www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নীলকুঠি ও নীল আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস- অন্তিম পর্ব

বাংলার জোয়ান অব আর্কঃ পিয়ারি সুন্দরী

টমাস আইভান কেনি তৎকালীন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে সবচে বড় নীল কারবারের অধিকারি ছিল। তার কয়েকটি কুঠি ছিল আমলা সদরপুরের জমিদারনি পিয়ারি সুন্দরীর জমিদারির ভেতরে। এই কেনি ছিল অত্যন্ত জুলুমবাজ। হত্যা-ধর্ষণ এগুলো তার কাছে সামান্য ব্যাপার ছিল। তার বিরুদ্ধে ১৮৫০ সালে রায়েতগন বিদ্রোহ করে। কিন্তু কেনি শক্তহাতে তা দমন করে এবং সকল রায়েতকে উচ্ছেদ করে নতুন রায়েত বসায়। পিয়ারি এতে অসন্তুষ্ট হন। তিনি কেনিকে প্রজাদের উচ্ছেদ করার কাজে নিষেধ করেন। এতে কেনি তাঁকে গালিগালাজ করে এবং জমিদারি কেড়ে নেবার ভয় দেখায়। পিয়ারি অনন্যোপায় হয়ে মৌনব্রত পালন করেন।
কিন্তু ১৮৬০ সালে ওই উচ্ছেদকৃত রায়েতগন সংগঠিত হয়ে ফিরে আসে এবং পিয়ারি সুন্দরী তাঁদের সাথে যোগ দেন। ওই বছরই এপ্রিল মাসে তারা কেনিকে হত্যা এবং তার কুঠি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে কুঠিতে হামলা করেন। কেনি বেঁচে যায়, কিন্তু তার কারবার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই হামলা করার কারণে পিয়ারি সুন্দরী ও তার রায়েতদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা করা হয়। পিয়ারি সুন্দরী সকল মামলার ব্যয়ভার নিজে বহন করেন, এতে তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে যান। তার পক্ষের প্রজাদের দ্বীপান্তর, জেল, জরিমানা হয় ও পিয়ারি সহ সকলের ভূসম্পত্তি বাতিল করা হয়। পিয়ারি তার পাঁচ বছর পর যশোরের এক মুচির বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় পরিজনহীন অবস্থায় টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার কথা আমরা ভুলে গেছি।
কিন্তু মজার কথা কি জানেন? কেনিকে আমরা ভুলিনি। কুষ্টিয়ার কেনি রোডের নামকরন এই নরপশুর নামে করা ।
নীলচাষের অন্তিমকালঃ ইন্ডিগো কমিশন গঠন

কৃষকদের বর্বর অত্যাচারে(!) নীলকরদের গেলুম গেলুম রব শুনে সরকারের ইয়ে, অর্থাৎ 'টনক' ভাইব্রেট করে ওঠে। ১৮৬০ সালের ৩১ মার্চ নীল কমিশন বা ইন্ডিগো কমিশন গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন বঙ্গীয় সরকারের সেক্রেটারি M.W.S. Seaton Carr। কমিশনের একজন বাদে সবাই ছিলেন ইংরেজ। বাকি ওই একজন ছিলেন জমিদার সমিতির এক সদস্য। কমিশনের প্রথম অধিবেশন বসে ১৮৬০ সালের ১৮ মে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরে। কমিশন তিন মাসে ১৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। সাক্ষীদের মাঝে ১৫ জন সরকারি কর্মচারী, ২১ জন নীলকর, ৮ জন মিশনারি, ১৩ জন জমিদার ও ৭৯ জন নীলচাষি । ভয় নাই সবার সাক্ষ্য শোনাব না। দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে কমিশন রিপোর্ট দেয়, 'The whole system is vicious in theory, injurious in practice and radically unsound.'
কমিশনের রিপোর্ট ও ছোটলাটের স্বীকৃতি সত্ত্বেও সরকার রায় দেয় নীলকরদের দিকেই। সরকার নিজেকে নিরপেক্ষ ঘোষণা করে, কিন্তু নীলকরদের নিরাপত্তার জন্য পূর্বের সকল দমনমূলক আইন বজায় রাখা হয়; নতুন নতুন থানা ও মহকুমা স্থাপন করে পুলিশের শক্তি বাড়ানো হয়, যাতে সহজে বিদ্রোহ দমন করা যায় । সেই সাথে কৃষকদের সান্ত্বনা দিতে কয়েকটি অর্থহীন ইশতেহার জারি করা হয়-
১. সরকার নীলচাষ করার বিষয়ে নিরপেক্ষ।
২. আইন অমান্য করলে বিদ্রোহী প্রজা বা নীলকর কেউই শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবে না।
৩. অন্য শস্যের মত নীল চাষ করা বা না করা প্রজার ইচ্ছাধীন।
সরকারের এ প্রতারণা কৃষকেরা বুঝতে পারে। নদীয়া ও যশোরের কৃষকেরা হেমন্তকালীন নীলচাষ করা এবং জমিদার ও নীলকরদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ধ্বংসাত্মক কর্মতৎপরতা থামাতে সরকার দুই জেলায় দুই দল সৈন্য রণতরী যোগে পাঠায়। দুই দলের অধিনায়কদের সাথে কৃষক জনতা আলোচনায় বসে। প্রজারা বলে, 'খাজনা দিতে আপত্তি নেই, তবে নীলকর ও জমিদারদের নির্যাতন হতে প্রজাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে '। অধিনায়ক দুজন ফিরে গিয়ে এই বিষয়ে রিপোর্ট দাখিল করেন।
রিপোর্ট পেয়ে বাংলার ছোটলাট গ্রান্ট স্বচক্ষে অবস্থা দেখতে স্টিমারে করে গোপনে ১৮৬০ সালের অগাস্ট মাসে ৭০ মাইল দীর্ঘ জলপথ পরিভ্রমণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু যাত্রা শুরুর পর কোনভাবে প্রজারা জেনে ফেলে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ স্টিমার তীরে ভেড়াবার জন্য নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁদের হাতে ঝাঁকিজাল ও কোঁচ। গ্রান্ট ভীত-সন্ত্রন্ত হয়ে নদীর মাঝ দিয়ে স্টিমার চালাবার আদেশ দেন। কিন্তু পথ কোথায়? নদী মানুষে মানুষে পরিপূর্ণ। গ্রান্ট ভয় পেয়ে যান। কিন্তু জনতা তাঁকে অভয় দেয়, তিনি অতিথি, তার জীবনের কোন ভয় নাই। স্টিমার তীরে ভেড়ান হল। গ্রান্ট সবাইকে পাবনা যেতে বললেন। বললেন, সেখানে জনসভায় তিনি নীল চাষ তুলে দেবার ঘোষণা দেবেন। এবারে স্টিমার চলল পাবনা। জন পিটার গ্রান্ট নিজেই এ অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। বলেছেন, প্রায় ১৪ ঘণ্টা ধরে ৬০-৭০ মাইল পথ ভ্রমণকালে তিনি নদীর উভয় পার্শ্বে লক্ষ লক্ষ জনতার ভিড় দেখেছেন। এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আর কোন রাজকর্মচারীর হয়নি ।
পাবনায় গিয়ে জনসভায় গ্রান্ট বলেন, 'অতি শীঘ্রই নীল চাষ বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চাষির ইচ্ছা ব্যতীত, কাউকে জোর করে নীল চাষ করান যাবে না। কেউ জোর করে নীল চাষ করালে আইন কঠোর হাতে তাঁকে দমন করবে'। কিন্তু গ্রান্ট তার কথা রাখতে পারেননি। নীলকররা তাঁদের সমিতি Indigo Planters Association এর ক্ষমতার জোর খাটিয়ে নীল চাষ বন্ধের যে আইন প্রণীত হবার কথা ছিল, তা রদ করে দেয়। এমনকি নীলকর সমিতি তাঁকে কঠোর অবস্থানের জন্য গালাগালি করতে থাকে। বিক্ষুব্ধ গ্রান্ট বিবৃতি দেন, 'আইনের বিপক্ষে, নীলচাষের সপক্ষে পৃথিবীর কোন শক্তিই আর বেশিদিন এ ব্যবস্থাকে সমর্থন করতে পারবে না। ন্যায়ের পথ উপেক্ষা করে যদি সরকার চলতে থাকে, তবে আরও বিপুল কৃষক অভ্যুত্থান ও বিপ্লব সরকারের শাস্তি বিধান করবে। সেই অভ্যুত্থান ভারতে ইউরোপীয় ও অন্যান্য মূলধনের পক্ষে যে সাংঘাতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে তা সাধারণ মানুষের হিসাবের বাইরে।'
ভারতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম পরবর্তীতে লিখেছিলেন, 'বিভিন্ন তথ্য থেকে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমরা ভয়ঙ্কর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি...আমাকে বিভিন্ন জেলা-মহকুমার রিপোর্ট দেখানো হয়, সেগুলোতে বারবার বিপ্লবের কথা, দরিদ্র মানুষের কথা এসেছে...তারা নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে যে, অত্যাচারে-অনাচারে তাঁদের মৃত্যু অনিবার্য। মরবার পূর্বে তাই তারা একটা কিছু করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।...এ একটা কিছুর অর্থ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। এই অবস্থা চলতে থাকলে একটা ব্যাপক অভ্যুত্থান শুরু হবে, এবং সেটা কৃষকদের মাঝে থেমে থাকবে না ।'
এদের কথা সত্যি হয়ে দেখা দেয় ক'বছরের মাঝেই। যারা জুলুমবাজ নীলকর ছিল, বিপ্লবের মুখে তারা ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়, নইলে কৃষকদের সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারায়। শুধুমাত্র যারা প্রজাদের সাথে সদয় ব্যবহার করতে শিখেছিল, তাঁদের কুঠিই টিকে থাকে। এসব কুঠিয়াল টিকে থাকার জন্য নানা জনহিতকর কাজ করতে শুরু করে। নতুন রাস্তাঘাট করে দেয়, মজা পুকুর সংস্কার করতে সাহায্য করে। নতুন মন্দির বানিয়ে দেয়। আবার এদের মাঝে ব্যতিক্রম ছিল সিন্দুরিয়া কুঠির ম্যানেজার ড্যাম্বেল পিটারস। সে এই বিদ্রোহে খেপে গিয়ে আরও বেশি অত্যাচার চালাতে শুরু করে। ওই স্থানে পুলিশের সংখ্যা বেশি ছিল বলে কৃষকদের প্রতিবাদ করতে গেলেই বিপদে পড়তে হত। এরই ফল হিসাবে ১৮৮৯ সালে সিন্দুরিয়ায় সর্বশেষ নীল বিদ্রোহ হয়। ফলস্বরূপ নীল চাষ সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে যায়। এই বিদ্রোহে সর্বপ্রথম অভিজাত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কৃষকদের সমর্থন করেন।
বাংলার সর্বশেষ নীল বিদ্রোহ

সিন্দুরিয়ার বিদ্রোহ ছিল সর্বশেষ নীল বিদ্রোহ। এর পরে বাংলায় আর বিদ্রোহ হয়নি, করার দরকারও হয়নি। কারণ কৃষকদের এমন বিদ্রোহে প্রাণ বাজি রেখে নীল চাষ করতে নীলকররা আর আগ্রহী হতে পারেনি। তাছাড়া জার্মানিতে কৃত্রিম রং আবিষ্কৃত হয়, এতে নীলকরদের লাভ পঞ্চাশ ভাগ কমে যায়। ফলে সব মিলিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, যাতে নীল চাষ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলার কৃষক মুক্তি পায় ঘৃণ্য নীলকরদের হাত থেকে।
সফলতার পথে নীল বিদ্রোহ ও তার কারণ

নীল বিদ্রোহ সফল হল কেন? যেখানে কাছাকাছি সময়ে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহ ও সিপাহী বিদ্রোহ দাঁড়াতেই পারেনি, সেখানে নীল বিদ্রোহের সাফল্যের পেছনে কারণ কি? কারণ তিনটি। সেগুলি হল –
* প্রথমতঃ, নীল বিদ্রোহের সম্পূর্ণ উৎপত্তি কৃষক অর্থাৎ উৎপাদক শ্রেণীর হাতে। এই বিদ্রোহে গ্রাম সমবায় আরও মহৎ হয়ে শ্রেণী সমবায়ে পরিণত হয়। একজন নেতা হারালে আক্ষরিক অর্থেই একশ জন এসে সে খালি স্থান পূরণে সক্ষম ছিল। সুতরাং নেতৃত্ব পরিচালনায় কখনো ছেদ পড়ে নি।
* দ্বিতীয়তঃ, তখন নব্বই শতাংশ লোক কৃষিকাজ করত। এরা যেকোনো বিদ্রোহের বেস হিসেবে কাজ করে। বেস-ই যখন বিদ্রোহ করে, সে বিদ্রোহ থামানোর সাধ্য কার?
* তৃতীয়তঃ, কৃষকদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে কোন বিভ্রান্তি ছিল না। রুখে দাঁড়াতে হবে, নইলে না খেয়ে মরব - এতটাই সরল ছিল তাঁদের ভাবনা।
আর এই কারনেই বাংলার সর্বপ্রথম সফল বিদ্রোহ - নীল বিদ্রোহ।
সাংস্কৃতিক প্রভাব ও সহৃদয় কিছু তত্কালের ব্রিটিশবর্গ

মোশাররফ হোসেন ইংরেজ দরদী ছিলেন। তাঁর অবস্থানটা ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। নদীয়ার নীলকরদের প্রধান পাণ্ডা টি আই কেনি ছিল মোশাররফের বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই কেনি সাহেব মোশাররফকে বিলাতে পড়তে যাবার খরচও দিতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে স্থানীয় নীল বিদ্রোহের নেতা ছিল তাঁদেরই জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোক। সম্পত্তি নিয়ে তাঁর পিতার সাথে এই লোকের গোলমাল লেগেছিল। ফলে, নীল বিদ্রোহ কবলিত অঞ্চলে থেকে নীলকরদের অত্যাচার স্বচক্ষে দেখার পরেও মীর মোশাররফ হোসেনের অবস্থান ছিল দ্বিধাময়। নদীয়ার এই কেনি সাহেব ছিলেন প্রবল অত্যাচারী লোক। এর কিছুটা ধারণা মেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক চিঠিতে। গণেন্দ্রনাথের এক চিঠির জবাবে দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ
‘ তোমার ২৭ মাঘের পত্রে নূতন প্রস্তাব হঠাৎ শুনিলাম। কেনি সাহেব ২০০০০০ টাকা দিয়া ছয় বৎসরের নিমিত্ত বিরাহিমপুর ইজারা লইবেক।… কেনি সাহেবের অধীনে অধুনা যে সকল প্রজা আছে তাহার মধ্যে অনেক প্রজা তাহার দৌরাত্ম্য জন্য তাহার এলাকা হইতে পালাইতেছে। বিরাহিমপুর তাহার হস্তগত হইলে এখানকারও অবস্থা তদ্রূপ হইবেক তাহার সন্দেহ নাই। ছয় বৎসর হস্তগত হইবার পরে এ জমিদারী প্রজাশূন্য দেখিতে হইবেক।’
এই কেনি সাহেবের সাথে প্রবল দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন সুন্দরপুরের জমিদার প্যারীসুন্দরী দাসী। প্রজাহিতকরণের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন এই ভদ্রমহিলা। কেনির হাত থেকে প্রজাদের বাঁচানোর জন্য তিনি বলেছিলেনঃ
‘ আমি থাকিতে আমার প্রজার প্রতি নীলকর ইংরেজ দৌরাত্ম করিবে? আমি বাঁচিয়া থাকিতে আমার প্রজার বুনানী ধান ভাঙিয়া কেনি নীল বুনিবে, ইহা আমার প্রাণে কখনই সহ্য হইবে না। প্রজাদিগের দূরবস্থা আমি এই নারীচক্ষে কখনই দেখিতে পারিব না। যে উপায়ে হউক, প্রজা রক্ষা করিতেই হইবে। লোক, জন, টাকা, সর্দ্দার, লাঠিয়াল যাহাতে হয় তাহার দ্বারা প্রজার ধন, মান, প্রাণ, জালেমের হস্ত হইতে বাঁচাইতে হইবে ।’
কেনিকে শায়েস্তা করার জন্য নীল বিদ্রোহের এই নেত্রী ঘোষণা দেন এই বলে যে,
‘ যে ব্যক্তি যে কোনো কৌশলে কেনির মাথা আমার নিকট আনিয়া দিবে, এই হাজার টাকার তোড়া আমি তাহার জন্য বাঁধিয়া রাখিলাম। এই আমার প্রতিজ্ঞা, আমার জমিদারী, বাড়ী, ঘর, নগদ টাকা, আসবাব যাহা আছে, সমুদয় কেনির কল্যাণে রাখিলাম। ধর্ম্মসাক্ষী করিয়া বলিতেছি, সুন্দরপুরের সমুদয় সম্পত্তি কেনির জন্য রহিল। অত্যাচারের কথা কহিয়া মুষ্টিভিক্ষায় জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিব। দ্বারে দ্বারে কেনির অত্যাচারের কথা কহিয়া বেড়াইব।… দুরন্ত নীলকরের হস্ত হইতে প্রজাকে রক্ষা করিতে জীবন যায় সেও আমার পণ ।’

প্রজাদের রক্ষার লড়াইয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন প্যারীসুন্দরী। নীল চাষে অস্বীকৃতি জানানোতে কেনির লোকেরা প্যারীসুন্দরীর প্রজাদের ক্ষেতের ধান পুড়িয়ে দেয়। এর বদলা নেবার জন্য প্যারীসুন্দরী লোকজন জড়ো করে একাধিকবার কেনির নীলকুঠিতে হামলা চালান। এরকমই এক হামলা কেরির নীলকুঠি চাষীদের রোষানল থেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় নিহত হন একজন পুলিশ অফিসার। এই অপরাধে সরকার তাঁর জমিদারী ক্রোক করে নেয়।
রেভারেন্ড জেমস লং

বিষয়টা পাদ্রি লং এর মাথায় গেঁথে যায়। তিনি নিজেই এর অনুবাদ করা শুরু করেন। কিন্তু কৃষকের চলতি গ্রাম্য ভাষা ছিল এই নাটকের প্রাণ। ফলে, এর অনুবাদে খুব একটা সুবিধা করতে পারেন না তিনি। তাই লং সাহেব শরণাপন্ন হলেন বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই বিশেষ দখল আছে, এমন একজন দেশি ব্যক্তির। সেই ব্যক্তি মাত্র এক রাতের মধ্যে নীল দর্পণের অনুবাদ করে দেন। পাদ্রি লং
তখন এই পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দেন ক্যালকাটা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং এর স্বত্বাধিকারী ক্লিমেন্ট হেনরি ম্যানুয়েল এর কাছে। তিনশ টাকার বিনিময়ে পাঁচশ কপি ছাপানোর সুরাহা হয়। নীল দর্পণ Nil Darpan, The Indigo Palnting Mirrorনামে তা ছাপা হয়ে যায় অনুবাদকের নাম ছাড়াই। বইতে শুধু লেখা ছিল Translated from the Bengali by a Native. বইটাতে পাদ্রি লং একটা ভূমিকাও জুড়ে দিয়েছিলেন।
নীল দর্পণের ইংরেজি অনুবাদ
বইগুলো হাতে পাবার পরে পাদ্রি লং সেগুলোকে বিভিন্ন গণ্যমান্য ইউরোপীয় এবং প্রভাবশালী নেটিভদের কাছে ডাকযোগে পাঠানো শুরু করেন। নীলকররা যখন এই ঘটনা জানতে পারলো তখন তাদের ক্ষিপ্ততা দেখে কে। গভর্নরের কাছে তারা জানতে চাইলো যে, কার অনুমতিতে এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে [
? সরকারের কাছ থেকে তেমন কোনো সদুত্তর না পেয়ে নীলকরেরা আদালতে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। লেখক এবং প্রকাশককে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলো।

কিন্তু, বইয়ে অনুবাদকের নাম না থাকায় শুধু প্রকাশক হেনরি ম্যানুয়েলকে আদালতে তোলা হলো। তিনি নিজেকে দোষী বলে স্বীকার করে নিলেন এবং জানালেন যে, পাদ্রি লং এর কাছ থেকে টাকা পেয়েই তিনি এই বইটি প্রকাশ করেছেন। এরপর মামলা সরে গেল পাদ্রি লং এর দিকে। পুরো বিচার চলাকালীন সময়ে পাদ্রি লং এর কাছ থেকে নেটিভ অনুবাদকের নাম জানার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই তাঁর মুখ খোলাতে পারে নি আদালত। বিচার শেষে দোষী বলে আদালত সাব্যস্ত করে তাঁকে। একমাসের কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে।
হাজার চেষ্টা করেও লং সাহেবের মুখ থেকে যে নেটিভ অনুবাদকের নাম জানা সম্ভব হয় নি, তাঁর নাম অবশ্য গোপন থাকে নি। থাকার কথাও নয়। ইংরেজরা ঠিকই ধরে ফেলেছিল। কিন্তু কিছুই করতে পারে নি প্রমাণ না থাকার কারণে। বাংলা এবং ইংরেজিতে ওইরকম তুখোড় দখল বাংলাদেশে মাত্র একজনেরই ছিল। বুদ্ধিমান পাঠকেরাও এতক্ষণে অনুবাদক কে ছিলেন, সেটা ধরে ফেলেছেন জানি। হ্যাঁ, নীল দর্পণের সেই অজ্ঞাতনামা নেটিভ অনুবাদক ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
নীল দর্পণের নেটিভ অনুবাদকের নাম প্রকাশ্যে ফাঁস করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি বলেছিলেন যে, এই ইংরেজি অনুবাদের ফলে মাইকেল মধুসূদন গোপনে তিরস্কৃত ও অপমানিত হয়েছিলেন এবং এইজন্য শেষে তাঁকে জীবিকানির্বাহের একমাত্র উপায় সুপ্রীম কোর্টের চাকরিও ছেড়ে আসতে হয়েছিল।
কারো জন্য যদি অন্য কেউ জেল খাটার বন্দোবস্ত থাকতো, তবে সেদিন পাদ্রি লং এর জন্য বহু লোকই এক পায়ে খাড়া ছিল। তবে, সেটা হবার নয়। কাজেই হয়ও নি। এক মাসের কারাবরণ করেছিলেন পাদ্রি লং। কিন্তু এক হাজার টাকার জরিমানা তাঁকে বইতে হয় নি। বিচারকের রায় বেরুনোর পরে দেখা গেল যে, আরেক নেটিভ ভদ্রলোক অযাচিতভাবে পাদ্রি লং এর অর্থদণ্ডের সমস্ত টাকা হাসিমুখে পরিশোধ করে দিয়েছেন।
এই নেটিভ ভদ্রলোক একজন জমিদার। নাম কালিপ্রসন্ন সিংহ। হুতোম পেঁচার নকশা দিয়েই তাঁকে চিনি আমরা।

নীলবিদ্রোহের শুরুর কিছু ঘটনা উল্লেখযোগ্য ও পরিসমাপ্তি

দুর্গাপুরের পিয়ারি মণ্ডলের রসিক প্রতিবাদ , সিন্দুরিয়া নীলকুঠির গোমস্তা শীতল বিশ্বাসের হত্যা , রব্বানি মণ্ডলের ওপরে অত্যাচার-এর মত ঘটনা নীল বিদ্রোহের অসহযোগ পর্যায়কে আরও বেগবান করে এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে দেয়। এই বিদ্রোহ মূলত শুরু হয় ১৮৫৯ সালে, বাস্তব রূপ পরিগ্রহন করে ১৮৬০ সালে এবং ১৮৬১ সালে প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। অসহযোগ এই আন্দোলন ঠেকাতে কুঠিয়াল ও জোতদাররা লাঠিয়াল বাহিনী নামায় ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে, ফলে ১৮৫৯ সালের শেষে বা ১৮৬০ সালের শুরুতে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহের কেন্দ্রে ছিল কৃষকদের লাঠিয়াল বাহিনী।

নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে 'নীল কমিশন' গঠন করে। এই কমিশন সরেজমিনে তদন্ত করে চাষিদের অভিযোগ যথার্থ বলে অভিমত দেয়। ফলে সরকার নীলচাষের ওপর একটি আইন পাস করেন। এতে ১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। ১৯০০ সালের মাঝে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণভাবে নীলচাষের অবসান ঘটে ।।
( সমাপ্ত )
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৭১১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৪/০৫/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast