বেটি পর্ব -২
২
এবছরটা তাদের জমিতে লক্ষ্মীর কৃপা । মোটামুটি স্বছলতার আভাস পাওয়া যায় । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা । কথা বলতে বলতে হঠাৎ লতা এক দৌড়ে বাইরে বেড়িয়ে যায় । বউয়ের এমন আচরণে আমোদ ঘাবড়ে ওঠে ।
- “ কি গো হল কি তোমার !” প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে আমোদ ।
- “ আরে তুমি শুনতে পাও নি ! বাইরে এস ” বাইরের বারান্দা থেকে লতা উঁচু গলায় জবাব দেয় ।
বেড়িয়ে কান পেতে মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে আমোদ । গ্রামে রাতটা একটু তাড়াতাড়ি হয়ে যায় । ভাল করে শোনা না গেলেও বহুদূর থেকে চাপা কান্না আর কিছু চাপা কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে ।
পাকা বাঁশের খুঁটিটা জড়িয়ে ধরে লতা একমনে দাঁড়িয়ে থাকে । কাঁধে আমোদের হাত পরতেই সে চমকে উঠে পাশ ফেরে ।
- “ জগা তাহলে গেল ” একটা গভীর নিঃশ্বাস চেড়ে আমোদ বলে ওঠে । অন্ধকারের মধ্যে অনুভব করে লতা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে । অবাক হয়ে আমোদ আবার বলে , “ কি হয়েছে তোমার ! তুমি কাঁদছ !”
- “ কই না তো ” ছোট্ট উত্তর দেয় লতা ।
আমোদ সব সহ্য করতে পারে কিন্তু বউয়ের চোখে জল বা কষ্ট তার কাছে শত আঘাতের থেকেও বড় । প্রায় জোড় করে টেনে নিয়ে যায় ঘড়ে । দোর বন্ধ করে ঘড়ের হাল্কা আলোয় আমোদ ভালো করে দেখার চেষ্টা করে লতার মুখের প্রতিটি টান । আঁতকে ওঠে দেখেই !
- “ একি তোমার চোখ যে লাল !”
- “ ও কিছু নয় , ঠাণ্ডা বাতাস লেগে অমন হয়েছে ” নিজেকে সামলে নিয়ে লতা অন্য দিকে যায় ।
আমোদ বেশী ঘাটায় না । সে জানে লতা চাপা মেয়ে । এটাও বোঝে তার বউ খুবই নরম স্বভাবের । জগার মৃত্যু তার নরম মাটিকে বেশ খানিকটা নাড়া দিয়েছে ।
এই গ্রামে একমাত্র ভদ্র শিক্ষিত ছেলে ছিল জগা । শহরের কাজ হঠাৎ-ই ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে আসে । গ্রামটা খুব একটা তো বড় না । প্রথম দিকে আলাপ না হলে পরে ভালো ভাবে পরিচয় হয়ে যায় । খুব জোর দু-এক বছরের ছোটই হবে জগা । মাঝে মধ্যে সময় বার করে চলে আসে আমোদের বাড়ী । আর লতাও ধীরে ধীরে দেওর হিসাবে একটু প্রাধান্য দিতেও শুরু করে । আমোদের তিন কুলে কেউ নেই । সুতরাং বন্ধুত্ব ক্রমশ আপনজনের স্থান নিয়ে ফেলে ।
কয়েকদিন আগেই মাঠ থেকে ফিরে দেখে লতা রান্না করতে করতে দিব্যি আড্ডা দিচ্ছে জগার সাথে । মনে মনে খুশী হয়ে বলদ দুটিকে গোয়ালে বেঁধে সেও মেতে ওঠে ওদেরই সাথে । কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে শহরে যে জুটমিলে কাজ করত তা আচমকা নোটিশ দিয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে । বেকার প্রায় কয়েকশো মানুষ । জগাও তাদের মধ্যে একজন । গ্রামে কিছুদিন থেকে নতুন চাকরীর সন্ধান করবে ।
আজ নানা কথা মনে পরে যাচ্ছে আমোদের । সত্যি মানুষের অনুপস্থিতি কত কি মনে করিয়ে দেয় !
- “ লতা আমি একটু আসছি ” – জামাটা গায়ে পরতে পরতে বলে আমোদ ।
- “ আমিও যাব তোমার সাথে ” কথাটা প্রায় চাপা অথচ ধারালো গলায় বলে ওঠে লতা ।
খট্ করে কানে লাগল ! এ ধরণের গলা ইতিমধ্যে কোনদিন শুনেছে বলে মনে হয় না । খানিকটা চুপ করে থেকে আমোদ বলে উঠলো “ তোমাকে কি যেতেই হবে ? জানোই তো নানা লোক তোমাকে নিয়ে...” কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দেখল লতা পরনের শাড়িটা ভাল করে গুঁজে আমোদের হাতটা শক্ত করে ধরেছে । নির্বাক কণ্ঠে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে , সে যাবেই ।
হাতের টর্চটা মাঝে মধ্যে জ্বালাতে হচ্ছে । গ্রামের সরু গলি বেয়ে জগার বাড়ীর দিকে যত এগোচ্ছে তত কান্নার শব্দ তীব্র হয়ে রাতের অন্ধকারকে আরও ভারী করে তুলছে ।
( চলবে )
এবছরটা তাদের জমিতে লক্ষ্মীর কৃপা । মোটামুটি স্বছলতার আভাস পাওয়া যায় । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা । কথা বলতে বলতে হঠাৎ লতা এক দৌড়ে বাইরে বেড়িয়ে যায় । বউয়ের এমন আচরণে আমোদ ঘাবড়ে ওঠে ।
- “ কি গো হল কি তোমার !” প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে আমোদ ।
- “ আরে তুমি শুনতে পাও নি ! বাইরে এস ” বাইরের বারান্দা থেকে লতা উঁচু গলায় জবাব দেয় ।
বেড়িয়ে কান পেতে মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে আমোদ । গ্রামে রাতটা একটু তাড়াতাড়ি হয়ে যায় । ভাল করে শোনা না গেলেও বহুদূর থেকে চাপা কান্না আর কিছু চাপা কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে ।
পাকা বাঁশের খুঁটিটা জড়িয়ে ধরে লতা একমনে দাঁড়িয়ে থাকে । কাঁধে আমোদের হাত পরতেই সে চমকে উঠে পাশ ফেরে ।
- “ জগা তাহলে গেল ” একটা গভীর নিঃশ্বাস চেড়ে আমোদ বলে ওঠে । অন্ধকারের মধ্যে অনুভব করে লতা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে । অবাক হয়ে আমোদ আবার বলে , “ কি হয়েছে তোমার ! তুমি কাঁদছ !”
- “ কই না তো ” ছোট্ট উত্তর দেয় লতা ।
আমোদ সব সহ্য করতে পারে কিন্তু বউয়ের চোখে জল বা কষ্ট তার কাছে শত আঘাতের থেকেও বড় । প্রায় জোড় করে টেনে নিয়ে যায় ঘড়ে । দোর বন্ধ করে ঘড়ের হাল্কা আলোয় আমোদ ভালো করে দেখার চেষ্টা করে লতার মুখের প্রতিটি টান । আঁতকে ওঠে দেখেই !
- “ একি তোমার চোখ যে লাল !”
- “ ও কিছু নয় , ঠাণ্ডা বাতাস লেগে অমন হয়েছে ” নিজেকে সামলে নিয়ে লতা অন্য দিকে যায় ।
আমোদ বেশী ঘাটায় না । সে জানে লতা চাপা মেয়ে । এটাও বোঝে তার বউ খুবই নরম স্বভাবের । জগার মৃত্যু তার নরম মাটিকে বেশ খানিকটা নাড়া দিয়েছে ।
এই গ্রামে একমাত্র ভদ্র শিক্ষিত ছেলে ছিল জগা । শহরের কাজ হঠাৎ-ই ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে আসে । গ্রামটা খুব একটা তো বড় না । প্রথম দিকে আলাপ না হলে পরে ভালো ভাবে পরিচয় হয়ে যায় । খুব জোর দু-এক বছরের ছোটই হবে জগা । মাঝে মধ্যে সময় বার করে চলে আসে আমোদের বাড়ী । আর লতাও ধীরে ধীরে দেওর হিসাবে একটু প্রাধান্য দিতেও শুরু করে । আমোদের তিন কুলে কেউ নেই । সুতরাং বন্ধুত্ব ক্রমশ আপনজনের স্থান নিয়ে ফেলে ।
কয়েকদিন আগেই মাঠ থেকে ফিরে দেখে লতা রান্না করতে করতে দিব্যি আড্ডা দিচ্ছে জগার সাথে । মনে মনে খুশী হয়ে বলদ দুটিকে গোয়ালে বেঁধে সেও মেতে ওঠে ওদেরই সাথে । কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে শহরে যে জুটমিলে কাজ করত তা আচমকা নোটিশ দিয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে । বেকার প্রায় কয়েকশো মানুষ । জগাও তাদের মধ্যে একজন । গ্রামে কিছুদিন থেকে নতুন চাকরীর সন্ধান করবে ।
আজ নানা কথা মনে পরে যাচ্ছে আমোদের । সত্যি মানুষের অনুপস্থিতি কত কি মনে করিয়ে দেয় !
- “ লতা আমি একটু আসছি ” – জামাটা গায়ে পরতে পরতে বলে আমোদ ।
- “ আমিও যাব তোমার সাথে ” কথাটা প্রায় চাপা অথচ ধারালো গলায় বলে ওঠে লতা ।
খট্ করে কানে লাগল ! এ ধরণের গলা ইতিমধ্যে কোনদিন শুনেছে বলে মনে হয় না । খানিকটা চুপ করে থেকে আমোদ বলে উঠলো “ তোমাকে কি যেতেই হবে ? জানোই তো নানা লোক তোমাকে নিয়ে...” কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দেখল লতা পরনের শাড়িটা ভাল করে গুঁজে আমোদের হাতটা শক্ত করে ধরেছে । নির্বাক কণ্ঠে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে , সে যাবেই ।
হাতের টর্চটা মাঝে মধ্যে জ্বালাতে হচ্ছে । গ্রামের সরু গলি বেয়ে জগার বাড়ীর দিকে যত এগোচ্ছে তত কান্নার শব্দ তীব্র হয়ে রাতের অন্ধকারকে আরও ভারী করে তুলছে ।
( চলবে )
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ১৪/০৭/২০১৮
ব্যকুল মনের কল্পনা, ব্যর্থ হবার লাঞ্ছনা।
আবেগের শেষ প্রান্তে, দ্বিমতের বিভ্রান্তে।
পরাজিত প্রাণের গ্লানি, নাভিশ্বাসে টানা ঘানি।
স্বপ্নে ভাসে প্রতিচ্ছবি, আকাশ জুড়ে শোকের রবি।
দুর্বলতার প্রাদুর্ভাব, ক্লান্ত দেহের মহোৎসব।
জর্জরিত বিষণ্ণ, বার্ধক্যে এই তারুণ্য।
বিজ্ঞাপনে চমৎকার, কাকতালীয় রুদ্ধদার।
আসল খোঁজার অধ্যয়ন, ইচ্ছাকৃত সঞ্চালন।
মায়াকান্না ছদ্দবেশ, সহানুভূতি নিরুদ্দেশ।
সয়ে চলা অত্যাচার, গড়ে তোলে অহংকার।
অভ্যন্তরে বক্রতা, প্রাণে প্রাণে হিংস্রতা।
অনুভূতির যন্ত্রণা, আবেগ বেচে প্রার্থনা।
বীণা অশ্রুর ক্রন্দন, স্বার্থসিদ্ধি ততক্ষণ।
মানবতার প্রত্যাহার, দাবীদার আজ প্রশংসার।
আভ্যন্তরীণ কোন্দলে, সামাজিকতা জঙ্গলে।
প্রাধান্য পায় হিংস্রতা, নম্র বেশে নগ্নতা।
অন্তরায় আজ অজস্র, ইচ্ছে করেই বিবস্ত্র।
রুদ্ধ শাস্ত্র আনকোরা, আত্মশুদ্ধি প্রাণ ভরা।
সম্মিলিত মন্ত্রনায়, ধর্ম বর্ণ মূর্ছা যায়।
অত্যাধুনিক যে যন্ত্র, ধর্ম শেখায় সে মন্ত্র।।