ঢাকী - পর্ব ২
৩
রাতটা বেশ গভীর । ঢাকটা জোড়েই বাজচ্ছে । বরং বেশী জোড়েই । উদ্যাম ভাবে বোল উঠছে একের পর এক । আদিম আর্তনাদের মতো প্রাচীন উলুর সাথে জুবু থুবু থাকা সারবদ্ধ পাঁঠার ভয়ার্ত স্বর মিলে মিশে একাকার । ভিজে উঠছে জমি , সারা হাত, কাপড় গাঢ় কালচে থকথকে জমাট রক্তে অমাবস্যাকে করে তুলছে যোগ্য পৌষে কালীর রাত । ফাঁক বুঝে পটু হাতে গলা সমেত কাটা মাথা তুলে নিচ্ছে কর্তা বাড়ীর নির্বাচিত লোক ।
না , পালু পৌষে কালী পুজোর ঢাক বাজাই নি । ওইদিন রাতের পর সকালে কীর্তন কামারের সাথে গৌরও মলাম সুরের খেই ধরে । কাজ উদ্ধার হয়নি, গৌরের চিল চিৎকার কিছুটা কানে ঢুকেছিল পালুর ।
বয়েসের ভারে ন্যুব্জ কীর্তন কামার তার বাপ-ঠাকুরদার টান করা ঢাকে কাঠি দিয়েছিল , বোলগুলো যেন বাধ্য শিশুর মত বুড়োর তালে কথা বলতে শুরু করে । এবার আর এই কামারদের কাছে বলির দায়িত্ব দেওয়া হয় নি । গৌরের মনটা খারাপ । এহেন ভাগ্যের কাজ পরেছে অন্য গ্রামের কামারদের । কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছে ব্যাটারা টাকা কম নিচ্ছে । তবে বলির মাংস বেশ ক্ষানিকটা করে পাবে ।
-“ ওহ ! ভারী তো কম লেবে ! কাটারিটাই ভালো কইরে ধইরতে লারচে ”, বাপের কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে গৌর ।
_ “ লিক গে , ছাড়ান দে , যা পেইচি তাতেই চালা রে ”, একটু গম্ভীর ভাবে বলে কীর্তন ।
এবছর, ধান কাটার তাড়া নেই । জমি কোথায় ! সারা বছর ফাঁক পেলে যে ভাগ চাষির কাজ করতো, তাও গেছে । আগের বছরে তাও কীর্তনের সাথে হাত মিলিয়েছিল ছেলে আর নাতি । নাতি হল নবাব , কীর্তনও পা হড়কে বেশ কিছু মাস বিছানার সাথে ভাব করেছিল । গৌর একা আর কত পারবে ! নাতি যত তাল গাছের মত বাড়ছে, এসব কাজকে কেন জানি না অস্পৃশ্য অচ্ছুতের মত দেখছে । ভাগ চাষির ভাগ্য খানিকটা বুড়ো বলদের মত ।
হঠাৎ সোরগোলে সম্বিৎ ফিরে পায় কীর্তন । কোমরটাকে একটু সোজা করে ঘারটা তুলে ধরে । লয়টা গেছে কেটে । পাশে গৌর নেই । গলাটা ঝেড়ে, শুকনো ঠোঁটের কষটা মুছে কয়েকবার নাতি আর ছেলের নাম ধরে ডাক দেয় ।
জমাট ধুনোর গন্ধ ম ম করছে , ভিজে ফুলের গন্ধের সাথে বাতাসকে ভারী করে তুলেছে নানা ফল-দুধ-রক্তের নোনতা গন্ধ । এসব আর নাড়া দেয় না কীর্তনদের । আচমকা শরীরটা কেঁপে উঠল পালুর অশ্লীল গলার শব্দে । নিজের কানকে বিশ্বাস করানোটা কঠিন । তবে যতই এগিয়ে যাচ্ছে কীর্তন ততই ছেলের রগরগে গলাটাও শুনতে পেল । চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে একটা জায়গায় বেশ কিছু লোকের মাথা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে চলছে হাত-পা নাড়িয়ে কথাবার্তা ।
ফাঁকা জায়গায় সন্তর্পণে ছাল ওঠা ঢাকটা রেখে বাঁকা দেহটাকে সেদিকে নিয়ে যেতেই কীর্তনের চক্ষু চড়কগাছ । একি ! পেলোকে পেরে মারছে কেন ?
