ভেম্পু গুম্ফায় চিত্রের খোঁজে মামা আর টুটুন
অঙ্কন : পবিত্র চক্রবর্তী
১
সেবার হোস্টেল থেকে ফেরার পথে মনে হচ্ছিল যে আমি বাসে না নৌকায় চেপে ফিরছি । যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি । বিশাল বিশাল নদী যেন আমাদের ঘাড়ে এসে, গিলে খেতে চাইছে। হুম, টি-ভি, এফ বি মানে ফেসবুকে , অ্যাপে নানা জায়গায় ভিডিও দেখেছি ঠিকই কিন্তু এমন অবস্থায় নিজে ইতিপূর্বে পরি নি ! আমার কি হবে...এ দেখে মামা আসবে কি!! এ যে নিদারুণ বন্যা...হায় হায় এ কি !! নানা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক দিতে লাগলো। অনেক দিন পর পুজোর ছুটিতে বাড়ি ফিরছি।
গ্রাম এখন আর সেই আগের মত নেই, অনেক উন্নত। আর আমি শহরেই জন্মিয়েছি, শহরেই কিছুদূর পড়ে সোজা বাইরে, আমি যাতে ভালো মানুষ হই তার জন্য হোস্টেলে পাঠিয়েছে। বাসে বসে বসে বেশ মজাই লাগছিল। যেখানে যেখানে বৃষ্টি থেমেছে, জল উপচে পরছে সেখানেই ছেলে – বুড়ো সব্বার হাতে একটা করে ছিপ, মশারির ছেঁড়া অংশ, মাছ ধরছে আর হাতে ঝোলানো ডিব্বায় টুক টুক করে পুড়ছে। অবশ্য ছোট ছোট মাছ। আবার কোথাও বড় পুকুরকে বিশাল বিশাল জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। বেশ দেখা যাচ্ছে, মাছ গুলো বেরোতে না পেরে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে। চারিদিক সবুজ। কোথাও কোথাও আবার খেজুর গাছগুলো যেন গলা জলে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দেখতে দেখতে কখন যে বর্ধমানে পৌঁছালাম খেয়াল করি নি। ঘড়িতে চোখ ফেলতেই দেখি বেলা ১২ টা, কিন্তু এত মেঘ থাকার জন্য মনে হচ্ছে এই তো সবে সকাল হল। বাস যদিও বর্ধমান শহরে ঢোকে না, বাইপাসের উপর প্যাসেঞ্জার থাকলে তবেই দাঁড়ায়। বাইপাস থেকে আমাদের বাড়ি যেতে হলে সাইকেল রিক্সা ছাড়া গতি নেই। ভর দুপুরে হঠাৎ আমাকে দেখে মা বুঝতে পারলেন না কি বলবেন! বাবা এখন অফিসে, আসতে দেরী আছে। মা মুখ খুলতে যাবেন তার আগেই একটু অভিমানী সুরে বললাম, “ না গো বাবা, কোন ঝামেলা করি নি। পরীক্ষা শেষ, প্রিন্সিপাল স্যারকে বুঝিয়ে চলে এলাম”।
জামা কাপড় ছেড়ে সটান স্নান করে আসতেই মা বললেন, “ টুটুন, খেতে দিয়েছি, খেয়ে যা ইচ্ছা করো”। মায়ের গলায় যেন কি একটা সন্দেহের কাঁটা বিঁধে আছে। অবশ্য এর কারন, আমি খুব একটা ভালো তো নই। দুবার মারপিট করার জন্য সাসপেন্ড হয়েছি। কি করি বলুন আমার কথা কেও বুঝতেই চায় না! ক্লাসের পড়ার ফাঁকে আমার চোখ চলে যায় বাইরে। মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে খুচ খুচ করে টাইম পেলেই ছবি তুলি। যাইহোক, আমি লক্ষী ছেলের মতো খেতে খেতে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ মা, মামা এবার কবে আসছে?”
“ আসবে তিন চার দিনের মধ্যেই”- গম্ভীর গলায় মা বলে রান্নাঘরে ঢুকলেন। মা এর এই হচ্ছে সমস্যা। আমি আসলেও চিন্তা আর দেরী করে আসলেও গভীর চিন্তা, মা’দের এটা চিরকালীন প্রথা। বাবার সাথে আমার বেশী বন্ধুত্ব, মায়ের ভাষায় ‘আদিখ্যেতা’। মা যতই গজ গজ করুক আমি আসলে রান্নার হাতটাও খুলে যায়। খেয়ে পেটটা জয়ঢাক করে নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে মামার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল বাবার আলতো ডাকে, “ টুটুন, বাবু ওঠ! সন্ধ্যে বেলায় ঘুমাতে নেই”। চোখ খুলেই দেখি বাবার মিষ্টি হাসি মুখ, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
“বাপী, দেখো না মা কেমন মুখটা গোমড়া করে আছে”- আমি কথাটা বলে উঠতেই মা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, “ কি করব বল! তোমার যা কাজকম্ম, কোনদিন কি সুস্থ ভাবে এসেছ ? এবার হাত পা সব গোটা আছে দেখে অবাক হচ্ছি”।
বাবার চোখের ইশারাতে চুপ করে থাকলাম। বাবা বড্ড শান্তিপ্রিয় মানুষ। আড়াল থেকে ইঙ্গিতে বললেন, “ চুপ, এখন কড়াইতে তেল ফুটছে, ঠাণ্ডা হলে কথা...”।
মা ঘড় থেকে বেড়িয়ে যেতেই বা্বা বললেন, “ টুটুন, মামা তো পড়শু আসছেন, কোন প্ল্যান...”। বাবার কথাতে মাথায় এলো, মামা আসলে আমাদের বাড়িতে খুব জোড় একদিন থাকেন, তারপর নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন। আমার মামার এই বাতিক নাকি ছোট থেকেই। চাকরি- বাকরি করেছেন, তবে তা ছেড়েওছেন নিজের মর্জিতে। কিছু টাকা জমলেই বেড়িয়ে পড়েন নানা জায়গায়। বিয়ে করেন নি। একটাই ব্যাগ, পায়ে চটি , টি- শার্ট আর হাফ প্যান্ট। অবশ্য এ রকম মামার সংখ্যা বা তাদের মুখ দিয়ে শোনা গল্প সারা বাংলায় খুব একটা কম নেই। একটাই পার্থক্য আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মত , প্রাণখোলা হাসি শুধু আমার সাথেই মামার । আর নানা মজার মজার গল্প। হুম কিছু কিছু পারসন্যাল কথাও হাল্কা স্বরে হয় বৈ কি।
“বুঝলে বাপী, এবার মামাকে ধরবো। ধূর এবার কোথাও ঘুড়ে আসব। প্রতিবার মামা নিয়ে যাবো বলে নিজেই টুক করে বেড়িয়ে পড়ে। আর বেরোয় তখনই, যখন আমি ঘুমাই। এবার সেটা আর হচ্ছে না”, উত্তেজিত হয়ে বললাম।
মা আর বাপী মুখ খোলার আগেই আবার বললাম, “ প্লিজ, ঘড় শত্রু বিভীষণ হয়ে সব কথা মামাকে আগেই ফাঁস করে দিও না”।
রাতে ঘুমটা অল্পতেই চলে এলো। আজ মন ফেসবুকে নেই। বুকটা শুধু যেন বলছে কখন আসবে সেই সময়।
২
“ বুঝলি রুপা মালাইকারিটা জব্বর হয়েছে, আর দে তো কটা ভাত”, মুখের মধ্যে হাফ চিংড়ী ঢুকিয়ে মামা চোখ বন্ধ করে খেতে খেতে মাকে বলল।
বাউন্ডুলে এই মামার প্রতি মা রেগে থাকেন ঠিকই কিন্তু চোখের সামনে আসলে সেই রাগ যে কোন দরজা দিয়ে পালায় তা ভগাই জানে। মা অপত্য স্নেহে তার এই দাদাটিকে ভাত দিয়ে নরম গলায় বললেন , “ তা এবার কোথা থেকে আসা হচ্ছে শুনি!”
মামা একগাল হেঁসে আমার দিকে চোখ নাচিয়ে বলে, “ টুটুন বেড়াল দেখেছিস!” আমি তো উত্তর শুনে হতবাক।
“আরে অবাক হস না, তোর মা ঠিক ওই বিড়ালগুলোর মত; ঠিক টুক টুক করে আমাদের গপ্প লুকিয়ে লুকিয়ে শোনে”। ব্যাস আর যায় কোথা, দাদা আর বোনের মধ্যে লাগলো বিশ্ব যুদ্ধ। ফাঁক বুঝে আমি কেটে পড়লাম।
দুপুরে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে প্রকান্ড একটা হাঁই তুলে মামা জড়ানো গলায় বলল , “ টুটুন, মায়ানমারের নাম তো শুনেছিস। বাংলাদেশের সুদূর দক্ষিণে, বর্ডার অঞ্চল”।
মামার কোল ঘেঁষে পাশ ফিরে বললাম, “ এবার বল”।
“কি বলব?” অবাক হয়ে মামা দাঁত খোঁচানো থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। বুঝলাম, মামার এটা হচ্ছে পলিসি। তাই আমিও চুপ করে থাকলাম।
“ নাফ নদী বাংলাদেশ আর মায়ানমারের মাঝ দিয়ে বয়ে যায়। নদীর পূর্বে মায়ানমার আর পশ্চিমে আমাদের বাংলাদেশ। উঁহু টুটুন, গুগুল ঘাটলেই কি সব জানা যায়? হুম কিছু তথ্য জানতে পারবি ঠিকই কিন্তু মজা পাওয়া যাবে না”, মামা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল। হাত থেকে মোবাইলটা সরিয়ে রেখে বললাম , “তা তুমি বল”।
“জায়গাটার নাম ‘তেকনাফ’, বণ্য প্রানী আছে, আছে নানা পাহাড়ী প্রজাতির পাখি। অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য। নদীর বালির চর ধরে যত এগিয়ে যাই ততই প্রকৃতি অসামান্য রুপ নেয়। চারিদিকে পাহাড়- কুল কুল করে বয়ে যায় নাফ নদী। যে দিকে তাকাও সবুজ আর সবুজ”। কিছুটা থেমে নিজের মনেই মামা বলল, “ ভাগ্যিস আব্দুল ভাই নিয়ে গেছিল, না হলে এসব দৃশ্য দেখতেই পারতাম না”।
মা যে কখন বেগুনি আর চা নিয়ে হাজির হয়েছে খেয়ালই করি নি। আসলে মা তার এই একমাত্র দাদাটিকে অসম্ভব ভালোবাসেন। দেশ ভাগ যে কি যন্ত্রণার কতটা বেদনার তা আমিও ছোটবেলায় দিদার মুখে শুনেছি। বাংলাদেশ যে কতটা সমৃদ্ধ তার রেশ দিদার স্বরে ঝরে পড়তো। শস্য – শ্যামলিমায় ভরা বাংলাদেশ।
সন্ধ্যেবেলার একটু আগেই আজ বাবা চলে এসেছেন তার একমাত্র শ্যালকের জন্য, হাতে ইয়া একটা রসগোল্লার হাঁড়ি আর দোকান থেকে কাটিয়ে আনা খাস পদ্মার ইলিশ।
আমাদের বাড়িতে রাত ৯টার মধ্যেই ডিনার হয়। মামার ভ্রমণের গল্প শুনতে বেশ ভালই লাগে কিন্তু আমার মন আজ পরে আছে অন্য দিকে। “বাবুন, বাংলাদেশ তো ঘুরলে, তা এবার কোন দিকে?”বাবা মামাকে প্রশ্ন ছোঁড়েন। আমার মুখ হাল্কা হাসিতে ভরে উঠল । বাবা ঠিক আমার মনের অবস্থা ধরেছেন।
“এখনও কিছু ঠিক করিনি জাম্ব”, মামা খাওয়া থামিয়ে বাবাকে বলে। মামা বাবাকে জাম্ব বলেন সর্টে । তারপর আমার দিকে তাকাতেই আমি কথা ঘুড়িয়ে বললাম, “ মামা, আমার এক বন্ধু বলছিল যে , বাংলাদেশে নাকি জ্যান্ত ইলিশ কিনতে পাওয়া যায়?”
আমার কথায় বাবা, মা, মামা সব আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠল। আমি থম মেরে যাওয়াতে মামা খোঁচা মেরে বলল, “ কেন তোর গুগুল কি বলে! দ্যাখ টুটুন ইলিশ জ্যান্তই থাকে, তবে ওদের ডাঙায় ওঠালেই মরে যায়”।
আমি বড় বড় চোখ করে ভারী গলায় বললাম , “তাহলে আমার ফ্রেন্ড কি ভুল বলেছে? ও খোদ বাংলাদেশের”।
“হুম কোন কোন জায়গায় অবশ্য পাওয়া যায়, ধর, কুমিল্লা, চাঁদপুর এইসব অঞ্চলে। জেলেরা নদী থেকে মাছ আনেন, তখন হয়ত তোর ফ্রেন্ড দেখতে পারে। আর মজা কি বলত, ওইসব জায়গায় মাছ কিন্তু কেজি তে বিক্রি হয় না”।
“তবে !”- বিস্ময়ে বললাম।
মামার বদলে বাবা বলে উঠলেন, “ ওখানে ‘ঠিকা’ হিসাবে বেচে”।
আমাদের মৎস পর্ব সবে শেষ হয়েছে মায়ের তাড়ায়। বাবা এর ফাঁকে টুক করে মামাকে বলেন, “ বলছিলাম কি টুটুনের পরীক্ষাও শেষ যদি...”।
বাবার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, “ মামা খুব ঘুম পাচ্ছে , চল শুতে চলো”। আমার অভিসন্ধি বাবা বুঝে গিয়ে চুপ করে হাসতে লাগলেন।
মামা আসলে আমি আর মামা একসাথেই শুই। এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। শুয়ে আছে মামা, কাল চলে যাবে। এখনও আমার মনের কথা বলি নি। কিন্তু এবার নো ছাড়, মনে মনে জেদ করে নিয়েছি। মামাকে আদর করে গলা জড়িয়ে আব্দারের সুরে বললাম, “ মামা, এবার আমাকে নিয়ে কোথাও চল বেড়াতে”।
“ মানে!” মামা যেন কারেন্ট খেল আমার কথা শুনে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “ টুটুন, আমি জানি তুই বড় হয়েছিস, কিন্তু তুই তো জানিস আমি একা মানুষ, নিজেরই কিছু ঠিক থাকে না”।
‘আমি কিছুই জানি না। এবার নিয়ে যেতেই হবে। তোমার সাথে গেলে কত কি জানতে, দেখতে, শিখতে পারবো। তারপর হোস্টেলের ফ্রেন্ডদের মজা করে শোনাব”।
“ও কে – কাল সকালে এ নিয়ে কথা বলব”, মামা কথা না বাড়িয়ে ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে নাক ডাকাতে শুরু করে দিল। নাক আজ যত ইচ্ছা ডাকুক, আমি আজ একদম ডিস্টার্ব করব না, সব সহ্য করব। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। এই নীতি নিয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম।
৩
আমাদের রাত ১১-৪৪ মিনিটে দার্জিলিং মেল। বর্ধমানে ঢুকতে ঢুকতে ১২ টা হয়ে যায়। শিয়ালদা থেকে মেনলাইন ধরে বর্ধমান ষ্টেশনে আসে। বহু কষ্টে আমার জন্য একটা টিকিট বাবা জোগাড় করেছেন। মামার তো আগেই রিজার্ভ করা ছিলই। যদিও আমার আর মামার একই বার্থে হল না, কিন্তু নো প্রবলেম, যাওয়া তো হচ্ছে। এ আনন্দ বর্ণনা করা যায় না। মা মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন, বাবা আর মামা আমার পুরো সঙ্গ দেওয়াতে আপত্তি আর ধোপে টেকেনি। যেহেতু রাতে ট্রেন সুতরাং রাতে ঘড় থেকে খেয়েই বেরলাম। আমাদের বাড়ি থেকে ষ্টেশন বেশী দূরে নয়। যথারীতি ট্রেন আসলো, মা তার উপদেশাবলী সব মায়েদের মতই দিলেন ।
রাতের অন্ধকার ভেদ করে দার্জিলিং মেল ছুটল নিউ জলপাইগুড়ির দিকে। মাঝ রাত, চারিদিক কাঁপিয়ে দুরন্ত বেগে ট্রেন ছুটে চলেছে। জানলা দিয়ে মুখ বার করে দেখলাম, কামরার হাল্কা আলো পাশে পাশে দৌড়াচ্ছে পাল্লা দিয়ে।
বেশ দেরি করেই ঘুম ভাঙল। মামা বলল, “ ব্রেকফাস্ট কিছু খেয়ে নে, আর এত বেলা করে উঠলে চলবে না। আমার সাথে থাকতে গেলে ঘুমটা একটু কমাতে হবে”।
আমি কল দেওয়া পুতুলের মত মাথাটা এদিকে ওদিকে দুলিয়ে সম্মতি জানালাম। একটু লেট করেছিল, তাই নির্ধারিত সময় থেকে ৩০ মিনিট দেরীতে ষ্টেশনে ঢুকল। মামা জিনিসপত্র নামাতে নামাতে বলল, “টুটুন বাবু এই বার শুরু হবে আমাদের জার্নি”।
ষ্টেশনের বাইরে দুপুর হলেও হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আমরা চটপট বাইরে একটা হোটেল থেকে মাছ-ভাত খেয়ে নিলাম। যদিও আমার খাওয়ার ইচ্ছা একদমই ছিল না। এটা হোটেল! মামা আমার মনের কথা বুঝেই গলা ঝেড়ে হেসে বলল, “এটাই দারুন হোটেল রে, ওঃ ডালটা দেখ কি চমৎকার”।
আশে পাশে দোকান থেকে শুকনো কিছু খাওয়ার কিনে ট্রেকার রিজার্ভ করলাম। এখন আমাদের যেতে হবে লাটাগুড়ি হয়ে চাপড়ামারি ফরেস্টে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে প্রথমে আরও উত্তরে লাটাগুড়ি যাবো সেখান থেকে একটু বাঁ দিক ৩০ কিলমিটার ঘেঁষে ৩১-সি জাতীয় সড়ক ধরে গেলেই ৯৬০ হেক্টরের বিশাল অভয়ারণ্য।
মামা গাড়ীর গোঁ গোঁ আওয়াজের সাথে পাল্লা দিয়েই জায়গাটার ইতিহাস বলতে শুরু করলো কারন মামা বলে, যেখানে যাবি সেখানকার হিস্ট্রি একটু জেনে রাখা ভালো, “ টুটুন, এই হল চাপড়ামারি Wildlife sanctuary”। মামার গলায় উত্তেজনা ভরপুর। আমারও একই হাল।
একজায়গায় গাড়ী দাঁড় করানো হল, চা খাব। কিচ্ছুক্ষণ আগেই খেয়েছি, এখন খিদে খিদে লাগছে। ব্যাগ থেকে কেক বার করে মামাকে আর দাফা মানে আমাদের ট্রেকারের চালককে দিলাম। চারিদিকে অসম্ভব সবুজ। সুবিশাল গাছ। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।
দাফা ভালই বাংলা জানে, চা খেতে খেতে গাইডের মত করে বলল, “ বাবু, সরকার, মানে ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৫ তেই এই জঙ্গলকে National Reserve Forest হিসাবে আখ্যা দেয় ,পরে ১৯৯৮ তে ভারত National Wildlife sanctuary পরিনত করে”।
কাছাকাছি নদী বলতে – তিস্তা, নেওড়া আর মূর্তি। বর্ষার জলেই পুস্ট । আমরা যখন যাই তখন নদীগুলো টই টম্বুর। এবছর অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া এ অভয়ারণ্য মনসুন থাকার জন্য জুন থেকে সেপ্টেম্বর অব্ধি পুরো বন্ধ থাকে। মাঝের এই আটটা মাস খোলা। কপালে থাকলে এই সময় নানা জন্তু- জানোয়ার দেখা যায়। এই অঞ্চলে যেটা বেশী দেখা যায় তা হল হাতি। পেপারে মাঝে মধ্যেই এখানকার কথা আসে, ট্রেনে কাটা পরে হাতির মৃত্যু। জঙ্গলের মাঝ বরাবর রেল লাইন চলে গেছে, জঙ্গল পারাপার করতে আবার হাতিরা এই লাইন পার করে, ফলে বিপত্তি। তবে সরকার ব্যাবস্থা নিয়েছেন।
আমাদের গাড়ী আধাপাহারী, আধাকাঁচা কালচে লাল পথ পেরিয়ে একটা ব্রিটিশ আমলের বাংলোর সামনে ঘ্যাঁচ করে দাঁড়ালো। বিস্তৃত জঙ্গলের মাঝে সাদা আর লাল টালি টাইপের বাংলোটা সহজেই মন কেড়ে নেওয়ার মত । মামার কাছ থেকে জানতে পারলাম, মামা যেকোন ভাবেই হোক এখানকার ফরেস্ট অফিসারের বাংলোটি জোগাড় করেছেন কয়েক দিনের জন্য। আর এই সব সরকারি বাংলো সহজে মেলে না। যাইহোক আমার প্রান কিছুটা ধড়ে এলো। আমাদের গাড়ী দেখে একজন হাফ শার্ট আর প্যান্ট পরা লোক হাত কচলাতে কচলাতে কাছে আসলে,মামা তার মাঝারি হাত ব্যাগ থেকে একটা কাগজ দেখানোর সাথে সাথেই লোকটির চওড়া মুখে এক গাল হাসি। বুঝলাম, কাগজটা হল এখানে থাকার পারমিশন লেটার। বেশ বেলা হয়ে গেছে। সূর্য ক্রমশ তার রঙ হারাচ্ছে। প্রকৃতির সব রঙ যেন খুব ধীর লয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে এই জঙ্গলের মাঝে ক্রমান্বয়ে। অঙ্কন : পবিত্র চক্রবর্তী
হাত ঘড়ি দেখে মামা হাঁক ছাড়ল, “ বাবা বেচুং , ঘড়ের লাইট যে টিম টিম করছে, যাইহোক,খেতে দিতে কি দেরী আছে ?”
বেচুং - এর মুখে একটা কোমল হাসি, ডালু সম্প্রদায়ের লোক, খাটো মজবুত পা। একসময় এরা পাহাড়ি এলাকায় চাষ আবাদ করতো, কিন্তু সময়ের তালে তাদের জীবিকারও পরিবর্তন হয়েছে। কিছুটা দুর পড়াশুনাও করেছে। জঙ্গলের এই বাংলোয় বেশ কিছু বছর কাজ করার ফলে এখানকার রাস্তাঘাটও প্রায় মুখুস্থ। মন দিয়ে আমি আর মামা হাল্কা আলোয় রুটি আর ডাল সিদ্ধ খেতে খেতে শুনছিলাম। পাহাড়ের সব জায়গায় এখনও ইলেক্ট্রিসিটি পুরপুরি আসে নি। সাড়ে সাতটা বাজতেই অন্ধকার হয়ে যায়, আবার আসে পরেরদিন সকালে। ভাগ্য ভালো সরকারি ঘড়ে আছি। পাশাপাশি দুটো খাটকে জুড়ে দিয়ে মনগড়া পালঙ্ক করে নিলাম।
লাইট অফ আর করতে হল না, নিজের থেকেই তিনবার ব্রেক ড্যান্স দেখিয়ে বাল্বটি নিদ্রা দিতে চলে গেলেন। সে তো ঘুমাতে গেলেন, মামার নাকের সুখকর আওয়াজ নির্জনতাকে বাড়ালেও আমার আর ঘুম আসে না।
“টুটুন, এই টুটুন”, মামার চাপা শব্দে ধড়মড়িয়ে উঠলাম।
অবাক হয়ে তাকাতেই চোখটা বন্ধ হয়ে গেল। কষ্ট করে খুললাম, দেখি মামা টর্চ হাতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিস্ময়ে প্রশ্ন করতে যাবো কিন্তু মামা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল। ব্যপারটা কি জানার চেষ্টা করতেই মামা খোলা জানলার দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল। ভরা পূর্ণিমার আলোয় অন্ধকারে ডুবে থাকা গাছগুলোর মাথা চিকচিক করছে।
“চল বেরোই, আওয়াজ করিস না, বেচুং জানতে পারলেই বাগড়া দেবে”, মামার এহেন প্রস্তাবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েও উঠে পরলাম। জানি পাগল মামার সাথে থাকতে গেলে আমাকেও পাগলামি করতে হবে।
হাল্কা টর্চের আলোয় জঙ্গুলে পথ হাঁটছি। ভাগ্য ভালো ক্যাঁচ করে লোহার দরজা খোলার শব্দ বেচুং –এর কানে যায় নি। মামা যেন এ পথ কত জানে, এভাবে দিব্যি হাঁটছে। অবিশ্যি আমারও ক্রেডিট আছে, দুবার গর্তে পা পড়লেও সামলে নিলাম।
“তোমার উদ্দেশ্য কি বলতো, গোয়েন্দা গল্পের কোন অভিযান নাকি” – শীতের রাতেও ঘামটা মুছতে মুছতে জিজ্ঞাসা না করে আর থাকতে পারলাম না।
মামা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ খেপেছিস নাকি, আমি আবার গোয়েন্দা হতে যাবো কোন দুঃখে ! বেশ আলো করা রাত, ফাঁকা জঙ্গল, লোভ সামলাতে পারলাম না”।
যত শুনছি তত বিষম খাচ্ছি মনে মনে। কিছু করার নেই, তাছাড়া আমারও বেশ লাগছিল। মামার সাথে না থাকলে এ ধরনের অভিজ্ঞতা হবে না। এদিকে আমরা কতটা পথ এসেছি জানা নেই। ফিরব কি ভাবে তাও অজানা। শেষে এই জঙ্গলে হারিয়ে যাবো না তো! মনে হাজার কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। আর ঠিক এই সময়েই অসম্ভব তীক্ষ্ণ অথচ জোড়াল হাতির ডাক শোনা গেল। মামা সঙ্গে সঙ্গেই টর্চ নিভিয়ে পাশের ঝোপে আমাকে সজোরে টান দিয়ে ঢুকিয়েই খুব আস্তে আস্তে কানের কাছে মুখ নামিয়ে যা শোনাল তাতে আমার আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে পালানোর জন্য রেডি, “ ওরে, শুনেছিলাম পূর্ণিমার রাতে হাতির দঙ্গল বের হয়, ওটাই দেখানোর জন্য তোকে নিয়ে বেড়িয়েছি। এ সব অরিজিনাল , টি ভি তে তো সবাই দেখে”।
চাঁদের আলোয় দূরে বেশ কিছু সচল পাহাড় দেখছি, মনে হল বেশ কটা আছে, সঙ্গে কয়েকটি বাচ্চা।
নির্বিঘ্নে ডাল পালা মড় মড় করে ভেঙ্গে খাচ্ছে। সময় কত পেরল জানি না, দুজনেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। মশা যে কয়েক লিটার রক্ত খেল তার দিকেও হুঁশ নেই। হুঁশ ফিরল ফট করা হাল্কা অথচ গম্ভীর শব্দে। দূরে মনে হল একসাথে কয়েকটা গাছ ঝুপ ঝাপ করে পড়ে গেল।
৪
“পাংলাবসলোম ছাম উৎসবে ভিড় প্রতিবারই হয়। এবারেও যথারীতি হয়েছে, নানা জায়গার লোকের অন্ত নেই এই মনোরম মরশুমে। রাবাংলা থেকে সারচোগ ভেপুগ গুম্ফা অনেকেই...”, থেমে থেমে কি বেশ ভাবতে ভাবতে বলছিলেন মিঃ বিন্দ্রা - ইনস্পেক্টর ক্রাইম ব্রাঞ্চের। মাঝে মধ্যে চায়ে হাল্কা চুমুক।
সঙ্গে ফরেস্ট রেঞ্জার তথাগত রায় ভ্রূ কুঁচকে চোয়াল শক্ত করে হাতের আঙুল গুলো মটকাতে মটকাতে মুখটা তুলে বললেন, “ কি যে হচ্ছে বুঝতে পারছি না, রাবাংলার সারচোগ ভেপুগ গুম্ফা থেকে এত সিকিউরিটি থাকা স্বত্তেও উধাও হল কি করে”।
তথাগত রায়, বয়েস কম । অসম্ভব ভালোবাসেন জঙ্গল। ছোটবেলার ইচ্ছা পূরণ করে তিনি আজ ভালো পোস্টেই আছেন। ছটফটে। নতুন জয়েন করেছেন। আগে সুন্দরবনে পোস্টিং ছিলেন। সম্প্রতি কয়েক মাস হল এই এলাকায়। আজ বিশেষ আমন্ত্রনে মিঃ বিন্দ্রা তার অফিসে এসেছেন। আর সেই সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে গুম্ফার কথাটা ওঠে। যদিও অধিকাংশ লোকের কানে এখনও খবরটা চাউর হয় নি।
হঠাৎ চা খাওয়া বন্ধ করে মিঃ বিন্দ্রা ভাঙ্গাচোরা বাংলায় জানতে চাইলেন, “ মিঃ রায় কেউ ধরা পরল কি ? দেখুন এই সব জায়গা থেকে বর্ডার কিন্তু বেশী দূরে নয়। একবার বেরোলেই ব্যাস আমাদের হাত আপাতত ভাবে বাঁধা হয়ে যাবে”।
অফিসের ফোনটা বাজতেই হাত বাড়িয়ে তড়িঘড়ি ফোনের রিসিভার কানে তুলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তথাগত বললেন, “ হুম, কখন। ও. কে, ওনাদের থাকতে বল, আসছি”।
“ যাবেন নাকি মিঃ বিন্দ্রা ? বাংলোটা থেকে ঘুড়ে আসি। ক্লু হয়ত পেতে পারি”। হাল্কা হেসে বললেন তথাগত।
গাঢ় তুঁতে রঙের জিপটা বন-বাংলোর সামনে দাঁড়াতেই বেচুং দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলেই পেল্লাই একটা স্যালুট ঠুকল। বারান্দা থেকে লক্ষ করলাম বেচুং দুজন বেশ হাট্টাকাট্টা লোককে নিয়ে আমাদের দিকেই আসছে। মামা নিজের মনে কাল রাতে যেখানে ছোরে গিয়েছিল সেখানে ওষুধ লাগাতে লাগতে ফুঁ দিচ্ছে। কথাটা জানাতেই মামা বারান্দায় বেরিয়েই , “ আরে, বিন্দু যে” – বলেই বেশ লম্বা লোকটির দিকে এগিয়ে গেল। মিঃ বিন্দ্রাও হো হো করে হেসে মামাকে জড়িয়ে ধরলেন।
“তারপর তুই এখানে, আয় আয় । বেচুং, চার কাপ চা নিয়ে আয়, আর হ্যাঁ, একটাতে চিনি ছাড়া” – কথা গুলো বলেই মামা বিন্দ্রা সাহেবের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচিয়ে হাসল। ভাব এমন, দেখেছ ভায়া এখনও মনে আছে।
তথাগত রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন মিঃ বিন্দ্রা। তথাগত মানুষটিকে আমার প্রথম থেকেই বেশ ভালো লাগল । পারমিশন পেয়ে আমি দাদা সম্বোধন করলাম। লোকটি স্মার্ট, মিশুকে। প্রকৃতি যেমন দরকারে অপরুপ রুপ নেয় আবার দরকারে ভয়ংকর, তথাগত’দাও ঠিক সেইরকম। চা খেলেন বিস্কুট গুলোকে পাশে সরিয়ে । অল্পেই আমাদের চারজন বেশ কাছের হয়ে গেলাম। এখানে বলে রাখি, মামা জীবনে হয়ত সে ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নি, কিন্তু তার পরিধি অনেকটাই বিস্তৃত । তিনি লেখক হিসাবে অনেকটাই নাম করেছেন। তাছাড়া তার প্রচুর ঘোরার জন্য অনেকেই তাকে চেনেন। মিঃ বিন্দ্রা মামার ছোটবেলার বন্ধু, বলা যায়, স্কুল লাইফের। তিনি লাটাগুড়ি পুলিশে আছেন কর্মরত বেশ কিছু বছর।
“ ভাই তোমাকে আমি নাম ধরেই বলছি, কিছু মনে করো না। হুম, কাল রাতে যেটা হল সেটা খুব একটা ভাল হল না। ভাগ্যিস বেচুং ছিল, আমরা অনেক্ষণ ফিরছি না দেখে ওই ভোররাতে আমাদের খুঁজে উদ্ধার করে বাংলোয় নিয়ে আসে”, মামা এক নিঃশ্বাসে তথাগত’দার তাকিয়ে বলে গেল।
“দেখুন হাতিটার দেহ আমরা পেয়েছি, খারাপ লাগছে। এমনিতেই ফি-বছর ট্রেনে কাটা পরে অকালে হাতি শেষ হচ্ছে, তার উপর ফরেস্ট গার্ড থাকা স্বত্তেও চোরাশিকার। কালকে যা হল। ভিজিট করার পর আমার অনুমান সত্য – একটা দাঁত কেটে নিয়ে গেছে, পূর্ণ বয়স্ক হাতি না”- কথাগুলো যেন অন্য তথাগত বলল, চোখ দুটো রাগে লজ্জায় জ্বলছে।
নিশ্চুপে সব শুনছিল মামা। মিঃ বিন্দ্রা গলা ঝেড়ে বললেন,“ আজ সকালেই তথাগতর ফোন পাওয়ার আগেই রাবাংলা ডিভিশন থেকে আমার কাছে ইনফরমেশন আসে যে, ওখানকার আবার ভেপুগ গুম্ফা থেকে প্রাচীন বৌদ্ধ চিত্র ভ্যানিস। আর ঘটেছে কাল রাতেই কাকতালীয় ভাবে”।
দূরেই বেচুং আমাদের কথা মন দিয়ে শুনছিল। সবাই কথায় ব্যাস্ত থাকার জন্য সেদিকে কারো লক্ষ না গেলেও আমার চোখে চোখ পরা মাত্রই সুট করে সরে পরল। আমি একটু এগিয়ে এদিক ওদিক চাইতে কোথাও আর দেখতে পেলাম না।
একটু্ পরেই ওরা গাড়ীর কাছে গিয়ে হ্যান্ডসেক করে যাওয়ার আগে বলে গেলেন টাচে থাকতে। ধোঁয়া আর কালচে লাল ধুলো উড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল।
দুপুরে খাওয়ার খেতে খেতে আজ মামাকে প্রথম দেখলাম এতটা গম্ভীর। বেচুং চুপচাপ পাশে বসে বসে মড়া হাতিটার গল্প বলছে। আশ্চর্য হলাম একটা কথায়, হাতিটার পেট থেকে কিছুটা অংশের ছাল কেটে নিয়ে গেছে। সাধারণত হাতির দাঁত কেটে নিয়ে যাওয়ার কথা আগে বেশ শুনেছি কিন্তু ছাল! মামাকে জিজ্ঞাসা করতেই ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল, “ এত বড় ফরেস্ট। দুটো লাইট আর কটা গাদা বন্দুক দিলে এই হয়। আরে প্রপার মডার্ন ইকুপমেন্ট না থাকলে সব শেষ হবে একদিন”। আমার উত্তর না পেয়ে দমে গেলাম।
“টুটুন বাবা, তুমি শুয়ে পর, কাল রাতে তোমার উপর বেশ ঝড় গেছে। আমি একটু চারপাশটা ঘুরে আসি” বলেই আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেড়িয়ে গেল। বুঝলাম, মামা কোন বিষয়ে চিন্তায় আছে, তার কারণ, মামার মুখ থেকে তুমি খুবই কম বেরোয় আমার বেলায়, আর যখন ...।
“সাব, আমি আমার ঘড়টাতেই আছি কোন দরকার পরলেই ডাক দেবে”, বেচুং – এর কথায় চিন্তায় ছেদ পরল। একটা জিনিস, কালকের পর থেকে বেচুং –এর মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। বার বার জঙ্গলের দিকে তাকাচ্ছে, আমাদের কথাগুলো তখন ওই ভাবে শুনছিল, কেমন যেন অস্থিরভাব।
ছালটার কথা চিন্তা করতে করতে মনটা চলে গেল তরাইয়ের এই সবুজ অরণ্যের দিকে। অরণ্য প্রাচীন কাল থেকে কত ভাবে আমাদের সমৃদ্ধ করেছে, আর আজ তারাই বিপদের মুখে। প্রকৃতি তার শোধ তো নেবেই। একবছর আগেই হিমালয়ান সুনামি তার ফল। কেদারনাথ, বদ্রীনাথকে মানুষ যেভাবে গ্রাস করেছিল তার ফলও হাতে নাতে পেয়েছে।
বিকাল পাঁচটা, ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথে সূর্য মামাও অনেক্ষণ আগেই হেলে পড়েছে। জঙ্গলে এটাই হয়। যেবার বাবা মায়ের সাথে গোমুখ গিয়েছিলাম, তখনই বুঝেছিলাম পাহাড়ি এলাকা আর জঙ্গলে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মামা কই! বেচুং! সেই বা গেল কোথায় ? বাইরে বেড়িয়ে ডাক দিলাম। ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ভয়টা কেন জানি না বেশ জমিয়ে বসতে শুরু করবে ঠিক তখনই দেখি মামা দূরে টর্চ জ্বালাচ্ছে আর নেভাচ্ছে, গায়ে কাঁটা দিল, কোন সিগন্যাল দিচ্ছে নাকি! না, মামা গুণ গুণ করে গান করতে করতে কাছে আসতেই আর থাকতে পারলাম না। মুখ খোলার আগেই মামার পিঠে দুম করে কিল মেরে বললাম, “ কি পেয়েছ অ্যা! আমাকে একা ছেড়ে ঘুড়ছো আর এদিকে বেচুং হাওয়া!”
মামা সেই পুরনো ফিচেল হাসি হেসে মুখ ভেংচিয়ে বলল, ‘ সে কি রে তুই ভয় পেলি !! এই তুই হোস্টেলের মারকুটে ছেলে! ছ্যা ছ্যা, ফ্রেন্ডসরা সব জানলে তোকে ..., বেচুং কে আমি পাঠিয়েছি। আজ বন-মুরগি খাবো”।
৫
শিলিগুড়ি থেকে রাবাংলা একশো কুড়ি কিলোমিটার, আমাদের এখান থেকে মোটামুটি নিরানব্বই কি একশো হবে ৩১ সি থেকে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক দরে আমাদের গাড়ী ছুটে চলেছে । মাঝে মাঝে সাপের মতো এঁকে বেঁকে, কখনবা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। দূরে পাহাড়ি বাচ্চারা ফাঁকা রাস্তায় দিব্যি ঝক ঝকে স্কুল ইউনিফর্ম পরে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। এখানে , আমাদের ওখানকার মত কোন ওষুধের দোকান নেই বললেই চলে, খুঁজে পেতে বহুদূরে একটা। পরিবেশ মানুষকে কতটা সুন্দর ভাবে রাখতে পারে। আর আমাদের ওখানে এক পা এগোতে না এগোতে সার সার দিয়ে ওষুধের দোকানের বৈচিত্র্য। বাড়ির কথা মনে পরতেই মামাকে বললাম, “মা কে তো খবর দেওয়াই হয় নি, নেটওয়ার্কের যা প্রবলেম !”
“ কি রে বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে টূটূন ! আমি ওয়্যারলেসের মাদ্ধমে খাবর দিয়ে দিয়েছি। কোল ড্রপ ইস্যু জালিয়ে খেলো” – মামার কথাতে মনটা আস্বস্ত যেমন হল তেমনি লজ্জাও একটু পেলাম। ভাবুক গিয়ে মামা যা ইচ্ছা। যেদিন ঘুষি মেরে নাক ফাটাবো সেদিন ঠ্যালা বুঝবে। অঙ্কন : পবিত্র চক্রবর্তী
পাহাড়ি জায়গার এই হচ্ছে ঝামেলা, রাস্তা ফুরাতেই চায় না, দু- ঘন্টার রাস্তা আট ঘন্টা লাগিয়ে দেয় । বেলা সাড়ে তিনটের সময় রাবাংলার একটা হোটেলে আমাদের গাড়ি থামল। শুকনো ভাত আর স্রেফ ডালটা তখন মুখে অমৃত লাগছিল। মামাই বলেছিল খেয়ে নিয়ে রুমে যেতে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাওয়ার সময়ে একটা কালো জ্যাকেট পরা লোক প্রায় ঘাড়ের উপর ধাক্কা মেরে পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই আমি রেগে হা করার আগেই লোকটি একবার মুখটা ঘুরিয়ে ডান হাতটা হেলিয়ে সরি বলেই খানিকটা জোড়েই দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। রুমের লক খোলাই ছিল। চটপট পরিষ্কার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। খানিক বাদেই মামা ঢুকতেই মামাকে ঘটনাটা বললাম। মামা দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে জিভে টক টক আওয়াজ করে বলল, “ ও এমন হতেই পারে, বুঝে গেছে মারকুটে ছেলে এসেছে”।
সিকিম এমনিতে খুবই পরিষ্কার জায়গায়, মনে হয়ে ভারতের বাইরে কোন একটা সুন্দর সাজানো দেশ। খুব জোড় রাত আটটা তারপর রাস্তা-ঘাট অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায় । মামা হোটেলের লোককে বলল আমাদের খাবার রেখে দিতে। দুজনেই চুপচাপ হাঁটছি, বেশ ঠাণ্ডা লাগছে এবার। পকেটে হাতটা ঢোকাতেই কি যেন বেশ হাতে ঠেকল। আন্দাজে জিনিসটাকে বার করতেই দেখি একটা গোলাপি ভাঁজ করা কাগজের টুকরো। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে মামা তাড়া লাগাতেই মামাকে দেখালাম। রাস্তাটা একটু অন্ধকার, কাছের ঢালুতে একটা ল্যাম্পপোস্টের কাছে কাগজের ভাঁজটা মামা খুলতেই বলল , “ যা হরি, বেশ তো ! এ যে থ্রেড লেটার ! কি জ্বালা”।
আমিও অবাক। ঘুড়তে এসে এসব আবার কি! আর মামা কোনদিনও গোয়েন্দাগিরি করেছে বলে আমার তো স্মরণে আসছে না। তবে এমন চিঠি! ঠোঁটটা কামড়ে ধরে উত্তেজিত হয়ে পরলাম। তবে এক দিকে ভালই হয়েছে, অনেকদিন হাত পা চালাই নি, জমে যাবে বেশ জমজমাট কিছু হলে।
“টুটুন, চল হোটেলে ফিরে যাই, রাতও হল”, মামা একটু ঠাণ্ডা গলায় বলল।
হেসে বললাম, “এই বার ভয় পেয়েছ, চল বাবা, তোমার যদি কিছু হয়ে যায় মা আমাকে আস্ত রাখবে না”। মামাও হো হো করে হেসে পা চালাল।
হোটেলে ঢোকার মুখে রুম সার্ভিস বয় মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “স্যার, খেয়ে উপরে চলে যান, রাত হলে খাবারটা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে”। একদম ঠিক কথা, সারাদিন ভালো করে পেটে কিছুই পরে নি, আমারা ডাইনিং রুমে খেতে বসলাম। হঠাৎ , আমার চোখ বাঁ পাশের একটু দূরের টেবিলে চলে গেল, দুপুরবেলার সেই লোকটাই তো, সঙ্গে আরেকজনের সাথে ঘাড় নীচু করে কথা বলছে। ব্যাপারটা জানাতেই মামা আস্তে করে বলল, “ হুম , লাটাগুড়ি থেকেই আমাদের গাড়ীর পিছনে ছিল, তুই এখন দেখলি নাকি !”
