www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ঢাকী - পর্ব ১

কান্ড দেখেছ !
দুগগা পুজোতে ঢাক ভালোই বাজিয়েছে কীর্তন কামার । ছোট্ট থেকেই বাপ ঠাকুরদার হাত ধরে শহুরে হাওয়ার মাঝে ট্যাং ট্যাং করে কাঁসি পিটাতে পিটাতে কখন যে বাপ থেকে নিজেই ঠাকুরদা হল, মনে করা দায় ।
বছরের কিছু সময় তার ছক বাঁধা কাজ । তাছাড়া বার মাসের তের পাব্বন , উৎসব লেগেই আছে, তবে তা থেকে ঘরে তোলার মত তেমন কিছু থাকে না । উঠোনের দাওয়ায় চমরাটাকে টান করতে করতে কত কথাই না মনে পরে যায় । এই তো সেবার রায় দালানের খড়ি ওঠা ঠাকুর মন্দিরের সামনে ঠাকুরদা পাল্লা দিয়েছিলেন অন্য ঢাকিদের সাথে । কীর্তনের তখন উঠতি বয়স, কচি কচি গোঁফ , হাল্কা দাড়ি এদিক উদিক দিয়ে উঁকি মারছে । কাঁসির বদলে ঢাকের বোলে হাত ঝালাচ্ছে সবে । পিঠ টন টন করলেই দাদুর চোখ পাকানো দেখেই আবার শুরু করছে বাদ্যি ।
রাত যত ঘন হচ্ছে , মা মা রব চারিদিকে । ধোঁয়া- ধুনোর গন্ধ । বৃদ্ধ রায় মশায়ের ঘড়ি ধরা কাজ , তার সাথে নরহরি বামুনের নিয়মের মাঝে কীর্তনের বাপ টপাটপ করে বিশাল রাম দা হাতে একটা একটা করে পাঁঠার মুন্ড মাটিতে নামাচ্ছে । ফিনকি দিয়ে লাল রক্ত ছিটকে ছিটকে লাগছে মুখে-গায়ে । উফ ভাবা যায় এসব পুণ্যির কাজ ।
-“ বলি দাদু , ঢাকের সাথে সাথে তুর চামরাও এব্বার শুকাবে , তুর ছেইলে যে ডেইকে ডেইকে সারা ”- পালুর কথায় বুড়ো তাকিয়ে দেখে বংশের একমাত্র পিদিম দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে । দাদুর সাথে রঙ্গ করার সময় পেলেই হাত ধুয়ে লেগে পরে ।
পালুর একটাই নাম । ইস্কুলের খাতাতেও ওই নাম তোলা আছে । কচি শাল গাছের মত চেহারা । পালুর বাপ বলে এক নম্বরের খচ্চর । কান ধরে কত বার ঢাক বাজানোর চেষ্টা করেছে । শেষে কীর্তনের কথায় পালু নাক বেঁকিয়ে ঢাক ধরে । এটা বোঝে না , কত পুন্ন্যি করলে ঢাকি হয়ে জন্ম নিতে হয় । সময় পেলেই নাতির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বুঝিয়েছে , “ দ্যাক , পেলো, তুর এই হাতেইর বাইদ্যি শুনেই দেবতারা সগগ থেইকে মাটিতে লামেন , খুশি হন ”।
পালুর হয়েছে জ্বালা , এই বুড়োর কথা খুব একটা ফেলতে পারে না । মাঝে মধ্যে অবশ্য ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে বলে, “ হ , তুর দেবতারা খুশি হন , আমার বন্ধুরাও দাঁত বাইর কইরে হাসে । বলে, ওই পেলো ঢাকি আইসছে ”।

পালুর বন্ধু মহলটাও কম ছোট না । গাঁয়ের শেষ প্রান্তে সন্ধ্যে হলেই মা-বাপ খেদানো ছেলে পিলেদের সাথে নানা ভাষার সম্মেলন আর কিঞ্চিৎ কটু ধোঁয়ার মৌতাতে জমে ওঠে আসর । টিম টিমে বাল্বের আলোয় চলে নানা রঙিন পরিকল্পনা । পালু এখানকার মাতব্বর । ভগবানের কৃপায় সুঠাম চেহারা আর মারকুটে স্বভাবের জন্য ওর মুখের ওপর খুব একটা কথা বলার সাহস রাখে না ।
-“ না ! এভাবে চলে না , একটা ঘড় দরকার । লক্ষী’দা অনেকদিন ধরেই বলছে পাশের গ্রামের সঙ্গে জলে ঝাঁপাতে হবে ”।
-“ হ রে তোর লক্ষী’দা বলেই খালাস , তারপর, টাকাটা কে দেবে তোর বাপ !” উত্তেজিত হয়ে মনা বলে ওঠে ।
