www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ঢাকী - অন্তিম পর্ব


কিছুদিন ধরেই আকাশটা ঘোলাটে হয়ে থাকতো । আজ সকাল থেকে তামাটে মেঘ কালো করে শুরু হল অঝোরে বৃষ্টি । শিং নামিয়ে গরুগুলো ডাক ছেড়েছে । কামার পাড়ায় আগুণ নিভু নিভু । বৈশাখীর মা কোমরে শাড়ির খুঁট খুঁজে ধানিকে মাঠ থেকে আনতে ছুটেছে । হাওয়ার দাপটে রতন কামারের দাওয়ার প্লাস্টিকের ত্রিপল পাল্লা দিয়ে কোন মতে টিকে আছে । গৌর কোনমতে ছাতাটা চেপে ধরে বাড়ির কাছে আসতেই ঠুন ঠুন করে শব্দ । ভ্রূ জোরা কুঁচকে দোরের দিকে কান পাততেই বুঝলো , আওয়াজটা একটু জোড়াল একঘেয়ে তালে বেজে চলেছে । এ যে ঢাকের বোল !
অনেক দিনের চেনা লয় । ছাতাটা দাওয়ার এক কোনে কোন মতে ফেলে কাদা পা নিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখে ঘড় অন্ধকার, জানলা দিয়ে জোলো হাওয়ার সাথে বৃষ্টির ছাঁট ঢুকছে । চোখ বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো শব্দের উৎস ।
-“ বাবা , জেইগে আছ নাকি ,” কিছুটা অজানা আতঙ্ক মিশ্রিত গলায় ডেকে ওঠে গৌর । জানলাটা বন্ধ না করে বাপের কাছে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় । খাটিয়ার একপাশে রাখা ছাল ওঠা ঢাকটার উপর টপ টপ করে বিন্দু বিন্দু জল চুঁইয়ে পড়ছে । শব্দটা ওখান থেকেই উঠে আসছে । ঠিক যেন প্রাচীন সভ্যতার ইতিকথার ধোঁয়াটে নিশীথের কথা বলে চলেছে । দিচ্ছে অস্তিত্বের প্রমান । শেষ হয়েও না শেষ হওয়া সংগ্রামের বীরত্বকে । গৌর থমকে থাকে । দেওয়ালের স্যাঁতস্যেঁতে কোনায় বসে পরে । রুক্ষ চামড়ায় আজ জলীয় বাষ্পের কণা লেগে আছে । ফাটা চামড়ায় আজ শীত আঁকিবুঁকি কাটছে স্বল্প । তবুও এক সহনশীল খোঁচায় সচকিত হয়ে গৌর তাকায় কীর্তনের দিকে । কিছু বলতে গিয়ে অজানা কান্নায় কামার জীবনের চোখটা সজল হয়ে ওঠে । অস্ফুট শব্দে বিড়বির করতে থাকে ।
- “ বাবা তুর হাইতটা লইরছে রে আবার , পারবিক তু ।” শুকনো মাটিতে বৃষ্টির প্রথম জলকণা প্রথম যে ছন্দের মদিরতা তোলে , তারই যেন অমোঘ ছোঁয়া লেগেছে কীর্তনের দেহে । সমূল উৎপাটিত বৃক্ষেরও কোন না কোন অংশ লেগে থাকে মাটির গহ্বরে । দীর্ঘ টানাপড়েনের ইতিহাস লেগে থাকে মানব জীবনে , তার সত্তার কোন এক প্রহেলিকাময় পটভূমিতে ।
নাতির ‘ তোরা নাকি শিল্পী, লাচ ভাইলো কইরে ’ কথাটা যে কতখানি তার শিল্পী সত্ত্বায় আঘাত হেনেছিল, তা এক উঠতি কিশরের মনে নাও দাগ কাটতে পারে । কিন্তু , কিছু আপাত বালখিল্য কথা পরিবর্তন করে দেয় মানব জীবনের আলেখ্য । দোষ পালুকে সত্যি কি দেওয়া উচিত ! প্রশ্নটা আপেক্ষিকতার প্রসঙ্গ টানতে পারে । এটা ঠিক আপেক্ষতার বিচার করতে বসলে অনেক কিছুই জীবনে পাওয়াও যেমন হয় তেমন, হারাতেও হয় তার বেশী । বেশ ক’টা মাস বিছানায় থেকে কীর্তনের অবচেতন মনে যে কথা ঘুরপাক খায় , তা এক অজানা রহস্যে আবৃত । সেই সত্য উদ্ঘাটন করার সামর্থ্য হয়তো কারোরই নেই । তবু বোধ যখন সজাগ হয় তখন সময় অনেকটা চলে গেলও ফেলে যায় কিছু দাগ । সেই দাগের ভরসায় শুরু হয় বাকী পথ চলা ।
থরথরে করে ঠোঁটটা কেঁপে ওঠে প্রাচীন কামারের শুষ্ক মুখের প্রতিটি বলি রেখায় । কয়েকবার ঢোঁক গিলে যেন কীর্তন বলতে চায় তার ঘুমন্ত দেশের অনুভুতির কথা । শীতের কোল ছেড়ে এক ক্ষুদার্ত অজগর যেমন অতি ধীর লয়ে এগিয়ে চলে খাদ্যের সন্ধানে । কীর্তনের দৃষ্টিও সেই সর্পিল আকারে ঘুড়ে ফিরে দেখতে চায় কিছু একটা ।
_ “ পে-লো ক-ই , বা-ই-দ্যি-টা ল-ই-য়ে আ-য় ”, শ্যাওলা ধরা বটের কোটরের কোন এক অতল অন্ধকার থেকে বেরল কীর্তনের ভাঙা ভাঙা স্বর ।
প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হলেও , ক্ষানিক পরে গৌর বুঝে যায় কথাটা । ক্ষানিক চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বলে , “ তু একটু সুইস্থ হইয়ে ওঠ , সব হবেক ।”
অকাল বৃষ্টির ছাঁট ঘড়ের এক কোণকে ভিজিয়ে তুলেছে । সব দেখেও ধীর ভাবে এগিয়ে যায় জানলার কপাটের কাছে । সুক্ষ গুঁড়োর মত জল কণা ভিজিয়ে তুলছে গৌরের রঙ ওঠা জামাটাকে । আজ খারাপ লাগছে না , বরং বেশী করে আসুক জল ধারা, ভরিয়ে তুলুক ফুটি ফাটা বক্ষ পিঞ্জরকে । সজীব করে তুলুক খয়েরী হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনকে । ভাবের ঘোরটা তা কাটলো একটু পরেই । আকস্মিক ভাবে রঙ ওঠা আধ খাওয়া দরজার ঠন ঠন করে কড়া নাড়ার শব্দে । একবার নয় –দু’বার নয় বেশ কয়েকবার , জোড়েই । এবার জানলাটা দ্রুত বন্ধ করে, দরজার দিকে পা চালায় গৌর ।
পাল্লাটা খুলতেই আরও এক বিস্ময় তার চোখে মুখে আছড়ে পড়ল । একটাই শব্দ অতি কষ্টে বেরোল , “ তু...!!”
- “ এইখানেই দাঁইড়ে রাইখবি নাকি !” প্রশ্নটা ছুঁড়েই ভিতরে ঢুকে জামার বোতাম খুলতে থাকে পালু ।
জটিল তত্ত্বে ভরা মানব জীবন । তার থেকেও নানা আবরণে ভরা ব্যবহারিক বৈচিত্র্য । গৌর দরজার দোরেই নিঃস্পন্দের মত দাঁড়িয়ে থাকে । দুটো চোখ লেপ্টে থাকে পালুর দিকে । বোঝা মুশকিল তার চোখের দৃষ্টি কী আদৌ কোন অর্থ খুঁজছে ! বেশ কিছু মাস ধরেই এই হাল । বয়েসের আগেই আর এক বয়েস যেন তাকে গিলে ফেলছে ক্রমশ । সেদিনের ঘটনার পর পালুকে নিয়ে নানা চর্চা বেশ কিছুদিন এক পল্লী জীবনে চায়ের আড্ডা , কামাড়শালা এমনকি রায় বাড়িতে জমে উঠেছিলো । একটু দুরের গ্রামীন হাসপাতালে কটাদিন পরে থাকতে হয়েছিল পালুকে । অসময়ের যদি কোন ফুল ফোটে তাহলে তাকে ঘিরে যেমন কথাও হয় ঠিক তেমনি নানা মানুষের অতি সক্রিয়তাও দেখা যায় ।
পালুর ঞ্জান ফিরতেই যে মানুষগুলো বৃদ্ধ কীর্তনকে , গৌরকে নানা ভাবে সাত্বনা দিয়েছিল তারাই আবার উস্কানির আগুনটা জ্বালাতে কম সাহায্য করে নি । স্রোতহীন পুকুরে একটা ঢিল যে তরঙ্গ ক্ষনিকের জন্য ওঠে , অনুরূপ ভাবে এক নতুন উৎসাহে জেগে উঠেছিল কীর্তনের অসম্যের প্রতেবেশীকুল । তবে এটাই আশ্চর্যের পালুকে পুলিশের কথা যতবারই বলা হয়েছে ততবারই ক্ষীণ স্বরে বাখান দিয়ে উঠেছিলো ।
- “ তুরা লিজের ঘড়টাকে সামলা শালো রা...”
স্তম্ভিত হয়ে যায় পালুর এই ব্যবহারিক পরিবর্তনে । বাখান থেকে মা বাপ তুলে কাঁচা খিস্তিটা নতুন নয়, বরং ডাগর ছেলের মুখে বড় মানানসই । কিন্তু প্রতিশোধের আগুন এত তাড়াতাড়ি নিভে যাবে এটাই অবাক করার মত !
অবাক হয়েছিল আরও ঠিক দু- একদিন পর , হয়ত আলোচনার রসদ আর মর্ম বানীর শোনানোর দুই রাস্তা প্রস্তুত করে পালু ঘড়ে আর পা বাড়ায় নি । কীর্তনের চোখ দিয়ে একটা শুষ্ক জলের রেখা কী যে বলতে চেয়েছিল নিজে কে তা বোঝাই দুঃসাধ্য । গৌর পুরপুরি পাথর না হলেও ছেলের দোষের গুণাগুণ হয়ত কিছুটা বিচার করার মত ক্ষমতাটা অর্জন করেছিল । সাধারণত জীবনে অনেক বড় কিছু হওয়ার পর মানুষের বোধেরও পরিবর্তন হয় ! গৌর কেন তার ব্যতিক্রম হবে ?
শাস্ত্র ঞ্জানহীন হতে পারে কীর্তন বা গৌর , তবে , এটা হয়তো বুঝেছিল, পালু খুব একটা ভুল নয় । সত্যিই , টাকার জন্য তাদের ঢাক বাজাতে হয় । পেটের তাগিদ বড় তাগিদ ! রক্তে ভেসে যাওয়া মন্দির প্রাঙ্গনের সাথে তাদের শিল্পের কোন যোগই নেই । পাশের পাড়ার জগু , মধো বলেছিল , “ দ্যাক গৌর ছেইলটা তোর বইড্ড পাকা । আরে বাবা ফেইল কড়ি মাকো তেল ।”
হরেন খুড়ো মুখ ঝামটা দিয়ে মরা মাছের মত কীর্তনকে বলতেও ছাড়েনি , “ সহাগের লাতি ! তা বইলে শিইল্প শিইল্প করে ... পেটে টান পড়লেই সব পাছা দিয়ে বেইড়ে পইড়ত !”
