চায়না পুতুল
তুই না নিলে আর কে নেবে বল সখিনা ? চুলের মুঠি ধরে জোড়ে টান মেরে সালমা বেগম জিগ্যেস করলেন সখিনাকে।
জবাবে সখিনা বলল,না খালাম্মা,আমি জীবনে ও কোনো দিন চুরি করি নাই।বিশ্বাস করেন খালাম্মা আমি চোর না।আমি চুরি করি নাই।বিশ্বাস করেন আমার কথা।
সখিনা। সালমা বেগমের ঘরের কাজের লোক।বহুদিন ধরে এই ঘরে কাজ করছে সখিনা।কোনো দিন কোনো ঝামেলা হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আজকে সকালে কাজে আসার পর থেকেই সখিনা আর তার তিন বছরের ছেলে কে একটা রুমে আটকে রেখেছে সালমা বেগমের বড় ছেলে আজমল।
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করে সখিনা নিজের বাড়ীতে চলে যায়।গতকালও সেভাবেই সে চলে গিয়েছিল,কিন্তু আজকে কাজে আসতেই আজমল তাকে বলল,সখিনা তুই চুরি করেছিস তাই এই রুমে তোকে আটকে রাখছি।তোকে কোনো মারধোর করবো না যদি তুই স্বীকার করিস আর চুরির টাকা ফিরিয়ে দিস।
তার কথা শুনে সখিনা তখন আকাশ থেকে পড়েছিল।সে তো চুরি সম্পর্কে কিছুই জানে না।অথচ তাকে এখন চুরির দায়ে বন্ধি করে রাখা হয়েছে।
আর সেই ব্যাপারেই গৃহকর্ত্রী সালমা বেগম এসে সখিনাকে জেরা করছিল।আর তার প্রশ্নের জবাবে সখিনা বারবার না সূচক উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল।
সালমা বেগম পুনরায় সখিনার চুলের মুঠি ধরে বলল,দেখ সখিনা তুই যে চুরি করেছিস তাতো পুরোপুরি সত্য,কিন্তু তুই ধরা পরে এভাবে মিথ্যা বলিস না।টাকাটা ফেরত দে,তাহলে তোকে আমরা পুলিশে দেব না।দেখ তুই আমাদের পুরানো কাজের লোক তাই আপোসে বলছি সত্য কথা বল।
সালমা বেগমের কথা শুনে সখিনা বলল,খালাম্মা আমি সত্য কথা বলছি ,বিশ্বাস করেন ,আমারে ছাইড়া দেন।
এভাবে হবে না মা । আমি পুলিশে খবর দিয়েছি,তারা এসে যাবে এক্ষুণি বলল আছরের আযানের পরপর ই ,যা করার তারাই করবে।পাশের রুম থেকে আজমল বলে উঠল।
পুলিশের কথা শুনে কেঁদে ফেলল সখিনা।সে তার ছেলেটাকে কাছে টেনে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো।তারপরে একটু উঠে গিয়ে পাশে দাঁড়ানো সালমা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে বলল,খালাম্মা আমারে পুলিশে দিয়েন না।বিশ্বাস করেন আমি চুরির ব্যাপারে কিছুই জানি না।
সখিনার কান্নায় সালমা বেগমের মন গলেনি।কেননা এতোগুলো টাকা সে কিভাবে ছেড়ে দেয়।আর সখিনা ছাড়া কে ই বা চুরি করতে সাহস পাবে আজমল এর বাবার পকেট থেকে।সারমা বেগম ভেবে কূল কিনারা করতে পারছে না।সে সখিনাকে পা থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,দেখ সখিনা পুলিশের মার খাওয়ার আগে স্বীকার কর।না হলে আমি কিন্তু তোর জন্য কিছু করতে পারবো না।
সালমা বেগমের কথা শুনে সখিনা আরো জোড়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো।সে যে চুরি করেনি তা কিভাবে বুঝাবে।কিভাবে প্রমাণ করবে সখিনা যে সে চোর নয়।এমনকি সে তো এটাও জানে না যে কার টাকা,কত টাকা কিভাবে চুরি হয়েছে।দুঃখে তার কান্না আরো বেড়ে গেল।আজ গরীব হয়েছে বলে,চুরির দায়ভার তার কাঁধেই চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।কি করবে সে বুঝতে পারছে না।নিশ্চুপে কাঁদতে লাগল সখিনা।তার ছোট্ট ছেলেটা নীরবে অবাক নয়নে মায়ের কান্না দেখতে লাগল।
আছরের নামাযের আযান হতেই পুলিশ এসে হাজির হলো। একজন পুলিশ কর্মকর্তা আর দুইজন কনষ্টেবল।পুলিশদেরকে সামনে বসাল আজমল।একটু বসেই পুলিশ কর্মকর্তা আজমল কে বলল,আসামি কোথায় ? আর সবাইকে সামনে নিয়ে আসেন , চুরির বিষয়টা পরিস্কার ভাবে জানতে হবে তো।
আজমল সবাইকে সামনের রুমে ডেকে আনলো।শেষে সখিনাকেও তার ছেলেসহ সামনের রুমে নিয়ে এলো।একে একে সবাই তারা বসে পড়লো।আজমলের স্ত্রী তার ছেলেকে নিয়ে আজমলের পাশে বসল।সালমা বেগম তার স্বামী আমজাদ খানকে সাথে নিয়ে বসল। আজমলদের এই ছোট্ট পরিবার।
সবাই বসতেই পুলিশ কর্মকর্তা আজমলকে জিগ্যেস করলো, সবাই কি এসেছে?
জবাবে আজমল বলল,হঁ্যা সবাই এসেছে।তবে আমার ছোটভাই বন্ধুদের সঙ্গে খুব ভোরে পিকনিকে গেছে। আজকেই ফেরার কথা।
আচ্ছা ঠিক আছে । তাহলে এই হচ্ছে চোর মহিলা আপনাদের মতে। এবার পুলিশ কর্মকর্তা জানতে চাইল আজমলদের কাছে।
হঁ্যা আমি নিশ্চিত ও ই টাকাটা চুরি করেছে। সালমা বেগম বলে উঠলেন ।
আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন?আর কত টাকা চুরি হয়েছে বলুন তো?পুলিশ কর্মকর্তা সালমা বেগমের কাছে এবার জানতে চাইল।
সালমা বেগম বলল,দশ হাজার টাকা।আর নিশ্চিত হয়েছি ঐ যে সখিনার ছেলের হাতের চাইনিজ পুতুলটা দেখে । এ টুকু বলে সালমা বেগম সখিনার ছেলের হাতের পুতুলটার দিকে ইঙ্গিত করলো।
সখিনা চমকে উঠলো সালমা বেগমের কথা শুনে।তাহলে খালাম্মা আমাকে এই কারণে সন্দেহ করেছে, সখিনা বিষয়টা এবার বুঝতে পারলো।সে তার ছেলেকে বুকে টেনে নিল।আর বলে উঠল,খালাম্মা আপনি ভুল বুঝছেন ,আমি টাকা চুরি করিনি।
পুলিশ কর্মকর্তা সখিনাকে ধমক দিয়ে বলল,তুমি চুপ করো। একটু থেমে সে আবার সালমা বেগমকে জিগ্যেস করলো,আচ্ছা বলুন তো আন্টি আপনি পুতুলটা দেখে কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে এই মহিলাই আপনাদের টাকাটা নিয়েছে?
এবার সালমা বেগম বিস্তারিত বলল,হঁ্যা তাহলে আমি খুলেই বলছি। গতকাল দুপুরে সখিনা আমার কাছে এসে দাবি করে বলে যে ,খালাম্মা আমাকে দুই হাজার টাকা অগ্রিম দেন।
আমি তখন জিগ্যেস করলাম ,কেন?
জবাবে ও বলল একটা চাইনিজ পুতুল নাকি ওর ছেলের খুব পছন্দ হয়েছে আর সখিনার বাবা অসুস্থ তাকে ডাক্তার দেখাতে টাকা লাগবে। আমি বললাম যে এত টাকা এখন দেয়া যাবে না।আর তাছাড়া তোর ছেলের চাইনিজ পুতুলের দরকারটাই বা কি? তখন সখিনা আর জোড়াজুড়ি করেনি আর আমিও তেমন আগ্রহ দেখাই নি। আর আজকে সকালে যখন আজমলের বাবার পকেট থেকে আমি বাজারের জন্য কিছু টাকা বের করতে যাই তখনই দেখি পকেটটা খালি। সবাইকে জিগ্যেস করলাম সবাই বলল কেউ ই টাকা নেয়নি। আর ঐ সময়েই সখিনা ওর ছেলেকে নিয়ে ঘরে ঢুকল আর ওর ছেলের হাতে দেখি ঐ চাইনিজ পুতুলটা।সুতরাং বুঝতেই পারছেন স্যার আমি কেন সখিনাকে নিশ্চিতভাবে সন্দেহ করছি।
দুইয়ে দুইয়ে মিলে চার হলো।এর চেয়ে নিশ্চিত প্রমাণ আর কি বা চাই।সালমা বেগমের অকাট্য প্রমাণে পুলিশ কর্মকর্তাও নিশ্চিত হলো যে সখিনাই টাকাটা চুরি করেছে।সে আর কিছু জিগ্যেস করলো না সালমা বেগমকে।
এবার সখিনার দিকে দৃষ্টি দিল পুলিশ কর্মকর্তা। সে সখিনাকে বলল, কি শুনলে তো আন্টির সব কথা,এবার বলো টাকাগুলো কি করেছ ,কোথায় রেখেছ ? যদি বাকি টাকা দিয়ে দাও তাহলে তোমাকে আর থানায় নেব না।এমনিতেই তুমি গরীব মানুষ আমরা তা বুঝতে পারছি।তুমি সত্যি কথা বলো এবং টাকাগুলো দিয়ে দাও।
পুলিশ কর্মকর্তার কথা শুনে সখিনা আবার জোড়ে কেঁদে উঠলো । কাঁদতে কাঁদতে সে বলল,স্যার আমি সত্যি কথাই বলছি আমি টাকা চুরি করি নাই। আর বাকি টাকার কথাই আসে না। আর ঐ চাইনিজ পুতুলটা আমার বোন ওকে কিনে দিয়েছে।গতকাল খালাম্মা টাকা না দেয়ায় আমি রাতে আমার বোনকে ছেলেটার পছন্দের কথা বলছিলাম ।আর গতকাল রাতেই ওর খালা ওরে ঐ পুতুলটা কিনে দিয়েছে।বিশ্বাস করুন আমি সত্যি কথা বলছি। আমি সত্যি কথা বলছি।
সখিনার কথা শুনে এক কনষ্টেবল একটু উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে জোড়সে বলে উঠল,এভাবে হবে না স্যার ,বলেন তো দুই ঘা লাগিয়ে দেই তাহলেই আর অভিনয় করবে না,ঠিক সত্যি কথা বলবে।
পুলিশ কর্মকর্তা তাকে থামিয়ে দিল।আর আমজাদ খানকে উদ্দেশ্যে করে জিগ্যেস করলো, আঙ্কেল আপনারা কি চান এই অল্প টাকার জন্য ওকে কি এখন জেলে পাঠাবেন ,নাকি ওকে সময় দেবেন টাকা শোধ করার জন্য?
জবাবে আমজাদ খান বলল,আমরা চাই ওর শাস্তি হোক।ও মিথ্যা কথা বলেছে তার প্রমাণ তো পেলেন।আর টাকার পরিমাণ যাই হোক চোরের শাস্তি হওয়া দরকার।
সখিনা তোমার আর কিছু বলার আছে ? পুলিশ কর্মকর্তা পুনরায় সখিনাকে জিগ্যেস করলো।
সখিনা কাঁদতে কাঁদতে বলল,আমি টাকা চুরি করি নাই।
পুলিশ কর্মকর্তা আর কথা বাড়াল না। সে বুঝতে পারল হয়তো সখিনাই টাকা নিয়েছে। আর এখন ধরা পরে ভয়ে মিথ্যা বলছে।সুতরাং ওকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়াই ভালো।সে কনষ্টেবলদের কে বলল, সখিনাকে গাড়ীতে নিয়ে ওঠাও। একটু থেমে আজমল কে বলল,আর আপনারা কেউ একজন আমাদের সঙ্গে চলেন।
পুলিশ কর্মকর্তার কথা শুনে আজমল দরজা খুলে তাদের সঙ্গে রওনা হওয়ার জন্য উদ্যত হলো। এমন সময় আজমলের ছোট ভাই এসে হাজির হলো।সে দরজার সামনে পুলিশ আর সখিনাকে বন্ধি দেখে তার বড় ভাইকে জিগ্যেস করলো,ভাইয়া কি হয়েছে ,পুলিশ কেন আর সখিনা বুয়াকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে কেন?
ছোট ভাইয়ের কথার জবাবে আজমল বলল,আরে বলিস না সখিনা বুয়া বাবার পকেট থেকে দশ হাজার টাকা চুরি করেছে সে কারণে ওকে নিয়ে এখন আমরা থানায় যাচ্ছি।
থামো ,থামো কত টাকা বললে?আজমলের ছোট ভাই চমকিত হয়ে জানতে চাইল।
ভিতর থেকে সালমা বেগম বললেন,দশ হাজার টাকা। কেন রনি তুই কিছু জানিস!
মায়ের কথার জবাবে রনি বলল,জানি মানে ঐ টাকা তো আব্বুর পকেট থেকে আমি নিয়েছিলাম।ও স্যরি মা ,আমার তাড়াহুড়ার জন্য আমি তোমাদেরকে জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম।আর পিকনিকে বন্ধুদের নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে তোমাদেরকে জানাতেই মনে ছিল না ,এদিকে যে এত কিছু হয়ে যাবে কে জানত!
সবাই বিস্মিত হলো রনির কথা শুনে।সখিনা রনির কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচল।এতক্ষণ তার মাথার ওপর যেন বিশাল পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল কেউ।
রনির কথা শুনে পুলিশ কর্মকর্তা কনষ্টেবলদেরকে ইঙ্গিত দিল সখিনাকে ছেড়ে দিতে।সখিনা ছাড়া পেয়ে তার ছেলেকে কোলে তুলে নিল।
পুলিশ কর্মকর্তা এবার আজমলকে উদ্দেশ্যে করে বলল, তাহলে আমরা চলি ভাই।সমস্যার সমাধান তো হয়ে গেল।আসলে আমার মনে হয় সবটুকুই ছিল আপনাদের নিজেদের মাঝে যোগাযোগের অভাবের কারণে একটা বড় ধরণের ভুল বোঝাবুঝি। আর আপনারা ঠিকভাবে খোঁজ নেন নি তাহলে আরো আগেই হযতো বিষয়টা বের হয়ে আসতো।আর তাহলে এভাবে সখিনা কে হেনস্তা হতে হতো না।যাই হোক সব ব্যাপারে একটু ভেবে চিন্তে পুলিশকে আপনারা ডেকে পাঠাবেন।
আমরা খুবই দুঃখিত।আজমল আর রনি দুই ভাই এক সঙ্গে বলে উঠল।
পুলিশ চলে গেল।সখিনাও চোখ মুছে চলে যেতে পা বাড়াল। সালমা বেগম পিছন থেকে ডাক দিয়ে তাকে থামাল এবং তাদের যে ভুল হয়ে গেছে সে জন্য সখিনার কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইল।
ঠিক আছে খালাম্মা । এতটুকু বলে সখিনা ছেলেকে নিয়ে হাঁটা দিল।
রনি তার পথ আটকাল আর বলল, বোন আমাকে মাফ করে দাও।আমার কারণে তোমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।আর তুমি আমাদের ছেড়ে যেও না।অনুরোধ করে বলছি।
সখিনার আবার কান্না পেল।চোখ মুছে ছেলেকে কোলে তুলে হাঁটতে হাঁটতে সে বলল, না ভাইজান সেটা আর হয় না।আপনারা সবাই ভালো থাকেন।
পিছনে চুরির অপবাদকে ফেলে নিজের এতোদিনের কাজ ফেলে সখিনা নতুন কোনো সম্ভাবনা খোঁজার প্রত্যয় নিয়ে সম্মুখপানে পা বাড়াল।
জবাবে সখিনা বলল,না খালাম্মা,আমি জীবনে ও কোনো দিন চুরি করি নাই।বিশ্বাস করেন খালাম্মা আমি চোর না।আমি চুরি করি নাই।বিশ্বাস করেন আমার কথা।
সখিনা। সালমা বেগমের ঘরের কাজের লোক।বহুদিন ধরে এই ঘরে কাজ করছে সখিনা।কোনো দিন কোনো ঝামেলা হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আজকে সকালে কাজে আসার পর থেকেই সখিনা আর তার তিন বছরের ছেলে কে একটা রুমে আটকে রেখেছে সালমা বেগমের বড় ছেলে আজমল।
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করে সখিনা নিজের বাড়ীতে চলে যায়।গতকালও সেভাবেই সে চলে গিয়েছিল,কিন্তু আজকে কাজে আসতেই আজমল তাকে বলল,সখিনা তুই চুরি করেছিস তাই এই রুমে তোকে আটকে রাখছি।তোকে কোনো মারধোর করবো না যদি তুই স্বীকার করিস আর চুরির টাকা ফিরিয়ে দিস।
তার কথা শুনে সখিনা তখন আকাশ থেকে পড়েছিল।সে তো চুরি সম্পর্কে কিছুই জানে না।অথচ তাকে এখন চুরির দায়ে বন্ধি করে রাখা হয়েছে।
আর সেই ব্যাপারেই গৃহকর্ত্রী সালমা বেগম এসে সখিনাকে জেরা করছিল।আর তার প্রশ্নের জবাবে সখিনা বারবার না সূচক উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল।
সালমা বেগম পুনরায় সখিনার চুলের মুঠি ধরে বলল,দেখ সখিনা তুই যে চুরি করেছিস তাতো পুরোপুরি সত্য,কিন্তু তুই ধরা পরে এভাবে মিথ্যা বলিস না।টাকাটা ফেরত দে,তাহলে তোকে আমরা পুলিশে দেব না।দেখ তুই আমাদের পুরানো কাজের লোক তাই আপোসে বলছি সত্য কথা বল।
সালমা বেগমের কথা শুনে সখিনা বলল,খালাম্মা আমি সত্য কথা বলছি ,বিশ্বাস করেন ,আমারে ছাইড়া দেন।
এভাবে হবে না মা । আমি পুলিশে খবর দিয়েছি,তারা এসে যাবে এক্ষুণি বলল আছরের আযানের পরপর ই ,যা করার তারাই করবে।পাশের রুম থেকে আজমল বলে উঠল।
পুলিশের কথা শুনে কেঁদে ফেলল সখিনা।সে তার ছেলেটাকে কাছে টেনে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো।তারপরে একটু উঠে গিয়ে পাশে দাঁড়ানো সালমা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে বলল,খালাম্মা আমারে পুলিশে দিয়েন না।বিশ্বাস করেন আমি চুরির ব্যাপারে কিছুই জানি না।
সখিনার কান্নায় সালমা বেগমের মন গলেনি।কেননা এতোগুলো টাকা সে কিভাবে ছেড়ে দেয়।আর সখিনা ছাড়া কে ই বা চুরি করতে সাহস পাবে আজমল এর বাবার পকেট থেকে।সারমা বেগম ভেবে কূল কিনারা করতে পারছে না।সে সখিনাকে পা থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,দেখ সখিনা পুলিশের মার খাওয়ার আগে স্বীকার কর।না হলে আমি কিন্তু তোর জন্য কিছু করতে পারবো না।
সালমা বেগমের কথা শুনে সখিনা আরো জোড়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো।সে যে চুরি করেনি তা কিভাবে বুঝাবে।কিভাবে প্রমাণ করবে সখিনা যে সে চোর নয়।এমনকি সে তো এটাও জানে না যে কার টাকা,কত টাকা কিভাবে চুরি হয়েছে।দুঃখে তার কান্না আরো বেড়ে গেল।আজ গরীব হয়েছে বলে,চুরির দায়ভার তার কাঁধেই চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।কি করবে সে বুঝতে পারছে না।নিশ্চুপে কাঁদতে লাগল সখিনা।তার ছোট্ট ছেলেটা নীরবে অবাক নয়নে মায়ের কান্না দেখতে লাগল।
আছরের নামাযের আযান হতেই পুলিশ এসে হাজির হলো। একজন পুলিশ কর্মকর্তা আর দুইজন কনষ্টেবল।পুলিশদেরকে সামনে বসাল আজমল।একটু বসেই পুলিশ কর্মকর্তা আজমল কে বলল,আসামি কোথায় ? আর সবাইকে সামনে নিয়ে আসেন , চুরির বিষয়টা পরিস্কার ভাবে জানতে হবে তো।
আজমল সবাইকে সামনের রুমে ডেকে আনলো।শেষে সখিনাকেও তার ছেলেসহ সামনের রুমে নিয়ে এলো।একে একে সবাই তারা বসে পড়লো।আজমলের স্ত্রী তার ছেলেকে নিয়ে আজমলের পাশে বসল।সালমা বেগম তার স্বামী আমজাদ খানকে সাথে নিয়ে বসল। আজমলদের এই ছোট্ট পরিবার।
সবাই বসতেই পুলিশ কর্মকর্তা আজমলকে জিগ্যেস করলো, সবাই কি এসেছে?
জবাবে আজমল বলল,হঁ্যা সবাই এসেছে।তবে আমার ছোটভাই বন্ধুদের সঙ্গে খুব ভোরে পিকনিকে গেছে। আজকেই ফেরার কথা।
আচ্ছা ঠিক আছে । তাহলে এই হচ্ছে চোর মহিলা আপনাদের মতে। এবার পুলিশ কর্মকর্তা জানতে চাইল আজমলদের কাছে।
হঁ্যা আমি নিশ্চিত ও ই টাকাটা চুরি করেছে। সালমা বেগম বলে উঠলেন ।
আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন?আর কত টাকা চুরি হয়েছে বলুন তো?পুলিশ কর্মকর্তা সালমা বেগমের কাছে এবার জানতে চাইল।
সালমা বেগম বলল,দশ হাজার টাকা।আর নিশ্চিত হয়েছি ঐ যে সখিনার ছেলের হাতের চাইনিজ পুতুলটা দেখে । এ টুকু বলে সালমা বেগম সখিনার ছেলের হাতের পুতুলটার দিকে ইঙ্গিত করলো।
সখিনা চমকে উঠলো সালমা বেগমের কথা শুনে।তাহলে খালাম্মা আমাকে এই কারণে সন্দেহ করেছে, সখিনা বিষয়টা এবার বুঝতে পারলো।সে তার ছেলেকে বুকে টেনে নিল।আর বলে উঠল,খালাম্মা আপনি ভুল বুঝছেন ,আমি টাকা চুরি করিনি।
পুলিশ কর্মকর্তা সখিনাকে ধমক দিয়ে বলল,তুমি চুপ করো। একটু থেমে সে আবার সালমা বেগমকে জিগ্যেস করলো,আচ্ছা বলুন তো আন্টি আপনি পুতুলটা দেখে কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে এই মহিলাই আপনাদের টাকাটা নিয়েছে?
এবার সালমা বেগম বিস্তারিত বলল,হঁ্যা তাহলে আমি খুলেই বলছি। গতকাল দুপুরে সখিনা আমার কাছে এসে দাবি করে বলে যে ,খালাম্মা আমাকে দুই হাজার টাকা অগ্রিম দেন।
আমি তখন জিগ্যেস করলাম ,কেন?
জবাবে ও বলল একটা চাইনিজ পুতুল নাকি ওর ছেলের খুব পছন্দ হয়েছে আর সখিনার বাবা অসুস্থ তাকে ডাক্তার দেখাতে টাকা লাগবে। আমি বললাম যে এত টাকা এখন দেয়া যাবে না।আর তাছাড়া তোর ছেলের চাইনিজ পুতুলের দরকারটাই বা কি? তখন সখিনা আর জোড়াজুড়ি করেনি আর আমিও তেমন আগ্রহ দেখাই নি। আর আজকে সকালে যখন আজমলের বাবার পকেট থেকে আমি বাজারের জন্য কিছু টাকা বের করতে যাই তখনই দেখি পকেটটা খালি। সবাইকে জিগ্যেস করলাম সবাই বলল কেউ ই টাকা নেয়নি। আর ঐ সময়েই সখিনা ওর ছেলেকে নিয়ে ঘরে ঢুকল আর ওর ছেলের হাতে দেখি ঐ চাইনিজ পুতুলটা।সুতরাং বুঝতেই পারছেন স্যার আমি কেন সখিনাকে নিশ্চিতভাবে সন্দেহ করছি।
দুইয়ে দুইয়ে মিলে চার হলো।এর চেয়ে নিশ্চিত প্রমাণ আর কি বা চাই।সালমা বেগমের অকাট্য প্রমাণে পুলিশ কর্মকর্তাও নিশ্চিত হলো যে সখিনাই টাকাটা চুরি করেছে।সে আর কিছু জিগ্যেস করলো না সালমা বেগমকে।
এবার সখিনার দিকে দৃষ্টি দিল পুলিশ কর্মকর্তা। সে সখিনাকে বলল, কি শুনলে তো আন্টির সব কথা,এবার বলো টাকাগুলো কি করেছ ,কোথায় রেখেছ ? যদি বাকি টাকা দিয়ে দাও তাহলে তোমাকে আর থানায় নেব না।এমনিতেই তুমি গরীব মানুষ আমরা তা বুঝতে পারছি।তুমি সত্যি কথা বলো এবং টাকাগুলো দিয়ে দাও।
পুলিশ কর্মকর্তার কথা শুনে সখিনা আবার জোড়ে কেঁদে উঠলো । কাঁদতে কাঁদতে সে বলল,স্যার আমি সত্যি কথাই বলছি আমি টাকা চুরি করি নাই। আর বাকি টাকার কথাই আসে না। আর ঐ চাইনিজ পুতুলটা আমার বোন ওকে কিনে দিয়েছে।গতকাল খালাম্মা টাকা না দেয়ায় আমি রাতে আমার বোনকে ছেলেটার পছন্দের কথা বলছিলাম ।আর গতকাল রাতেই ওর খালা ওরে ঐ পুতুলটা কিনে দিয়েছে।বিশ্বাস করুন আমি সত্যি কথা বলছি। আমি সত্যি কথা বলছি।
সখিনার কথা শুনে এক কনষ্টেবল একটু উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে জোড়সে বলে উঠল,এভাবে হবে না স্যার ,বলেন তো দুই ঘা লাগিয়ে দেই তাহলেই আর অভিনয় করবে না,ঠিক সত্যি কথা বলবে।
পুলিশ কর্মকর্তা তাকে থামিয়ে দিল।আর আমজাদ খানকে উদ্দেশ্যে করে জিগ্যেস করলো, আঙ্কেল আপনারা কি চান এই অল্প টাকার জন্য ওকে কি এখন জেলে পাঠাবেন ,নাকি ওকে সময় দেবেন টাকা শোধ করার জন্য?
জবাবে আমজাদ খান বলল,আমরা চাই ওর শাস্তি হোক।ও মিথ্যা কথা বলেছে তার প্রমাণ তো পেলেন।আর টাকার পরিমাণ যাই হোক চোরের শাস্তি হওয়া দরকার।
সখিনা তোমার আর কিছু বলার আছে ? পুলিশ কর্মকর্তা পুনরায় সখিনাকে জিগ্যেস করলো।
সখিনা কাঁদতে কাঁদতে বলল,আমি টাকা চুরি করি নাই।
পুলিশ কর্মকর্তা আর কথা বাড়াল না। সে বুঝতে পারল হয়তো সখিনাই টাকা নিয়েছে। আর এখন ধরা পরে ভয়ে মিথ্যা বলছে।সুতরাং ওকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়াই ভালো।সে কনষ্টেবলদের কে বলল, সখিনাকে গাড়ীতে নিয়ে ওঠাও। একটু থেমে আজমল কে বলল,আর আপনারা কেউ একজন আমাদের সঙ্গে চলেন।
পুলিশ কর্মকর্তার কথা শুনে আজমল দরজা খুলে তাদের সঙ্গে রওনা হওয়ার জন্য উদ্যত হলো। এমন সময় আজমলের ছোট ভাই এসে হাজির হলো।সে দরজার সামনে পুলিশ আর সখিনাকে বন্ধি দেখে তার বড় ভাইকে জিগ্যেস করলো,ভাইয়া কি হয়েছে ,পুলিশ কেন আর সখিনা বুয়াকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে কেন?
ছোট ভাইয়ের কথার জবাবে আজমল বলল,আরে বলিস না সখিনা বুয়া বাবার পকেট থেকে দশ হাজার টাকা চুরি করেছে সে কারণে ওকে নিয়ে এখন আমরা থানায় যাচ্ছি।
থামো ,থামো কত টাকা বললে?আজমলের ছোট ভাই চমকিত হয়ে জানতে চাইল।
ভিতর থেকে সালমা বেগম বললেন,দশ হাজার টাকা। কেন রনি তুই কিছু জানিস!
মায়ের কথার জবাবে রনি বলল,জানি মানে ঐ টাকা তো আব্বুর পকেট থেকে আমি নিয়েছিলাম।ও স্যরি মা ,আমার তাড়াহুড়ার জন্য আমি তোমাদেরকে জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম।আর পিকনিকে বন্ধুদের নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে তোমাদেরকে জানাতেই মনে ছিল না ,এদিকে যে এত কিছু হয়ে যাবে কে জানত!
সবাই বিস্মিত হলো রনির কথা শুনে।সখিনা রনির কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচল।এতক্ষণ তার মাথার ওপর যেন বিশাল পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল কেউ।
রনির কথা শুনে পুলিশ কর্মকর্তা কনষ্টেবলদেরকে ইঙ্গিত দিল সখিনাকে ছেড়ে দিতে।সখিনা ছাড়া পেয়ে তার ছেলেকে কোলে তুলে নিল।
পুলিশ কর্মকর্তা এবার আজমলকে উদ্দেশ্যে করে বলল, তাহলে আমরা চলি ভাই।সমস্যার সমাধান তো হয়ে গেল।আসলে আমার মনে হয় সবটুকুই ছিল আপনাদের নিজেদের মাঝে যোগাযোগের অভাবের কারণে একটা বড় ধরণের ভুল বোঝাবুঝি। আর আপনারা ঠিকভাবে খোঁজ নেন নি তাহলে আরো আগেই হযতো বিষয়টা বের হয়ে আসতো।আর তাহলে এভাবে সখিনা কে হেনস্তা হতে হতো না।যাই হোক সব ব্যাপারে একটু ভেবে চিন্তে পুলিশকে আপনারা ডেকে পাঠাবেন।
আমরা খুবই দুঃখিত।আজমল আর রনি দুই ভাই এক সঙ্গে বলে উঠল।
পুলিশ চলে গেল।সখিনাও চোখ মুছে চলে যেতে পা বাড়াল। সালমা বেগম পিছন থেকে ডাক দিয়ে তাকে থামাল এবং তাদের যে ভুল হয়ে গেছে সে জন্য সখিনার কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইল।
ঠিক আছে খালাম্মা । এতটুকু বলে সখিনা ছেলেকে নিয়ে হাঁটা দিল।
রনি তার পথ আটকাল আর বলল, বোন আমাকে মাফ করে দাও।আমার কারণে তোমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।আর তুমি আমাদের ছেড়ে যেও না।অনুরোধ করে বলছি।
সখিনার আবার কান্না পেল।চোখ মুছে ছেলেকে কোলে তুলে হাঁটতে হাঁটতে সে বলল, না ভাইজান সেটা আর হয় না।আপনারা সবাই ভালো থাকেন।
পিছনে চুরির অপবাদকে ফেলে নিজের এতোদিনের কাজ ফেলে সখিনা নতুন কোনো সম্ভাবনা খোঁজার প্রত্যয় নিয়ে সম্মুখপানে পা বাড়াল।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ফয়জুল মহী ০৩/০৭/২০২১অনাবিল সুন্দর কথা I
-
রাফিয়া নূর পূর্বিতা ০৩/০৭/২০২১দারুন