www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নৃত্য-গীত-বাদ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশ

সঙ্গীত হচ্ছে যে গীত সংগত হচ্ছে, অর্থ্যাত বাদ্য-যন্ত্র সংগত করে যে সুর বা গান পরিবেশিত হচ্ছে। সম-গীত কেও সঙ্গীত বলা যায়। সঙ্গীত পরিবেশিত হবার আগে এর কিছু অধ্যায় পরিবর্তিত হতে হয়। সঙ্গীতের প্রথম অধ্যায় হচ্ছে গীত বা গানের কথা, তারপর সেই গীত সুরের বলয়ের মধ্যে অধিষ্টিত করা, তারপর সেই সুরারোপিত গান কে বিভিন্ন বাদ্য-যন্ত্রের অনুষংগ দ্বারা আবদ্ধ করা এবং শেষ পর্যায় হচ্ছে কন্ঠ শিল্পী এবং যন্ত্রী দ্বারা সেই সঙ্গীত পরিবেশন করা।
মানব জীবন প্রতি মুহূর্তে তার ভাব প্রকাশের জন্য প্রকৃতি এবং পরিবেশের কাছ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে এসেছে । সঙ্গীত যেহেতু বাদ্য-নৃত্য সহযোগে এক প্রকার বিশেষ ভাব প্রকাশের কলা-শৈলী তাই তার প্রতিটি ছত্রে প্রাকৃতিক স্পর্শ কোন না কোন ভাবে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে । সাহিত্যে-সঙ্গীতে তথা বিভিন্ন কবি লেখকের শিল্প চেতনায় তা ঋতু নানা ভাবে ধরা পরে । বাঙালীর মননে যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সদা বিরাজমান সেহেতু তাঁর প্রকৃতি ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করা হল ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋতু সৌন্দর্যের কবি। তাঁর ঋতু-সাহিত্যে যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, তা শুধু আকাশে-বাতাসে, মেঘে-বর্ষণে, ফুলে-পল্লবেই প্রকাশ পায় এমন নয়, সে বৈচিত্র্য মানুষের শৈশব-কৈশোর, যৌবন-বার্ধক্যেও সমান। ঋতুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ একদিকে দেখেছেন তার কঠোর রূপ, অন্যদিকে দেখেছেন রস-কোমলতা, সৃষ্টির স্নিগ্ধতা।
রবীন্দ্র সঙ্গীতে ও নৃত্যে কয়েকটি প্রকৃতি পর্যায়- সংক্ষিপ্ত আলোচনা
দারুণ গ্রীষ্মে একদিকে যেমন ‘প্রখর তপন তাপে, আকাশ তৃষায় কাঁপে, বায়ু করে হাহাকার’, তার পরেই সেখানে আসে চাঁপাফুলের ছোঁয়া, বকুলমালার গন্ধ। বৈশাখের রুদ্রতা ও কোমলতা দিয়ে তিনি কামনা করেছেন সমস্ত গ্লানি দূর করে পবিত্র ও নির্মল এক পৃথিবীর। রবীন্দ্রনাথের গানে প্রতিটি ঋতু যেন তাদের নিজ নিজ চিত্র, ধ্বনি, বর্ণ ও গন্ধ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। এ গানগুলো যেন বাংলার প্রকৃতির চিরকালের মর্মবাণী। তাঁর অন্যান্য গানের মতো প্রকৃতির গানেও তিনি বিশ্ববোধ ছড়িয়ে দিয়েছেন। ‘কুসুমে কুসুমে’ তিনি তাঁর অন্তরাত্মার ‘চরণচিহ্ন’ দেখেছেন, তাঁর আগমনে পৃথিবীর বুকে ‘আকুলতা ও চঞ্চলতা’ অনুভব করেছেন। ‘আকাশভরা সূর্য তারা’ এবং ‘বিশ্বভরা প্রাণের’ মাঝখানে ‘বিস্ময়ে’ নিজেকে আবিষ্কার করেছেন।প্রতিটি ঋতু একেকটি দার্শনিক তাত্পর্য নিয়ে রবীন্দ্রসংগীতে উপস্থাপিত হয়েছে। গ্রীষ্মের গানে দারুণ দাহনবেলার রসহীনতার চিত্র যেমন আঁকা হয়েছে, বৈশাখী ঝড়কে তেমনি জীর্ণতার অবসানে নতুনের আগমনের পূর্ব সংকেতরূপে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রভাবনায় বৈশাখী ঝড় কেবল বাইরের প্রকৃতিতেই আসে না, হৃদয়ের ভেতরেও সে ঝড় তোলে। গ্রীষ্মের মধ্যে তিনি একদিকে দেখেছেন এর কঠোর রূপ, বৈরাগীর বেশ, অন্যদিকে তার রস-কোমলতা ও সৃষ্টির স্নিগ্ধতায়ও মুগ্ধ হয়েছেন।গীতবিতানে গ্রীষ্মের গান ১৬টি, যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৬০ থেকে ৭২ বছর বয়সের মধ্যে রচনা করেছেন।
কবির প্রকৃতি প্রেমের সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বর্ষাকে ঘিরে। বাংলা ভাষায় বর্ষার আদি কবি কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যে বর্ষামাধুর্য, বিরহের অশ্র স্পর্শ এবং যে সজল কোমলতা বর্ণনা করেছেন, তার তুলনা মেলা ভার। এই মেঘদূতের প্রভাবেই ‘আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবসে’র বর্ণনা আজো বাংলার সাহিত্যাকাশ এবং মনোভূমিকে শ্যামল করে রেখেছে। বর্ষার মেঘে ঘনিয়ে আসা অন্ধকার, অবিরল বৃষ্টির একটানা সুর, বাইরের সব রূপ, সব শব্দকে যেন একটা গভীর যবনিকার আড়ালে আচ্ছন্ন করে রাখে। মন কেবলই ফিরে আসে অন্তর রাজ্যের কল্পলোকে। সেই কল্পলোকে বসে রবীন্দ্রনাথ যখন বর্ষার গান রচনা করেন, তখন মনে হয় শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, সেখানে তাঁর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছেন কালিদাস, জয়দেবসহ অন্যান্য আদি কবি, বিশেষত বৈষ্ণব কবিরা। রবীন্দ্রনাথের বর্ষামঙ্গল কবিতা বিশ্লেষণ করলেও এ রূপটি পরিষ্কার বোঝা যাবে। তবে এই ঐক্যতানে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠ কোথাও ঢাকা পড়েনি । এই শতেক যুগের কবিকণ্ঠ নিঃসৃত ঘনীভূত বর্ষাগীতরাশি অবশেষে সহস্র ধারায় বিগলিত হয়ে ধরা দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানে।

বর্ষা ঋতু তার বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্ভার নিয়ে প্রকৃতিকে যে রূপে সাজিয়ে তোলে তিনি চিরদিন সেই রূপের পূজারী। গুরু গুরু মেঘ, গমরী গমরী গরজে, গগনে গগনে যখন বর্ষার আগমনবার্তা জানিয়ে দেয় তখন কবি আনন্দ উদ্বেল চিত্তে তাঁর রচনা সম্ভারের নৈবেদ্য দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। বহু প্রত্যাশিত ‘সুরের তরীর’ আবির্ভাবে কবি হৃদয়ের পুলক বেদনা নিবিড়তর উচ্ছ¡াসে জেগে উঠে তাঁর সমস্ত চেতনাকে প্লাবিত করে দেয়। প্রকৃতির চিত্র চিত্রণে রবীন্দ্রনাথের সাথে কবি কালিদাসের সবচেয়ে বেশি মিল রয়েছে। উভয়েই প্রধানত বর্ষার কবি। কালিদাস বর্ষার আরম্ভকে বর্ণনা করেছেন রাজার আগমনের মতো। জল পূর্ণ মেঘ তার মত্তহস্তী, বিদ্যুৎ তার পতাকা, আর অশনি তার বাদ্যযন্ত্র। কালিদাসের চিত্ত মুগ্ধ হয়েছিল বর্ষার বাহ্য ঐশ্বর্যে এবং অপরূপ উদ্দাম শক্তিতে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে এই সমৃদ্ধি ও আকুলতা ছাড়াও আরো কিছু আছে যা তাঁর একান্ত নিজস্ব। বর্ষার রাজোচিত ঐশ্বর্য, তার অনির্দেশ্য উন্মাদনা, তার গীতিমুখরতা সব মিলে কবির কাছে পরিপূর্ণতার একটি মূর্তি গড়ে তুলেছে। তাই কবি এই ঋতুর মধ্যে শুধু প্রণয়ের আহ্বানই নয়, সুদূরের আগমনের বাঁশির সুরও শুনেছেন।

রোমান্টিকতা, বিরহ, মিলন জীবন-মরণ এবং সর্বোপরি ঈশ্বর প্রেমে আমরা ভাবনা বিহŸল হই তাঁর বর্ষার গানে। বর্ষার বৈচিত্র্যময় রূপে কবির মন কখনো মেতে উঠেছে, কখনো চিত্ত হয়েছে চঞ্চল, আবার কখনো বা শ্রাবণের বারিধারা, আষাঢ় মেঘের গর্জন ও অশান্ত পবনকে কবি অনুভব করেছেন বিরহ ক্রন্দন ও মিলনের আকুল আবেদনে, করেছেন শ্যামল সুন্দর বর্ষার জন্য তপস্যা-
‘এসো শ্যামল সুন্দর,

আনো তবে তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গ সুধা।

বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে।’

আবার বলেছেন :

‘বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো,

আউসের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,

কালি মাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহি রে।

ওগো, আজ তোরা যাস নে গো তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানে, প্রেমের বিচিত্র উপলব্ধি ঘন হয়ে আসে। অতীত স্মৃতির বেদনা, সীমাহীন নিঃসঙ্গতা, আর এক মানসকন্যার সাথে, অসম্ভব মিলনের বৃথা প্রত্যাশার ব্যাকুলতার, রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে সুরে এক অব্যক্ত বিরহের কান্না রণিত হতে থাকে। কল্পনায় যার আভাস মেলে তাকে আয়ত্তে না পেয়ে কবির বেদনা, মেঘলা আকাশের উতলা বাতাসে, ব্যাকুল বাদল সাঁঝে তার জন্যই অন্তহীন আকাক্সক্ষা অনুভব করা যায় তার বর্ষার গানে-
‘সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলোরব।

কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে

হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব-

আঁধারে মিশে গেছে আর সব।’

বাংলার মাটি, মানুষ, সংগ্রাম, স্বপ্ন, শপথ, বাস্তবতা, কোনোটাই কখনই বিস্মৃত নন রবীন্দ্রনাথ। তিনি প্রেয়সী বর্ষা, প্রেমিকা বর্ষার পাশাপাশি এর বিধ্বংসীরূপ বন্যাকে প্রতিরোধ চেতনায় আমাদের সাহসী করে তুলে বলেন, ‘বামে রাখ ভয়ংকরী, বন্যা-মরণ-ঢালা’। রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’র যে চিত্রকল্প তা বর্ষাদিনের বাংলাদেশ, তার ঘর-সংসার, মাঠ, গোয়াল, পাওয়া না পাওয়া, চাওয়া না চাওয়ার অনন্ত অব্যক্ত মাধুরী। বর্ষাকে মূর্ত বিহŸল করে তুলতে, কত চিত্রই না গানে গানে সুরে সুরে এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। একদিকে মিলন অভিসার, অন্যদিকে অনন্ত গভীর বিরহকে জানে বর্ষা কোনোখানে বেশি অনন্যা। না পাওয়ার বেদনা, আবার মিলনের মুহ‚র্তে হারানোর আশঙ্কা, প্রিয়তমের জন্য বিজন ঘরের কোণ, প্রদীপ খানি জ্বেলে, অপেক্ষার মধ্যে, সব সময় গভীর বিরহ ব্যথা আমরা রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানে অনুভব করি।

প্রকৃতির প্রতি মানুষের মনে যে সহজাত ভালোবাসা আছে সেই মজ্জাগত আকর্ষণকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ বোধ ও অনুভবের অতিসূ²তম লীলাকে পর্যন্ত তাঁর বর্ষার গানে ও কবিতায় রূপায়িত করে তুলেছেন অত্যন্ত সার্থকতার সাথে, যা প্রায়শই সীমাকে ছাড়িয়ে অসীমের দিকে হাত বাড়িয়েছে। চির প্রিয়তম জীবন দেবতার সাথে মিলিত হবার জন্য কবির গভীর আকুতি আমাদের সেই অনুভবেই বিলীন করে দেয়- ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধু হে আমার’। তার পরান সখা, সে তো অনন্ত মানুষেরই পরান সখা। তার অভিসারের স্বপ্নেই তো বারবার অন্তবিহীন পথ পেরিয়ে মরুতীর হতে সুধাশ্যামলিম পারে আসা-যাওয়া। আবার মায়াবিনী সন্ধ্যায় মিলনের বৃথা প্রত্যাসার ব্যাকুলতায় ভরা এক অব্যক্ত বিরহের চিত্র- যা রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ বর্ষার গানে পাওয়া যাবে।

