নীলকুঠি ও নীল আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - তৃতীয় পর্ব
কুঠি স্থাপন ও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নীলকুঠি
১৮১৫ সালের মাঝে সারা বাংলাদেশে প্রায় সমস্ত অঞ্চলে নীল ব্যবসা প্রসার লাভ করে ও নীলকুঠি স্থাপিত হয়। এর পেছনে তিনটি কারণ বিদ্যমান - কোম্পানির আগ্রাসী বানিজ্য নীতি, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের উদ্যোগ এবং দেশি মুৎসুদ্দিদের প্রয়াস। ১৭৯৫ সাল থেকে যেসব নীল কারবারি ও ব্যবসায়ী এদেশে কুঠি স্থাপন করে কারবারি শুরু করেন, তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন -
১৭৯৫ সালে মিঃ সি. ডব্লিউ. শেরিফ জোড়াদহে
১৭৯৬ সালে মিঃ জন রিভস ও শেরিফ যৌথ মালিকানায় সিন্দুরিয়ায়
১৭৯৬ সালে মিঃ টাপট মহম্মদশাহীতে
১৮০০ সালে মিঃ ফারগুসন ও মে সাহেব যৌথ মালিকানায় যথাক্রমে দহকোলা ও আলমপুরে
১৮০০ সালে মিঃ টেলর মহেশপুরে
১৮০১ সালে মিঃ বার্কার সাহেব চুয়াডাঙ্গার নিশ্চিন্তপুরে
১৮০১ সালে মিঃ অ্যান্ডারসন যশোরের বারিন্দি ও বারুই পাড়ায়
১৮০৫ থেকে ১৮১৫ সালের মাঝে যারা নীল কুঠি স্থাপন করেন-
মিঃ টেলর ও ন্যুডশন - মিরপুরে
মিঃ রিজেট - ন'হাটায়
মার্টিন কোম্পানির ম্যানেজার মিঃ স্টিভেনসন - কুষ্টিয়ার আমবাগানে
মিঃ জেনকিনস ও ম্যাকেঞ্জি - ঝিকরগাছায়
মিঃ ওয়াটস - গোস্বামী দুর্গায়
মিঃ ডেভরেল - ঝিনেদার পার্শ্ববর্তি হাজরাপুরে
অবিভক্ত বঙ্গদেশে জমি ও রঞ্জিনীর উৎপাদনের পরিমান
বাংলাদেশের ২০ লক্ষ ৪০ হাজার বিঘা জমিতে ১২ লক্ষ ৮০ হাজার মণ নীল উৎপন্ন হত। বাংলায় ১১৬টি কোম্পানি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ৬২৮টি সদর কুঠির অধীনে সর্বমোট ৭৪৫২টি নীলকুঠি ছিল (ব্যক্তিগত ও দেশীয় জমিদার-মহাজনদের কুঠি বাদে)। নীলচাষে কর্মরত ছিল ১ কোটি ১২ লক্ষ ৩৬ হাজার কৃষক এবং নীলকুঠিগুলোতে নিযুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৪শ ৮২ জন। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধনের শতকরা ৭৩ ভাগ নীলের কারবারে লগ্নিকৃত ছিল। সে সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোন পণ্য নীলের মত এত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে নি।
নীলচাষের প্রাথমিক অসুবিধা ও প্রতিকার
লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বহু হিন্দু সরকারি কর্মচারীকে এদেশের জমির মালিক করে দেন। এরা নিজ জমিদারি সীমার মাঝে ছোটখাটো রাজা-বাদশার মত ক্ষমতা ভোগ করত। এরা জমি তো বটেই, প্রজার জানমাল, এমনকি তাঁদের ইজ্জত-সম্ভ্রমের মালিকও ছিল(১৬)। ইংরেজরা এদেশে এসে এই ভূস্বামী শ্রেণীটিকে তাঁদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে দেখতে পেল। কারণ, তারা যদি জমি কিনেও নিত, তবুও প্রজারা ওই ভূস্বামীদের অধীনে থাকত। ফলে জমিদারের অধীন প্রজাকে দিয়ে নীলকররা ইচ্ছেমত কাজ করিয়ে নিতে পারত না।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিগণ প্রভাব বিস্তার করে ১৮১৯ সালে অষ্টম আইন(Eighth regulation of 1819) বলবৎ করেন। এই আইনে জমিদার নিজের ভূমির ভেতর 'পত্তনি তালুক' দেবার সুযোগ পায় এবং কিছু দিনের মাঝেই জমিদাররা অধিক মুনাফার আশায়, আবার কোথাও অত্যাচার বা জুলুমের ভয়ে নীলকরদের কাছে বড় বড় পত্তনি দিতে শুরু করে। কিন্তু তবুও ইংরেজদের সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয় নি। কারণ পত্তনি ব্যবস্থায় জমিদারকে উচ্চহারে সেলামি ও খাজনা দিতে হত, বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য জমিস্বত্ব এবং দৈনিক মজুরির বিনিময়ে প্রজার সেবা পাওয়া যেত, যা ছিল অত্যন্ত খরচসাধ্য। তাই খরচ কমাতে নীলকরদের বাঁকুড়া, বীরভূম, সিংভূম, ধানভূম, মানভূম প্রভৃতি দূরবর্তী এলাকা থেকে শ্রমিক এনে কাজ করাতে হত। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কুঠিয়ালরা জমিদারি হস্তগত করার চেষ্টা করতে থাকে। তাঁদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেন মুৎসুদ্দি ও চাকুরেগণ। এদের মাঝে প্রসন্নকুমার ঘোষণা করেন,
'আলস্য, অনভিজ্ঞতা ও ঋণের জন্য দেশীয় জমিদারগন জমি পত্তনি দিতে উদগ্রীব হন, কারণ ইহাতে তাহারা জমিদারি চালাইবার ভার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং জমি পত্তনিদানের মত একটি নিশ্চিত আয়ের সাহায্যে রাজধানী কিংবা কোন একটা বড় শহরে বাস করিতে পারেন। এবং ইহাই রায়তদের জন্যে কল্যাণকর।'
এভাবে ভেতরে বাইরে চেষ্টার ফলে ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ার সনদে চতুর্থ আইনের(fourth regulation of 1833) দ্বারা বাংলাদেশে ইংরেজদের জমি ও জমিদারি ক্রয়ের সুযোগ প্রদান করা হয়। অনেক জমিদার অধিক মূল্য পেয়ে, কেউবা দুর্ধর্ষ নীলকর বা ম্যাজিস্ট্রেটের হুমকি পেয়ে জমিদারি বিক্রি করে চলে যায়। যারা এর আগে পত্তনি বন্দোবস্ত দিয়েছিল, তারা আর কখনো তালুক বা জমিদারি ফেরত পায়নি। অনেক জমিদার পাশের জমিদারের সাথে শত্রুতা করে জব্দ করার জন্য নীলকরদের ডেকে আনত। কিন্তু পরবর্তীতে নীলকররা উভয়ের জমিই গ্রাস করে নিত। এভাবে বাংলার সর্ববৃহৎ নীল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান 'বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি' কেবল চুয়াডাঙ্গা, ঝিনেদা, রানাঘাট ও যশোর থেকেই ৫৯৪টি গ্রামের জমিদারি ক্রয় করে। এই বিশাল জমিদারি থেকে তারা ব্রিটিশ সরকারকে রাজস্ব দিত মাত্র ৩ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা, যেখানে কেবল চুয়াডাঙ্গা ও রানাঘাট এলাকায় এরা ১৮ লক্ষ মূলধন খাটাত। মূলতঃ এই ভাবে ইংরেজগণ অধিকাংশ জমিদারি ক্রয় করে বাংলায় জেঁকে বসে ও নীল চাষ শুরু করে।
( চলবে )
১৮১৫ সালের মাঝে সারা বাংলাদেশে প্রায় সমস্ত অঞ্চলে নীল ব্যবসা প্রসার লাভ করে ও নীলকুঠি স্থাপিত হয়। এর পেছনে তিনটি কারণ বিদ্যমান - কোম্পানির আগ্রাসী বানিজ্য নীতি, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের উদ্যোগ এবং দেশি মুৎসুদ্দিদের প্রয়াস। ১৭৯৫ সাল থেকে যেসব নীল কারবারি ও ব্যবসায়ী এদেশে কুঠি স্থাপন করে কারবারি শুরু করেন, তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন -
১৭৯৫ সালে মিঃ সি. ডব্লিউ. শেরিফ জোড়াদহে
১৭৯৬ সালে মিঃ জন রিভস ও শেরিফ যৌথ মালিকানায় সিন্দুরিয়ায়
১৭৯৬ সালে মিঃ টাপট মহম্মদশাহীতে
১৮০০ সালে মিঃ ফারগুসন ও মে সাহেব যৌথ মালিকানায় যথাক্রমে দহকোলা ও আলমপুরে
১৮০০ সালে মিঃ টেলর মহেশপুরে
১৮০১ সালে মিঃ বার্কার সাহেব চুয়াডাঙ্গার নিশ্চিন্তপুরে
১৮০১ সালে মিঃ অ্যান্ডারসন যশোরের বারিন্দি ও বারুই পাড়ায়
১৮০৫ থেকে ১৮১৫ সালের মাঝে যারা নীল কুঠি স্থাপন করেন-
মিঃ টেলর ও ন্যুডশন - মিরপুরে
মিঃ রিজেট - ন'হাটায়
মার্টিন কোম্পানির ম্যানেজার মিঃ স্টিভেনসন - কুষ্টিয়ার আমবাগানে
মিঃ জেনকিনস ও ম্যাকেঞ্জি - ঝিকরগাছায়
মিঃ ওয়াটস - গোস্বামী দুর্গায়
মিঃ ডেভরেল - ঝিনেদার পার্শ্ববর্তি হাজরাপুরে
অবিভক্ত বঙ্গদেশে জমি ও রঞ্জিনীর উৎপাদনের পরিমান
বাংলাদেশের ২০ লক্ষ ৪০ হাজার বিঘা জমিতে ১২ লক্ষ ৮০ হাজার মণ নীল উৎপন্ন হত। বাংলায় ১১৬টি কোম্পানি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ৬২৮টি সদর কুঠির অধীনে সর্বমোট ৭৪৫২টি নীলকুঠি ছিল (ব্যক্তিগত ও দেশীয় জমিদার-মহাজনদের কুঠি বাদে)। নীলচাষে কর্মরত ছিল ১ কোটি ১২ লক্ষ ৩৬ হাজার কৃষক এবং নীলকুঠিগুলোতে নিযুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৪শ ৮২ জন। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধনের শতকরা ৭৩ ভাগ নীলের কারবারে লগ্নিকৃত ছিল। সে সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোন পণ্য নীলের মত এত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে নি।
নীলচাষের প্রাথমিক অসুবিধা ও প্রতিকার
লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বহু হিন্দু সরকারি কর্মচারীকে এদেশের জমির মালিক করে দেন। এরা নিজ জমিদারি সীমার মাঝে ছোটখাটো রাজা-বাদশার মত ক্ষমতা ভোগ করত। এরা জমি তো বটেই, প্রজার জানমাল, এমনকি তাঁদের ইজ্জত-সম্ভ্রমের মালিকও ছিল(১৬)। ইংরেজরা এদেশে এসে এই ভূস্বামী শ্রেণীটিকে তাঁদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে দেখতে পেল। কারণ, তারা যদি জমি কিনেও নিত, তবুও প্রজারা ওই ভূস্বামীদের অধীনে থাকত। ফলে জমিদারের অধীন প্রজাকে দিয়ে নীলকররা ইচ্ছেমত কাজ করিয়ে নিতে পারত না।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিগণ প্রভাব বিস্তার করে ১৮১৯ সালে অষ্টম আইন(Eighth regulation of 1819) বলবৎ করেন। এই আইনে জমিদার নিজের ভূমির ভেতর 'পত্তনি তালুক' দেবার সুযোগ পায় এবং কিছু দিনের মাঝেই জমিদাররা অধিক মুনাফার আশায়, আবার কোথাও অত্যাচার বা জুলুমের ভয়ে নীলকরদের কাছে বড় বড় পত্তনি দিতে শুরু করে। কিন্তু তবুও ইংরেজদের সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয় নি। কারণ পত্তনি ব্যবস্থায় জমিদারকে উচ্চহারে সেলামি ও খাজনা দিতে হত, বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য জমিস্বত্ব এবং দৈনিক মজুরির বিনিময়ে প্রজার সেবা পাওয়া যেত, যা ছিল অত্যন্ত খরচসাধ্য। তাই খরচ কমাতে নীলকরদের বাঁকুড়া, বীরভূম, সিংভূম, ধানভূম, মানভূম প্রভৃতি দূরবর্তী এলাকা থেকে শ্রমিক এনে কাজ করাতে হত। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কুঠিয়ালরা জমিদারি হস্তগত করার চেষ্টা করতে থাকে। তাঁদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেন মুৎসুদ্দি ও চাকুরেগণ। এদের মাঝে প্রসন্নকুমার ঘোষণা করেন,
'আলস্য, অনভিজ্ঞতা ও ঋণের জন্য দেশীয় জমিদারগন জমি পত্তনি দিতে উদগ্রীব হন, কারণ ইহাতে তাহারা জমিদারি চালাইবার ভার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং জমি পত্তনিদানের মত একটি নিশ্চিত আয়ের সাহায্যে রাজধানী কিংবা কোন একটা বড় শহরে বাস করিতে পারেন। এবং ইহাই রায়তদের জন্যে কল্যাণকর।'
এভাবে ভেতরে বাইরে চেষ্টার ফলে ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ার সনদে চতুর্থ আইনের(fourth regulation of 1833) দ্বারা বাংলাদেশে ইংরেজদের জমি ও জমিদারি ক্রয়ের সুযোগ প্রদান করা হয়। অনেক জমিদার অধিক মূল্য পেয়ে, কেউবা দুর্ধর্ষ নীলকর বা ম্যাজিস্ট্রেটের হুমকি পেয়ে জমিদারি বিক্রি করে চলে যায়। যারা এর আগে পত্তনি বন্দোবস্ত দিয়েছিল, তারা আর কখনো তালুক বা জমিদারি ফেরত পায়নি। অনেক জমিদার পাশের জমিদারের সাথে শত্রুতা করে জব্দ করার জন্য নীলকরদের ডেকে আনত। কিন্তু পরবর্তীতে নীলকররা উভয়ের জমিই গ্রাস করে নিত। এভাবে বাংলার সর্ববৃহৎ নীল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান 'বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি' কেবল চুয়াডাঙ্গা, ঝিনেদা, রানাঘাট ও যশোর থেকেই ৫৯৪টি গ্রামের জমিদারি ক্রয় করে। এই বিশাল জমিদারি থেকে তারা ব্রিটিশ সরকারকে রাজস্ব দিত মাত্র ৩ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা, যেখানে কেবল চুয়াডাঙ্গা ও রানাঘাট এলাকায় এরা ১৮ লক্ষ মূলধন খাটাত। মূলতঃ এই ভাবে ইংরেজগণ অধিকাংশ জমিদারি ক্রয় করে বাংলায় জেঁকে বসে ও নীল চাষ শুরু করে।
( চলবে )
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ২০/০৫/২০১৮তথ্যবহুল ইতিহাস। জানা প্রয়োজন।
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ২০/০৫/২০১৮শিক্ষণীয়।