মানুষগুলো অন্য মানুষ
ফারিয়া আর তার বান্ধবী রেহানা কলেজ থেকে বাসায় ফিরছিল।এমন সময় তাদের মহল্লার বখাটে ছেলে রবিন তার চার পাচ জন বন্ধু নিয়ে তাদের পথ আটকে দিয়ে নানা ধরনের আজে বাজে কথা বলতে শুরু করলো।ওদের আজে বাজে কথা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না আজ ফারিয়া।ওরা প্রায়ই এভাবে ফারিয়াদের পথ আটকে এসব কথা বলে থাকে।কিন্তু কখনো কেউ প্রতিবাদ করে না।তবে আজ কেন জানি ফারিয়া খুব রেগে গেল।সে সহসা তার হাতের কলম দিয়ে রবিনসহ আরো দুইজনের ওপরে আক্রমন করে বসলো। বেশ জখম করে ফেলল সে ওদের কে।লোকজন ওদের কে ধরে হাসপাতালে নিয়ে গেল আর ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ এসে ফারিয়াকে ধরে নিয়ে গেল।
রেহানা দ্রুত এই খবর নিয়ে ফারিয়াদের বাসায় এসে পৌঁছাল।তার বাসাও একই মহল্লায়।হন্তদন্ত হয়ে সে দৌঁড়ে এসে ফারিয়ার বাবার সামনে এসে দাঁড়াল।এক নিঃশ্বাসে সবকিছু খুলে বলল সে।
ফারিয়ার বাবা সবকিছু শুনে অস্থির হয়ে উঠলো।সে কিভাবে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।পাশে ছিলো ফারিয়ার মা সে কান্না করতে লাগলো।কান্না জড়ানো কন্ঠে সে ফারিয়ার বাবাকে বলল,যেভাবে পারো তাড়াতাড়ি আমার মেয়েকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসো।
ফারিয়ার বাবা তার বউকে বলল,তুমি এতো কান্নাকাটি করো না আমি দেখছি কিভাবে ফারিয়াকে মুক্ত করা যায়।আমি আসছি রেহানা তুমি বাড়িতে যাও।
বেশ চিন্তা নিয়ে বাসা থেকে বের হলো ফারিয়ার বাবা আরমান খান।সে কখনো থানার ধারে কাছেও যায়নি কিন্তু এখন তাকে যেতে হবে তবে সে কি কিছু করতে পারবে? নিজে নিজে ভাবলো তাকে দিয়ে এ বিষয়ে কোনো কাজ তো হবে না।কারণ পুলিশের সঙ্গে সে কিছু বলে সুবিধে করতে পারবে না।কি করা যায়।একটু চিন্তা করে সে বের করলো আরে আমি ভাবছি কেন আমার বন্ধু মিজান ই তো একজন উকিল।ওকে খবর দিলেই তো হয়।
এদিকে মহল্লায় খবর ছড়িয়ে পরলো কমিশনারের ছেলে রবিন আর তার বন্ধুকে একটি মেয়ে খুন করে ফেলেছে।আসলে কি ঘটেছে তা কেউ খতিয়ে না দেখে এলাকায় একটা খবর ছড়িয়ে দিল কেউ কেউ। এ কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেল আরমান খান।সে ভাবলো যদি ঐ বখাটে ছেলে মারাই যায় তবে তো ফারিয়ার আর রক্ষা নাই।
বেশ অস্থির হয়ে সে তার বন্ধুকে মোবাইলে সবকিছু খুলে বলল। আর তাকে দ্রুত আসতে বলল।বন্ধুর কথা শুনে এক ঘন্টার মধ্যেই মিজান এসে তার সামনে হাজির হলো।বন্ধুর জন্যই অপেক্ষা করছিল সে থানার সামনে।ফারিয়াকে বাসায় না নিয়ে সে তো বাসায় যেতে পারে না।
এবার বন্ধু আসায় তার মনের শক্তি বেড়ে গেল।সে বন্ধুকে বলল,দোস্ত মিজান সবকিছু তো শুনছিস মেয়েটা আমার অনেকক্ষণ হলো থানায় আটকা আছে তাড়াতাড়ি ওকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা কর।
অস্থির হইও না বন্ধু।আমি সব ব্যবস্থা করছি আরেকটু সবুর করো আমার সহকারি হাসপাতালে গেছে ওরা আসলে কেমন আছে সেটা দেখে তবেই আমরা সেই ধরনের ব্যবস্থা নেব।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ফারিয়াকে বের করে নিয়ে এলো মিজান।কারণ বখাটে ছেলেদের তেমন কিছুই হয়নি ওরা আসলে কিছুটা অভিনয় করেছিল ফারিয়াকে বিপাকে ফেলে দেবার জন্য।হাসপাতাল থেকে ওরা ছাড়া পেয়ে যে যার মতো বাসায় চলে যায়।গুজবের কারণে চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরেছিল।আর কলমের আক্রমণে কতটা ই বা আর ক্ষতি হতে পারে।যেহেতু ছেলেগুলো অপরাধি ছিল তাই তাদের পক্ষ থেকে কেউ আর থানায় হয়তো কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেনি।সুতরাং ফারিয়াকেও আর থানায় আটকে রাখার তেমন কোনো কারণ খুঁজে পায়নি থানার ওসি।
ভবিষ্যতে ফারিয়াকে সাবধান হয়ে চলার জন্য বলে দিলো থানার ওসি।এভাবে সে যেন না বুঝে আর কারো প্রতি আক্রমণ করে বসে। তাকে সমাজের এই বখাটে ছেলেদের এড়িয়ে চলার জন্য বলে দিল সে।ফারিয়া তার সব কথায় সায় দিয়ে থানা থেকে বের হয়ে এলো তার বাবা আর তার বাবার বন্ধুর সঙ্গে। পুলিশের সঙ্গে যাবতীয় কথা মিজানই বলেছিল।
পরদিন আর কলেজে যাওয়া হয়নি ফারিয়া কিম্বা রেহানা কারোর ই।ওরা ভয় পেয়েছে মনে মনে হয়তো অথবা ওদের বাবা মায়েরা আরো বেশি ভয় পেয়েছে তাই বাবা মা ই ওদের আর কলেজে যেতে দেয়নি। কারণ বখাটে ছেলে গুলো তো আর রাস্তা ছেড়ে দেয়নি। সমাজে কেউ ওদের বাঁধা দেয় না বরং আরো উস্কে দেয়।এটাই এখন সমাজের ভয়,মানুষের ভয় তথা দেশের ভয়। অপরাধকে কেউ এখন আর অপরাধ বলতে চায় না,কেউ বাঁধা দিতে চায় না।আর এ কারণেই দিকে দিকে ছড়িয়ে পরছে রোজ রোজ অস্থিরতা আর শৃঙ্খলাহীনতা।
ফারিয়াকে এবার তার বাবা মাও বোঝাতে চেষ্টা করতে লাগল।তার বাবা তাকে বলল,মা তুমি এমন করতে কেন গেলে আর এভাবে কখনো নিজেকে উত্তেজিত করে ফেলো না যেন।এরা সমাজের প্রতিটি যায়গায় রয়েছে যতটা পারা যায় এদেরকে এড়িয়ে চলা শিখতে হবে।
বাবার কথা শুনে ফারিয়া হেসে বলল,বাবা তুমি ও তো ওসির মতো বললে আসলে ঐ অমানুষদের কিভাবে তুমি এড়িয়ে যাবে ওরা তো হারামি,বাবা মায়ের অবাধ্য সন্তান তুমি যদি ওদের দেখে আরেক দিকে হেঁটে যাও তবে ওরাও সে দিকে যাবে।কিছুতেই এড়াতে পারবে না তোমার পিছু লেগেই থাকবে।এ মানুষগুলো যেন অন্য মানুষ কিছুতেই পিছু ছাড়বে না।এরা সমাজের কিট মানুষের জন্য ভোগান্তির তবু কেউ এদের থামাতে আসে না।
তোকে থামাতে হবে না।তুই নিজের পথে মাথা নিচু করে চলবি বুঝলি। সব মেয়েরা নিজেদের বাঁচিয়ে চলে তুইও সে ভাবে চলবি বুঝলি।ফারিয়ার মা তাকে শাসিয়ে বলে উঠল।
আচ্ছা মা ঠিক আছে তোমাদের কথা মতোই চলব। আমি আর কখনো মাথা গরম করবো না।এবার তো বলো আমাকে আবার কবে কলেজে যেতে দেবে?ফারিয়া আবার কবে কলেজে যেতে পারবে সেটা বাবা মায়ের কাছে জানতে চাইল।
অবস্থা একটু ঠান্ডা হোক।ওরা তো বাজে ছেলে আবার কি করে বসে আমার তো খুব চিন্তা হচ্ছে মা তুই এ সপ্তাহে আর কলেজে যেতে পারবি না।তোর বাবা বাইরে গিয়ে ঘুরে দেখুক ওই ছেলেগুলোকে রাস্তায় দেখলে আর তোর কলেজে যাওয়া হবে না।পরিস্থিতি শান্ত হলে তবেই কলেজে যেতে পারবি। ফারিয়ার মা তাকে কঠিন ভাবে বলে দিল।
ফারিয়া মায়ের কথা মেনে নিল।সে কোনো কথা বলল না আর।
পনের দিন চলে গেল।ফারিয়ার বাবা দেখল চারিদিকে ঐ বিষয়ে আর কেউ কোনো আলোচনা করে না।সুতরাং হয়তো বখাটেরাও আর এ কথা মনে রাখেনি তাই সে এবার মেয়েকে কলেজে যাবার জন্য বলল। আবার আগের মতো ফারিয়া তার বান্ধবী রেহানাকে নিয়ে কলেজে যেতে শুরু করে দিল।
মেয়ে আবার কলেজে যেতে শুরু করেছে ঠিকই কিন্তু তাদের বাবা মায়ের চিন্তা কিছুতেই দূর হয়ে যায়নি।তাই মাঝে মাঝে ফারিয়ার মা তার সঙ্গে কলেজে গিয়ে তাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে লাগল।
এদিকে কমিশনারের ছেলে রবিন চুপচাপ বসে থাকার পাত্র নয়।সে একটু কৌশল করে কিছুদিন চুপ করে ছিল।তার বাবা তাকে চরম তিরস্কার করলো মেয়েদের হাতে মার খেয়েছে বলে।আর এ কারনে মহল্লায় তাদের ইজ্জত মাটির সাথে মিশে গেছে এটা বলে তার বাবা তাকে আরো বেশি করে উস্কে দিল।সে চুপচাপ তার বাবার কথা শুনে শুধু বলল,তুমি দেখে নিও বাবা এর চরম প্রতিশোধ আমি নেব।তখন কিন্তু আবার বলো না যেন যে এভাবে করতে গেলি কেন।
যা যা দেখা হয়েছে তোর ক্ষমতা।মেয়েদের মার খেয়ে ইজ্জত নষ্ট করেছিস আবার কথা বলিস তোর লজ্জা থাকা উচিত।রবিনের বাবা তাকে এভাবে নানা ধরনের কথা বলে বেশ ক্ষেপিয়ে দিল যার ফলে সে চরম প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা করে চুপচাপ বসে রইল।
মাস পার হয়ে গেল।ফারিয়া আর তার বাবা মা ভাবলো আর কোনো সমস্যা হবে না।সুতরাং আবার আগের মতো স্বাভাবিক ভাবে সে তার বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে কলেজে,প্রাইভেট পড়তে যাওয়া আসা করতে শুরু করলো।কোথাও আর রবিন কে বা তার সাঙ্গপাঙ্গ কে দেখা গেল।ফারিয়া ভেবেই নিল যে তার দেয়া শাসনে কাজ হয়েছে ছেলেগুলো হয়তো শুধরে গিয়েছে।সে তার বাবা মাকেও বললো ,দেখেছ তোমরা কেউ ওদের কাজে প্রতিরোধ করলেই ওরা থেমে যেত কিন্তু এতোদিন কেউ তা করেনি। আমরা সাহস করে এ কাজটা করেছি আর ওরা ছিল ভীতু তাই নিজেদের খারাপ কাজ থেকে ওরা ফিরে গিয়েছে।
ফারিয়ার বাবা শুধু বলল,না মা এতোটা সহজ ভাবে বিষয়টাকে নিয়ে নিলে হবে না।আমার মনে হয় যাই ঘটুক তোমাকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।কেননা ওরা তো ভালো মানুষ না।
আচ্ছা বাবা আমরা সাবধানেই চলব তোমরা বেশি চিন্তা করো না।ফারিয়া তার বাবা মাকে নিশ্চিন্ত করে বলল।
যদিও ফারিয়া তার বাবা মাকে নিশ্চিন্ত করে বলল কিন্তু আসলে তার ভাবনা সঠিক ছিল না।তার বাবা যে সংশয় করেছিল সেটাই ঠিক ছিল। কেননা রবিন আর তার বন্ধুরা ছিল বাজে ছেলে তারা তো দমে যায়নি শুধু কিছুদিন চুপ করে ছিল কারন তারা চাইছিল এলাকার লোকজন যেন বিষয়টা ভুলে যায়।আর তাদের মনের ইচ্ছাই তারা পূরণ করলো।
মহল্লায় সবাই যখন বিষয়টা ভুলে যেতে বসেছে ঠিক তখনই তারা আবার সরব হয়ে উঠল।ফারিয়া আর তার বান্ধবী রেহানা প্রাইভেট পড়া শেষ করে বাসায় ফিরছিল তখনই বখাটের দল তাদের ওপরে ঝাপিয়ে পরলো। এবার আর নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না ফারিয়া।
এসিডে ঝলসে গেল ফারিয়া আর রেহানা।বখাটের দল আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিল।তাই ওরা কিছু বোঝার আগেই ওদের ওপরে এসিড দিয়ে এমনভাবে আক্রমণ করলো বখাটে রবিনের দল যে ওরা আর কিছু বলার ই সুযোগ পেল না।কাজ শেষ করে সবাই পালিয়ে গেল কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
পাচ ছয় জন লোক বিষয়টা দেখল।তারা আর ওদের পিছু নিল না কিন্তু মানবিক কারনে তারা ফারিয়া আর রেহানাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।ওরা এতো বড় ধকল কেউই সহ্য করতে পারলো না।
ফারিয়া আর রেহানার মা দুজনেই কান্নায় ভেঙ্গে পরলো।মেয়েদের লাশ দেখে তারা বারবার অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগল।তারা ভুলেও ভাবেনি এমন ঘটনা তাদের জীবন কখনো ঘটতে পারে।তারা ভাবেনি যে বখাটে ছেলেগুলো এতটা অমানুষ হতে পারে তাহলে আর কোনোদিন মেয়েদেরকে বাইরে বের হতে দিত না।কেন যে তারা বুঝল না তা নিয়ে বারবার আক্ষেপ করতে লাগল।
ফারিয়ার বাবা মনে মনে কিছু একটা ভয় করতে ছিল যে বখাটে ছেলেগুলো আবার কিছু করে বসে কিনা তার সেই ভয় যে এভাবে বাস্তব হয়ে উঠবে তা সে কল্পনাও করেনি কোনোদিন।নিজের একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে সে নিথর হয়ে বসে রইল।
কেউ কেউ বলল তাড়াতাড়ি থানায় গিয়ে ওদের নামে মামলা করে দাও।এর একটা বিচার হওয়া দরকার।আরো কত মেয়ের জীবন ওরা নষ্ট করে ফেলে কে জানে।
ফারিয়ার বাবা নিশ্চুপ বসে রইল।
সে মনে মনে বলল আজ আমার মেয়েকে হারিয়েছি তাকে আর ফিরে পাব না।কিন্তু আমি আর লড়তে যাব না,আমি জানি তাদের সঙ্গে আমি লড়ে পারবো না।দেশের আইন নানাবিধ কলকাঠিতে নড়েচড়ে শেষে আমাকেই হেস্তনেস্ত করে ফেলবে হয়তো।অথবা রাজনৈতিক গ্যাড়াকলে আমি আমার মেয়েকে হারিয়েছি তারপরেও আমাকেই নানাবিধভাবে আবার অপমানিত হতে হবে।কেননা আমাকে কেউ সাপোর্ট করতে আসবে না এখানে সবাই যাবে ওদের দলে কারন ওদের রয়েছে টাকা আর দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা।আমি ভয় করছি আমি পেরে উঠবো না ওদের সাথে।তাই আমি লড়বো না, শুধু সময়ের হাতে আল্লাহ্ র হাতে ছেড়ে দিলাম এর বিচারের দায়িত্ব।
ফারিয়ার বাবার নিশ্চুপ হাহাকার কেউই শুনলো না।হয়তো আল্লাহ্ শুনে নিয়েছেন আর এর বিচার তিনিই করবেন এই বিশ্বাস বুকে নিয়ে তিনি চোখ মুছে ফারিয়াকে শেষ বিদায় জানানোর ব্যবস্থা করার কাজে লেগে গেলেন।
২১.০৮.২০২১
রেহানা দ্রুত এই খবর নিয়ে ফারিয়াদের বাসায় এসে পৌঁছাল।তার বাসাও একই মহল্লায়।হন্তদন্ত হয়ে সে দৌঁড়ে এসে ফারিয়ার বাবার সামনে এসে দাঁড়াল।এক নিঃশ্বাসে সবকিছু খুলে বলল সে।
ফারিয়ার বাবা সবকিছু শুনে অস্থির হয়ে উঠলো।সে কিভাবে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।পাশে ছিলো ফারিয়ার মা সে কান্না করতে লাগলো।কান্না জড়ানো কন্ঠে সে ফারিয়ার বাবাকে বলল,যেভাবে পারো তাড়াতাড়ি আমার মেয়েকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসো।
ফারিয়ার বাবা তার বউকে বলল,তুমি এতো কান্নাকাটি করো না আমি দেখছি কিভাবে ফারিয়াকে মুক্ত করা যায়।আমি আসছি রেহানা তুমি বাড়িতে যাও।
বেশ চিন্তা নিয়ে বাসা থেকে বের হলো ফারিয়ার বাবা আরমান খান।সে কখনো থানার ধারে কাছেও যায়নি কিন্তু এখন তাকে যেতে হবে তবে সে কি কিছু করতে পারবে? নিজে নিজে ভাবলো তাকে দিয়ে এ বিষয়ে কোনো কাজ তো হবে না।কারণ পুলিশের সঙ্গে সে কিছু বলে সুবিধে করতে পারবে না।কি করা যায়।একটু চিন্তা করে সে বের করলো আরে আমি ভাবছি কেন আমার বন্ধু মিজান ই তো একজন উকিল।ওকে খবর দিলেই তো হয়।
এদিকে মহল্লায় খবর ছড়িয়ে পরলো কমিশনারের ছেলে রবিন আর তার বন্ধুকে একটি মেয়ে খুন করে ফেলেছে।আসলে কি ঘটেছে তা কেউ খতিয়ে না দেখে এলাকায় একটা খবর ছড়িয়ে দিল কেউ কেউ। এ কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেল আরমান খান।সে ভাবলো যদি ঐ বখাটে ছেলে মারাই যায় তবে তো ফারিয়ার আর রক্ষা নাই।
বেশ অস্থির হয়ে সে তার বন্ধুকে মোবাইলে সবকিছু খুলে বলল। আর তাকে দ্রুত আসতে বলল।বন্ধুর কথা শুনে এক ঘন্টার মধ্যেই মিজান এসে তার সামনে হাজির হলো।বন্ধুর জন্যই অপেক্ষা করছিল সে থানার সামনে।ফারিয়াকে বাসায় না নিয়ে সে তো বাসায় যেতে পারে না।
এবার বন্ধু আসায় তার মনের শক্তি বেড়ে গেল।সে বন্ধুকে বলল,দোস্ত মিজান সবকিছু তো শুনছিস মেয়েটা আমার অনেকক্ষণ হলো থানায় আটকা আছে তাড়াতাড়ি ওকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা কর।
অস্থির হইও না বন্ধু।আমি সব ব্যবস্থা করছি আরেকটু সবুর করো আমার সহকারি হাসপাতালে গেছে ওরা আসলে কেমন আছে সেটা দেখে তবেই আমরা সেই ধরনের ব্যবস্থা নেব।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ফারিয়াকে বের করে নিয়ে এলো মিজান।কারণ বখাটে ছেলেদের তেমন কিছুই হয়নি ওরা আসলে কিছুটা অভিনয় করেছিল ফারিয়াকে বিপাকে ফেলে দেবার জন্য।হাসপাতাল থেকে ওরা ছাড়া পেয়ে যে যার মতো বাসায় চলে যায়।গুজবের কারণে চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরেছিল।আর কলমের আক্রমণে কতটা ই বা আর ক্ষতি হতে পারে।যেহেতু ছেলেগুলো অপরাধি ছিল তাই তাদের পক্ষ থেকে কেউ আর থানায় হয়তো কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেনি।সুতরাং ফারিয়াকেও আর থানায় আটকে রাখার তেমন কোনো কারণ খুঁজে পায়নি থানার ওসি।
ভবিষ্যতে ফারিয়াকে সাবধান হয়ে চলার জন্য বলে দিলো থানার ওসি।এভাবে সে যেন না বুঝে আর কারো প্রতি আক্রমণ করে বসে। তাকে সমাজের এই বখাটে ছেলেদের এড়িয়ে চলার জন্য বলে দিল সে।ফারিয়া তার সব কথায় সায় দিয়ে থানা থেকে বের হয়ে এলো তার বাবা আর তার বাবার বন্ধুর সঙ্গে। পুলিশের সঙ্গে যাবতীয় কথা মিজানই বলেছিল।
পরদিন আর কলেজে যাওয়া হয়নি ফারিয়া কিম্বা রেহানা কারোর ই।ওরা ভয় পেয়েছে মনে মনে হয়তো অথবা ওদের বাবা মায়েরা আরো বেশি ভয় পেয়েছে তাই বাবা মা ই ওদের আর কলেজে যেতে দেয়নি। কারণ বখাটে ছেলে গুলো তো আর রাস্তা ছেড়ে দেয়নি। সমাজে কেউ ওদের বাঁধা দেয় না বরং আরো উস্কে দেয়।এটাই এখন সমাজের ভয়,মানুষের ভয় তথা দেশের ভয়। অপরাধকে কেউ এখন আর অপরাধ বলতে চায় না,কেউ বাঁধা দিতে চায় না।আর এ কারণেই দিকে দিকে ছড়িয়ে পরছে রোজ রোজ অস্থিরতা আর শৃঙ্খলাহীনতা।
ফারিয়াকে এবার তার বাবা মাও বোঝাতে চেষ্টা করতে লাগল।তার বাবা তাকে বলল,মা তুমি এমন করতে কেন গেলে আর এভাবে কখনো নিজেকে উত্তেজিত করে ফেলো না যেন।এরা সমাজের প্রতিটি যায়গায় রয়েছে যতটা পারা যায় এদেরকে এড়িয়ে চলা শিখতে হবে।
বাবার কথা শুনে ফারিয়া হেসে বলল,বাবা তুমি ও তো ওসির মতো বললে আসলে ঐ অমানুষদের কিভাবে তুমি এড়িয়ে যাবে ওরা তো হারামি,বাবা মায়ের অবাধ্য সন্তান তুমি যদি ওদের দেখে আরেক দিকে হেঁটে যাও তবে ওরাও সে দিকে যাবে।কিছুতেই এড়াতে পারবে না তোমার পিছু লেগেই থাকবে।এ মানুষগুলো যেন অন্য মানুষ কিছুতেই পিছু ছাড়বে না।এরা সমাজের কিট মানুষের জন্য ভোগান্তির তবু কেউ এদের থামাতে আসে না।
তোকে থামাতে হবে না।তুই নিজের পথে মাথা নিচু করে চলবি বুঝলি। সব মেয়েরা নিজেদের বাঁচিয়ে চলে তুইও সে ভাবে চলবি বুঝলি।ফারিয়ার মা তাকে শাসিয়ে বলে উঠল।
আচ্ছা মা ঠিক আছে তোমাদের কথা মতোই চলব। আমি আর কখনো মাথা গরম করবো না।এবার তো বলো আমাকে আবার কবে কলেজে যেতে দেবে?ফারিয়া আবার কবে কলেজে যেতে পারবে সেটা বাবা মায়ের কাছে জানতে চাইল।
অবস্থা একটু ঠান্ডা হোক।ওরা তো বাজে ছেলে আবার কি করে বসে আমার তো খুব চিন্তা হচ্ছে মা তুই এ সপ্তাহে আর কলেজে যেতে পারবি না।তোর বাবা বাইরে গিয়ে ঘুরে দেখুক ওই ছেলেগুলোকে রাস্তায় দেখলে আর তোর কলেজে যাওয়া হবে না।পরিস্থিতি শান্ত হলে তবেই কলেজে যেতে পারবি। ফারিয়ার মা তাকে কঠিন ভাবে বলে দিল।
ফারিয়া মায়ের কথা মেনে নিল।সে কোনো কথা বলল না আর।
পনের দিন চলে গেল।ফারিয়ার বাবা দেখল চারিদিকে ঐ বিষয়ে আর কেউ কোনো আলোচনা করে না।সুতরাং হয়তো বখাটেরাও আর এ কথা মনে রাখেনি তাই সে এবার মেয়েকে কলেজে যাবার জন্য বলল। আবার আগের মতো ফারিয়া তার বান্ধবী রেহানাকে নিয়ে কলেজে যেতে শুরু করে দিল।
মেয়ে আবার কলেজে যেতে শুরু করেছে ঠিকই কিন্তু তাদের বাবা মায়ের চিন্তা কিছুতেই দূর হয়ে যায়নি।তাই মাঝে মাঝে ফারিয়ার মা তার সঙ্গে কলেজে গিয়ে তাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে লাগল।
এদিকে কমিশনারের ছেলে রবিন চুপচাপ বসে থাকার পাত্র নয়।সে একটু কৌশল করে কিছুদিন চুপ করে ছিল।তার বাবা তাকে চরম তিরস্কার করলো মেয়েদের হাতে মার খেয়েছে বলে।আর এ কারনে মহল্লায় তাদের ইজ্জত মাটির সাথে মিশে গেছে এটা বলে তার বাবা তাকে আরো বেশি করে উস্কে দিল।সে চুপচাপ তার বাবার কথা শুনে শুধু বলল,তুমি দেখে নিও বাবা এর চরম প্রতিশোধ আমি নেব।তখন কিন্তু আবার বলো না যেন যে এভাবে করতে গেলি কেন।
যা যা দেখা হয়েছে তোর ক্ষমতা।মেয়েদের মার খেয়ে ইজ্জত নষ্ট করেছিস আবার কথা বলিস তোর লজ্জা থাকা উচিত।রবিনের বাবা তাকে এভাবে নানা ধরনের কথা বলে বেশ ক্ষেপিয়ে দিল যার ফলে সে চরম প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা করে চুপচাপ বসে রইল।
মাস পার হয়ে গেল।ফারিয়া আর তার বাবা মা ভাবলো আর কোনো সমস্যা হবে না।সুতরাং আবার আগের মতো স্বাভাবিক ভাবে সে তার বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে কলেজে,প্রাইভেট পড়তে যাওয়া আসা করতে শুরু করলো।কোথাও আর রবিন কে বা তার সাঙ্গপাঙ্গ কে দেখা গেল।ফারিয়া ভেবেই নিল যে তার দেয়া শাসনে কাজ হয়েছে ছেলেগুলো হয়তো শুধরে গিয়েছে।সে তার বাবা মাকেও বললো ,দেখেছ তোমরা কেউ ওদের কাজে প্রতিরোধ করলেই ওরা থেমে যেত কিন্তু এতোদিন কেউ তা করেনি। আমরা সাহস করে এ কাজটা করেছি আর ওরা ছিল ভীতু তাই নিজেদের খারাপ কাজ থেকে ওরা ফিরে গিয়েছে।
ফারিয়ার বাবা শুধু বলল,না মা এতোটা সহজ ভাবে বিষয়টাকে নিয়ে নিলে হবে না।আমার মনে হয় যাই ঘটুক তোমাকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।কেননা ওরা তো ভালো মানুষ না।
আচ্ছা বাবা আমরা সাবধানেই চলব তোমরা বেশি চিন্তা করো না।ফারিয়া তার বাবা মাকে নিশ্চিন্ত করে বলল।
যদিও ফারিয়া তার বাবা মাকে নিশ্চিন্ত করে বলল কিন্তু আসলে তার ভাবনা সঠিক ছিল না।তার বাবা যে সংশয় করেছিল সেটাই ঠিক ছিল। কেননা রবিন আর তার বন্ধুরা ছিল বাজে ছেলে তারা তো দমে যায়নি শুধু কিছুদিন চুপ করে ছিল কারন তারা চাইছিল এলাকার লোকজন যেন বিষয়টা ভুলে যায়।আর তাদের মনের ইচ্ছাই তারা পূরণ করলো।
মহল্লায় সবাই যখন বিষয়টা ভুলে যেতে বসেছে ঠিক তখনই তারা আবার সরব হয়ে উঠল।ফারিয়া আর তার বান্ধবী রেহানা প্রাইভেট পড়া শেষ করে বাসায় ফিরছিল তখনই বখাটের দল তাদের ওপরে ঝাপিয়ে পরলো। এবার আর নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না ফারিয়া।
এসিডে ঝলসে গেল ফারিয়া আর রেহানা।বখাটের দল আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিল।তাই ওরা কিছু বোঝার আগেই ওদের ওপরে এসিড দিয়ে এমনভাবে আক্রমণ করলো বখাটে রবিনের দল যে ওরা আর কিছু বলার ই সুযোগ পেল না।কাজ শেষ করে সবাই পালিয়ে গেল কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
পাচ ছয় জন লোক বিষয়টা দেখল।তারা আর ওদের পিছু নিল না কিন্তু মানবিক কারনে তারা ফারিয়া আর রেহানাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।ওরা এতো বড় ধকল কেউই সহ্য করতে পারলো না।
ফারিয়া আর রেহানার মা দুজনেই কান্নায় ভেঙ্গে পরলো।মেয়েদের লাশ দেখে তারা বারবার অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগল।তারা ভুলেও ভাবেনি এমন ঘটনা তাদের জীবন কখনো ঘটতে পারে।তারা ভাবেনি যে বখাটে ছেলেগুলো এতটা অমানুষ হতে পারে তাহলে আর কোনোদিন মেয়েদেরকে বাইরে বের হতে দিত না।কেন যে তারা বুঝল না তা নিয়ে বারবার আক্ষেপ করতে লাগল।
ফারিয়ার বাবা মনে মনে কিছু একটা ভয় করতে ছিল যে বখাটে ছেলেগুলো আবার কিছু করে বসে কিনা তার সেই ভয় যে এভাবে বাস্তব হয়ে উঠবে তা সে কল্পনাও করেনি কোনোদিন।নিজের একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে সে নিথর হয়ে বসে রইল।
কেউ কেউ বলল তাড়াতাড়ি থানায় গিয়ে ওদের নামে মামলা করে দাও।এর একটা বিচার হওয়া দরকার।আরো কত মেয়ের জীবন ওরা নষ্ট করে ফেলে কে জানে।
ফারিয়ার বাবা নিশ্চুপ বসে রইল।
সে মনে মনে বলল আজ আমার মেয়েকে হারিয়েছি তাকে আর ফিরে পাব না।কিন্তু আমি আর লড়তে যাব না,আমি জানি তাদের সঙ্গে আমি লড়ে পারবো না।দেশের আইন নানাবিধ কলকাঠিতে নড়েচড়ে শেষে আমাকেই হেস্তনেস্ত করে ফেলবে হয়তো।অথবা রাজনৈতিক গ্যাড়াকলে আমি আমার মেয়েকে হারিয়েছি তারপরেও আমাকেই নানাবিধভাবে আবার অপমানিত হতে হবে।কেননা আমাকে কেউ সাপোর্ট করতে আসবে না এখানে সবাই যাবে ওদের দলে কারন ওদের রয়েছে টাকা আর দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা।আমি ভয় করছি আমি পেরে উঠবো না ওদের সাথে।তাই আমি লড়বো না, শুধু সময়ের হাতে আল্লাহ্ র হাতে ছেড়ে দিলাম এর বিচারের দায়িত্ব।
ফারিয়ার বাবার নিশ্চুপ হাহাকার কেউই শুনলো না।হয়তো আল্লাহ্ শুনে নিয়েছেন আর এর বিচার তিনিই করবেন এই বিশ্বাস বুকে নিয়ে তিনি চোখ মুছে ফারিয়াকে শেষ বিদায় জানানোর ব্যবস্থা করার কাজে লেগে গেলেন।
২১.০৮.২০২১
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মনিরুজ্জামান প্রমউখ ০৭/০১/২০২২সুন্দর ।
-
এন এ জুবাইর মাহমুদ ১৫/১২/২০২১সত্যি, অসাধারন লেখনী । এগিয়ে যান ভাই ।
-
ফয়জুল মহী ২৬/১১/২০২১শুভ কামনা রইলো।
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ২৬/১১/২০২১দুঃখজনক কাহিনী।