www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

উধাও চলচ্চিত্রের পাঠ

সময়ের হিসেবে অমিত আশরাফের ‘উধাও’ চলচ্চিত্রটি কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ একটি চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এক. বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের দোরগোড়ায় নির্বাচন করা নাড়ছে। নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উচ্ছ্বাস কোন সময়েই থাকে না। বরং নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় যত কাছিয়ে আসে ততই উৎকণ্ঠা কাজ করে সবার মনে। কিন্তু নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের ব্যাপারে ভাবার খুব একটা প্রয়োজন বোধ করে না সাধারণ মানুষ। ফলে রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থার পরিবর্তন হলেও সাধারণ মানুষের জীবনমানের তেমন পরিবর্তন হয় না। উধাও চলচ্চিত্র এমনই একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধির দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে । যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে আপনজনকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। যে ব্যক্তির হাত থেকে নিজ পরিবার নিরাপদ নয়, তার কাছে কি দেশ-দেশের মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি দর্শককে দাঁড় করিয়ে দেয় উধাও চলচ্চিত্রটি।

দুই, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। ক্রমান্বয়ে বিরান হয়ে ওঠা সিনেমা হলগুলোতে নতুন করে সবুজ শস্য হাওয়ায় দুলতে শুরু করেছে। এমন সময়ে ভাল নির্মান ও ভাল গল্পের চলচ্চিত্র বাংলা চলচ্চিত্রকে নতুন মাত্রায় পৌছে দিতে খুবই প্রয়োজন। অমিত আশরাফের চলচ্চিত্রের চমৎকার সিনেমাটোগ্রাফি ও মিউজিকের অসাধারণ ব্যবহার, সর্বোপরি চলচ্চিত্রটির ভাল নির্মান শিক্ষিত দর্শকের তৃষ্ণা কিছুটা হলেও মেটাতে পারবে একথা বলাই যায়।

তিন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এ দুই দশককাল ধরে দুইটি বড় বিভাজনে বিভাজিত হয়ে আছে। একটি. এফডিসিকেন্দ্রীক কতিপয় অশিক্ষিত নির্মাতাদের কুরুচিপূর্ণ তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবি, আরেকটি ড্রইংরুম ঘেষা, বড়জোর পাবলিক লাইব্রেরি কেন্দ্রীক উচ্চশ্রেণীর শিক্ষিত নির্মাতার বিকল্প ধারার চলচ্ছবি। এ দুটি ঘরানার কোনটিই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দর্শকের চাহিদা মেটাতে পারেনি। অমিত আশরাফ এ দুই ঘোরাটোপে বন্দি না থেকে শিল্পমণ্ডিত বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মান করেছে। যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দর্শকের কাছে নতুনই বটে। এবং তা যথেষ্ট আগ্রহের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। তাছাড়া মুক্তির আগেই কয়েকটি পৃরস্কার অর্জন চলচ্চিত্রটিকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে। যদিও ফেস্টিভাল পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র সম্পর্কে এদেশের দর্শকের ধারণা মোটেই নির্মাতাবান্ধব নয়।

চলচ্চিত্রটির সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা ও মিউজিক থেকে শুরু করে কাজের অনেকাংশই বিদেশি কারিগর দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। চলচ্চিত্রটির চিত্রায়ন অসাধারণ। মিউজিকের ব্যবহারও চমৎকার। তবে সম্পাদনার বেলায় কিছুটা অগোছালো। বিশেষ করে কালার কারেকশনের ব্যপারে আরও বেশি সচেতন হওয়ার দরকার ছিলো। বাংলা ভাষার প্রতিথযশা চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের ‘ মাল হলো কাট-এ’  উক্তিটি একজন শিক্ষিত নির্মাতা হিসেবে ভুলে গেলে চলবে কি করে। এছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে গান গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যদিও উধাওয়ে দুএকটা গান ব্যবহার করা হয়েছে-কিন্তু তার ব্যবহার যথোপযুক্ত হয় নাই। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মান করতে হলে ও সিনেমা হলে রিলিজ দিতে হলে- এ কথাটি মাথায় রাখতেই হবে নির্মাতাকে।

উধাও চলচ্চিত্রের কাহিনী আকবর হোসেন নামের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির আবর্তনে আবর্তিত হয়। একজন গ্রামের সাধারণ কৃষক ও সবজি বিক্রেতা থেকে ঘটনাপরিক্রমায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন ও রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠার গল্প। সেখান থেকে আবার ভ্যানচালক এর হাতে বন্দি হয়ে ক্রমান্বয়ে নিজের আত্মপরিচয়ে ফেরার উপন্যাস। কাহিনী হিসেবে উধাও চলচ্চিত্র যেমন নতুন তেমনি আকর্ষণীয়। তবে উপস্থাপনের ধরণে চলচ্চিত্রটি কিছুটা বিভ্রান্তিকর। বিশেষ করে ভ্যানচালকের গ্রামে বাস, শহরে রিকশা চালিয়ে দিনযাপন করে। যখন প্রথম গ্রামে আসে তখন অনেক কম সময়েই চলে আসে। অথচ যখন আকবরকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসে তখন অনেক দীর্ঘ সময় লাগে। তাছাড়া কিডন্যাপ করার দৃশ্যটি একদমই কাঁচা হয়েছে। আকবরের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসা, তারপরে ভ্যানে করে সারা শহর পাড়ি দিয়ে গ্রামে নিয়ে যাওয়া দৃশ্যগুলো মোটেই স্বাভাবিক মনে হয়নি। আকবরের মেয়ের পতিতাবৃত্তি দেখানো দৃশ্যটি শুধুমাত্র তৃতীয় বিশ্ব সম্পর্কে পশ্চিমাদেশের  দৃষ্টিভঙ্গিকেই তুলে ধরে। যেন বাংলাদেশের গরীব মেয়েগুলো কিছু করতে না পারলেই পতিতা হয়ে যায়।

চরিত্র নির্বাচনে ও চরিত্র চিত্রায়ণে আরেকটু সচেতন হওয়ার সুযোগ ছিলো। কখনও কখনও আকবর ও আকবরের ছেলেকে প্রায় সমবয়সি মনে হয়েছে। এছাড়া রাজ ও আকবরের শহুরে স্ত্রী চরিত্র দুটি বিকশিত হওয়ার সুযোগ ছিলো। মন্দিরের পুরোহিতের চরিত্রটি একেবারেই আরোপিত একটি চরিত্র। আকবরের গলাও ঝুলিয়ে দেওয়া ঢালাই এর চাইটি বড়ো হাস্যকর হয়ে ওঠে। যে আকবার নিজের অস্তিত্বে নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষকে হত্যা করে, যথেষ্ঠ সুযোগ থাকা স্বত্বেও তা কাজে লাগায় না কেবল কাহিনীর অগ্রসর করার জন্যই। ব্যপারটা মেনে নেওয়া যেত যদি বোঝা যেত যে এ জার্নির মধ্য দিয়ে তাঁর ভেতরগত একটা পরিবর্তন হয়েছে। তা বানচাল করে দেয় চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্য। পরিবারের সকলকে আকবরের খুন করার মধ্য দিয়ে।

শুধুমাত্র ভাষা ছাড়া বাকী সবক্ষেত্রেই উধাও অতিমাত্রায় হলিউডি। এর কারণ হতে পারে, নির্মাতা অমিত আশরাফের অবগাহন হলিউডি চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। তবে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে একথা বলে দায় এড়ানো যায় না কোনভাবেই। আর তখনই নির্মাতা নিজেই চলচ্চিত্রের নায়ক আকবরের মতো হয়ে যান। আকবর যেমন টাকার নেশায় ও শহরের ছোয়ায় নিজের অত্বিস্ত ভুলে যায়। তেমনি হলিউডি সংস্কৃতির প্রভাবে নির্মাতা নিজেও নিজের  অবস্থানকে ভুলে যান। আকবরকে নাহয় পরিচালক আকবরের ভ্যানচালক ছেলের মাধ্যমে তার অতীতে ফিরিয়ে এনেছেন-নির্মাতাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব কার?!

সর্বোপরি চলচ্চিত্র হিসেবে অমিত আশরাফের উধাও চলচ্চিত্রটি একটি ভাল চলচ্চিত্র নিঃসন্দেহে। তবে উপস্থাপনা ও বিয়য়ের কারণে চলচ্চিত্রটিতে প্রবাসি বাঙালির চোখে বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রবাসিরা বিদেশে প্রচণ্ড নাগরিক সুবিধা ভোগরত অবস্থায় যখন বাংলাদেশের দিকে, বিশেষ করে ঢাকার দিকে তাকান, তখন তাদের চোখ বিরক্তিতে কুচকে ওঠে। নোংরা শহর, তীব্র যানজট, কোলাহল ও উচ্ছৃঙ্খল রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদের এ বিরক্তির কারণ। তবে গ্রামের দিকে গিয়ে আবার তাদের চোখ কিছুটা উচ্ছল হয়ে ওঠে। এতো সবুজ আর কোথায় পাবো আমার এ দেশ ছাড়া। উধাও চলচ্চিত্রের কাহিনীতেও এর ব্যতিক্রম নেই।

লেখক : সম্পাদক, sangskriti.com
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৮০০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৮/১০/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • Înšigniã Āvî ০৮/১০/২০১৩
    অনেক কিছু জানলাম....
  • চলচ্চিত্র আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পাক তার প্রত্যাশা সবসময়ই। বর্তমান চলচ্চিত্রের ক্রান্তি লগ্নে এই ছবিটি আশা করি চলচ্চিত্র প্রেমীদের আশার আলো যোগাবে। ধন্যবাদ আপনার তথ্যবহুল এই প্রবন্ধের জন্য।
    • পার্থিব রাশেদ ০৯/১০/২০১৩
      আমাদের সবারই প্রত্যাশা বাংলা চলচ্চিত্র তার সুদিন ফিরে পাক। সবাইকে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার আহ্বান রইল। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
  • অনেক মূল্যবাদ তথ্য পেলাম আপনার লেখা থেকে।
 
Quantcast