ঋতু সঙ্গীতের মধ্যে বর্ষার গানই তিনি বেশি রচনা করেছেন। গীতবিতান অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান মোট ১১৫টি। জীবনের প্রথম ৪০ বছরে তিনি মাত্র ৭টি বর্ষার গান রচনা করেছেন, যার সবগুলোর রাগিণীই ছিল মল্লার বা মিশ্র মল্লার। ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়স অর্থাৎ পরবর্তী বিশ বছরে তিনি রচনা করেছেন আরো ১৭টি বর্ষার গান।
শীতের হাওয়ার নাচন থামতে না থামতে ঋতুরাজ এসে হানা দেয় ঘরে-মনে, অশান্ত মনকে জানান দেয়, বেঁচে আছো এখনও প্রেমে আর গানে। 'আওল ঋতুপতি রাজ বসন্ত,/ধাওল অলিকুল মধুকর গুঞ্জন।' প্রকৃতি, মানুষ আর বিশ্ব কবিগুরুর গানে এক নব অধ্যায়ের সৃষ্টি। বসন্ত ঋতু নিয়ে রচিত তার গানগুলো বসন্ত ঋতুর বিচিত্র রূপের বর্ণনা। তিনি লিখেছেন,
'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তবু অবগুণ্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।'
বসন্ত ঋতুকে আহ্বান জানিয়েছেন তার গানে। রচনা করেছেন গান, সুর দিয়েছেন বাণীতে। তিনি গেয়েছেন,
'আজ দখিন দুয়ার খোলা_
এসো হে, এসো হে, এসে হে আমার বসন্ত এসো '
সুরের ডালি সাজিয়ে বসন্ত আসে। সঙ্গীতের ছন্দে বসন্ত ঋতুকে বরণ করে নেয় সবাই গানে গানে। বীণার সুরে যেমন একটা মধুর অনুরণন তন্ত্রীতে টোকা দিলেই বেজে ওঠে। শীত ঋতুর পর বসন্ত ঋতুর আগমনেও সুরের বীণা বেজে ওঠে নতুন চঞ্চল ছন্দে। তখন কবিগুরু যেন গেয়ে ওঠেন,
'মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি
কোন নব চঞ্চল ছন্দে।
মম অন্তর কম্পিত আজি নিখিলের হৃদয়স্পন্দে '
মানব-হৃদয়ে বসন্তের ফাগুন হৃদস্পন্দন তোলে। পার্থিবের সঙ্গে অপার্থিবের যেন এক যোগসূত্র স্থাপিত হয়। প্রকৃতির নিরাভরণ রূপ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। নবপল্লব দল মানুষের মর্মরে চলচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বসন্তের এই রূপ চিরন্তন প্রতি বছরই আসে। বর্ষা শেষে সেই আগমনের তিরোধান। প্রকৃতি নিয়মের বন্ধন। কিন্তু তাই বলে হৃদয় তো আর উদাস থাকতে পারে না। বসন্তের ফাগুনের রঙে রঞ্জিত হয়ে প্রকৃতির দোরে দোরে ঘুরে বেড়ায়। আর খুশি আমেজের নিনাদ পেঁৗছে দেয় মানুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে। কবি তাই লিখেন,
'ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে_
ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে '
দখিনা সমীরণ মানুষের মনে সঙ্গীতের দোলা তোলে। সঙ্গীতের সেই সুরে মন হয়ে ওঠে পাগলপারা। বসন্ত মানুষের অন্তরে আনন্দের হিল্লোল বইয়ে দিয়ে যায়। যৌবনের প্রাণচাঞ্চল্য জীবনে আনে নতুন স্বাদ। প্রাণ ভরে ওঠে জীবন-জয়ের গানে। আবির্ভাব থাকলে যেমন তিরোধানও সময়ের জন্য প্রতীক্ষা করে। ফাগুনের নেশায় হৃদয় টালমাটাল হলেও তিরোধানের সঙ্গীতও যেন বলে যায়, 'এল আমার যাবার পালা।' বসন্তের ফুলের রূপবৈচিত্র্য এবং মানবমনে তার প্রভাব নিয়ে যেন রবিঠাকুর লিখলেন,
'বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা।
বইল প্রাণে দখিন-হাওয়া আগুন জ্বালা । '
গীতবিতান খুললে দেখা যায়, ৫০০ পাতা থেকে শুরু হয়ে ৫৪০ পাতা পর্যন্ত বসন্ত চলেছে তো চলেছেই৷ ‘প্রকৃতি’ পর্বে ১৮৮ নম্বর গান থেকে ২৮৩ নম্বর গান বসন্ত নিয়ে৷ মানে সংখ্যায় ৯৬৷
বসন্তের থেকে কবির কাছে বেশি গান নিংড়ে নেওয়ার কৃতিত্ব শুধু বর্ষার, সংখ্যাটা ১১৫৷ বাকি ঋতুদের কিন্ত্ত তুলনায় দুয়োরাণিই লেখা উচিত৷ গ্রীষ্ম (১৬), শরত্‍ (৩০), হেমন্ত (৫), শীত (১২)৷
রবীন্দ্র দর্শনে ও সংগীত-নৃত্যে ঋতু বর্ণাশ্রম
রবীন্দ্রনাথ ঋতুতে ঋতুতে যে ভেদ তা সনাতন হিন্দু ধর্মের চার বর্ণের মধ্যে ফেলে এর স্বরূপকে তুলনা করেছেন। তিনি গ্রীষ্মকে বলেছেন ব্রাহ্মণ। বর্ষাকে ক্ষত্রিয়। শীতকে বৈশ্য। হেমন্ত, শরৎ ও বসন্তকে তুলনা করেছেন শুদ্রের সঙ্গে।
• গ্রীষ্ম চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে বকুল ফুলে ফুলে কখন যে ভ্রমর আসে, বাতাসে সে কানাকানি। আকাশে কী গোপন বাণী এসে আছড়ে পড়ে বিরহ সাগরের কূলে। দাহনবেলায় ক্লান্ত কপোত তাপিত প্রাণে তৃষ্ণার জল খোঁজে। খালবিল নদী নালাও তৃষ্ণার্ত। প্রকৃতির ভেতর রস ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ফলে গিয়ে স্থিত হয়। বৈশাখী ঝড়ের বাতাসে থাকে ঠাণ্ডা ঝড়ো বৃষ্টির আগমনী বার্তা। প্রকৃতি বলে, ‘এসো শ্যামল সুন্দর আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।’ রবীন্দ্রনাথ গ্রীষ্মের বৈরাগ্য, বিতৃষ্ণা, অসহিষ্ণুতা, অনাসক্তি, অনাগ্রহ অগ্নি-স্বাদে তুলে ধরেছেন । গ্রীষ্মকে ব্রাহ্মণ বলা যেতে পারে।
• বর্ষা নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে। বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান, আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান। বর্ষাকে তাঁর অঙ্গে অঙ্গে চেনা যায়। একটানা বৃষ্টি হলেই রবীন্দ্র বর্ষার আষাঢ়-শ্রাবণের নস্টালজিক চিত্র যেন আমাদের মানসপটে আজও ভাসে। মনে হয় ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এলো আমার মনে।’ কিংবা ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো/দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।’ ইত্যাদি।
• শরৎ ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা’। রবীন্দ্রনাথ শরৎকে বলেছেন প্রাণধর্ম সম্পন্ন। শরতের মধ্যে শিশুর ভাব। তার হাসি-কান্নার মতো এই শরৎ। ঐ হাসি-কান্নার কার্যকারণের গভীর কোনো কারণ থাকে না। ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরির খেলা, কে যেন বিনা কারণে দূরে বাঁশি বাজায় ফলে কাশের গুচ্ছ মাথা নাড়ে, দোলে কারা যেন শেফালিমালা পরে শুভ্র মেঘের রথে চড়ে, শিশিরভেজা ঘাসে শিউলিফুলের গোলাপী রং যেন ভাতশালিকের পায়ের মতো, মেঠো ফুল মালতির বনে উঁকি দেয় মেঠো চাঁদ… ইত্যাদি।
• হেমন্ত বৈশ্যবৃত্তির অন্তর্ভূক্ত রবীন্দ্র তিন ঋতু— শরৎ-হেমন্ত-শীত। তাঁর মতে, সমাজের নিচের বড়ো ভিত্তি ঐ বৈশ্য। বর্ষা, শরৎ যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে আলোড়িত করেছে, মনে হয় হেমন্ত তেমনটা পারে নাই। প্রকৃতি পর্বে মাত্র ৪/৫টি গান আছে হেমন্তকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বর্ষার কবি, নজরুল বসন্ত, আর জীবনানন্দ দাশ হেমন্ত ঋতুর কবি। শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে। পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয় আয় আয়। প্রকৃতির মধ্যে গ্রীষ্ম থেকে হেমন্ত পর্যন্ত যত ময়লা, ক্লান্তি, জরা জমে তা শীতের শরীরে স্তূপ হতে থাকে। শীত ঐ পুঞ্জীভূত জরা নিজ কাঁধে নিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায়ে থাকে। জরা ধারণ করে শীত কিন্তু সে জরাক্রান্ত নয়। ভেতরে ভেতরে চলে নানা ভোগের আয়োজন। শরৎ ও হেমন্ত যতটা ত্যাগের শীত ততটাই ভোগের এবং কর্মময় ঋতু।
• শীত এই ঋতুকে শূদ্র বর্ণের মধ্যে ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথ। শীতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শরতে তাহা চোখ জুড়াইয়া নবীন বেশে দেখা দেয়, হেমন্ত তাহা মাঠ ভরিয়া প্রবীণ শোভায় পাকে, আর শীতে তাহা ঘর ভরিয়া পরিণতি রূপে সঞ্চিত। শীত শেষ হওয়ার আগেই আমলকী পাতা ঝরে, শিউলিঝরা শেষ, তারাময় রাত, দুর্বা ঘাসে ঘাসে শিশির-তাতে সূর্যালোক লেগে চোখ ধাঁধানো সুন্দর মুক্তার পরে দূর্বা নুয়ে থাকে, কুয়াশায় ঢেকে রাখে দূরে গ্রাম-জীবনবৃক্ষ-সারি ।
• বসন্ত বসন্ত যৌবনের ঋতু। ছয় ঋতুর মধ্যে মধ্যে বর্ষা, শীত ও বসন্তকে তাদের প্রাবল্যের তীক্ষ্ণতা ও বিশেষ বিশিষ্টতার জন্য একদম আলাদা করে চেনা যায়। শীতের জীর্ণবাস ফেলে নতুন সাজে সজ্জিত। আমের মঞ্জরি, দখিন বাতাস কোথা যায়, ঝুমকো লতার চিকন পাতা কাঁপছে কেন, পলাশ কানন ধৈর্য হারা কিশলয়, রঙের ঝড়ে কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে ।
নজরুল সঙ্গীতে প্রকৃতি- সংক্ষিপ্ত আলোচনা
নজরুল ইসলাম চৈত্র-বৈশাখ থেকে বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর গান রচনা করেছেন। নজরুল অত্যন্ত বড় প্রতিভা ছিলেন। ফলে বৈশাখী গান অথবা বৈশাখের আগমনী গানেও তিনি চমৎকারিত্ব আনতে সক্ষম হয়েছেন, ‘সরজে গম্ভীর গগনে কম্বু/ নাচিছে সুন্দর নাচে স্বয়ম্ভূ।’ এ গানটি উন্নত মানসম্পন্ন এবং সমকালে গানটি দিলীপ রায় এবং অতুল প্রসাদ সেনের প্রশংসা ধন্য হয়েছিল। ‘মেঘবিহীন খরবৈশাখে’, ‘কে দূরন্ত বাজাও ঝড়ের ব্যাকুল বাঁশরী।’ ওগো বৈশাখী ঝড় লয়ে যাও অবেলায় ঝরা এ মুকুল/ লয়ে যাও বিফল এ জীবনণ্ডএই পায়ে দলা ফুলণ্ডএ গানগুলোর কল্পনা, কথা ও সুরের গাঁথুনী অত্যন্ত চমৎকার।
এক সময় বাংলার লোকজীবনে বারমাস্যার প্রচলন ছিল, বারমাস্যায় লোককবিরা প্রোষিতভর্তৃকা নারীদের বারো মাসের বিরহ বেদনা তুলে ধরতেন। যেমন, চৈত্র গেল বৈশাখ গেল, গাছে ধরল আম/ স্বামী আমার কাছেতে নাই কারে খাওয়াইতাম। নজরুল ইসলাম বাংলার এই আঙ্গিকটি গ্রহণ করে চমৎকার কয়েকটি গান রচনা করেছিলেন। আমরা প্রথমে বলতে পারি, একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী গানটির কাথ। এ গানে ছয় ঋতুতে অথবা বিভিন্ন মাসে লোক বাংলার যে রূপ-বৈচিত্র্য আসে সেটি তুলে ধরেছেন। যেমন, ‘রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল/আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল/ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল লয়ে অশনি।’ নতুন বছরকে বরণ করতে গিয়ে আমরা প্রাকৃতিক রূপের বর্ণনা করব। নজরুল এ গানে বারমাসীর আঙ্গিকে বৈশাখ, বর্ষা, শরতে, অঘ্রাণে, শীতে, ফাল্গুনে বাংলার রূপবৈচিত্র্য তুলে ধরেছেন। বার মাস্যার আঙ্গিকে রচিত নজরুলের আরেকটি বিখ্যাত গান: তোরা চলিসলো সখী মাধবে মথুরায়/ কেমনে রাধার কাঁদিয়া বরষ যায়।’ মথুরায় চলে গেছেন কৃষ্ণ রাধাকে ছেড়ে। রাধা বিভিন্ন ঋতুতে তার মনের অবস্থা বর্ণনা করছেন, অবিকল বারমাস্যার নারীদের মতো। বরষায় অবিরল/ঝর ঝর ঝরে জল/ জুড়াইল জগতের নারী/ রাধার গলার মালা/ সখিরে হইল জ্বালা/তৃষ্ণা মিটিল না তারি।/ঃ জ্বালা তার জুড়াই না জলে গো/ শাওনের জলে তার মনের আগুন যেন দ্বিগুণ জ্বলেগো/ জ্বালা তার জুড়াইনা জলেগো। কৃষ্ণমেঘ গেছে চলে সখি, অকরুণ অশনি হানিয়া হিয়ায়। এখানে নজরুল রাধা কৃষ্ণ, বারমাস্যার ঐতিহ্য, কীর্তনের আঙ্গিক-ঐতিহ্য সবই ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সফলভাবে।
ঐতিহ্য সচেতন নজরুল বর্ষা ও বসন্তের গানে আরো অনেক কৌশল ব্যবহার করেছেন। বর্ষা-কেন্দ্রিক গানে নজরুল কালিদাসের মেঘদূত কেন্দ্রিক বিভিন্ন ইমেজ এবং রাধা-কৃষ্ণ কেন্দ্রিক কাজরী ও জুলনের আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন। যেমন, মেঘদূত-কেন্দ্রিক ইমেজসমূহ ১. যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে আমার বিরহলিপি লেখা কেয়া-পাতে। ২. পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে বলিও আমার পরদেশীরে। ৩. আজ শ্রাবণের লঘু মেঘের সাথে/ মন চলে মোর ভেসে/ রেবা নদীর বিজন তীরে মালবিকার দেশের। ৪. স্নিগ্ধশ্যাম বেনীবর্ণ এসো মালবিকা/ অর্জুন মঞ্জুরী কর্ণে গলে নীপ মালিকা। অন্যদিকে উত্তর ভারতের কাজুরী ও ঝুলনের ঐতিহ্যকে বাংলায় এনে রাধা কৃষ্ণকে নতুনরূপে উপস্থাপন করেছেন নজরুল। নজরুলের জনপ্রিয় কাজরী: শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলনা/কাজরীর কাজল মেঘ পথ পেল খুজিয়া/ সেকি ফেরার পথ পেল না মা পেল না। রাধা-কৃষ্ণ আসবেন এ বর্ষায়। তারা দোল খাবেন। তাদের জন্য ঝুলন বাঁধতে হবে। রাধাভাবে ভাবিত সখীরা তাই গাচ্ছেনণ্ডবাঁধলো বাঁধলো ঝুলনিয়া।/নামিল মেঘলা মোর বাদিরয়া/ চল তমাল তলে গাহি কাজরিয়া/ চললো গৌরী শ্যামলিয়া।
বসন্ত কেন্দ্রিক অনেক গান লিখেছেন নজরুল। বর্ষার গানের মতো বসন্তের গানেও প্রকৃতির সঙ্গে নর-নারীর মনের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এবং সে সঙ্গে মিশিয়েছেন বাংলা তথা ভারতীয় ঐতিহ্যকে। আসে বসন্ত ফুলবনে/ সাজে বনভূমি সুন্দরীণ্ডএ গানে মূলত প্রকৃতির বর্ণনা করেছেনণ্ডতবে পারসনিফিকেশনও করেছেন যথেষ্ট। কিন্তু ঐতিহ্য সচেতন কবি-ঐতিহ্যের ব্যবহার করবেনই-প্রকৃতির রূপ-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনের অবস্থার যে পরিবর্তন হয়-তাও তুলে ধরবেন। যেমন, ব্রজগোপী খেলে হোরী সানো নজরুল কি যেন কিছু করেছেন। এ গানে প্রকৃতির বর্ণনা আছেণ্ড বলেছেন, হরিত্র কুঞ্জ, পুঞ্জে পুঞ্জে হোরি অশোক ফোটার কথা। অন্যদিকে বলেছেন, ব্রঞ্জের গোপীবৃন্দের খেলার কথা। হোলী উপলক্ষে হোরি খেলছে সবেণ্ডরাধাভাবে ভাবিত সখীবৃন্দ এবং কল্পনার রাধা-কৃষ্ণ। তাদের মনের অবস্থা/ গোপিনীরা হানে সপাঙ্গ খরসার ভ্রুকুটি ভঙ্গ/ অনঙ্গ আবেসে জর জর থর থর শ্যামের অঙ্গ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সঙ্গীত যেহেতু ত্রি-ধারার সমাবেশ তাই বিভিন্ন সময়ে শিল্পীরা গীতকে অবলম্বন করে নৃত্যের সূচনা করেছেন । রবীন্দ্র-নজরুল প্রকৃতি কেন্দ্রিক যে সকল গান রচনা করেছেন তার মধ্যে অনেক সঙ্গীতকে কেন্দ্র করে নৃত্যেরও সৃষ্টি হয়েছে ।

নৃত্যনাট্যে ঋতু- সংক্ষিপ্ত আলোচনা
চিন্তাধারা রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ সম্পর্কিত যে চিন্তা ধারার প্রকাশ ঘটেছে তার মূলে রয়েছে উপনিষদীয় দৃষ্টিভঙ্গি, “বসুধৈব কুটুম্বকম” অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব একই পরিবার ভূক্ত। রবীন্দ্রনাথের মতে প্রকৃতি ও মানব জীবন একই অখণ্ড সত্তার অঙ্গীভূত। তাই তাঁর অন্যান্য নৃত্য ভাবনায় সঙ্গীতের সাথে যেমন একাত্ম হয়েছে প্রকৃতি-পরিবেশ ঠিক তাঁর নৃত্যনাট্যেও প্রকৃতি সুন্দরভাবে মিশে গেছে । কয়েকটি নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে তা দেখানো হল অতি সংক্ষেপে ।
• চণ্ডালিকা
ফুলওয়ালির দল। নব বসন্তের দানের ডালি এনেছি তোদেরি দ্বারে,
আয় আয় আয়,
পরিবি গলার হারে।
লতার বাঁধন হারায়ে মাধবী মরিছে কেঁদে--
বেণীর বাঁধনে রাখিবি বেঁধে,
অলকদোলায় দুলাবি তারে,
আয় আয় আয়।
নৃত্যনাট্যটির সূচনাতেই কবি বসন্তের আবহাওয়া যেমন উল্লেখ করেছেন ঠিক সেইরকম ভাবে তা মানব বা নারীর অঙ্গ ভূষণ কিভাবে হতে পারে তার পরিকল্পনায় ফুটে উঠেছে ।
দইওয়ালা। দই চাই গো, দই চাই, দই চাই গো?
শ্যামলী আমার গাই,
তুলনা তাহার নাই।
কঙ্কনানদীর ধারে
ভোরবেলা নিয়ে যাই তারে—
অন্যদিকে শুধুমাত্র প্রকৃতির বিসয়ই নয় , প্রকৃতির সাথে জড়িত জীবকুলেরও বর্বণা দিয়েছেন উক্ত নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে।
• চিত্রাঙ্গদা
গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে পর্বতশিখরে,
অরণ্যে তমশ্ছায়া।
মুখর নির্ঝরকলকল্লোলে
ব্যাধের চরণধ্বনি শুনিতে না পায় ভীরু
হরিণদম্পতি।
লক্ষ্য করা যায় নৃত্যনাট্যে চিত্রাঙ্গদার শিকারের আয়োজনকেও কবি প্রকৃতির সাথে অসামান্য ভাবে চিত্রায়িত করেছেন ।
আবার চিত্রাঙ্গদার উদ্দীপনার কথা বর্ষার সাথে তুলনা করা হয়েছে –
ওরে ঝড় নেমে আয়, আয় রে আমার
শুকনো পাতার ডালে,
এই বরষায় নবশ্যামের
আগমনের কালে।
এছাড়াও এই নৃত্যনাট্যে বসন্ত ঋতুরও সফল প্রয়োগ দেখা যায় ।
• শ্যামা
ফাগুন যখন যাবে গো নিয়ে
ফুলের ডালা
কী দিয়ে তখন গাঁথিবে তোমার
বরণমালা।
বাজবে বাঁশি দূরের হাওয়ায়,
চোখের জলে শূন্যে চাওয়ায়
কাটবে প্রহর--
বাজবে বুকে বিদায়পথে চরণ-ফেলা দিনযামিনী,
হে গরবিনী॥
শ্যামা নৃত্যনাট্যকেও বাঙলার ফাল্গুন মাসের সাথে সখীরা তুলনা করেছেন জীবন সৌন্দর্যকে ।
বাদ্য যন্ত্রের উদ্ভবে প্রকৃতি- অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা
সঙ্গীতের আরেক ধারা হল বাদ্যযন্ত্র । বাদ্য কখন একাকী সাঙ্গেতিক ভাবে পরিবেশিত হয় , কখনো বা গীতের মাধ্যমে পরিবেশিত হয়ে থাকে । প্রসঙ্গত লক্ষ্য করা যায় যে বাদ্যের উদ্ভবও কিন্তু প্রকৃতির কাছ থেকে । প্রাকৃতিক পরিবেশের নানা সুরেলা শব্দকে মানুষ যন্ত্রের সাহাজ্যে ভাব প্রকাশের মাধ্যম করে তুলেছে ।
বাঁশির মধ্য দিয়ে সুললিত ধ্বনি তাও প্রকৃতির দান । অন্যদিকে মৃদঙ্গ সম্পর্কে পাই পৌরাণিক মতবাদ । সেটি হল - মৃদঙ্গের আবিষ্কর্তা হিসেবে ঋষি স্বাতির নাম পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, এক বৃষ্টির দিনে সরোবর থেকে জল আনার সময় সরোবরের জলে ছড়িয়ে থাকা পদ্মপাতায় বৃষ্টির ফোঁটার আওয়াজে মুগ্ধ হয়ে সেই শব্দকে বাদ্যে ধরে রাখার চেষ্টায় স্বাতি মৃদঙ্গের উদ্ভব করেন ।
আবার অন্যদিকে তবলার জন্ম সম্বন্ধে নানা মতবাদ আছে। একটি হল আমীর খস্রু সম্বন্ধে। মৃদঙ্গ জাতীয় কোন দুইদিক চামড়ায় ছাওয়া যন্ত্র ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়, কিন্ত তার পরেও তা থেকে সুন্দর অওয়াজ বের হয়। শুনে মুগ্ধ খস্রু বলেন "তব ভি বোলা" । অর্থাৎ শব্দ উৎপত্তিগত দিক দিয়ে মৃদঙ্গের অনুরূপ ।
জলতরঙ্গ একটি বাদ্যযন্ত্র যার নামের মধ্যেই প্রকৃতির সন্ধান রয়েছে । ঝর্নার জলের মূর্ছনাকেই মানুষ বাদ্যের রূপ দান করেছে ।

এইভাবে তানপুরা , সারেঙ্গী সহ বিভিন্ন যন্ত্রের উদ্ভব , বিকাশে প্রকৃতির উপাদান ও অনুপ্রেরণা সুন্দর ভাবে রয়েছে ॥
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১৬১৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০২/০৫/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast