www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সবুজ পালক ও সোনা-রূপার কাঠি


সেইদিন অমাবস্যার তীক্ষ্ণ আঁধার কাটিয়ে এক সিদ্ধ ফকির জঙ্গলের মাঝের এক ফালি পথ বেয়ে নিজের বাসায় ফিরছিলেন । শীতের মধ্যেও পরিধানে সামান্য একটা আলখাল্লা । খানিক পথ বেয়ে যেতেই ঘন গাছের একধার থেকে ভেসে এলো কিছু কথাবার্তা । কিছুটা এগোতেই দেখলেন , জলাশয়ের এক কোণে এক কুনো ব্যাঙ আর একটি রূপার মত আলো করা রূপালি মাছ নিজেদের মধ্যে কথা বলছে । তাদের মধ্যে কুনো বলছে –
“ বাদশা মোদের বড়ই ভালো –
কিসের পাপে হল জীবন কালো ?
ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে আছে তার প্রাসাদ ,
সব আজ আঁধার , প্রজাদের আবসাদ ।”
এ কথা শুনে রূপালি মাছ চিন্তিত মুখে জানায় –
“ শোন কুনো এক বড় সত্যি কথা –
দুষ্ট মন্ত্রীর তরে বাদশার গেছে মাথা ।
দেখছ আজ যেটুকু আছে জল –
তারও তরে একদিন চিত্ত হবে বিহ্বল ।”
সাধক ফকির এদের দুঃখের কথা শুনে বুঝলেন , এরা সামান্য প্রানী হয়েও সকলের কথা চিন্তা করছে ।প্রসন্ন হয়ে তিনি মাছ আর কুনোর সামনে এসে দাঁড়ালেন । মানুষ দেখেই তারা যেই জলে ডুব মেরে পালানোর চেষ্টা করতে গেল , ঠিক তখনই ফকির অভয় দিয়ে বললেন –
“ কালো রাতে নোংরা জলে –
কইছ দুখের কথা ,
দেশের তরে সব কথা ভুলে –
দূর কর সবের ব্যথা ।”
ফকির বাবার কথায় তারা জানতে চাইলো সমস্যার সমাধান কী ভাবে হবে আর কী করেই বা রাজ্যগুলোর কষ্ট মিটবে । আলখাল্লার মধ্যে তখন হাত ঢুকিয়ে ফকির বাবা দুটি কবজ তাদের দিয়ে বললেন –
“ কুনো আর মাছ প্রভাত হলে পরবে এ কবজ –
সকল ব্যথা যাবে সব , কঠিন জিনিস হবে সহজ ।”
কুনো আর মাছ তো বুঝতেই পারলো না কী করে সব সমাধান হবে !! মনের কথা বুঝতে পেরে ফকির শুধু মৃদু হাসলেন । আর যাওয়ার সময় বার বার বলে গেলেন , এ কবজ সূর্যাস্ত অবধি কাজ করবে ।

পাখীর ডাকে জঙ্গলের ঘুম ভাঙে । কিন্তু আজকের সকাল যেন অন্য দিনের তুলনায় বিষণ্ণ । পাখী-গাছ কারোরই যেন না আছে সুর , না আছে ছন্দ-লয় । ফকির বাবার কথা মত প্রায় শুকনো-কালো নোংরা জলাশয় থেকে বেরিয়ে এসে কুনো আর মাছ যেই না কবজ পড়েছে । ওমা একী !! চারিদিক আলো করে কুনো হয়ে গেল তরতাজা সুদর্শন যুবক । যেমনি তার রূপ , তেমনি বলিষ্ঠ চেহারা । আর মাছ হল রাজকন্যের মত রূপসী এক যুবতী । গায়ে তাদের ঝলমলে পোশাক । মাছের হাতে সোনার কাঠি আর কুনোর হাতে রূপার কাঠি ।
জঙ্গলের পথ বেয়ে তারা চলল ফিরোজ নগরে , যেখানে বাদশার প্রধান প্রাসাদ । প্রাসাদের মূল ফটকে প্রহরীরা তাদের আলো করা রূপ আর চেহারা দেখে নিজে থেকেই ফটক খুলে দিল । কেউ তাদের চিনতেই পারলো না যে তারা আসলে কারা । মাছ আর কুনো মানুষের বেশে বাদশার সভায় গিয়ে উপস্থিত হল । বাদশা সেই সময়ে অবসন্ন মন নিয়ে সভাসদদের সাথে শলা-পরামর্শ করছিলেন রাজ্যের উন্নতি কী ভাবে করা যায় ।
প্রধান মন্ত্রী বাদশাকে কুর্নিশ করে বলে –
“ উত্তর কোণে আছে এক বিশাল জলাশয় –
ভরাট করে প্রাসাদ হলে বাড়বে বিষয়-আশয় ।”
মন্ত্রীর কথায় বাদশা তো হতবাক । কারণ , সেখানে তো দিবারাত্র ফুটে থাকে দুষ্প্রাপ্য সোনালী পদ্ম । বছরের কোন ঋতুতেই তার পাপড়ি খসে যেমন পরে না , তেমনি ওই সরোবরে দূরদূরান্ত থেকে কত নাম না জানা পাখী হেমন্তের শুরুতেই এসে বাসা বানায় , ডিম পাড়ে । জলে কত রঙ-বেরঙের মাছ খেলে বেড়ায় ।
মন্ত্রী রাজার মনের কথা আন্দাজ করতে পেরে পুনরায় বলে –
“ করতে হলে দূর সকল অবসাদ –
পদ্মের উপর প্রলেপ দিয়ে গড়ুন প্রাসাদ ।”
কী আর করা ! মন্ত্রী তো বাদশার মাথা আগেই কুপরামর্শ দিয়ে নষ্ট করেছিল । তাই , তার পরামর্শ মত , বাদশা নির্দেশ দিলেন রাজমিস্ত্রিকে দ্রুত প্রাসাদ নির্মান করার জন্য । কিন্তু , সেই আদেশের মাঝেই মানুষরূপী কুনো আর মাছ বাদশাকে শতবার কুর্নিশ করে আবেদন জানায় –
“ বাদশা দিলে মোদের দু’দিন সময় –
সকল সমস্যার হবেই হবে নিরাময় ।”
সভায় উপস্থিত সকলেই এ ধরনের আজনবির কাছ থেকে এমনতর কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে উঠল । বাদশা তো নিজের সিংহাসন থেকেই উঠে পরলেন । এদের মধ্যে সকলের মুখে খুশীর রেখা ফুটে উঠলেও মন্ত্রীর মুখ কালো আর রাগে লাল হয়ে উঠল । সভার মধ্যে আরেকজনও কিন্তু খুশী হয়ে গান জুড়ে দিল । তার ভাষা বাদশা ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারে না । কারণ , বাদশা তাকে একদম ছোট্ট থেকেই মানুষ করেছে । সে হল বাদশার অতি আদরের তোতা পাখী । তোতা গান গাইতে গাইতে বাদশাকে বলে –
“ বাদশা বাদশা শোনো ওদের কথা –
রাজ্যগুলোয় আসবে সুখ সদা-সর্বদা ।”
একসময় সকলকেই বাদশা সমস্যার কথা বলেছিলেন । তারা সাহায্য করার আশ্বাসন দিলেও অদ্ভুতভাবে এক-দু’দিনের মধ্যেই মারা যায় । তাই আর ইতিমধ্যে কেউই সাহস করে আর এগিয়ে আসে নি । মন্ত্রীর কথা আপাতত তুলে রেখে অচেনা ছেলে-মেয়েকে দিন দুয়েকের সুযোগ দিলেন । আর বাদশা এটাও মনে করিয়ে দিলেন , এই উপকার করার ফল হিসাবে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে ।
মাছ আর কুনো এ কথা শুনে বাদশাকে আশ্বাস দিয়ে বলে –
“ ওগো বাদশা মিছে করো না চিন্তা আর ,
রাতের পর দিন , দুখের পর সুখ হয় সবার ।”
এই বলে তারা প্রাসাদ থেকে বেড়িয়ে আসলো । পথে তারা চিন্তা করতে লাগলো রাজ্যগুলোর সমাধান কী ভাবে করবে । এদিকে বেলা পরতে বেশী দেরী আর নেই । ফকিরের কথা ফলে যেতে পারে বলে তারা দ্রুত পা চালিয়ে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে যেতে লাগলো । আকস্মিক ভাবে একটা ডানার আওয়াজ আর মানুষের মত কণ্ঠস্বর শুনে মানুষরূপী কুনো আর মাছ দাঁড়িয়ে পরল মাঝ পথে । এমন গলা যেন কোথায় শুনেছে ! একটু বাদেই দেখল অদূরের একটা গাছের ডালে বাদশার পোষা তোতা তাদের ডাকছে । অবাক হল কুনো আর মাছ !
তোতা তাদের ডেকে কয় –
“ সোনার কাঠি আর রূপার কাঠি –
করবে সব কষ্ট দূর ,
মানুষ সব মুখোশ পরে করে কাটাকাটি –
পশু-পাখী হয় না এত ক্রুর ।”
কুনো রূপী যুবক আর মাছ বুঝলো যে বাদশার পোষা তোতা ঠিক তাদের চিনে নিয়ে উপকার করতেই এসেছে । তখন কুনো বলে –
“ তোতা বোন তোতা বোন কর সাহায্য –
কী করলে বাঁচবে প্রকৃতি আর রাজ্য ?”

তোতা তখন হেসে আবার বলে –
“ হচ্ছে এখন সন্ধ্যে-আঁধার , যাও ফিরে বাসায় ,
পদ্মের মধ্যে আছে প্রাণ ভোমরা –
সোনা রুপার স্পর্শ করালে তোমরা ,
মানুষরূপী রাক্ষস হবে ধ্বংস , বাঁচবে সবে আশায় ।”
যাওয়ার আগে তোতা তাদের দুজনকে নিজের দুটি সবুজ পালক দিয়ে বললে , “ নিয়ে যাও কাজে লাগবে ।”

সেদিন রাতে ফকির বাবা আবার দেখা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন , কুনো আর মাছকে কী করতে হবে । ফিরে যাওয়ার সময় আবার বলে গেলেন , বাধা বিপদ আসলে ভয় না পেতে । যারাই লক্ষ্যে স্থির থাকে না তাদের জয় অসম্ভব । ওই রাজ্যে এমন একজন আছে যে আসলে......। পুরো কথা না বলেই এক অট্টহাসি দিতে দিতে বনের মধ্যে হারিয়ে গেলেন সিদ্ধ পুরুষ ফকির বাবা ।
সকালের সূর্যের আলো ফুটতে না ফুটতেই তারা দুই জনে আগের মত মানুষে রূপান্তর হয়ে চলল রাজ্যের উত্তরের সেই সরোবরে । যখন তারা সেখানে পোঁছাল , দেখল , বাদশা তার পাত্র-মিত্র নিয়ে আগেই হাজির । আর আছে সেই পোষা তোতা পাখী । বাদশা ওদের দুজনকে বেঁচে আছে দেখেই অবাক । কারণ ইতিপূর্বে অনেকে সাহস দেখালেও বাঁচে নি । খুশী হলেন তিনি । বাদশার কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে তারা সরোবরের কাছে গেল । তখনও ফুটে আছে সোনালী পদ্ম । চারিদিকে বিচ্ছুরণ হচ্ছে সোনার মত আভা , ঠিক যেন কেউ সোনা গলিয়ে জলের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছে । এমনই তার শোভা ।
কুনো আর মাছ কোমর থেকে সোনার-রূপার কাঠি বার করে বলে –
“ সকলের আসবে সুখ , ঘুচবে দুখ –
যাও তোমরা পদ্মের বুকে
হবে ধ্বংস রাক্ষস , দেখবে শান্তির মুখ ।”
যেই না বলা অমনি সোনা-রূপার দুই কাঠি বিদ্যুৎ বেগে ছুটল পদ্মের দিকে । আর তক্ষুনি আকাশ কাঁপিয়ে , মেঘে রঙ কালো করে গর্জন করতে করতে ছুটে আসে সেই দুষ্ট মন্ত্রী । বাদশা , সভাসদ সকলেই অবাক । মন্ত্রী তখন ভয়ঙ্কর রাক্ষস হয়ে মুলোর মত দাঁত বার করে গিলতে আসছে সকলকে । ভয় পেয়ে প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পারলো ছুটে পালাতে লাগলো । কিন্তু রাক্ষসের সাথে কী আর পেরে ওঠে । ইয়া ইয়া লম্বা লম্বা হাত দিয়ে রাক্ষস কয়েকশ মাথা দিয়ে কপাত করে মানুষ ধরে আর খায় । মুখ দিয়ে ঝরে পড়ছে লাল রক্তের স্রোত ।
তোতা সেই সময় মনে করিয়ে দিল কুনো আর মাছকে তার দেওয়া সবুজ পালকের কথা । এতক্ষণ এসব কান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল তারা । পাখীর কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় । কুনো আর মাছ সেই মুহূর্তে তাদের পাগড়ীতে গোঁজা পালক দুটি বার করে রাক্ষসের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মন্ত্রের মত বলে ওঠে –
“ পালক পালক আটকাও রাক্ষস –
আর দেরী নেই , ভাঙবে ওর সাহস ।”
দুটি পালক নির্দেশ পেয়েই রাক্ষসের শরীর স্পর্শ করতেই , মন্ত্রী রূপী রাক্ষসকে কেউ যেন অদ্ভুত মন্ত্রবলে শিকল দিয়ে শক্ত করে দিল বেঁধে । সে আর একচুলও নড়তে পারে না । আর ওদিকে সোনা রূপার কাঠি সোজা গিয়ে পদ্মের বুকে তীক্ষ্ণ বানের মত বিঁধে গেল । লুটিয়ে পড়লো সরোবরের স্বর্ণ পদ্ম । পদ্ম পরে যেতেই মন্ত্রীরূপী রাক্ষসের মাথার উপর এসে পরলো আকাশ থেকে তীব্র বেগে বজ্র । সারা শরীর দাউ দাউ করে জ্বলে যেতে লাগলো ।

পদ্মফুল নষ্ট হয়ে যেতেই সেখান থেকে একটা কালো ধোঁয়া সারা রাজ্যের যত্রতত্র ছড়িয়ে পরলো । দূর দূর থেকে শোনা গেল গুম গুম করে কী যেন ভেঙে পরছে । সাহস পেয়ে আমাত্যরা ছুটলো খবর আনতে । কিছুক্ষন পর তারা এসে বাদশাকে জানালো , রাজ্যের যেখানে যেখানে জলাশয় বুজিয়ে প্রাসাদ বানানো হয়েছিল , সব কটা তাসের মত পরে গিয়ে গুড়িয়ে শেষ হয়ে গেছে । শুধু তাই নয় , সেখানে আগের মত স্বচ্ছ সরোবরও সৃষ্টি হয়েছে । পাখীরা সেখানে খেলা করছে ।
সন্ধ্যে হতে আর বেশী দেরী নেই । কুনো আর মাছের কাজ শেষ হয়েছে । কিন্তু তাদের মনের কোণায় এক অজানা দুঃখ । ঠিক সে সময়ে সকলের সামনে সেই ফকির বাবা হাজির হয় । তিনি নীরবে উত্তরের পদ্ম পুকুরের জল হাতে তুলে নিয়ে ছিটিয়ে দেয় রাক্ষস রূপী মন্ত্রীর দিকে । এ দেখে সকলে হায় হায় করে ওঠে । ফকিরের জলের ছোঁয়া পেতেই মন্ত্রী রাক্ষস থেকে পুনরায় মানুষে পরিণত হয় ।
বাদশা ফকিরকে বললেন , “ এ কী করলেন বাবা , এ যে , এত দিন মানুষ সেজে সব কিছু শেষ করে দিচ্ছিল ।”
ফকির হাল্কা হেসে বলেন –
“ মানুষ যখন হারায় মান আর হুঁশ –
তখনই সৃষ্টি হয় যত বেহুঁশ রাক্ষুস ।
আজ ওর এসেছে জীবনের বোধ –
প্রকৃতি ধ্বংস করে লোভ আর নির্বোধ ।”
সত্যি , তারপর থেকে শুধু সেই রাজ্য কেন , বাদশার অধীনের সকল রাজ্যের পরিবেশ , মানুষের , পশু-পাখীর মনে ফিরে এলো শান্তি । দূর হল অবসাদ । মন্ত্রীও প্রকৃত মানুষ হয়ে পরিবেশ ও প্রজাদের সেবা করতে শুরু করলো ।
পথে যেতে যেতে আঁধার এলো প্রায় ঘনিয়ে । মানুষ থেকে কুনো আর মাছ তাদের আসল রূপে ফিরে আসতে শুরু করে । জলাশয়ের কাছে আসতেই তারা অবাক ! সেটি আর আগের মত নোংরা নেই । হেমন্তের শীতল পরিবেশেও তাদের বাসস্থান সুন্দর ও জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে । ফকির বাবা ফিরে যাওয়ার সময় একটা মহা বাক্য কয়ে গেলেন –
“ জীবনে কখনো করো না দুঃখ
পেয়েছ যে পূণ্যময় জীবন ,
জগতে একে অপরকে দাও সুখ –
কীটপতঙ্গ-মানুষ সকলেরই এক মন ।”
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫৩১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৪/০৪/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

 
Quantcast