ভবানীর শেষ তলোয়ার
১
ইতিমধ্যে দু-দুটো অভিযান চালিয়ে মামার থেকেও টুটুন কলেজ মহলে বেশ নামডাক করে ফেলেছে । মামা পূর্বের মতই ভাবলেশ । বললেই একটাই পুরনো কথা “ কাকতালীয় ।” তা সে যাইহোক টুটুন মহাখুশী । সেদিনই মামা ফিরেছেন রাঁচি থেকে টুটুনদের বর্ধমানের বাড়ী । কয়েকদিন পর টুটুন পুনা ফিরে যাবে , আবার কবে দেখা হয় তার জন্য বাড়ীতে হই রই ব্যাপার । মায়ের চোখে সন্তান সারাজীবন রোগা , তাই এটা খাও ওটা খেতে নেই লেগেই আছে । মামাকে পেয়ে টুটুনের বাঁচোয়া ।
রাতে খাওয়ার পর মামা ভাগ্নের সাথে আসর জমিয়েছে বিশ্বম্ভর বাবু আর টুটুনের মা । এ কথা সে কথার পর বিশ্বম্ভর বাবু শালাকে বলেই বসলেন “ বিশ আইল্যান্ডের সমস্যা তো মিটলো , তা এবার প্ল্যান কী ?” মামা হতবাক হয়ে বলল , “ প্ল্যান আবার পালানো , আমি বাবা আর ওসবের নেই । ধুর ছাতা যেখানেই যাই কিছু একটা ঘটবেই ...।” আরও কিছু কথা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তার আগেই বিশ্বম্ভর বাবুর মোবাইলটা সুর তুলে বেজে উঠল । কানে দিতেই অপার থেকে ভেসে এল কণ্ঠস্বর, “ হ্যালো... বিশু শালাবাবু আছে নাকি ?” বাবা পরিচিত গলার আওয়াজ শুনেই একগাল হেসে বললেন “ কী ব্যাপার হে , সবার খবর ছেড়ে শালার পিছনে... হুম দাঁড়াও দিই ।” স্পিকারে হাত চেপে বাবা অনুচ্চ গলায় বললেন মামাকে “ প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মধু চাটুজ্যে কথা বলতে চায় তোমার সাথে...”। মামা ফোনটা কানে গুঁজে বাইরের ঘড়ে গেল। ভিতরে নেটয়ার্ক সমস্যা । বেশ খানিকক্ষণ পর ফিরে এসে রবি ঠাকুরের কবিতার কয়েক অংশ হাসতে হাসতে বলল – “ দেখি নি একটি ঘাসের উপর একটি শিশির বিন্দু...।” আমরা তো অবাক ! হল কী ! মামার মুল কথা হল প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ একটি সমস্যায় পড়েছেন ।
“ কী ?” আমরা তিনজন প্রায় একসাথেই বলে উঠলাম ।
“ উনি বর্ধমানের কাছেই একটি জায়গার উপর গবেষণা বহুদিন করছেন । শেষে তাঁর সেই রথ এক ধাঁধাঁয় এসে তালগোল পাকিয়ে গেছে , তার জন্যই আলোচনা করতে চান ।” মনে মনে খুশী হলাম । আমার মুখ দেখে বলল “ উঁহু অত উৎসাহ ভাল না আর আমিও ইতিহাসবিদ নই ।” আমি জানি মামা সামান্য পত্র পত্রিকায় বিনি পয়সায় লেখে তবে মামার যা বুদ্ধি তাতে আগের কেসগুলোতেই পরিষ্কার ।
২
পরেরদিন সকালেই মধু কাকার বাড়ী পৌঁছে গেলাম । বর্ধমান থেকে মাত্র ৬০ কি.মি । স্থানটার নাম না হয় পরেই আসবে ঘটনাচক্রে । মধু কাকা আপ্যায়ন করে নানা ইতিহাস বলতে লাগ্লেন । আমি নিজেই জানতাম না বাড়ীর এত কাছেই এত বড় আধুনিক এই শহরটার বুকে জমে রয়েছে কত ইতিহাস আর ডাকাতের গল্প । এর মাঝে মধু কাকা টুক করে ভিতর ঘড়ে উঠে গেলেন । একটু পড়েই প্রায় আধখাওয়া প্রাচীন একটা পাণ্ডুলিপি নিয়ে ফিরলেন । উঁকি মেরে দেখলাম বর্ধমানের ইতিহাস । আমাদের শুনিয়ে কিছুটা পড়তে পড়তে এক জায়গায় থামলেন । মামাকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বললেন “ এই , এই জায়গাটা ঝামেলায় ফেলছে , দ্যাখো ।” মামার সাথে আমিও যা দেখলাম তা হল এরকম –
“ চৌধুরী রানী দুর্গার দেশে
পাঠক মায়ের শেষ আদেশে ,
রেখে যায় অন্তিম তরবারি –
গহ্বরের উত্তরে আছে মায়ের বাড়ী ,
পূবের আঁধার জঠরে সে রয় –
মা যায় , এনেছিল বিজয় ।”
মামা মধুকাকার পারমিশন নিয়ে মোবাইলে হেঁয়ালিটার ছবি তুলে নিতে বলল আমাকে । নিজেও বার কয়েক পড়ে উত্তর দিল , “ দাদা প্রথম দু’লাইন তো আপনার দৌলতে বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না কিন্তু...।” “ ঠিক বলেছ তবে আছেটা কোথায় এটাই বুঝতে পারছি না !” মামা হেসে ঘাড় নাড়িয়ে বলে ওঠে “ দাদা আমি তো ডিটেকটিভ নই তবুও আপনার সাহায্য করতে পারলে আমি নিজেকেও ধন্য মনে করব ।” এখানে আমার ভূমিকা প্রায় বোবা শ্রোতা আর দুজনের মুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ।
৩
রাতে কাকার বাড়ীতেই থাকার ব্যবস্থা । মামা মশগুল আমার মোবাইলের ওই লাইনগুলি নিয়ে । আমি আমার সাইডের লাইটল্যাম্প নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম । রাত কটা হবে জানি না , মামার ডাকে ধরফরিয়ে উঠে বসলাম । মামা বললে “ টুটুন নিরানব্বই শতাংশ উদ্ধার করা গেছে রে , এবার শুধু মধু’দার ইনফরমেশন পেলেই কাজ শেষ ।” মনে মনে নিরাশ হলাম । এবার কিছুই কী হবে না !!
সকাল হতেই মামা পড়ল কাকাকে নিয়ে । মাঝে একবার উঠে আমাকে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ার জন্য তাড়া লাগিয়ে গেল । এখন বেলা বারোটা । গ্রীষ্মের দাবদাহ কিছুটা মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে কমেছে । গাড়ীতে যেতে যেতে মামা আর মধুকাকার আলোচনায় উঠে এল দুর্গাপুরের ইতিহাস । দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গাপুরের আদি জনক , তাঁর নামেই এখানকার নাম । ভূগোলে প্রায় আঠারোটি দুর্গাপুরের নাম থাকলেও এখানকার প্রাচীন গুহা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে । “ দেবী চৌধুরানীর গুহা ”। কথা বলতে বলতে আমরা এসে পড়লাম সেখানে । বর্তমানে সেই ঈষৎ উঁচু টিলাটিকে কেন্দ্র করে পার্ক গড়ে উঠেছে । ভাবলাম গুহার মধ্যে নামা যাবে । হা হতস্মিন ! আজ থেকে প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে গুহার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নানা কারনে ।
মামা আমাকে বললে , “ টুটুন সেই ছড়াটার প্রথম দুটি লাইন মনে পড়ে ?” মাথা নাড়িয়ে “ হ্যাঁ ” বললাম । মামা জিজ্ঞাসা করে ভ্রূ নাচিয়ে , “ দুর্গার দেশে মানে কী দাঁড়াল , দুর্গাপুর , তাই তো ! আর চৌধুরী রানী ?” আমিও কম যাই না , চটপট জবাব দিলাম “ তোমাদের আলোচনাতে বুঝলাম ডাকাত দেবী চৌধুরানী , যিনি ডাকাতি করে গরীবদের সাহায্য করতেন । দুষ্টু জমিদার আর ব্রিটিশদের সাথেও লড়াই করেছিলেন...” আমার কথার মাঝেই মামার উদ্দেশ্যে মধুকাকা বলেন “ তোমার মতই দেখছি টুটুনের চমৎকার বুদ্ধি ।” বুঝলাম মামার বুক কয়েক ইঞ্চি বেড়ে গেছে ।
মধুকাকার কাছে একটু এগিয়ে মামা বলল “ আচ্ছা এই গুহাটার অপর কোন কী নাম আছে ?” “ ভবানী পাঠকের গুহা ” কাকা উত্তরটা দিয়েই হা হা করে হেসে উঠলেন আর বার বার মাথা নাড়িয়ে বলতে লাগলেন “ মিলছে মিলছে ।” তারপর নিজেই চিন্তা মিশ্রিত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন “ কিন্তু শালাবাবু পাঠক মা কোথায় রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন তলোয়ারটি ?” “ ওটাই লাখ টাকার প্রশ্ন দাদা ?” মামার গলাতেও চিন্তা । আমি মামার ভাগ্নে , বললাম , “ এই মা’টা মানে তো কালী-দুর্গা তাহলে তো মা এখানে ভবানী । সেটা হলে ওই গুহার উত্তর দিকে মায়ের বাড়ী । আচ্ছা মামা বঙ্কিম রচনাবলীতে পড়েছি ভবানী পাঠক কালী পুজা করতেন এটা কী সত্যি ?”
মামা আর মধুকাকা দু’জনেই আমার কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক । আমার দিকে তাকিয়ে সোল্লাসে লাফ দিয়ে কাকা বলেই ফেলল “ বাপ রে বাপ ! এত পুরো গোয়েন্দা যে শালাবাবু । হ্যাঁ আছে তো , অম্বুজার কাছেই প্রাচীন মন্দির ।” মামা ব্যাপারটা শুনে মিটিমিটি হাসছে আর আমার পিঠে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।
৪
মামার কথা মত সেদিন আমরা কাকার বাড়ী ফিরে গেলাম । মধুকাকা পরামর্শ মত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উচ্চ পদস্থ প্রাক্তন ছাত্রকে পুরো বিষয়টি সংক্ষেপে ফোনে বললেন । ঠিক আগামীকাল সকালে মন্দির প্রাঙ্গনে যাব । সকাল দশটায় জিপ এলো । দেরী না করে আমরা কাকার ছাত্রের জীপে টুক করে চেপে রওনা দিলাম ।
মন্দিরটি পুরনো হলেও স্থানীয়রা রক্ষণাবেক্ষণ করে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রেখেছে । মামা কাকার ছাত্র উজ্জ্বল রায়কে জিজ্ঞাসা করলেন, “ মন্দিরের পূর্ব দিকে আপনারা কী কোন মুখ পেয়েছিলেন গুহার ?”
“ হুম , বেশ কিছু বছর আগে একজন জমির ভিদ খোঁড়ার সময় বেড়িয়ে আসে গুহার আরেকটি মুখ আর আমাদের কাছে খবর আসা মাত্রই সেটি আমাদের জিম্মায় নিয়ে নেই ।”
এবারে মামা মধুকাকার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে ওঠে “ ব্যাস দাদা আপনার গবেষণার জন্য সন্ধান কমপ্লিট । এবার আপনার আর আপনার ছাত্রের আণ্ডারে বাকীটা ।”
“ কেমন করে ?”
“ শেষ দু’লাইন মনে করুন , ‘পূবের আঁধার জঠরে সে রয়’ অর্থাৎ ওই নতুন গুহার তলায় রয়েছে দেবীর তলোয়ার , যা ভবানী পাঠক দিয়েছিলেন দেবী চৌধুরানীকে ।”
পরের দিন আমরা বর্ধমান ফিরে এলাম । এবার মারপিট না থাকলেও থ্রিল কিন্তু কোন অংশে কম ছিল না । বাড়ী এসে মামা আমাকে উপহার হিসাবে দিলো প্রাচীন এক মুর্তি । “ এটা কেন , এটা তো তোমাকে দিয়েছেন কাকা ।”
“ হুম তা ঠিক এই মূর্তিটা কিন্তু তোরই পাওয়া উচিৎ । যত্ন করে রেখে দে।”
“ কী এটা ?”
“ এটা হল অনেক হাজার বছরের মূর্তি । দুর্গাপুর ব্যারেজ খননের সময় বেরিয়েছিল । তার কয়েকটি ওখানকার নিকটবর্তী এলাকা বিরভানপুরের মন্দিরে পুজো হয় । ও হ্যাঁ , ভবানী পাঠকের গুহার আরেকটি মুখ আছে বাঁকুড়ার দিকে । যা এখন ব্যারেজের জলের তলায় । ভাটার সময় অনেকেই দেখেছেন ।।”
ইতিমধ্যে দু-দুটো অভিযান চালিয়ে মামার থেকেও টুটুন কলেজ মহলে বেশ নামডাক করে ফেলেছে । মামা পূর্বের মতই ভাবলেশ । বললেই একটাই পুরনো কথা “ কাকতালীয় ।” তা সে যাইহোক টুটুন মহাখুশী । সেদিনই মামা ফিরেছেন রাঁচি থেকে টুটুনদের বর্ধমানের বাড়ী । কয়েকদিন পর টুটুন পুনা ফিরে যাবে , আবার কবে দেখা হয় তার জন্য বাড়ীতে হই রই ব্যাপার । মায়ের চোখে সন্তান সারাজীবন রোগা , তাই এটা খাও ওটা খেতে নেই লেগেই আছে । মামাকে পেয়ে টুটুনের বাঁচোয়া ।
রাতে খাওয়ার পর মামা ভাগ্নের সাথে আসর জমিয়েছে বিশ্বম্ভর বাবু আর টুটুনের মা । এ কথা সে কথার পর বিশ্বম্ভর বাবু শালাকে বলেই বসলেন “ বিশ আইল্যান্ডের সমস্যা তো মিটলো , তা এবার প্ল্যান কী ?” মামা হতবাক হয়ে বলল , “ প্ল্যান আবার পালানো , আমি বাবা আর ওসবের নেই । ধুর ছাতা যেখানেই যাই কিছু একটা ঘটবেই ...।” আরও কিছু কথা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তার আগেই বিশ্বম্ভর বাবুর মোবাইলটা সুর তুলে বেজে উঠল । কানে দিতেই অপার থেকে ভেসে এল কণ্ঠস্বর, “ হ্যালো... বিশু শালাবাবু আছে নাকি ?” বাবা পরিচিত গলার আওয়াজ শুনেই একগাল হেসে বললেন “ কী ব্যাপার হে , সবার খবর ছেড়ে শালার পিছনে... হুম দাঁড়াও দিই ।” স্পিকারে হাত চেপে বাবা অনুচ্চ গলায় বললেন মামাকে “ প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মধু চাটুজ্যে কথা বলতে চায় তোমার সাথে...”। মামা ফোনটা কানে গুঁজে বাইরের ঘড়ে গেল। ভিতরে নেটয়ার্ক সমস্যা । বেশ খানিকক্ষণ পর ফিরে এসে রবি ঠাকুরের কবিতার কয়েক অংশ হাসতে হাসতে বলল – “ দেখি নি একটি ঘাসের উপর একটি শিশির বিন্দু...।” আমরা তো অবাক ! হল কী ! মামার মুল কথা হল প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ একটি সমস্যায় পড়েছেন ।
“ কী ?” আমরা তিনজন প্রায় একসাথেই বলে উঠলাম ।
“ উনি বর্ধমানের কাছেই একটি জায়গার উপর গবেষণা বহুদিন করছেন । শেষে তাঁর সেই রথ এক ধাঁধাঁয় এসে তালগোল পাকিয়ে গেছে , তার জন্যই আলোচনা করতে চান ।” মনে মনে খুশী হলাম । আমার মুখ দেখে বলল “ উঁহু অত উৎসাহ ভাল না আর আমিও ইতিহাসবিদ নই ।” আমি জানি মামা সামান্য পত্র পত্রিকায় বিনি পয়সায় লেখে তবে মামার যা বুদ্ধি তাতে আগের কেসগুলোতেই পরিষ্কার ।
২
পরেরদিন সকালেই মধু কাকার বাড়ী পৌঁছে গেলাম । বর্ধমান থেকে মাত্র ৬০ কি.মি । স্থানটার নাম না হয় পরেই আসবে ঘটনাচক্রে । মধু কাকা আপ্যায়ন করে নানা ইতিহাস বলতে লাগ্লেন । আমি নিজেই জানতাম না বাড়ীর এত কাছেই এত বড় আধুনিক এই শহরটার বুকে জমে রয়েছে কত ইতিহাস আর ডাকাতের গল্প । এর মাঝে মধু কাকা টুক করে ভিতর ঘড়ে উঠে গেলেন । একটু পড়েই প্রায় আধখাওয়া প্রাচীন একটা পাণ্ডুলিপি নিয়ে ফিরলেন । উঁকি মেরে দেখলাম বর্ধমানের ইতিহাস । আমাদের শুনিয়ে কিছুটা পড়তে পড়তে এক জায়গায় থামলেন । মামাকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বললেন “ এই , এই জায়গাটা ঝামেলায় ফেলছে , দ্যাখো ।” মামার সাথে আমিও যা দেখলাম তা হল এরকম –
“ চৌধুরী রানী দুর্গার দেশে
পাঠক মায়ের শেষ আদেশে ,
রেখে যায় অন্তিম তরবারি –
গহ্বরের উত্তরে আছে মায়ের বাড়ী ,
পূবের আঁধার জঠরে সে রয় –
মা যায় , এনেছিল বিজয় ।”
মামা মধুকাকার পারমিশন নিয়ে মোবাইলে হেঁয়ালিটার ছবি তুলে নিতে বলল আমাকে । নিজেও বার কয়েক পড়ে উত্তর দিল , “ দাদা প্রথম দু’লাইন তো আপনার দৌলতে বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না কিন্তু...।” “ ঠিক বলেছ তবে আছেটা কোথায় এটাই বুঝতে পারছি না !” মামা হেসে ঘাড় নাড়িয়ে বলে ওঠে “ দাদা আমি তো ডিটেকটিভ নই তবুও আপনার সাহায্য করতে পারলে আমি নিজেকেও ধন্য মনে করব ।” এখানে আমার ভূমিকা প্রায় বোবা শ্রোতা আর দুজনের মুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ।
৩
রাতে কাকার বাড়ীতেই থাকার ব্যবস্থা । মামা মশগুল আমার মোবাইলের ওই লাইনগুলি নিয়ে । আমি আমার সাইডের লাইটল্যাম্প নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম । রাত কটা হবে জানি না , মামার ডাকে ধরফরিয়ে উঠে বসলাম । মামা বললে “ টুটুন নিরানব্বই শতাংশ উদ্ধার করা গেছে রে , এবার শুধু মধু’দার ইনফরমেশন পেলেই কাজ শেষ ।” মনে মনে নিরাশ হলাম । এবার কিছুই কী হবে না !!
সকাল হতেই মামা পড়ল কাকাকে নিয়ে । মাঝে একবার উঠে আমাকে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ার জন্য তাড়া লাগিয়ে গেল । এখন বেলা বারোটা । গ্রীষ্মের দাবদাহ কিছুটা মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে কমেছে । গাড়ীতে যেতে যেতে মামা আর মধুকাকার আলোচনায় উঠে এল দুর্গাপুরের ইতিহাস । দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গাপুরের আদি জনক , তাঁর নামেই এখানকার নাম । ভূগোলে প্রায় আঠারোটি দুর্গাপুরের নাম থাকলেও এখানকার প্রাচীন গুহা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে । “ দেবী চৌধুরানীর গুহা ”। কথা বলতে বলতে আমরা এসে পড়লাম সেখানে । বর্তমানে সেই ঈষৎ উঁচু টিলাটিকে কেন্দ্র করে পার্ক গড়ে উঠেছে । ভাবলাম গুহার মধ্যে নামা যাবে । হা হতস্মিন ! আজ থেকে প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে গুহার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নানা কারনে ।
মামা আমাকে বললে , “ টুটুন সেই ছড়াটার প্রথম দুটি লাইন মনে পড়ে ?” মাথা নাড়িয়ে “ হ্যাঁ ” বললাম । মামা জিজ্ঞাসা করে ভ্রূ নাচিয়ে , “ দুর্গার দেশে মানে কী দাঁড়াল , দুর্গাপুর , তাই তো ! আর চৌধুরী রানী ?” আমিও কম যাই না , চটপট জবাব দিলাম “ তোমাদের আলোচনাতে বুঝলাম ডাকাত দেবী চৌধুরানী , যিনি ডাকাতি করে গরীবদের সাহায্য করতেন । দুষ্টু জমিদার আর ব্রিটিশদের সাথেও লড়াই করেছিলেন...” আমার কথার মাঝেই মামার উদ্দেশ্যে মধুকাকা বলেন “ তোমার মতই দেখছি টুটুনের চমৎকার বুদ্ধি ।” বুঝলাম মামার বুক কয়েক ইঞ্চি বেড়ে গেছে ।
মধুকাকার কাছে একটু এগিয়ে মামা বলল “ আচ্ছা এই গুহাটার অপর কোন কী নাম আছে ?” “ ভবানী পাঠকের গুহা ” কাকা উত্তরটা দিয়েই হা হা করে হেসে উঠলেন আর বার বার মাথা নাড়িয়ে বলতে লাগলেন “ মিলছে মিলছে ।” তারপর নিজেই চিন্তা মিশ্রিত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন “ কিন্তু শালাবাবু পাঠক মা কোথায় রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন তলোয়ারটি ?” “ ওটাই লাখ টাকার প্রশ্ন দাদা ?” মামার গলাতেও চিন্তা । আমি মামার ভাগ্নে , বললাম , “ এই মা’টা মানে তো কালী-দুর্গা তাহলে তো মা এখানে ভবানী । সেটা হলে ওই গুহার উত্তর দিকে মায়ের বাড়ী । আচ্ছা মামা বঙ্কিম রচনাবলীতে পড়েছি ভবানী পাঠক কালী পুজা করতেন এটা কী সত্যি ?”
মামা আর মধুকাকা দু’জনেই আমার কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক । আমার দিকে তাকিয়ে সোল্লাসে লাফ দিয়ে কাকা বলেই ফেলল “ বাপ রে বাপ ! এত পুরো গোয়েন্দা যে শালাবাবু । হ্যাঁ আছে তো , অম্বুজার কাছেই প্রাচীন মন্দির ।” মামা ব্যাপারটা শুনে মিটিমিটি হাসছে আর আমার পিঠে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।
৪
মামার কথা মত সেদিন আমরা কাকার বাড়ী ফিরে গেলাম । মধুকাকা পরামর্শ মত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উচ্চ পদস্থ প্রাক্তন ছাত্রকে পুরো বিষয়টি সংক্ষেপে ফোনে বললেন । ঠিক আগামীকাল সকালে মন্দির প্রাঙ্গনে যাব । সকাল দশটায় জিপ এলো । দেরী না করে আমরা কাকার ছাত্রের জীপে টুক করে চেপে রওনা দিলাম ।
মন্দিরটি পুরনো হলেও স্থানীয়রা রক্ষণাবেক্ষণ করে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রেখেছে । মামা কাকার ছাত্র উজ্জ্বল রায়কে জিজ্ঞাসা করলেন, “ মন্দিরের পূর্ব দিকে আপনারা কী কোন মুখ পেয়েছিলেন গুহার ?”
“ হুম , বেশ কিছু বছর আগে একজন জমির ভিদ খোঁড়ার সময় বেড়িয়ে আসে গুহার আরেকটি মুখ আর আমাদের কাছে খবর আসা মাত্রই সেটি আমাদের জিম্মায় নিয়ে নেই ।”
এবারে মামা মধুকাকার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে ওঠে “ ব্যাস দাদা আপনার গবেষণার জন্য সন্ধান কমপ্লিট । এবার আপনার আর আপনার ছাত্রের আণ্ডারে বাকীটা ।”
“ কেমন করে ?”
“ শেষ দু’লাইন মনে করুন , ‘পূবের আঁধার জঠরে সে রয়’ অর্থাৎ ওই নতুন গুহার তলায় রয়েছে দেবীর তলোয়ার , যা ভবানী পাঠক দিয়েছিলেন দেবী চৌধুরানীকে ।”
পরের দিন আমরা বর্ধমান ফিরে এলাম । এবার মারপিট না থাকলেও থ্রিল কিন্তু কোন অংশে কম ছিল না । বাড়ী এসে মামা আমাকে উপহার হিসাবে দিলো প্রাচীন এক মুর্তি । “ এটা কেন , এটা তো তোমাকে দিয়েছেন কাকা ।”
“ হুম তা ঠিক এই মূর্তিটা কিন্তু তোরই পাওয়া উচিৎ । যত্ন করে রেখে দে।”
“ কী এটা ?”
“ এটা হল অনেক হাজার বছরের মূর্তি । দুর্গাপুর ব্যারেজ খননের সময় বেরিয়েছিল । তার কয়েকটি ওখানকার নিকটবর্তী এলাকা বিরভানপুরের মন্দিরে পুজো হয় । ও হ্যাঁ , ভবানী পাঠকের গুহার আরেকটি মুখ আছে বাঁকুড়ার দিকে । যা এখন ব্যারেজের জলের তলায় । ভাটার সময় অনেকেই দেখেছেন ।।”
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ন্যান্সি দেওয়ান ০৪/০৫/২০১৮Nice.
-
ন্যান্সি দেওয়ান ০৩/০৫/২০১৮Darun.
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ০৩/০৫/২০১৮দাদা,
অনেক ধন্যবাদ