ভ্যাবাচাকা খেয়ে মামার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। রুমে যেতেই মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম কি করে জানলো। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে হাঁই তুলে বলল , “ সিম্পল, গাড়ীটি সিকিমের কারণ, নম্বর প্লেট, চা খাওয়ার টাইমে লক্ষ করেছিলাম। অ্যান্ড সেকন্ডলি, লোকটির নাম থেন্ডাপ, লেপচা”।
বিস্ময়ে বললাম, “ নাম আবার কি করে জানলে ? বাকিটা নাহয় লজিক্যালি বলা যায়...”
“ তুই ধাক্কা খাওয়ার আগে রিসিপসনে রেকর্ড বুকে নাম লেখার টাইমে দেখলাম , যদিও অ্যাড্রেস দিয়েছে শিলিগুড়ির , তাছাড়া কনফার্ম হলাম ডান হাতের কব্জির কাছে ডিপ করে TH লেখা ট্যাটুটা দেখে”।
যত শুনছি তত অবাক হচ্ছি। হাল্কা রেগে গিয়ে বললাম , “ যখন জানোই এত কিছু, তাহলে থ্রেড লেটারটার বিষয়ে তো কিছু বললে না”।
“কি বলবো! ধুর ওটা পড়তে অমন লাগছে, আসলে ওটা ইনফরমেশন দিল, সাবধানে থাকবেন, আমরাও আছি”।
বেশী রাত হয় নি, ঘুমও আসছে না, কি করি । মামাও চুপচাপ, খুব একটা উত্তর দিচ্ছে না, কেবল ভ্রুটা কুঁচকে আছে। আমিও টুরিস্ট গাইড খুলে পড়তে শুরু করলাম। মনে হচ্ছে সমস্ত হোটেল ঘুমিয়ে পড়েছে। মামা হাত দুটো টানটান করে বলল, “শুয়ে পড়। আকাশ পাতাল চিন্তা করতে হবে না, কাল একটু ভোর ভোর কাছা কাছি সারচোগ ভেপুগ গুম্ফা থেকে ঘুড়ে আসব”।
হাত ঘড়িতে দেখলাম রাত দশটা । লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। মাথার মধ্যে একটা কথা ঘুরে ফিরে আসছে,খাওয়ার সময় থেন্ডাপ যখন কথা বলছিল, হঠাৎ ওর জ্যকেটে একটু টান পরায় কোমরের কাছে কালো মতো কি যেন চকচক করছিল , রিভলবার কি? কিন্তু মামা যে বলল ,নো প্রবলেম!
৬
ভোর চারটে। মামার টানাটানিতে ঘুম ভাঙল। সঙ্গে মৃদু ধমক, “ তুই ঘুমা, ঘুরতে এসে শুধু ঘুম! চটপট রেডি হও”।
রুম বয় চা দেওয়ার পর জানাল, “ সাব গাড়ী একটু পরেই চলে আসবে, রেডি হয়ে যান”।
ফ্রেশ হয়ে আধা অন্ধকারে হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁইটা পুরো না হতেই দেখলাম, মামা দিব্যি গল্প জুড়েছে থেন্ডাপের সাথে। থেন্ডাপ আর একজন মামার সাথে কি কথা বলছে আর মাঝে মধ্যে হো হো করে হাসছে। ওদের আলাদা গাড়ী, বাঁচা গেল। কেন জানি না প্রথম থেকেই লোকটার প্রতি আমার বিরক্ত ভাব লাগছে। আমাদের গাড়ী আসার আগেই ওদের গাড়ী রওনা দিল। মামা কাছে আসতেই হেসে হেসে জানাল, “ জানিস টুটুন থেন্ডাপ বলে লোকটি ভারী চমৎকার, কে বলবে লোকটির ষাট বছর বয়স! পাহাড়ি মানুসদের এই একটাই মজা বয়স বোঝাই যায় না”।
কথা বলতে বলতেই আমাদের গাড়ী চলে এলো। বেশ ইয়াং ড্রাইভার। কে জানে বাবা, দেখে তো লাগছে চব্বিশ – পঁচিশ । গালে চাপ দাড়ি, সাধারনত পাহাড়িদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না, যদিও আজকাল সবই প্রায় ফ্যাশন আর হ্যাঁ বেশ মিশুকে। রাবাংলা থেকে গুম্ফা বেশী দুর নয়, ম্যাক্সিমাম দু কিলোমিটার, কালকেই গাইড বইতে পড়ছিলাম। সঙ্গে আমাদের বিশেষ কিছুই নেই, বেশ ঝারা হাত পা। মামা তার মাঝারি ছোট হাল্কা ছাল ওঠা হাত ব্যাগ নিয়েছে। গাড়ী ছাড়তেই সুন্দর নেপালি সুরের গান চালিয়ে দিল চ্যাং ; আমাদের ড্রাইভার , নামটা মনে পরতেই ফিচ করে হেসে ফেললাম। গাড়ী চলেছে এঁকে বেঁকে, পাহাড় জেগে উঠছে, সোনালী আভা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, বেশ মনোরম। মাথার টুপিটা এঁটে বসালাম, মামাও ইতিমধ্যে মান্ধাতার আমলের জ্যেকেটের চেন টেনে বসে আছে জানলার দিকে মুখ করে, মাঝে মধ্যে নিজেই শুনতে পাবে এমন বেসুর সুরে গুন গুন করে গাইছে, কিছুই বোঝা গেল না।
“আরে ! থেন্ডাপ অ্যান্ড কোম্পানি কি করছে !”প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম। মামা “রক্কে” বলে উঠতেই চ্যাং এর গাড়ী কিছুটা দুর গিয়েই ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। লাফ দিয়ে মামা দরজা খুলেই বেড়িয়ে গেল। আমিও পিছু নিলাম।
থেন্ডাপ মন দিয়ে ছবি এঁকে চলেছে, পরছে নানা রঙের টান । কাছে যেতেই দেখলাম দৃশ্যটা। অদূরেই নীচে পরে আছে একটা লম্বা টাইপের নলের মতো মোটা কি যেন, পরে বুঝলাম, আর্ট পেপার যাতে নস্ট না হয়ে যায় তার জন্য পেপার রোল করে এর মধ্যে রাখা যায়। আমাদের দেখেই, হেসে বললেন, “ তোমরাও কি গুম্ফা ?”
“ আমরা গুম্ফা না, গুম্ফা দেখতে যাচ্ছি”, কথাগুলো হাল্কা রেগেই বললাম বদমাশটাকে, উফ, কি জোড়টাই না ধাক্কা মেরেছিল ।
“বাব্বা, এত সুন্দর জায়গায় রেগে রেগে কথা বলতে নেই” বলেই হা হা করে হেসে উঠলো।
মামা চুপচাপ পেইন্টিঙটা দেখছিল, আমাদের দিকে কোন কানই যেন নেই; মাঝে সুন্দর বলল, “বাহ, চমৎকার আঁকার হাত তো , অনেক দিন আঁকছেন তাই না মিঃ থেন্ডাপ”!
“ইয়েস স্যার , হুবুহু না হলেও যা দেখি তা আঁকি, জায়গাটা চমৎকার, নির্জন”, শেষের কথাগুলো একটু জোর দিয়েই মাথা ঝাঁকিয়ে জানালেন।
“ও. কে, আপনি কাজ সারুন, আমরা বরং এগোই”, বলে মামা আর আমি একটু এদিক ওদিক হাত পা চালিয়ে লাফালাফি করে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর মামা থম মেরে বলল, “যাই বল, হাতটা কিন্তু মন্দ না, বলা যেতে পারে একদম প্রফেশনাল”।
গাড়ীর গতিটা একটু ধীর হল, চ্যাং গালে হাত দিয়ে জানাল “ ধস সাফ হচ্ছে, সামনে জ্যাম স্যার”। কি আর করা চ্যাং এর সাথাসাথি আমরাও নামলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম থেন্ডাপদের গাড়ীটা আর কায়েকটা গাড়ীর পিছনেই থেমে গেল। মনে মনে ভাবলাম বেশ হয়েছে, দেখ কেমন মজা।
মামা কাছাকাছি হাঁটছিল, হঠাৎ দৌড়ে এসে গাড়ীতে বসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “ চ্যাং, আর কতক্ষণ! গাড়ী হোটেলে নিয়ে চল”। চ্যাং কি ভাবল কে জানে ,আমি তো ভ্যাবাচাকা।
“কি হল তোমার”! মামা নখ চিবোতে চিবোতে বলল, “ গণ্ডগোলে ব্যাপার রে ভাই”।
ইতিমধ্যে চ্যাং কি কায়দা করে গাড়ী ঘুরিয়েছে কে জানে, থেন্ডাপদের গাড়ীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ওদের গাড়ীতে ড্রাইভার ছাড়া কেও নেই। চ্যাং ওদের ভাষাতে কি জিজ্ঞাসা করলো কে জানে! আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুধু বলল, “হোটেল”।
পাশ কাটাতে কাটাতে চ্যাং এর গাড়ী ছুটল হোটেলের দিকে। বাইরের দৃশ্য দেখার মন আর কারোরই নেই। মামা কাকে যেন ফোন করে বলতে লাগলেন, “হুম। আসছি, ঠিক ঠিক...”। এ অবস্থায় কিছু আর জিজ্ঞাসা করের সাহস পেলাম না কারণ মামার এই নব কলেবর ফার্স্ট দেখছি।
কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ী হোটেলের কাছে আসতেই দেখি বাইরে ভীড়। মামা লাফ দিয়ে নেমে বলতে বলতে গেল, “ তুই রুমটায় যা তো, আর দেখ ভেতরটা”। চ্যাং উত্তেজিত হতেই মামা হাত দিয়ে ইশারা করে দাঁড়াতে বলেই ছুটে ভিতরে ঢুকল। আমরাও পিছু নিলাম।
হোটেলের ম্যানেজারের রুমটা খোলা, একটা গোঙানির শব্দ। আমি কয়েকটা সিঁড়ি লাফাতে লাফাতে এসে দেখি আমাদের রুম খোলা, কারা যেন মামার ব্যাগ আর আমার রুকস্যাকটা টানাটানি করে খোলার চেষ্টা করেছে। জামা কাপর গুলো এদিক ওদিক ছড়ানো।
নীচে নেমে মামার কানে কানে বলতেই ভ্রূ ধনুকের মতো করে বলল, “ লাভ নেই কিছু”। আবার অন্য একজন স্টাফকে বলল ডাক্তার ডেকেছে কিনা!
একটু পরেই লোকাল পুলিশ হাজির, সঙ্গে ডাক্তার। মামার পরিচয় জানতেই মামা বলে উঠলো, “ স্যার আমার পরিচয় মিঃ বিন্দ্রার কাছ থেকে জেনে নেবেন, আপাতত বলুন চায়না বর্ডার যাওয়ার রাস্তা ক্লোজ করতে পারবেন কিনা!”
কি ভাবল ভগাই জানে পুলিশ। ইনস্পেক্টর একটু খানি চুপ করে কাকে যেন ফোন করলেন ভুটিয়া ভাষায় বোধ হয়। এখানকার সব ভাষায় মনে হয় এক। খানিকটা হিন্দি ওয়ার্ড থাকায় অনুমান করার চেষ্টা করলাম মাত্র, বুঝলাম, কাকে যেন কি ইনফরম করছেন। আবার ফোন লাগালেন, এবার “স্যার” আর “মিঃ বিন্দ্রা” এইটুকু বলতেই বুঝলাম যে মামার সম্পর্কে কনফার্ম হলেন।
মামা অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললে, “ স্যার জি কনফার্মড হলেন ?”
অফিসার কাঁধ নাড়িয়ে একটু হেসে ভাঙাচোরা বাংলায় বললেন, “ ডোন্ট মাইন্ড স্যার, হোপ ইউ ক্যান... বুঝতেই পারছেন। বাই দ ওয়ে আই অ্যাম ইনস্পেক্টর ওয়াঙ্গেল লামা, আপনি আমাকে লামা বলতে পারেন”।
“ তা মিঃ লামা, ডাক্তার কতক্ষণে আসবেন” কথাটা পুরো শেষ হওয়ার আগেই হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তার হাজির। ম্যানেজারকে কি যেন জিজ্ঞাসা করে খচ খচ করে ওষুধ লিখে দিয়ে মাথা বেশ ঢাউস একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে বললেন, “ওষুধ লিখে দিয়েছি, মাথায় বেশ জোর একটা মোটা কিছু দিয়ে মেরেছে”।
মামা মিঃ লামাকে কি যেন বলল, অন্য একজন কনস্টেবল ম্যানেজারের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত কড়া পড়াতেই ম্যানেজার হাঁউ মাউ করে কেঁদে উঠল। মিঃ লামা এক ধমক লাগাতেই চুপ ক্তেইথম মেরে গেল। বাইরের পুলিশ ভ্যানে তুলেই মিঃ লামা বললেন, “ মিঃ। সি, দেয়ার আর টু ওয়েস , একটা থ্রু ইয়ান্থুম হয়ে জিরো পয়েন্ট দিয়ে নাথুলা পাশ আর একটা পেডং অ্যান্ড দেন সিল্ক রুট টু বর্ডার...”।
মামা রেগে গিয়ে মিঃ লামার কাছে গিয়ে বলল, “ ধুর মশাই, কি করতে পুলিশে জব করছেন ! নাথুলা পাশ দিয়ে বর্ডার যাবে না , কজ দেয়ার হেভ মেনি আর্মি চেকপোস্টস”।
“দেন...” অত বড় অফিসার ওইটুকু বলেই চুপ, কি জানি কি মনে হল আবার মোবাইলে কি যেন ধমক দিতে দিতে বললেন।
চ্যাং এতক্ষন চুপ করে সব দেখচ্ছিল আর মন দিয়ে শুনছিল, সে চটপট করে মামার কাছে এসে বলল, “ এনি হেল্প স্যার ?”
“হেল্প মানে, সাংঘাতিক হেল্প দরকার। দৌড়াতে হবে পেডং বাট উই হ্যাভ নো টাইম, জিতনা জলদি হো দৌড়াও”।
মামা উত্তেজিত হলে বেশ সুন্দর গুছিয়ে কাজ চালাবার মতো ভুলভাল ইংলিশ বলে, তার পর আজকের ঘটনা, পুরো ভাষাটা পাঁচ মিশালি তরকারি। এর মধ্যেই ফিক ফিক করে হেসে ফেলেছি দেখে মামা গুম হয়ে ভেংচিয়ে বলল, “ নে নে ইঞ্জিরি পুত্তুর, আমি পাতি বাঙলা মিডিয়ামের, তাও তো বলছি। যা জলদি আমাদের রুম লক করে বেড়িয়ে আয়”।
সিকিমের রাবাংলা থেকে আমাদের যেতে হবে প্রায় পশ্চিম দিকে, সেই পাহাড় আর খাদের পাশ কাটিয়ে। তবে খাদ গুলো খুব একটা ভয়ংকর না, ভয় পেলেও মানিয়ে নেওয়া যায়। পাকা ড্রাইভার চ্যাং, ফাঁকা পেলেই তুলছে স্পীড। খিদে পেলেও এখন মাথায় উঠেছে খাওয়া । মাঝে মধ্যে মামা মোবাইলে প্রায় চিৎকার করে বলছে, “ আরে বাবা, ওখানেই থেকো... এই রে নম্বর...”
চ্যাং বেশ জোড়ে বলল, “স্যার ... ০০৯২”।
গাড়ী এত স্পীড নিয়েছে যে মামা শুধু অ্যা অ্যা ০০৯২ বলেই ফোন রেখে দিল। অনেকটা রাস্তা যাওয়ার পর বুঝলাম এটা পেডং এর কাছাকাছি, বাস স্ট্যান্ড, ট্রেকার দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কই ০০৯২!! আর একটু এগোতেই পেডং ফুটবল গ্রউন্ড। আরও গেলে প্রায় তিব্বতের সীমানা। আমাদের গাড়ী এগোচ্ছে। কিছুদূরেই বৌদ্ধদের মৃতদেহ সমাধি স্থল, বেশ নির্জন। লোক জন নেই বলা যায়, চারিপাশে পাহাড়, আর বড় বড় গাছ, খানিকটা জঙ্গল। অজানা পাখির হাল্কা ডাক। দুপুর প্রায় গড়িয়ে পরেছে। কিছু লেপচা মহিলা পীঠে ঝুড়ি নিয়ে আধা ঝুঁকে হেলতে দুলতে বাড়ীর দিকে ফিরছে। চ্যাং জানাল গাড়ী চালাতে চালাতেই এরা কাছাকাছি ঝুলুক গ্রামে থাকে, তাছাড়া এই দিকে তেমন কোন বসতি নেই। মামা যেন সব শুনেও শুনছে না , অন্য দিকে মন, কি যেন একটা চিন্তা করেই চলেছে।
চিন্তার রেশ কাটতে না কাটতেই চ্যাং গাড়ী সজোরে ব্রেক কোষে থামাল, সামনেই ০০৯২ । টায়ার পাঞ্চার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । চ্যাং বুদ্ধি করে ০০৯২ মার্কা গাড়ীটার সামনে আড়াআড়ি করে দাঁড় করিয়ে রাখলে, ভাবটা এমন বাছাধন গাড়ী নিয়ে পালাবে কোথায় ? মামা চটপট গাড়ী থেকে নেমে কাছে যেতেই দেখল খালি গাড়ী। আমরাও মামার পিছনে পিছনে সাবধানে এলাম, বলা যায় না কি কান্ড ঘটে যেতে পারে!
একটু ভালো করে দেখতেই বোঝা গেল ড্রাইভার গাড়ীর নীচে কি যেন ঠিক করছে, আমাদের চোখে চোখ পরতেই হাত দুটো থেমে গেল, পকেট থেকে কিছু বার করার আগেই আমি বেরিয়ে থাকা ছোট ছোট পা দুটো ধরে হিড় হিড় করে টেনে বার করলাম। চ্যাং কি জানি কি বুঝেছে, কলার চেপে ধরল। পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু বার করতেই আমি হোস্টেল মুডে ফিরে এলাম। ক্যাঁক করে এক ফ্রি কিক পেটে মারতেই লোকটা ওক করে উঠলো। একটু ঝিমিয়ে পড়ে আবার একটা হাত কোনমতে ছাড়িয়ে পকেট থেকে প্রায় এক বিঘত ধারালো স্প্রিং ছুড়ি বার করেই চোখের নিমেষে চ্যাং এর কোমরে মারতেই চ্যাং ছিটকে পরে গেল। মামা ছুটে এসে চ্যাং কে তুলে ধরে বসাল। চ্যাং এর মুখ বিকৃত করে মামাকে বলে, “ ক্যাচ হিম, ক্যাচ হিম”।
লোকটি পালানোর তাল করতেই মারলাম এক ভল্ট, সজোরে পায়ে এক লাথি, পরে যেতেই সপাটে এক থাপ্পর। অনেকদিন পর হাতের সুখ মিটছে। লোকটির মুখের কষ বেয়ে রক্ত পরছে। বুঝতে পারলাম আমি কখন এতটা সাহসী হয়ে গেছি এই অজানা জায়গায়। গলাটা প্রায় টিপে ধরে চিৎকার করে বললাম, “বাকি গুলো কোথায় ? তোর থেন্ডাপ কোথায় পালাল ?” কাহিল হয়ে লোকটি হাত দিয়ে দেখিয়ে বলার চেষ্টা করলো গাড়ী খারাপ হয়ে যাওয়ার জন্য ওরা অন্য গাড়ী বেরিয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে চ্যাং আর মামা হাজির। চ্যাং এর জামাটা ভিজে গেছে কিন্তু সাবাস চ্যাং নিজের জামা খুলে খত জায়গায় কষে বেঁধে নিয়ে জানলো, উঠে পরতে গাড়ীতে। মামা গাড়ী চালাতে পারবে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই কষ্ট করে হেসে গাড়ীতে ওঠার জন্য ইশারা করলো। আমরা ওকে ছেড়ে চ্যাং এর গাড়ীতে চাপতেই ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়ী চলল আরও এগিয়ে। অন্ধকার নামতে বেশী দেরী নেই। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর গাড়ী আর নড়তে চায় না, তেল শেষ।
হঠাৎ, দূরে একটা হাল্কা লাইট চোখে পরতেই চোখ আড়াল করে আমরা দেখলাম একটা গাড়ী আমাদের দিকেই আসছে। হুড়মুড়িয়ে আমাদের সামনে ব্রেক কষে দাঁড়াতেই, মামা অস্ফুট ভাবে বলে ওঠে, “আরে মিঃ লামা যে !!” আমিও অবাক হয়ে গেলাম। ইন্সপেক্টার লামা লাফ দিয়ে নেমে বললেন, “চটপট উঠে পড়ুন স্যার,ওয়্যারলেসে খবর এসেছে”। মনের ভিতর আনন্দে নেচে উঠলো। কিন্তু জানতাম না এরপর কি ভয়ানক পরিস্থিতে পড়তে চলেছি।
৭
শীতের মিঠেকড়া রোদে আমি প্রায় হাফ শোয়া । ইন্সপেক্টর বিন্দ্রা, তথাগত’দা আর মামা জমিয়ে আড্ডা মারছেন সামনের বাঁধানো বারান্দায়, সঙ্গে টুকটাক ভাজা আর চা। তথাগত’দা কুচো মাছ ভাজা চিবাতে চিবাতে বলেন, “ বুঝলেন স্যার, এই মাছ সাধারন ভাবে বাজারে খুব একটা পাওয়া যায় না, তিস্তার ধারে লোকাল লকেরা আই মাছ গামছা দিয়ে ধরে, চমৎকার টেস্ট”। মামা ও বিন্দ্রা সাহেব ঘাড় দুলিয়ে সহমত প্রকাশ করলেন। আমি লোভ আর সামলাতে পারলাম না। যদিও ঘাড়ের ব্যাথাটা আছে কিন্তু আগের থেকে কম। আমাকে আসতে দেখে তথাগত’দা হাত নেড়ে জোড়ে বলে উঠলেন, “ সো ব্রো, আর ইউ ফাইন নাও! কম অন”
“আরে তুই উঠে এলি, ঠিক আছিস তো ?”উত্তেজিত হয়ে মামা বলল। উফ ভগবান মামা যেন সব না বলে বসে, মামার আবার তাল থাকে না কখন কি বলতে হবে, হুম যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়।
“ বাবা টুটুন, তাড়াতাড়ি ঠিক হো, না হলে তোর মা আমাকে আস্ত রাখবে না। এক রদ্দায় ছেলে আমার কুপোকাত” মামা বেশ মজা করে বললেও গা জ্বলে উঠলো শুনেই।
“ আহা, ও যা করেছে, ওটাই বিশাল , কজন পারে ফাইট করতে”, বিন্দ্রা সাহেব হাসতে হাসতে মামাকে থামিয়ে বললেন।
“না স্যার এবার আমাদের উঠতে হবে, বেশ খানিক কাজ পরে আছে”, বলে তথাগত’দা উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে মিঃ বিন্দ্রা সম্মতি জানিয়ে বললেন “ইয়া, এবার মামা ভাগ্নে ইনজয় অ্যান্ড গল্প করো”। মামার সাথে হ্যান্ডসেক করে আর মাথায় হাল্কা হাত বুলিয়ে দুজনেই রওনা দিলেন।
আমরা এখন সেই চাপড়ামারির ফরেস্ট বাংলোয়। তবে মামা যে এমন করবে ভাবতেও অবাকও হচ্ছি আবার গর্বও লাগছে। এই মামাকে কেওই খুব একটা প্রাধান্য দেয় নি। যদি আমি না আসতাম আর ঘটনাটা যদি না ঘটত তাহলে মামার আর এক দিক যা জানতাম না তা দেখতে পেলাম।
রাতে হরি বলে নিপাট এক বাঙালী বাংলোর কেয়ারটেকার খাবার দিয়ে যেতেই বিস্ময়ে ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বেচুং কই ? প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল, আগে জানলে ব্যাটাকে দিতাম”।
“কাকে, বেচুংকে কেন ! আর তোর মারপিট করতে হবে না বাপ। হ্যাঁ, বেচুং যা করলো তা ভুলবার না”, মামা খেতে খেতে জানালো।
“কি হয়েছিল বলবে কি হেঁয়ালি না করে, খুব ক্রেডিট নিচ্ছ। কিছু জায়গায় তো আমি নিজেই জানি না”, একটু রেগে গিয়ে বললাম।
“টুটুন আসল কালপ্রিট কে বলতে পারিস ? দেখি কেমন তোর বুদ্ধি”।
“কে আবার, ইটস ভেরি সিম্পল, বেচুং হল ঘটনার পান্ডা”, আমার কোথায় মামা হো হো করে হেসে বলল, “হল না বাবু, কেসটা অত সহজ না যতটা ভাবছিস বাট ইয়েস, আমি তোদের জেনারেসনকে থ্যাংকস জানাই, স্পেসিয়ালি ট্যাটু অ্যান্ড লো ওয়েস্ট জিন্সকে”।
আমি অবাক হয়ে খাওয়া বন্ধ করে ঘাড়টা কোনমতে উঁচু করেই বললাম,” মানে! ট্যাটু আর জিন্স এর কি সম্পর্ক?” মামা চুপ করে হাসতে দেখে আবার বললাম, “ও বুঝলাম, থেন্ডাপ, তাই তো ? বাট এর সাথে জিন্স কি ভাবে এলো”।
মামা হা হা করে করে খাওয়া ফেলে বলে, “ আরে অত ঘাড় জোড় করে উঁচু করিস না, ভেঙে যাবে! আর ধীরে বৎস ধীরে, হুম তুই ঠিকই ধরেছিস , মজা কি জানিস, থেন্ডাপ কিন্তু আমাদের সাথেই সবসময়ই ছিল, আমাদের চ্যাং বাবাজী রূপ নিয়ে”। আবার অবাক হওয়ার পালা, বলে কি মামা, চ্যাং!
“ কিন্তু মামা, চ্যাং কি করে হয়, আমাদের বাঁচাতেই তো বেচারা ছুরি খেল যে !”
‘তো কি হয়েছে, মরে তো নি, আর বড় বাপারে হাত মারতে গেলে ওই সামান্য আঘাত সহ্য করা যায়, কি জানিস , চমৎকার একটা ড্রামা হল আই দুদিন ধরে”।
“ঝেড়ে কাশো তো, হলটা কি”, আমি আর থাকতে না পেরে বলে উঠলাম, না শুনলে আমার খাবার হজম হবে না।
“ শোনো বাছা, হোটেলের থেকে থেন্ডাপদের গাড়ী আগে বেরিয়ে ছিল এটা সত্যি, থেন্ডাপ ছবি আঁকছিল এটাও সত্যি, ভুলটা হল রাস্তা, মানে রাবাংলা থেকে দুভাবে গুম্ফা যাওয়া যায়। চ্যাং যে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সে জানত ওখানে রাস্তা বন্ধ, তাও নিয়ে গেছিলো কারণ আমরা ওখানে আটকিয়ে গেলে থেন্ডাপ সহজেই মাল পাচার করতে পারবে...”
মামাকে বাধ্য হয়ে থামালাম কারণ বেশ কিছু জায়গায় জট পাকিয়ে যাচ্ছিল, মনের ভাব বুঝতে পেরে নিজেই বলল, “ তোর মত অবস্থা আমার হয়ে গিয়েছিল রে, স্রিফ একটা ভেল্কি। মনে আছে আমরা কিছু মিনিটের জন্য থেন্ডাপের ছবি দেখতে গিয়েছিলাম , ওখানেই যা হয়ে যায়। আমরা মুগ্ধ হয়ে ছবি দেখছি, আর এদিকে চ্যাং হল থেন্ডাপ আর থেন্ডাপ হয়ে গেল চ্যাং, ছিল বিড়াল হল রুমাল”
“মানে”
“ মানে সহজ, দাড়ি অদল বদল, চ্যাং এর দাঁড়িটা ছিল ফলস আর যেহেতু প্রকৃতি গত কারনে আমাদের কাছে সব পাহাড়ের মানুষদের মুখ প্রায় এক রকম লাগে, এখানেও হল তাই। মোদ্দা কথা চ্যাং এর দাড়ি পরল থেন্ডাপ আর হয়ে গেল চ্যাং। তার থেকে বড় জিনিস আর্ট পেপার রাখার বড় রোলটা, মোটা প্লাস্টিকের রোল। ওটা সুট করে আমাদের গাড়ীর ডিকিতে ট্রান্সফার হয়ে গেল, কারণ ওরা জানতোই আমাদের গাড়ীতে রাখলে নো প্রবলেম, পুলিসের সঙ্গে আমার মটামুটি ভালই হাত আছে তা বুঝেই গিয়েছিল”- এতটা বলে মামা থামলেন।
“তারপর, তারপর কি হল?”
“ তারপর, চটপট খেয়ে নিয়ে ওষুধ লাগিয়ে শুয়ে পর, শুয়ে শুয়ে গপ্প বলছি”, মামা মুর্গীর ঠ্যাং চিবাতে চিবাতে বলল।
রাতটা বেশ সুন্দর, পূর্ণিমার সেই আলো নেই, কিন্তু মোটামুটি ভাবে চারিদিক দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে। হক হক করে কি যেন একটা রাতের পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। অদূরে কিছু হাল্কা হাতির ডাক। হুম এই ডাক শুনেই মনে পরে গেল যে হাতিটা মারা পড়ল, তাদের কি হল? আর অদ্ভুত ভাবে যে ছালটা কেটে নিয়েছিল! তার?
মামাকে ঠেলে বললাম, “এবার তো বল, ছাল – দাঁত ওই গুলোর কি হল?”
হাল্কা ধমক দিয়ে লম্বা হাঁই তুলে বলল, ‘ টুটুন, শুনেছিলাম তুই নাকি অঙ্কে খুবই ভালো, জানিস তো স্টেপ জাম্প করলে কি হয় ? তোর তাড়া কিসের ?”
কি করে বোঝাই আই ভদ্রলোককে যে আমি আর পারছি না। যাই হোক মামা আমার অবস্থা টের পেয়ে হাসতে হাসতে বলল, “ হোটেলের ম্যানেজার কিন্তু রিয়েল মার খেয়েছিল আমরা বেরনর আগেই, যা আমরা টের পাই নি। কারনটা অবশ্য ওদের নিজেদের মধ্যে টাকার বখরা নিয়ে ঝামেলা, ম্যানেজার শাঁসালে, খায় ওই মোটা প্লাস্টিকের রোলের জোড় ঘা। এটা যদিও মিঃ লামা আমাকে পরে জানিয়েছিলেন”।
এর মধ্যে হরি আম্য একগ্লাস দুধ দিয়ে গেল। মামা দরজা বন্ধ করতে করতে মুখ ভেংচে বলে, “খাও সোনা” কিছু করার নেই। বিপাকে পরলে এমনই হয়। যদিও মামা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, আমাদের মধ্যে এমন চলে, ভাগ্য ভালো এমন ফ্রেঙ্ক মামা পেয়েছি।
মশারির মধ্যে আমার ঘুম হয় না, কিন্তু এখানে টাঙাতেই হবে না মশারা আমাদের জঙ্গলে উঠিয়ে নিয়ে চলে যাবে। ঘড় এখন পুরো অন্ধকার। শুধু পাওয়া যাচ্ছে মামার গলার স্বর। “ আমরা ফাঁকা গাড়ী দেখলাম কখন বলত টুটুন ? হুম মনে আছে নিশ্চয়, চ্যাং কিন্তু মাঝ রাস্তায় গাড়ী নিয়ে রাবাংলার দিকে চলে যায়। আমাদের সন্দেহটা কিন্তু তাখনি থেন্ডাপের দিকে ঘুরে যায়, মজাটা হল থেন্ডাপ আমাদের সাথেই থাকল আপ টু পেডং আর থাকল কি বল তো ?”
“কি, ওই রোলটা তো”, আমি বলে উঠতেই মামা বলল “গুড, ইয়েস, ওই রোলটার মধ্যেই ছিল রোল করা প্রসেস করা ছাল। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ছাল দিয়ে হবে টা কি, তাই না ?”
“ আচ্ছা মামা তুমি থেন্ডাপের আঁকা ছবিটা কেন মন দিয়ে দেখছিলে ?”
“ কারণ, ওই পেন্টিঙ্গের মধ্যে তো রয়েছে, কি? রয়েছে, ভেপুগ গুম্ফার প্রাচীন বৌদ্ধ চিত্র। থেন্ডাপ আমাদের ঘোল খাওয়ানোর জন্য শুধু জল রঙের আঁচর কাটছিল, কিন্তু ভুলটা করলো যে অয়েল পেন্টিঙ্গে ওয়াটার কালার ধরে না, তাই ওই জল রঙ ঠিক ভাবে লাগছিল না দেখে অবাক হচ্ছিলাম”।
“মামা তুমি তো অয়েল পেন্টিং তো জানো , তাই না “, বলে উঠলাম।
“এখন দেখ কোন জিনিস ফেলা যায় না , কবে এক কালে শিখেছিলাম এখন কাজে লাগলো। যাইহোক, প্রসেস করা ছালের মধ্যে গুম্ফার প্রাচীন বৌদ্ধ চিত্র জড়িয়ে আমাদেরই গাড়ী করে থেন্ডাপ কি চমৎকার অভিনয়টা করে গেল। আর হ্যাঁ, ওই প্লাস্টিকের রোল মধ্যে ওই ভাবে যে নিয়ে যাবে এটা কিন্তু আমিও ভাবতে পারি নি, স্বাভাবিক কারোরই সন্দেহ হবেই না,কারন ওখানকার প্রকৃতি এতটাই রঙিন যে যে কেও আঁকতে পারে”।
একটু থেমে মামা জোড়ে হেসে দিয়ে বলল, “ অ্যাকচুয়ালি , হিরো কিন্তু তুই ?”
থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম “কেন ?”
“ সে কি রে হিরো বাবু! ভাগ্যিস তুই ওই মোটা রোলটার গদাম করে বারি খেলি, আর হাতির দাঁত সমেত গুম্ফা চিত্র বেরিয়ে পড়লো , না হলে কারো বাবার ক্ষমতা ছিল না কোথায় আছে ওইগুলো ধরার”।
“ কিন্তু তুমি কি করে বুঝলে , চ্যাং এর অভিনয় করছে থেন্ডাপ ?”
“ হা হা। জিও ট্যাটু আর লো ওয়েস্ট জিন্স । বাবা, চ্যাং ওরফে থেন্ডাপ যখন বুদ্ধি হারিয়ে পাকামি করে জামা খুলে ক্ষতটা বাঁধে তখনই দেখলাম TH । বুঝলি এবার। হুম এবার আসুক জিন্স, তোদের নিউ হালের জিন্সের জন্য বুঝতে পারলাম যে ওর পকেটে রয়েছে রিভলবার, উঁচু হয়ে ছিল”।
“জিও মামা, তুমি না জিনিয়াস”, উল্লাসে বললাম।
“হুম, কার মামা দেখতে হবে তো, আমিও এবার ওই রকম একটা কিনব, তোর মা কে বলবি ভাইফোঁটাতে গিফট দিতে। আসলে দেখ কেউ বোকার মতো পেডং থেকে সিল্ক রুট ধরে বর্ডারে সহজে যায় না, কারণ , রাস্তাটা খুবই খারাপ, আবার অন্য দিকে নাথুলা পাশে আর্মিদের কড়াকড়ি। ইন্সপেক্টর লামা এটা জানতেন, তাও আমাদের ওই রুট টার কথা বললেন, জালে পড়লো আমাদের থেন্ডাপ সাহেব”।
“ইয়েস মামা, ওদিকে। বিন্দ্রা আঙ্কেল আর তথাগত’দা লাটাগুড়ি এরিয়া ব্লক করেই ছিল, যেদিকে পালাও ধরা পড়তোই”, আমি বললাম।
“এক দম ঠিক, থেন্ডাপ যখন দেখল, আমাদের আর বোকা বানাতে পারছে না অ্যান্ড মিঃ লামা তার বাহিনী নিয়ে হাজির, তখন শুরু করলো ফায়ারিং । কতক্ষণ আর চলে ওই রিভলভারে, তারপর তুই ব্যাথা জায়গায় দিলি দুঃসাহসিক ভাবে সামার সল্ট। ব্যাস মুখ থুবড়ে পড়লো। আর হাতকড়া পরার আগেই ধাঁই করে তোকে দিল”, বলে মামা প্রান খুলে হাসতে শুরু করলো।
৮
আজ আমরা ফিরব। বিন্দ্রা আঙ্কেল আই কেসটা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরেছেন। তথাগত’দা এলেন।
“ আবার এস কিন্তু , এবার যা ঝামেলা গেল”। মিষ্টি একটা হাসি হেসে বললেন।
মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ স্যার সুন্দর বনে থাকার সময় একবার একজনের সাথে দেখা হয়েছিল, কি যেন বেশ নাম, হুম মনে পরেছে, আব্দুল রজ্জাক, কথায় কথায় আপনার কথা বলেছিলেন”।
মামা মুচকি হাসি হেসে বলল, “ আমি আবার কি করলাম,ভাই ?”
“ আর স্যার কি যে বলেন আপনি তো ছোট ইলিশ যারা বেআইনি ভাবে ধরে তাদের একটা গ্যাং কে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, এর জন্য আপনি পুরস্কারও পান”
মামা যেন লজ্জায় মিশে যেতে চাইছে। কোন ভাবে নিজেকে সামলিয়ে বলল, “ধুর ও এমন কিছু না, আমি ঘুড়ে বেড়াই আর ওই টুকটাক লিখি, নিজের চলে যায়। তবে হ্যাঁ, অন্যায়কে মানতে পারি নি আর হয়ত পারবোও না”।
আমি যত শুনছি ততই অবাক হচ্ছি, মামা তলে তলে এত কান্ড করে , পুরস্কার পায় কিছুই তো জানি না, এটাই শুধু জানি মামা নাকি একটু ক্ষ্যাপাটে, বাউন্ডুলে, আর ওই কি সব লেখে, তা নিজেও কোনোদিন পড়ে দেখি নি । আজ কেন জানি না নিজের কাছে নিজেকেই ছোট লাগছিল।
আরও খারাপ লাগছিল এই ভেবে যে সন্দেহ করা ভালো, কিন্তু একটুতেই পুরো সন্দেহ বা অভিযোগ করা ঠিক না, যখন মামা তথাগত’দা জিজ্ঞাসা করলেন উদগ্রীব হয়ে, “ ভাই, বেচুং কেমন আছে ? ডাক্তার কি বললেন ? ইস, আমরা একবারও পারলাম না যেতে”।
জীপটা করে ফিরছি। মামা কে জিজ্ঞাসা করলাম, “ কি হয়েছে বেচুং এর ?”
মামা শুধু বলল, “ ও তো ফরেস্ট অফিসে কাজ করে, তাই, আই অভিজানে ও গিয়েছিলো মিঃ লামার সাথে, যখন ফায়ারিং হয় তখন তোকে গার্ড করতে গিয়ে গুলি লাগে”। একটু থেমে আবার বলল, “ টুটুন জীবনটা খুব ছোট্ট, কিন্তু এই ছোট্ট জীবন্টাকে সুন্দর করা দরকার, শুধু একটু ভালবাসলে। চিন্তা করিস না ভালো হয়ে যাবে বেচুং”।
পিছনে পরে রইল লাটাগুড়ির জঙ্গল, পরে রইল প্রকৃত সভ্যতা ।।
১
সেবার হোস্টেল থেকে ফেরার পথে মনে হচ্ছিল যে আমি বাসে না নৌকায় চেপে ফিরছি । যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি । বিশাল বিশাল নদী যেন আমাদের ঘাড়ে এসে, গিলে খেতে চাইছে। হুম, টি-ভি, এফ বি মানে ফেসবুকে , অ্যাপে নানা জায়গায় ভিডিও দেখেছি ঠিকই কিন্তু এমন অবস্থায় নিজে ইতিপূর্বে পরি নি ! আমার কি হবে...এ দেখে মামা আসবে কি!! এ যে নিদারুণ বন্যা...হায় হায় এ কি !! নানা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক দিতে লাগলো। অনেক দিন পর পুজোর ছুটিতে বাড়ি ফিরছি।
গ্রাম এখন আর সেই আগের মত নেই, অনেক উন্নত। আর আমি শহরেই জন্মিয়েছি, শহরেই কিছুদূর পড়ে সোজা বাইরে, আমি যাতে ভালো মানুষ হই তার জন্য হোস্টেলে পাঠিয়েছে। বাসে বসে বসে বেশ মজাই লাগছিল। যেখানে যেখানে বৃষ্টি থেমেছে, জল উপচে পরছে সেখানেই ছেলে – বুড়ো সব্বার হাতে একটা করে ছিপ, মশারির ছেঁড়া অংশ, মাছ ধরছে আর হাতে ঝোলানো ডিব্বায় টুক টুক করে পুড়ছে। অবশ্য ছোট ছোট মাছ। আবার কোথাও বড় পুকুরকে বিশাল বিশাল জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। বেশ দেখা যাচ্ছে, মাছ গুলো বেরোতে না পেরে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে। চারিদিক সবুজ। কোথাও কোথাও আবার খেজুর গাছগুলো যেন গলা জলে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দেখতে দেখতে কখন যে বর্ধমানে পৌঁছালাম খেয়াল করি নি। ঘড়িতে চোখ ফেলতেই দেখি বেলা ১২ টা, কিন্তু এত মেঘ থাকার জন্য মনে হচ্ছে এই তো সবে সকাল হল। বাস যদিও বর্ধমান শহরে ঢোকে না, বাইপাসের উপর প্যাসেঞ্জার থাকলে তবেই দাঁড়ায়। বাইপাস থেকে আমাদের বাড়ি যেতে হলে সাইকেল রিক্সা ছাড়া গতি নেই। ভর দুপুরে হঠাৎ আমাকে দেখে মা বুঝতে পারলেন না কি বলবেন! বাবা এখন অফিসে, আসতে দেরী আছে। মা মুখ খুলতে যাবেন তার আগেই একটু অভিমানী সুরে বললাম, “ না গো বাবা, কোন ঝামেলা করি নি। পরীক্ষা শেষ, প্রিন্সিপাল স্যারকে বুঝিয়ে চলে এলাম”।
জামা কাপড় ছেড়ে সটান স্নান করে আসতেই মা বললেন, “ টুটুন, খেতে দিয়েছি, খেয়ে যা ইচ্ছা করো”। মায়ের গলায় যেন কি একটা সন্দেহের কাঁটা বিঁধে আছে। অবশ্য এর কারন, আমি খুব একটা ভালো তো নই। দুবার মারপিট করার জন্য সাসপেন্ড হয়েছি। কি করি বলুন আমার কথা কেও বুঝতেই চায় না! ক্লাসের পড়ার ফাঁকে আমার চোখ চলে যায় বাইরে। মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে খুচ খুচ করে টাইম পেলেই ছবি তুলি। যাইহোক, আমি লক্ষী ছেলের মতো খেতে খেতে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ মা, মামা এবার কবে আসছে?”
“ আসবে তিন চার দিনের মধ্যেই”- গম্ভীর গলায় মা বলে রান্নাঘরে ঢুকলেন। মা এর এই হচ্ছে সমস্যা। আমি আসলেও চিন্তা আর দেরী করে আসলেও গভীর চিন্তা, মা’দের এটা চিরকালীন প্রথা। বাবার সাথে আমার বেশী বন্ধুত্ব, মায়ের ভাষায় ‘আদিখ্যেতা’। মা যতই গজ গজ করুক আমি আসলে রান্নার হাতটাও খুলে যায়। খেয়ে পেটটা জয়ঢাক করে নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে মামার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল বাবার আলতো ডাকে, “ টুটুন, বাবু ওঠ! সন্ধ্যে বেলায় ঘুমাতে নেই”। চোখ খুলেই দেখি বাবার মিষ্টি হাসি মুখ, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
“বাপী, দেখো না মা কেমন মুখটা গোমড়া করে আছে”- আমি কথাটা বলে উঠতেই মা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, “ কি করব বল! তোমার যা কাজকম্ম, কোনদিন কি সুস্থ ভাবে এসেছ ? এবার হাত পা সব গোটা আছে দেখে অবাক হচ্ছি”।
বাবার চোখের ইশারাতে চুপ করে থাকলাম। বাবা বড্ড শান্তিপ্রিয় মানুষ। আড়াল থেকে ইঙ্গিতে বললেন, “ চুপ, এখন কড়াইতে তেল ফুটছে, ঠাণ্ডা হলে কথা...”।
মা ঘড় থেকে বেড়িয়ে যেতেই বা্বা বললেন, “ টুটুন, মামা তো পড়শু আসছেন, কোন প্ল্যান...”। বাবার কথাতে মাথায় এলো, মামা আসলে আমাদের বাড়িতে খুব জোড় একদিন থাকেন, তারপর নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন। আমার মামার এই বাতিক নাকি ছোট থেকেই। চাকরি- বাকরি করেছেন, তবে তা ছেড়েওছেন নিজের মর্জিতে। কিছু টাকা জমলেই বেড়িয়ে পড়েন নানা জায়গায়। বিয়ে করেন নি। একটাই ব্যাগ, পায়ে চটি , টি- শার্ট আর হাফ প্যান্ট। অবশ্য এ রকম মামার সংখ্যা বা তাদের মুখ দিয়ে শোনা গল্প সারা বাংলায় খুব একটা কম নেই। একটাই পার্থক্য আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মত , প্রাণখোলা হাসি শুধু আমার সাথেই মামার । আর নানা মজার মজার গল্প। হুম কিছু কিছু পারসন্যাল কথাও হাল্কা স্বরে হয় বৈ কি।
“বুঝলে বাপী, এবার মামাকে ধরবো। ধূর এবার কোথাও ঘুড়ে আসব। প্রতিবার মামা নিয়ে যাবো বলে নিজেই টুক করে বেড়িয়ে পড়ে। আর বেরোয় তখনই, যখন আমি ঘুমাই। এবার সেটা আর হচ্ছে না”, উত্তেজিত হয়ে বললাম।
মা আর বাপী মুখ খোলার আগেই আবার বললাম, “ প্লিজ, ঘড় শত্রু বিভীষণ হয়ে সব কথা মামাকে আগেই ফাঁস করে দিও না”।
রাতে ঘুমটা অল্পতেই চলে এলো। আজ মন ফেসবুকে নেই। বুকটা শুধু যেন বলছে কখন আসবে সেই সময়।
২
“ বুঝলি রুপা মালাইকারিটা জব্বর হয়েছে, আর দে তো কটা ভাত”, মুখের মধ্যে হাফ চিংড়ী ঢুকিয়ে মামা চোখ বন্ধ করে খেতে খেতে মাকে বলল।
বাউন্ডুলে এই মামার প্রতি মা রেগে থাকেন ঠিকই কিন্তু চোখের সামনে আসলে সেই রাগ যে কোন দরজা দিয়ে পালায় তা ভগাই জানে। মা অপত্য স্নেহে তার এই দাদাটিকে ভাত দিয়ে নরম গলায় বললেন , “ তা এবার কোথা থেকে আসা হচ্ছে শুনি!”
মামা একগাল হেঁসে আমার দিকে চোখ নাচিয়ে বলে, “ টুটুন বেড়াল দেখেছিস!” আমি তো উত্তর শুনে হতবাক।
“আরে অবাক হস না, তোর মা ঠিক ওই বিড়ালগুলোর মত; ঠিক টুক টুক করে আমাদের গপ্প লুকিয়ে লুকিয়ে শোনে”। ব্যাস আর যায় কোথা, দাদা আর বোনের মধ্যে লাগলো বিশ্ব যুদ্ধ। ফাঁক বুঝে আমি কেটে পড়লাম।
দুপুরে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে প্রকান্ড একটা হাঁই তুলে মামা জড়ানো গলায় বলল , “ টুটুন, মায়ানমারের নাম তো শুনেছিস। বাংলাদেশের সুদূর দক্ষিণে, বর্ডার অঞ্চল”।
মামার কোল ঘেঁষে পাশ ফিরে বললাম, “ এবার বল”।
“কি বলব?” অবাক হয়ে মামা দাঁত খোঁচানো থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। বুঝলাম, মামার এটা হচ্ছে পলিসি। তাই আমিও চুপ করে থাকলাম।
“ নাফ নদী বাংলাদেশ আর মায়ানমারের মাঝ দিয়ে বয়ে যায়। নদীর পূর্বে মায়ানমার আর পশ্চিমে আমাদের বাংলাদেশ। উঁহু টুটুন, গুগুল ঘাটলেই কি সব জানা যায়? হুম কিছু তথ্য জানতে পারবি ঠিকই কিন্তু মজা পাওয়া যাবে না”, মামা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল। হাত থেকে মোবাইলটা সরিয়ে রেখে বললাম , “তা তুমি বল”।
“জায়গাটার নাম ‘তেকনাফ’, বণ্য প্রানী আছে, আছে নানা পাহাড়ী প্রজাতির পাখি। অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য। নদীর বালির চর ধরে যত এগিয়ে যাই ততই প্রকৃতি অসামান্য রুপ নেয়। চারিদিকে পাহাড়- কুল কুল করে বয়ে যায় নাফ নদী। যে দিকে তাকাও সবুজ আর সবুজ”। কিছুটা থেমে নিজের মনেই মামা বলল, “ ভাগ্যিস আব্দুল ভাই নিয়ে গেছিল, না হলে এসব দৃশ্য দেখতেই পারতাম না”।
মা যে কখন বেগুনি আর চা নিয়ে হাজির হয়েছে খেয়ালই করি নি। আসলে মা তার এই একমাত্র দাদাটিকে অসম্ভব ভালোবাসেন। দেশ ভাগ যে কি যন্ত্রণার কতটা বেদনার তা আমিও ছোটবেলায় দিদার মুখে শুনেছি। বাংলাদেশ যে কতটা সমৃদ্ধ তার রেশ দিদার স্বরে ঝরে পড়তো। শস্য – শ্যামলিমায় ভরা বাংলাদেশ।
সন্ধ্যেবেলার একটু আগেই আজ বাবা চলে এসেছেন তার একমাত্র শ্যালকের জন্য, হাতে ইয়া একটা রসগোল্লার হাঁড়ি আর দোকান থেকে কাটিয়ে আনা খাস পদ্মার ইলিশ।
আমাদের বাড়িতে রাত ৯টার মধ্যেই ডিনার হয়। মামার ভ্রমণের গল্প শুনতে বেশ ভালই লাগে কিন্তু আমার মন আজ পরে আছে অন্য দিকে। “বাবুন, বাংলাদেশ তো ঘুরলে, তা এবার কোন দিকে?”বাবা মামাকে প্রশ্ন ছোঁড়েন। আমার মুখ হাল্কা হাসিতে ভরে উঠল । বাবা ঠিক আমার মনের অবস্থা ধরেছেন।
“এখনও কিছু ঠিক করিনি জাম্ব”, মামা খাওয়া থামিয়ে বাবাকে বলে। মামা বাবাকে জাম্ব বলেন সর্টে । তারপর আমার দিকে তাকাতেই আমি কথা ঘুড়িয়ে বললাম, “ মামা, আমার এক বন্ধু বলছিল যে , বাংলাদেশে নাকি জ্যান্ত ইলিশ কিনতে পাওয়া যায়?”
আমার কথায় বাবা, মা, মামা সব আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠল। আমি থম মেরে যাওয়াতে মামা খোঁচা মেরে বলল, “ কেন তোর গুগুল কি বলে! দ্যাখ টুটুন ইলিশ জ্যান্তই থাকে, তবে ওদের ডাঙায় ওঠালেই মরে যায়”।
আমি বড় বড় চোখ করে ভারী গলায় বললাম , “তাহলে আমার ফ্রেন্ড কি ভুল বলেছে? ও খোদ বাংলাদেশের”।
“হুম কোন কোন জায়গায় অবশ্য পাওয়া যায়, ধর, কুমিল্লা, চাঁদপুর এইসব অঞ্চলে। জেলেরা নদী থেকে মাছ আনেন, তখন হয়ত তোর ফ্রেন্ড দেখতে পারে। আর মজা কি বলত, ওইসব জায়গায় মাছ কিন্তু কেজি তে বিক্রি হয় না”।
“তবে !”- বিস্ময়ে বললাম।
মামার বদলে বাবা বলে উঠলেন, “ ওখানে ‘ঠিকা’ হিসাবে বেচে”।
আমাদের মৎস পর্ব সবে শেষ হয়েছে মায়ের তাড়ায়। বাবা এর ফাঁকে টুক করে মামাকে বলেন, “ বলছিলাম কি টুটুনের পরীক্ষাও শেষ যদি...”।
বাবার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, “ মামা খুব ঘুম পাচ্ছে , চল শুতে চলো”। আমার অভিসন্ধি বাবা বুঝে গিয়ে চুপ করে হাসতে লাগলেন।
মামা আসলে আমি আর মামা একসাথেই শুই। এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। শুয়ে আছে মামা, কাল চলে যাবে। এখনও আমার মনের কথা বলি নি। কিন্তু এবার নো ছাড়, মনে মনে জেদ করে নিয়েছি। মামাকে আদর করে গলা জড়িয়ে আব্দারের সুরে বললাম, “ মামা, এবার আমাকে নিয়ে কোথাও চল বেড়াতে”।
“ মানে!” মামা যেন কারেন্ট খেল আমার কথা শুনে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “ টুটুন, আমি জানি তুই বড় হয়েছিস, কিন্তু তুই তো জানিস আমি একা মানুষ, নিজেরই কিছু ঠিক থাকে না”।
‘আমি কিছুই জানি না। এবার নিয়ে যেতেই হবে। তোমার সাথে গেলে কত কি জানতে, দেখতে, শিখতে পারবো। তারপর হোস্টেলের ফ্রেন্ডদের মজা করে শোনাব”।
“ও কে – কাল সকালে এ নিয়ে কথা বলব”, মামা কথা না বাড়িয়ে ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে নাক ডাকাতে শুরু করে দিল। নাক আজ যত ইচ্ছা ডাকুক, আমি আজ একদম ডিস্টার্ব করব না, সব সহ্য করব। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। এই নীতি নিয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম।
৩
আমাদের রাত ১১-৪৪ মিনিটে দার্জিলিং মেল। বর্ধমানে ঢুকতে ঢুকতে ১২ টা হয়ে যায়। শিয়ালদা থেকে মেনলাইন ধরে বর্ধমান ষ্টেশনে আসে। বহু কষ্টে আমার জন্য একটা টিকিট বাবা জোগাড় করেছেন। মামার তো আগেই রিজার্ভ করা ছিলই। যদিও আমার আর মামার একই বার্থে হল না, কিন্তু নো প্রবলেম, যাওয়া তো হচ্ছে। এ আনন্দ বর্ণনা করা যায় না। মা মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন, বাবা আর মামা আমার পুরো সঙ্গ দেওয়াতে আপত্তি আর ধোপে টেকেনি। যেহেতু রাতে ট্রেন সুতরাং রাতে ঘড় থেকে খেয়েই বেরলাম। আমাদের বাড়ি থেকে ষ্টেশন বেশী দূরে নয়। যথারীতি ট্রেন আসলো, মা তার উপদেশাবলী সব মায়েদের মতই দিলেন ।
রাতের অন্ধকার ভেদ করে দার্জিলিং মেল ছুটল নিউ জলপাইগুড়ির দিকে। মাঝ রাত, চারিদিক কাঁপিয়ে দুরন্ত বেগে ট্রেন ছুটে চলেছে। জানলা দিয়ে মুখ বার করে দেখলাম, কামরার হাল্কা আলো পাশে পাশে দৌড়াচ্ছে পাল্লা দিয়ে।
বেশ দেরি করেই ঘুম ভাঙল। মামা বলল, “ ব্রেকফাস্ট কিছু খেয়ে নে, আর এত বেলা করে উঠলে চলবে না। আমার সাথে থাকতে গেলে ঘুমটা একটু কমাতে হবে”।
আমি কল দেওয়া পুতুলের মত মাথাটা এদিকে ওদিকে দুলিয়ে সম্মতি জানালাম। একটু লেট করেছিল, তাই নির্ধারিত সময় থেকে ৩০ মিনিট দেরীতে ষ্টেশনে ঢুকল। মামা জিনিসপত্র নামাতে নামাতে বলল, “টুটুন বাবু এই বার শুরু হবে আমাদের জার্নি”।
ষ্টেশনের বাইরে দুপুর হলেও হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আমরা চটপট বাইরে একটা হোটেল থেকে মাছ-ভাত খেয়ে নিলাম। যদিও আমার খাওয়ার ইচ্ছা একদমই ছিল না। এটা হোটেল! মামা আমার মনের কথা বুঝেই গলা ঝেড়ে হেসে বলল, “এটাই দারুন হোটেল রে, ওঃ ডালটা দেখ কি চমৎকার”।
আশে পাশে দোকান থেকে শুকনো কিছু খাওয়ার কিনে ট্রেকার রিজার্ভ করলাম। এখন আমাদের যেতে হবে লাটাগুড়ি হয়ে চাপড়ামারি ফরেস্টে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে প্রথমে আরও উত্তরে লাটাগুড়ি যাবো সেখান থেকে একটু বাঁ দিক ৩০ কিলমিটার ঘেঁষে ৩১-সি জাতীয় সড়ক ধরে গেলেই ৯৬০ হেক্টরের বিশাল অভয়ারণ্য।
মামা গাড়ীর গোঁ গোঁ আওয়াজের সাথে পাল্লা দিয়েই জায়গাটার ইতিহাস বলতে শুরু করলো কারন মামা বলে, যেখানে যাবি সেখানকার হিস্ট্রি একটু জেনে রাখা ভালো, “ টুটুন, এই হল চাপড়ামারি Wildlife sanctuary”। মামার গলায় উত্তেজনা ভরপুর। আমারও একই হাল।
একজায়গায় গাড়ী দাঁড় করানো হল, চা খাব। কিচ্ছুক্ষণ আগেই খেয়েছি, এখন খিদে খিদে লাগছে। ব্যাগ থেকে কেক বার করে মামাকে আর দাফা মানে আমাদের ট্রেকারের চালককে দিলাম। চারিদিকে অসম্ভব সবুজ। সুবিশাল গাছ। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।
দাফা ভালই বাংলা জানে, চা খেতে খেতে গাইডের মত করে বলল, “ বাবু, সরকার, মানে ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৫ তেই এই জঙ্গলকে National Reserve Forest হিসাবে আখ্যা দেয় ,পরে ১৯৯৮ তে ভারত National Wildlife sanctuary পরিনত করে”।
কাছাকাছি নদী বলতে – তিস্তা, নেওড়া আর মূর্তি। বর্ষার জলেই পুস্ট । আমরা যখন যাই তখন নদীগুলো টই টম্বুর। এবছর অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া এ অভয়ারণ্য মনসুন থাকার জন্য জুন থেকে সেপ্টেম্বর অব্ধি পুরো বন্ধ থাকে। মাঝের এই আটটা মাস খোলা। কপালে থাকলে এই সময় নানা জন্তু- জানোয়ার দেখা যায়। এই অঞ্চলে যেটা বেশী দেখা যায় তা হল হাতি। পেপারে মাঝে মধ্যেই এখানকার কথা আসে, ট্রেনে কাটা পরে হাতির মৃত্যু। জঙ্গলের মাঝ বরাবর রেল লাইন চলে গেছে, জঙ্গল পারাপার করতে আবার হাতিরা এই লাইন পার করে, ফলে বিপত্তি। তবে সরকার ব্যাবস্থা নিয়েছেন।
আমাদের গাড়ী আধাপাহারী, আধাকাঁচা কালচে লাল পথ পেরিয়ে একটা ব্রিটিশ আমলের বাংলোর সামনে ঘ্যাঁচ করে দাঁড়ালো। বিস্তৃত জঙ্গলের মাঝে সাদা আর লাল টালি টাইপের বাংলোটা সহজেই মন কেড়ে নেওয়ার মত । মামার কাছ থেকে জানতে পারলাম, মামা যেকোন ভাবেই হোক এখানকার ফরেস্ট অফিসারের বাংলোটি জোগাড় করেছেন কয়েক দিনের জন্য। আর এই সব সরকারি বাংলো সহজে মেলে না। যাইহোক আমার প্রান কিছুটা ধড়ে এলো। আমাদের গাড়ী দেখে একজন হাফ শার্ট আর প্যান্ট পরা লোক হাত কচলাতে কচলাতে কাছে আসলে,মামা তার মাঝারি হাত ব্যাগ থেকে একটা কাগজ দেখানোর সাথে সাথেই লোকটির চওড়া মুখে এক গাল হাসি। বুঝলাম, কাগজটা হল এখানে থাকার পারমিশন লেটার। বেশ বেলা হয়ে গেছে। সূর্য ক্রমশ তার রঙ হারাচ্ছে। প্রকৃতির সব রঙ যেন খুব ধীর লয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে এই জঙ্গলের মাঝে ক্রমান্বয়ে। অঙ্কন : পবিত্র চক্রবর্তী
হাত ঘড়ি দেখে মামা হাঁক ছাড়ল, “ বাবা বেচুং , ঘড়ের লাইট যে টিম টিম করছে, যাইহোক,খেতে দিতে কি দেরী আছে ?”
বেচুং - এর মুখে একটা কোমল হাসি, ডালু সম্প্রদায়ের লোক, খাটো মজবুত পা। একসময় এরা পাহাড়ি এলাকায় চাষ আবাদ করতো, কিন্তু সময়ের তালে তাদের জীবিকারও পরিবর্তন হয়েছে। কিছুটা দুর পড়াশুনাও করেছে। জঙ্গলের এই বাংলোয় বেশ কিছু বছর কাজ করার ফলে এখানকার রাস্তাঘাটও প্রায় মুখুস্থ। মন দিয়ে আমি আর মামা হাল্কা আলোয় রুটি আর ডাল সিদ্ধ খেতে খেতে শুনছিলাম। পাহাড়ের সব জায়গায় এখনও ইলেক্ট্রিসিটি পুরপুরি আসে নি। সাড়ে সাতটা বাজতেই অন্ধকার হয়ে যায়, আবার আসে পরেরদিন সকালে। ভাগ্য ভালো সরকারি ঘড়ে আছি। পাশাপাশি দুটো খাটকে জুড়ে দিয়ে মনগড়া পালঙ্ক করে নিলাম।
লাইট অফ আর করতে হল না, নিজের থেকেই তিনবার ব্রেক ড্যান্স দেখিয়ে বাল্বটি নিদ্রা দিতে চলে গেলেন। সে তো ঘুমাতে গেলেন, মামার নাকের সুখকর আওয়াজ নির্জনতাকে বাড়ালেও আমার আর ঘুম আসে না।
“টুটুন, এই টুটুন”, মামার চাপা শব্দে ধড়মড়িয়ে উঠলাম।
অবাক হয়ে তাকাতেই চোখটা বন্ধ হয়ে গেল। কষ্ট করে খুললাম, দেখি মামা টর্চ হাতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিস্ময়ে প্রশ্ন করতে যাবো কিন্তু মামা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল। ব্যপারটা কি জানার চেষ্টা করতেই মামা খোলা জানলার দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল। ভরা পূর্ণিমার আলোয় অন্ধকারে ডুবে থাকা গাছগুলোর মাথা চিকচিক করছে।
“চল বেরোই, আওয়াজ করিস না, বেচুং জানতে পারলেই বাগড়া দেবে”, মামার এহেন প্রস্তাবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েও উঠে পরলাম। জানি পাগল মামার সাথে থাকতে গেলে আমাকেও পাগলামি করতে হবে।
হাল্কা টর্চের আলোয় জঙ্গুলে পথ হাঁটছি। ভাগ্য ভালো ক্যাঁচ করে লোহার দরজা খোলার শব্দ বেচুং –এর কানে যায় নি। মামা যেন এ পথ কত জানে, এভাবে দিব্যি হাঁটছে। অবিশ্যি আমারও ক্রেডিট আছে, দুবার গর্তে পা পড়লেও সামলে নিলাম।
“তোমার উদ্দেশ্য কি বলতো, গোয়েন্দা গল্পের কোন অভিযান নাকি” – শীতের রাতেও ঘামটা মুছতে মুছতে জিজ্ঞাসা না করে আর থাকতে পারলাম না।
মামা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ খেপেছিস নাকি, আমি আবার গোয়েন্দা হতে যাবো কোন দুঃখে ! বেশ আলো করা রাত, ফাঁকা জঙ্গল, লোভ সামলাতে পারলাম না”।
যত শুনছি তত বিষম খাচ্ছি মনে মনে। কিছু করার নেই, তাছাড়া আমারও বেশ লাগছিল। মামার সাথে না থাকলে এ ধরনের অভিজ্ঞতা হবে না। এদিকে আমরা কতটা পথ এসেছি জানা নেই। ফিরব কি ভাবে তাও অজানা। শেষে এই জঙ্গলে হারিয়ে যাবো না তো! মনে হাজার কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। আর ঠিক এই সময়েই অসম্ভব তীক্ষ্ণ অথচ জোড়াল হাতির ডাক শোনা গেল। মামা সঙ্গে সঙ্গেই টর্চ নিভিয়ে পাশের ঝোপে আমাকে সজোরে টান দিয়ে ঢুকিয়েই খুব আস্তে আস্তে কানের কাছে মুখ নামিয়ে যা শোনাল তাতে আমার আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে পালানোর জন্য রেডি, “ ওরে, শুনেছিলাম পূর্ণিমার রাতে হাতির দঙ্গল বের হয়, ওটাই দেখানোর জন্য তোকে নিয়ে বেড়িয়েছি। এ সব অরিজিনাল , টি ভি তে তো সবাই দেখে”।
চাঁদের আলোয় দূরে বেশ কিছু সচল পাহাড় দেখছি, মনে হল বেশ কটা আছে, সঙ্গে কয়েকটি বাচ্চা।
নির্বিঘ্নে ডাল পালা মড় মড় করে ভেঙ্গে খাচ্ছে। সময় কত পেরল জানি না, দুজনেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। মশা যে কয়েক লিটার রক্ত খেল তার দিকেও হুঁশ নেই। হুঁশ ফিরল ফট করা হাল্কা অথচ গম্ভীর শব্দে। দূরে মনে হল একসাথে কয়েকটা গাছ ঝুপ ঝাপ করে পড়ে গেল।
৪
“পাংলাবসলোম ছাম উৎসবে ভিড় প্রতিবারই হয়। এবারেও যথারীতি হয়েছে, নানা জায়গার লোকের অন্ত নেই এই মনোরম মরশুমে। রাবাংলা থেকে সারচোগ ভেপুগ গুম্ফা অনেকেই...”, থেমে থেমে কি বেশ ভাবতে ভাবতে বলছিলেন মিঃ বিন্দ্রা - ইনস্পেক্টর ক্রাইম ব্রাঞ্চের। মাঝে মধ্যে চায়ে হাল্কা চুমুক।
সঙ্গে ফরেস্ট রেঞ্জার তথাগত রায় ভ্রূ কুঁচকে চোয়াল শক্ত করে হাতের আঙুল গুলো মটকাতে মটকাতে মুখটা তুলে বললেন, “ কি যে হচ্ছে বুঝতে পারছি না, রাবাংলার সারচোগ ভেপুগ গুম্ফা থেকে এত সিকিউরিটি থাকা স্বত্তেও উধাও হল কি করে”।
তথাগত রায়, বয়েস কম । অসম্ভব ভালোবাসেন জঙ্গল। ছোটবেলার ইচ্ছা পূরণ করে তিনি আজ ভালো পোস্টেই আছেন। ছটফটে। নতুন জয়েন করেছেন। আগে সুন্দরবনে পোস্টিং ছিলেন। সম্প্রতি কয়েক মাস হল এই এলাকায়। আজ বিশেষ আমন্ত্রনে মিঃ বিন্দ্রা তার অফিসে এসেছেন। আর সেই সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে গুম্ফার কথাটা ওঠে। যদিও অধিকাংশ লোকের কানে এখনও খবরটা চাউর হয় নি।
হঠাৎ চা খাওয়া বন্ধ করে মিঃ বিন্দ্রা ভাঙ্গাচোরা বাংলায় জানতে চাইলেন, “ মিঃ রায় কেউ ধরা পরল কি ? দেখুন এই সব জায়গা থেকে বর্ডার কিন্তু বেশী দূরে নয়। একবার বেরোলেই ব্যাস আমাদের হাত আপাতত ভাবে বাঁধা হয়ে যাবে”।
অফিসের ফোনটা বাজতেই হাত বাড়িয়ে তড়িঘড়ি ফোনের রিসিভার কানে তুলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তথাগত বললেন, “ হুম, কখন। ও. কে, ওনাদের থাকতে বল, আসছি”।
“ যাবেন নাকি মিঃ বিন্দ্রা ? বাংলোটা থেকে ঘুড়ে আসি। ক্লু হয়ত পেতে পারি”। হাল্কা হেসে বললেন তথাগত।
গাঢ় তুঁতে রঙের জিপটা বন-বাংলোর সামনে দাঁড়াতেই বেচুং দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলেই পেল্লাই একটা স্যালুট ঠুকল। বারান্দা থেকে লক্ষ করলাম বেচুং দুজন বেশ হাট্টাকাট্টা লোককে নিয়ে আমাদের দিকেই আসছে। মামা নিজের মনে কাল রাতে যেখানে ছোরে গিয়েছিল সেখানে ওষুধ লাগাতে লাগতে ফুঁ দিচ্ছে। কথাটা জানাতেই মামা বারান্দায় বেরিয়েই , “ আরে, বিন্দু যে” – বলেই বেশ লম্বা লোকটির দিকে এগিয়ে গেল। মিঃ বিন্দ্রাও হো হো করে হেসে মামাকে জড়িয়ে ধরলেন।
“তারপর তুই এখানে, আয় আয় । বেচুং, চার কাপ চা নিয়ে আয়, আর হ্যাঁ, একটাতে চিনি ছাড়া” – কথা গুলো বলেই মামা বিন্দ্রা সাহেবের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচিয়ে হাসল। ভাব এমন, দেখেছ ভায়া এখনও মনে আছে।
তথাগত রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন মিঃ বিন্দ্রা। তথাগত মানুষটিকে আমার প্রথম থেকেই বেশ ভালো লাগল । পারমিশন পেয়ে আমি দাদা সম্বোধন করলাম। লোকটি স্মার্ট, মিশুকে। প্রকৃতি যেমন দরকারে অপরুপ রুপ নেয় আবার দরকারে ভয়ংকর, তথাগত’দাও ঠিক সেইরকম। চা খেলেন বিস্কুট গুলোকে পাশে সরিয়ে । অল্পেই আমাদের চারজন বেশ কাছের হয়ে গেলাম। এখানে বলে রাখি, মামা জীবনে হয়ত সে ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নি, কিন্তু তার পরিধি অনেকটাই বিস্তৃত । তিনি লেখক হিসাবে অনেকটাই নাম করেছেন। তাছাড়া তার প্রচুর ঘোরার জন্য অনেকেই তাকে চেনেন। মিঃ বিন্দ্রা মামার ছোটবেলার বন্ধু, বলা যায়, স্কুল লাইফের। তিনি লাটাগুড়ি পুলিশে আছেন কর্মরত বেশ কিছু বছর।
“ ভাই তোমাকে আমি নাম ধরেই বলছি, কিছু মনে করো না। হুম, কাল রাতে যেটা হল সেটা খুব একটা ভাল হল না। ভাগ্যিস বেচুং ছিল, আমরা অনেক্ষণ ফিরছি না দেখে ওই ভোররাতে আমাদের খুঁজে উদ্ধার করে বাংলোয় নিয়ে আসে”, মামা এক নিঃশ্বাসে তথাগত’দার তাকিয়ে বলে গেল।
“দেখুন হাতিটার দেহ আমরা পেয়েছি, খারাপ লাগছে। এমনিতেই ফি-বছর ট্রেনে কাটা পরে অকালে হাতি শেষ হচ্ছে, তার উপর ফরেস্ট গার্ড থাকা স্বত্তেও চোরাশিকার। কালকে যা হল। ভিজিট করার পর আমার অনুমান সত্য – একটা দাঁত কেটে নিয়ে গেছে, পূর্ণ বয়স্ক হাতি না”- কথাগুলো যেন অন্য তথাগত বলল, চোখ দুটো রাগে লজ্জায় জ্বলছে।
নিশ্চুপে সব শুনছিল মামা। মিঃ বিন্দ্রা গলা ঝেড়ে বললেন,“ আজ সকালেই তথাগতর ফোন পাওয়ার আগেই রাবাংলা ডিভিশন থেকে আমার কাছে ইনফরমেশন আসে যে, ওখানকার আবার ভেপুগ গুম্ফা থেকে প্রাচীন বৌদ্ধ চিত্র ভ্যানিস। আর ঘটেছে কাল রাতেই কাকতালীয় ভাবে”।
দূরেই বেচুং আমাদের কথা মন দিয়ে শুনছিল। সবাই কথায় ব্যাস্ত থাকার জন্য সেদিকে কারো লক্ষ না গেলেও আমার চোখে চোখ পরা মাত্রই সুট করে সরে পরল। আমি একটু এগিয়ে এদিক ওদিক চাইতে কোথাও আর দেখতে পেলাম না।
একটু্ পরেই ওরা গাড়ীর কাছে গিয়ে হ্যান্ডসেক করে যাওয়ার আগে বলে গেলেন টাচে থাকতে। ধোঁয়া আর কালচে লাল ধুলো উড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল।
দুপুরে খাওয়ার খেতে খেতে আজ মামাকে প্রথম দেখলাম এতটা গম্ভীর। বেচুং চুপচাপ পাশে বসে বসে মড়া হাতিটার গল্প বলছে। আশ্চর্য হলাম একটা কথায়, হাতিটার পেট থেকে কিছুটা অংশের ছাল কেটে নিয়ে গেছে। সাধারণত হাতির দাঁত কেটে নিয়ে যাওয়ার কথা আগে বেশ শুনেছি কিন্তু ছাল! মামাকে জিজ্ঞাসা করতেই ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল, “ এত বড় ফরেস্ট। দুটো লাইট আর কটা গাদা বন্দুক দিলে এই হয়। আরে প্রপার মডার্ন ইকুপমেন্ট না থাকলে সব শেষ হবে একদিন”। আমার উত্তর না পেয়ে দমে গেলাম।
“টুটুন বাবা, তুমি শুয়ে পর, কাল রাতে তোমার উপর বেশ ঝড় গেছে। আমি একটু চারপাশটা ঘুরে আসি” বলেই আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেড়িয়ে গেল। বুঝলাম, মামা কোন বিষয়ে চিন্তায় আছে, তার কারণ, মামার মুখ থেকে তুমি খুবই কম বেরোয় আমার বেলায়, আর যখন ...।
“সাব, আমি আমার ঘড়টাতেই আছি কোন দরকার পরলেই ডাক দেবে”, বেচুং – এর কথায় চিন্তায় ছেদ পরল। একটা জিনিস, কালকের পর থেকে বেচুং –এর মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। বার বার জঙ্গলের দিকে তাকাচ্ছে, আমাদের কথাগুলো তখন ওই ভাবে শুনছিল, কেমন যেন অস্থিরভাব।
ছালটার কথা চিন্তা করতে করতে মনটা চলে গেল তরাইয়ের এই সবুজ অরণ্যের দিকে। অরণ্য প্রাচীন কাল থেকে কত ভাবে আমাদের সমৃদ্ধ করেছে, আর আজ তারাই বিপদের মুখে। প্রকৃতি তার শোধ তো নেবেই। একবছর আগেই হিমালয়ান সুনামি তার ফল। কেদারনাথ, বদ্রীনাথকে মানুষ যেভাবে গ্রাস করেছিল তার ফলও হাতে নাতে পেয়েছে।
বিকাল পাঁচটা, ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথে সূর্য মামাও অনেক্ষণ আগেই হেলে পড়েছে। জঙ্গলে এটাই হয়। যেবার বাবা মায়ের সাথে গোমুখ গিয়েছিলাম, তখনই বুঝেছিলাম পাহাড়ি এলাকা আর জঙ্গলে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মামা কই! বেচুং! সেই বা গেল কোথায় ? বাইরে বেড়িয়ে ডাক দিলাম। ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ভয়টা কেন জানি না বেশ জমিয়ে বসতে শুরু করবে ঠিক তখনই দেখি মামা দূরে টর্চ জ্বালাচ্ছে আর নেভাচ্ছে, গায়ে কাঁটা দিল, কোন সিগন্যাল দিচ্ছে নাকি! না, মামা গুণ গুণ করে গান করতে করতে কাছে আসতেই আর থাকতে পারলাম না। মুখ খোলার আগেই মামার পিঠে দুম করে কিল মেরে বললাম, “ কি পেয়েছ অ্যা! আমাকে একা ছেড়ে ঘুড়ছো আর এদিকে বেচুং হাওয়া!”
মামা সেই পুরনো ফিচেল হাসি হেসে মুখ ভেংচিয়ে বলল, ‘ সে কি রে তুই ভয় পেলি !! এই তুই হোস্টেলের মারকুটে ছেলে! ছ্যা ছ্যা, ফ্রেন্ডসরা সব জানলে তোকে ..., বেচুং কে আমি পাঠিয়েছি। আজ বন-মুরগি খাবো”।
৫
শিলিগুড়ি থেকে রাবাংলা একশো কুড়ি কিলোমিটার, আমাদের এখান থেকে মোটামুটি নিরানব্বই কি একশো হবে ৩১ সি থেকে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক দরে আমাদের গাড়ী ছুটে চলেছে । মাঝে মাঝে সাপের মতো এঁকে বেঁকে, কখনবা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। দূরে পাহাড়ি বাচ্চারা ফাঁকা রাস্তায় দিব্যি ঝক ঝকে স্কুল ইউনিফর্ম পরে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। এখানে , আমাদের ওখানকার মত কোন ওষুধের দোকান নেই বললেই চলে, খুঁজে পেতে বহুদূরে একটা। পরিবেশ মানুষকে কতটা সুন্দর ভাবে রাখতে পারে। আর আমাদের ওখানে এক পা এগোতে না এগোতে সার সার দিয়ে ওষুধের দোকানের বৈচিত্র্য। বাড়ির কথা মনে পরতেই মামাকে বললাম, “মা কে তো খবর দেওয়াই হয় নি, নেটওয়ার্কের যা প্রবলেম !”
“ কি রে বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে টূটূন ! আমি ওয়্যারলেসের মাদ্ধমে খাবর দিয়ে দিয়েছি। কোল ড্রপ ইস্যু জালিয়ে খেলো” – মামার কথাতে মনটা আস্বস্ত যেমন হল তেমনি লজ্জাও একটু পেলাম। ভাবুক গিয়ে মামা যা ইচ্ছা। যেদিন ঘুষি মেরে নাক ফাটাবো সেদিন ঠ্যালা বুঝবে। অঙ্কন : পবিত্র চক্রবর্তী
পাহাড়ি জায়গার এই হচ্ছে ঝামেলা, রাস্তা ফুরাতেই চায় না, দু- ঘন্টার রাস্তা আট ঘন্টা লাগিয়ে দেয় । বেলা সাড়ে তিনটের সময় রাবাংলার একটা হোটেলে আমাদের গাড়ি থামল। শুকনো ভাত আর স্রেফ ডালটা তখন মুখে অমৃত লাগছিল। মামাই বলেছিল খেয়ে নিয়ে রুমে যেতে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাওয়ার সময়ে একটা কালো জ্যাকেট পরা লোক প্রায় ঘাড়ের উপর ধাক্কা মেরে পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই আমি রেগে হা করার আগেই লোকটি একবার মুখটা ঘুরিয়ে ডান হাতটা হেলিয়ে সরি বলেই খানিকটা জোড়েই দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। রুমের লক খোলাই ছিল। চটপট পরিষ্কার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। খানিক বাদেই মামা ঢুকতেই মামাকে ঘটনাটা বললাম। মামা দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে জিভে টক টক আওয়াজ করে বলল, “ ও এমন হতেই পারে, বুঝে গেছে মারকুটে ছেলে এসেছে”।
সিকিম এমনিতে খুবই পরিষ্কার জায়গায়, মনে হয়ে ভারতের বাইরে কোন একটা সুন্দর সাজানো দেশ। খুব জোড় রাত আটটা তারপর রাস্তা-ঘাট অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায় । মামা হোটেলের লোককে বলল আমাদের খাবার রেখে দিতে। দুজনেই চুপচাপ হাঁটছি, বেশ ঠাণ্ডা লাগছে এবার। পকেটে হাতটা ঢোকাতেই কি যেন বেশ হাতে ঠেকল। আন্দাজে জিনিসটাকে বার করতেই দেখি একটা গোলাপি ভাঁজ করা কাগজের টুকরো। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে মামা তাড়া লাগাতেই মামাকে দেখালাম। রাস্তাটা একটু অন্ধকার, কাছের ঢালুতে একটা ল্যাম্পপোস্টের কাছে কাগজের ভাঁজটা মামা খুলতেই বলল , “ যা হরি, বেশ তো ! এ যে থ্রেড লেটার ! কি জ্বালা”।
আমিও অবাক। ঘুড়তে এসে এসব আবার কি! আর মামা কোনদিনও গোয়েন্দাগিরি করেছে বলে আমার তো স্মরণে আসছে না। তবে এমন চিঠি! ঠোঁটটা কামড়ে ধরে উত্তেজিত হয়ে পরলাম। তবে এক দিকে ভালই হয়েছে, অনেকদিন হাত পা চালাই নি, জমে যাবে বেশ জমজমাট কিছু হলে।
“টুটুন, চল হোটেলে ফিরে যাই, রাতও হল”, মামা একটু ঠাণ্ডা গলায় বলল।
হেসে বললাম, “এই বার ভয় পেয়েছ, চল বাবা, তোমার যদি কিছু হয়ে যায় মা আমাকে আস্ত রাখবে না”। মামাও হো হো করে হেসে পা চালাল।
হোটেলে ঢোকার মুখে রুম সার্ভিস বয় মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “স্যার, খেয়ে উপরে চলে যান, রাত হলে খাবারটা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে”। একদম ঠিক কথা, সারাদিন ভালো করে পেটে কিছুই পরে নি, আমারা ডাইনিং রুমে খেতে বসলাম। হঠাৎ , আমার চোখ বাঁ পাশের একটু দূরের টেবিলে চলে গেল, দুপুরবেলার সেই লোকটাই তো, সঙ্গে আরেকজনের সাথে ঘাড় নীচু করে কথা বলছে। ব্যাপারটা জানাতেই মামা আস্তে করে বলল, “ হুম , লাটাগুড়ি থেকেই আমাদের গাড়ীর পিছনে ছিল, তুই এখন দেখলি নাকি !”
ভ্যাবাচাকা খেয়ে মামার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। রুমে যেতেই মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম কি করে জানলো। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে হাঁই তুলে বলল , “ সিম্পল, গাড়ীটি সিকিমের কারণ, নম্বর প্লেট, চা খাওয়ার টাইমে লক্ষ করেছিলাম। অ্যান্ড সেকন্ডলি, লোকটির নাম থেন্ডাপ, লেপচা”।
বিস্ময়ে বললাম, “ নাম আবার কি করে জানলে ? বাকিটা নাহয় লজিক্যালি বলা যায়...”
“ তুই ধাক্কা খাওয়ার আগে রিসিপসনে রেকর্ড বুকে নাম লেখার টাইমে দেখলাম , যদিও অ্যাড্রেস দিয়েছে শিলিগুড়ির , তাছাড়া কনফার্ম হলাম ডান হাতের কব্জির কাছে ডিপ করে TH লেখা ট্যাটুটা দেখে”।
যত শুনছি তত অবাক হচ্ছি। হাল্কা রেগে গিয়ে বললাম , “ যখন জানোই এত কিছু, তাহলে থ্রেড লেটারটার বিষয়ে তো কিছু বললে না”।
“কি বলবো! ধুর ওটা পড়তে অমন লাগছে, আসলে ওটা ইনফরমেশন দিল, সাবধানে থাকবেন, আমরাও আছি”।
বেশী রাত হয় নি, ঘুমও আসছে না, কি করি । মামাও চুপচাপ, খুব একটা উত্তর দিচ্ছে না, কেবল ভ্রুটা কুঁচকে আছে। আমিও টুরিস্ট গাইড খুলে পড়তে শুরু করলাম। মনে হচ্ছে সমস্ত হোটেল ঘুমিয়ে পড়েছে। মামা হাত দুটো টানটান করে বলল, “শুয়ে পড়। আকাশ পাতাল চিন্তা করতে হবে না, কাল একটু ভোর ভোর কাছা কাছি সারচোগ ভেপুগ গুম্ফা থেকে ঘুড়ে আসব”।
হাত ঘড়িতে দেখলাম রাত দশটা । লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। মাথার মধ্যে একটা কথা ঘুরে ফিরে আসছে,খাওয়ার সময় থেন্ডাপ যখন কথা বলছিল, হঠাৎ ওর জ্যকেটে একটু টান পরায় কোমরের কাছে কালো মতো কি যেন চকচক করছিল , রিভলবার কি? কিন্তু মামা যে বলল ,নো প্রবলেম!
৬
ভোর চারটে। মামার টানাটানিতে ঘুম ভাঙল। সঙ্গে মৃদু ধমক, “ তুই ঘুমা, ঘুরতে এসে শুধু ঘুম! চটপট রেডি হও”।
রুম বয় চা দেওয়ার পর জানাল, “ সাব গাড়ী একটু পরেই চলে আসবে, রেডি হয়ে যান”।
ফ্রেশ হয়ে আধা অন্ধকারে হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁইটা পুরো না হতেই দেখলাম, মামা দিব্যি গল্প জুড়েছে থেন্ডাপের সাথে। থেন্ডাপ আর একজন মামার সাথে কি কথা বলছে আর মাঝে মধ্যে হো হো করে হাসছে। ওদের আলাদা গাড়ী, বাঁচা গেল। কেন জানি না প্রথম থেকেই লোকটার প্রতি আমার বিরক্ত ভাব লাগছে। আমাদের গাড়ী আসার আগেই ওদের গাড়ী রওনা দিল। মামা কাছে আসতেই হেসে হেসে জানাল, “ জানিস টুটুন থেন্ডাপ বলে লোকটি ভারী চমৎকার, কে বলবে লোকটির ষাট বছর বয়স! পাহাড়ি মানুসদের এই একটাই মজা বয়স বোঝাই যায় না”।
কথা বলতে বলতেই আমাদের গাড়ী চলে এলো। বেশ ইয়াং ড্রাইভার। কে জানে বাবা, দেখে তো লাগছে চব্বিশ – পঁচিশ । গালে চাপ দাড়ি, সাধারনত পাহাড়িদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না, যদিও আজকাল সবই প্রায় ফ্যাশন আর হ্যাঁ বেশ মিশুকে। রাবাংলা থেকে গুম্ফা বেশী দুর নয়, ম্যাক্সিমাম দু কিলোমিটার, কালকেই গাইড বইতে পড়ছিলাম। সঙ্গে আমাদের বিশেষ কিছুই নেই, বেশ ঝারা হাত পা। মামা তার মাঝারি ছোট হাল্কা ছাল ওঠা হাত ব্যাগ নিয়েছে। গাড়ী ছাড়তেই সুন্দর নেপালি সুরের গান চালিয়ে দিল চ্যাং ; আমাদের ড্রাইভার , নামটা মনে পরতেই ফিচ করে হেসে ফেললাম। গাড়ী চলেছে এঁকে বেঁকে, পাহাড় জেগে উঠছে, সোনালী আভা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, বেশ মনোরম। মাথার টুপিটা এঁটে বসালাম, মামাও ইতিমধ্যে মান্ধাতার আমলের জ্যেকেটের চেন টেনে বসে আছে জানলার দিকে মুখ করে, মাঝে মধ্যে নিজেই শুনতে পাবে এমন বেসুর সুরে গুন গুন করে গাইছে, কিছুই বোঝা গেল না।
“আরে ! থেন্ডাপ অ্যান্ড কোম্পানি কি করছে !”প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম। মামা “রক্কে” বলে উঠতেই চ্যাং এর গাড়ী কিছুটা দুর গিয়েই ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। লাফ দিয়ে মামা দরজা খুলেই বেড়িয়ে গেল। আমিও পিছু নিলাম।
থেন্ডাপ মন দিয়ে ছবি এঁকে চলেছে, পরছে নানা রঙের টান । কাছে যেতেই দেখলাম দৃশ্যটা। অদূরেই নীচে পরে আছে একটা লম্বা টাইপের নলের মতো মোটা কি যেন, পরে বুঝলাম, আর্ট পেপার যাতে নস্ট না হয়ে যায় তার জন্য পেপার রোল করে এর মধ্যে রাখা যায়। আমাদের দেখেই, হেসে বললেন, “ তোমরাও কি গুম্ফা ?”
“ আমরা গুম্ফা না, গুম্ফা দেখতে যাচ্ছি”, কথাগুলো হাল্কা রেগেই বললাম বদমাশটাকে, উফ, কি জোড়টাই না ধাক্কা মেরেছিল ।
“বাব্বা, এত সুন্দর জায়গায় রেগে রেগে কথা বলতে নেই” বলেই হা হা করে হেসে উঠলো।
মামা চুপচাপ পেইন্টিঙটা দেখছিল, আমাদের দিকে কোন কানই যেন নেই; মাঝে সুন্দর বলল, “বাহ, চমৎকার আঁকার হাত তো , অনেক দিন আঁকছেন তাই না মিঃ থেন্ডাপ”!
“ইয়েস স্যার , হুবুহু না হলেও যা দেখি তা আঁকি, জায়গাটা চমৎকার, নির্জন”, শেষের কথাগুলো একটু জোর দিয়েই মাথা ঝাঁকিয়ে জানালেন।
“ও. কে, আপনি কাজ সারুন, আমরা বরং এগোই”, বলে মামা আর আমি একটু এদিক ওদিক হাত পা চালিয়ে লাফালাফি করে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর মামা থম মেরে বলল, “যাই বল, হাতটা কিন্তু মন্দ না, বলা যেতে পারে একদম প্রফেশনাল”।
গাড়ীর গতিটা একটু ধীর হল, চ্যাং গালে হাত দিয়ে জানাল “ ধস সাফ হচ্ছে, সামনে জ্যাম স্যার”। কি আর করা চ্যাং এর সাথাসাথি আমরাও নামলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম থেন্ডাপদের গাড়ীটা আর কায়েকটা গাড়ীর পিছনেই থেমে গেল। মনে মনে ভাবলাম বেশ হয়েছে, দেখ কেমন মজা।
মামা কাছাকাছি হাঁটছিল, হঠাৎ দৌড়ে এসে গাড়ীতে বসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “ চ্যাং, আর কতক্ষণ! গাড়ী হোটেলে নিয়ে চল”। চ্যাং কি ভাবল কে জানে ,আমি তো ভ্যাবাচাকা।
“কি হল তোমার”! মামা নখ চিবোতে চিবোতে বলল, “ গণ্ডগোলে ব্যাপার রে ভাই”।
ইতিমধ্যে চ্যাং কি কায়দা করে গাড়ী ঘুরিয়েছে কে জানে, থেন্ডাপদের গাড়ীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ওদের গাড়ীতে ড্রাইভার ছাড়া কেও নেই। চ্যাং ওদের ভাষাতে কি জিজ্ঞাসা করলো কে জানে! আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুধু বলল, “হোটেল”।
পাশ কাটাতে কাটাতে চ্যাং এর গাড়ী ছুটল হোটেলের দিকে। বাইরের দৃশ্য দেখার মন আর কারোরই নেই। মামা কাকে যেন ফোন করে বলতে লাগলেন, “হুম। আসছি, ঠিক ঠিক...”। এ অবস্থায় কিছু আর জিজ্ঞাসা করের সাহস পেলাম না কারণ মামার এই নব কলেবর ফার্স্ট দেখছি।
কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ী হোটেলের কাছে আসতেই দেখি বাইরে ভীড়। মামা লাফ দিয়ে নেমে বলতে বলতে গেল, “ তুই রুমটায় যা তো, আর দেখ ভেতরটা”। চ্যাং উত্তেজিত হতেই মামা হাত দিয়ে ইশারা করে দাঁড়াতে বলেই ছুটে ভিতরে ঢুকল। আমরাও পিছু নিলাম।
হোটেলের ম্যানেজারের রুমটা খোলা, একটা গোঙানির শব্দ। আমি কয়েকটা সিঁড়ি লাফাতে লাফাতে এসে দেখি আমাদের রুম খোলা, কারা যেন মামার ব্যাগ আর আমার রুকস্যাকটা টানাটানি করে খোলার চেষ্টা করেছে। জামা কাপর গুলো এদিক ওদিক ছড়ানো।
নীচে নেমে মামার কানে কানে বলতেই ভ্রূ ধনুকের মতো করে বলল, “ লাভ নেই কিছু”। আবার অন্য একজন স্টাফকে বলল ডাক্তার ডেকেছে কিনা!
একটু পরেই লোকাল পুলিশ হাজির, সঙ্গে ডাক্তার। মামার পরিচয় জানতেই মামা বলে উঠলো, “ স্যার আমার পরিচয় মিঃ বিন্দ্রার কাছ থেকে জেনে নেবেন, আপাতত বলুন চায়না বর্ডার যাওয়ার রাস্তা ক্লোজ করতে পারবেন কিনা!”
কি ভাবল ভগাই জানে পুলিশ। ইনস্পেক্টর একটু খানি চুপ করে কাকে যেন ফোন করলেন ভুটিয়া ভাষায় বোধ হয়। এখানকার সব ভাষায় মনে হয় এক। খানিকটা হিন্দি ওয়ার্ড থাকায় অনুমান করার চেষ্টা করলাম মাত্র, বুঝলাম, কাকে যেন কি ইনফরম করছেন। আবার ফোন লাগালেন, এবার “স্যার” আর “মিঃ বিন্দ্রা” এইটুকু বলতেই বুঝলাম যে মামার সম্পর্কে কনফার্ম হলেন।
মামা অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললে, “ স্যার জি কনফার্মড হলেন ?”
অফিসার কাঁধ নাড়িয়ে একটু হেসে ভাঙাচোরা বাংলায় বললেন, “ ডোন্ট মাইন্ড স্যার, হোপ ইউ ক্যান... বুঝতেই পারছেন। বাই দ ওয়ে আই অ্যাম ইনস্পেক্টর ওয়াঙ্গেল লামা, আপনি আমাকে লামা বলতে পারেন”।
“ তা মিঃ লামা, ডাক্তার কতক্ষণে আসবেন” কথাটা পুরো শেষ হওয়ার আগেই হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তার হাজির। ম্যানেজারকে কি যেন জিজ্ঞাসা করে খচ খচ করে ওষুধ লিখে দিয়ে মাথা বেশ ঢাউস একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে বললেন, “ওষুধ লিখে দিয়েছি, মাথায় বেশ জোর একটা মোটা কিছু দিয়ে মেরেছে”।
মামা মিঃ লামাকে কি যেন বলল, অন্য একজন কনস্টেবল ম্যানেজারের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত কড়া পড়াতেই ম্যানেজার হাঁউ মাউ করে কেঁদে উঠল। মিঃ লামা এক ধমক লাগাতেই চুপ ক্তেইথম মেরে গেল। বাইরের পুলিশ ভ্যানে তুলেই মিঃ লামা বললেন, “ মিঃ। সি, দেয়ার আর টু ওয়েস , একটা থ্রু ইয়ান্থুম হয়ে জিরো পয়েন্ট দিয়ে নাথুলা পাশ আর একটা পেডং অ্যান্ড দেন সিল্ক রুট টু বর্ডার...”।
মামা রেগে গিয়ে মিঃ লামার কাছে গিয়ে বলল, “ ধুর মশাই, কি করতে পুলিশে জব করছেন ! নাথুলা পাশ দিয়ে বর্ডার যাবে না , কজ দেয়ার হেভ মেনি আর্মি চেকপোস্টস”।
“দেন...” অত বড় অফিসার ওইটুকু বলেই চুপ, কি জানি কি মনে হল আবার মোবাইলে কি যেন ধমক দিতে দিতে বললেন।
চ্যাং এতক্ষন চুপ করে সব দেখচ্ছিল আর মন দিয়ে শুনছিল, সে চটপট করে মামার কাছে এসে বলল, “ এনি হেল্প স্যার ?”
“হেল্প মানে, সাংঘাতিক হেল্প দরকার। দৌড়াতে হবে পেডং বাট উই হ্যাভ নো টাইম, জিতনা জলদি হো দৌড়াও”।
মামা উত্তেজিত হলে বেশ সুন্দর গুছিয়ে কাজ চালাবার মতো ভুলভাল ইংলিশ বলে, তার পর আজকের ঘটনা, পুরো ভাষাটা পাঁচ মিশালি তরকারি। এর মধ্যেই ফিক ফিক করে হেসে ফেলেছি দেখে মামা গুম হয়ে ভেংচিয়ে বলল, “ নে নে ইঞ্জিরি পুত্তুর, আমি পাতি বাঙলা মিডিয়ামের, তাও তো বলছি। যা জলদি আমাদের রুম লক করে বেড়িয়ে আয়”।
সিকিমের রাবাংলা থেকে আমাদের যেতে হবে প্রায় পশ্চিম দিকে, সেই পাহাড় আর খাদের পাশ কাটিয়ে। তবে খাদ গুলো খুব একটা ভয়ংকর না, ভয় পেলেও মানিয়ে নেওয়া যায়। পাকা ড্রাইভার চ্যাং, ফাঁকা পেলেই তুলছে স্পীড। খিদে পেলেও এখন মাথায় উঠেছে খাওয়া । মাঝে মধ্যে মামা মোবাইলে প্রায় চিৎকার করে বলছে, “ আরে বাবা, ওখানেই থেকো... এই রে নম্বর...”
চ্যাং বেশ জোড়ে বলল, “স্যার ... ০০৯২”।
গাড়ী এত স্পীড নিয়েছে যে মামা শুধু অ্যা অ্যা ০০৯২ বলেই ফোন রেখে দিল। অনেকটা রাস্তা যাওয়ার পর বুঝলাম এটা পেডং এর কাছাকাছি, বাস স্ট্যান্ড, ট্রেকার দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কই ০০৯২!! আর একটু এগোতেই পেডং ফুটবল গ্রউন্ড। আরও গেলে প্রায় তিব্বতের সীমানা। আমাদের গাড়ী এগোচ্ছে। কিছুদূরেই বৌদ্ধদের মৃতদেহ সমাধি স্থল, বেশ নির্জন। লোক জন নেই বলা যায়, চারিপাশে পাহাড়, আর বড় বড় গাছ, খানিকটা জঙ্গল। অজানা পাখির হাল্কা ডাক। দুপুর প্রায় গড়িয়ে পরেছে। কিছু লেপচা মহিলা পীঠে ঝুড়ি নিয়ে আধা ঝুঁকে হেলতে দুলতে বাড়ীর দিকে ফিরছে। চ্যাং জানাল গাড়ী চালাতে চালাতেই এরা কাছাকাছি ঝুলুক গ্রামে থাকে, তাছাড়া এই দিকে তেমন কোন বসতি নেই। মামা যেন সব শুনেও শুনছে না , অন্য দিকে মন, কি যেন একটা চিন্তা করেই চলেছে।
চিন্তার রেশ কাটতে না কাটতেই চ্যাং গাড়ী সজোরে ব্রেক কোষে থামাল, সামনেই ০০৯২ । টায়ার পাঞ্চার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । চ্যাং বুদ্ধি করে ০০৯২ মার্কা গাড়ীটার সামনে আড়াআড়ি করে দাঁড় করিয়ে রাখলে, ভাবটা এমন বাছাধন গাড়ী নিয়ে পালাবে কোথায় ? মামা চটপট গাড়ী থেকে নেমে কাছে যেতেই দেখল খালি গাড়ী। আমরাও মামার পিছনে পিছনে সাবধানে এলাম, বলা যায় না কি কান্ড ঘটে যেতে পারে!
একটু ভালো করে দেখতেই বোঝা গেল ড্রাইভার গাড়ীর নীচে কি যেন ঠিক করছে, আমাদের চোখে চোখ পরতেই হাত দুটো থেমে গেল, পকেট থেকে কিছু বার করার আগেই আমি বেরিয়ে থাকা ছোট ছোট পা দুটো ধরে হিড় হিড় করে টেনে বার করলাম। চ্যাং কি জানি কি বুঝেছে, কলার চেপে ধরল। পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু বার করতেই আমি হোস্টেল মুডে ফিরে এলাম। ক্যাঁক করে এক ফ্রি কিক পেটে মারতেই লোকটা ওক করে উঠলো। একটু ঝিমিয়ে পড়ে আবার একটা হাত কোনমতে ছাড়িয়ে পকেট থেকে প্রায় এক বিঘত ধারালো স্প্রিং ছুড়ি বার করেই চোখের নিমেষে চ্যাং এর কোমরে মারতেই চ্যাং ছিটকে পরে গেল। মামা ছুটে এসে চ্যাং কে তুলে ধরে বসাল। চ্যাং এর মুখ বিকৃত করে মামাকে বলে, “ ক্যাচ হিম, ক্যাচ হিম”।
লোকটি পালানোর তাল করতেই মারলাম এক ভল্ট, সজোরে পায়ে এক লাথি, পরে যেতেই সপাটে এক থাপ্পর। অনেকদিন পর হাতের সুখ মিটছে। লোকটির মুখের কষ বেয়ে রক্ত পরছে। বুঝতে পারলাম আমি কখন এতটা সাহসী হয়ে গেছি এই অজানা জায়গায়। গলাটা প্রায় টিপে ধরে চিৎকার করে বললাম, “বাকি গুলো কোথায় ? তোর থেন্ডাপ কোথায় পালাল ?” কাহিল হয়ে লোকটি হাত দিয়ে দেখিয়ে বলার চেষ্টা করলো গাড়ী খারাপ হয়ে যাওয়ার জন্য ওরা অন্য গাড়ী বেরিয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে চ্যাং আর মামা হাজির। চ্যাং এর জামাটা ভিজে গেছে কিন্তু সাবাস চ্যাং নিজের জামা খুলে খত জায়গায় কষে বেঁধে নিয়ে জানলো, উঠে পরতে গাড়ীতে। মামা গাড়ী চালাতে পারবে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই কষ্ট করে হেসে গাড়ীতে ওঠার জন্য ইশারা করলো। আমরা ওকে ছেড়ে চ্যাং এর গাড়ীতে চাপতেই ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়ী চলল আরও এগিয়ে। অন্ধকার নামতে বেশী দেরী নেই। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর গাড়ী আর নড়তে চায় না, তেল শেষ।
হঠাৎ, দূরে একটা হাল্কা লাইট চোখে পরতেই চোখ আড়াল করে আমরা দেখলাম একটা গাড়ী আমাদের দিকেই আসছে। হুড়মুড়িয়ে আমাদের সামনে ব্রেক কষে দাঁড়াতেই, মামা অস্ফুট ভাবে বলে ওঠে, “আরে মিঃ লামা যে !!” আমিও অবাক হয়ে গেলাম। ইন্সপেক্টার লামা লাফ দিয়ে নেমে বললেন, “চটপট উঠে পড়ুন স্যার,ওয়্যারলেসে খবর এসেছে”। মনের ভিতর আনন্দে নেচে উঠলো। কিন্তু জানতাম না এরপর কি ভয়ানক পরিস্থিতে পড়তে চলেছি।
৭
শীতের মিঠেকড়া রোদে আমি প্রায় হাফ শোয়া । ইন্সপেক্টর বিন্দ্রা, তথাগত’দা আর মামা জমিয়ে আড্ডা মারছেন সামনের বাঁধানো বারান্দায়, সঙ্গে টুকটাক ভাজা আর চা। তথাগত’দা কুচো মাছ ভাজা চিবাতে চিবাতে বলেন, “ বুঝলেন স্যার, এই মাছ সাধারন ভাবে বাজারে খুব একটা পাওয়া যায় না, তিস্তার ধারে লোকাল লকেরা আই মাছ গামছা দিয়ে ধরে, চমৎকার টেস্ট”। মামা ও বিন্দ্রা সাহেব ঘাড় দুলিয়ে সহমত প্রকাশ করলেন। আমি লোভ আর সামলাতে পারলাম না। যদিও ঘাড়ের ব্যাথাটা আছে কিন্তু আগের থেকে কম। আমাকে আসতে দেখে তথাগত’দা হাত নেড়ে জোড়ে বলে উঠলেন, “ সো ব্রো, আর ইউ ফাইন নাও! কম অন”
“আরে তুই উঠে এলি, ঠিক আছিস তো ?”উত্তেজিত হয়ে মামা বলল। উফ ভগবান মামা যেন সব না বলে বসে, মামার আবার তাল থাকে না কখন কি বলতে হবে, হুম যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়।
“ বাবা টুটুন, তাড়াতাড়ি ঠিক হো, না হলে তোর মা আমাকে আস্ত রাখবে না। এক রদ্দায় ছেলে আমার কুপোকাত” মামা বেশ মজা করে বললেও গা জ্বলে উঠলো শুনেই।
“ আহা, ও যা করেছে, ওটাই বিশাল , কজন পারে ফাইট করতে”, বিন্দ্রা সাহেব হাসতে হাসতে মামাকে থামিয়ে বললেন।
“না স্যার এবার আমাদের উঠতে হবে, বেশ খানিক কাজ পরে আছে”, বলে তথাগত’দা উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে মিঃ বিন্দ্রা সম্মতি জানিয়ে বললেন “ইয়া, এবার মামা ভাগ্নে ইনজয় অ্যান্ড গল্প করো”। মামার সাথে হ্যান্ডসেক করে আর মাথায় হাল্কা হাত বুলিয়ে দুজনেই রওনা দিলেন।
আমরা এখন সেই চাপড়ামারির ফরেস্ট বাংলোয়। তবে মামা যে এমন করবে ভাবতেও অবাকও হচ্ছি আবার গর্বও লাগছে। এই মামাকে কেওই খুব একটা প্রাধান্য দেয় নি। যদি আমি না আসতাম আর ঘটনাটা যদি না ঘটত তাহলে মামার আর এক দিক যা জানতাম না তা দেখতে পেলাম।
রাতে হরি বলে নিপাট এক বাঙালী বাংলোর কেয়ারটেকার খাবার দিয়ে যেতেই বিস্ময়ে ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বেচুং কই ? প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল, আগে জানলে ব্যাটাকে দিতাম”।
“কাকে, বেচুংকে কেন ! আর তোর মারপিট করতে হবে না বাপ। হ্যাঁ, বেচুং যা করলো তা ভুলবার না”, মামা খেতে খেতে জানালো।
“কি হয়েছিল বলবে কি হেঁয়ালি না করে, খুব ক্রেডিট নিচ্ছ। কিছু জায়গায় তো আমি নিজেই জানি না”, একটু রেগে গিয়ে বললাম।
“টুটুন আসল কালপ্রিট কে বলতে পারিস ? দেখি কেমন তোর বুদ্ধি”।
“কে আবার, ইটস ভেরি সিম্পল, বেচুং হল ঘটনার পান্ডা”, আমার কোথায় মামা হো হো করে হেসে বলল, “হল না বাবু, কেসটা অত সহজ না যতটা ভাবছিস বাট ইয়েস, আমি তোদের জেনারেসনকে থ্যাংকস জানাই, স্পেসিয়ালি ট্যাটু অ্যান্ড লো ওয়েস্ট জিন্সকে”।
আমি অবাক হয়ে খাওয়া বন্ধ করে ঘাড়টা কোনমতে উঁচু করেই বললাম,” মানে! ট্যাটু আর জিন্স এর কি সম্পর্ক?” মামা চুপ করে হাসতে দেখে আবার বললাম, “ও বুঝলাম, থেন্ডাপ, তাই তো ? বাট এর সাথে জিন্স কি ভাবে এলো”।
মামা হা হা করে করে খাওয়া ফেলে বলে, “ আরে অত ঘাড় জোড় করে উঁচু করিস না, ভেঙে যাবে! আর ধীরে বৎস ধীরে, হুম তুই ঠিকই ধরেছিস , মজা কি জানিস, থেন্ডাপ কিন্তু আমাদের সাথেই সবসময়ই ছিল, আমাদের চ্যাং বাবাজী রূপ নিয়ে”। আবার অবাক হওয়ার পালা, বলে কি মামা, চ্যাং!
“ কিন্তু মামা, চ্যাং কি করে হয়, আমাদের বাঁচাতেই তো বেচারা ছুরি খেল যে !”
‘তো কি হয়েছে, মরে তো নি, আর বড় বাপারে হাত মারতে গেলে ওই সামান্য আঘাত সহ্য করা যায়, কি জানিস , চমৎকার একটা ড্রামা হল আই দুদিন ধরে”।
“ঝেড়ে কাশো তো, হলটা কি”, আমি আর থাকতে না পেরে বলে উঠলাম, না শুনলে আমার খাবার হজম হবে না।
“ শোনো বাছা, হোটেলের থেকে থেন্ডাপদের গাড়ী আগে বেরিয়ে ছিল এটা সত্যি, থেন্ডাপ ছবি আঁকছিল এটাও সত্যি, ভুলটা হল রাস্তা, মানে রাবাংলা থেকে দুভাবে গুম্ফা যাওয়া যায়। চ্যাং যে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সে জানত ওখানে রাস্তা বন্ধ, তাও নিয়ে গেছিলো কারণ আমরা ওখানে আটকিয়ে গেলে থেন্ডাপ সহজেই মাল পাচার করতে পারবে...”
মামাকে বাধ্য হয়ে থামালাম কারণ বেশ কিছু জায়গায় জট পাকিয়ে যাচ্ছিল, মনের ভাব বুঝতে পেরে নিজেই বলল, “ তোর মত অবস্থা আমার হয়ে গিয়েছিল রে, স্রিফ একটা ভেল্কি। মনে আছে আমরা কিছু মিনিটের জন্য থেন্ডাপের ছবি দেখতে গিয়েছিলাম , ওখানেই যা হয়ে যায়। আমরা মুগ্ধ হয়ে ছবি দেখছি, আর এদিকে চ্যাং হল থেন্ডাপ আর থেন্ডাপ হয়ে গেল চ্যাং, ছিল বিড়াল হল রুমাল”
“মানে”
“ মানে সহজ, দাড়ি অদল বদল, চ্যাং এর দাঁড়িটা ছিল ফলস আর যেহেতু প্রকৃতি গত কারনে আমাদের কাছে সব পাহাড়ের মানুষদের মুখ প্রায় এক রকম লাগে, এখানেও হল তাই। মোদ্দা কথা চ্যাং এর দাড়ি পরল থেন্ডাপ আর হয়ে গেল চ্যাং। তার থেকে বড় জিনিস আর্ট পেপার রাখার বড় রোলটা, মোটা প্লাস্টিকের রোল। ওটা সুট করে আমাদের গাড়ীর ডিকিতে ট্রান্সফার হয়ে গেল, কারণ ওরা জানতোই আমাদের গাড়ীতে রাখলে নো প্রবলেম, পুলিসের সঙ্গে আমার মটামুটি ভালই হাত আছে তা বুঝেই গিয়েছিল”- এতটা বলে মামা থামলেন।
“তারপর, তারপর কি হল?”
“ তারপর, চটপট খেয়ে নিয়ে ওষুধ লাগিয়ে শুয়ে পর, শুয়ে শুয়ে গপ্প বলছি”, মামা মুর্গীর ঠ্যাং চিবাতে চিবাতে বলল।
রাতটা বেশ সুন্দর, পূর্ণিমার সেই আলো নেই, কিন্তু মোটামুটি ভাবে চারিদিক দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে। হক হক করে কি যেন একটা রাতের পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। অদূরে কিছু হাল্কা হাতির ডাক। হুম এই ডাক শুনেই মনে পরে গেল যে হাতিটা মারা পড়ল, তাদের কি হল? আর অদ্ভুত ভাবে যে ছালটা কেটে নিয়েছিল! তার?
মামাকে ঠেলে বললাম, “এবার তো বল, ছাল – দাঁত ওই গুলোর কি হল?”
হাল্কা ধমক দিয়ে লম্বা হাঁই তুলে বলল, ‘ টুটুন, শুনেছিলাম তুই নাকি অঙ্কে খুবই ভালো, জানিস তো স্টেপ জাম্প করলে কি হয় ? তোর তাড়া কিসের ?”
কি করে বোঝাই আই ভদ্রলোককে যে আমি আর পারছি না। যাই হোক মামা আমার অবস্থা টের পেয়ে হাসতে হাসতে বলল, “ হোটেলের ম্যানেজার কিন্তু রিয়েল মার খেয়েছিল আমরা বেরনর আগেই, যা আমরা টের পাই নি। কারনটা অবশ্য ওদের নিজেদের মধ্যে টাকার বখরা নিয়ে ঝামেলা, ম্যানেজার শাঁসালে, খায় ওই মোটা প্লাস্টিকের রোলের জোড় ঘা। এটা যদিও মিঃ লামা আমাকে পরে জানিয়েছিলেন”।
এর মধ্যে হরি আম্য একগ্লাস দুধ দিয়ে গেল। মামা দরজা বন্ধ করতে করতে মুখ ভেংচে বলে, “খাও সোনা” কিছু করার নেই। বিপাকে পরলে এমনই হয়। যদিও মামা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, আমাদের মধ্যে এমন চলে, ভাগ্য ভালো এমন ফ্রেঙ্ক মামা পেয়েছি।
মশারির মধ্যে আমার ঘুম হয় না, কিন্তু এখানে টাঙাতেই হবে না মশারা আমাদের জঙ্গলে উঠিয়ে নিয়ে চলে যাবে। ঘড় এখন পুরো অন্ধকার। শুধু পাওয়া যাচ্ছে মামার গলার স্বর। “ আমরা ফাঁকা গাড়ী দেখলাম কখন বলত টুটুন ? হুম মনে আছে নিশ্চয়, চ্যাং কিন্তু মাঝ রাস্তায় গাড়ী নিয়ে রাবাংলার দিকে চলে যায়। আমাদের সন্দেহটা কিন্তু তাখনি থেন্ডাপের দিকে ঘুরে যায়, মজাটা হল থেন্ডাপ আমাদের সাথেই থাকল আপ টু পেডং আর থাকল কি বল তো ?”
“কি, ওই রোলটা তো”, আমি বলে উঠতেই মামা বলল “গুড, ইয়েস, ওই রোলটার মধ্যেই ছিল রোল করা প্রসেস করা ছাল। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ছাল দিয়ে হবে টা কি, তাই না ?”
“ আচ্ছা মামা তুমি থেন্ডাপের আঁকা ছবিটা কেন মন দিয়ে দেখছিলে ?”
“ কারণ, ওই পেন্টিঙ্গের মধ্যে তো রয়েছে, কি? রয়েছে, ভেপুগ গুম্ফার প্রাচীন বৌদ্ধ চিত্র। থেন্ডাপ আমাদের ঘোল খাওয়ানোর জন্য শুধু জল রঙের আঁচর কাটছিল, কিন্তু ভুলটা করলো যে অয়েল পেন্টিঙ্গে ওয়াটার কালার ধরে না, তাই ওই জল রঙ ঠিক ভাবে লাগছিল না দেখে অবাক হচ্ছিলাম”।
“মামা তুমি তো অয়েল পেন্টিং তো জানো , তাই না “, বলে উঠলাম।
“এখন দেখ কোন জিনিস ফেলা যায় না , কবে এক কালে শিখেছিলাম এখন কাজে লাগলো। যাইহোক, প্রসেস করা ছালের মধ্যে গুম্ফার প্রাচীন বৌদ্ধ চিত্র জড়িয়ে আমাদেরই গাড়ী করে থেন্ডাপ কি চমৎকার অভিনয়টা করে গেল। আর হ্যাঁ, ওই প্লাস্টিকের রোল মধ্যে ওই ভাবে যে নিয়ে যাবে এটা কিন্তু আমিও ভাবতে পারি নি, স্বাভাবিক কারোরই সন্দেহ হবেই না,কারন ওখানকার প্রকৃতি এতটাই রঙিন যে যে কেও আঁকতে পারে”।
একটু থেমে মামা জোড়ে হেসে দিয়ে বলল, “ অ্যাকচুয়ালি , হিরো কিন্তু তুই ?”
থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম “কেন ?”
“ সে কি রে হিরো বাবু! ভাগ্যিস তুই ওই মোটা রোলটার গদাম করে বারি খেলি, আর হাতির দাঁত সমেত গুম্ফা চিত্র বেরিয়ে পড়লো , না হলে কারো বাবার ক্ষমতা ছিল না কোথায় আছে ওইগুলো ধরার”।
“ কিন্তু তুমি কি করে বুঝলে , চ্যাং এর অভিনয় করছে থেন্ডাপ ?”
“ হা হা। জিও ট্যাটু আর লো ওয়েস্ট জিন্স । বাবা, চ্যাং ওরফে থেন্ডাপ যখন বুদ্ধি হারিয়ে পাকামি করে জামা খুলে ক্ষতটা বাঁধে তখনই দেখলাম TH । বুঝলি এবার। হুম এবার আসুক জিন্স, তোদের নিউ হালের জিন্সের জন্য বুঝতে পারলাম যে ওর পকেটে রয়েছে রিভলবার, উঁচু হয়ে ছিল”।
“জিও মামা, তুমি না জিনিয়াস”, উল্লাসে বললাম।
“হুম, কার মামা দেখতে হবে তো, আমিও এবার ওই রকম একটা কিনব, তোর মা কে বলবি ভাইফোঁটাতে গিফট দিতে। আসলে দেখ কেউ বোকার মতো পেডং থেকে সিল্ক রুট ধরে বর্ডারে সহজে যায় না, কারণ , রাস্তাটা খুবই খারাপ, আবার অন্য দিকে নাথুলা পাশে আর্মিদের কড়াকড়ি। ইন্সপেক্টর লামা এটা জানতেন, তাও আমাদের ওই রুট টার কথা বললেন, জালে পড়লো আমাদের থেন্ডাপ সাহেব”।
“ইয়েস মামা, ওদিকে। বিন্দ্রা আঙ্কেল আর তথাগত’দা লাটাগুড়ি এরিয়া ব্লক করেই ছিল, যেদিকে পালাও ধরা পড়তোই”, আমি বললাম।
“এক দম ঠিক, থেন্ডাপ যখন দেখল, আমাদের আর বোকা বানাতে পারছে না অ্যান্ড মিঃ লামা তার বাহিনী নিয়ে হাজির, তখন শুরু করলো ফায়ারিং । কতক্ষণ আর চলে ওই রিভলভারে, তারপর তুই ব্যাথা জায়গায় দিলি দুঃসাহসিক ভাবে সামার সল্ট। ব্যাস মুখ থুবড়ে পড়লো। আর হাতকড়া পরার আগেই ধাঁই করে তোকে দিল”, বলে মামা প্রান খুলে হাসতে শুরু করলো।
৮
আজ আমরা ফিরব। বিন্দ্রা আঙ্কেল আই কেসটা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরেছেন। তথাগত’দা এলেন।
“ আবার এস কিন্তু , এবার যা ঝামেলা গেল”। মিষ্টি একটা হাসি হেসে বললেন।
মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ স্যার সুন্দর বনে থাকার সময় একবার একজনের সাথে দেখা হয়েছিল, কি যেন বেশ নাম, হুম মনে পরেছে, আব্দুল রজ্জাক, কথায় কথায় আপনার কথা বলেছিলেন”।
মামা মুচকি হাসি হেসে বলল, “ আমি আবার কি করলাম,ভাই ?”
“ আর স্যার কি যে বলেন আপনি তো ছোট ইলিশ যারা বেআইনি ভাবে ধরে তাদের একটা গ্যাং কে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, এর জন্য আপনি পুরস্কারও পান”
মামা যেন লজ্জায় মিশে যেতে চাইছে। কোন ভাবে নিজেকে সামলিয়ে বলল, “ধুর ও এমন কিছু না, আমি ঘুড়ে বেড়াই আর ওই টুকটাক লিখি, নিজের চলে যায়। তবে হ্যাঁ, অন্যায়কে মানতে পারি নি আর হয়ত পারবোও না”।
আমি যত শুনছি ততই অবাক হচ্ছি, মামা তলে তলে এত কান্ড করে , পুরস্কার পায় কিছুই তো জানি না, এটাই শুধু জানি মামা নাকি একটু ক্ষ্যাপাটে, বাউন্ডুলে, আর ওই কি সব লেখে, তা নিজেও কোনোদিন পড়ে দেখি নি । আজ কেন জানি না নিজের কাছে নিজেকেই ছোট লাগছিল।
আরও খারাপ লাগছিল এই ভেবে যে সন্দেহ করা ভালো, কিন্তু একটুতেই পুরো সন্দেহ বা অভিযোগ করা ঠিক না, যখন মামা তথাগত’দা জিজ্ঞাসা করলেন উদগ্রীব হয়ে, “ ভাই, বেচুং কেমন আছে ? ডাক্তার কি বললেন ? ইস, আমরা একবারও পারলাম না যেতে”।
জীপটা করে ফিরছি। মামা কে জিজ্ঞাসা করলাম, “ কি হয়েছে বেচুং এর ?”
মামা শুধু বলল, “ ও তো ফরেস্ট অফিসে কাজ করে, তাই, আই অভিজানে ও গিয়েছিলো মিঃ লামার সাথে, যখন ফায়ারিং হয় তখন তোকে গার্ড করতে গিয়ে গুলি লাগে”। একটু থেমে আবার বলল, “ টুটুন জীবনটা খুব ছোট্ট, কিন্তু এই ছোট্ট জীবন্টাকে সুন্দর করা দরকার, শুধু একটু ভালবাসলে। চিন্তা করিস না ভালো হয়ে যাবে বেচুং”।
পিছনে পরে রইল লাটাগুড়ির জঙ্গল, পরে রইল প্রকৃত সভ্যতা ।।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ২৭/০৪/২০১৮দারুন।
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ২৭/০৪/২০১৮তারুণ্যে স্বাগতম
প্রিয় বন্ধুবর।
নিয়মিত লেখার জন্য তোমাকে আহ্বান জানাই।
ভাল থেকো এবং ভাল লিখো :: এই প্রত্যাশা।
(ছবিটা ভিজিবল নয়, লিংকটা ঠিক করে দিও ব্ন্ধু)