পালুর আকস্মিক কোথায় চলে যাওয়ার পর খুব একটা খোঁজ নেয় নি কেউই । বেয়াড়া ছেলের থাকা থেকে না থাকাই ভালো , এই ভাবতে টকটকে লাল লোহার পর বলিষ্ঠ হাতুড়ির ঘা দিতে দিতে বহুবার ভেবেছে । আর যত ভেবেছে , ততই সেই অবয়বহীন লোহা কোন ফাঁকে যে কাটারীতে পরিণত হয়েছে খেয়ালই সে করে নি !
খেয়াল যখন এলো তখন দেখে যতটা পাতলা হওয়ার দরকার তার থেকে বেশী পাতলা হয়ে গেছে । আর কয়েক ঘা দিলে ওটা আর কাটারীই থাকত না । সাঁড়াশি দিয়ে ধরে জলে ফেলতেই ছ্যান করে গরম ধাতু এক শান্তির নিঃশ্বাস যেন কোন অতল থেকে ছাড়ে । যেন বলতে চায় , সৃষ্টির মধ্যেও থাকে শৃঙ্খলা , অনুশাসন , তার বাইরে বেরোলেই সৃষ্টির অবমাননা ।
পেটের জন্য সৃষ্টি ,না, সৃষ্টির জন্য পেট ! আপাত সংসারী মানুষ কীভাবে দেখেন সেটা তাদের রুচির বিষয় , বাঁচার ও বাঁচানোর তাগিদের বিষয় । পালু হয়ত , পরোক্ষ স্বার্থ যুক্ত শিল্পী , যার উন্মাদনা সৃষ্টির মধ্যেই সীমিত , আবেগ বাধাহীন । হাজারো পরস্পর পক্ষ ও বিরোধী কথায় চঞ্চল হয়ে পড়েছিল সেই পুজো এবং তার পরবর্তী ঘটনা ক্রম । যতই চঞ্চলতা বেড়েছে স্তিমিত হয়েছে তার পিতৃ মন ।

- “ হাঁ কইরে কি দেইকছ , দরজাটা দাও কেনে !” পালুর কথায় সম্বিত ফিরে পায় গৌর ।
দরজার পাল্লাটা বন্ধ করে গৌর বলে ওঠে , “ কুথা থেইকে আসছিস ?”
- “ ও বড্ড জব্বর বিষয় , কাইল দেইখতে পাবেক , শালো এই ‘ ফাঁপি ’র চোটে লস্ট না হইয়ে যায় ।” সত্যিই এই অকাল পউষে বাদলায় আর ‘ ফাঁপি ’র তান্ডবে জীবন কিছুটা বিপর্যস্ত । তবে বহুকাল পর এমন হওয়ায় একটু অন্য মেজাজে আছে প্রকৃতি ।
প্রকৃতিও তো মানুষের মত । পালুর কথায় সন্দেহটা কেন জানি না আরও দীর্ঘতর হতে থাকে বাপের মন ।
পালু উদ্বেগহীন ভাবে দাদুর কাছে গিয়ে বুড়োর কঠিন কর্কশ গালের চামড়ায় টান মেরে আদরের সুরে বলে ওঠে , “ বুড়ার বইড্ড গোসা , অনেক শুইয়ে লিয়েছিস , কাল সকালে তুকে লাচাব দেইকে লিছ ।”
দাদু আর নাতির বহু পুরনো এক দৃষ্টি বিনিময় হয় । বহুদিনের বীজ যেমন তার ছোট্ট মাথাটি দিয়ে শক্ত মাটির গালে স্নেহের চুম্বন দিয়ে বলে ওঠে , এবার আমাকে আলো দেখাও , জেগে ওঠে নতুন অঙ্কুর । কীর্তনের চোখে দেখা দিল সেই নব কিশলয়ের স্নিগ্ধতা ।
ঘড় থেকে পালানোর উদ্দেশ্য ঠিক উদ্দেশ্যমূলক ছিল না । অদ্ভুত একটা বিষণ্ণতা পালুর মনে দাগ কেটেছিল । হয়ত ওই ঘটনাটা হয়েই পালুর জীবনে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এনেছিল । সে তার রায় বাড়ীর ঘটনার উপর কোন কারনেই অনুতপ্ত নয় । মনে মনে সে আজও তা স্বীকার করে । নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা ধর্মের নামে ! ঠিকই করেছে । কিন্তু অন্তরে দাগ কেটেছে তার দাদুকে কথাটা বলার পর । যদিও সে কতটা বুঝে বলেছে তা সে নিজেও জানে না ।
