গরুগম্ভীর ইতিকথা
"ভাই, এবার আপনি গরু, নাকি ছাগল?" প্রতি বছরই কোরবানীর সময় এলে এই ধরনের রসালো কথাবার্তা আমাদের প্রত্যেককেই কমবেশি শুনতে হয়। শুধু কোরবানীই না, আমাদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও গরুর ভূমিকা অপরিসীম। গৃহপালিত কোন একটি প্রাণীর নাম বলতে গেলেই সবার আগে শিং বাগানো লেজ দুলানো মনোরম যেই প্রাণীটির কথা আমাদের মনে দোলা দিয়ে যায়, তা নিঃসন্দেহে এই গরু বেচারাই বটে। গরু দিয়ে হালচাষ তো বটেই, গরুর মাংস-চামড়া থেকে নিয়ে গোবর পর্যন্ত আমরা কতোই না কাজে লাগাই।
আর এ জন্যেই সেই ছোটবেলা থেকেই কেন জানি গরুর সাথে আমার একটা বেশ আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। আমাকে দেখলেই গরুরা বেশ উদ্বেলিত হয়ে উঠতো, এবং নিজস্ব পদ্ধতিতে শিং বাগিয়ে ভাবের আদান-প্রদান করতে চাইতো। আশেপাশে গরু দেখলেই তাই আমার পঞ্চ ইন্দ্রিয় পুরো সজাগ হয়ে যেতো, এবং বিগলিত গরুর হাতে বিড়ম্বিত হওয়া থেকে বরং মানে মানে এলাকা থেকে কেটে পড়ার পায়তারা কষাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচনা করতাম।
ঘটনা বরং শুরু থেকেই একটু খোলাসা করি।
আমার বয়স তখন পাঁচের আশেপাশে। সবেমাত্র আবিস্কার করেছি যে ম্যাচের বক্সে এঁটেল মাটি ভরে সাইজ করে রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়ালে ছোট ছোট বেশ সুন্দর ইট তৈরী হয়। অতএব আমরা তিন ভাই এবং আরও কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধুসহ পুরোদমে শুরু করে দিলাম আমাদের ইটভাটা প্রকল্প। যদিও আমার ছোট ভাইটা তখন অতিমাত্রায় ছোট ছিলো এসব মহান পরিকল্পনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহনের জন্যে, তবে আমাদের আশেপাশে থেকে বিভিন্নভাবে নর্তনকূর্দনের মাধ্যমে কাজে উৎসাহ দেয়ার প্রচেষ্টায় তার আন্তরিকতার কোন ঘাটতি ছিলো না। এবং এভাবেই মহা উদ্দমে চলতে লাগলো আমাদের ইট উৎপাদন। শুধু ইট তৈরী করেই ক্ষান্ত দিলাম না, সেই ইটের সাথে কাদামাটির সিমেন্টের প্রলেপে তৈরী হলো প্রায় কোমর সমান উঁচু দূর্গসদৃশ এক বিল্ডিং। সেই দূর্গে ছিলো নানারকম অত্যাধুনিক কারুকাজ। ছাদের উপরের এক খুপরী দিয়ে বালু ঢেলে দিলে তা আরও কয়েক খুপরী পার হয়ে ঝর্ণার মতো দূর্গের নিচর অংশ দিয়ে বের হয়ে আসতো। ছিলো আমাদের প্রত্যেকের মূল্যবান ধনরত্ন সংরক্ষণের জন্যে আলাদা আলাদা গোপন কুঠুরী। হিরে-পান্নার চেয়েও দামী আমাদের মার্বেলগুলোকে দূর্গের একেক ফোঁকরের মধ্যে ছেড়ে দিলে সেগুলো বিভিন্ন সুরঙ্গ অতিক্রম শেষে যার যার কুঠুরীতে গিয়ে জমা হতো। সেই কুঠুরীগুলোও আবার এমনই সুরক্ষিত যে এর থেকে ধনরত্ন বের করার জন্য অন্য আর কোনরকম ফাঁকফোকরই ছিলো না। একবার এর মাঝে মার্বেল ফেলা হয়েছে তো চোর দূরে থাক, মার্বেলের মালিকেরও সাধ্য ছিলো না দূর্গ আস্ত রেখে সেখান থেকে মার্বেলগুলো বের করে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু তাতে কি? গুপ্তধন নিরাপদে আছে এটাই তো সবচেয়ে বড় আনন্দের ব্যপার তার মালিকের কাছে।
এই দূর্গের পুরো নীলনকশাই ছিলো আমার বড় ভাইয়ের উর্বর মস্তিষ্ক নিঃসরিত, এবং তৈরীতেও মূল ভূমিকা ছিলো সেই সুমহান নায়কেরই। এবং অনেক অনেক দিন পরে একসময় আমরা এটাও আবিস্কারে সক্ষম হয়েছিলাম যে আমাদের প্রত্যেকের গোপন কুঠুরী থেকেই আরও গোপনে মার্বেল বের করে নেয়ার গোপন ব্যবস্থাও সে আমাদের অজান্তে এর মধ্যে করে রেখেছিলো।
যাই হোক, আমরা আমাদের গরু প্রসঙ্গ থেকে গড়াগড়ি করে ইতিমধ্যেই অনেকটা দূরে সরে এসেছি। এ যেন অনেকটা গরুর রচনা লিখতে গিয়ে গরু কোথায় ঘাস খায় সেই মাঠেরই গুনগান গাইতে থাকা। অতএব চলুন আমরা আবার লাইনে ফিরে আসি।
আমাদের ইটভাটায় ইট তৈরীর জন্যে কাঁচামাল হচ্ছে আঠালো এঁটেল মাটি। তাও আবার যেই সেই জায়গার মাটি হলেই হবে না। অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে বিচক্ষণ বড় ভাইয়ের নির্দেশ করা এক বিশেষ দূর্গম এলাকা থেকে সেই মাটি আনতে হতো। বাসার পিছনে রাস্তা দিয়ে কিছুদূর গেলে মাঠ, তার ওপাশে নিচু ধানক্ষেত, সেখানে জমে থাকা বোটঁকা গন্ধময় পানির মাঝখানে আইল দিয়ে সাবধানে ওপারে গেলে তবেই আমাদের মাটি কাটার জায়গা। তার ওপাশে বিশাল ফাঁকা মাঠ, আমার টেরিটরির বাইরের এলাকা।
তো সেদিনও আমি ডালিম নামের এক চালাক মস্তিষ্ককে সহকারী হিসাবে সাথে নিয়ে গেলাম মাটি সংগ্রহে। প্রখর রৌদ্রজ্জল ভরদুপুরের নিশ্চুপ শান্ত পরিবেশ। গাছের পাখিগুলোও পর্যন্ত খরতাপে বিরক্ত হয়ে ঝিমাচ্ছে। আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। না, ভুল বললাম। বেশ কিছুটা দূরে ছোট ছোট শিংওয়ালা তাগড়াই কাল একটা ষাড় বেশ ভদ্রভাবেই ঘাস খেয়ে যাচ্ছিলো। অতএব এমন শান্তিময় পরিবেশে আমরা বেশ মনের সুখেই মাটি সংগ্রহে মগ্ন হয়ে গেলাম। এবং একসময় মাটির দায়িত্ব ডালিমের হাতে দিয়ে আমি আরেকটু সামনে মাঠের ঘাসফুলের উপর ঘুরে বেড়ানো ছোট ছোট রঙ্গীন প্রজাপতিগুলো ধরার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি।
কিন্তু এমন সময় বেরসিকের মতো পিছন থেকে ডালিম ফাউ কান্না শুরু করে দিলো। পিছে তাকিয়ে দেখি সে মাঠের ঢালে গড়াগড়ি করে কান্নাকাটি করছে আর বলছে যে কে নাকি তাকে মারে। কান্নার জন্যে কথা তেমন একটা স্পষ্ট নয়। অবাক কান্ড! আশেপাশে তো মারার মতো কেউই নেই, শুধু ২০-৩০ হাত দূরের ঐ গরুটা ছাড়া! আর আমরা নাহয় মহৎ একটা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটু মাটি চুরি করলামই, সেইজন্যে আমাদের মারতে হবে? নির্ঘাত সবই এই ছেলের নেকামী। ক'দিন আগেও এমন হয়েছে। মাঠে খেলতে খেলতে হঠাৎ কান্না। কি হয়েছে? না, তার পায়ের নিচে নিরীহ একটা মৌমাছি কিভাবে যেন পড়ে গিয়েছিলো। তো নিরীহ হলে কি তার বাঁচার অধিকার নেই? সেই অধিকার রক্ষার্থেই সে মরার আগে ছোট্ট একটা হুল ফুটিয়েছিল তার পায়ে। এ নিয়ে যে এত্তো কান্নার কি আছে সেটাই আমি বুঝি না! আরে, মৌমাছি ধরতে গিয়ে সেই বয়সেই আমি নিজেও কি কম হুল খেয়েছি নাকি? এমনও তো হয়েছে যে মৌমাছি কামড় দেয়, নাকি হুল ফুটায় সেটা বুঝার জন্যে মৌমাছি মেরে তার হুল নিয়ে নিজেই নিজের হাতে ফুটিয়ে দেখেছি হাত ফুলে কিনা। এমনও ধারনা ছিলো যে একবার হুল ফুটালে সেই হুলে আর বিষ থাকে না, ফলে পরবর্তীতে একি হুল আবারো ফুটালে কোন কিছুই হয় না। যদিও বাস্তবে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছি যে একই হুল যতো বার হাতে ফুটাই ততোবারই হাত ফুলে যায়, ব্যথা করে।
যাক, আমি তাই ডালিমকে একটা ধমক দিয়ে কান্না থামিয়ে মাটি তুলতে বলে আবার নিজের কাজে মগ্ন হলাম। কিন্তু এই নাচ্ছাড় ছেলে যেন কিছুতেই আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না বলে ঠিক করেছে। একটু আগেই ধমক খেয়ে উঠে দাড়িয়েছিলো, এবার ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার কাছেই এসে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চোখমুখ প্রচন্ড লাল হয়ে আছে, আর কোনমতে বলার চেষ্টা করছে যে গরু নাকি তাকে গুতায়। অবাক হয়ে গরুর দিকে তাকালাম! সে তো আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরে উল্টোদিকে দৌড়ে যাচ্ছে। কি দীপ্ত কি তেজীই না তার সেই দৌড়ের ভঙ্গি! কিন্তু আমার মুগ্ধ চোখের সামনেই একসময় গরু থেমে ঘুরে দাড়ালো। তারপর মাথা নিচু করে খুর দিয়ে কিছুক্ষন মাটি ঠুকে চার্জ করে ছুটে এলো আমাদের দিকে। এবং হঠাতই যেন দিব্যজ্ঞানের মতো টের পেলাম যে গরু দূরে থাকলেও কিভাবে ডালিম তার গুতা খেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি যায়। এবার প্রচন্ড আতংকে ডালিমকে দৌড়াতে বলে আমি নিজেও উল্টোদিকে ছুট লাগালাম। এবং দৌড়াতে দৌড়াতেই পিছনে তাকিয়ে দেখলাম কিভাবে গরুর গুতায় ডালিম মাটিতে ডিগবাজি খেলো। প্রতিবার চার্জ শেষে গরু উল্টোদিকে কিছুদূর দৌড়ে নতুন প্রস্ততি নিয়ে আবার ফিরে আসে, আর প্রতিবার গরু উল্টোদিকে ঘুরলেই আমি দৌড়ে গিয়ে ডালিমকে তুলে আবারও ছুট লাগাই। এবং এভাবেই একসময় এহেন মূর্তিমান আতঙ্ক থেকে কিভাবে যেন নিরাপদ দুরত্বে চলে আসতে পারলাম। কিন্তু নিজেকে আবিস্কার করলাম আমার চেনাজানা টেরিটরির বাইরে পুরো অপরিচিত এক এলাকায়। তারপরে কিছুক্ষণ ডালিমের ব্যথার কান্না, আর কিছুক্ষণ "আমরা আর কখনো বাসায় ফিরতে পারবো না"-র কান্না সামলে কিভাবে পথ চিনে বাসায় ফিরলাম, সেটাও অনেকটা যেন স্বপ্নেরই মতো ছিলো।
অতএব এর পরে যদি কখনও আশেপাশে আমি গরু দেখি, এবং তার মুখে নিরাপদ বন্ধুসুলভ সদ্ভাবাপন্ন হাসি দেখেও ছিটকে দূরে পালানোর চিন্তা করি, তাহলে আমাকে নিশ্চয় আপনারা কেউ দোষ দিতে পারবেন না। বলতে কি, পরবর্তী বেশ কয়েক বছর আমার সেভাবেই কাটলো। ততোদিনে জায়গা পরিবর্তন হয়েছে, আমিও বেশ অনেকটা বড় এবং দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছি। এবং একসময় এটাও বুঝতে শিখেছি যে গরু মাত্রেই গোয়ার না, যদিও সবজায়গাতেই কিছু গোয়ারগোবিন্দ মর্কট থাকেই। এদের বাদ দিলে বাকী বেশিরভাগ গরুই নিরীহ গোবেচারা প্রাণী। তবে কাছে ঘেষতে দেয়ার আগে তাদের চোখ ও মুখের হাসি হাসি ভাব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝে নিতে হয় যে এই বিশেষ অস্তিত্ত্বটি ঠিক কোন গোত্রে পড়ে।
বেশ অনেকদিন পরের কথা। আমি তখন ক্লাস টু কি থ্রি-তে পড়ি। বাসার কাছেই এক মুদির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে লজেন্স বা তেমন কিছু একটা কেনার পায়তারা করছি। এমন সময় তাকিয়ে দেখি রাস্তা দিয়ে একপাল গরু বেশ নাদুসনুদুসভাবে হেলেদুলে এদিকেই আসছে। এদের দলপতিটি যেমন লম্বাচওড়া, তেমনই চোখা লম্বা লম্বা শিং। বেশ রাজকীয় ভাব তার, হাটার ভঙ্গিতে পর্যন্ত যেন তার ব্যক্তিত্ব এবং মর্যাদা উপচে পড়ছে। তাই সচেতনভাবে পর্যবেক্ষন শেষে তার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েই যেন সিদ্ধান্ত নিলাম যে এই গরু কোনমতেই দায়িত্বজ্ঞানহীন উগ্র কেউ হতে পারে না। তাই একে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। বরং সে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার মর্যাদাকে সম্মান দেখানোর জন্যেই আমি আমার সবচেয়ে সুন্দর বিনয়ী হাসিটা তাকে উপহার দিলাম। কিন্তু হাসি বন্ধ হবার আগেই ঠক করে কি যেন একটা এসে আমার দাঁতে বাড়ি লাগলো। এবং ব্যপারটা কি হলো টের পেতে পেতেই দেখি যে গরুরাজ আমার মাথার সামনে থেকে তার শিং সরিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করে গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে আবার আগের মতোই গদাইলস্করী চালে হাটতে লাগলো নিজ গন্তব্যে। এ যেন গরুজাতির প্রতি আমার সম্মানকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যই