স্বাধীনতার সঙ্কট
স্বাধীনতার সঙ্কট / সুদীপ্ত বিশ্বাস
১৮৯৮ সাল।বিচার প্রহসন সমাপ্ত হল। দামোদরের বিরুদ্ধে হত্যা অপরাধের চার্জ। পুনার প্লেগ অফিসার রান্ড সাহেব কে হত্যা করেছেন মহারাষ্ট্রের এই বিপ্লবী। বিদ্রোহী চাপেকারের মৃত্যু দণ্ড উচ্চারিত হল কোর্টে।সহাস্যে দামোদর বললেন , ‘এই মাত্র? আর কিছু নয়?’ নির্দিষ্ট দিনে দামোদরের কণ্ঠ রোধ করল ফাঁসির নির্মম রজ্জু।ঝুলে পড়ল তার মৃত্যুহীন দেহটি।এই ভাবে শুধু মাত্র একটি নয়, একই মায়ের বুক থেকে ঝরে গেল তিন তিনটি ভাই- দামোদর, বালকৃষ্ণ ও বাসুদেব চাপেকার- চাপেকার পরিবারের তিন তিনটি সন্তান।দেশ জননীর অপমান অসহ্য মনে হয়েছিল বলেই তারা প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন দেশ মাতৃকার পরাধীনতার বন্ধন মোচনের জন্য।তাদের সংগ্রাম ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম।সাদা চামড়ার বিদেশি মানুষের বিরুদ্ধে দেশি মানুষের সংগ্রাম।সে সংগ্রাম ছিল শক্তিশালীর বিরুদ্ধে দুর্বলের, শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের, পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার।চাপেকার ভাইদের মত প্রাণ দিতে হয়েছে বহু বিপ্লবী বন্ধুদের। কিন্তু কখনোই পিছপা হয়নি ভারতের যুবকেরা।এক জনের মৃত্যুর পর আরও দশ জন হাসি মুখে এগিয়ে এসেছে প্রাণ দান করার জন্য। কারন, তখন তাদের মধ্যে জেগে উঠেছিল দেশাত্মবোধ।তখন ভারতবর্ষে ছিল পরাধীনতার সঙ্কট।আজ যুগ বদলেছে, স্বাধীন হয়েছে ভারতবর্ষ। কিন্তু সে আজ ভুগছে মানবিকতার সঙ্কটে যা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে স্বাধীনতার সঙ্কট। যা আরও অনেক জটিল আর ভয়ংকর। কোনও রোগকে যদি ধরা যায় তবে তা নির্মূলও করা যায় ।কিন্তু রোগ ধরা না গেলে তার দাওয়াই দেওয়া সহজ নয়। সে সময় শত্রু পক্ষ ছিল সাদা চামড়ার ইংরেজ। ইংরেজ দেখলেই বয়কট কর, বিদ্রোহ কর, যুদ্ধ কর- এই ছিল রীতি।ভারতবাসী সেটা বুঝতে পেরেছিল। তাই এসেছিল স্বাধীনতাও। কিন্তু তথাকথিত স্বাধীন ভারতবাসী আজও বুঝতে পারছে না স্বাধীনতাটা ধরে রাখা যাবে কিভাবে?তারা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়ে বসছে।এ ক্ষেত্রেও রোগটি ঢুকেছে ওই সাদা চামড়ার দেশ থেকেই। শুধু AIDS বা ডিভোর্স নয়।ভারতবর্ষকে গ্রাস করেছে ভয়ংকর পশ্চিমী ভোগবাদ। কনভেন্ট এজুকেশনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি শিশুর মনেই ঢুকে পড়েছে ভয়ংকর ভোগবাদ। ছোঁয়াচে এই রোগ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে যারা কোনও দিন স্কুলে যায়নি তাদের মধ্যেও। আজ ভারতের মানুষ সবাই ভোগী । তারা চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় ভোগ করতে চায়। এনজয়, এনজয়টাই আজকের ভারতের মূল মন্ত্র। টাকা, টাকা চাই।আজকের ভারত সকালে ঘুম থেকে উঠে বলে- টাকা চাই। সারাদিন হন্যে হয়ে ছোটে টাকার পিছনে।রাতে ঘুমতে যাবার আগেও হাই তুলতে তুলতে বলে, টাকা চাই।কিন্তু স্বপ্নের মধ্যেও সে ধরতে পারে না তার অধরা টাকাকে। সত্যি করে বললে কত টাকা চাই, কত টাকা পেলে এই টাকার পেছনে ছোটা বন্ধ হবে সেটা জানে না একজন ভারতীয়ও ।তাই তারা শুধু ছুটছে আর ছুটছে। এই ছোটাছুটিতে পরস্পরকে শুধুমাত্র ধাক্কাধাক্কি নয়, মেরে ফেলতেও পিছপা নয় ভারতবাসি।তাদের মানবিকতার ফাঁসি হয়ে গেছে অনেকদিন।সবাই চায় সবাইকে ঠকাতে। আর এই ঠকানোর জুয়া চুরিতে ঠকতে হয় সবাইকেই।মাছ ওয়ালা ঠকায় খদ্দেরকে।সেই খদ্দেরই তাকে ঠকায় যখন সে তেল বা চাল কিনতে তাদের দোকানে যায়। ডাক্তার ঠকান রোগীকে। সেই রোগীও ডাক্তারকে ঠকান যখন ডাক্তার গাড়িতে চড়েন, বাজারে যান, ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করান, ফ্ল্যাট কেনেন অথবা নেহাতই হাওয়া বদল করতে বেড়াতে যান অন্য কোনও জায়গায়।সব ভারতবাসীই আপ্রাণ চেষ্টা করেন তার কাছে অন্য যেই আসুক, তার গলা কাটতে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা বা পুলিশেরাই তাদের চরিত্র হারাননি, চারিত্রিক ভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন আমজনতা। প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে ভোগবাদ আর দুর্নীতি। রং মিস্ত্রি, সাইকেল মিস্ত্রি, জুতো পালিশের কবলার, ঠিকে ঝি, ছাত্র, শিক্ষক, হেডমাস্টার, জমির দালাল, ইঞ্জিনিয়ার, পলিটিশিয়ান- সবার চরিত্র সমান।সবাই-ই দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।সবাই জানে রোগ একটা হয়েছে।কিন্তু এ যে সর্ষের মধ্যেই ভূত- থুড়ি- ভূতের মধ্যেই সর্ষে। ভেজালের পরিমাণটা বাড়তে বাড়তে এতটাই বেড়ে গেছে যে এখন, আসল বস্তুটি যে কি সেটাই বোঝা দায়। স্বাধীনতার যুদ্ধটা ছিল অনেক সহজ একটা অঙ্ক। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, ব্যস। কিন্তু আজ এ যে নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যা খুব কঠিন কাজ।সেদিন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের হতাশ যুবক অধ্যাপকের সঙ্গে কথা হল। জীবনের যাঁতা কলে ঠকতে ঠকতে এখন তিনি দ্বিধাগ্রস্থ। দুটি সন্তান তার। নিজে খুব সহজেই ম্যানেজমেন্টের থিওরির উপর লেকচার দেন এম. বি. এ’র ক্লাসে। কিন্তু কি শিক্ষা দেবেন তিনি তার নিজের কচি কাঁচা ছেলে মেয়ে দুটিকে ? তাদেরকে কি শেখাবেন মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে ? বিবেকবান হতে?না কি তাদের কে শেখাবেন স্বার্থপর হতে, স্রোতের সঙ্গে ভেসে গিয়ে টাকা, টাকা করে হাই তুলতে? বিবেকবান হলে তো তাদেরকে জীবন ভোর ঠকতে হবে, সাঁতার কাটতে হবে স্রোতের বিরুদ্ধে। কোনও মা বাবাই কি চান তার সন্তানেরা জীবনভোর ঠকুক? কষ্টে থাকুক? কিন্তু চাপেকার ভাইদের মা চেয়েছিলেন। পরাধীন ভারতের বহু মা বাবা চেয়েছিলেন তার ছেলে রায়বাহাদুর না হয়ে বিপ্লবী হোক। দুধেভাতে না থেকে গর্জে উঠুক, হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ুক। সে সময়ে মানবিকতার সঙ্কটটি আসেনি। মানুষ মনের অন্তস্থল থেকে ফকির হয়ে যায়নি। আজ লাখোপতি , কোটিপতি, মিলিয়নিয়ার, বিলিয়নিয়ার-সবাই ফকির।তারা চায় তাদের ছেলেরা আরও অনেক টাকা আয় করুক। আরও লোক ঠকাক। একটি পদার্থের মধ্যে কিছু পরিমাণ অপদ্রব্য মিশে গেলে তাকে পৃথক করা যায়। কিন্তু পদার্থটির প্রতিটি পরমাণুই যদি বিষাক্ত হয়ে পড়ে তবে তাকে বিষ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় কি? আজ ভারতীয় সমাজটির হয়েছে শেষোক্ত পদার্থটির দশা। ভাষা, জাতি, ধর্ম, রাজ্য নির্বিশেষে গোটা ভারতের একই চিত্র। ভারত একটি ভোগী দেশ।ভারত একটি দুর্নীতিপূর্ণ দেশ।যে ভারত পৃথিবীকে শুনিয়েছিল উপনিষদের শান্তির ললিত বাণী- ‘ত্যক্তেন ভুঞ্জিথ্যা’, তার এই নৈতিক অবনমন সত্যিই অকল্পনীয়। পশ্চিমী হালকা ভোগবাদ সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে ভারতের গোটা সমাজটাকে। মিথ্যে বলা ও লোক ঠকানো ভারতবাসীর সাধারণ ধর্মে পরিণত হয়েছে। যিনি মিথ্যে বলেন না বা কাওকে ঠকান না তাকে সর্ব ক্ষেত্রেই ঠকতে হচ্ছে পদে পদে। বিপদে তার পাশে দাঁড়াবার কেউ থাকে না। তিনি সমাজের চোখে বোকা লোক। আজকের ভারতে –An honest man is a stupid man.
একটি শিশুও জানে কিসে ভারতের মঙ্গল হবে আর কিসে হবে অমঙ্গল। কিন্তু গোটা ভারত বিশাল অজগরের মত জেগে ঘুমাচ্ছে। জাত-পাত ও ধর্ম ভিত্তিক সংরক্ষণ দেশের সব চেয়ে বড় শত্রু। কিন্তু ভোটের রাজনীতির যুগে দিন দিন বাড়ছে নানাবিধ সংরক্ষণের দাপট। দরকার, খুব দরকার এমন কিছু মানুষের যারা গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করবে- রাজা তোর কাপড় কোথায়?
আমজনতা মনে করে সব দোষ শাসক দলের। শাসক দলটি বদলালেই সব কিছু ম্যাজিকের মত বদলে যাবে।আবার রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে সবাই গর্জে ওঠে, পরিবর্তন, পরিবর্তন চাই। কি পরিবর্তন? না, নিজেরা সবাই দুর্নীতি গ্রস্থই থাকব, কিন্তু নতুন শাসক দল হবে ধোওয়া তুলসী পাতা। যা সত্যিই সোনার পাথর বাটি খোঁজার সামিল। সুতরাং পরিবর্তন প্রত্যাশী জনগণ নতুন শাসক দলের শাসনে কিছু দিনের মধ্যেই আবার বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। এরপর গঠিত হয় আরও কিছু নতুন রাজনৈতিক দল যা আরও বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ বলে প্রমাণিত হয় অল্প দিনের মধ্যেই। আসলে পরিবর্তনটি দরকার শাসক দলের নয়, জনগণের নিজেদের চরিত্রের। আম জনগণের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ নেতা হন। সেই আম জনগণের চরিত্রই যদি কালিমা যুক্ত এবং ভোগ বাদে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়, তবে যিনি নেতা- তিনি শাসক বা বিরোধী যে দলেরই হন না কেন , তিনি তো দুর্নীতিগ্রস্থ হবেনই। তিনি তো চুরি-চামারি, ডাকাতি, ধর্ষণ, রাহাজানি করবেনই, তিনি তো দেশটাকে বিক্রির ব্যবস্থা করবেনই। এতে অবাক হবারই বা কি আছে, হতাশ হবারই বা কি আছে?
যতদিন না ভারতবর্ষের আমজনতার মধ্যে ফিরে আসবে বিবেকবোধ, যতদিন না ভারতবর্ষের আমজনতা ভোগবাদ ত্যাগ করে পরস্পরকে ঠকানোর জুয়োচুরি বন্ধ করে পরস্পরের সহাবস্থানে বিশ্বাসী হবে, তত দিন পর্যন্ত যতই শাসক শ্রেণির বদল হোক, গণভোট হোক, কোনও পরিবর্তন হবে না, চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে এই মানবিকতার সঙ্কট তথা স্বাধীনতার সঙ্কট।
Sudipta Biswas (WBCS),Ediror-Digantopriyo, Nokari Uttar Para, Ranaghat(Nasra), Nadia,pin-741202,Mob-9836020902, [email protected]
১৮৯৮ সাল।বিচার প্রহসন সমাপ্ত হল। দামোদরের বিরুদ্ধে হত্যা অপরাধের চার্জ। পুনার প্লেগ অফিসার রান্ড সাহেব কে হত্যা করেছেন মহারাষ্ট্রের এই বিপ্লবী। বিদ্রোহী চাপেকারের মৃত্যু দণ্ড উচ্চারিত হল কোর্টে।সহাস্যে দামোদর বললেন , ‘এই মাত্র? আর কিছু নয়?’ নির্দিষ্ট দিনে দামোদরের কণ্ঠ রোধ করল ফাঁসির নির্মম রজ্জু।ঝুলে পড়ল তার মৃত্যুহীন দেহটি।এই ভাবে শুধু মাত্র একটি নয়, একই মায়ের বুক থেকে ঝরে গেল তিন তিনটি ভাই- দামোদর, বালকৃষ্ণ ও বাসুদেব চাপেকার- চাপেকার পরিবারের তিন তিনটি সন্তান।দেশ জননীর অপমান অসহ্য মনে হয়েছিল বলেই তারা প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন দেশ মাতৃকার পরাধীনতার বন্ধন মোচনের জন্য।তাদের সংগ্রাম ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম।সাদা চামড়ার বিদেশি মানুষের বিরুদ্ধে দেশি মানুষের সংগ্রাম।সে সংগ্রাম ছিল শক্তিশালীর বিরুদ্ধে দুর্বলের, শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের, পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার।চাপেকার ভাইদের মত প্রাণ দিতে হয়েছে বহু বিপ্লবী বন্ধুদের। কিন্তু কখনোই পিছপা হয়নি ভারতের যুবকেরা।এক জনের মৃত্যুর পর আরও দশ জন হাসি মুখে এগিয়ে এসেছে প্রাণ দান করার জন্য। কারন, তখন তাদের মধ্যে জেগে উঠেছিল দেশাত্মবোধ।তখন ভারতবর্ষে ছিল পরাধীনতার সঙ্কট।আজ যুগ বদলেছে, স্বাধীন হয়েছে ভারতবর্ষ। কিন্তু সে আজ ভুগছে মানবিকতার সঙ্কটে যা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে স্বাধীনতার সঙ্কট। যা আরও অনেক জটিল আর ভয়ংকর। কোনও রোগকে যদি ধরা যায় তবে তা নির্মূলও করা যায় ।কিন্তু রোগ ধরা না গেলে তার দাওয়াই দেওয়া সহজ নয়। সে সময় শত্রু পক্ষ ছিল সাদা চামড়ার ইংরেজ। ইংরেজ দেখলেই বয়কট কর, বিদ্রোহ কর, যুদ্ধ কর- এই ছিল রীতি।ভারতবাসী সেটা বুঝতে পেরেছিল। তাই এসেছিল স্বাধীনতাও। কিন্তু তথাকথিত স্বাধীন ভারতবাসী আজও বুঝতে পারছে না স্বাধীনতাটা ধরে রাখা যাবে কিভাবে?তারা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়ে বসছে।এ ক্ষেত্রেও রোগটি ঢুকেছে ওই সাদা চামড়ার দেশ থেকেই। শুধু AIDS বা ডিভোর্স নয়।ভারতবর্ষকে গ্রাস করেছে ভয়ংকর পশ্চিমী ভোগবাদ। কনভেন্ট এজুকেশনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি শিশুর মনেই ঢুকে পড়েছে ভয়ংকর ভোগবাদ। ছোঁয়াচে এই রোগ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে যারা কোনও দিন স্কুলে যায়নি তাদের মধ্যেও। আজ ভারতের মানুষ সবাই ভোগী । তারা চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় ভোগ করতে চায়। এনজয়, এনজয়টাই আজকের ভারতের মূল মন্ত্র। টাকা, টাকা চাই।আজকের ভারত সকালে ঘুম থেকে উঠে বলে- টাকা চাই। সারাদিন হন্যে হয়ে ছোটে টাকার পিছনে।রাতে ঘুমতে যাবার আগেও হাই তুলতে তুলতে বলে, টাকা চাই।কিন্তু স্বপ্নের মধ্যেও সে ধরতে পারে না তার অধরা টাকাকে। সত্যি করে বললে কত টাকা চাই, কত টাকা পেলে এই টাকার পেছনে ছোটা বন্ধ হবে সেটা জানে না একজন ভারতীয়ও ।তাই তারা শুধু ছুটছে আর ছুটছে। এই ছোটাছুটিতে পরস্পরকে শুধুমাত্র ধাক্কাধাক্কি নয়, মেরে ফেলতেও পিছপা নয় ভারতবাসি।তাদের মানবিকতার ফাঁসি হয়ে গেছে অনেকদিন।সবাই চায় সবাইকে ঠকাতে। আর এই ঠকানোর জুয়া চুরিতে ঠকতে হয় সবাইকেই।মাছ ওয়ালা ঠকায় খদ্দেরকে।সেই খদ্দেরই তাকে ঠকায় যখন সে তেল বা চাল কিনতে তাদের দোকানে যায়। ডাক্তার ঠকান রোগীকে। সেই রোগীও ডাক্তারকে ঠকান যখন ডাক্তার গাড়িতে চড়েন, বাজারে যান, ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করান, ফ্ল্যাট কেনেন অথবা নেহাতই হাওয়া বদল করতে বেড়াতে যান অন্য কোনও জায়গায়।সব ভারতবাসীই আপ্রাণ চেষ্টা করেন তার কাছে অন্য যেই আসুক, তার গলা কাটতে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা বা পুলিশেরাই তাদের চরিত্র হারাননি, চারিত্রিক ভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন আমজনতা। প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে ভোগবাদ আর দুর্নীতি। রং মিস্ত্রি, সাইকেল মিস্ত্রি, জুতো পালিশের কবলার, ঠিকে ঝি, ছাত্র, শিক্ষক, হেডমাস্টার, জমির দালাল, ইঞ্জিনিয়ার, পলিটিশিয়ান- সবার চরিত্র সমান।সবাই-ই দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।সবাই জানে রোগ একটা হয়েছে।কিন্তু এ যে সর্ষের মধ্যেই ভূত- থুড়ি- ভূতের মধ্যেই সর্ষে। ভেজালের পরিমাণটা বাড়তে বাড়তে এতটাই বেড়ে গেছে যে এখন, আসল বস্তুটি যে কি সেটাই বোঝা দায়। স্বাধীনতার যুদ্ধটা ছিল অনেক সহজ একটা অঙ্ক। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, ব্যস। কিন্তু আজ এ যে নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যা খুব কঠিন কাজ।সেদিন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের হতাশ যুবক অধ্যাপকের সঙ্গে কথা হল। জীবনের যাঁতা কলে ঠকতে ঠকতে এখন তিনি দ্বিধাগ্রস্থ। দুটি সন্তান তার। নিজে খুব সহজেই ম্যানেজমেন্টের থিওরির উপর লেকচার দেন এম. বি. এ’র ক্লাসে। কিন্তু কি শিক্ষা দেবেন তিনি তার নিজের কচি কাঁচা ছেলে মেয়ে দুটিকে ? তাদেরকে কি শেখাবেন মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে ? বিবেকবান হতে?না কি তাদের কে শেখাবেন স্বার্থপর হতে, স্রোতের সঙ্গে ভেসে গিয়ে টাকা, টাকা করে হাই তুলতে? বিবেকবান হলে তো তাদেরকে জীবন ভোর ঠকতে হবে, সাঁতার কাটতে হবে স্রোতের বিরুদ্ধে। কোনও মা বাবাই কি চান তার সন্তানেরা জীবনভোর ঠকুক? কষ্টে থাকুক? কিন্তু চাপেকার ভাইদের মা চেয়েছিলেন। পরাধীন ভারতের বহু মা বাবা চেয়েছিলেন তার ছেলে রায়বাহাদুর না হয়ে বিপ্লবী হোক। দুধেভাতে না থেকে গর্জে উঠুক, হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ুক। সে সময়ে মানবিকতার সঙ্কটটি আসেনি। মানুষ মনের অন্তস্থল থেকে ফকির হয়ে যায়নি। আজ লাখোপতি , কোটিপতি, মিলিয়নিয়ার, বিলিয়নিয়ার-সবাই ফকির।তারা চায় তাদের ছেলেরা আরও অনেক টাকা আয় করুক। আরও লোক ঠকাক। একটি পদার্থের মধ্যে কিছু পরিমাণ অপদ্রব্য মিশে গেলে তাকে পৃথক করা যায়। কিন্তু পদার্থটির প্রতিটি পরমাণুই যদি বিষাক্ত হয়ে পড়ে তবে তাকে বিষ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় কি? আজ ভারতীয় সমাজটির হয়েছে শেষোক্ত পদার্থটির দশা। ভাষা, জাতি, ধর্ম, রাজ্য নির্বিশেষে গোটা ভারতের একই চিত্র। ভারত একটি ভোগী দেশ।ভারত একটি দুর্নীতিপূর্ণ দেশ।যে ভারত পৃথিবীকে শুনিয়েছিল উপনিষদের শান্তির ললিত বাণী- ‘ত্যক্তেন ভুঞ্জিথ্যা’, তার এই নৈতিক অবনমন সত্যিই অকল্পনীয়। পশ্চিমী হালকা ভোগবাদ সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে ভারতের গোটা সমাজটাকে। মিথ্যে বলা ও লোক ঠকানো ভারতবাসীর সাধারণ ধর্মে পরিণত হয়েছে। যিনি মিথ্যে বলেন না বা কাওকে ঠকান না তাকে সর্ব ক্ষেত্রেই ঠকতে হচ্ছে পদে পদে। বিপদে তার পাশে দাঁড়াবার কেউ থাকে না। তিনি সমাজের চোখে বোকা লোক। আজকের ভারতে –An honest man is a stupid man.
একটি শিশুও জানে কিসে ভারতের মঙ্গল হবে আর কিসে হবে অমঙ্গল। কিন্তু গোটা ভারত বিশাল অজগরের মত জেগে ঘুমাচ্ছে। জাত-পাত ও ধর্ম ভিত্তিক সংরক্ষণ দেশের সব চেয়ে বড় শত্রু। কিন্তু ভোটের রাজনীতির যুগে দিন দিন বাড়ছে নানাবিধ সংরক্ষণের দাপট। দরকার, খুব দরকার এমন কিছু মানুষের যারা গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করবে- রাজা তোর কাপড় কোথায়?
আমজনতা মনে করে সব দোষ শাসক দলের। শাসক দলটি বদলালেই সব কিছু ম্যাজিকের মত বদলে যাবে।আবার রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে সবাই গর্জে ওঠে, পরিবর্তন, পরিবর্তন চাই। কি পরিবর্তন? না, নিজেরা সবাই দুর্নীতি গ্রস্থই থাকব, কিন্তু নতুন শাসক দল হবে ধোওয়া তুলসী পাতা। যা সত্যিই সোনার পাথর বাটি খোঁজার সামিল। সুতরাং পরিবর্তন প্রত্যাশী জনগণ নতুন শাসক দলের শাসনে কিছু দিনের মধ্যেই আবার বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। এরপর গঠিত হয় আরও কিছু নতুন রাজনৈতিক দল যা আরও বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ বলে প্রমাণিত হয় অল্প দিনের মধ্যেই। আসলে পরিবর্তনটি দরকার শাসক দলের নয়, জনগণের নিজেদের চরিত্রের। আম জনগণের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ নেতা হন। সেই আম জনগণের চরিত্রই যদি কালিমা যুক্ত এবং ভোগ বাদে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়, তবে যিনি নেতা- তিনি শাসক বা বিরোধী যে দলেরই হন না কেন , তিনি তো দুর্নীতিগ্রস্থ হবেনই। তিনি তো চুরি-চামারি, ডাকাতি, ধর্ষণ, রাহাজানি করবেনই, তিনি তো দেশটাকে বিক্রির ব্যবস্থা করবেনই। এতে অবাক হবারই বা কি আছে, হতাশ হবারই বা কি আছে?
যতদিন না ভারতবর্ষের আমজনতার মধ্যে ফিরে আসবে বিবেকবোধ, যতদিন না ভারতবর্ষের আমজনতা ভোগবাদ ত্যাগ করে পরস্পরকে ঠকানোর জুয়োচুরি বন্ধ করে পরস্পরের সহাবস্থানে বিশ্বাসী হবে, তত দিন পর্যন্ত যতই শাসক শ্রেণির বদল হোক, গণভোট হোক, কোনও পরিবর্তন হবে না, চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে এই মানবিকতার সঙ্কট তথা স্বাধীনতার সঙ্কট।
Sudipta Biswas (WBCS),Ediror-Digantopriyo, Nokari Uttar Para, Ranaghat(Nasra), Nadia,pin-741202,Mob-9836020902, [email protected]
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আসোয়াদ লোদি ১০/১২/২০১৪সমকালীন মুল্যবোধের অবক্ষয়ে লেখকের মানবিক সাম্যবাদী নিষ্ঠার পরিচয় পেলাম ।
-
আবিদ আল আহসান ০৭/১২/২০১৪সুন্দর হয়েছে
-
অগ্নিপক্ষ ০৭/১২/২০১৪আপনাদের মতো হতাশাবাদীরাই ভারতের উন্নতির পক্ষে প্রধান বাধা। কলিযুগের ধর্ম মেনে দশজনের মধ্যে তিন জন খারাপ হবেই আর সেটাকে "সবাই খারাপ" বলা চলে না।
আমি নিজের জীবন থেকে হাজার-একটা উদাহরণ দিতে পারি আমার পরিচিত লোক এবং বন্ধুবান্ধবদের, যারা ডলারের লোভ ত্যাগ করে বিদেশের বদলে এখানেই কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থায়, বা শহরের বদলে গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা করছে।
আগে নিজের দৃষ্টিভঙ্গী পালটান। জাপানকে টেক্কা দিয়ে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি এমনি এমনি হওয়া যায় না। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশ এমনি এমনি হওয়া যায় না।
আপনি আমার জীবনের দশ মিনিট সময় নষ্ট করে দিলেন! এইটা আবার প্রবন্ধ?!! নিজের কর্ম এবং কর্তব্য মন দিয়ে করুন। তাহলেই দেশ এবং দশের উন্নতি হবে। -
সুদীপ্তবিশ্বাস ০৭/১২/২০১৪পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ রইলো...