নীলকুঠি ও নীল আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - দ্বিতীয় পর্ব
. . . . . ইন্ডিগোটিন ছাড়া তাতে অন্যান্য পদার্থ থাকে তার মধ্যে ইন্ডিরুবাইনম ইন্ডিগো গ্রীন ও ইন্ডিগো ব্রাউন।
প্রাচীন ও আধুনিক নীলচাষ
প্রাচীন কাল থেকেই বাংলায় নীল চাষ প্রচলিত ছিল। ভারতীয় ভেষজ বিজ্ঞানের নানা গ্রন্থে, প্রাচীন প্রতিমূর্তির বর্ণে, অঙ্কিত পট ও চিত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইংরেজিতে নীল indigo নামে আর গ্রিক ও রোমান ভাষায় indium নামে পরিচিত। উভয় শব্দই India শব্দের সমার্থবোধক। আবার প্রাচীন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মাঝে নীলের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তারা সিন্ধু নদের (the Indus) তীরে বাস করত। এজন্য ধারণা করা হয় এদেশেই নীল চাষের উৎপত্তি।
লুই বন্ড নামের একজন ফরাসি বণিকের মাধ্যমে এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে নীলচাষ ও এর ব্যবহার প্রচলন ঘটে। তিনি ১৭৭৭ আমেরিকা থেকে প্রথম নীলবীজ ও আধুনিক চাষের পদ্ধতি এদেশে নিয়ে আসেন। একই বছরে হুগলী নদীর তীরবর্তী গোন্দালপাড়া ও তালডাঙ্গা গ্রামে তিনি সর্বপ্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। এর কয়েক বছর পরে মালদহে, ১৮১৪ সালে বাকিপুরে, এবং তারপরে যশোরের নহাটা ও কালনাতে নীলকুঠি ও কারখানা স্থাপন করেন। ১৮২০ সালে কালনা থেকে প্রায় দেড় হাজার মণ পরিশোধিত নীল রপ্তানি করে বন্ড উপমহাদেশ ও ব্রিটেনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। ১৮২০ সালে তার মৃত্যু হয়।
বাংলায় নীলচাষের প্রসার
লুই বন্ডের এক বছর পর ক্যারল ব্লুম নামের একজন ইংরেজ কুষ্টিয়ায় একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নীলচাষে বিপুল মুনাফার কথা অবহিত করে দ্রুত নীলের কারবার শুরু করার আহ্বান জানান ও ১৭৭৮ সালে গভর্নর জেনারেলের কাছে এই বিষয়ে সপারিষদ একটি স্মারকপত্র দাখিল করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় এবং কাপড় রং করার জন্য নীলের চাহিদা শতগুনে বেড়ে যায়। ফলে ওই সময়ে নীল চাষের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে ওঠে।
কোম্পানি লাভের সম্ভাবনা দেখে শীঘ্রই সমস্ত কারবার হস্তগত করে নেয়। এক হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৮০৩ সাল পর্যন্ত নীল চাষে যে খরচ হত, তার সবটাই কোম্পানি অল্প সুদে অগ্রিম প্রদান করত। এতে যে নীল উৎপাদিত হত, তার সবটাই যেত ইংল্যান্ডে এবং কোম্পানি বহুগুণ বেশি লাভ করত। এই ব্যবসা এতই লাভজনক ছিল যে, বহু কর্মচারী ও সরকারি আমলা চাকরি ও রাজনীতি ছেড়ে নীলচাষের কারবারে আত্মনিয়োগ করে। বহু দেশীয় জমিদার ও মহাজন ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথ মালিকানায় কারবার খোলে এবং ১৮১৫ সালের মধ্যে নদীয়া, যশোর, খুলনা, ২৪ পরগণা, বগুড়া, রাজশাহী, মালদহ, পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল প্রভৃতি জেলায় অসংখ্য নীলকুঠি গড়ে ওঠে। এসব এলাকার নীলের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যবঙ্গের উৎকৃষ্ট নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী হবার কাহিনী সকল ধনিক ও বণিক সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করে এবং ক্রমশ ফরাসি, ডাচ, পর্তুগীজ, দিনেমার প্রভৃতি দেশের ধনিক গোষ্ঠীও দলে দলে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়।
নীল চাষের প্রসার দেখে বাংলার শীর্ষস্থানীয় মুৎসুদ্দি, নব প্রতিষ্ঠিত জমিদার গোষ্ঠী ও উদীয়মান শহুরে শ্রেণী নীলকরদের সুযোগ-সুবিধা ও নীলচাষের প্রসারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ সরকারের সুনজরে থাকা। এদের মাঝে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায় অন্যতম। তারা ১৮২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে এক সভা করেন এবং নীল চাষ প্রসারের দাবী জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ পাঠান। পার্লামেন্ট তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দাস মালিক ও দাস পরিচালনাকারীদের বাংলায় এনে নীলচাষের তদারকিতে নিয়োজিত করে। এছাড়া ব্যাপক নীল চাষের কারণে বিহার ও উড়িষ্যা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যে ইংরেজরা আগ্রা ও অযোধ্যা দখল করে।
অবিভক্ত বাঙলায় নানা নীলকুঠির ভৌগলিক অবস্থান –
ইছামতি ছোট একটি নদী। যশোর এবং ভারতের পশ্চিবঙ্গের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এই নদীর তীরে অবস্থিত ছিল এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নীলকুঠি। এই মোল্লাহাটি বর্তমান পড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ মহাকুমার মধ্যে। বনগাঁ শহর থেকে ৯ কিলোমিটার উত্তরে ইছামতি নদীর তীরে। আর এই নীলকুঠির ইংরেজ ছিলেন লারমোর এবং জেমস ফরলঙ। তারা ছিলেন খুব অত্যাচারী।
তবে যশোর জেলায় প্রথম নীলকুঠি স্থাপন করা হয় রূপদিয়া বাজারে। যশোর-খুলনা মহাসড়কের রূপদিয়া বাজারে প্রবেশের মুখেই বাঁ হাতে ঘন গাছ-পালা ঘেরা একটি স্থান। কিছুটা ফাঁকা। জংলী লতাপাতায় ঢেকে গেছে চারদিক। আশেপাশে কিছু আধুনিক ভবন উঠেছে। ওই লতা-পাতা ঢাকা স্থানে পুরনো ভবনের ধবংসাবশেষ কৌতুহলী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পাশ দিয়েই চলে গেছে ভৈরব নদী। উত্তর প্রান্তের এই নদী পশ্চিম থেকে পূর্বগামী। ভাঙ্গা ভবনের ধারঘেঁষা নদীর ওপর বাঁধান সিঁড়ি। স্পষ্ট বোঝা যায়, এটি অতীতে ঘাট হিসাবে ব্যবহার করা হতো। এখন ভাঙ্গা ঘাট মূল্যহীন। কেননা, যাঁরা ঘাটটি তৈরি করেছিলেন তাঁরা নেই। নদীটিও ক্ষীণকায়া। বর্ষায় নাব্যতা পায়।
[ চিত্র ১ ]
তাছাড়া আধুনিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এ এলাকায় নদীর প্রয়োজনও ফুরিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। পুরনো ভবনের ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে স্থানীয় মানুষজন জানেন এটি কুঠিবাড়ি। নীলকুঠি। কিন্তু এর ইতিহাস জানেন না অনেকেই। এই ধ্বংসাবশেষই যশোর জেলায় স্থাপিত প্রথম নীলকুঠি। ১৭৯৫ সালে এটি নির্মাণ করেন মিঃ বন্ড। এই বন্ড সাহেবকে ঘিরে রূপদিয়া এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা কিংবদন্তী। বাংলাদেশে প্রথম নীলচাষ আরম্ভ করেন ফরাসী বনিক লুই বোনড। ১৭৭৭ সালে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার চন্দননগরের তালডাঙ্গা ও গোন্দলপাড়ায় নীলকুঠি স্থাপন করেন। ক্রমান্বয়ে নীলচাষ ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সর্বত্র। তবে যশোর ও নদীয়ার নীল ছিল উৎকৃষ্ট। ১৮১০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত নীলকরদের জন্য পরিস্থিতি ছিল অনুকূলে। সে সময় এদেশের সব থেকে বেশি নীলচাষ হয়। ১৮৫৯-৬০ সালের নীল বিদ্রোহের দরুন নীলচাষ হ্রাস পায় ক্রমান্বয়ে। পরে পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় এর চাষ। যশোরে মিঃ বন্ড যখন নীলকুঠি স্থাপন করেন, তখন কোম্পানি শাসন পাকাপোক্ত। বিভিন্ন স্থানে রাজস্ব আদায় ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নতুন নতুন জেলা ও থানা স্থাপন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে যশোরে ১৭৮১ সালে নতুন জেলা স্থাপিত হয়েছে। যার সদর দফতর বসেছে মুড়লীতে। রূপদিয়া থেকে যশোর শহরে আসার পথেই মুড়লী। ১৭৯৫ সালে যশোরে কালেক্টরেট ছিলেন থমাস পোনে। মিঃ বন্ড ছিলেন তার ব্যক্তিগত বন্ধু। তারই পরামর্শে মিঃ বন্ড রূপদিয়াতে কুঠি স্থাপন করেন। ভৈরব নদীর ঠিক দক্ষিণ প্রান্তে জঙ্গল কেটে তৈরি হয় বিশাল এলাকা নিয়ে নতুন নতুন ভবন। এলাকটি ছিল পুরোপুরি জঙ্গলাকীর্ণ। জনবসতি ছিল বিরল। বনে বাঘও থাকত। রূপদিয়া সরাসরি নদী পথে মুড়লীর সঙ্গে সংযুক্ত। অন্যদিকে পূর্বদিকে শেখহাটি, অভয়নগর, ফুলতলা, নয়াবাদ (খুলনা) পর্যন্তও যাওয়া যায় সহজে। যাই হোক, মোল্লাহাটিতে বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানির সদর কুঠি ছিল। এর অধীনে ছিল মোল্লাহাটি, বাঘডাঙ্গা, পিপুলবাড়িয়া, পিপড়াগাছি, ভবানীপুর, বেনাপোল, দুর্গাপুর, গাইঘাটা, হুগলী, মীর্জাপুর সহ ১৭টি কুঠি। বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানির প্রথম ম্যানেজার ছিলেন লারমোর। পরে ১৮৬০ সালের প্রথম দিকে যোগ দেন জেমস ফরলঙ।
( চলবে )
প্রাচীন ও আধুনিক নীলচাষ
প্রাচীন কাল থেকেই বাংলায় নীল চাষ প্রচলিত ছিল। ভারতীয় ভেষজ বিজ্ঞানের নানা গ্রন্থে, প্রাচীন প্রতিমূর্তির বর্ণে, অঙ্কিত পট ও চিত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইংরেজিতে নীল indigo নামে আর গ্রিক ও রোমান ভাষায় indium নামে পরিচিত। উভয় শব্দই India শব্দের সমার্থবোধক। আবার প্রাচীন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মাঝে নীলের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তারা সিন্ধু নদের (the Indus) তীরে বাস করত। এজন্য ধারণা করা হয় এদেশেই নীল চাষের উৎপত্তি।
লুই বন্ড নামের একজন ফরাসি বণিকের মাধ্যমে এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে নীলচাষ ও এর ব্যবহার প্রচলন ঘটে। তিনি ১৭৭৭ আমেরিকা থেকে প্রথম নীলবীজ ও আধুনিক চাষের পদ্ধতি এদেশে নিয়ে আসেন। একই বছরে হুগলী নদীর তীরবর্তী গোন্দালপাড়া ও তালডাঙ্গা গ্রামে তিনি সর্বপ্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। এর কয়েক বছর পরে মালদহে, ১৮১৪ সালে বাকিপুরে, এবং তারপরে যশোরের নহাটা ও কালনাতে নীলকুঠি ও কারখানা স্থাপন করেন। ১৮২০ সালে কালনা থেকে প্রায় দেড় হাজার মণ পরিশোধিত নীল রপ্তানি করে বন্ড উপমহাদেশ ও ব্রিটেনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। ১৮২০ সালে তার মৃত্যু হয়।
বাংলায় নীলচাষের প্রসার
লুই বন্ডের এক বছর পর ক্যারল ব্লুম নামের একজন ইংরেজ কুষ্টিয়ায় একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নীলচাষে বিপুল মুনাফার কথা অবহিত করে দ্রুত নীলের কারবার শুরু করার আহ্বান জানান ও ১৭৭৮ সালে গভর্নর জেনারেলের কাছে এই বিষয়ে সপারিষদ একটি স্মারকপত্র দাখিল করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় এবং কাপড় রং করার জন্য নীলের চাহিদা শতগুনে বেড়ে যায়। ফলে ওই সময়ে নীল চাষের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে ওঠে।
কোম্পানি লাভের সম্ভাবনা দেখে শীঘ্রই সমস্ত কারবার হস্তগত করে নেয়। এক হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৮০৩ সাল পর্যন্ত নীল চাষে যে খরচ হত, তার সবটাই কোম্পানি অল্প সুদে অগ্রিম প্রদান করত। এতে যে নীল উৎপাদিত হত, তার সবটাই যেত ইংল্যান্ডে এবং কোম্পানি বহুগুণ বেশি লাভ করত। এই ব্যবসা এতই লাভজনক ছিল যে, বহু কর্মচারী ও সরকারি আমলা চাকরি ও রাজনীতি ছেড়ে নীলচাষের কারবারে আত্মনিয়োগ করে। বহু দেশীয় জমিদার ও মহাজন ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথ মালিকানায় কারবার খোলে এবং ১৮১৫ সালের মধ্যে নদীয়া, যশোর, খুলনা, ২৪ পরগণা, বগুড়া, রাজশাহী, মালদহ, পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল প্রভৃতি জেলায় অসংখ্য নীলকুঠি গড়ে ওঠে। এসব এলাকার নীলের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যবঙ্গের উৎকৃষ্ট নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী হবার কাহিনী সকল ধনিক ও বণিক সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করে এবং ক্রমশ ফরাসি, ডাচ, পর্তুগীজ, দিনেমার প্রভৃতি দেশের ধনিক গোষ্ঠীও দলে দলে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়।
নীল চাষের প্রসার দেখে বাংলার শীর্ষস্থানীয় মুৎসুদ্দি, নব প্রতিষ্ঠিত জমিদার গোষ্ঠী ও উদীয়মান শহুরে শ্রেণী নীলকরদের সুযোগ-সুবিধা ও নীলচাষের প্রসারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ সরকারের সুনজরে থাকা। এদের মাঝে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায় অন্যতম। তারা ১৮২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে এক সভা করেন এবং নীল চাষ প্রসারের দাবী জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ পাঠান। পার্লামেন্ট তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দাস মালিক ও দাস পরিচালনাকারীদের বাংলায় এনে নীলচাষের তদারকিতে নিয়োজিত করে। এছাড়া ব্যাপক নীল চাষের কারণে বিহার ও উড়িষ্যা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যে ইংরেজরা আগ্রা ও অযোধ্যা দখল করে।
অবিভক্ত বাঙলায় নানা নীলকুঠির ভৌগলিক অবস্থান –
ইছামতি ছোট একটি নদী। যশোর এবং ভারতের পশ্চিবঙ্গের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এই নদীর তীরে অবস্থিত ছিল এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নীলকুঠি। এই মোল্লাহাটি বর্তমান পড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ মহাকুমার মধ্যে। বনগাঁ শহর থেকে ৯ কিলোমিটার উত্তরে ইছামতি নদীর তীরে। আর এই নীলকুঠির ইংরেজ ছিলেন লারমোর এবং জেমস ফরলঙ। তারা ছিলেন খুব অত্যাচারী।
তবে যশোর জেলায় প্রথম নীলকুঠি স্থাপন করা হয় রূপদিয়া বাজারে। যশোর-খুলনা মহাসড়কের রূপদিয়া বাজারে প্রবেশের মুখেই বাঁ হাতে ঘন গাছ-পালা ঘেরা একটি স্থান। কিছুটা ফাঁকা। জংলী লতাপাতায় ঢেকে গেছে চারদিক। আশেপাশে কিছু আধুনিক ভবন উঠেছে। ওই লতা-পাতা ঢাকা স্থানে পুরনো ভবনের ধবংসাবশেষ কৌতুহলী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পাশ দিয়েই চলে গেছে ভৈরব নদী। উত্তর প্রান্তের এই নদী পশ্চিম থেকে পূর্বগামী। ভাঙ্গা ভবনের ধারঘেঁষা নদীর ওপর বাঁধান সিঁড়ি। স্পষ্ট বোঝা যায়, এটি অতীতে ঘাট হিসাবে ব্যবহার করা হতো। এখন ভাঙ্গা ঘাট মূল্যহীন। কেননা, যাঁরা ঘাটটি তৈরি করেছিলেন তাঁরা নেই। নদীটিও ক্ষীণকায়া। বর্ষায় নাব্যতা পায়।
[ চিত্র ১ ]
তাছাড়া আধুনিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এ এলাকায় নদীর প্রয়োজনও ফুরিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। পুরনো ভবনের ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে স্থানীয় মানুষজন জানেন এটি কুঠিবাড়ি। নীলকুঠি। কিন্তু এর ইতিহাস জানেন না অনেকেই। এই ধ্বংসাবশেষই যশোর জেলায় স্থাপিত প্রথম নীলকুঠি। ১৭৯৫ সালে এটি নির্মাণ করেন মিঃ বন্ড। এই বন্ড সাহেবকে ঘিরে রূপদিয়া এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা কিংবদন্তী। বাংলাদেশে প্রথম নীলচাষ আরম্ভ করেন ফরাসী বনিক লুই বোনড। ১৭৭৭ সালে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার চন্দননগরের তালডাঙ্গা ও গোন্দলপাড়ায় নীলকুঠি স্থাপন করেন। ক্রমান্বয়ে নীলচাষ ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সর্বত্র। তবে যশোর ও নদীয়ার নীল ছিল উৎকৃষ্ট। ১৮১০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত নীলকরদের জন্য পরিস্থিতি ছিল অনুকূলে। সে সময় এদেশের সব থেকে বেশি নীলচাষ হয়। ১৮৫৯-৬০ সালের নীল বিদ্রোহের দরুন নীলচাষ হ্রাস পায় ক্রমান্বয়ে। পরে পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় এর চাষ। যশোরে মিঃ বন্ড যখন নীলকুঠি স্থাপন করেন, তখন কোম্পানি শাসন পাকাপোক্ত। বিভিন্ন স্থানে রাজস্ব আদায় ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নতুন নতুন জেলা ও থানা স্থাপন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে যশোরে ১৭৮১ সালে নতুন জেলা স্থাপিত হয়েছে। যার সদর দফতর বসেছে মুড়লীতে। রূপদিয়া থেকে যশোর শহরে আসার পথেই মুড়লী। ১৭৯৫ সালে যশোরে কালেক্টরেট ছিলেন থমাস পোনে। মিঃ বন্ড ছিলেন তার ব্যক্তিগত বন্ধু। তারই পরামর্শে মিঃ বন্ড রূপদিয়াতে কুঠি স্থাপন করেন। ভৈরব নদীর ঠিক দক্ষিণ প্রান্তে জঙ্গল কেটে তৈরি হয় বিশাল এলাকা নিয়ে নতুন নতুন ভবন। এলাকটি ছিল পুরোপুরি জঙ্গলাকীর্ণ। জনবসতি ছিল বিরল। বনে বাঘও থাকত। রূপদিয়া সরাসরি নদী পথে মুড়লীর সঙ্গে সংযুক্ত। অন্যদিকে পূর্বদিকে শেখহাটি, অভয়নগর, ফুলতলা, নয়াবাদ (খুলনা) পর্যন্তও যাওয়া যায় সহজে। যাই হোক, মোল্লাহাটিতে বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানির সদর কুঠি ছিল। এর অধীনে ছিল মোল্লাহাটি, বাঘডাঙ্গা, পিপুলবাড়িয়া, পিপড়াগাছি, ভবানীপুর, বেনাপোল, দুর্গাপুর, গাইঘাটা, হুগলী, মীর্জাপুর সহ ১৭টি কুঠি। বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানির প্রথম ম্যানেজার ছিলেন লারমোর। পরে ১৮৬০ সালের প্রথম দিকে যোগ দেন জেমস ফরলঙ।
( চলবে )
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
পি পি আলী আকবর ২০/০৫/২০১৮সুন্দর
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ১৯/০৫/২০১৮দারুণ গবেষণা..................
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ১৯/০৫/২০১৮তৃতীয় পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
শুভেচ্ছা জানবেন।