করা হলো। তবে এর দুঃখটা ঠিকমতো অনুভব করতে পারার আগেই আশেপাশের সব লোক এসে আমাকে ঘিরে দাড়ালো। অনেকটা তাদের আগ্রহেই ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করতে গিয়ে দেখি যে গুতা খেয়ে আমার সামনের একটা দাঁত বেশ ভালভাবেই নড়ে গেছে। ভাগ্যিস তখন আমার বয়সটাই ছিলো দাঁত পড়ার বয়স। কিছুদিনের মধ্যেই তাই শুধু ঐ দাঁতই না, অন্য আরও অনেক দাঁতই পড়ে আবার নতুন করে গজিয়েছিলো।
তো এই হলো অবস্থা। আমি বুঝতে পারলাম যে আমার হিসাব দিয়ে গরুজাতি তাদের নিজেদের হিসাব করে না। করলে অবশ্য তাদের সম্মানই বৃদ্ধি পেতো। কিন্তু তারা যেন মানবপ্রদত্ত সম্মানকে তুচ্ছজ্ঞান করবে বলেই প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে। কি আর করা, আমিও তাই যাবতীয় হিসাব নির্বিশেষে গরুজাতির সকলের কাছ থেকেই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলা শুরু করলাম।
আরও বছরখানেক পরের কথা। স্কুল শেষে বাজার থেকে হালকা কিছু বাজার করে একদিন আমরা দুই ভাই বাসার উদ্দেশ্যে হাটছি। আমার বড় ভাই অবশ্য এমন অনাকাংক্ষিতভাবে হাটতে বাধ্য হওয়ায় আমার উপরে মহা বিরক্ত। বাজারের টাকা বাঁচিয়ে তার সাথে রিকশাভাড়া যোগ করে আমি কেন অনর্থক ছোট একটা তাল কিনতে গেলাম, সেটাই তার রাগের মূল কারণ। অতএব বড় ভাই হিসাবে বাজারের ব্যগ তাকেই হাতে বহন করতে হলেও তালটা কোনমতেই তার হাতে গছাতে পারলাম না। ইতিমধ্যে বাসার প্রায় কাছাকাছি পৌছে গেছি। এমন সময় হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি এক রাখাল এক গরু নিয়ে এদিকেই হেটে আসছে। ব্যস, আর যায় কোথায়! ডানে বামে না দেখেই ভাইয়ের নিষেধ অমান্য করে আমি জোর হাটা দিলাম রাস্তা ক্রস করে উলটাপাশে যাওয়ার জন্যে। ভাগ্যিস ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তখন এখনকার মতো এতো গাড়িঘোড়ার ভীড় ছিলো না। তারপরেও কিছু বুঝার আগেই টের পেলাম পায়ে যেন কিসের সাথে প্রচন্ড বাড়ি খেলাম, এবং পর মূহুর্তেই শুন্যে দশহাত উপরে ডিগবাজী খেয়ে পাশের এক সাইডরোডে ধপ্পাস করে আছড়ে পড়লাম। অবশ শরীরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম যে হাত থেকে তালটা ছিটকে রাস্তার পাশ দিয়ে গড়িয়ে নিচে নর্দমার দিকে নেমে যাচ্ছে। এতো সখের একটা তাল, সেটা এভাবে নর্দমায় পড়ে যাচ্ছে, এই দুঃখটাই বুকের ভিতর বাজতে লাগলো প্রচন্ডভাবে। কিন্তু না, গড়াতে গড়াতে মাঝপথেই তালটা থেমে গেলো। ইতিমধ্যে আমাকে আঘাত করা হোন্ডাটাও থেমে দাঁড়িয়েছে। আমি হাত-পা ঝেড়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে কোনমতে তালটা নিয়ে রাস্তায় ফিরে আসলাম। হোন্ডার আরোহী তো প্রচন্ডভাবে আমাকে এক বকা দিলো, যে এই বয়সেই এভাবে আমি মরতে চাই নাকি। কিন্তু তার কথার কি জবাব দেবো? আরোহীর পিছনে প্রায় আমার সমান বয়েসী ফ্রকপড়া এক মেয়ে বসে চোখ বড় বড় করে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। একটা মেয়ের সামনে আমার এমন লজ্জাস্কর একটা ঘটনা ঘটলো, অনেকটা সেই লজ্জাতেই যেন আমি নির্বাক হয়ে রইলাম। আমার বড় ভাইও নির্বাক হয়ে আমার দিয়ে তাকিয়ে আছে। আর হা করে আমার পা দেখছে। যাই হোক বাসায় ফেরার পথে ভাইকে বললাম যে বাসায় যেন এই ঘটনা কাউকে না বলে ও। তখনও টের পাইনি আশেপাশের সব লোকই কেন আমার পায়ের দিকে এমন হা করে তাকাচ্ছে।
বাসায় ঢুকেই সোজা দৌড় দিলাম বাথরুমের দিকে। যতো জলদি শরীরের ময়লয়া ধুয়ে সাফ করে ভদ্রবেশ ধারণ করা যায়, ততোই নিরাপদ আমি। কিন্তু তার আগেই আম্মার চিৎকার শুরু হয়ে গেলো যে মেঝেতে এত্তো রক্ত কেন, কার কি হয়েছে। এবং আমি ধরা পরে গেলাম। তখন পর্যন্ত অবশ্য সুস্থই ছিলাম বলা যায়। আম্মা কি দেখে এত্ত প্রলাপ-বিলাপ শুরু করেছে তা বুঝার জন্যে আমার পায়ের দিকে ভালমতো তাকিয়েই শেষে চরম ধাক্কাটা খেলাম। এক পায়ের হাটুর মাঝে বড় একটা গর্ত হয়ে আছে, আরেক পায়ের গোছার অনেকটা জুরে কোন চামড়া-মাংস নেই!
অতঃপর আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি, এবং স্কুল ফেলে পরবর্তী বেশ কয়েক সপ্তাহ আরামেই ঘরে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়া। এজন্যেই মনে হয় বলে যে প্রত্যেক খারাপ ঘটনারও কিছু ভাল দিক থাকে। কারন এভাবে স্কুল ফাঁকি দিতে পেরে সেই মূহুর্তে এক্সিডেন্টের প্রতি আমি বরং বেশ কিছুটা কৃতজ্ঞই ছিলাম বলা যায়। আর কিছুটা কৃতজ্ঞতা বোধ হয় গরু জাতির প্রতিও এসে গিয়েছিলো।
(লেখাটি ইতিপূর্বে বকলম সহ অন্যান্য ব্লগে পোস্ট করা হয়েছে।)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
খায়রুল আহসান ৩০/০৭/২০১৭
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ০২/১১/২০১৪পড়তে পড়তে টায়ার্ড.....
-
স্বাতী বিশ্বাস ২৫/০৯/২০১৩খুব ভাল লাগল। এই ম্যাচ বাক্স দিয়ে আমরাও অনেক কিছু বানিয়েছি। এত ভাল লিখেছেন যে পড়তে পড়তে সব কিছু চোখের সামনে ফুটে উঠছে।
-
সুবীর কাস্মীর পেরেরা ২৪/০৯/২০১৩খুব খুব ভাল লেগেছে পল্লব ভাই
-
Înšigniã Āvî ২৪/০৯/২০১৩
খুব ভাল বুদ্ধির তারিফ করতেই হয় । -
নাজমুন নাহার ২৪/০৯/২০১৩বেশ ভালো বুদ্ধি তো ।ম্যাচের বাক্সের ভেতর মাটি দিয়ে ইট বানানো ।ইস ছেলেবেলেটা হারিয়ে গেল । নইলে একটা ট্রাই করা যেতো আবার !
চমৎকার এসব অভিজ্ঞতার কাহিনী নিয়েই আমাদের জীবন সমৃ্দ্ধ।