যতবার পালু নিজের সাথে নিজে কথা বলেছে ততবার অনুভব করতে পেরেছে সেই কথাটার তাৎপর্য । এটা বুঝেছে , অশতিপর ওই বুড়ো তাকে , তার পরিবারকে নিরন্তর ভাবে বাঁচিয়ে রেখেছিলো ঢাকের জোরেই । আজ ওই বাদ্দ্যিটা যদি না জানত তার অশিক্ষিত দাদু তাহলে কেমন জীবনযাত্রা হত ! সেটা অন্য প্রসঙ্গ ।
শিল্পের জন্য সাধনা , না বাঁচবার জন্য শেখা ! এই জটিল তত্ত্ব বোধ করি কেউই ভাবে না , কীর্তনও ভাবে নি । বাপের ধারাকে বজায় রেখে তার আগামী প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া , এই সরল অঙ্কে হয়ত ছিল তার জগত । তবে কীর্তন ভালবেসেছিল ।
শহরে কিছুকাল কুলিগিরি করে বুঝেছে , জীবনে বাস্তবের দৈর্ঘ্যটা বড্ড রকম বেশী । তাও কামারের কাঠিন্য পালু ভোলে কী করে , এ যে তার অস্তিত্ব ! কিছু টাকা কোনমতে রোজগার করে সে ফিরে এসেছে তার গ্রামে । কী ভাবে কোন পথে রোজগার করল , সেটা না হয় নাই জানলাম ।

পরের দিন সকালে বাদলা কমে গেছে । ফাটা ঠোঁটের মত জমি সমস্ত নির্যাস সংগ্রহ করে কিছুটা প্রশান্ত । পালু ভোর থেকেই কোদাল হাতে গ্রামের পাঁচটা ছেলের সাথে ভিজে আগাছা গুলো পরিস্কার করে যেন বলতে চাইছে , সকল মলিনতা ভুলে আবার তৈরী হোক নতুন জমি ।
- “ কে পালু নাকি ? কবে এলি বাপ ”, মুরুব্বি গোছের এক বুড়ো পালুকে জিজ্ঞাসা করে উঠল ।
- “ ও দাদু , এয়েচি কাল গো । আজ এস বাদ্দ্যি শোনাব ,” পালু হাঁসতে হাঁসতে জবাব দিল ।
বেলা যত গড়ায় । ভগ্ন শীতের সকাল একটু তার পরিধিও বিস্তার করে । বেলা একটু বেড়েছে । তবে , আজ গ্রামে যেন অকাল উৎসব লেগেছে । গ্রাম্য জীবনে খুশীর প্রলেপ । সাঁঝ বেলায় শাঁখের ফুঁ দেওয়ার পর বারয়ারি তলায় আসর জমানোর জন্য বাউল গানের আসর বসবে ।
পালু গ্রামে ফেরার পথে কিছু টাকা দিয়ে এসব কান্ড করে আসে ।
সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানোর পর , যে যার মত বেড়িয়ে এসে জমতে থাকে অনুষ্ঠানের জায়গায় । শীতের প্রাবল্য না কমায় মা তার বাচ্চাকে বেশ খানিকটা পুরনো উলের সোয়েটার চাপিয়ে দিয়েছে । হঠাৎ এই অত্যাচারের আতিশয্যে শিশু প্রবল চীৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে উঠলেও আসর ছাড়া যাবে না । এমন সুজোগ সীমিত কামার ও গ্রাম্য কুলে কমই পাওয়া যায় ।
- “ চল বুড়া আইজ দেইখবি তোর পেলো কেমন লাচায় ,” পাজাকলা করে পালু কীর্তনকে তুলে আনে । মঞ্চের পাশে খাটিয়ায় শুইয়ে দেয় ।
ক্রমে রাতের সাথে সাথে বাড়ছে লোক , বাড়ছে হ্যজাকের আলোর তীব্রতা । বাউল গানের পর পালু তার বন্ধু জছোনের বাড়ী থেকে নিয়ে এলো লাল শালুতে মোড়ানো ঢাক ।
চমকে ওঠে গৌর । ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকায় কীর্তন । মাথায় তার জমে থাকা ধোঁয়ার মত কুন্ডলীকৃত চিন্তা যেন বেড়িয়ে আসতে চায় । ঢাকটা পালু কাছে নিয়ে যেতেই প্রাচীন বদ্ধ দরজার মত ঠোঁট দুটি কেঁপে ওঠে তির তির করে ।
- “ দ্যাক , এিটা কে বইলে চাদর , কেমন শইব্দ হয় দ্যাক কেনে ,” বলেই প্লাস্টিকের শক্ত কাঠি নিয়ে নতুন পাতলা ফাইবারে মোড়ানো ঢাকে কাঠি দিয়ে বাজাতে থাকে পালু ।
গম গম করে ওঠে চারি দিক । চামড়ার ঢাকের বদলে নতুন সাজে ঢাক । দিব্ব্যি সুরও তোলে । বাজিয়ে চলেছে পালু । এক উন্মাদনা যেন তার আজ প্রতিটি রন্ধ্রে আবর্তিত হতে থাকে । কার তাগিদে , কীসের জন্য তার এই প্রচেষ্টা !
বেশ খানিকক্ষণ বাজানোর পর থামে পালু । শীতের রাতেও দরদরিয়ে ঘাম ছুটে চলেছে । ঝাঁকড়া চুল মুখের সামনে থেকে তুলে বুড়োর কাছে মুখটা নামিয়ে বলে , “ বইল্লি না তো কেমন হল !”
মানব জীবনে প্রত্যাবর্তন নানা ভাবে আসতে পারে । এটা নয় যে জীবন কাওকে সুজোগ দেয় না । এটা নয় মৃত্যু দোরগোড়াতে দাঁড়িয়ে আছে বলে আরও একবার আশা দেখবে না ।
কীর্তনও পেয়েছিল । দীর্ঘ খরা কাটানোর পর সেই প্রথম বৃষ্টির মত । নিশ্চুপ সে বহুকাল ধরেই । আজ যেন সে আরও নিশ্তব্ধ । তবুও বৃদ্ধের জীর্ণ হাত আস্তে আস্তে উঠলো । মুখে একটা আবেদন । পালু এগিয়ে দিল নতুন ঢাকের নতুন কাঠি ।
- “ বাজা বুড়া , এইবার বাজা ,” একটু ঝুঁকে জড়ালো ভাবে দাবী জানিয়ে পালু বলে উঠলো ।
কামার পাড়া অবাক । অবাক গৌরও । কামারের কঠোর চোখে আজ যেন জমাট জল । ছেলের কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখল , কীর্তনের হাতে কাঠিটি ধরা । পালু ঢাক এগিয়ে দিল । ক্ষীণ শব্দ উঠলো অশতিপর বৃদ্ধের হাত দিয়ে , ধিন ধিন ধিন...।


মাঝ সমুদ্রে যে জাহাজটা চলছিল । নাবিক দূরবীনটা চোখে দেয় । যাত্রীরা নামার জন্য ব্যস্ত । এখন শুধু স্থির হাতে হুইল ধরে রেখে ধীরে লাগাতে হবে জাহাজ বন্দরে ।।

( শেষ )
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৪৭৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩১/০৫/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast