www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

কাক ও দুষ্টু হনুমান


এক বনে বাস করত কাক আর কাকিনী । তাদের মনে বড়ই দুঃখ । যে কয়বার ডিম দিয়েছে সেই ক’বারই দুষ্টু হনুমানের দল সব খেয়ে ফেলেছে । কিছু বলতে গেলেই হনুমান তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে কাক দম্পতিকে আচ্ছা করে শাসিয়ে গিয়ে বলেছে –
“ কালো কাক, একদম চুপ থাক
মেরে তাড়াব, ফাটাব তোদের নাক !”
তবুও কাক গিন্নী কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে ছাড়ে নি । আর তার ফল , যে গাছেই তারা খড়কুটো দিয়ে বাসা বানাত সেখানেই হনুমানের দলবল সব ভেঙে চুড়ে একাকার করে দিয়ে যেত ।
বনের ধারে যম ঠাকুরের মন্দিরে কত কেঁদেছে কাক দম্পতি । কতই না মানত করেছে প্রতি সপ্তাহে ! তারা মাথা ঠেকিয়ে বারবার যম দেবতাকে বলেছে –
“ যম ঠাকুর আমরা যে তোমার দূত –
হনুর অত্যাচার , একী অদ্ভুত !”
কাক ঠাকুরকে আরও তুষ্ট করার জন্য বলে –
“ আমরা তো সমাজকে করি পরিষ্কার –
তাও কপালে জোটে দুঃখের উপহার !!”
তারপর তারা চোখের জল মুছতে মুছতে নিজের নতুন বাসায় উড়ে যায় ।
এক বৈশাখের প্রখর দিনে দুখী কাক দম্পতীর ঘর আলো করে দুটি ঝকঝকে ডিম হয় ।
তাদের প্রিয় বন্ধু কোকিল কুমারীর আর কোকিল কুমারের সাহায্য নেয় আবার নিজের ঘরে ডিম পারতে দিয়েও উপকারের প্রতিদান দেয় । তারা একে অপরকে সর্বদাই সাহায্য করে । কাকদের মন খারাপ হলে কোকিল কুমার গান শুনিয়ে মন ঠিক করে দেয় । কোকিল কুমার সবসময় বলে –
“ আমরা ধরার সাহিত্যিক –
পরের তরে হিত করাই উচিৎ ।”
যাইহোক , এবার কোকিলদের পরামর্শ মেনে লম্বা এক নারকেল গাছের আগায় কাক দম্পতি বাসা বেঁধেছিল । পাতার আড়ালে থাকার জন্য হনুমানদের নজর এড়ানো গেছে । আর হনুমানরা তো আর শক্ত ডাব খেতেও পারে না সহজে !
কোকিলদের এই বুদ্ধির জন্যই আজ তাদের ঘরে ফুটফুটে ডিম ! আনন্দে কাক দম্পতি কোকিল দম্পতির গলা জড়িয়ে ধরে । কাক কা কা কা করে বলে –
“ তোমাদের প্রখর বুদ্ধিতে পেলাম রক্ষা –
সারাজীবন পাশে থেকো, এই শুধু ভিক্ষা ।”

বেশ কিছুদিন নির্বিঘ্নে কাটানোর পর কাক দম্পতীর বাসায় এই প্রথমবার ছানাদের চিঁ চিঁ রব শোনা গেল । কত করে চুমো খেল নতুন ছানাদের গালে ঠোঁটে মা-বাবা ।
বন্ধুদের সন্তান ডিম ফুটে বেরিয়েছে এত কাল পর ! তাই কোকিলরা নানান উপহার তো আনলই , তার সাথে তাদের মধুর স্বরে গেয়ে উঠল গান –
“ কাক-কাকিনীর হল ছানা –
কি যে মজা তানা –না-না ।”
এদিকে কাকদের বহুদিন সন্ধান না পেয়ে বুড়ো হনুমান আর তার দল রেগে আগুন । তাদের পরম শত্রু এই কাক দম্পতি । হনুমানরা গৃহস্থের বাড়িতে হানা দিতে গেলেই ওরা এমন বিশ্রী গলায় কা কা করে চেঁচিয়ে ওঠে যে বাড়ীর লোকজন লাঠি সোটা নিয়ে তাড়া করতেও ছাড়ে না ।
এমন সময় এক যুবক হনুমান হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দেয় –
“ হনু দাদু নারিকেলের শিখড়ে ,
বসন্তহীনে কোকিল তোলে গান !
নিশ্চয়ই কোন আছে কারণ –
এমন আছে কিছু যা পরে না গোচরে !”
এ হেন কথায় বুড়ো হনুমান গালে হাত দিয়ে বলে –
“ আজকাল বসন্ত লেগে থাকে সারাবছর –
যাও তবু ! দেখো দেখি কি খবর !”
পাখীরা রাতের বেলা দেখতে না পেলেও হনুমানরা দিব্যি দেখতে পায় । তারা নারকেল গাছের তলায় ঘাপটি মেরে কান পেতে থাকে । বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর তাদের চোখ বিস্ময়ে জ্বল জ্বল করে ওঠে । তারা শোনে কাকিনী কাককে বলছে –
“ ওগো কাল বাজার থেকো এনো আনাজ –
বাছাদের অন্নপ্রাশন, দেব নব সাজ ।”
এ কথা শুনে তো হনুমানদের তো মাথায় হাত ! তারা একে অপরের দিকে চায় । নিজেরা কথা কয়ে ঠিক করে এই রাতের অন্ধকারেই ব্যাটাদের শায়েস্তা করতে হবে ।
বৈশাখে মাঝে মধ্যেই তুমুল বৃষ্টি হয় । আজ সন্ধ্যে বেলায় ছিল গুমোট আবহাওয়া । আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে মাঝে মাঝেই । রাতের অন্ধকার ঠেলে ক-ড়া-ত করে বাজ পরছে সজোরে । একটু পরেই শুরু হয় চিট মিট করে বৃষ্টি ।
এক হনুমান হতাশ হয়ে বলে –
“ যাহ বাবা একি হল আজ –
কাক বিনাশের হবে না যে কাজ !”
ক্রমশ বৃষ্টি বাড়তে থাকলে হনুমানরা সিদ্ধান্ত নিল কাল সকালেই কাক বাচ্চাদের অন্নপ্রাশন সারাজীবনের মত ঘোচাবে । বৃষ্টির ছাঁট গায়ে ভালো করে পরতেই তারা নিজেদের লেজ কাঁধে তুলে দুড়দাড় করে পালাতে লাগল । জায়গা তো চিনে নিয়েছে , ব্যাস ! আর কে রক্ষা করে ।

বনের ধারেই ছিল এক নদী । সারা বছরই শান্ত মেয়ের মত কুলকুল করে গান করতে করতে বয়ে চলে ।বনের সব পশু-পাখীরা এর মিষ্টি জল খেয়ে তেষ্টা মেটায় ।
বৈশাখী বৃষ্টি সেদিন সারা রাত প্রবল ভাবে হয়েছে । ভোরের ক্ষীণ আলোয় জঙ্গলের সব প্রানীরা দেখে তাদের প্রিয় নদী জলে টই টম্বুর । বনের অনেক গাছ পালা জলে প্রায় আধ ডোবা !
সবার মাথায় হাত ! এই এক রাতের বৃষ্টিতেই অকাল বন্যা ! তখন বনের সবচেয়ে বৃদ্ধ পাখী হাঁড়িচাচা লাল লাল চোখ করে ঘঁক ঘঁক করে জবাব দেয় –
“ ভাইসব শোনো , এ নয় পশু-পাখীর কাজ –
মানুষ জীবের ব্যবহৃত প্ল্যাস্টিক করেছে এ অকাজ !”
কী আর করা ! মানুষের সঙ্গে তারা কী করে পেরে উঠবে ! তারা যে পশু-পাখীদের থেকেও বাজে । আবার মানুষ জীবরাই বলে ‘ পশুর মত কাজ করেছে ’ , এক শিয়াল কথাটা ঘাড় নাড়িয়ে বলে ।
হুনুমানের হয়েছে মস্ত জ্বালা ! তারা ভেবেছিল , আজ সকালেই কাকদের বিনাশ করবে । তা তো হলই না ! এদিকে তাদের ঘরের বাচ্চারাও খিদেতে চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে ।
সকালের দিকে আকাশ একটু পরিষ্কার হতেই কাক উড়তে উড়তে আনাজ আনতে যায় । যে করেই হোক আজই অন্নপ্রাশনের কাজ নম নম করে সারতে হবে । পরে বন্যা কাটলে সকল বন্ধুকে না হয় খাওয়ানো যাবে !
কোকিল দম্পতি এই বিপর্যয়ে কাকের বাসায় ঠাই নিয়েছে । কাকিনী যত্ন করে ভিজে বাসার এক পাশে শুকনো জমা করা পালকের আসন পেতে দিয়ে আরাম করতে দিয়েছে তাদের পরম বন্ধুদের ।
কাক গিন্নী হেঁসেলের সামলাতে গেলে কোকিল মামা ভাগ্নে ভাগ্নীদের গান শোনাতে থাকে ।
কাকের মনে আজ নেই কোন দুঃখ । ভাগ্যিস ওই লম্বা নারকেল গাছে বাসা তাদের । না হলে বাচ্চা সমেত এই বন্যায় পথের ভিখারি হতে হত !
কাক ঠোঁটে করে আনাজপাতি ব্যাগ ভর্তি করে ফিরছিল । কিন্তু পথেই বটগাছে হনুমানদের বাসার কাছে শুনতে পায় কারা যেন খুব ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।

হনুমানের দল না পারে উড়তে , না পারে জলের মধ্যে বেশীক্ষণ থাকতে । সারাটা বন হন্যে হয়েও সেদিন তারা কোন ফল-পাকুড় কিছুই পেল না । দুশ্চিন্তায় তাদের মন ভার ।
কোন মতে লম্ফঝম্ফ দিয়ে তারা বাসায় ফেরার চেষ্টা করে । কিন্তু বাসার কাছে আসতেই তাদের রক্ত হিম ! মা হনুমান বাবা হনুমানকে বলে –
“ ওগো শোনো না যায় বাচ্চাদের রব –
বনের বিশাল অজগর খেল কি সব !!”
সংসারের বৃদ্ধ হনুমান চিন্তিত হয়ে জবাব দেয় –
“ সে তো ঠিক কথা বৌমা –
বাছারা যে কোন রবই তোলে না !”
এসব নানা কথা ভেবে তারা বহু কষ্টে জল ডিঙিয়ে বটগাছের ডাল ধরে নিজের বাসাতে আসতেই অবাক ! এত সাহস !
বাবা হনুমান লাফ দিয়ে কাকের গলা খপ করে ধরে বলে –
“ শয়তান এ তোর কাজ –
এদের মারতে এসেছিস আজ !”
কাক ডানা ঝটপট করতে থাকে যন্ত্রণায় । ঠিক তখনই ছোট ছোট হনুমান ছানারা তিড়িং করে বাবার মাথায় চেপে বলে –
“ বাবা করছ কী যে অধর্ম –
কাকু খেতে দিয়ে করেছে পুণ্যকর্ম ।”
এ কথা শুনে গোটা হনুমানের দল অবাক হয়ে যায় । ভাল করে তারা দেখে অন্নপ্রাশনের জন্য আনা সমস্ত আনাজ কাক তাদের বাচ্চাদের খেতে দিয়ে দিয়েছে ।
হনুমানদের মনের সব ভুল ভাঙে । বৃদ্ধ হনুমান কাকের কাছে হাত জোর করে বার বার ক্ষমা চায় ।
তখন কাক হেসে বলে –
“ আপদ-বিপদের বন্দধু আমরা সকলে –
এসো থাকি সব বিবাদ ভুলে ।
তোমার সন্তান আমারও সন্তান –
না দিব তাদের ভেদাভেদ ঞ্জান ।”
কিছুদিন পর বন্যার জল নেমে যায় । প্রকৃতি আবার ঝলমলিয়ে ওঠে । আজ কাক দম্পতি সন্তানদের ভাল ঘটা করে দেবে অন্নপ্রাশন । বনের সকল পশু-পাখী নেমন্তন্ন রক্ষা করতে এসেছে সপরিবারে । হনুমানরাও তাদের বাচ্চাদের চমৎকার ভাবে সাজিয়ে সদলদলে হাজির ।
ভোজের আসরে কোকিল তখন সুরেলা গলায় গেয়ে উঠলো –
“ মানুষ না ভালোবাসে একে অপরকে –
ধ্বংস করতেও নাহি লাগে বিবেকে ;
আমরা পশু-পাখী এসো করি শপথ –
সুখে–দুখে সাথে রব, কাটাব সব বিপদ ।।”
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৪৪১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২০/০৪/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast