www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মাতৃভূমির মায়া

১৫-০৮-২০১৭
রাত গেলেই জুমাবার। মর্জিনা’র বড় ছেলে আকাশ’কে বলল-বাহিরে বেশীক্ষণ থেকোনা। দেশের অবস্থা ভালো নয়। আর্মি ঢুকতে পারে যখন তখন। সেইদিন কালা মিয়ার সহজ সরল ছেলেটাকে নিয়ে গেছে। ফেরত দেয়নি। এখন কোথায় আছে কেউ জানে না। তোর বাপকে বলেছি বাজারে যেন দেরী না করে। বাজারে আড্ডা দেয়া ভাল না। কে শুনে কার কথা? মর্জিনা আকাশ-কে বিড়বিড় করে বলতে থাকে।
বাজার বলতে ছোট ছোট কয়েকটা দোকান ঘর। প্রতিদিন বিকেলে হাট বসে। গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। আকাশ ১৫-১৬ বছরের টকবকে যুবক। পড়ালেখার সুযোগ না থাকাতে কৃষিকাজ করে। শুধু ওই কেন? এলাকার সবাইতো এই কাজ করে। পড়ালেখার সুযোগ গোটা এলাকাতেই নেই। তাছাড়া দু’একজন অনেক কষ্ট করে উচ্চ শিক্ষা নিলেও কোন সরকারী চাকুরী কপালে জোটেনি।
মর্জিনার শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। রোগে-শোকে কাতর। বড় মেয়েটাকে ঘর ছাড়া করা হয়েছে। মানে বিয়ে (বিয়ে রাষ্ট্রীভাবে নিষিদ্ধ) হয়েছে। তখন ওর বয়স ছিল ১৩-১৪ বছর। মেঝে ছেলে ফারুখ-এর বয়স যখন ৯ বছর, চিকিৎসার অভাবে নিউমনিয়া’য় মারা যায়। এরপর কামাল-এর বয়স কেবল ৫ বছর। মোটামুটি চটপটে। তারপর ০২ বছর বয়সের মেয়ে-হাজেরা। দেখতে ফুটফুটো। কোলে আছে ০১ মাস বয়সের ছেলে-মাসুদ। সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে খুবই চিন্তিত। সেয়ানা পোলাপাইনদের ঘরে রাখাও সমস্যা। কারণ ওর বাহিরে থাকতে হয় সারাক্ষণ। মাঠে কাজ করে। ফসল ফলায়। মেয়েরা’তো বাসায় থাকে। তাই অতটা ভয় নেই। যদিও মেয়েদেরও মাঝে মধ্যে নানান সমস্যা দেখা যায়।
কয়েকদিন আগে গ্রামে কি যেন একটা গন্ডগোল হয়েছে। তার রেশ এখনও কাটেনি। রাত্রে খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। পরপর কয়েকটি গুলির আওয়াজ শোনা গেল। ঘুমটা কেবল ধরেছে-মর্জিনার। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে বিরক্তি লাগছে। কি হয়েছে? মারামারি? নাকি আগুন লেগেছে কারো বাড়িতে? আকাশের বাপ’কে ডেকে তোলা হলো। মানুষের আহাজারী, চিৎকারে যেন গ্রামটাকে জিনের আছরে ধরেছে। গন্ডগোল মনে হয় ভালো করেই লেগেছে। আন্দাজ করা কঠিন।
পাশের বাড়ির ‘কালাম’ এসে আকাশ’কে ডেকে নিয়ে গেল। বল্ল-চাচী আমরা বাড়ির দরজার কাছেই আছি। দেখি কোথায় কি হয়েছে। কালাম’ও আকাশ-এর সমবয়সী। একসাথে আড্ডা দেয়। খোঁছ খবর রাখে। কি হয়েছে গ্রামে একটু কাছ থেকে দেখতে গিয়ে আর ফেরার কোন খবর নেই। ছেলে আসতে দেরী দেখে আকাশের বাপ ‘সাদেক’-কে পাঠানো হলো বাড়ির আশে-পাশে খোঁজ নিতে।
ভোর হতে আরো ঘন্টা খানেক লাগবে হয়ত। দু’চোখে কোন ঘুম নেই। বাসার সবাই অপেক্ষা করছে। আকাশ কখন আসবে? তাকে খোঁজতে গিয়ে সাদেক সাহেবেরও কোন খবর নেই। মানুষের চিৎকার, আহাজারী বাড়তেছে।
সকালের সূর্য ওঠার লাল আভায় দেখা যাচ্ছে চারিদিকে আগুন জ¦লছে। কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী অনেক দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে। মানুষের আত্মচিৎকার যেন থামছে না। কেয়ামতের সকাল বেলা মনে হচ্ছে-মর্জিনার। বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়েছে আর্মিরা। ঘরে যাকে পাচ্ছে, পিটিয়ে বের করে দিচ্ছে। যারা কিছু বলতে চেষ্টা করেছে, তাদেরকে মুহু মুহু গুলি করে পেলে দিচ্ছে নির্বিচারে। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিচ্ছে। উপরে ছুড়ে মারছে খেলার পুতুলের মতো। পাশের বাড়ির এক মেয়েকে প্রকাশ্যে নির্যাতন করেছে কয়েকজন আর্মি। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা’দের টেনে হেজড়ে মজা করতে করতে বের করে দিচ্ছে। অনেক কাকুতি মিনতি করেও রেহাই পাচ্ছে না কেউ। এসব কানে আসতেছে-মর্জিনার। আশে-পাশের সবাই দিকবিদিক ছোটাছুটি করছে। কি করবে? কোন দিকে যাবে? সবাই যার যার মতো পালানোর চেষ্টা। অজানা গন্তব্যে। মর্জিনা কি করবে? কোন উপায় না দেখে পাশের বাড়ির তোঁতা মিয়ার বউ কমলা’র সাথে বের হয়ে পড়লো। কমলা’র সামান্য পড়ালেখা জানা আছে। একটু চালাকও বটে। মর্জিনা-ছেলে কামাল ও হাজেরা এবং কোলের মাসুদ-কে নিয়ে বের হলো জীবন বাঁচানোর জন্য। বাপ-বেটা যেখানে থাকুক ভালো থাকবে (ইনশাল্লাহ), মনে পোষণ করা ছাড়া কোন গতান্তর নাই। ওদের অপেক্ষা করলে হয়তো কেউ রেহাই পাবনা, জালিমদের হাত থেকে। বাড়ি থেকে বের হয়ে আর একবার ঘর-বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে মর্জিনা। এই দেখাই হয়ত শেষ দেখা! বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ফসলি জমি। গোয়ালে গরু। হাঁস-মোরগ। চৌদ্দ পুরুষের ‘মাতৃভ‚মির মায়া’ সব ছেড়ে.........।
ফসলি জমি। কর্দমাক্ত মাঠ। মেঘমুক্ত আকাশ। বাঁশ বাগান। ঝোঁপ-ঝাপ, পাহাড়ী রাস্তা। প্রায় ১৫-২০ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিয়ে চলছে ভ্রমণ। দূর্দিনের যাত্রী। এই পথ যেন কখনও শেষ হবার নয়! শুধু ওই কেন? আরো অনেকে। শত শত লোক। খাবার নেই। পানি নেই। ছোট ছোট বাচ্চা। জীবনেও এতটা পথ হাঁটা হয়নি। কামাল কিছুটা হাঁটতে পারলেও হাজেরা পারে না। মাঝে মাঝে কামাল হাজেরা’কে কাঁধে নেয়। বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন। ওই নিজেও একটা শিশু। কি করবে। বোন’কে রেখে যাওয়া যায়? মর্জিনা মাঝে মাঝে হাজেরা-কে কোলে নেয়। দু’টা শিশুকে একসাথে কোলে-পিঠে নিয়ে হাঁটা। পেটে নেই খাবার। আতঙ্কতো আছেই। যদি আর্মিদের হাতে ধরা পড়ে। তবে হয় ইজ্জত, না হয় জীবন। নিস্তার নাই।
বহু কাকুতি মিনতি করে মাঝিকে রাজি করান যাচ্ছে না। কানের দুল, নাকের নূলক খুলে দিয়ে বহু কষ্টে শেষমেষ মাঝিকে রাজি করিয়ে চাম্পানে। মনের মধ্যে একটাই আতংক নাফ নদী পাড়ি দিয়ে ওই পাড়ে যাওয়া যাবে তো? আবার সাহসও হয়, আমি তো একা না, অনেকেই তো যাচ্ছে। কিন্তু ওই পারে না জানি কি হবে? আল্লাই জানেন। চারিদিকে পানি আর পানি, মানুষ আর মানুষ। পেটেতো একটি দানাও নেই। কিন্তু সেদিকে কোন ভ্রক্ষেপ নেই।
টলমল করতে করতে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ। দুই’টা বাচ্চা, ভাই-বোন আর মর্জিনার কোলে মাসুদ নদী পার হয়ে যেন রাজ্য জয় করেছে। এমন একটি আনন্দ কাজ করছে মনে মনে। যা হোক জীবনতো বাঁচান গেল। উখিয়া’য় এসে একটি তাঁবু টানানো ‘আশ্রয় কেন্দ্র’-এ ঠাঁই হলো। অন্য সবার সাথে মাথা রাখার জায়গা পাওয়া। লোকে লোকারণ্য। এখন কিছু খাওয়া দরকার। কোথায় যাবো? কোথায় খাবার পাওয়া যায়? কথা বলা যাবে কিনা। পুলিশ আবার কি করে-না করে। ইতিমধ্যে, কে যেন একটা বনরুটি, কিছু শুকনো খাবার দিল। বাচ্চারা না হয় খেতে পারবে, কিন্তু কোলের ‘মাসুদ’? ওতো ঘুমিয়ে আছে! লক্ষী ছেলে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে? বলতে বলতে কান্না চোখে। কিন্তু মা’তো জানেনা তাঁর ছেলে আর কোনদিন ঘুম থেকে ওঠবে না। তবুও। মা’ তার কাঁদে। ছেলেটি মরে গেছে.... হায়রে হায়, আরাকান.......।
(লেখক: কবি, কলামিস্ট ও ঊন্নয়ন কর্মী; [email protected])
Cell# 01715363079
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৭৮১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩১/১০/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সোলাইমান ৩১/১০/২০১৭
    অসাধারণ লিখেছেন কবি
    উপলদ্ধিতে মুগ্ধতা,
    জানবেন শুভেচ্ছা নিরন্তর।।।।
  • আজাদ আলী ৩১/১০/২০১৭
    Valo laglo priy kobi
 
Quantcast