ইন্টারভিউ
গ্রামের পথ ধরে চলে যেতে খুব ভালো লাগে।দুদিকের মাঠের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনটা উদাস হয়ে ওঠে।মনে হয় যেন কবি হয়ে উঠি,কেননা আমাদের আত্তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে উদাসীনতা। আমাদের বাংলার এই মধুময় প্রকৃতিই আমাদেরকে উদাস করে তোলো।
মনে দোলা দিয়ে যায় বাংলার এই সোনালী মাঠ ঘাট প্রান্তর।আমরা এই প্রানবন্ত সবুজকে কেউ ই উপেক্ষা করতে পারিনা।তেমন আমাকেও খুব টানে বাংলার এই সোনালী সবুজ।তেমনি এক সোনালী সবুজের ভিতর দিয়ে গ্রামের পথে রিক্সা করে চলেছি বহুদূর।আমাদের চলার পথ বুঝি আর শেষ হয় না।আমার সঙ্গি আমার এক বন্ধু, রুপম ওর নাম।ওদের এলাকায় এসেছি তাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।যেন আমার সবকিছু খুঁজে পেতে একটু সুবিধে হয়।আর পথ চলায় কোনো সঙ্গি না থাকলে ঠিক আরামদায়ক হয়না ভ্রমন।ছুটির দিন তাই বন্ধুও আমার রাজি হয়ে গেল।
আমি খবরের কাগজের জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে এই সবুজ শ্যামল সুন্দর গ্রামের পথে এসেছি। অবশ্য সে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা নয়।সে কমান্ডার ছিল এবং সে একজন খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।আমার বেশ ভালো লাগছিল যে একজন মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে পারব এটা ভেবে।
রিক্সায় চলতে চলতে বন্ধুকে সে কথাটাই বললাম।
জবাবে বন্ধু আমার বলল,আমারও ভালো লাগছে তোকে এই প্রথম আমাদের গ্রামে কোনো একটা উছিলায় আসতে হয়েছে।সেই শিক্ষা জীবনে কতবার তোকে বলেছি কিন্ত আসিসনি। এবার দেখ আমাদের গ্রামটা কত সুন্দর।
আমি আর অস্বীকার করতে পারলাম না আসলে ওদের গ্রামের এই সবুজ আমাকে যেন আটকে ধরেছে।খুবই সুন্দর ওদের এই গ্রাম।
রিক্সাটা দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে আমিও চারিদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনমনে নিজের মাঝে ডুবে রইলাম।বন্ধুকে মাঝে মাঝে দু একটা প্রশ্ন করলাম সেও তার উত্তর দিয়ে আমাদের যাত্রাটাকে সুন্দর করে তুলল।
আমাকে যার ইন্টারভিউ নিতে হবে তার নাম হলো কাদের খান।সে সত্যিকারের বীর ছিল।মুক্তিযুদ্ধে সে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।তার বর্তমান পরিস্থিতি এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার ভাবনা আর বর্তমানে এই দেশকে নিয়ে তার চিন্তা চেতনা কি সেটাই আমাকে জানতে হবে।আর এ কারণে আমাকে তার কাছে যেতে হচ্ছে।আমার খুব ভালো লাগে এ কাজটা করতে আর এ কারণেই আমি আমার এ কাজটাকে খুব সুন্দর করে উপভোগ করি।কাজে তৃপ্তি পেলে কাজটা করেও মনে শান্তি পাওয়া যায়।
সে যা হোক আমাদের রিক্সা কাদের খানের বাসার সামনে এসে হাজির হলো।আমরা রিক্সা থেকে নেমে রিক্সাওয়ালাকে বিদায় করে কাদের খানের বাসায় প্রবেশ করলাম।
চারিদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা সুন্দর একটা দুইতলা বিল্ডিং কাদের খানের।বেশ চমৎকার বাড়িটা,দেখতে।গ্রামের মাঝে এরকম বাড়ি দেখতে বেশ ভালো লাগে।বেশি টাকা-পয়সা যাদের রয়েছে তারাই হয়ত এরকম সুন্দর করে বাড়ি তৈরি করতে পারে।মনে হচ্ছে কাদের খান পারিবারিক ভাবেই বেশ অর্থকড়ির মালিক।
মোবাইলের মাধ্যমে আগে থেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সময়টা ঠিক করে রেখেছিলাম যেন আমরা আসলে তখন তার দেখা পাই।আমাদের আসতে অবশ্য প্রায় একঘন্টা দেরি হয়েছে তবুও সে আমাদেরকে হাসি মুখেই গ্রহন করে নিল।
বাড়ির সামনে টেবিল চেয়ার বসানো ছিল আমরা সেখানে বসলাম।কাদের খান আমাদের বসিয়ে রেখে ভিতরে চলে গেল।আমাদের কাছ থেকে সে একটু সময় চেয়ে নিল।আমরা বসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।বেশিক্ষণ বসতে হলো না,দশ মিনিট পরেই সে ভিতর থেকে বাইরে এসে আমাদের সামনে বসল।একটু হাসি দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,আপনিই সম্ভবতঃ আমার ইন্টারভিউ নেবেন।শুরু করতে পারেন আমি তৈরি আছি।
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কাদের খানের অনুমতি পেয়ে আমি শুরু করে দিলাম।বললাম,আপনাকে প্রথমে একটা অন্যরকম প্রশ্ন করতে চাই যদি আপনি অনুমতি দেন।
আমার কথা শুনে কাদের খান বলল,দেখেন সাংবাদিক সাহেব আগেই বলে নিচ্ছি আমাকে আপনি সবধরনের প্রশ্ন করতে পারেন তাতে আমার অনুমতির দরকার নাই।যেহেতু আপনাকে সময় দিয়েছি সুতরাং আপনার সব প্রশ্নের উত্তর ই আমি দেব।
এবার আমি তার কাছে জানতে চাইলাম,আচ্ছা আপনি এতদূর এই গ্রামে এসে একা আপনার এই বাড়িতে বসবাস করছেন অথচ আপনার ছেলে মেয়ে সবাই নাকি আছে।আপনি এই বয়সে শুধু স্ত্রী কে নিয়ে একাকি এখানে থাকছেন এর কি কোনো কারণ রয়েছে?
কাদের খান বলল,আপনি সুন্দর প্রশ্ন করেছেন।সবাই কোনো না কোনো ভাবে এই প্রশ্নটা আমাকে করে।কারণ সবাই ভাবে আমার সবকিছু থাকতে আমি কেন আমার বউকে নিয়ে এই বুড়ো বয়সে এখানে একাকি থাকছি।আসলে এর কোনো কারণ নেই।সবাই ভুল ভাবে মূলতঃ আমি এখানে থাকছি আমার বাবার নির্দেশে আমার বাবা আমাকে বলেছিল কোনোদিন নিজের শিকড়কে ভুলে যাবি না।তাই আমি আমার শিকড়কে ভুলে যাইনি।এখান থেকেই আমার শুরু হয়েছিল আর আমি এখানে এসেই আমার জীবনের শেষ সময়টা পার করছি।ছেলে মেয়ে কারো সাথে আমার এতটুকু খারাপ সম্পর্ক নেই সবাই কর্মজীবনের তাগিদে দেশে বিদেশে রয়েছে কিন্তু তারাও তাদের শিকড়কে ভুলে যায়নি।মাঝে মাঝে আমার ছেলে মেয়েরা আসে।কিছুদিন আমাদের সাথে থাকে আমাদের দেখভাল করে।এভাবেই পর হয়ে যাচ্ছে আমার জীবনের সময়।
কাদের খান চুপ করলো তার নিজ গ্রামে বসবাসের কারণ জানিয়ে।আমরা ও জানতে পারলাম তার চুপচাপ এই গ্রামে পরে থাকার কারণ।এবার আমি জানতে চাইলাম,মুক্তিযুদ্ধে কেন যোগ দিয়েছিলেন?
খুব সুন্দর প্রশ্ন।আমি আবার বলব আমার বাবার কথা।আমি ছিলাম চরম ভীতু মানুষ।কাউকে ধমক দিয়ে কথা বলার সাহসও আমার ছিল না।যখন যুদ্ধ শুরু হলো তখন দেশ মাতৃকার টানে ঘরে ঘরে যুবকেরা যুদ্ধে যোগদানের জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগল।কিন্তু আমি ভিতু মানুষ কিভাবে যুদ্ধ থেকে দূরে সরে থাকব তার চিন্তা করতে লাগলাম।কোন আত্নীয়র বাসায় গেলে নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারব সেই নিয়ে মায়ের সঙ্গে বুদ্ধি পরামর্শ করতে লাগলাম।
আমার বাবা ছিলেন বুদ্ধিমান লোক।সে এই গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন আর দাদার কাছ থেকে পেয়েছিলেন চালের ব্যবসা।সুতরাং টাকার অভাব আমাদের ছিল না আর আমিও সেইভাবে আরাম আদরে মানুষ হয়েছিলাম।তাই বাবা আমার বিষয়টা বুঝে গেলেন।সে মাকে আর আমাকে ডেকে বলল,তোমরা মা ছেলেতে যে বুদ্ধি করতেছ তা খুবই পচা বুদ্ধি কাপুরুষেরা এমনটা করে।আমি যদি তোমার মতো এমন তাগড়া জওয়ান থাকতাম তাহলে সবাইকে না বলেই যুদ্ধে চলে যেতাম।
বাবার কথা শুনে আমি তখন বলেছিলাম,কিন্তু বাবা আমি তো কখনও কারো সাথে সামান্য ঝগড়াও করিনি আমার তো যুদ্ধ করার সাহস নাই।
সাহস লাগবে না আমি সবকিছু ঠিক করে এসেছি কালকেই তুমি ট্রেনিং এ যাচ্ছ।সবকিছু শিখে ফেললে তোমার মতো মেধাবি ছাত্ররাই সেরা যোদ্ধা হয়ে উঠবে।কোথা থেকে যে সাহস আসবে তুমি বুঝতেও পারবে না।কালকে থেকে তোমাকে যুদ্ধে যোগ দিতে হচ্ছে কাদের।
বাবার নির্দেশ আজও পালন করছি তাই তখনও তার নির্দেশ অমান্য করার মতো বেয়াদবি করিনি।আমি আমার বাবার নির্দেশে সেই যে যুদ্ধে গিয়েছিলাম আর দেশ স্বাধীন করেই তবে বাড়িতে ফিরেছিলাম।কিন্তু বাড়িতে ফিরে এসে আর বাবা মা ছোট ভাই বোন কাউকেই ফিরে পাইনি।
এতটুকু বলে কাদের খান তার চোখ দুটো মুছল।
বীর যোদ্ধা কাদের খানের কথা শুনতে শুনতে আমাদের বুকেও শিহরণ জাগল আর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।আসলে দেশের টানে তখন মানুষ তার সর্বস্ব হারিয়ে ও দেশকে স্বাধীন করার চেষ্টা করে গেছে।
এবার আমি তার কাছে জানতে চাইলাম,আচ্ছা তাহলে দেশকে স্বাধীন করেই আপনি বাড়িতে এসেছিলেন কিন্তু আপনার বাবা মা ছোট ভাই বোনের কি হয়েছিল তাদেরকে আর আপনি ফিরে পাননি কেন?
এই প্রশ্ন শুনে কাদের খান একটু নিশ্চুপ হয়ে রইল।একটু পরে সে বলল,আমি যুদ্ধে যোগদানের কিছুদিন পরেই আমাদের এই গ্রামে ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢুকে পরে আর তাদের এই দেশি সঙ্গিদের সহযোগিতা নিয়ে প্রথম দিকেই আমাদের বাড়িতে আক্রমন করে কারণ আমার বাবা যুদ্ধের পক্ষে ছিল আর আমাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিল।তারা সহজেই আমার নিরস্ত্র বাবা মা ভাই বোনকে খুন করে ফেলেছিল পরে আমাদের সেই ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।আর এ কারণেই আমি বাড়িতে ফিরে কাউকেই আর পাইনি।আমার সহযোদ্ধারা কেউ কেউ বিষয়টা জেনেছিল কিন্তু তারা তাদের এই মেধাবি লিডারকে হারাতে চায়নি তাই কেউ আমাকে বিষয়টা জানায়নি।আমি ফিরে এসে পরে আবার তাদের সঙ্গে যখন দেখা করেছিলাম তখন যারা জীবিত ছিল তারা অনেকেই আমার পরিবারের এ বিষয়টা নিয়ে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিল।
কাদের খানকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে দিলাম তার পিছনের ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়ে।এবার বিষয় ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম,আচ্ছা আপনার ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বলুন।আপনার বউ ছেলে মেয়েদের সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বলুন।
আবার কাদের খান বলতে শুরু করল, আসলে যুদ্ধের কারণে আমার জীবনটাই অন্য রকম হয়ে গেছে।কেননা যে ভাবনা আমাদের জীবন নিয়ে তখন ছিল তা যুদ্ধের কারণে পুরোটাই পাল্টে গিয়েছিল।যুদ্ধ থেকে ফিরে কাউকে না পেয়ে বেশ হতাশ হয়ে পরেছিলাম।পরে আমার মামা যিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি আমাকে আবার দিক নির্দেশনা দিয়ে জীবন পথে আমাকে আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন।তিনিই দায়িত্ব নিয়ে আমাকে বিয়ে করিয়ে দেন।আমাদের পুরানো ব্যবসায় আমাকে আবার ঠিকঠাক করে তিনি বসিয়ে দিয়েছিলেন।সেই থেকে এই ব্যবসা নিয়েই এর পরিধিকে অনেক বৃদ্ধি করেছি।দুই ছেলে দুই মেয়েকে মানুষ করেছি।আল্লাহ্ র রহমতে তারা যে যার মতো ভালো রয়েছে। এক ছেলে দেশের বাইরে রয়েছে।এইতো আমার ব্যক্তি জীবন কিছুটা সাদামাটা তেমন রোমাঞ্চকর নয়।তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কিছু সরকারি সুযোগ সুবিধা পেয়েছিলাম তার সবকিছুই রাজধানীর বুকে রয়েছে।সেখানেও আমার ব্যবসা রয়েছে।বড় ছেলেই তার দায়িত্ব পালন করছে।এই তো সবাই মিলেমিশে আমরা বেশ মোটামুটি আছি।
রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি?
আমার এই প্রশ্নের জবাবে কিছুটা মুচকি হাসি দিলেন কাদের খান। বললেন,খুবই কমন প্রশ্ন।আসলে এই প্রশ্নের উত্তরটা খুব সোজা আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অনেক সুযোগ নিতে পারতাম।কিন্তু আমি তেমন কোনো সুযোগ নিতে চাইনি।এলাকার মানুষের সুখে দুঃখে তাদের সঙ্গে রয়েছি সবসময়।কিন্তু সক্রিয়ভাবে আমি কখনো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পরিনি।আসলে সবার ভালোবাসা পেয়েছি আমি তাই আর বেশি কিছু চাইনি সে কারণে সক্রিয়ভাবে কখনো রাজনীতি করা হয়নি আমার।
দেশকে স্বাধীন করে তখন কেমন অনুভূতি হয়েছিল আপনার?
এই প্রশ্নের জবাবে কাদের খান বলল,অনুভূতি,সে কথা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।আমাদের জীবনের তখনকার লক্ষ্য ছিল কেবলমাত্র দেশকে স্বাধীন করা।আর সেটা করতে পেরে আমাদের সুখের কমতি ছিল না।আমরা দেশকে স্বাধীন করতে পেরে তখন ভেবেছিলাম পৃথিবী পেয়ে গেছি আমরা।
এতটুকু বলে কাদের খান একটু থামল।তারপরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,আপনাদের জন্য একটু খাবার আয়োজন করেছি এবার ভিতরে চলুন কিছু খেয়ে নেই তারপরে আবার ইন্টারভিউ দেয়া যাবে।
তার আহ্বান আমরা উপেক্ষা করতে পারলাম না।দুপুরও গড়িয়ে যাচ্ছে , বন্ধু রুপম আর আমি তার পিছন পিছন বাসার ভিতরে গিয়ে বসলাম।খুব সুন্দর ভাবে গোছানো রয়েছে বাড়ির ভিতরটা।বেশ সুন্দর লাগছে।মনে হয় অনেক সৌখিন লোক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের খান।
অনেক আইটেম দিয়ে বেশ ভুরি ভোজের আয়োজন করা হয়েছে আমাদের জন্য যা আমাদের ভাবনায়ও ছিল না।এ থেকেই বুঝে গেলাম সে আসলে মানুষকে ভালোবাসে আর এ কারণে কাদের খান একজন ভালো মানুষ আর তাই চারিদিকে তার এতো সুনাম।
খাওয়া শেষ করে আমরা একটু সময় বিশ্রাম করে নিলাম তারপরে আবার মুক্তিযোদ্ধা সাহেবকে কিছু প্রশ্ন করার জন্য তৈরি হলাম।এবার আর বাইরে গেলাম না।
ভিতরে বসেই তাকে আবার প্রশ্ন করলাম, চারিদিকে আপনার এতো সুনাম এটাকে কেমনভাবে আপনি উপভোগ করেন?
হেসে ফেললেন তিনি।বললেন,আসলে মানুষ আমাকে দলমত নির্বিশেষে ভালোবাসে এটা ভালো লাগে।দেশের সব মানুষকে আমি ভালোবাসি তাই হয়তো তারাও সবাই আমাকে ভালোবাসে।এই ভালোবাসাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
কেমন দেশ চেয়েছিলেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন,আসলে সব চাওয়া তো আর পাওয়া হয় না।আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।আমরা চেয়েছিলাম দল-মত-নির্বিশেষে একটি সুখি সুন্দর সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে আমাদের দেশ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।কিন্তু আমরা হয়তো এখনও তা অর্জন করতে পারিনি।যার যার দিক থেকে তা অর্জন করার জন্য আমাদেরকে এখনো তার জন্য চেষ্টা করে যাওয়া দরকার।
কেমন দেশ পেলেন বলে আপনি মনে করেন?
আমরা স্বাধীন দেশে পেয়েছি আমাদের রক্তের দামে।এখনো মনের মতো সেই দেশ আমরা গড়তে পারিনি।যে দেশ পেলাম তাতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা শতভাগ সন্তুষ্ট নই।তবে তার মানে এই নয় যে আমরা হতাশ আমরা আশাবাদী।এ দেশের মানুষ সম্ভাবনাময়,তারাই আমাদের স্বপ্নের দেশ গড়ে তুলবে একদিন।
মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতি মনে আছে?
কিছু কিছু স্মৃতি মনে রয়েছে।তার মধ্যে সবচেয়ে যে বিষয়টা আমাকে এখনো নাড়া দেয় তা হলো,আমার নেতৃত্বে আমাদের যুদ্ধ এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার পর সেখানে এক শতবর্ষী বৃদ্ধ আমাকে স্যালুট করে বলেছিল,তোমাদেরকে চিরদিনের জন্য স্যালুট জানাই কারণ তোমার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছ।তার সেই কথা এখনো আমার কানে বাজে। এতটুকু বলে চুপ করলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আমি বুঝতে পারলাম তার কথাগুলো খুবই দামি আমাদের সবার জন্য তার সাথে বেশিক্ষণ সময় কাটাতে পারলে অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা শোনা যেত। কিন্তু আমাদের তো আবার ফিরে আসতে হবে।সুতারং আমি আর বেশি প্রশ্ন না করার কথা ভাবলাম। এবার বললাম, আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মকে গাইড লাইন দিয়ে কিছু উপদেশ দেবেন।
এ কথার জবাবে তিনি বললেন,উপদেশ নয় বাবা আমি অনুরোধ করে বলতে পারি, আপনারা দেশটাকে নিয়ে খেলবেন না।এটা রক্ত দিয়ে কেনা দেশ।এই দেশটাকে ভালোবাসুন।দল-মত-নির্বিশেষে নিজের নিজের জায়গায় থেকে এই সোনার স্বদেশটাকে গড়ে তুলুন।প্রতিহিংসা ছেড়ে দিন।সকল মানুষকে ভালোবাসুন।
এতো সুন্দর কথা শুনে আমাদের মনটা ও ভরে গেল।আর কি প্রশ্ন করা যায় তার কাছে তার প্রতি আমাদেরও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে গেল।শেষ প্রশ্ন করলাম বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের খানের কাছে,
বর্তমান এই পরিস্থিতিতে দেশকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আমার প্রশ্নের জবাবে কিছুটা ভেবে নিলেন তিনি।তারপরে বললেন,যদি খুব ছোট করে বলি তাহলে বলব আমাদের দেশ থেকে অন্ধকার এখনো দূর হয়নি।বেশ রেশারেশি বেড়ে যাচ্ছে চারিদিকে।কেউ যেন কারো ছায়া দেখতে পারে না।চারিদিকে ভীষণ অন্ধকার নেমে আসবে বুঝি।গভীর এক কালো রাত বুঝি বিরাজমান এখনো দেশের বুকে।আমরা সবাই রয়েছি ভোরের প্রতীক্ষায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আর প্রশ্ন করলাম না। আমরা তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম নিজেদের গন্ত্যেবে।
পথ চলতে চলতে আমার কানে বাজতে লাগল বীর মুক্তিযোদ্ধার শেষ কথাটি আমরা রয়েছি ভোরের প্রতীক্ষায়।অন্ধকার গভীর কালো রাত এখনো পুরোপুরি দেশের বুক থেকে কেটে যায়নি।
২০.০২.২০২১
মনে দোলা দিয়ে যায় বাংলার এই সোনালী মাঠ ঘাট প্রান্তর।আমরা এই প্রানবন্ত সবুজকে কেউ ই উপেক্ষা করতে পারিনা।তেমন আমাকেও খুব টানে বাংলার এই সোনালী সবুজ।তেমনি এক সোনালী সবুজের ভিতর দিয়ে গ্রামের পথে রিক্সা করে চলেছি বহুদূর।আমাদের চলার পথ বুঝি আর শেষ হয় না।আমার সঙ্গি আমার এক বন্ধু, রুপম ওর নাম।ওদের এলাকায় এসেছি তাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।যেন আমার সবকিছু খুঁজে পেতে একটু সুবিধে হয়।আর পথ চলায় কোনো সঙ্গি না থাকলে ঠিক আরামদায়ক হয়না ভ্রমন।ছুটির দিন তাই বন্ধুও আমার রাজি হয়ে গেল।
আমি খবরের কাগজের জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে এই সবুজ শ্যামল সুন্দর গ্রামের পথে এসেছি। অবশ্য সে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা নয়।সে কমান্ডার ছিল এবং সে একজন খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।আমার বেশ ভালো লাগছিল যে একজন মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে পারব এটা ভেবে।
রিক্সায় চলতে চলতে বন্ধুকে সে কথাটাই বললাম।
জবাবে বন্ধু আমার বলল,আমারও ভালো লাগছে তোকে এই প্রথম আমাদের গ্রামে কোনো একটা উছিলায় আসতে হয়েছে।সেই শিক্ষা জীবনে কতবার তোকে বলেছি কিন্ত আসিসনি। এবার দেখ আমাদের গ্রামটা কত সুন্দর।
আমি আর অস্বীকার করতে পারলাম না আসলে ওদের গ্রামের এই সবুজ আমাকে যেন আটকে ধরেছে।খুবই সুন্দর ওদের এই গ্রাম।
রিক্সাটা দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে আমিও চারিদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনমনে নিজের মাঝে ডুবে রইলাম।বন্ধুকে মাঝে মাঝে দু একটা প্রশ্ন করলাম সেও তার উত্তর দিয়ে আমাদের যাত্রাটাকে সুন্দর করে তুলল।
আমাকে যার ইন্টারভিউ নিতে হবে তার নাম হলো কাদের খান।সে সত্যিকারের বীর ছিল।মুক্তিযুদ্ধে সে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।তার বর্তমান পরিস্থিতি এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার ভাবনা আর বর্তমানে এই দেশকে নিয়ে তার চিন্তা চেতনা কি সেটাই আমাকে জানতে হবে।আর এ কারণে আমাকে তার কাছে যেতে হচ্ছে।আমার খুব ভালো লাগে এ কাজটা করতে আর এ কারণেই আমি আমার এ কাজটাকে খুব সুন্দর করে উপভোগ করি।কাজে তৃপ্তি পেলে কাজটা করেও মনে শান্তি পাওয়া যায়।
সে যা হোক আমাদের রিক্সা কাদের খানের বাসার সামনে এসে হাজির হলো।আমরা রিক্সা থেকে নেমে রিক্সাওয়ালাকে বিদায় করে কাদের খানের বাসায় প্রবেশ করলাম।
চারিদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা সুন্দর একটা দুইতলা বিল্ডিং কাদের খানের।বেশ চমৎকার বাড়িটা,দেখতে।গ্রামের মাঝে এরকম বাড়ি দেখতে বেশ ভালো লাগে।বেশি টাকা-পয়সা যাদের রয়েছে তারাই হয়ত এরকম সুন্দর করে বাড়ি তৈরি করতে পারে।মনে হচ্ছে কাদের খান পারিবারিক ভাবেই বেশ অর্থকড়ির মালিক।
মোবাইলের মাধ্যমে আগে থেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সময়টা ঠিক করে রেখেছিলাম যেন আমরা আসলে তখন তার দেখা পাই।আমাদের আসতে অবশ্য প্রায় একঘন্টা দেরি হয়েছে তবুও সে আমাদেরকে হাসি মুখেই গ্রহন করে নিল।
বাড়ির সামনে টেবিল চেয়ার বসানো ছিল আমরা সেখানে বসলাম।কাদের খান আমাদের বসিয়ে রেখে ভিতরে চলে গেল।আমাদের কাছ থেকে সে একটু সময় চেয়ে নিল।আমরা বসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।বেশিক্ষণ বসতে হলো না,দশ মিনিট পরেই সে ভিতর থেকে বাইরে এসে আমাদের সামনে বসল।একটু হাসি দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,আপনিই সম্ভবতঃ আমার ইন্টারভিউ নেবেন।শুরু করতে পারেন আমি তৈরি আছি।
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কাদের খানের অনুমতি পেয়ে আমি শুরু করে দিলাম।বললাম,আপনাকে প্রথমে একটা অন্যরকম প্রশ্ন করতে চাই যদি আপনি অনুমতি দেন।
আমার কথা শুনে কাদের খান বলল,দেখেন সাংবাদিক সাহেব আগেই বলে নিচ্ছি আমাকে আপনি সবধরনের প্রশ্ন করতে পারেন তাতে আমার অনুমতির দরকার নাই।যেহেতু আপনাকে সময় দিয়েছি সুতরাং আপনার সব প্রশ্নের উত্তর ই আমি দেব।
এবার আমি তার কাছে জানতে চাইলাম,আচ্ছা আপনি এতদূর এই গ্রামে এসে একা আপনার এই বাড়িতে বসবাস করছেন অথচ আপনার ছেলে মেয়ে সবাই নাকি আছে।আপনি এই বয়সে শুধু স্ত্রী কে নিয়ে একাকি এখানে থাকছেন এর কি কোনো কারণ রয়েছে?
কাদের খান বলল,আপনি সুন্দর প্রশ্ন করেছেন।সবাই কোনো না কোনো ভাবে এই প্রশ্নটা আমাকে করে।কারণ সবাই ভাবে আমার সবকিছু থাকতে আমি কেন আমার বউকে নিয়ে এই বুড়ো বয়সে এখানে একাকি থাকছি।আসলে এর কোনো কারণ নেই।সবাই ভুল ভাবে মূলতঃ আমি এখানে থাকছি আমার বাবার নির্দেশে আমার বাবা আমাকে বলেছিল কোনোদিন নিজের শিকড়কে ভুলে যাবি না।তাই আমি আমার শিকড়কে ভুলে যাইনি।এখান থেকেই আমার শুরু হয়েছিল আর আমি এখানে এসেই আমার জীবনের শেষ সময়টা পার করছি।ছেলে মেয়ে কারো সাথে আমার এতটুকু খারাপ সম্পর্ক নেই সবাই কর্মজীবনের তাগিদে দেশে বিদেশে রয়েছে কিন্তু তারাও তাদের শিকড়কে ভুলে যায়নি।মাঝে মাঝে আমার ছেলে মেয়েরা আসে।কিছুদিন আমাদের সাথে থাকে আমাদের দেখভাল করে।এভাবেই পর হয়ে যাচ্ছে আমার জীবনের সময়।
কাদের খান চুপ করলো তার নিজ গ্রামে বসবাসের কারণ জানিয়ে।আমরা ও জানতে পারলাম তার চুপচাপ এই গ্রামে পরে থাকার কারণ।এবার আমি জানতে চাইলাম,মুক্তিযুদ্ধে কেন যোগ দিয়েছিলেন?
খুব সুন্দর প্রশ্ন।আমি আবার বলব আমার বাবার কথা।আমি ছিলাম চরম ভীতু মানুষ।কাউকে ধমক দিয়ে কথা বলার সাহসও আমার ছিল না।যখন যুদ্ধ শুরু হলো তখন দেশ মাতৃকার টানে ঘরে ঘরে যুবকেরা যুদ্ধে যোগদানের জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগল।কিন্তু আমি ভিতু মানুষ কিভাবে যুদ্ধ থেকে দূরে সরে থাকব তার চিন্তা করতে লাগলাম।কোন আত্নীয়র বাসায় গেলে নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারব সেই নিয়ে মায়ের সঙ্গে বুদ্ধি পরামর্শ করতে লাগলাম।
আমার বাবা ছিলেন বুদ্ধিমান লোক।সে এই গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন আর দাদার কাছ থেকে পেয়েছিলেন চালের ব্যবসা।সুতরাং টাকার অভাব আমাদের ছিল না আর আমিও সেইভাবে আরাম আদরে মানুষ হয়েছিলাম।তাই বাবা আমার বিষয়টা বুঝে গেলেন।সে মাকে আর আমাকে ডেকে বলল,তোমরা মা ছেলেতে যে বুদ্ধি করতেছ তা খুবই পচা বুদ্ধি কাপুরুষেরা এমনটা করে।আমি যদি তোমার মতো এমন তাগড়া জওয়ান থাকতাম তাহলে সবাইকে না বলেই যুদ্ধে চলে যেতাম।
বাবার কথা শুনে আমি তখন বলেছিলাম,কিন্তু বাবা আমি তো কখনও কারো সাথে সামান্য ঝগড়াও করিনি আমার তো যুদ্ধ করার সাহস নাই।
সাহস লাগবে না আমি সবকিছু ঠিক করে এসেছি কালকেই তুমি ট্রেনিং এ যাচ্ছ।সবকিছু শিখে ফেললে তোমার মতো মেধাবি ছাত্ররাই সেরা যোদ্ধা হয়ে উঠবে।কোথা থেকে যে সাহস আসবে তুমি বুঝতেও পারবে না।কালকে থেকে তোমাকে যুদ্ধে যোগ দিতে হচ্ছে কাদের।
বাবার নির্দেশ আজও পালন করছি তাই তখনও তার নির্দেশ অমান্য করার মতো বেয়াদবি করিনি।আমি আমার বাবার নির্দেশে সেই যে যুদ্ধে গিয়েছিলাম আর দেশ স্বাধীন করেই তবে বাড়িতে ফিরেছিলাম।কিন্তু বাড়িতে ফিরে এসে আর বাবা মা ছোট ভাই বোন কাউকেই ফিরে পাইনি।
এতটুকু বলে কাদের খান তার চোখ দুটো মুছল।
বীর যোদ্ধা কাদের খানের কথা শুনতে শুনতে আমাদের বুকেও শিহরণ জাগল আর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।আসলে দেশের টানে তখন মানুষ তার সর্বস্ব হারিয়ে ও দেশকে স্বাধীন করার চেষ্টা করে গেছে।
এবার আমি তার কাছে জানতে চাইলাম,আচ্ছা তাহলে দেশকে স্বাধীন করেই আপনি বাড়িতে এসেছিলেন কিন্তু আপনার বাবা মা ছোট ভাই বোনের কি হয়েছিল তাদেরকে আর আপনি ফিরে পাননি কেন?
এই প্রশ্ন শুনে কাদের খান একটু নিশ্চুপ হয়ে রইল।একটু পরে সে বলল,আমি যুদ্ধে যোগদানের কিছুদিন পরেই আমাদের এই গ্রামে ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢুকে পরে আর তাদের এই দেশি সঙ্গিদের সহযোগিতা নিয়ে প্রথম দিকেই আমাদের বাড়িতে আক্রমন করে কারণ আমার বাবা যুদ্ধের পক্ষে ছিল আর আমাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিল।তারা সহজেই আমার নিরস্ত্র বাবা মা ভাই বোনকে খুন করে ফেলেছিল পরে আমাদের সেই ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।আর এ কারণেই আমি বাড়িতে ফিরে কাউকেই আর পাইনি।আমার সহযোদ্ধারা কেউ কেউ বিষয়টা জেনেছিল কিন্তু তারা তাদের এই মেধাবি লিডারকে হারাতে চায়নি তাই কেউ আমাকে বিষয়টা জানায়নি।আমি ফিরে এসে পরে আবার তাদের সঙ্গে যখন দেখা করেছিলাম তখন যারা জীবিত ছিল তারা অনেকেই আমার পরিবারের এ বিষয়টা নিয়ে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিল।
কাদের খানকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে দিলাম তার পিছনের ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়ে।এবার বিষয় ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম,আচ্ছা আপনার ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বলুন।আপনার বউ ছেলে মেয়েদের সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বলুন।
আবার কাদের খান বলতে শুরু করল, আসলে যুদ্ধের কারণে আমার জীবনটাই অন্য রকম হয়ে গেছে।কেননা যে ভাবনা আমাদের জীবন নিয়ে তখন ছিল তা যুদ্ধের কারণে পুরোটাই পাল্টে গিয়েছিল।যুদ্ধ থেকে ফিরে কাউকে না পেয়ে বেশ হতাশ হয়ে পরেছিলাম।পরে আমার মামা যিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি আমাকে আবার দিক নির্দেশনা দিয়ে জীবন পথে আমাকে আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন।তিনিই দায়িত্ব নিয়ে আমাকে বিয়ে করিয়ে দেন।আমাদের পুরানো ব্যবসায় আমাকে আবার ঠিকঠাক করে তিনি বসিয়ে দিয়েছিলেন।সেই থেকে এই ব্যবসা নিয়েই এর পরিধিকে অনেক বৃদ্ধি করেছি।দুই ছেলে দুই মেয়েকে মানুষ করেছি।আল্লাহ্ র রহমতে তারা যে যার মতো ভালো রয়েছে। এক ছেলে দেশের বাইরে রয়েছে।এইতো আমার ব্যক্তি জীবন কিছুটা সাদামাটা তেমন রোমাঞ্চকর নয়।তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কিছু সরকারি সুযোগ সুবিধা পেয়েছিলাম তার সবকিছুই রাজধানীর বুকে রয়েছে।সেখানেও আমার ব্যবসা রয়েছে।বড় ছেলেই তার দায়িত্ব পালন করছে।এই তো সবাই মিলেমিশে আমরা বেশ মোটামুটি আছি।
রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি?
আমার এই প্রশ্নের জবাবে কিছুটা মুচকি হাসি দিলেন কাদের খান। বললেন,খুবই কমন প্রশ্ন।আসলে এই প্রশ্নের উত্তরটা খুব সোজা আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অনেক সুযোগ নিতে পারতাম।কিন্তু আমি তেমন কোনো সুযোগ নিতে চাইনি।এলাকার মানুষের সুখে দুঃখে তাদের সঙ্গে রয়েছি সবসময়।কিন্তু সক্রিয়ভাবে আমি কখনো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পরিনি।আসলে সবার ভালোবাসা পেয়েছি আমি তাই আর বেশি কিছু চাইনি সে কারণে সক্রিয়ভাবে কখনো রাজনীতি করা হয়নি আমার।
দেশকে স্বাধীন করে তখন কেমন অনুভূতি হয়েছিল আপনার?
এই প্রশ্নের জবাবে কাদের খান বলল,অনুভূতি,সে কথা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।আমাদের জীবনের তখনকার লক্ষ্য ছিল কেবলমাত্র দেশকে স্বাধীন করা।আর সেটা করতে পেরে আমাদের সুখের কমতি ছিল না।আমরা দেশকে স্বাধীন করতে পেরে তখন ভেবেছিলাম পৃথিবী পেয়ে গেছি আমরা।
এতটুকু বলে কাদের খান একটু থামল।তারপরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,আপনাদের জন্য একটু খাবার আয়োজন করেছি এবার ভিতরে চলুন কিছু খেয়ে নেই তারপরে আবার ইন্টারভিউ দেয়া যাবে।
তার আহ্বান আমরা উপেক্ষা করতে পারলাম না।দুপুরও গড়িয়ে যাচ্ছে , বন্ধু রুপম আর আমি তার পিছন পিছন বাসার ভিতরে গিয়ে বসলাম।খুব সুন্দর ভাবে গোছানো রয়েছে বাড়ির ভিতরটা।বেশ সুন্দর লাগছে।মনে হয় অনেক সৌখিন লোক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের খান।
অনেক আইটেম দিয়ে বেশ ভুরি ভোজের আয়োজন করা হয়েছে আমাদের জন্য যা আমাদের ভাবনায়ও ছিল না।এ থেকেই বুঝে গেলাম সে আসলে মানুষকে ভালোবাসে আর এ কারণে কাদের খান একজন ভালো মানুষ আর তাই চারিদিকে তার এতো সুনাম।
খাওয়া শেষ করে আমরা একটু সময় বিশ্রাম করে নিলাম তারপরে আবার মুক্তিযোদ্ধা সাহেবকে কিছু প্রশ্ন করার জন্য তৈরি হলাম।এবার আর বাইরে গেলাম না।
ভিতরে বসেই তাকে আবার প্রশ্ন করলাম, চারিদিকে আপনার এতো সুনাম এটাকে কেমনভাবে আপনি উপভোগ করেন?
হেসে ফেললেন তিনি।বললেন,আসলে মানুষ আমাকে দলমত নির্বিশেষে ভালোবাসে এটা ভালো লাগে।দেশের সব মানুষকে আমি ভালোবাসি তাই হয়তো তারাও সবাই আমাকে ভালোবাসে।এই ভালোবাসাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
কেমন দেশ চেয়েছিলেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন,আসলে সব চাওয়া তো আর পাওয়া হয় না।আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।আমরা চেয়েছিলাম দল-মত-নির্বিশেষে একটি সুখি সুন্দর সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে আমাদের দেশ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।কিন্তু আমরা হয়তো এখনও তা অর্জন করতে পারিনি।যার যার দিক থেকে তা অর্জন করার জন্য আমাদেরকে এখনো তার জন্য চেষ্টা করে যাওয়া দরকার।
কেমন দেশ পেলেন বলে আপনি মনে করেন?
আমরা স্বাধীন দেশে পেয়েছি আমাদের রক্তের দামে।এখনো মনের মতো সেই দেশ আমরা গড়তে পারিনি।যে দেশ পেলাম তাতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা শতভাগ সন্তুষ্ট নই।তবে তার মানে এই নয় যে আমরা হতাশ আমরা আশাবাদী।এ দেশের মানুষ সম্ভাবনাময়,তারাই আমাদের স্বপ্নের দেশ গড়ে তুলবে একদিন।
মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতি মনে আছে?
কিছু কিছু স্মৃতি মনে রয়েছে।তার মধ্যে সবচেয়ে যে বিষয়টা আমাকে এখনো নাড়া দেয় তা হলো,আমার নেতৃত্বে আমাদের যুদ্ধ এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার পর সেখানে এক শতবর্ষী বৃদ্ধ আমাকে স্যালুট করে বলেছিল,তোমাদেরকে চিরদিনের জন্য স্যালুট জানাই কারণ তোমার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছ।তার সেই কথা এখনো আমার কানে বাজে। এতটুকু বলে চুপ করলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আমি বুঝতে পারলাম তার কথাগুলো খুবই দামি আমাদের সবার জন্য তার সাথে বেশিক্ষণ সময় কাটাতে পারলে অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা শোনা যেত। কিন্তু আমাদের তো আবার ফিরে আসতে হবে।সুতারং আমি আর বেশি প্রশ্ন না করার কথা ভাবলাম। এবার বললাম, আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মকে গাইড লাইন দিয়ে কিছু উপদেশ দেবেন।
এ কথার জবাবে তিনি বললেন,উপদেশ নয় বাবা আমি অনুরোধ করে বলতে পারি, আপনারা দেশটাকে নিয়ে খেলবেন না।এটা রক্ত দিয়ে কেনা দেশ।এই দেশটাকে ভালোবাসুন।দল-মত-নির্বিশেষে নিজের নিজের জায়গায় থেকে এই সোনার স্বদেশটাকে গড়ে তুলুন।প্রতিহিংসা ছেড়ে দিন।সকল মানুষকে ভালোবাসুন।
এতো সুন্দর কথা শুনে আমাদের মনটা ও ভরে গেল।আর কি প্রশ্ন করা যায় তার কাছে তার প্রতি আমাদেরও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে গেল।শেষ প্রশ্ন করলাম বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের খানের কাছে,
বর্তমান এই পরিস্থিতিতে দেশকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আমার প্রশ্নের জবাবে কিছুটা ভেবে নিলেন তিনি।তারপরে বললেন,যদি খুব ছোট করে বলি তাহলে বলব আমাদের দেশ থেকে অন্ধকার এখনো দূর হয়নি।বেশ রেশারেশি বেড়ে যাচ্ছে চারিদিকে।কেউ যেন কারো ছায়া দেখতে পারে না।চারিদিকে ভীষণ অন্ধকার নেমে আসবে বুঝি।গভীর এক কালো রাত বুঝি বিরাজমান এখনো দেশের বুকে।আমরা সবাই রয়েছি ভোরের প্রতীক্ষায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আর প্রশ্ন করলাম না। আমরা তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম নিজেদের গন্ত্যেবে।
পথ চলতে চলতে আমার কানে বাজতে লাগল বীর মুক্তিযোদ্ধার শেষ কথাটি আমরা রয়েছি ভোরের প্রতীক্ষায়।অন্ধকার গভীর কালো রাত এখনো পুরোপুরি দেশের বুক থেকে কেটে যায়নি।
২০.০২.২০২১
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সালমান মাহফুজ ২৬/০২/২০২৩সুন্দর বর্ণনাভঙ্গি
-
আব্দুর রহমান আনসারী ২২/০৩/২০২২ভাল
-
আব্দুর রহমান আনসারী ০৭/০৪/২০২১চমৎকার
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ০৩/০৪/২০২১সুন্দর ও সাবলীল বর্ণনা।
-
মাহতাব বাঙ্গালী ৩১/০৩/২০২১Yes; we hope still; the thick darkness will be far away and the golden rising sunny ray will show us the independent flag through the well-developed country paths.
-
ন্যান্সি দেওয়ান ২৮/০৩/২০২১beautiful
-
এম এম হোসেন ২৭/০৩/২০২১চমৎকার
-
ফয়জুল মহী ২৭/০৩/২০২১চমৎকার উপস্থাপন