বেশ কিছু শক্তি ফিরে পায় বুড়ো । কোঁচকানো শিরা ওঠা হাতে ভিড় করে থাকা ভক্তদের সরিয়ে এগিয়ে যায় কীর্তন । ঘাড় গোঁজা পেলোর পাশেই ফুঁসতে থাকা ষাঁড়ের মত গৌর মাজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
-“ ও গৌর, বাবা কি হইচে বল রে , পেলোকে কি কললি !”, শত বছরের প্রাচীন অশ্বত্থের পাতায় হাওয়া লেগে যে ভয়ার্ত আওয়াজ ওঠে, কীর্তনের স্বরে যেন তারই অনুকম্পন জেগে উঠছে ।
-“ লাও লাও আর মাতা খেয়ো নি , তুর লবাব কি কইরেচে, হারামজাদা ” ফুঁসতে ফুঁসতে জবাব দেয় গৌর ।
হাজার কথার মধ্যে সব কথা যেন হারিয়ে যায় । বেদীর কালী মূর্তির নিথর পাঁঠার নীলাভ চোখের মত কীর্তনের চোখ বোঝার চেষ্টা করে । রাশি রাশি ঝাঁঝালো কটু নগ্ন কথার সারমর্ম যখন আশি বছরের বুড়োর কালচে খড়ি ওঠা ধুলোটে হৃদয়ে ঢুকল , বুঝল কি আহামক্কের মত কাজটা সে করেছে । ঢাকের বায়না তো দূর অস্ত, মুখও দেখবে না কেও গ্রামের । হয়ত, বাবুদের কৃপাতে একঘড়ে হয়ে পরবে ।
-“ পেলো এইটা কইরতে পাইরলি ! এত্ত বচরে এইমনটা কেও কইরে নি বাপ ” , নিঃস্পন্দ গলায় কেটে কেটে ধীর ভাবে বলে কীর্তন । না, চোখ দিয়ে জল পরছে না । তারা কামার । শত লোহার বল বুকের প্রতিটা পাঁজরে । অনেক ঘটনা জীবনের ইতিহাসকে ওলট-পালট করেছে । বুকের ভীষণ এক গভীরে নাড়া খেলেও, চোখের জলে মণি কখন ভাসে নি ।
_ “ বেশ কইরেচি , আবার কইরব দইরকার হলে ”, কথাটা বলে পালু মার খাওয়া ফুলো ফুলো চোখে টলতে টলতে হাঁটা লাগাল ।
কর্তা মশাইয়ের মন । ধন্যি লোক । ঘাড় ধরে বার করে দিলেও , লোকের হাত দিয়ে হাজার তিনেক টাকা কীর্তনের হাতে দিয়েছে । অবশ্য, গৌর বা কীর্তন ধুলোয় বসে বার কয়েক নিষ্ফল ব্যর্থ আবেদন করতে পিছিয়ে যায় নি । কর্তা পাথর চোখে তাকাতেই, কিছু মাতব্বর গৌরের পিছনে লাথ মেরে পায়ের সুখটা জমিয়ে করেছে । অতি উৎসাহীরা ঢাকের চামড়ায় বেশ কিছু আঁকিবুঁকি কেটে বাদ-প্রতিবাদও জানিয়েছে ।
৪
জীবনের গতিপথ কুয়াশা ঢাকা এক সরল রেখা । সরল যে অনেক সময় আক্ষরিক অর্থে জটিলতার রূপান্তর । হয়ত সেই আলেখ্য বুঝতেই জীবনের অনেকটা সময় শেষবারের জন্য জ্বলে ওঠার অবলম্বন খোঁজে । তার তাগিদে এক অনামী সন্ধ্যায় বিছানার পাশে শুয়ে কীর্তন হাতরে বেড়ায় ফেলে আসা রুক্ষ পথ । এখন তার চোখ দিয়ে যে জল বেরোয় , তার নাম কান্না কিনা বোজা মুশকিল । তবে তীব্র দহন যে তার হাড় বার করা বুকের খাঁচার বাইরের না, সেটা বোঝে একমাত্র নিজেই । কিছু দড়ি ছেঁড়া খাটিয়ার একচেটে জীবন আজ তার সর্বক্ষনের সঙ্গী । মাঝে মধ্যে গৌর এসে উঁকি মারে । ঘোর কাটলে কীর্তন ক্ষয়াটে জীর্ন ভুরূর ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করে । দুর্বোধ্য ভাষায় চলমান জীবনের অভিযোগ জানাতে ছাড়ে না । আদৌ অভিযোগ না অনুনয় তা গৌর কেন কেওই বোঝে না !
-“ শুইয়ে থাক , চিল্লাতে হবেক লা, পেটের ভাইত তো আইনতে হবেক ”, নিত্যদিনের রোজনামচার মত বলে বেরিয়ে যায় গৌর । এইভাবেই শুরু হয় দিন আর শেষও হয় অনুরুপ ভাবে । ঢাকের বোলের ছন্দ কীর্তন কামারের গত হয়েছে মাস ক্ষানেক হল ।
সামান্যের মাঝে অসামান্য নানা রূপে আসে । সেই আকস্মিক পরিবর্তনের লয় ধরতে পারলে জীবন তোমার, না ধরতে পারলেও জীবন সেই তোমারই থাকে । শুধু পটভূমি যায় পরিবর্তিত হয়ে । কর্তা বাড়ির ঘটনাটা পালুর কাছে ছিল তীব্র প্রতিবাদ । উঠতি বয়েসের এক চেতনার মিশ্রণ । তবে তা তথাকথিত শাস্ত্রের পরিপন্থী কিনা তা ভাবার সময় তার ছিল না । নিরীহ জীবহত্যা লীলার বিরুদ্ধে এক কিশোরের চরম থাপ্পর ।
সেদিন থাকতে পারে নি পালু । চোখের সামনে ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে যাওয়া নির্বাক পশুগুলোর ভাষা যেন তার কানের পর্দাকে ছিঁড়ে দিচ্ছিল । পালু যে আগে এসব দেখে নি তা নয় । কিন্তু কৈশোরের প্রাবল্য তার মনের অতলে জাগায় প্রশ্ন, অনুভূতি । কাঁসিটা টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে কাটারি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কামারের গালে সপাটে থাপ্পর মারতে সে বেশী চিন্তা করে নি । চিন্তা করে নি নামাবলী কোমরে জড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুতের অস্তিত্বকে । গলাটা টিপে ধরে থামিয়ে দিয়েছিল অর্থ না বুঝে মন্ত্রের কচকচানি । প্রাচিত্তির সহ শুদ্ধ ভাবে হোম করে আবার শুরু হয়েছিলো পৌষে কালীকে তুস্টি করার পালা । শুধু পালা পরিবর্তন হয়েছিলো কীর্তন-গৌরদের গতিপথে । তবে, সেদিনের এই দুঃসাহস ভোলা কি যায় ! ক’জনের মনের মধ্যেই বা জেগে ওঠে আদিম রূপের মধ্যেও আদিমতা ।
কামার জীবনে এহেন ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায় প্রাচীন কীর্তন । বিরোধ বাধে নিজের সাথে নিজেরই । গৌর যখন তার ‘লবাব’কে বাঁখারি দিয়ে পিটাচ্ছিল থামাই নি সে । এটাই পালুর প্রাপ্য শাস্তি । মার খেতে খেতে কঁকিয়ে বলেছিল , “ শালা, বেশ কইরেচি , কোন ধম্মে লিকেচে কালী মাংস খাবে , আর তোরা নাকি শিল্পী, লাচ ভাইলো কইরে ...” কথাটা শেষ করার আগেই রাগের মাথা খেয়ে বলিষ্ঠ গৌর পালুর মুখে দেয় সজোরে গুঁতো । রক্তে ভেসেছিল গৌরের হাত । লুটিয়ে থাকা ছেলেটার পাশে পিচ করে থুতু ফেলে চালার মধ্যে ঢোকে । কীর্তন ভালো ভাবে বোঝার আগেই গৌর হিড় হিড় করে টেনে তাকে নিয়ে যেতে যেতে বলে , “ শালো থাকুক পইড়ে ।”
‘ তোরা নাকি শিল্পী, লাচ ভাইলো কইরে ’,- এ কথার মানে যে কতটা নিষ্ঠুর হাসির মত তা এতদিনে বোঝে নি কামার শ্রেণীর এই প্রাচীন প্রতিনিধি । বার বার করে ঘুরে ফিরে আসে কীর্তনের মাথায় পালুর মার খাওয়া জড়ানো গলার ব্যঙ্গ । ধর্ম বা শাস্ত্রের তলোয়ার তাকে যতটা না কাটাকুটি করেছে, তার থেকেও বেশী বার এই ভোঁতা অথচ ছ’টি শব্দের চাবুক তার পঁচাত্তরটা বছরের ধারাপ্রবাহকে আকস্মিক ভাবে মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছিল বারবার । ঝর্না থেকে নদী চলতে চলতে অন্তিম লগ্নে এসেও অনেক সময় পথের ক্লান্তিতেই যে ভাবে হারিয়ে ফেলে মাটির সাথে সখ্যতা , সেই নিয়মটা কীর্তনের শিল্পী সত্ত্বাকে এক কঠিন কথার অনুরণনে করে তুলেছিল শুষ্ক ।
পরদিন সকালে গৌরের কড়া নিষেধ অমান্য করে ‘ লবাব’-এর কাছে ছুটে যেতে গিয়েই ধাক্কা খায় ।
-“ পেলো , ও পেলো ওঠ রে, গৌর দ্যাকে যা লাতি উঠছেক লাই ”, মাটিতে বসে পরে নাতির ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া মাথাটাকে কোলের উপর তুলে ডাকাডাকি জুড়ে দেয় কীর্তন । কাক ভোরে ক্ষোয়াটে গলার চিৎকারে পথ চলতি লোক, কামার পাড়ার হাঁপরের দড়ি ছেড়ে হুমড়ে পরে কিছু মানুষ । গৌর ছেলেকে পাঁজাকোলা করে ঘড়ের মধ্যে ঢোকে । কীর্তন পাথরের মত পা ভাঁজ করে উবু হয়ে বসে থাকে উঠোনের সজনে গাছের ছড়ি ছিটিয়ে থাকা পাতা-ফুলের মাঝে । অদূরেই শিশিরে ভিজে থাকা খয়েরি রক্তের উপর জমতে শুরু করেছে ধুলোর আস্তরণ । গুন গুন করে শুরু হয় কামার পাড়ার গুঞ্জন । সূর্যের আলোয় ভর করে বগল ছেঁড়া সোয়েটার , র্যাপার জড়িয়ে আসে কীর্তনের মত কিছু রোঁয়া ওঠা প্রাচীনের দল ।
-“ ওঠ রে কেত্তন । চুপ কইরে থাকিস না রে । বিশে ডাগতার লিয়ে আইসলেই দেইখবি লাতি ছুইটবে ।”
-“ হ গো কেত্তন’দা ডবকা লাতি তুমার , বইসে বইসে না ভেইবে উইঠে পর ।”
-“ বড্ড ভালো গো তুর লাতি, উটতি বয়েসে কাইলকের মত কাইন্ড কইরে থাকে, তা বলে গৌর বাড়াবাড়ি কইরবে কেনে ?”
বাক্যবাণে জর্জরিত কীর্তন বোঝাতে পারে না বা হয়ত বোঝানোর চেষ্টাও করে না । ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মাটির দিকে । অস্ফুট গলায় বলার চেষ্টা করে , “ শিইল্প , আমি কি ঢাকি...”
বোধের বাইরে কথাগুলো চলে যাওয়াতে কামার পাড়ার কিছু চ্যাঙরা ছেলের দল ধরাধরি করে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসে । আশ্চর্য মানুষ আর তাদের জীবন ! কালকের ঘটনায় প্রায় একঘরে করে দেওয়ার নিদানের পক্ষে একজোট হয়ে গলা চড়িয়েছিল, আর আজ এক রাতের প্রবাহে নতুন এক উৎসাহে কীর্তন, পালুকে সমবেদনা জানাতে একবারের জন্য কার্পন্য করতে ভোলে নি । ভুলে যায় নি না দেখা নিশুত রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনায় নানা রঙের পরত চাপাতে ।
( চলবে )
রাতটা বেশ গভীর । ঢাকটা জোড়েই বাজচ্ছে । বরং বেশী জোড়েই । উদ্যাম ভাবে বোল উঠছে একের পর এক । আদিম আর্তনাদের মতো প্রাচীন উলুর সাথে জুবু থুবু থাকা সারবদ্ধ পাঁঠার ভয়ার্ত স্বর মিলে মিশে একাকার । ভিজে উঠছে জমি , সারা হাত, কাপড় গাঢ় কালচে থকথকে জমাট রক্তে অমাবস্যাকে করে তুলছে যোগ্য পৌষে কালীর রাত । ফাঁক বুঝে পটু হাতে গলা সমেত কাটা মাথা তুলে নিচ্ছে কর্তা বাড়ীর নির্বাচিত লোক ।
না , পালু পৌষে কালী পুজোর ঢাক বাজাই নি । ওইদিন রাতের পর সকালে কীর্তন কামারের সাথে গৌরও মলাম সুরের খেই ধরে । কাজ উদ্ধার হয়নি, গৌরের চিল চিৎকার কিছুটা কানে ঢুকেছিল পালুর ।
বয়েসের ভারে ন্যুব্জ কীর্তন কামার তার বাপ-ঠাকুরদার টান করা ঢাকে কাঠি দিয়েছিল , বোলগুলো যেন বাধ্য শিশুর মত বুড়োর তালে কথা বলতে শুরু করে । এবার আর এই কামারদের কাছে বলির দায়িত্ব দেওয়া হয় নি । গৌরের মনটা খারাপ । এহেন ভাগ্যের কাজ পরেছে অন্য গ্রামের কামারদের । কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছে ব্যাটারা টাকা কম নিচ্ছে । তবে বলির মাংস বেশ ক্ষানিকটা করে পাবে ।
-“ ওহ ! ভারী তো কম লেবে ! কাটারিটাই ভালো কইরে ধইরতে লারচে ”, বাপের কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে গৌর ।
_ “ লিক গে , ছাড়ান দে , যা পেইচি তাতেই চালা রে ”, একটু গম্ভীর ভাবে বলে কীর্তন ।
এবছর, ধান কাটার তাড়া নেই । জমি কোথায় ! সারা বছর ফাঁক পেলে যে ভাগ চাষির কাজ করতো, তাও গেছে । আগের বছরে তাও কীর্তনের সাথে হাত মিলিয়েছিল ছেলে আর নাতি । নাতি হল নবাব , কীর্তনও পা হড়কে বেশ কিছু মাস বিছানার সাথে ভাব করেছিল । গৌর একা আর কত পারবে ! নাতি যত তাল গাছের মত বাড়ছে, এসব কাজকে কেন জানি না অস্পৃশ্য অচ্ছুতের মত দেখছে । ভাগ চাষির ভাগ্য খানিকটা বুড়ো বলদের মত ।
হঠাৎ সোরগোলে সম্বিৎ ফিরে পায় কীর্তন । কোমরটাকে একটু সোজা করে ঘারটা তুলে ধরে । লয়টা গেছে কেটে । পাশে গৌর নেই । গলাটা ঝেড়ে, শুকনো ঠোঁটের কষটা মুছে কয়েকবার নাতি আর ছেলের নাম ধরে ডাক দেয় ।
জমাট ধুনোর গন্ধ ম ম করছে , ভিজে ফুলের গন্ধের সাথে বাতাসকে ভারী করে তুলেছে নানা ফল-দুধ-রক্তের নোনতা গন্ধ । এসব আর নাড়া দেয় না কীর্তনদের । আচমকা শরীরটা কেঁপে উঠল পালুর অশ্লীল গলার শব্দে । নিজের কানকে বিশ্বাস করানোটা কঠিন । তবে যতই এগিয়ে যাচ্ছে কীর্তন ততই ছেলের রগরগে গলাটাও শুনতে পেল । চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে একটা জায়গায় বেশ কিছু লোকের মাথা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে চলছে হাত-পা নাড়িয়ে কথাবার্তা ।
ফাঁকা জায়গায় সন্তর্পণে ছাল ওঠা ঢাকটা রেখে বাঁকা দেহটাকে সেদিকে নিয়ে যেতেই কীর্তনের চক্ষু চড়কগাছ । একি ! পেলোকে পেরে মারছে কেন ?
বেশ কিছু শক্তি ফিরে পায় বুড়ো । কোঁচকানো শিরা ওঠা হাতে ভিড় করে থাকা ভক্তদের সরিয়ে এগিয়ে যায় কীর্তন । ঘাড় গোঁজা পেলোর পাশেই ফুঁসতে থাকা ষাঁড়ের মত গৌর মাজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
-“ ও গৌর, বাবা কি হইচে বল রে , পেলোকে কি কললি !”, শত বছরের প্রাচীন অশ্বত্থের পাতায় হাওয়া লেগে যে ভয়ার্ত আওয়াজ ওঠে, কীর্তনের স্বরে যেন তারই অনুকম্পন জেগে উঠছে ।
-“ লাও লাও আর মাতা খেয়ো নি , তুর লবাব কি কইরেচে, হারামজাদা ” ফুঁসতে ফুঁসতে জবাব দেয় গৌর ।
হাজার কথার মধ্যে সব কথা যেন হারিয়ে যায় । বেদীর কালী মূর্তির নিথর পাঁঠার নীলাভ চোখের মত কীর্তনের চোখ বোঝার চেষ্টা করে । রাশি রাশি ঝাঁঝালো কটু নগ্ন কথার সারমর্ম যখন আশি বছরের বুড়োর কালচে খড়ি ওঠা ধুলোটে হৃদয়ে ঢুকল , বুঝল কি আহামক্কের মত কাজটা সে করেছে । ঢাকের বায়না তো দূর অস্ত, মুখও দেখবে না কেও গ্রামের । হয়ত, বাবুদের কৃপাতে একঘড়ে হয়ে পরবে ।
-“ পেলো এইটা কইরতে পাইরলি ! এত্ত বচরে এইমনটা কেও কইরে নি বাপ ” , নিঃস্পন্দ গলায় কেটে কেটে ধীর ভাবে বলে কীর্তন । না, চোখ দিয়ে জল পরছে না । তারা কামার । শত লোহার বল বুকের প্রতিটা পাঁজরে । অনেক ঘটনা জীবনের ইতিহাসকে ওলট-পালট করেছে । বুকের ভীষণ এক গভীরে নাড়া খেলেও, চোখের জলে মণি কখন ভাসে নি ।
_ “ বেশ কইরেচি , আবার কইরব দইরকার হলে ”, কথাটা বলে পালু মার খাওয়া ফুলো ফুলো চোখে টলতে টলতে হাঁটা লাগাল ।
কর্তা মশাইয়ের মন । ধন্যি লোক । ঘাড় ধরে বার করে দিলেও , লোকের হাত দিয়ে হাজার তিনেক টাকা কীর্তনের হাতে দিয়েছে । অবশ্য, গৌর বা কীর্তন ধুলোয় বসে বার কয়েক নিষ্ফল ব্যর্থ আবেদন করতে পিছিয়ে যায় নি । কর্তা পাথর চোখে তাকাতেই, কিছু মাতব্বর গৌরের পিছনে লাথ মেরে পায়ের সুখটা জমিয়ে করেছে । অতি উৎসাহীরা ঢাকের চামড়ায় বেশ কিছু আঁকিবুঁকি কেটে বাদ-প্রতিবাদও জানিয়েছে ।
৪
জীবনের গতিপথ কুয়াশা ঢাকা এক সরল রেখা । সরল যে অনেক সময় আক্ষরিক অর্থে জটিলতার রূপান্তর । হয়ত সেই আলেখ্য বুঝতেই জীবনের অনেকটা সময় শেষবারের জন্য জ্বলে ওঠার অবলম্বন খোঁজে । তার তাগিদে এক অনামী সন্ধ্যায় বিছানার পাশে শুয়ে কীর্তন হাতরে বেড়ায় ফেলে আসা রুক্ষ পথ । এখন তার চোখ দিয়ে যে জল বেরোয় , তার নাম কান্না কিনা বোজা মুশকিল । তবে তীব্র দহন যে তার হাড় বার করা বুকের খাঁচার বাইরের না, সেটা বোঝে একমাত্র নিজেই । কিছু দড়ি ছেঁড়া খাটিয়ার একচেটে জীবন আজ তার সর্বক্ষনের সঙ্গী । মাঝে মধ্যে গৌর এসে উঁকি মারে । ঘোর কাটলে কীর্তন ক্ষয়াটে জীর্ন ভুরূর ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করে । দুর্বোধ্য ভাষায় চলমান জীবনের অভিযোগ জানাতে ছাড়ে না । আদৌ অভিযোগ না অনুনয় তা গৌর কেন কেওই বোঝে না !
-“ শুইয়ে থাক , চিল্লাতে হবেক লা, পেটের ভাইত তো আইনতে হবেক ”, নিত্যদিনের রোজনামচার মত বলে বেরিয়ে যায় গৌর । এইভাবেই শুরু হয় দিন আর শেষও হয় অনুরুপ ভাবে । ঢাকের বোলের ছন্দ কীর্তন কামারের গত হয়েছে মাস ক্ষানেক হল ।
সামান্যের মাঝে অসামান্য নানা রূপে আসে । সেই আকস্মিক পরিবর্তনের লয় ধরতে পারলে জীবন তোমার, না ধরতে পারলেও জীবন সেই তোমারই থাকে । শুধু পটভূমি যায় পরিবর্তিত হয়ে । কর্তা বাড়ির ঘটনাটা পালুর কাছে ছিল তীব্র প্রতিবাদ । উঠতি বয়েসের এক চেতনার মিশ্রণ । তবে তা তথাকথিত শাস্ত্রের পরিপন্থী কিনা তা ভাবার সময় তার ছিল না । নিরীহ জীবহত্যা লীলার বিরুদ্ধে এক কিশোরের চরম থাপ্পর ।
সেদিন থাকতে পারে নি পালু । চোখের সামনে ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে যাওয়া নির্বাক পশুগুলোর ভাষা যেন তার কানের পর্দাকে ছিঁড়ে দিচ্ছিল । পালু যে আগে এসব দেখে নি তা নয় । কিন্তু কৈশোরের প্রাবল্য তার মনের অতলে জাগায় প্রশ্ন, অনুভূতি । কাঁসিটা টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে কাটারি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কামারের গালে সপাটে থাপ্পর মারতে সে বেশী চিন্তা করে নি । চিন্তা করে নি নামাবলী কোমরে জড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুতের অস্তিত্বকে । গলাটা টিপে ধরে থামিয়ে দিয়েছিল অর্থ না বুঝে মন্ত্রের কচকচানি । প্রাচিত্তির সহ শুদ্ধ ভাবে হোম করে আবার শুরু হয়েছিলো পৌষে কালীকে তুস্টি করার পালা । শুধু পালা পরিবর্তন হয়েছিলো কীর্তন-গৌরদের গতিপথে । তবে, সেদিনের এই দুঃসাহস ভোলা কি যায় ! ক’জনের মনের মধ্যেই বা জেগে ওঠে আদিম রূপের মধ্যেও আদিমতা ।
কামার জীবনে এহেন ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায় প্রাচীন কীর্তন । বিরোধ বাধে নিজের সাথে নিজেরই । গৌর যখন তার ‘লবাব’কে বাঁখারি দিয়ে পিটাচ্ছিল থামাই নি সে । এটাই পালুর প্রাপ্য শাস্তি । মার খেতে খেতে কঁকিয়ে বলেছিল , “ শালা, বেশ কইরেচি , কোন ধম্মে লিকেচে কালী মাংস খাবে , আর তোরা নাকি শিল্পী, লাচ ভাইলো কইরে ...” কথাটা শেষ করার আগেই রাগের মাথা খেয়ে বলিষ্ঠ গৌর পালুর মুখে দেয় সজোরে গুঁতো । রক্তে ভেসেছিল গৌরের হাত । লুটিয়ে থাকা ছেলেটার পাশে পিচ করে থুতু ফেলে চালার মধ্যে ঢোকে । কীর্তন ভালো ভাবে বোঝার আগেই গৌর হিড় হিড় করে টেনে তাকে নিয়ে যেতে যেতে বলে , “ শালো থাকুক পইড়ে ।”
‘ তোরা নাকি শিল্পী, লাচ ভাইলো কইরে ’,- এ কথার মানে যে কতটা নিষ্ঠুর হাসির মত তা এতদিনে বোঝে নি কামার শ্রেণীর এই প্রাচীন প্রতিনিধি । বার বার করে ঘুরে ফিরে আসে কীর্তনের মাথায় পালুর মার খাওয়া জড়ানো গলার ব্যঙ্গ । ধর্ম বা শাস্ত্রের তলোয়ার তাকে যতটা না কাটাকুটি করেছে, তার থেকেও বেশী বার এই ভোঁতা অথচ ছ’টি শব্দের চাবুক তার পঁচাত্তরটা বছরের ধারাপ্রবাহকে আকস্মিক ভাবে মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছিল বারবার । ঝর্না থেকে নদী চলতে চলতে অন্তিম লগ্নে এসেও অনেক সময় পথের ক্লান্তিতেই যে ভাবে হারিয়ে ফেলে মাটির সাথে সখ্যতা , সেই নিয়মটা কীর্তনের শিল্পী সত্ত্বাকে এক কঠিন কথার অনুরণনে করে তুলেছিল শুষ্ক ।
পরদিন সকালে গৌরের কড়া নিষেধ অমান্য করে ‘ লবাব’-এর কাছে ছুটে যেতে গিয়েই ধাক্কা খায় ।
-“ পেলো , ও পেলো ওঠ রে, গৌর দ্যাকে যা লাতি উঠছেক লাই ”, মাটিতে বসে পরে নাতির ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া মাথাটাকে কোলের উপর তুলে ডাকাডাকি জুড়ে দেয় কীর্তন । কাক ভোরে ক্ষোয়াটে গলার চিৎকারে পথ চলতি লোক, কামার পাড়ার হাঁপরের দড়ি ছেড়ে হুমড়ে পরে কিছু মানুষ । গৌর ছেলেকে পাঁজাকোলা করে ঘড়ের মধ্যে ঢোকে । কীর্তন পাথরের মত পা ভাঁজ করে উবু হয়ে বসে থাকে উঠোনের সজনে গাছের ছড়ি ছিটিয়ে থাকা পাতা-ফুলের মাঝে । অদূরেই শিশিরে ভিজে থাকা খয়েরি রক্তের উপর জমতে শুরু করেছে ধুলোর আস্তরণ । গুন গুন করে শুরু হয় কামার পাড়ার গুঞ্জন । সূর্যের আলোয় ভর করে বগল ছেঁড়া সোয়েটার , র্যাপার জড়িয়ে আসে কীর্তনের মত কিছু রোঁয়া ওঠা প্রাচীনের দল ।
-“ ওঠ রে কেত্তন । চুপ কইরে থাকিস না রে । বিশে ডাগতার লিয়ে আইসলেই দেইখবি লাতি ছুইটবে ।”
-“ হ গো কেত্তন’দা ডবকা লাতি তুমার , বইসে বইসে না ভেইবে উইঠে পর ।”
-“ বড্ড ভালো গো তুর লাতি, উটতি বয়েসে কাইলকের মত কাইন্ড কইরে থাকে, তা বলে গৌর বাড়াবাড়ি কইরবে কেনে ?”
বাক্যবাণে জর্জরিত কীর্তন বোঝাতে পারে না বা হয়ত বোঝানোর চেষ্টাও করে না । ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মাটির দিকে । অস্ফুট গলায় বলার চেষ্টা করে , “ শিইল্প , আমি কি ঢাকি...”
বোধের বাইরে কথাগুলো চলে যাওয়াতে কামার পাড়ার কিছু চ্যাঙরা ছেলের দল ধরাধরি করে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসে । আশ্চর্য মানুষ আর তাদের জীবন ! কালকের ঘটনায় প্রায় একঘরে করে দেওয়ার নিদানের পক্ষে একজোট হয়ে গলা চড়িয়েছিল, আর আজ এক রাতের প্রবাহে নতুন এক উৎসাহে কীর্তন, পালুকে সমবেদনা জানাতে একবারের জন্য কার্পন্য করতে ভোলে নি । ভুলে যায় নি না দেখা নিশুত রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনায় নানা রঙের পরত চাপাতে ।
( চলবে )
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শাফিউল কায়েস ৩০/০৫/২০১৮ঢাকী-০২ পর্ব অসাধারণ।। লিখেছেন।
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ৩০/০৫/২০১৮দারুন লেগেছে।