উদাস ভাবে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর প্যান্ট ঝেরে উঠে পরে পালু । সারা রাস্তায় নানা স্বপ্নের জালগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘিরে ধরে পালুর শরীরকে । আপন বলে ওঠে “ নিদেন হাজার দুই তো লাগবেই ।” ঠোঁটটা কামড়িয়ে হাঁটতে থাকে পালু । পড়ে থাকে পিছনে পড়ে থাকা শিশিরে ভেজা ধুলো পথ ।
ঘড়ের টিমটিমে আলোয় পা টিপে টিপে ঢুকতেই বাবা বলে উঠলেন , “ লবাব পুত্তুর এয়েছেন , রাত –বিরেত লাই , গান্ডে পিন্ডে গিলে লাও ”।
নিঃশব্দে পালু রান্নাঘড়ে ঢুকে থালা টেনে খেয়ে শুতে চলে গেল । মনে হল না বাপের কথায় কোন ছাপ পরেছে । এ যেন এক চিরস্থায়ী । বাপ বলে যাবে আর পালু সমান্তরাল কান দিয়ে বার করে দেবে ।
ছোট্ট ঘড় । কিছুটা পরিপাটীর ছাপ আছে । যদিও বাড়াবাড়ি রকমের কিছু করার ক্ষমতা নেই । কীর্তন কামার থেকে শুরু করে পালুর মা স্কুলের গণ্ডী পার করাটাকে বাহুল্য মনে করেছিল এক জমানায় । তবে পালুর ক্ষেত্রে তাদের মতের পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে । যদিও মাঝে মধ্যে ছেলের বেয়াদপি দেখে নিজের পরিবর্তিত সেই চিন্তার গালে চড় মেরে বসে ।
কামার সম্প্রদায়ের হলেও , কীর্তন তার ছেলের নাম নিজের সাথে মিলিয়ে রেখেছিল গৌর । মাঝে মধ্যে সন্ধ্যেবেলায় গৌর গ্রামের বুড়ো বটের দাঁত বার করা রোয়াকে বসে বিড়িতে জব্বর টান মেরে ভাগ্যকে এন্তারসে গাল পেরে বলে , “ কি আর হবে , এত্ত কাল ধইরে ঢাক বাজাচ্চি , আর আমার পুত্তুর ইস্কুলে গিয়ে পূবপুরুষদের বিদ্যে লদীতে ফেলচে ।”
এইভাবেই কাটে কীর্তন কামারদের প্রতি সন্ধ্যা । সামনেই পৌষ মাস । অমাবস্যার কালী পুজো । বায়নার জন্য ডাক পরে হরিপুর থেকে । সংসারে অসময়ে দেবতারা মাঝে মধ্যে আসেন বলে কিছুটা ক্ষরা কাটে । মা লক্ষ্মী সদয় হন । সেদিন রাতে কীর্তন পালুর দরজাটা ঠেলে ঘুমন্ত পালুর কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে পরে । ঘোলাটে চোখে বোঝার চেষ্টা করে নাতির মতিটাকে । ঘড়ের বাল্বের হাল্কা আলোয় নিজের কৈশোরকে অনুভব করে । পরম মমতায় পীঠে হাত বোলাতেই জেগে পালু । বিস্ময়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে । নাতির ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বুড়ো এক মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে মলাম স্বরে বলে , “ পেলো , সামনেই পৌষে কালী , কর্তা বাড়ীর বায়না এয়েচে । বাপের সঙ্গে যা তু । ”
-“ বুড়োর মাতাটা সত্যিই গেচে , সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা ।”
-“ তো কি হয়েচে বাপ ! দেবতাদের চটাতে লাই রে , এবার তু বাজাবি আর আমি না হয় কাঁসিটা বাজাবো , কেমন !”
কোনও ক্রমে ঠেকের ভাষাকে সামলিয়ে পেলো ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “ ভাগ তো , মাঝ রাতে কেলো কইরতে এয়েচে ”, বলেই পাশ ফিরে জোর করে চোখ বন্ধ করে ।
( চলবে )
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৪৮৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৮/০৫/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast