রক্তিম মানচিত্র
রক্ত ঝরিয়েই স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় বুঝলে রবিন।মতিন মাষ্টার তার সহযোদ্ধা রবিনের নানা প্রশ্নের উত্তরে কথাগুলো বলল।
কিন্তু ভাই আপনি বলতে পারেন আমরা আর কতোদিন এইভাবে রক্ত ঝরিয়ে যাব।প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল আমরা বিভিন্ন রনাঙ্গনে যুদ্ধ করে যাচ্ছি কিন্তু স্বাধীনতা আর কতদূর।আপনি বলতে পারেন আমরা আরো কতদিন এইভাবে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে যাব।রবিন এবার নিজের হতাশার কথা বলল।
মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে হয় রবিন। আমরা মুক্তিযোদ্ধা আমাদের হতাশ হলে চলবে না।পাকিস্তানিদের এ দেশ থেকে চিরতরে তাড়িয়ে দিয়ে তবেই আমাদের কাজ শেষ হবে।তুমি দিন দিন অস্থির হয়ে যাচ্ছ রবিন যা আমার কাছে ভালো লাগছে না।নিজেকে সামলে নাও। আমি যদি যুদ্ধে মারা যাই তবে কিন্তু এ দলকে তোমাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।সুতরাং এতটা অস্থির হলে চলবে না রবিন।নিজের মনের শক্তিকে আরো বাড়াতে হবে তোমার।যতদিন ই লাগুক আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব আর এ দেশকে স্বাধীন করে তবেই আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্থক হব।
আপনার মনের শক্তি দেখে আমিও বিস্মিত না হয়ে পারি না।তবে আপনার মতো একজন শক্তিশালী মনের মুক্তিযোদ্ধা ছিল বলেই কিন্তু আমরা প্রতিদিন পাকিস্তানি আর রাজাকার বাহিনীকে খুন করে ওদের রক্তে স্নান করতে পারছি।আমরা যোদ্ধারা আপনার মতো নেতৃত্বই চাই।যার মনে রয়েছে প্রচুর মানসিক শক্তি আর মগজে রয়েছে নতুন নতুন যুদ্ধের কৌশল।রবিন তার নেতা এবং সহযোদ্ধা মতিন মাষ্টারকে নেতা মেনে নিয়ে বলল।
কি যে বল রবিন আমরা মুক্তিযোদ্ধা।কেউ কারো নেতা নই।এই দেশকে এই সোনার বাংলাদেশকে স্বাধীন করাই আমাদের এখনকার সবচেয়ে বড় সময়ের প্রয়োজন।বুঝতে পেরেছ।মতিন মাষ্টার এবার রবিনকে নিজের পরিচয় আর তাদের কাজ কি সেটা বলে দিল।
রবিন আর কিছু বলল না।সে নিশ্চুপ মতিন মাষ্টারের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল।
দেশের বুকে যুদ্ধ চলছে,স্বাধীনতা যুদ্ধ।মতিন মাষ্টার আর রবিন দুজনেই মুক্তিযোদ্ধা। যারা দেশকে মুক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে নিজের জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরেছে।দুজনে একই গ্রামের লোক। একজন স্কুল শিক্ষক আর একজন চাকুরিজীবী।যারা দুজনে আজ একই পথের পথিক।দেশ মুক্ত করার কাজে তারা নিজেদের জীবনকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত।যুদ্ধের শুরুতেই তারা নিজেদের পরিবারের সকল আপনজনদের হারিয়েছে। রাজাকার বাহিনী রাতের আঁধারে তাদের গ্রামের ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল আর তখনই মুক্তিযোদ্ধা মতিন মাষ্টার আর রবিনের পরিবারের সবাই আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে।সেই দুঃখ বুকে নিয়েই তাদেরকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।তার ই এক ফাঁকে দুজন একত্র হওয়ায় নানাবিধ আলোচনা করে নিল।
স্বাধীনতা অর্জন ই মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ কথা।সবকিছু হারিয়েও তারা যেন কিছুই হারায়নি।শুধু স্বাধীনতা পেলেই তাদের সবকিছু পাওয়া হয়ে যাবে। তখন সব হারানোর কষ্ট তাদেরকে আর ছুঁয়ে যেতে পারবে না।
মতিন মাষ্টার চৌকষ মুক্তিযোদ্ধা।সে পনের জনের একটা দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে।তবে তার দলের দুজন একটা অপারেশনে শহীদ হয়েছে। আর একজন আহত হয়েছে।সে নিজেও একবার গুলিবিদ্ধ হয়েছিল।কিন্তু নিজের প্রবল মনের শক্তির কারণে সে আবার যুদ্ধের ময়দানে ফিরে এসেছে।
তারা কয়েকটা অপারেশন করে একটা গ্রামের বনের মাঝে অবস্থান নিয়েছে।আর সেখানে বসেই পাশের গ্রামের রাজাকার বাহিনীর একটা শক্তিশালী টিমকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে যাচ্ছিল।ঐ রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানী কিছু সেনাদের আশ্রয় দিয়ে এই এলাকার যুদ্ধ পরিচালনায় তাদেরকে সাহায্য করে যাচ্ছিল।
মতিন মাষ্টার তার যুদ্ধের পরিকল্পনা সবার কাছে খুলে বলল।
সবকিছু শুনে একজন মুক্তিযোদ্ধা একটু সংশয় প্রকাশ করে জানতে চাইল,সবই বুঝলাম মতিন ভাই কিন্তু একটা বিষয় বুঝলাম না।আর তা হলো আমরা ওদের ওপরে এখনো ঝাপিয়ে পরছি না কেন?
একটু সবুর কর।আমি সবাইকে বুঝিয়ে বলছি কেন আমরা তাড়াহুড়ো করছি না।মতিন মাষ্টার বলল।
বলেন তাইলে।মুক্তিযোদ্ধা রবিন তাগাদা দিয়ে বলল।
আমি গোপনে একজনকে পাগল সাজিয়ে ওদের ঐখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। ঠিকভাবে না জেনে আক্রমন করলে উল্টা আমরা সবাই মারা পরতে পারি।সুতরাং ওদের সঠিক অবস্থান জেনে ওরা কতজন রয়েছে,ওদের প্লান কি এগুলো জেনে তবেই আমরা ওদের ওপরে আক্রমন করবো। বুঝলে তোমরা সবাই।এবার নেতার মতো মতিন মাষ্টার সবাইকে বলল।
নেতার কথা শুনে এবার সবাই নিশ্চুপ রইল।
আরো দুইদিন অপেক্ষার পর মুক্তিযোদ্ধারা যে বনে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে দেখা মিলল এক পাগলের।তাকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে মতিন মাষ্টারের কাছে নিয়ে এলো।কমান্ডার মতিন তাকে দেখে চিনল।সে পাগলকে ছেড়ে দিতে বলল।
পাগলও মতিন মাষ্টারকে চিনতে পারল।
মতিন মাষ্টার তাকে একটু আড়ালে নিয়ে গেল।সঙ্গে রবিন ও চলল।তারা দুইজনে এবার পাগলবেশী সাহসী ঐ মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নিল।এবার তাকে বিদায় দিয়ে দিল তারা।
সে চলে যেতে রবিন মতিন মাষ্টারের কাছে জানতে চাইল,তাহলে আমাদেরকে দুপুরের পরে যেকোনো দিন ঐখানে আক্রমন করতে হবে তাই না।
ঠিক বলেছ তুমি।মতিন মাষ্টার বলল।
মতিন মাষ্টারের সম্মতি পেয়ে রবিন বলল, তাহলে আর দেরী কেন।আমরা আজকে রাতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে নেই।কালকে দুপুরের পর আমরা সবাই মিলে ওদের ওপরে আক্রমন করবো।আর পাকিস্তান বাহিনীসহ সমস্ত রাজাকারকে মেরে শেষ করে দেবো।ওরা আমাদের পরিবারের সবাইকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে।ওদের ক্ষমা নাই।
রবিনের কথা শুনে মতিন মাষ্টার বলল,ঠিক আছে আর দেরী করবো না।তোমরা সবাই প্রস্তুত হয়ে নাও।এবার কিন্তু আমরা সবচেয়ে বড় একটা শত্রূ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি।তাই আমাদেরকে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।আমরা মোট তের জন আর ওরা কিন্তু প্রায় একশো জন সুতরাং আমাদেরকে সবোর্চ্চ শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের গেরিলা পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে হবে।অতএব তোমরা সেইভাবে নিজেদেরকে তৈরি করে নাও।
আচ্ছা সেটা আমরা করবো তবে ভাই আপনার প্রতি আমার একটা অনুরোধ থাকবে।রবিন বলল।
কি সেটা? মতিন মাষ্টার জানতে চাইল।
এবার রবিন বলল,প্রতিবার দেখেছি আপনি বেপরোয়াভাবে সবার সামনে চলে যান আর ওদেরকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেন এটা খুবই সাহসী কাজ আমি স্বীকার করি কিন্তু ভাই এতে আপনার জীবনেরও তো বেশ ঝুঁকি রয়েছে।তাই আমার অনুরোধ আপনি আর এতটা অগ্রগামি হয়ে যুদ্ধ করবেন না।আমরা একসঙ্গে রনাঙ্গনে যুদ্ধ করে যাব।
রবিনের কথা শুনে হেসে ফেলল মতিন মাষ্টার ।সে বলল,রবিন আমরা মুক্তিযোদ্ধা আমরা ভীতু নই।আমাদের যুদ্ধ করতে করতেই মৃতু্য হবে।দেশেকে স্বাধীন করাই আমাদের কাজ।আর সব মুক্তিযোদ্ধা একরকম হবে না।তাই আমাকে তুমি অনুরোধ করো না রবিন।আমি আমার স্টাইলেই যুদ্ধ করে যাব।সবার সম্মুখে থেকে শত্রূকে নিধন করতে করতে ই আমিও একদিন নিশ্চুপ হয়ে যাব।কিন্তু আমার বাংলাদেশকে কখনো আর পরাধীন থাকতে দেব না।রক্ত দিয়ে আমার দেশের এই রক্তিম মানচিত্র কে পৃথিবীর বুকে চিরস্থায়ী করে যাব।
নেতার কথা শুনে এবার রবিন আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না।একজন মুক্তিযোদ্ধা কত বড় মাপের মানুষ হতে পারে তা সে বুঝে গেল।নিজের জীবন তার কাছে একেবারে তুচ্ছ নিজের দেশকে স্বাধীন করার জন্য সে অকাতরে বিলিয়ে দিতে পারে তার জীবন।মতিন মাষ্টারও তেমন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।যে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার তরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। জীবন চলে যাক কিন্তু বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে সদা প্রস্তুত সে।
পরদিন বিকেলবেলা পরে যাওয়া আলোতে তের জনের এক মুক্তিবাহিনীর দল মতিন মাষ্টারের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর ঘাটিতে সরাসরি আক্রমন করলো।যেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বহু সেনা অবস্থান করছিল।মতিন বাহিনী বেপরোয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দল তারা মৃতু্যকে ভয় পেত না।তাই তাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী শত্রূদল কে তারা আক্রমন করতে সাহস পেয়েছিল।
শত্রূদল প্রস্তুত ছিল না।তাই প্রথমবারেই অনেক পাকিস্তানিকে মেরে ফেলতে সক্ষম হলো মতিন বাহিনী। বরাবরের মতোই মতিন মাষ্টার সবার সম্মুখে থেকে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল।সে একটু একটু করে শত্রূ পক্ষের খুব কাছাকাছি চলে গেল।রবিন তাকে পিছন থেকে নিষেধ করলো।
সে বলল,ভাই আমরা এমনিতেই খুব নিকটে এসে গেছি।আপনি আর সামনে এগিয়ে যাবেন না।আর ওরা এখন নিশ্চুপ রয়েছে জানি না ভিতরে কি হচ্ছে।তাই আমার মনে হয় আমাদের আর সামনে এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।দেখি না ওরা ভিতরে থেকে কি করে।
মতিন মাষ্টার রবিনের কথা শুনে বলল,রবিন আমাকে বাঁধা দিও না।এ পুরো এলাকায় এই ঘাঁটিতে অবস্থান করা পাকিস্তান বাহিনী আর রাজাকার বাহিনী থেকে থেকে নির্যাতন করে যাচ্ছে সুতরাং ওদেরকে শেষ করলেই এ এলাকা স্বাধীন হয়ে যাবে। তাই আমি এ সুযোগ আর হাতছাড়া করতে চাই না।তোমরা কিছুতেই পিছু হঠো না আর আমার নির্দেশ ছাড়া কেউ যুদ্ধ থামাবে না। দেখছ না ওরা কেমন কোনঠাসা হয়ে পরেছে।নিশ্চয় ই ওদের গোলা বারুদ শেষ হয়ে গেছে আর যেহেতু ওরা প্রস্তুত ছিল না তাই আমার মনে হয় বেশির ভাগ শত্রূই মৃতু্যমুখে পতিত হয়েছে।
রবিন এবার জানতে চাইল,তাহলে আপনি কি করতে চান।
আমি ওদের ক্যাম্পের ভিতরে চলে যাব।আর তুমি বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চারিদিক দিয়ে একইভাবে যুদ্ধকে অব্যাহত রাখ।যদি ভিতরে কেউ জীবিত থাকে বা ওরা একটা গুলি চালায় তবে তোমরাও সেইদিকে গুলি চালাবে।আমি ওদেরকে পুরোপুরি শেষ করে দিতে চাই। একজনকেও জীবিত রাখতে চাই না।মতিন মাষ্টার বলল।
কিন্তু এতটা ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হবে।আপনাকে হারালে আমরা তো দিকহারা হয়ে যাব।রবিন বলল।
কেউ দিকহারা হবে না। আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ।আর মুক্তিযোদ্ধারা দিকভ্রষ্ট হয় না।কারণ তাদের সকলের একই চাহিদা দেশকে স্বাধীন করা।সুতরাং যদি বেঁচে না থাকি এ দলের দায়িত্ব তোমার ওপরে দিয়ে গেলাম দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমার হুকুম পালন করে যাবে।যেভাবে আমি সম্মুখে থেকে যুদ্ধ করেছি আর তোমাদেরকে পরিচালনা করেছি ঠিক সেভাবে দায়িত্ব পালন করে যাবে।কি পারবে না রবিন।আমি চললাম । এইটুকু বলে মতিন মাষ্টার হানাদার বাহিনীর সীমানার মাঝে প্রবেশ করলো।
রবিন পিছন থেকে তার কমান্ডারকে স্যালুট দিয়ে বলল,আমরা আপনাকে হারাতে চাই না।আপনার হুকুম সদা পালন করে যাব।আপনার মতো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সারাজীবন এই বাংলাদেশের বুকে দরকার।অথবা সারা পৃথিবীতে এই রকম দেশপ্রেমিক আজীবন প্রয়োজন।
রবিনের স্যালুটের শব্দ শুনতে পেল মতিন মাষ্টার কিন্তু পিছনে ফিরে দেখার সময় আর তার হাতে নেই সে এখন মনোস্থির করেছে সম্মুখে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের দিকে।
সে শত্রূ সীমানার মধ্যে ঢুকে পরলো।
সামনে যাকে পেল তাকেই গুলি করে মারতে লাগলো।একে একে বহু জনকে খুন করলো সে। তার চোখে এখন দেশের স্বাধীনতা অর্জন ই সবচেয়ে বড় কথা তাই রাজাকার হোক আর পাক বাহিনী যেই হোক কাউকেই সে বাঁচিয়ে রাখতে চাইল না। এইভাবে আধা ঘন্টা কেটে গেল।
এদিকে বাইরে তার বাহিনী তার হুকুম মতো অবস্থান নিয়ে মাঝে মাঝে গুলি ছুড়তে লাগল।আস্তে আস্তে যুদ্ধ চলতে লাগল।সহসা রবিন খেয়াল করলো ভিতরে আর গুলির শব্দ হচ্ছে না।আর ভিতর থেকে বাইরের দিকেও কেউ আর গুলি ছুড়ছে না।তবে কি হলো ভিতরে সবাই কি মরে গেল। নাকি তাদের কমান্ডার মরে গেল।কিছুই রবিনের মাথায় ঢুকছে না।সে ভাবতে লাগল কি করতে হবে এখন।কি নির্দেশ দেবে সে তার বাহিনীকে এখন।নাকি সবাই মিলে এখন ভিতরে চলে যাবে।দেখবে গিয়ে কি ঘটেছে ওখানে।
রবিনের ভাবনায় সহসা ছেদ টানল তাদের সেই গেরিলা পাগল মুক্তিযোদ্ধা এসে। সে এসে রবিনকে বলল,কমান্ডার তার সাহসী পদক্ষেপে সবগুলোকে প্রায় শেষ করে এনেছিল।কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি।কমান্ডার ওদের হাতে গ্রেফতার হয়েছে।সে তোমাদেরকে আপাততঃ পিছু হঠতে নির্দেশ দিয়েছে ইঙ্গিতে।আমি সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে খবরটা তোমাদের জানাতে এসেছি। আপাততঃ তোমরা তোমাদের বনের মাঝে গিয়েই আশ্রয় নাও।পরবর্তী খবর আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব।এখন যুদ্ধ করে লাভ হবে না তাহলে ওরা কমান্ডারকে মেরে ফেলবে।সুতরাং চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে এই সুযোগ নিয়ে তোমরা সবার অগোচরে কেটে পর।আমি তোমাদের সব খবর ঠিক সময়ে পৌঁছে দেব।
রবিন পাগলবেশী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার কথা মেনে নিল।সে তার কমান্ডারের হুকুম সবসময় পালন করবে এমন কথাই তাকে দিয়েছিল সুতরাং আপাততঃ তারা যুদ্ধ ছেড়ে নিজেদের আশ্রয়ে ফিরে এলো।
এদিকে পাক বাহিনীর দশজন আর রাজাকার বাহিনীর একজন নেতা জীবিত ছিল।তারা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিন মাষ্টারকে আটকে ফেলল। তারা ইচ্ছে করলে সাহসী এই মুক্তিযোদ্ধাকে মেরে ফেলতে পারতো।কিন্তু তারা তা না করে তাকে তারা নির্যাতন করার সিদ্ধান্ত নিল।
মতিন মাষ্টারকে রাতভর তারা নির্যাতন করলো।মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান তার কাছে তারা জানতে চাইল।কিন্তু সে কিছুতেই তার মুখ খুলল না।সে একবারই তার মুখ খুলল আর বলল,আমি তোদের একটাকেও ছেড়ে দেব না।একবার একটু সুযোগ পেলেই তোদের সব কয়টাকে শেষ করে দেব।
এ কথা শুনে পাক বাহিনীর অধিনায়ক রেগে গেল। সে বলল, ওকে এখনই শেষ করে দাও।
না না ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।ওর কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের অনেক খবর আমাদেরকে জানতে হবে।আরেক পাক বাহিনীর অফিসার বলে উঠল।
রাজাকার বাহিনীর নেতা বলল,ঠিক বলেছেন।আমরা ওকে মেরে ফেললে কোনো খবর জানতে পারবো না।ওকে বাঁচিয়ে রেখে ওর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানতে হবে।
ঠিক আছে। তোমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নাও কি করবে এখন।পাক বাহিনীর অধিনায়ক বাকিদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিল।
রাজাকার বাহিনীর প্রধান বলল,আমাদের আর এখানে থাকা ঠিক হবে না হুজুর।আমাদেরকে দ্রুত এ স্থান ছাড়তে হবে।কেননা আমরা মাত্র এগারো জন লোক রয়েছি এখানে তাই মুক্তিযোদ্ধারা যেকোনো সময়ে আক্রমন করে আমাদেরকে মেরে ফেলতে পারে।সুতরাং এই মুক্তিসেনাকে সাথে নিয়ে চলুন আমরা ভোর বেলাই এ ক্যাম্প ছেড়ে দেই।
ঠিক বলেছ আমাদের গোলাম।তোমাদের কথাই ঠিক।তোমরা রাজাকার বাহিনী ছিলে বলে ই আমরা পথ ঘাট ঠিক মতো চিনে মুক্তিবাহিনীকে শেষ করতে পারছি।আচ্ছা আমরা তাহলে ভোর হলেই এখান থেকে পাশের থানার ক্যাম্পের দিকে রওনা হবো।আচ্ছা এখন সবাই অস্ত্রগুলো ঠিকঠাক মতো যার যার মতো করে ঠিক করে নিয়ে নাও।পাক বাহিনীর অধিনায়ক সবাইকে নির্দেশ দিয়ে চুপ করলো।
এ খবর শুনে পাগলবেশী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা তখনই গোপনে পাক বাহিনীর ঘাঁটি ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পৌঁছে দেবার জন্য রওনা হয়ে গেল।
ভোরের আলো ফুটতেই একটা জিপে করে সবাই রওনা হলো পাশের পাক বাহিনীর ঘাঁটির উদ্দেশ্যে।আর তারা সাথে নিল বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিন মাষ্টারকে।তারা এ ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল কোনো অসুবিধা করলে তারা মতিন মাষ্টারকে পথেই খুন করে ফেলবে।
গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে। যদিও অতটা গতিতে চলতে পারছে না গাড়ি।কারণ গ্রামের পথ অতটা মসৃন নয়।এর মাঝে কারো দিকে আর কারো কোনো খেয়াল নেই।সবাই যেন মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে চুপসে আছে।কখন কোথা থেকে কে আক্রমন করে বসে সেই ভয়ে পাকবাহিনী নিশ্চুপ পথ চলতে লাগল।এই নিরবতা কাজে লাগাল চৌকষ মুক্তিযোদ্ধা মতিন মাষ্টার।
সে তার কাছে লুকিয়ে রাখা গোপন ছুঁড়ি দিয়ে অতি কষ্টে তার হাতের বাঁধন কেটে ফেলল।আর চোখ মেলে চারিদিকে তাকিয়ে সবাইকে মেরে ফেলার টার্গেট করে সুযোগ খুঁজতে লাগল। গাড়ি আস্তে আস্তে বড় রাস্তার ওপরে উঠল। এবার সে রাস্তাটা চিনতে পারল।এর একটু পরই একটা ব্রীজ রয়েছে তার কাছাকাছিই বনটা অবস্থিত যেখানে তার বাকি সঙ্গিরা রয়েছে সুতরাং এখান দিয়েই ওদের ওপরে আক্রমন করতে হবে।গুলির শব্দ শুনলে অবশ্যই মুক্তিবাহিনীরা তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।
ভাবনা অনুযায়ি কাজ করলো সে।পাশে বসে থাকা পাকবাহিনী সেনার হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাকে গুলি করে শেষ করে দিল সে।গুলির শব্দ শুনে গাড়ি থামিয়ে দিল চালক।মতিন লাফিয়ে পড়ে গাড়ি থেকে নিচে নেমে গেল।
টার্গেট করে এক একজনকে শেষ করতে লাগল সে।পাকবাহিনীও চুপ রইল না।তারাও পাল্টা গুলিতে মতিন মাষ্টারের বুকটা ঝাঝরা করে দিল।রক্তে তার শরীর লাল হয়ে গেল।কিন্তু সবাইকে শেষ না করা পর্যন্ত সে নিজেকে ধরে রাখল।তার দৃঢ়তার কাছে হার মানল পাকবাহিনী।সবাইকে ঠিকঠাক মতো টার্গেট করে সে গুলি দিয়ে খুন করে তবেই নিজের হাত কে থামাল।অল্প সময়েই জায়গাটা মৃ্তু্যপুরিতে পরিণত হলো।
এদিকে রবিনরা সবাই পাগলবেশী মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে খবরটা আগেই পেয়ে গিয়েছিল।তাই তারা সকাল থেকেই অপেক্ষা করছিল কখন গাড়িটা আসে।তাই তারা বড় রাস্তার নিচে তৈরি হয়েই ছিল।কিন্তু তারা বুঝে উঠতে পারছিল না তারা আক্রমন করবে কিনা,কারণ ঐ গাড়িতে তাদের কমান্ডার মতিন মাষ্টার রয়েছে।সুতরাং তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে চুপ করে অপেক্ষা করতে ছিল।আর যখন ই তারা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেল তখনই তারা দ্রুত বড় রাস্তার ওপরে উঠে এলো।কিন্তু তারা আসার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে গেল।
রক্তাক্ত মুক্তিযোদ্ধা মতিন মাষ্টারকে বুকে চেপে ধরলো রবিন।তখনও বেঁচে ছিল সে।রবিনকে দেখে সে বলল,আমি মনে খুব সুখ পেয়েছি কারণ ওদের সবগুলোকে আমি মেরে ফেলতে পেরেছি রবিন।এখন আমার আর কোনো দুঃখ নেই। এই অঞ্চলে আর কোনো রাজাকার বা পাকবাহিনী নেই।আমি আমাদের এই এলাকা মুক্ত করতে পেরেছি।আমার আর কোনো কষ্ট নেই।
এতটুকু বলে সে এবার তার মাথায় বেঁধে রাখা রক্তে ভেজা বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকাটা খুলে রবিনের হাতে দিয়ে বলল,আমি চললাম বাকি কাজ তোমরা শেষ করো।এ দেশকে স্বাধীন করে তবেই তোমরা শান্ত হইও।এ রক্তিম মানচিত্রকে আর কখনো অবহেলিত হতে দিও না।তোমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন হিসেবে আগামীর হাতে তুলে দিও।
রবিন শুধু বলল,আপনার নির্দেশ আমরা পালন করবো।জীবন দিয়ে হলেও আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ আগামী ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে তুলে দেব।
রবিনের কথা শুনে একটু হাসল বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিন মাষ্টার।তারপরে আর তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।সে নিথর হয়ে গেল।
চোখ মুছে রবিন উঠে দাঁড়াল।সবাইকে নিয়ে সে তাদের কমান্ডারকে স্যালুট করলো।তারপরে সবাই মিলে কাঁধে তুলে নিল মতিন মাষ্টারকে।
এবার দলের সবাইকে রবিন নির্দেশ দিল তাদের নেতাকে নিয়ে বনের মাঝে দাফন করার জন্য। আর তারপরে তারা রওনা হবে আরেক এলাকার উদ্দেশ্যে।যেখানে এখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি। সেখানে গিয়ে হানাদার পাক বাহিনী আর রাজাকার বাহিনী শেষ করবে তারা।তাদের নেতার নির্দেশ পালন করবে তারা। বাংলাদেশ স্বাধীন করে তবেই ক্ষান্ত হবে।
সকালের ফুটফুটে আলোতে কমান্ডারের লাশ কাঁধে নিয়ে ছুটে চলল একদল বীর মুক্তিযোদ্ধা। যাদের কামনায় রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের একটা স্বাধীন মানচিত্র।
কিন্তু ভাই আপনি বলতে পারেন আমরা আর কতোদিন এইভাবে রক্ত ঝরিয়ে যাব।প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল আমরা বিভিন্ন রনাঙ্গনে যুদ্ধ করে যাচ্ছি কিন্তু স্বাধীনতা আর কতদূর।আপনি বলতে পারেন আমরা আরো কতদিন এইভাবে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে যাব।রবিন এবার নিজের হতাশার কথা বলল।
মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে হয় রবিন। আমরা মুক্তিযোদ্ধা আমাদের হতাশ হলে চলবে না।পাকিস্তানিদের এ দেশ থেকে চিরতরে তাড়িয়ে দিয়ে তবেই আমাদের কাজ শেষ হবে।তুমি দিন দিন অস্থির হয়ে যাচ্ছ রবিন যা আমার কাছে ভালো লাগছে না।নিজেকে সামলে নাও। আমি যদি যুদ্ধে মারা যাই তবে কিন্তু এ দলকে তোমাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।সুতরাং এতটা অস্থির হলে চলবে না রবিন।নিজের মনের শক্তিকে আরো বাড়াতে হবে তোমার।যতদিন ই লাগুক আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব আর এ দেশকে স্বাধীন করে তবেই আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্থক হব।
আপনার মনের শক্তি দেখে আমিও বিস্মিত না হয়ে পারি না।তবে আপনার মতো একজন শক্তিশালী মনের মুক্তিযোদ্ধা ছিল বলেই কিন্তু আমরা প্রতিদিন পাকিস্তানি আর রাজাকার বাহিনীকে খুন করে ওদের রক্তে স্নান করতে পারছি।আমরা যোদ্ধারা আপনার মতো নেতৃত্বই চাই।যার মনে রয়েছে প্রচুর মানসিক শক্তি আর মগজে রয়েছে নতুন নতুন যুদ্ধের কৌশল।রবিন তার নেতা এবং সহযোদ্ধা মতিন মাষ্টারকে নেতা মেনে নিয়ে বলল।
কি যে বল রবিন আমরা মুক্তিযোদ্ধা।কেউ কারো নেতা নই।এই দেশকে এই সোনার বাংলাদেশকে স্বাধীন করাই আমাদের এখনকার সবচেয়ে বড় সময়ের প্রয়োজন।বুঝতে পেরেছ।মতিন মাষ্টার এবার রবিনকে নিজের পরিচয় আর তাদের কাজ কি সেটা বলে দিল।
রবিন আর কিছু বলল না।সে নিশ্চুপ মতিন মাষ্টারের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল।
দেশের বুকে যুদ্ধ চলছে,স্বাধীনতা যুদ্ধ।মতিন মাষ্টার আর রবিন দুজনেই মুক্তিযোদ্ধা। যারা দেশকে মুক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে নিজের জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরেছে।দুজনে একই গ্রামের লোক। একজন স্কুল শিক্ষক আর একজন চাকুরিজীবী।যারা দুজনে আজ একই পথের পথিক।দেশ মুক্ত করার কাজে তারা নিজেদের জীবনকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত।যুদ্ধের শুরুতেই তারা নিজেদের পরিবারের সকল আপনজনদের হারিয়েছে। রাজাকার বাহিনী রাতের আঁধারে তাদের গ্রামের ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল আর তখনই মুক্তিযোদ্ধা মতিন মাষ্টার আর রবিনের পরিবারের সবাই আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে।সেই দুঃখ বুকে নিয়েই তাদেরকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।তার ই এক ফাঁকে দুজন একত্র হওয়ায় নানাবিধ আলোচনা করে নিল।
স্বাধীনতা অর্জন ই মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ কথা।সবকিছু হারিয়েও তারা যেন কিছুই হারায়নি।শুধু স্বাধীনতা পেলেই তাদের সবকিছু পাওয়া হয়ে যাবে। তখন সব হারানোর কষ্ট তাদেরকে আর ছুঁয়ে যেতে পারবে না।
মতিন মাষ্টার চৌকষ মুক্তিযোদ্ধা।সে পনের জনের একটা দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে।তবে তার দলের দুজন একটা অপারেশনে শহীদ হয়েছে। আর একজন আহত হয়েছে।সে নিজেও একবার গুলিবিদ্ধ হয়েছিল।কিন্তু নিজের প্রবল মনের শক্তির কারণে সে আবার যুদ্ধের ময়দানে ফিরে এসেছে।
তারা কয়েকটা অপারেশন করে একটা গ্রামের বনের মাঝে অবস্থান নিয়েছে।আর সেখানে বসেই পাশের গ্রামের রাজাকার বাহিনীর একটা শক্তিশালী টিমকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে যাচ্ছিল।ঐ রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানী কিছু সেনাদের আশ্রয় দিয়ে এই এলাকার যুদ্ধ পরিচালনায় তাদেরকে সাহায্য করে যাচ্ছিল।
মতিন মাষ্টার তার যুদ্ধের পরিকল্পনা সবার কাছে খুলে বলল।
সবকিছু শুনে একজন মুক্তিযোদ্ধা একটু সংশয় প্রকাশ করে জানতে চাইল,সবই বুঝলাম মতিন ভাই কিন্তু একটা বিষয় বুঝলাম না।আর তা হলো আমরা ওদের ওপরে এখনো ঝাপিয়ে পরছি না কেন?
একটু সবুর কর।আমি সবাইকে বুঝিয়ে বলছি কেন আমরা তাড়াহুড়ো করছি না।মতিন মাষ্টার বলল।
বলেন তাইলে।মুক্তিযোদ্ধা রবিন তাগাদা দিয়ে বলল।
আমি গোপনে একজনকে পাগল সাজিয়ে ওদের ঐখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। ঠিকভাবে না জেনে আক্রমন করলে উল্টা আমরা সবাই মারা পরতে পারি।সুতরাং ওদের সঠিক অবস্থান জেনে ওরা কতজন রয়েছে,ওদের প্লান কি এগুলো জেনে তবেই আমরা ওদের ওপরে আক্রমন করবো। বুঝলে তোমরা সবাই।এবার নেতার মতো মতিন মাষ্টার সবাইকে বলল।
নেতার কথা শুনে এবার সবাই নিশ্চুপ রইল।
আরো দুইদিন অপেক্ষার পর মুক্তিযোদ্ধারা যে বনে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে দেখা মিলল এক পাগলের।তাকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে মতিন মাষ্টারের কাছে নিয়ে এলো।কমান্ডার মতিন তাকে দেখে চিনল।সে পাগলকে ছেড়ে দিতে বলল।
পাগলও মতিন মাষ্টারকে চিনতে পারল।
মতিন মাষ্টার তাকে একটু আড়ালে নিয়ে গেল।সঙ্গে রবিন ও চলল।তারা দুইজনে এবার পাগলবেশী সাহসী ঐ মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নিল।এবার তাকে বিদায় দিয়ে দিল তারা।
সে চলে যেতে রবিন মতিন মাষ্টারের কাছে জানতে চাইল,তাহলে আমাদেরকে দুপুরের পরে যেকোনো দিন ঐখানে আক্রমন করতে হবে তাই না।
ঠিক বলেছ তুমি।মতিন মাষ্টার বলল।
মতিন মাষ্টারের সম্মতি পেয়ে রবিন বলল, তাহলে আর দেরী কেন।আমরা আজকে রাতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে নেই।কালকে দুপুরের পর আমরা সবাই মিলে ওদের ওপরে আক্রমন করবো।আর পাকিস্তান বাহিনীসহ সমস্ত রাজাকারকে মেরে শেষ করে দেবো।ওরা আমাদের পরিবারের সবাইকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে।ওদের ক্ষমা নাই।
রবিনের কথা শুনে মতিন মাষ্টার বলল,ঠিক আছে আর দেরী করবো না।তোমরা সবাই প্রস্তুত হয়ে নাও।এবার কিন্তু আমরা সবচেয়ে বড় একটা শত্রূ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি।তাই আমাদেরকে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।আমরা মোট তের জন আর ওরা কিন্তু প্রায় একশো জন সুতরাং আমাদেরকে সবোর্চ্চ শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের গেরিলা পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে হবে।অতএব তোমরা সেইভাবে নিজেদেরকে তৈরি করে নাও।
আচ্ছা সেটা আমরা করবো তবে ভাই আপনার প্রতি আমার একটা অনুরোধ থাকবে।রবিন বলল।
কি সেটা? মতিন মাষ্টার জানতে চাইল।
এবার রবিন বলল,প্রতিবার দেখেছি আপনি বেপরোয়াভাবে সবার সামনে চলে যান আর ওদেরকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেন এটা খুবই সাহসী কাজ আমি স্বীকার করি কিন্তু ভাই এতে আপনার জীবনেরও তো বেশ ঝুঁকি রয়েছে।তাই আমার অনুরোধ আপনি আর এতটা অগ্রগামি হয়ে যুদ্ধ করবেন না।আমরা একসঙ্গে রনাঙ্গনে যুদ্ধ করে যাব।
রবিনের কথা শুনে হেসে ফেলল মতিন মাষ্টার ।সে বলল,রবিন আমরা মুক্তিযোদ্ধা আমরা ভীতু নই।আমাদের যুদ্ধ করতে করতেই মৃতু্য হবে।দেশেকে স্বাধীন করাই আমাদের কাজ।আর সব মুক্তিযোদ্ধা একরকম হবে না।তাই আমাকে তুমি অনুরোধ করো না রবিন।আমি আমার স্টাইলেই যুদ্ধ করে যাব।সবার সম্মুখে থেকে শত্রূকে নিধন করতে করতে ই আমিও একদিন নিশ্চুপ হয়ে যাব।কিন্তু আমার বাংলাদেশকে কখনো আর পরাধীন থাকতে দেব না।রক্ত দিয়ে আমার দেশের এই রক্তিম মানচিত্র কে পৃথিবীর বুকে চিরস্থায়ী করে যাব।
নেতার কথা শুনে এবার রবিন আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না।একজন মুক্তিযোদ্ধা কত বড় মাপের মানুষ হতে পারে তা সে বুঝে গেল।নিজের জীবন তার কাছে একেবারে তুচ্ছ নিজের দেশকে স্বাধীন করার জন্য সে অকাতরে বিলিয়ে দিতে পারে তার জীবন।মতিন মাষ্টারও তেমন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।যে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার তরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। জীবন চলে যাক কিন্তু বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে সদা প্রস্তুত সে।
পরদিন বিকেলবেলা পরে যাওয়া আলোতে তের জনের এক মুক্তিবাহিনীর দল মতিন মাষ্টারের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর ঘাটিতে সরাসরি আক্রমন করলো।যেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বহু সেনা অবস্থান করছিল।মতিন বাহিনী বেপরোয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দল তারা মৃতু্যকে ভয় পেত না।তাই তাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী শত্রূদল কে তারা আক্রমন করতে সাহস পেয়েছিল।
শত্রূদল প্রস্তুত ছিল না।তাই প্রথমবারেই অনেক পাকিস্তানিকে মেরে ফেলতে সক্ষম হলো মতিন বাহিনী। বরাবরের মতোই মতিন মাষ্টার সবার সম্মুখে থেকে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল।সে একটু একটু করে শত্রূ পক্ষের খুব কাছাকাছি চলে গেল।রবিন তাকে পিছন থেকে নিষেধ করলো।
সে বলল,ভাই আমরা এমনিতেই খুব নিকটে এসে গেছি।আপনি আর সামনে এগিয়ে যাবেন না।আর ওরা এখন নিশ্চুপ রয়েছে জানি না ভিতরে কি হচ্ছে।তাই আমার মনে হয় আমাদের আর সামনে এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।দেখি না ওরা ভিতরে থেকে কি করে।
মতিন মাষ্টার রবিনের কথা শুনে বলল,রবিন আমাকে বাঁধা দিও না।এ পুরো এলাকায় এই ঘাঁটিতে অবস্থান করা পাকিস্তান বাহিনী আর রাজাকার বাহিনী থেকে থেকে নির্যাতন করে যাচ্ছে সুতরাং ওদেরকে শেষ করলেই এ এলাকা স্বাধীন হয়ে যাবে। তাই আমি এ সুযোগ আর হাতছাড়া করতে চাই না।তোমরা কিছুতেই পিছু হঠো না আর আমার নির্দেশ ছাড়া কেউ যুদ্ধ থামাবে না। দেখছ না ওরা কেমন কোনঠাসা হয়ে পরেছে।নিশ্চয় ই ওদের গোলা বারুদ শেষ হয়ে গেছে আর যেহেতু ওরা প্রস্তুত ছিল না তাই আমার মনে হয় বেশির ভাগ শত্রূই মৃতু্যমুখে পতিত হয়েছে।
রবিন এবার জানতে চাইল,তাহলে আপনি কি করতে চান।
আমি ওদের ক্যাম্পের ভিতরে চলে যাব।আর তুমি বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চারিদিক দিয়ে একইভাবে যুদ্ধকে অব্যাহত রাখ।যদি ভিতরে কেউ জীবিত থাকে বা ওরা একটা গুলি চালায় তবে তোমরাও সেইদিকে গুলি চালাবে।আমি ওদেরকে পুরোপুরি শেষ করে দিতে চাই। একজনকেও জীবিত রাখতে চাই না।মতিন মাষ্টার বলল।
কিন্তু এতটা ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হবে।আপনাকে হারালে আমরা তো দিকহারা হয়ে যাব।রবিন বলল।
কেউ দিকহারা হবে না। আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ।আর মুক্তিযোদ্ধারা দিকভ্রষ্ট হয় না।কারণ তাদের সকলের একই চাহিদা দেশকে স্বাধীন করা।সুতরাং যদি বেঁচে না থাকি এ দলের দায়িত্ব তোমার ওপরে দিয়ে গেলাম দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমার হুকুম পালন করে যাবে।যেভাবে আমি সম্মুখে থেকে যুদ্ধ করেছি আর তোমাদেরকে পরিচালনা করেছি ঠিক সেভাবে দায়িত্ব পালন করে যাবে।কি পারবে না রবিন।আমি চললাম । এইটুকু বলে মতিন মাষ্টার হানাদার বাহিনীর সীমানার মাঝে প্রবেশ করলো।
রবিন পিছন থেকে তার কমান্ডারকে স্যালুট দিয়ে বলল,আমরা আপনাকে হারাতে চাই না।আপনার হুকুম সদা পালন করে যাব।আপনার মতো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সারাজীবন এই বাংলাদেশের বুকে দরকার।অথবা সারা পৃথিবীতে এই রকম দেশপ্রেমিক আজীবন প্রয়োজন।
রবিনের স্যালুটের শব্দ শুনতে পেল মতিন মাষ্টার কিন্তু পিছনে ফিরে দেখার সময় আর তার হাতে নেই সে এখন মনোস্থির করেছে সম্মুখে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের দিকে।
সে শত্রূ সীমানার মধ্যে ঢুকে পরলো।
সামনে যাকে পেল তাকেই গুলি করে মারতে লাগলো।একে একে বহু জনকে খুন করলো সে। তার চোখে এখন দেশের স্বাধীনতা অর্জন ই সবচেয়ে বড় কথা তাই রাজাকার হোক আর পাক বাহিনী যেই হোক কাউকেই সে বাঁচিয়ে রাখতে চাইল না। এইভাবে আধা ঘন্টা কেটে গেল।
এদিকে বাইরে তার বাহিনী তার হুকুম মতো অবস্থান নিয়ে মাঝে মাঝে গুলি ছুড়তে লাগল।আস্তে আস্তে যুদ্ধ চলতে লাগল।সহসা রবিন খেয়াল করলো ভিতরে আর গুলির শব্দ হচ্ছে না।আর ভিতর থেকে বাইরের দিকেও কেউ আর গুলি ছুড়ছে না।তবে কি হলো ভিতরে সবাই কি মরে গেল। নাকি তাদের কমান্ডার মরে গেল।কিছুই রবিনের মাথায় ঢুকছে না।সে ভাবতে লাগল কি করতে হবে এখন।কি নির্দেশ দেবে সে তার বাহিনীকে এখন।নাকি সবাই মিলে এখন ভিতরে চলে যাবে।দেখবে গিয়ে কি ঘটেছে ওখানে।
রবিনের ভাবনায় সহসা ছেদ টানল তাদের সেই গেরিলা পাগল মুক্তিযোদ্ধা এসে। সে এসে রবিনকে বলল,কমান্ডার তার সাহসী পদক্ষেপে সবগুলোকে প্রায় শেষ করে এনেছিল।কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি।কমান্ডার ওদের হাতে গ্রেফতার হয়েছে।সে তোমাদেরকে আপাততঃ পিছু হঠতে নির্দেশ দিয়েছে ইঙ্গিতে।আমি সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে খবরটা তোমাদের জানাতে এসেছি। আপাততঃ তোমরা তোমাদের বনের মাঝে গিয়েই আশ্রয় নাও।পরবর্তী খবর আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব।এখন যুদ্ধ করে লাভ হবে না তাহলে ওরা কমান্ডারকে মেরে ফেলবে।সুতরাং চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে এই সুযোগ নিয়ে তোমরা সবার অগোচরে কেটে পর।আমি তোমাদের সব খবর ঠিক সময়ে পৌঁছে দেব।
রবিন পাগলবেশী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার কথা মেনে নিল।সে তার কমান্ডারের হুকুম সবসময় পালন করবে এমন কথাই তাকে দিয়েছিল সুতরাং আপাততঃ তারা যুদ্ধ ছেড়ে নিজেদের আশ্রয়ে ফিরে এলো।
এদিকে পাক বাহিনীর দশজন আর রাজাকার বাহিনীর একজন নেতা জীবিত ছিল।তারা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিন মাষ্টারকে আটকে ফেলল। তারা ইচ্ছে করলে সাহসী এই মুক্তিযোদ্ধাকে মেরে ফেলতে পারতো।কিন্তু তারা তা না করে তাকে তারা নির্যাতন করার সিদ্ধান্ত নিল।
মতিন মাষ্টারকে রাতভর তারা নির্যাতন করলো।মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান তার কাছে তারা জানতে চাইল।কিন্তু সে কিছুতেই তার মুখ খুলল না।সে একবারই তার মুখ খুলল আর বলল,আমি তোদের একটাকেও ছেড়ে দেব না।একবার একটু সুযোগ পেলেই তোদের সব কয়টাকে শেষ করে দেব।
এ কথা শুনে পাক বাহিনীর অধিনায়ক রেগে গেল। সে বলল, ওকে এখনই শেষ করে দাও।
না না ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।ওর কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের অনেক খবর আমাদেরকে জানতে হবে।আরেক পাক বাহিনীর অফিসার বলে উঠল।
রাজাকার বাহিনীর নেতা বলল,ঠিক বলেছেন।আমরা ওকে মেরে ফেললে কোনো খবর জানতে পারবো না।ওকে বাঁচিয়ে রেখে ওর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানতে হবে।
ঠিক আছে। তোমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নাও কি করবে এখন।পাক বাহিনীর অধিনায়ক বাকিদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিল।
রাজাকার বাহিনীর প্রধান বলল,আমাদের আর এখানে থাকা ঠিক হবে না হুজুর।আমাদেরকে দ্রুত এ স্থান ছাড়তে হবে।কেননা আমরা মাত্র এগারো জন লোক রয়েছি এখানে তাই মুক্তিযোদ্ধারা যেকোনো সময়ে আক্রমন করে আমাদেরকে মেরে ফেলতে পারে।সুতরাং এই মুক্তিসেনাকে সাথে নিয়ে চলুন আমরা ভোর বেলাই এ ক্যাম্প ছেড়ে দেই।
ঠিক বলেছ আমাদের গোলাম।তোমাদের কথাই ঠিক।তোমরা রাজাকার বাহিনী ছিলে বলে ই আমরা পথ ঘাট ঠিক মতো চিনে মুক্তিবাহিনীকে শেষ করতে পারছি।আচ্ছা আমরা তাহলে ভোর হলেই এখান থেকে পাশের থানার ক্যাম্পের দিকে রওনা হবো।আচ্ছা এখন সবাই অস্ত্রগুলো ঠিকঠাক মতো যার যার মতো করে ঠিক করে নিয়ে নাও।পাক বাহিনীর অধিনায়ক সবাইকে নির্দেশ দিয়ে চুপ করলো।
এ খবর শুনে পাগলবেশী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা তখনই গোপনে পাক বাহিনীর ঘাঁটি ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পৌঁছে দেবার জন্য রওনা হয়ে গেল।
ভোরের আলো ফুটতেই একটা জিপে করে সবাই রওনা হলো পাশের পাক বাহিনীর ঘাঁটির উদ্দেশ্যে।আর তারা সাথে নিল বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিন মাষ্টারকে।তারা এ ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল কোনো অসুবিধা করলে তারা মতিন মাষ্টারকে পথেই খুন করে ফেলবে।
গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে। যদিও অতটা গতিতে চলতে পারছে না গাড়ি।কারণ গ্রামের পথ অতটা মসৃন নয়।এর মাঝে কারো দিকে আর কারো কোনো খেয়াল নেই।সবাই যেন মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে চুপসে আছে।কখন কোথা থেকে কে আক্রমন করে বসে সেই ভয়ে পাকবাহিনী নিশ্চুপ পথ চলতে লাগল।এই নিরবতা কাজে লাগাল চৌকষ মুক্তিযোদ্ধা মতিন মাষ্টার।
সে তার কাছে লুকিয়ে রাখা গোপন ছুঁড়ি দিয়ে অতি কষ্টে তার হাতের বাঁধন কেটে ফেলল।আর চোখ মেলে চারিদিকে তাকিয়ে সবাইকে মেরে ফেলার টার্গেট করে সুযোগ খুঁজতে লাগল। গাড়ি আস্তে আস্তে বড় রাস্তার ওপরে উঠল। এবার সে রাস্তাটা চিনতে পারল।এর একটু পরই একটা ব্রীজ রয়েছে তার কাছাকাছিই বনটা অবস্থিত যেখানে তার বাকি সঙ্গিরা রয়েছে সুতরাং এখান দিয়েই ওদের ওপরে আক্রমন করতে হবে।গুলির শব্দ শুনলে অবশ্যই মুক্তিবাহিনীরা তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।
ভাবনা অনুযায়ি কাজ করলো সে।পাশে বসে থাকা পাকবাহিনী সেনার হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাকে গুলি করে শেষ করে দিল সে।গুলির শব্দ শুনে গাড়ি থামিয়ে দিল চালক।মতিন লাফিয়ে পড়ে গাড়ি থেকে নিচে নেমে গেল।
টার্গেট করে এক একজনকে শেষ করতে লাগল সে।পাকবাহিনীও চুপ রইল না।তারাও পাল্টা গুলিতে মতিন মাষ্টারের বুকটা ঝাঝরা করে দিল।রক্তে তার শরীর লাল হয়ে গেল।কিন্তু সবাইকে শেষ না করা পর্যন্ত সে নিজেকে ধরে রাখল।তার দৃঢ়তার কাছে হার মানল পাকবাহিনী।সবাইকে ঠিকঠাক মতো টার্গেট করে সে গুলি দিয়ে খুন করে তবেই নিজের হাত কে থামাল।অল্প সময়েই জায়গাটা মৃ্তু্যপুরিতে পরিণত হলো।
এদিকে রবিনরা সবাই পাগলবেশী মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে খবরটা আগেই পেয়ে গিয়েছিল।তাই তারা সকাল থেকেই অপেক্ষা করছিল কখন গাড়িটা আসে।তাই তারা বড় রাস্তার নিচে তৈরি হয়েই ছিল।কিন্তু তারা বুঝে উঠতে পারছিল না তারা আক্রমন করবে কিনা,কারণ ঐ গাড়িতে তাদের কমান্ডার মতিন মাষ্টার রয়েছে।সুতরাং তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে চুপ করে অপেক্ষা করতে ছিল।আর যখন ই তারা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেল তখনই তারা দ্রুত বড় রাস্তার ওপরে উঠে এলো।কিন্তু তারা আসার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে গেল।
রক্তাক্ত মুক্তিযোদ্ধা মতিন মাষ্টারকে বুকে চেপে ধরলো রবিন।তখনও বেঁচে ছিল সে।রবিনকে দেখে সে বলল,আমি মনে খুব সুখ পেয়েছি কারণ ওদের সবগুলোকে আমি মেরে ফেলতে পেরেছি রবিন।এখন আমার আর কোনো দুঃখ নেই। এই অঞ্চলে আর কোনো রাজাকার বা পাকবাহিনী নেই।আমি আমাদের এই এলাকা মুক্ত করতে পেরেছি।আমার আর কোনো কষ্ট নেই।
এতটুকু বলে সে এবার তার মাথায় বেঁধে রাখা রক্তে ভেজা বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকাটা খুলে রবিনের হাতে দিয়ে বলল,আমি চললাম বাকি কাজ তোমরা শেষ করো।এ দেশকে স্বাধীন করে তবেই তোমরা শান্ত হইও।এ রক্তিম মানচিত্রকে আর কখনো অবহেলিত হতে দিও না।তোমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন হিসেবে আগামীর হাতে তুলে দিও।
রবিন শুধু বলল,আপনার নির্দেশ আমরা পালন করবো।জীবন দিয়ে হলেও আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ আগামী ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে তুলে দেব।
রবিনের কথা শুনে একটু হাসল বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিন মাষ্টার।তারপরে আর তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।সে নিথর হয়ে গেল।
চোখ মুছে রবিন উঠে দাঁড়াল।সবাইকে নিয়ে সে তাদের কমান্ডারকে স্যালুট করলো।তারপরে সবাই মিলে কাঁধে তুলে নিল মতিন মাষ্টারকে।
এবার দলের সবাইকে রবিন নির্দেশ দিল তাদের নেতাকে নিয়ে বনের মাঝে দাফন করার জন্য। আর তারপরে তারা রওনা হবে আরেক এলাকার উদ্দেশ্যে।যেখানে এখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি। সেখানে গিয়ে হানাদার পাক বাহিনী আর রাজাকার বাহিনী শেষ করবে তারা।তাদের নেতার নির্দেশ পালন করবে তারা। বাংলাদেশ স্বাধীন করে তবেই ক্ষান্ত হবে।
সকালের ফুটফুটে আলোতে কমান্ডারের লাশ কাঁধে নিয়ে ছুটে চলল একদল বীর মুক্তিযোদ্ধা। যাদের কামনায় রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের একটা স্বাধীন মানচিত্র।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ১৪/০৪/২০২২ভালো লেখা
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ২৭/০২/২০২১রক্তের বিনিময়ে কেনা স্বাধীনতা।
-
মশিউর ইসলাম (বিব্রত কবি) ২১/০২/২০২১অসাধারণ
-
ফয়জুল মহী ২০/০২/২০২১, ভাষা শহীদদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।