলাডারে ভর্তি কইরা লইয়েন। পুণম নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে তার মন সাই দিল না। ছেলেটা আবার এসেছে। পুণম তাকে সরাসরি বলে দিল- উনাকে বলে দিবেন মেয়ে বলে কেউকে দুর্বল ভাবা ঠিক নয়। ছেলেটা যাবার পর মনে হল জলে থেকে কুমিরের সাথে লড়াই করা ঠিক হচ্ছে না। রাত আটটা। একটা মাইক্রো এসে থামল মেডিক্যলের সামনে। কয়েকজন সশস্ত্র ক্যাডার কামাণ্ডো স্টাইলে নামল গাড়ি থেকে। সরাসরি গিয়ে ঢুকল পুণমের রুমে। কিছু বুঝে উঠার আগেই কালো কাপড়ে চোখ মুখ হাত বেঁধে কোলে তুলে নিল। মাইক্রো বাস ছাড়ার শব্দ শুনল। বিশ মিনিট পর তাকে নিয়ে গিয়ে ফেলল একটি বিছানায়। চোখের বাঁধন যখন খুলল তখন আবছা অন্ধকারে দেখল চারজন লোক শকুনের মত তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর যা ঘটল তা সে মনে করতে চায় না। পরে মেডিক্যালের কাছেই ওকে ফেলে দিয়ে গেছে ওরা। মুখের বাঁধন খুলে আস্তে আস্তে রুমে ঢুকল। ঘড়িতে এখনো বারোটা বাজে নি। কিন্তু তার জীবনের বারোটা বেজে গেছে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
প্রবাসী পাঠক ২৮/১১/২০১৩
-
টিটু আচার্য্য ২৪/০৯/২০১৩ভয়ংকর সুন্দর লিখেছেন ।
-
suman ২৩/০৯/২০১৩সাহসী কাজ...আরো লিখুন ...
-
Înšigniã Āvî ২৩/০৯/২০১৩জীবনের বাস্তবতার ছবি দেখলাম আরও একবার
এবং সেই বাস্তব কতটাই রুঢ় -
ইব্রাহীম রাসেল ২৩/০৯/২০১৩--সমাজের ঘৃণ্য বাস্তবাতার শিকার একটি মেয়ের গল্প--শেখার আছে--
আমাদের রাজনীতিবিদ , তারা মনে হয় ভিন্ন কোন স্পেসিস । তারা আসলে মানুষ , বাঙালি নাকি বাংলাদেশি এটা নিয়ে একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা হওয়া অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের যে কোন রাজনীতিবিদের ডি এন এ পরিক্ষা করে দেখা উচিৎ। আমার ব্যাক্তিগত মতামত এরা ভিন্ন গ্রহের এলিয়েন। তবে তাদের চেয়ে আমাদের দোষটাও খুব একটা কম না। আমরাই তাদের নির্বাচিত করি। কাউকে চেয়ারম্যান, কাউকে এম পি ।
আর অনেক অনেক শ্রদ্ধা ডাঃ পুনমদের মত মানুষদের জন্য যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এদের মত মানুষগুলোর জন্যই এত প্রতিকূলতার মাঝেও বিশ্বের বুকে আজও মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।
আমারা সবাই যদি ডাঃ পুনমের মত একটু সাহস করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই তবে অন্যায়কারী লোকগুলো পালাবার পথও খুজে পাবে না।
চমৎকার একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্য অনেক অভিনন্দন প্রবীর ভাই।